দীর্ঘ কবিতা: ভেকপুরাণ অথবা জনগণতান্ত্রিক ইস্তেহার

শামসেত তাবরেজী

Since human nature is the true community of men, those who produce thereby affirm their nature, human community, and social being which, rather than an abstract, general power in opposition to the isolated individual, is the being each individual, his own activity, his own joy, his own richness. To say that a man is alienated from himself is to say that the society of this alienated man is the caricature of his real community.
-Karl Marx

Write your self. Your body must be heard. Only then will the immense resources of the unconscious spring forth. Our naphtha will spread, throughout the world; without dollars- black or gold- nonassessed values that will change the rules of the old game.
-Helen Cixous

Be of good cheer; thou livest; but my life hath long been given to death, that so I might serve the dead.
-Antigone, Sophocles

 

ভেক ডাকতেছে।

ওইখানে ময়দানে জমে আছে জল
দর্পণের দর্প হ’য়ে, টলমল কালো ও কপিশ
মেঘের সামান্য নীচে,
যেমত চুম্বনের আগে হতবিহ্বল নারী,
যেমত মাটির স্পর্শ পেতে ব্যগ্র লাঙল,
আকাশের দিকে মুখ ক’রে
এইমত জলের আয়না গাহিতেছে বিবাহের গান ।

সেইখানে জলবাহী মেঘের মূরতি কত
মাঠের ঘাসের সনে ফস্টিনস্টি করছে নিয়ত
ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে মেখে।

শাদী মোবারক
যুবতী ঘাসের সনে বরষার নতুন পানির,
ঠাণ্ডা বাতাস ঘটকালি করতেছে তার,
আর-আমি আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি
বসে আছি বাতায়ন খুলে মনীষার।

দেখি-যে, একজন কাক আপাদমস্তক ভিজে
রয়েছেন নিষ্ঠার সঙ্গে ব’সে দহলিজে, প্রকৃতির প্রফেসর সাহেব,
বেহুদা বিরক্ত হন নাই তিনি, অনতি-অদূরে
একটি নিবিড় নিম ছিলিবিলি পাতার বিজ্ঞান
ইশারা ক’রে কাকভদ্রমহোদয়ের শরীরে
তুলেছেন হেমবর্ণ শিহরণ!

বিবাহের দৃশ্য সদা রূপায়িত হন এই-আরশিতে।

প্রত্যেকের জীবনের কাছে আরশি তাই অতীব জরুরী।
অথবা জীবন মানে নিরলস আরশিতে এই চিহ্ণ সেই চিহ্ণ লেখা
অথবা মৃত্যু লেখা তলে-তলে অপরের তরে।
মোদ্দা কথা, জীবন মানেই মৃত্যু, মৃত্যু ছাড়া আর
অন্য কোন মানে নাই তার। জীবনের ব্যতিরেকে
মৃত্যু হ’ল ছবি না-ওঠা নেগেটিভ নিরেট, অসাড়।

বিপরীতে জীবন হ’ল মৃত্যুর মৌল শর্ত:
কবিতার ছন্দের মত, সন্নিহিত পদে, সিলেবলে।
রতিরম্ভা জীবনের গাদ ও সকল গর্জন
চির-আরাধ্য মৃত্যুর কাছে। তাকেই সাদর
অভ্যর্থনা দিতে এত আয়োজন এত ভাষা এত ভালবাসা।

ফলে দেখি, জীবন ও মৃত্যুর বিবাহ অনিবার্য ঘটনা।
এ বিবাহে তাই দ্বিমত অসম্ভব, যদিও-বা  পছন্দ বা
অপছন্দ আছে, তারই জের ধরে ময়দানের ঘাসের লগে
আমি মেঘের বিবাহের প্রসঙ্গ তুলছি।

ক.
ডাইকোটমির ফাঁদ নয়, বাপ
একই বিন্দুর তাগিদে,
তর্ক তৃষ্ণা রভসে কলাপ
মিলনোচ্ছ্বাস ও-ঈদে।

যে পুরুষ তার বিদেহ তরীর
প্রকৃতি ব্যগ্র মেদিনী,
ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে রুধির
ভাষা-তৎপর জেদিনী।

