লুৎফুল হোসেন: নিষ্ঠ কলম, নিপাট-নান্দনিক সম্পাদনা ও সাহসে উচ্চকিত একজন আবুল হাসনাত

[পঞ্চাশের দশক থেকে এ পর্যন্ত যে কয়েকজন সাহিত্য সম্পাদকের হাতে বাংলাদেশের সাহিত্য ও নামীদামী সাহিত্যিক গড়ে উঠেছে তাঁদের  মধ্যে কবি আহসান হাবীব (মিল্লাত, ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান/বাংলা) হাসান হাফিজুর রহমান (একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন), সিকান্দার আবু জাফর (মাসিক সমকাল) ও আবুল হাসনাত (সংবাদ, গণসাহিত্য, প্রোণোদনা, কালি ও কলম)। এঁদের প্রত্যেকের ছিল সাহিত্য সম্পাদনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠা, সাবধানী ও নৈর্ব্যক্তিক নির্বাচন, প্রতিভাবান নতুন লেখকদের মর্যাদা প্রদান, মনোযোগী সম্পাদনা এবং মুদ্রণ পরিপাট্য বজায় রাখার ক্ষমতা। কেউ কেউ বিশেষত হাসান হাফিজুর রহমান ও সিকান্দার আবু জাফর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে বাংলা সাহিত্য আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার করেছিলেন। কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক আবুল হাসনাত  ১ নভেম্বর ২০২০ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। গতকাল ছিল তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাহিত্য ক্যাফে প্রকাশ করছে কবি, প্রকাশক ও সাহিত্যকর্মী লুৎফুল হোসেন-এর এই লেখাটি। – সম্পাদক, সাহিত্য ক্যাফে]

 

পুরনো ঢাকার উয়ারী বনগ্রাম। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করা পরিবারে জন্ম নিলো যে সন্তান, আশৈশব যারপরনাই কড়া শাসনে তার মেধা-মননের বিকাশ তো দূর, আত্মবিশ্বাসে চিড়ই অবিস্যম্ভাবী। স্কুলের নিচের ক্লাসগুলোতে যা-ও-বা উৎরে যাওয়া যাচ্ছিল, উপরের ক্লাসে উঠতে উঠতে পাশ করাটাই আটকে গেল। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে অন্তর্মুখী হয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেটাকে ক্লাস টপকাবার পথ খুঁজতে পালটে দেয়া হলো স্কুল। নবাবপুর স্কুল থেকে টিপু সুলতান রোডের গ্র‍্যাজুয়েট স্কুলে ভর্তি করা হলো তাকে। ক্লাস এইটে নতুন স্কুলের নতুন ক্লাসে এসে আরও নিঃসঙ্গ, আরও অন্তর্মুখী হয়ে উঠলো ছেলেটা।

অতি কড়া শাসন, দারিদ্র্য, পরীক্ষা পাশ দেয়ার মতো মেধাবী নয়, নিঃসঙ্গ, আত্মবিশ্বাসহীন একটা সাধারণ ছেলে গড্ডালিকার ভিড়ে হারিয়ে যাবে এমনটাই স্বাভাবিক। ছেলেটার অপার সৌভাগ্য ছিল শুধু মাতৃস্নেহের। অপত্য স্নেহে মা তার সব সন্তানকে যেভাবে আগলে রাখতেন, সেই স্নেহ-ভালোবাসার কমতি ছিল না তার ক্ষেত্রেও।

১৭ জুলাই ১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া ওইটুকুন অপ্রাপ্তি সম্বল কিশোর ছেলেটাই মধ্য কুড়িতে হয়ে গেলো বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। কোথাও কিছু একটা না থাকলে তো আর এমনি এমনি এমনটা হয়ে যায় না। অনেক না থাকার পরেও তার ভিতরে ছিল দেশপ্রেম, ছিল কাব্যপ্রেম, সাহিত্যপ্রেম, শিল্পপ্রেম; এসব বিষয়ে তার অন্তর্গত তাড়নার কিছুমাত্র কমতি ছিল না। তবু ভাবতে হয়, সকল বৈরিতার বিপরীতে স্রোতের তোড়ে হারিয়ে যাওয়ার বদলে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যাবার মতো আত্মবিশ্বাস ও সাহস কোথা থেকে আসলো তার! সংগোপনে লালিত ছিল নিশ্চয় তার অন্তর্গত সত্তায়।

একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বিদেশে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা ঘিরে শহিদ মিনারে শপথ পাঠ করায় এই ছেলেটিই। এর পর থেকেই ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনে আরও সক্রিয় হয়। একাত্তরের ২৭ মার্চ কয়েক ঘন্টার জন্য কার্ফ্যু শিথিল হলে সারা ঢাকা শহর ঘুরে পাকহানাদারদের নির্মমতা দেখে স্তম্ভিত এই ছেলেটিই সদ্য চাক্ষুস করা অবর্ণনীয় নৃশংসতার প্রতিশোধ নিতে বন্ধুর সাথে বাড়ি ছাড়ে ২৯ মার্চ। মা সেদিন যুগিনগরের বাসায় দোতলার বারান্দা থেকে তাকিয়ে ছিলেন যতক্ষণ দেখা যায় ছেলেকে। কারণ তিনি জানেন, শিগগিরই ফিরবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধ অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া ছেলেটির ফিরে আসবার দিন-ক্ষণ বা সম্ভাবনার কোনো নিশ্চয়তা বাস্তবে নেই।

ছেলেটির যুদ্ধকালীন প্রথম ঠিকানা হয় আগরতলার ক্র‍্যাফট হোস্টেল। যেটা তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশি বামপন্থীদের প্রধান আশ্রয়স্থল ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অফিস হয়ে উঠেছিল। দুহাজার সাত সালে বাংলাদেশ হাসপাতাল ১৯৭১ এর জন্য হাবুল ব্যানার্জির আম বাগানের ফুটেজ নিতে আগরতলা গিয়ে আমি ও অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ যেদিন দাঁড়িয়েছিলাম ক্র‍্যাফট হোস্টেলের সামনে, তখন তা ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। খুব আফসোস হচ্ছিল সেই ঐতিহাসিক হোস্টেলের আদিরূপ দেখতে না পারায়। তবে তিন দিনের ভ্রমণ চৌদ্দ দিনে গিয়ে ঠেকেছিল সমগ্র ত্রিপুরা জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্ততা পুনরাবিষ্কার করতে করতে।

ক্র‍্যাফট হোস্টেল থেকে তাকে পরবর্তীতে নানা সময়ে দলীয় নির্দেশে তাকে যেতে হয় কোলকাতায়। তবে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্র‍্যাফট হোস্টেলই ছিল তার আসল ঠিকানা। এখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পথ ও পন্থা নিয়ে বাম নেতৃত্বের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের আলোচনা সভায়ও ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব তার এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এ সভার সূত্র ধরেই ইন্দিরা গান্ধীর সায় মিললে প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ জোরদার হয় বাংলাদেশের বাম রাজনীতির মানুষদের।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা বন্ধের প্রতিবাদে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছিল একাত্তরের মে মাসে সিপিআই-এর উদ্যোগে বুদাপেস্টে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলন। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে কথা বলতে যাওয়া চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের একজন ছিল এই অন্তর্মুখী ছেলেটিই।

যে প্রত্যয় নিয়ে দেশের জন্য ভালোবাসায় উদ্বেল উন্মুখ হওয়া, যুদ্ধের নয় মাস দেশ ও দেশের মুক্তির জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া, সেই একই নিষ্ঠা ও নিমগ্নতা ধরে রাখা এই মানুষটিই প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক ও সাহিত্যিক আবুল হাসনাত। অদ্যাবধি দেশের সেরা সম্পাদকের শীর্ষ অবস্থানে গণ্য হবার দ্বিধাহীন অবস্থানটি তার অন্তর্গত সৎ ও বলিষ্ঠ চিত্ত এবং চরিত্রের স্পষ্ট পরিচায়ক। অন্য সব ক্ষেত্রে স্পষ্ট বিদ্যমান কলুষের মতো চারদিকে যখন স্বজনপ্রীতি, দলবাজি, তেলবাজি, মোসাহেবি, এসব নানান স্বার্থসিদ্ধির ফিকিরে চাপা পড়ছে ও পড়েছে সাহিত্যাঙ্গনটিও, সম্পাদকের টেবিলগুলোও, তখন মৃদুভাষী আবুল হাসনাত আড্ডা, বন্ধুত্ব, সখ্য, সম্প্রীতি, দল-স্বজনের পক্ষপাত এসবের বালাই না করে আচরণে কাঠখোট্টা হলেও কাজে শুধু লেখাকেই প্রাধান্য দিয়ে গেছেন। কে লিখেছে তার বিচারে নয়; কী লিখেছে, কেমন লিখেছে, তার বিচারে লেখা নির্বাচন ও প্রকাশ করেছেন।

