ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের জনক আন্দ্রেই তারকোভস্কি (শেষ পর্ব)

।।প্রথম পর্ব।।

ফারহানা রহমান

১৯৬৫ সালে তিনি ১৫ শতকের আইকন পেইন্টার আন্দ্রেই রুবলভকে নিয়ে ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’ নামেই একটি ফিচার ফিল্ম তৈরি করেন। ছবিটি তৈরির পর থেকেই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তাঁর উপর ভীষণভাবে রুষ্ট হয়ে ওঠেন। এবং সিনামাটির ব্যাপারে প্রবলভাবে বাঁধা দিতে থাকেন। ফলে সিনামাটিকে বহুবার কাটছাঁট করার ফলে এটির বেশ কয়েকটি ভার্সন তৈরি হয়। ১৯৬৯ সালে এর একটি ভার্সন দেখানো হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। ছবিটি সেখানে ফিপ্রেস্কি প্রাইজ জিতে নেয়। আন্দ্রেই রুবলেভ রাশিয়ার সংস্কৃতির ইতিহাসে সবচেয়ে অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বদের একজন। তার জীবন ও শিল্পে, বিষয়বস্তুর ব্যতিক্রমী রসদ রয়েছে বলেই মূলত তারকোভস্কি তাঁকে নিয়ে ফিল্ম বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। সহজাত সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধির দৌলতে একজন চিত্রকর যে সময়টিতে বাস করেন, সেই সময়টির গভীরতম অর্থ অনুধাবন করাই ছিল এই সিনামাটি তৈরি করার প্রধান উদ্দেশ্য। এটি কোন ঐতিহাসিক বা জীবনীমূলক ছবি নয়। চিত্রকরের অর্থাৎ রুবলেভের শিল্পীসুলভ পরিণতি প্রাপ্তির প্রক্রিয়া এবং তাঁর প্রতিভা বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াটিই মূলত ছবিটির উপজীব্য। যদিও এখানে রুবলেভকে কোন আইকন হিসেবে দেখানো হয়নি তবুও একজন শিল্পীর মানসিকতা ও সচেতনতা, অনন্তকালের জন্য তাঁর সৃষ্টির আত্মিক তাৎপর্যের আধ্যাত্মিকতাকে এখানে উপজীব্য করা হয়েছে। ছবিটি তৈরি হয়েছে মূলত চিত্রকর রুবলেভের অনুভূতিকে কেন্দ্র করে। তারকোভস্কি নিজেই বলেছেন, ‘রুবলেভের জীবনকাহিনী সম্পূর্ণ রহস্যময়।… আমাদের কোন ইচ্ছেই ছিলোনা তাঁর জীবনের ধাঁধার জটগুলো খুলে দেখবার। বরং আমরা দেখাতে চেয়েছি এমন একজনের দৃষ্টিকে যিনি আশ্চর্য ও ভয়ংকর এক সময়ের রাশিয়াকে দেখেছেন। যে দেশ ক্রমশ আপন রূপ ধারণ করছিল।’

রাশিয়ার আইকন চিত্রশিল্পী রুবলেভের ভাবনা ও অনুভূতিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে চলচ্চিত্রটি। কবি-সন্ন্যাসী রুবলেভ পৃথিবীকে দেখেছিলেন একজন বালকের দৃষ্টিতে যার চোখের সামনে ঘটে চলেছিল একের পর এক পাশবিক হিংস্রতা ও নারকীয় ভয়াবহতা। তবু তিনি অন্যের প্রতি দয়া দেখিয়েছেন, বিলিয়েছেন প্রেম ও মমতা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে একমাত্র মনুষ্যপ্রকৃতির শুভচেতনা ও মুক্তমনের ভালোবাসাই পারে সব হিংস্রতাকে পরাজিত করে মানবিক এক পৃথিবী গড়তে। রুবলেভ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তারকোভস্কি বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলেন একজন শিল্পীর মানসিকতা ও সচেতনতা। তিনি দর্শককে দেখাতে চেয়েছিলেন দূষিত পঙ্কিল ব্যধিগ্রস্ত একটি কালেও, দুর্বিনীত সময়ের দাসত্বের মধ্যেও, ধ্বংসাত্মক লড়াইয়ের ভেতরেও কী করে সহমর্মিতা ও সহধর্মিতার আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। আর সেখান থেকেই জন্ম হতে পারে ট্রিনিটির মতো মহান শিল্পের। আন্দ্রেই রুবলেভই প্রথম সিনেমা যাতে তারকোভস্কি রঙিন এবং সাদাকালো দৃশ্য পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন, পরবর্তীতে তার অনেক সিনেমায় এ ব্যাপারটি আমরা দেখতে পাই।