একই সর্পের এক জোড়া ফণা
উদ্যত মোরা যে-বিষে,
সে আমাকে দেবে অভ্যর্থনা
আমি যাব তাতে মিশে।

ডাইকোটমির ফাঁদ নয় বাপ
বাংলার এই তরীকায়,
আছেময়তার চির রসচাপ
ভাষাপুঞ্জের মনীষায়।

দ্যাখো ঝলমল, শোনো খিলখিল বাজে
থাকিস নে আর মিথ্যের শত ভাঁজে।।

খ.
‘পছন্দ’, নির্বাচন বা বাছাইয়ের এক পদ। ফার্সি মুল্লুক থেকে বেড়াতে এসে রয়ে গেলেন বাংলায়।
কিন্তু তার ক্রিয়ায় আমার হাত রইল না। অন্যের ধমকে, অন্যের ঠমকে আমি বাছাই করি তা-ই যা
আমি পছন্দ করি নিরুপায় হ’য়ে।

আমার পছন্দের সিদ্ধান্ত দেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, গোয়ার্তুমির রাষ্ট্র আর সাম্রাজ্যবাদ
আর আমি যদি থেকে যাই ভোদাই, না চিনি নিজেরে, শত্রু আর মিত্রের ভেদ পর্যন্ত না বুঝি,
তবে আমার কপালে যা লেখার, তাই হবে লেখা।

এই মোতাবেক, এক্ষণে যদি আমার বিবাহের ইন্তেজাম হয়, আমার স্বামী হবেন যা-তা,
কিন্তু কিছুই করার নাই, তার সঙ্গেই আমার সংসার ধার্য। তারই না-মাজা দাঁতের হাসির
লগে হাসতে হবে আমাকেও, আমরা খায়েশ করব ফুলের বাগানে ঘুরতে, কিন্তু
পৌঁছে যাব ‘মেড ইন জাপান শপিং কমপ্লেক্সে’। তার ঘাড়ের উপরে একটা তিল যখন আমার
ভিতর তুমুল হুলুস্থুল বাঁধাবে, আমি ঠোট লাগাতে গিয়া দেখব সেইটা হইল একটা কীরার একখণ্ড গু।

গ.
পরম করুণাময় আমারে বুদ্ধিবিবেক দিছেন, আমি যদি তা কাজে না লাগাই, তবে কার দোষ?

আমারে দিছেন এক জোড়া হাত
এই হাত আমি নিযুক্ত করছি হাত-সাফাইয়ের কাজে
আমারে দিছেন এক জোড়া চোখ
এই চোখ আমি আঠার মত সাঁইটা দিছি টেলিভিশনের পর্দায়
আমারে দিছেন এক জোড়া কান
এই কান আমি নিযুক্ত করছি নিমকহারামের সঙ্গীত শ্রবণে
আমারে দিছেন এক জোড়া পা
আমি খালি ঘুরঘুর করি ক্ষমতার ক্ষীরের থালার চারদিকে
আমারে দিছেন একটা মুখ
আমি তারে নিযুক্ত করছি মিথ্যার গল্প প্রচারে

ফলে, এই রকম জীবনের জন্য সুন্দর, সুশ্রী আর বুদ্ধিমান পাত্র আমি কিভাবে আশা করতে পারি?

ঘ.
তোমার জীবনপাত্র তোমার নুলা,
গর্ত চোখে চিরকালের আঁধার।
সারা গায়ে বদমায়েশীর ধূলা,
মৃত্যু তোমার শুধুই গোলকধাঁধার।

তোমার জীবনপাত্র তোমার কালা,
পরের জীবন নিজের করে বাঁচে।
ঘর থু’য়ে যায় আনাচে-কানাচে
মৃত্যু তোমায় করবে ফালা-ফালা।

তোমার জীবনপাত্র তোমার মরণ
কিন্তু তুমি হারাইলা তার চরণ!