এমন সম্পাদকের হাত ধরে তাই নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রণোদনা পেয়ে গেছে সম্ভাবনাময় লেখক। প্রকাশ পেয়েছে তার আঙিনায় পৌঁছা সব ভালো লেখা। একজন সম্পাদকের এর চেয়ে বড় গুন ও অবদান আর কী হতে পারে! তবে হ্যাঁ, আবুল হাসনাত শুধু এই গণ্ডিতেই আটকে থাকেননি। ভালো লেখা প্রকাশের পাশাপাশি ভালো লেখক নির্মাণে তার ভূমিকা ছিল বিরল, অতুলনীয়। চব্বিশ বছর সংবাদ সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালীন সাময়িকীটির প্রতিটি প্রকাশকে কেমন করে আরো নান্দনিক, শৈল্পিক ও সৃষ্টিশীল অভিনবত্বের ছোঁয়ায় প্রকাশ করা যায় সে চেষ্টায় হয়ে উঠেছিলেন দেশের তাবৎ দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে একজন সত্যিকারের শীর্ষ সাহিত্য সম্পাদক। সে সময় আজকের মতো আধুনিক ছিল না মুদ্রণ শিল্প। লেটার প্রেস আর ব্লকে নকশা ছাপার আমলে যেসব শিল্পমান তার সাহিত্য পাতায় হাজির করেছিলেন তা বিস্ময়ের। স্রেফ তার কারণে সাহিত্য পাতার কলেবর দ্বিগুণ হয়েছিল সংবাদে। তার কারণেই সাহিত্য পাতা প্রকাশের দিন সংবাদ অন্তত পাঁচ হাজার কপি অতিরিক্ত বিপনন চলতো।

তার সম্পাদনার শুরু সংবাদে সাহিত্য সম্পাদক হবার আরও আগে দলীয় পত্রিকা ও অন্যান্য ছোটো পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হবার আগে আবুল হাসনাত ছিলেন ছাত্র সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। সেইসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সম্পাদক। নানান রকম সাহিত্য প্রকাশনার পাশাপাশি কয়েকটি একুশে সংকলনও সেসময় প্রকাশিত হয়েছে তার সম্পাদনায়। স্বাধীনতার পরে পরেই ‘গণসাহিত্য’ নামে একটা ছোটকাগজ প্রকাশ করতে শুরু করেন হাসনাত তার সম্পাদনায়। বলা যায় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে নজরকাড়া ও লেখা-সমৃদ্ধ লিটলম্যাগ ছিল তার সম্পাদিত গণসাহিত্য। এই সূত্রে মূল ধারার দৈনিক ও সাহিত্য পত্রিকার পাশাপাশি ছোটকাগজেরও একটা বিশেষ ঋণ রয়ে গেছে সম্পাদক আবুল হাসনাতের কাছে। লিটলম্যাগ গণসাহিত্যের পাতায় তিনি শিল্প বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে নানান বিষয়ে মানোত্তীর্ণ যেসব লেখা ছেপেছেন সেইগুলো নিজে সম্পাদনা করা ছাড়াও অনেক সময়ই লেখককে দিয়ে বারবার ঘষামাজা করিয়ে নিয়েছেন। লেখার উৎকর্ষ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনোপ্রকার আপস তার বিবেচনায় তখন থেকেই কিছুমাত্র ছাড় পায়নি।

শিল্পবোদ্ধা ও শিল্প সমালোচক হিসেবে এপার বাংলা ওপার বাংলায় শিল্পী মহলে সমান পরিচিত ও সমাদৃত হলেও কাজে এর ছাপ রাখার বাইরে এতটুকু প্রকাশ কখনও ঘটেনি তার আচরণে কথায় বা প্রকাশে। এমন নির্মোহ মানুষ, নির্মেদ সম্পাদক, তার সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে লেখক পরিচয়টিও প্রায় হারাতে বসেছিলেন। সাগিত্যানুরাগীরা ভালো জানেন মাহমুদ আল জামান নামে তার কবিতা লেখার কথা। আর সেই নামে প্রকাশিত গ্রন্থগুলো তার নির্মাণতৃষিত অন্তরে পরিপূর্ণ একজন কবির সন্ধানই দেয়- যে কোনো কাব্যবোদ্ধা ও কাব্যপ্রেমী পাঠককে। কবিতার পাশাপাশি আবুল হাসনাত লিখে গেছেন শিল্প সমালোচনা, শিল্পসত্তা ও শিল্পী জীবন উন্মোচনী গ্রন্থ, উপন্যাস, স্মৃতিগদ্য ও আত্মজৈবনিক, শিশু-কিশোর সাহিত্য, ছোটদের জন্য খ্যাতিমানদের জীবনী, নাটক এমন কি অনুবাদ গ্রন্থও।

