শূন্যকুঞ্জ শ্যামচন্দ্র নাহি রে… এক অন্য গাঁথা : বৈশাখী নার্গিস

বৈশাখী নার্গিস

সখী হে, আজ যাইব মোহি…ঘর গুরুজন ডর না মানব, বচন চুকাব নাহি। কিন্তু যাবটা কোথায়। চোখ বন্ধ করে ডুবে ছিলাম এক অন্য জগতে। রাত নেমে গেছে বোধহয় এতক্ষণে। হ্যাঁ রাত, আমার সব কিছুর আশ্রয় রাত। এখানেই কাঁদতে পারি আমি মন খুলে, কথা বলতে পারি নিজের সঙ্গে, স্বপ্ন দেখতে পারি অবিরাম। বৃষ্টির ভেতর গান গাইতেও আমার তখন দ্বিধা হয় না। হুম আজ আমার অবস্থা ঠিক তার মতো। মানে রাধিকার মতো। আর তাই বলতে ইচ্ছে করছে—‘চন্দন আনি— আনি অঙ্গ লেপব, ভূষণ কে গজমোতি… অঞ্জন বিহুন লোচন-যুগল ধরত ধবল জ্যোতি… ধবন বসনে তনু ঝাপাওব গমন করব মন্দা’… কিন্তু আবারো সেই এক চিন্তা যাব কোথায়।

সে যে কোথায়, সে যে কোথায়… জানি না। মন খারাপের মেঘ আকাশে। রেশমি শাড়ি, পশমিনা শালে নিজেকে জড়িয়ে খুব ইচ্ছে করছে রাতের মায়ায় গা ভাসিয়ে দিতে। সখী হে, কি পুছসি অনুভব মোহে। আমি ডুবে আছি সেই তার ভাবনায়। সেই যে সে। যার জন্যে বলতে ইচ্ছে করছে— সে পিরিতি অনুরাগ বখানি। তিল-তিল নূতন হোএ’। আহ! তার জন্যে তো সবসময় নতুন হতে ইচ্ছে করে। সে প্রেম, সেই প্রেমিক রোজ নতুন হয়ে ওঠে আমার কাছেও। সেই রূপ একজন্মের নয় জানি। হয়ত অন্য কোনো এক জন্মের কথা। সে আর আমি…কোনও এক পাহাড়ি উপত্যকায় হাতে হাত … এক তারা ভরা রাত। দূরে কোথাও গান বাজছিল…কিন্তু সেই জন্ম কি আদৌ অনুরাগ মেশানো প্রেমে ভরে ছিল। আর সে কি আমায় ভুলে যেতে যেতে আবার নতুন করে আসবে আমার সামনে। ‘জনম অবধি হম রূপ নিহারল
নযন ন তিরপিত ভেল’। যে আমার চোখে চোখ রেখে একদিন বলবে… স্বপ্ন।

যার কথা শুনে আমি ভেবে নেবো সমুদ্রের ডাক। কিন্তু কই সে? ‘সেহো মধুর বোল স্রবন সূনল। স্রুতি পথ পরস ন গেল’। কিন্তু সে তো বোঝেই না …কথা। কত দিন চলে গেলো, কত রাত… ‘কত মধু-জামিনি রভস গমাওলি
ন বুঝল কইসন কেল’। এত এত গুলো দিন, মাস, বছর…লাখ লাখ যুগ… ‘লাখ লাখ জুগ হিঅ হিঅ রাখল, তইযো হিঅ রজনি গেল’। তবু সে এলো না। না এলো না। সহসা এলেই বা। কি ক্ষতি। উহু লাখেও একজন তার মতো হতে পারে কই। কতই বা এলো গেল। নাহ, তার মতো তো বলে না কেউ, হাসে না কেউ, ভালোবাসেও না। বিদ্যাপতি ঠিক বলেছেন… ‘কহ প্রাণ জুড়াইতে… লাখে মিলল ন এক।

একাই একাই তাই গান করি…আর ভাবি…বহু মনোরথে সাচো অভিসারে পেহলু সুনিল বেশ…কজরা নয়ানে সগাজে বয়ানে কুসুমে সাজানো কেশ…সখী হাম মোহন অভিসারি জাউ…বোলো হাম এতত সুখ কাহা পাউ।

 

এক দিকভ্রান্ত সকালে ঘুম ভাঙলে মনের ভেতর কেউ বলে উঠল, শুনে রাখো বালিকা, কিছু কুসুম ফুল তুলে রাখো আজ সকাল সকাল। মনের ভেতর এক বিরহ বেদনা মোচড় দিয়ে উঠল। তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে। এলো চুলে বাগানে এসে দাঁড়ালাম। মন উচাটন, কোথায় যে হারিয়েছে কেউ জানে না। সেই ফুল তুলে এনে মালা গাঁথতে বসে পড়লেও, শ্যাম কই। কই শ্যাম। কেউ বলছে তখনও, ‘কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহি রে…’

কোথায় কোথায় না খুঁজে ফিরছি… যেন সে ফুলের মধ্যেও নিজের সুগনশ ছড়িয়ে রাখে। ভ্রমরের গানে কি এক নেশা। দিক ভুলে যাওয়া আমার ভেতর শূন্যতা তাঁকে ছাড়া। কই শ্যাম… কোথায় আছো লুকিয়ে।

‘দুলই কুসুমমুঞ্জরী, ভমর ফিরই গুঞ্জরী,’

এদিকে অলস নদী বয়ে চলেছে। সময় যে কিছুতেই কাটে না। কাটে না দুপুরের তপ্ত প্রহর।

‘অলস যমুনা বহয়ি যায় ললিত গীত গাহি রে।’