ঙ.
ভেকের গল্পে আসি আরো একবার।

০০০
ভেক-এর অন্যপদ ব্যাঙ। কথায়-কথায়
আমরা হামেশা ‘কূয়ার ব্যাঙ’ বলি,
যেহেতু সে-থাকে সামান্য সীমায়,
একরত্তি জগতে। আমরা গাই কলি
ভেকজাতিরে করি উপহাস:
ইহারা নিতান্ত ক্ষুদ্র, এস, পদ দলি
ইহারাই শান্ত-ভদ্র রাষ্ট্রের ত্রাস!

ক্ষমতার দাগকাঠি দিয়া আমাদের ভেদের বিচার!

০০০
কিন্তু, ওই  ক্ষমতাবস্তুটা কি?

০০০
ক্ষমতা কি নির্বিশেষ দখলদারীতা?
ক্ষমতা কি চিন্তনে কার্তেসিয়ান কিছু?
ক্ষমতা কি পরবস্তু ভোগের লালসা?
ক্ষমতা কি অন্যকে করে ফেলা নীচু?
নাকি ক্ষমতাই জীবনের মৌলিক দশা,
মিষ্টত্ত্বের তীব্রতায় আলাহিদা তিতা!
ক্ষমতা কি ন্যায় বা অন্যায় ভরসা?

০০০
বড়র ধারণা দিয়া জগতের এই মাপামাপি
আমাদের যুদ্ধের বয়ান আছিল।
হেথা কোন ছোটর জগত উচ্চারিত হয় নাই,
ক্ষুদ্রের খিদা নিয়া এখনো যে কাঁহাতক ইতরামি খালি।
এমত দেখায় দেখি, ভেকের জগত ছোট, নীচু অতিশয়।

সুতরাং,

ইহাদের ভাষা
অপাঙক্তেয়, ধরে তিলমাত্র আশা
ইহাদের দৌড় ওই মসজিদ-তক্
পাজির পা-ঝাড়া যত, বড় আহাম্মক

০০০
সে-কারণে ইহারা তো উন-জাত, ইহাদের নিয়া
কথা কওয়া নাজায়েজ, বিলকুল বেত্তমেজি কাজ
তাদের পক্ষ নিয়া কেউ যদি উকালতি করে
যেমন রাষ্ট্রের মিহিদানাসভা, সেটাও অন্যায় ঘোর!

চ.
জাতীয়তাবাদ হল বড়লোকদের ব্যাপার, গরীবের জন্য অবশ্য মান্য কালাম
বল: আমেন

জাতীয়তাবাদ হল যাদের রবীন্দ্রনাথ আছেন মম চিত্তে…
বল: আমেন

জাতীয়তাবাদ হল টেলিভিশনের পর্দায়  হস্তমৈথুনবিষয়ক আন্ কাট সাংস্কৃতিক চর্চ্চা
বল: আমেন

জাতীয়তাবাদ হল তুমি কতটা শাসকগোষ্ঠির
বল: আমেন

জাতীয়তাবাদ হল পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার উন্নয়ন-অর্থনীতি
বল: আমেন

জাতীয়তাবাদ হল নকশাদার পায়জামা-পাঞ্জাবি, পারলারে-বাঁধা খোঁপা, কপালের ছায়ানটী টিপ
বল: আমেন

জাতীয়তাবাদ হল জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদের রান্নাবান্না
বল: আমেন

উকিল-মোক্তারে ছয়লাপ-করা মহান বাঙালি আর বাংলাদেশি
বল:  আমেন, আমেন, ছুম্মা আমেন

ছ.
বাকী সব করে রব চিরকাল, রাতি পোহাইল:

যারা চাকমা মারমা যারা
যারা সাঁওতাল গারো যারা
যারা হাজং মনিপুরী যারা
যারা মুরং টিপরা যারা
যারা মগ পামে যারা

ইহারা হলেন প্রকৃতপক্ষে ‘উপ’

০০০
আর-যত গরীবের-গরীব তস্য গরীব
উহারাও উপ

নারী হয় উপ
ইহারা আদপে হয় মহিলা ইহারা হয় রমণী ইহারা হয় গৃহিণী

০০০
ইহাদের জন্মনিরোধক জাতিনিরোধক ট্যাবলেট দাও
খালি সোনার বাংলা গাওয়ার সময় এদের আমুণ্ডু রাখো খাঁড়া
সকল ‘উপ-নুনু’ বেঁধে দাও নির্বীজ  তাবিজে
আর ভোটের সময় এদের রাখো আলাদা খোঁয়াড়ে
যেন নাজাই-পড়া ভোটের হিশাব হয় ইহাদের মাথা গুণে

০০০
বড় যারা তারা বড়লোক          তুমি কোন্ দলে?
ছোট যারা তারা ছোটলোক   তুমি কোন‌ দলে?