একটি গরম বায়ু চালিত বেলুনের যাত্রায় মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটি শুরু হয়। বেলুনটি একটি নদীর পাশের গির্জার সাথে একটি দড়ি দিয়ে পেঁচানো ছিল। ইয়ফিম নামে একটি লোক (নিকোলায় গ্লাজকোভ) বেলুনের নিচের দড়িকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে উড়ার চেষ্টা করছিলেন। তার ওড়ার চেষ্টার প্রথম মুহূর্তেই নদী থেকে একদল অজ্ঞ মানুষে এসে হাজির হয় ও উড়ে চলার চেষ্টাকে ব্যর্থতায় পরিণত করতে ইফিমকে সহায়তা করছে এমন একজনের মুখে জ্বলন্ত কাঠখন্ড চেপে ধরে ।এতকিছুর পরেও বেলুনটি সফল ভাবে আকাশে উড়ে যায়। ইয়েফিম আকাশে ওড়ার আনন্দ অনুভব করতে পারে ও উপর থেকে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার আনন্দে অভিভূত হয়। যদিও সে ক্রাশ ল্যান্ডিংকে কিছুতেই প্রতিহত করতে পারে না ফলে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। এই পতনের পর পুকুরের পাশে আমরা একটি বিষণ্ণ ঘোড়াকে গড়াগড়ি খেতে দেখি, ঘোড়াটি ছিল এইসব কিছুর একজন নীরব সাক্ষী। তারকোভস্কি সবসময় জীবনের প্রতিশব্দ হিসেবে ঘোড়াকেই দেখেছেন। তার মতে, ‘ যখন আমি একটা ঘোড়ার দিকে তাকাই তখন জীবনের সারবস্তুর প্রত্যেক সংস্পর্শে আছি বলে মনে করি। সেটা সম্ভবত এই কারণে যে ঘোড়া একটি খুব সুন্দর জন্তু ও মানুষের বন্ধুতুল্য। তাছাড়া ঘোড়া ভীষণভাবে রুশীয় নিসর্গের বৈশিষ্টসূচকও বটে।’

মধ্যযুগের মর্মবিদারক জীবন, মৃত্যু, প্রতিবেশের দুঃখ-কষ্ট ও যাতনা দেখে বিমূঢ় হয়ে একজন আদর্শবাদী তরুণ রুবলেভ যখন চিত্রকর থেকে নির্বাক সন্ন্যাসীতে পরিণত হয় তখন আমরা দেখতে পাই রঙিন ছবির মন্টাজ। কিন্তু সিনেমা শেষের দৃশ্যে রুবলেভ দেখে ছাদ থেকে পড়ে জীবন হারানোর ঝুঁকি নিয়েও একজন ঘণ্টা নির্মাতা একটি চার্চে প্রথমবারের মত ঘণ্টা লাগানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। ঘণ্টা নিয়ে তার কাজের সময়ে দেখানো প্রত্যয় ও আবেগ রুবলেভকে এতদিনের নীরবতা থেকে জাগিয়ে তোলে। তখন সে আবার অনুপ্রাণিত হয়। ফলে মানবিক সৃজনশীলতা, অধ্যাবসায় এবং বিশ্বাসের শক্তি রুবলেভকে তাঁর নির্বাক থাকার শপথ থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। বৃষ্টিতে ঘোড়ারা ভিজে চলেছে এমন একটি ইমেজ দিয়ে এই অসাধারণ ছবিটি শেষ হয়। সিনেমাটিতে রুবলেভ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তাঁর প্রিয় অভিনেতা আনাতোলি সোলোনিৎসিন। যাকে তারকোভস্কির পরের সবগুলো সিনেমাতেই দেখা গেছে। আন্দ্রেই রুবলেভ ১৯৭১ সালয়ে মুক্তি পায়।