দিক ভুলে যাওয়া এক মন নিয়ে গুছিয়ে রাখি তুলে আনা ফুল… ফেলে রাখি কাজ। এমন উচাটন মন নিয়ে কি যে করি। মনের ভেতর কুহু স্বরে কোকিল ক্রমে ডেকেই চলেছে। ফুলের মালা যেন এখন ভার লাগছে। হৃদয়ে আগুনের তপ্ত এক স্রোত বয়ে চলেছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ।

‘শশিসনাথ যামিনী, বিরহবিধুর কামিনী,’ … কুসুমহার ভইল ভার হৃদয় তার দাহিছে।… অধর উঠই কাঁপিয়া… সখিকরে কর আপিয়া… কুঞ্জভবনে পাপিয়া কাহে গীত গাহিছে।

আনমনে মেঘের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কখন চোখে ঘুম চলে এসেছিল। মৃদু হাওয়ায় কুঞ্জবন চঞ্চল। মনের অস্থির ঘরে স্থির চিত্র তাঁর। হঠাৎ পায়ের আওয়াজে চমকে চেয়ে দেখি বিকেলের ছায়ার দিকে। চেনা গন্ধে মাতাল হয়ে ওঠে মন। ‘মৃদু সমীর সঞ্চলে… হরয়ি শিথিল অঞ্চলে,… চকিত হৃদয় চঞ্চলে কাননপথ চাহি রে।’

ছায়ার ভেতর এক পিটুস পাখির আলতো চলাচল মনের দরজায় আঘাত করছে। বাতাসে ফাগুনের হু হু করা সময়। চোখের কাজলে লেপ্টে ওঠে নোনাজল… কোথায় শ্যাম … কোথায়… শূন্য কুঞ্জ অপেক্ষার নীল রঙে মিশে… ‘ কুঞ্জপানে হেরিয়া, অশ্রুবারি ডারিয়া… ভানু গায় শূন্যকুঞ্জ শ্যামচন্দ্র নাহি রে!’

শোনো হে প্রিয় আজ কিছুতেই যেন মন বসছে না কাজে। যেন কোথায়… কতদূর ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে বারবার। ঘুমচোখে পাশ ফিরে চাই তাঁর চোখে স্বপ্ন স্বপ্ন চাহনি। ওই যে স্বপ্নে দেখা সেই জায়গার মতো…

শুনহ শুনহ বালিকা,

রাখ কুসুমমালিকা,

কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহি রে।

শুধু ইচ্ছে হয়… তাঁকে এলোমেলো করে দিই। তাঁকে বয়ে নিয়ে যাই নদীর স্রোতের মতো। সেই চিলেকোঠায় দেখা এক অন্ধকার আকাশে আমার রাতজাগা তারা। সে যে বড়োই প্রিয়… বড়ো আপনার জন।

দুলই কুসুমমুঞ্জরী,

ভমর ফিরই গুঞ্জরী,

অলস যমুনা বহয়ি যায় ললিত গীত গাহি রে।

যেন চারদিকে কি সব বাজছে… চারদিকে কথা বলে উঠছে ফুলের দল। এদিকে আমিও হারাই… হারাই। আমার পায়ের নূপুরে ফুটে ওঠে এক উচ্ছল নদীর গান। তবু এক কথা ভাবি বার বার। সে কি আমায়… ভুলে ভুলে থাকে… সে কি আমায় দূরে দূরে রাখতে চায়।

শশিনাথ যামিনী,

বিরহবিধুর কামিনী,

কুসুমহার ভইল ভার হৃদয় তার দাহিছে।

সন্ধে নেমে আসে, আমি কান্না লুকোই। ওর দিকে চেয়ে ইচ্ছে হয় বলি… একবার কি! নাহয় থাক। আমি চোখ নামিয়ে ফেলি।

অধর উঠই কাঁপিয়া

সখিকরে কর আপিয়া,

কুঞ্জভবনে পাপিয়া কাহে গীত গাহিছে।

হয়ত বোঝে না সে… অথবা চায় না বুঝতে… ফুলের উপত্যকায় জোনাকি নেমে আসে, রাতের আকাশে কত তারা। হালকা বাতাসে কেমন এক মিষ্টি গন্ধ। জামার পকেটে গুচ্ছ স্বপ্নের রঙ ভরে রাখি।

মৃদু সমীর সঞ্চলে

হরয়ি শিথিল অঞ্চলে,

চকিত হৃদয় চঞ্চলে কাননপথ চাহি রে।

তবু অপেক্ষায় থাকি… তবু শহরের পথ চেয়ে আমি স্থির হয়ে যাই। শিশির ছুঁয়ে থাকে উড়ো চুল। আমি হাত বাড়াই তাঁর দিকে। সে হেসে ওঠে আলতো।

কুঞ্জপানে হেরিয়া,

অশ্রুবারি ডারিয়া

ভানু গায় শূন্যকুঞ্জ শ্যামচন্দ্র নাহি রে!

কি জানি কেন নোনা জলে ভরে ওঠে চোখ… কি জানি কেন আগলে রাখি তাঁকে। কি জানি কেন শহর জুড়ে জোনাক ওঠে জ্বলে।

 

বৈশাখী নার্গিস

জন্ম ২৫ মার্চ ১৯৯৩। বসবাস কলকাতা। পড়াশুনো সংস্কৃত-এ মাস্টার্স। বর্তমানে লেখালিখি এবং সম্পাদনার কাজে যুক্ত। লেখার সঙ্গে যুক্ত ২০০৯ সাল থেকে। 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top