০০০
তুমি ‘উপ’ নিত্য তোমার মধ্যে দেখি কত কিসিমের ‘পনা’
আমরা বীরের জাতি তোমারেই করি ভর্তসনা।
তোমাদের ছেমা দিয়া খুব ভাল সংস্কৃতি হয়,
তোমাদের নাচাগানা, ভাতপচা মদ আমাদের আনন্দের বিষয়!

০০০
এই ‘পনাকে’ আমরা ততটুকুই গ্রহণ করি যতটুকুন বড়র সংস্কৃতির বৈচিত্রের মশলা হিশাবে কাজে লাগে

০০০
কাজে লাগাটা খুউব ইম্পর্ট্যান্ট আমাদের কাছে
কাজে লাগাটা খুউব পটেনশিয়াল আমাদের কাছে
কেননা তাতে বাজারের পেট মোটা হয়, আয়তন বাড়ে
বাড়ে তাতে ক্রেতা, আমরা তখন একটা কিনলে একটা ফ্রি দিবার পারি
তোমরা কি চাও না লিপস্টিক, সৌন্দর্যসাবান কিংবা ফর্সাক্রিম ফ্রি?

 

হে ছোটলোক, তোমরা কুয়ার ব্যাঙ
জগত তোমাদের ওইটুকু, যেটুকু প্রাচীর

জ.
It is good to rely upon others. For no one can bear this life alone
-Holderlin

ফিরে আসি, বিবাহে আবার:

যদি তুমি মনে কর, তুমি সেয়ানা হইছ
যদি তুমি সত্যিসত্যি টের পাও, তোমার ভিতর জ্বলতেছে বিরহের আগুন
স্বাতী নক্ষত্রের আলো পড়ছে তোমার চোখে
যদি আকাশসমান ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে তোমার পাহাড়ে
ধাক্কা লেগে মতিলাল পাথর চুঁইয়ে পড়ে
ঝরনাধারার দিকে ধায় অজস্র অণুপরমাণু

০০০
তবে আজ সময়নিষ্ঠ হও
কাতারে কাতার বেঁধে সশস্ত্র বৃত্ত হও
তমোহরা তত্ত্বে দাঁড়িয়ে দাও হাঁক
তুমি হও চলচ্চিত্র রঙিন ও সবাক

০০০
যদি বোঝো, জীবনের প্রবল তর্ক নয় পন্য-উপাসনা
যদি বোঝো, এ জীবন নয় মোটে স্বপ্নস্তনা
যদি বোঝো, কোকাকোলা ইরির ছবক
বিলি করছে মূঢ় অধ্যাপক

০০০
তবে, তৈরি হও অমৃত বিবাহে
তৈরি হও মৃত্যুর বঁধুয়ার তরে
কাতারে কাতার বাঁধো ওই ঈদগাহে
বিপ্লব তুলে ধর উচ্চস্বরে

ঝ.
যেও না আন্দাজী পথে  মন-রসনা
কু ঘোরে বিপাকে প’লে প্রাণ বাঁচবে না।
পনেরো পরিচয় করে
যাও না মনের সন্দ মেরে বুঝের দ্বারে।
-সাঁইজি লালন

তাহলে, এক্ষণে যেটা পরিষ্কার, তোমার দরকার একটা পার্টি।

(কভু দল নয়, পার্টি ইতিহাস)

০০০
পার্টি : অমৃতের সন্ধানে
পার্টি : জাতপাতহীন জনগণতান্ত্রিক লড়াইয়ের জন্যে
পার্টি : নারীর নতুন অভ্যুদয়ের জন্যে
পার্টি : ইতিহাস থেকে নুনুবাজি মুছে ফেলতে
পার্টি : জীবন ও মৃত্যুর মেলবন্ধনে