তার সম্পাদনায় পত্রিকা ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে বহু গ্রন্থ। সর্বশেষ কর্মস্থল বেঙ্গলে ‘কালি ও কলম’ সম্পাদনা ছাড়াও ‘শিল্প ও শিল্পী’ নামে যে ত্রৈমাসিকটির সম্পাদনা তিনি করতেন অমন ঘরানার ও মানের পত্রিকা এদেশে কমই প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদকদের সম্পাদক আবুল হাসনাত লেখালেখির বাইরে অনেক কিছুর সাথেই জড়িত ছিলেন। ছায়ানটের অন্যতম সদস্য হিস্রবে আজীবন অবদান রেখে গেছেন। এমন কী জাতীয় লীগে ক্রিকেটও খেলেছেন। চিত্র সমালোচকের পাশাপাশি ছিলেন সংগ্রাহকও। সীমিত আয়ের জীবনে টাকা জমিয়ে অনেক ছবিও কিনেছেন। নামি-দামি সকল চিত্রশিল্পীর সাথে সুসম্পর্কের কোনো ব্যক্তিগত ফায়দা না খুঁজলেও তার সম্পাদিত দৈনিকের সাহিত্য পাতায় বা সাময়িকীতে আঁকাআঁকির জন্য ডাকা মাত্র অগ্রজ অনুজ খ্যাতিমান নবীন সকলেই এগিয়ে এসেছেন প্রশ্নহীন।

জাতীয় কবিতা পরিষদের উৎসব মঞ্চে পটুয়া কামরুল হাসানের মৃত্যুতে তাৎক্ষণিক যে সাহিত্য পাতা তিনি প্রকাশ করেছিলেন তাতে নতুন লেখার পাশাপাশি তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত ছোটো কাগজ গণসাহিত্য থেকে পঁচাত্তর সালের পুরনো লেখাও ছেপেছিলেন। সম্পাদনা ও প্রকাশনার মানে সেই পুরনো আমলের লেখাটিও এতো বছর পর ছাপবার মতো প্রাসঙ্গিক ও মানোত্তীর্ণ থাকাটা সম্পাদক আবুল হাসনাতের সক্ষমতার আরেকটি প্রমাণ পরিচায়ক। তার আরেকটি মাইলফলক প্রকাশনা ছিল সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও কবিতা’।

মিতবাক স্বল্পবাক হলেও ভালো লেখাটি বের করে নিতে লেখককে বারবার খাটাতে বলবার ক্ষেত্রে পিছপা ছিলেন না কখনোই। বয়স কিংবা পেশা বা প্রতিষ্ঠা পরিমাপের বাইরে গিয়ে সখ্য নির্মাণে কম কথা বলার বিপরীত বিস্তার ছিল তার। কাজের আঙিনায় কথা বলা মানুষটিই অন্য সময় অন্যত্র কাজের বাইরে পছন্দের মানুষ(দের) সাথে আড্ডা ও আলাপে কথা বলতে হিসেবি ছিলেন না কখনোই। এমন নিভৃতচারী মানুষটি কৃপণ ছিলেন শুধু নিজের কথা বলতে। নিজের লেখাটি কাউকে পড়তে দিতে বা ছাপতে দিতে।

জীবনের শুরুতে অতিরিক্ত কড়া শাসনের বেড়াজাল কিংবা অকৃতকার্য ছাত্রের তকমা তার প্রতিভাকে আটকে রাখতে না পারলেও শৈশবের সঙ্গী আর্থিক সংকট এবং চারপাশে বিভিন্ন মানুষের সততা ও আচরণের বৈরিতা তাকে নিপাট সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে সংবাদ সাহিত্য সাময়িকীর ঐতিহ্য ফেলে কর্পোরেট আঙিনায় চলে যাবার পথে এগিয়ে নিয়েছিল। নিবেদিতপ্রাণ ও সফল সম্পাদক হবার কীর্তিময় সাফল্য বিপত্তি ঘটিয়েছে তার লেখক সত্তার পরিধি সমান সৃষ্টি সাফল্যে। এইখানে নিশ্চিতভাবে তার সামর্থ্যের সৌভাগ্য বঞ্চিত হয়েছে আমাদের সাহিত্য। তথাপি একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সম্পাদক হিসেবে, নান্দনিক প্রকাশনার পথিকৃৎ হিসেবে, অনেক লেখক পাইয়ে দেবার অবদান স্বীকারে এইটুকুন দুঃখ ও খেদ আমরা বুকের ভিতর গুটিয়ে নিতেই পারি।

লুৎফুল হোসেন

কবি, প্রকাশক ও সাহিত্যকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন রকমের পোর্টাল ও পত্রিকায় নিয়মিত গল্প, কবিতা, ফিচার, প্রবন্ধ এবং গান লিখছেন। বাংলাদেশের লিটলম্যাগ ও নানা প্রকাশনা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আছেন সেই ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকেই। শৈল্পিক মননশীলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে একটু একটু করে গড়ে তুলছেন তার নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘রচয়িতা’।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top