আমাদের নতুন অস্তিত্ব তৈরি হোক নির্জিতের পার্টির সামিয়ানাতলে

ঞ.
(We) must fight theoretically as primitive infantilism the attempt to explain every fluctuation
of politics and ideology as an immediate reflection of some change in the economic base of the structure.
-Antonio Gramsci

তোমার নিজের করে দয়িতাকে যেইভাবে চাও, একইভাবে চাইতে হবে পার্টিকে।
এ কথা সত্যি ইতিহাসে অনেক পার্টি তুমি দেখেছ, কিন্তু তার বেশির ভাগই প্রমাণ করেছে,
তারা আদৌ তোমার জন্য ছিল না। তোমাকে আপাদমস্তক ব্যবহার করে অবৈধ পুত্রের মত
ছেড়ে গেছে তারা ভোগ্যপণ্য তক্তার কাছে। যার ময়ূরীবিভাস দেখে বড়লোকরা খাই-খাই করে,
এক দঙ্গল এক লগে একটা ময়ূর-গমন করে আহ্লাদে আটখানা হয়। সেই তক্তাজাত প্রজন্মের সাইজও
কিন্তু ছোট না এখন।

তোমার নিজের মত একটা পার্টি তবে কিভাবে তৈরি হবে?
এই প্রশ্ন তোলাটা বটে ভীষণ জরুরী। আর বিষয়টাও না অতটা সহজ।
যখন,

০০০
তোমার নামের পার্টি তোমারে ভোগা দিয়া এখন কোন্ বনেগা ক্রোড়পতি
তোমার নামের পার্টি নয়া এই তর্জমার যুগে বলতেছে বিষয়টা উন্নয়নের
যে পার্টি তোমার পরিচয় নিয়া দেবে সাত-সমুদ্র পাড়ি তার কোনোটা উধাও
আর কোনোটা মাখন চাটতেছে বহুজাতিক কোম্পনির কোলে

ট.
ওলো বাবু, খায় লে দুদু
কান্দে না লে সোনাল চান,
দিমু তোলে আইনা যাদু
হিন্দিছবির ফিডালখান।

দরগা গিয়া শিরনি দিমু
বাবুল নুনুল দেও না তেজ,
দিও তালে ধনদৌলত
দিও না গো অর্শগেজ।

ঠ.
আমি আবার বলতেছি, তোমার পার্টি মানে একান্তই তোমার। আল্লার সঙ্গে মোলাকাতে
আহার্যের স্বাদ নিয়ে আসে যে-কৃষিসভ্যতা, তাকে ফিরিয়ে আনার পার্টি, ফসলের সোনার
মঞ্জিল ঘিরে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নাচের ঘূর্ণি তুলতে যে পার্টি দরকার, সেই পার্টি গড়ে
তুলতে হবে তোমাকে নিজেকেই।

কিন্তু বিষয়টা, আগেও বলেছি, অত সহজ না।

বিষয়টা তেমন নয় কপালে ইয়াব্বড় লাল টিপ লাগিয়ে রমনার বটমূলে বৃন্দ-উচ্চারণ:

‘কঠিনেরে ভালবাসিলাম…’

…ততক্ষণে পাঞ্জাবির হাতা ব্লাউজের মধ্যে…

ড.
ভাব ছাড়া পার্টির এক পাই দাম নাই কোনো। তোমার হাজার বছরের ভাব ও ভাবনা,
ঐতিহ্য-ফৈতিজ্য নয়, বরং এক মূর্ত ইতিহাস, যেখানে রয়েছে তোমার রুহের আবিষ্কারের তত্ত্ব,
যেখানে আমি-তুমি-সে মিলে মিশে একাকার,  সেই গভীর তত্ত্ব ছাড়া পার্টির ভিত্তি গড়া
অসম্ভব জেনো। তুমি যে-মাটির ঢেলার অংশ, তোমার পার্টিও সেই মাটির আবির
মেখেই দাঁড়াবে। তাহলে  আগে জান  কি তোমার ভাব?

ঢ.
তথ্যরে তত্ত্ব বলে যারা চালান দিছে এতকাল, তাদের কথাগুলান ফ্যালো নিয়ে ভাগাড়ে,
এনলাইটেনমেন্টের তাঁবেদারি থেকে তোমার চিন্তাকে সরিয়ে আনতে হবে আগে। অন্যের
রোশনাই দিয়া তোমার চেহারা দেখলে তা ঠিক তোমারে দেখা হবে না। তোমার পার্টি
মানে তোমার চেহারাটা পষ্ট দেখার আয়োজন। সেই আয়োজন কর। তুমি যদি বল,
তবে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত লালনস্যার তোমাকে নিষেধ করবেন না। সাঁইজি নিজেও
সাঁইজি তোমার দেহের মাটি মেখে। এই মাটির আয়নায় পার্টির চিদছবি ফুটিয়ে তোলার ভার
তোমার। ফলে ঘনঘন পাতলা পায়খানায় দৌড়াবার মতন ভোটখানায় যাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ কর।
কলাপাতার ছাই দিয়া ধুয়ে নাও তোমার হাত। ওযু ঠিক রাখো। বুকে বাঁধো ঈমানের জোর। আমি
হানড্রেড পার্সেন্ট সিওর, লালনস্যার না করবেন না। বরং এতদিন পর বাংলার মাটির হ’য়ে ওঠার
আরম্ভ দেখে তিনি হাতে তুলে নিবেন একতারা। ছেঁউড়িয়া থেকে গলা খুলবেন আরশের দিকে মুখ দিয়া

ণ.
মাংসের পরতে-পরতে যে নবী লিখছেন সমাচার
তারে বৃষ্টি করে ঢালবেন আল্লা আবার
লতিফা চনমন করা বাণী যত লেখা আছে তার
আলো করে জ্বালবেন রহমানুর রাহিম আবার

কলব বিদীর্ণ করে সেই শব্দ আওয়াজিবে সপ্ত আসমান
তোমার পার্টি হবে জনগণতন্ত্রের বিধুর বিজ্ঞান

০০০
শুরু কর তবে, সাঁইজির কালাম করে ডিসকোর্স জরুরী
পার্টি নিমিত্তে আসো দৈন্য গান ধরি।।

০০০
দৈন্য গানের ভিতর দিয়া পার্টির দিকে এগিয়ে যেতে হবে।  আমরা শুরু করব নদীয়ার
গলুই থেকে, দিনেশ সেনের বৃহৎ বাংলা থেকে অপার ভাবের নিশান হয়ে ওঠার
কাজে কোদাল ধরব আজ, এক্ষুণি।

ত.
আবারো সতর্ক করি যা বলেছেন ডাক্তারনী আপা, আসলে বোঝেন নাই কি কইতে কি কইছেন তিনি,
কিন্তু আপাকে ধন্যবাদ তিনি আমাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। আমরা ছিলাম শাহরুখের
ডানার ভাঁজে, ছিলাম মার্কিন টমাহক যুদ্ধবিমানের তলায়, কিন্তু এরাকের আর
আফগানিস্তানের লাশের গন্ধ আমাদের অন্তরাত্মা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ঘুম এখন হারাম,
এক নলা ভাত গ্রাস করবার সময় আমাদের জেদ চেপে যায়। ঘাড়ের রগ যমুনা ব্রিজের মত
বেঁকে উঠে রক্ত ছিটিয়ে দেয় ভূ-মণ্ডল জুড়ে।

এক্ষণে, তুমি তবে বুঝে গেছ, খালি ঈমান আর পার্টি গঠনের তর্ক না, পরদেশভোগকারী
কিংবা আমরা যাদের বলি সাম্রাজ্যবাদ মানে ‘আম্রিগা’, তার বিরুদ্ধে জারি রাখতে হবে লড়াই,
‘মেড ইন জাপান’ এর বিরুদ্ধে জারি রাখতে হবে লড়াই। এক সঙ্গে দুই লড়াই, ঘরের শত্রু
বিভীষণ আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে এই লড়াইয়ের তুফান উঠবে লালনের একতারা থেকে।
ভাব মানে যে ‘হওয়া’ বোঝায় শুরু করতে হবে তা’ আজ, এক্ষুনি।

(এমন ক্রিয়ামূলক চিন্তার নজির তুমি কি দেখছ অন্য দুনিয়ায়?)

থ.
ভেক ডাকতেছে। চিরসংগমের গান বাজতেছে প্রান্তর ব্যেপে
ভেক ডাকতেছে। কদমের ব্যাঘ্রহলুদ এসো সারা গায়ে লেপে
ভেক ডাকতেছে। আদি ও অনাদি এসে মুখচুম্বন করবে এখন
ভেক ডাকতেছে। জীবনের মৃত্যুর মহাকাব্য হইবে লিখন
ভেক ডাকতেছে। বিধুর চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে আজ বরষামিররে
ভেক ডাকতেছে। এসো আজ এক শ’ তিন ডিগ্রির কৈশোরক জ্বরে

০০০
আজ আমি অতিথি প্রধান
দেখতেছি বিবাহবাসর,
শুনতেছি সেই মহাগান
ভাসতেছে সুবাস আতর।।

০০০
এসেছেন আরো-আরো অতিথি সকল,
আনতশাখায় বসে সকাতর কত কৃষ্ণফল।
সব সিলেবল আজ একবিন্দুতে,
মিশে যাচ্ছে মূর্ধা আর গহন-তালুতে।
লিচ্ছবি চমৎকারা  ও-চঞ্চল অধরা,
তুমি নিষ্ঠ-যৌবন বায়ু, তুমি সসাগরা।।
নয়ান-মুগ্ধ তুমি নিরঞ্জনা, তুমি কমলিনী,
লো রহম প্রাপঞ্চনিক, ও-মধুরভাষিণী।।

০০০
বরষামিররে, সংকীর্তনের ভিতর গর্ভেচ্ছু মেঘের চলাফেরা
বরষামিররে, ভেকের আকাশবিদীর্ণ নিনাদের কামনাতরঙ্গ
বরষামিররে, স্নাত পৃথিবীর সবুজ আহ্লাদ
বরষামিররে, আমনের গন্ধ-ব্যাকুলতা
বরষামিররে, আমাদের জীবনের লেখা মৃত্যুর অমৃত-কথন

০০০
ভেকের বিপুল শব্দে আমাদের জাগরণ ঘটুক দেহে
কামনা অধীর বৃষ্টিতে বহুক চিরমিলনের বান

০০০
আমি দেখেতেছি বরষার পানির লগে মেঘের বিবাহ
পরখ করতেছি তাদের বিবাহের মৌলিক আয়াত
টুকে রাখতেছি, পার্টি লাইন আর রণকৌশলের তত্ত্বসমূহ
কার সঙ্গে কার বিয়ে ছহিহ্ ও জায়েজ

০০০
তোমরা কি শুনতে পাও না ওই ভেকের সঙ্গীত?
তোমরা কি টের পাও না অনিঃশেষ বিপ্লবের গান?
টেলিকাঁথা ছেড়ে আসো আপন-আপন যত বোনের সহিত,
ওই শোন গর্জাতেছে অমৃতের সকল কামান।

০০০
মরসুমের এই মাতম ওরে আয় রে আয়
দিনগুলি যে বেকার কামে যায় রে যায়

তৎপরতার আগুন তুলে নে রে বুকে
ভুগিস নে আর ফালতু যত সুখ-অসুখে

জাতীয়তার গ্লানি ঝেড়ে নগ্ন হ’না
একটি সাপের পুরুষ-নারী দুইটি ফণা

দে রে ছোবল, বসিয়ে দে প্রবলভাবে
সাঁইজির ভাব আপন করে তোর স্বভাবে

আয় রে সবাই ভেদ ঘুচিয়ে জাতের খোয়াব
থাকবে নাকো দেখিস তখন প্রেমের অভাব

চিরকালের মিলন নিয়ে সেই দুনিয়ায
আয় রে নারী আয় রে পুরুষ আয় রে আয়

আয় রে নারী আয় রে পুরুষ আয় রে আয়

…..

 

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top