পোলিশ সাইন্সফিকশন লেখক স্তানিশল লেম এর ১৯৬১ সালে প্রকাশিত কল্পবিজ্ঞান

উপন্যাস সোলারিস অবলম্বনে আন্দ্রেই ১৯৭২ সালে সোলারিস মুভিটি তৈরি করেন। সোলারিস নামক একটি অদ্ভূত গ্রহের চারদিকে আবর্তনরত, মানুষের তৈরি একটি কৃত্রিম উপগ্রহে ঘটতে থাকা অদ্ভূত সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সিনামাটির কাহিনী। ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য পৃথিবী থেকে একজন মনোবিজ্ঞানী ক্রিস কেলভিনকে (দোনাতাস বানিয়োনিস) সেখানে পাঠানো হয়। এমন মনে হতে থাকে যে সোলারিস গ্রহটি নিজেই একটি বিশাল মস্তিষ্ক। কেলভিন লক্ষ্য করেন, গ্রহটি কৃত্রিম উপগ্রহের অধিবাসীদের অবচেতন মনে প্রবেশ করতে পারছে এবং সেখানে যা যা দেখতে পায় তাকে বাস্তবের মত তার সামনে এনে উপস্থিত করতে পারে। এভাবে একদিন কেলভিন তার মৃত স্ত্রী হারিকে নিজের ক্যাবিনেটে দেখতে পান। হারি পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করেছিল। একসময় স্পেসশিপের বিজ্ঞানীরা হারিকে তাঁর ১০ বছর আগে পৃথিবীতে থাকতে আত্মহত্যা করার কথা এবং সে যে প্রকৃত হারি না তা মনে করাতে সে তরল নাইট্রোজেন খেয়ে আবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেখানে আবারও তার পুনর্জন্ম হয়। তারকোভস্কির “সোলারিস” মুভিটি ব্যাক্তি এবং ব্যাক্তির দহনকে মুখ্য করে তৈরি করা হয়েছে।

এরপর ১৯৭৩ থেকে ৭৪ পর্যন্ত তিনি দ্য মিরর সিনামাটির শুটিং করেন। সিনামাটি আসলে একটি আত্মজীবনীমূলক সিনামা। এটি যদিও কিছুটা অপ্রচলিত কাঠামোগতভাবে তৈরি করা সিনামাটিতে তিনি তাঁর বাবা আর্সেনি তারকোভস্কির কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ছবিটি মূলত মার্গারিতা তেরেকোভা, ইগনাট ড্যানিলৎসেভ, আলা ডেমিডোভা, আনাতোলি সোলনিৎসিন, তারকভস্কির স্ত্রী লারিসা তারকোভস্কায়া এবং তার মা মারিয়া বিশনিয়াকোভাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এখানে আমরা নানা আঙ্গিকে একজন মৃত্যু পথযাত্রী কবির অর্থাৎ তার বাবা আর্সেনি তারকোভস্কির স্মৃতিকে উন্মোচন হতে দেখি। যিনি তার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার তুমুল সংঘর্ষপূর্ণ সময়ে তার সন্তান ও সংসারকে ত্যাগ করেছিলেন। দৃশ্যত এই থিমগুলিকে উপস্থাপন করার জন্য সিনামাটিতে বর্তমান সময়ের সাথে শৈশবের স্মৃতি ও স্বপ্নকে নিউজরিয়েল ফুটেজের সাথে সমসাময়িক দৃশ্যগুলির সমন্বিত করার চেষ্টা করা হয়। ছবিটিতে স্বল্প প্রবাহের ইমেজগুলোর গতি হারিয়ে তার সমৃদ্ধ এবং সংকেতিক প্রতীকীর সাথে একাত্ম হয়ে মিশে যেতে দেখি। যা আধুনিকতাবাদী সাহিত্যে চেতনা প্রযুক্তির প্রবাহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মিররে আমরা আসলে অ্যালেক্সেরই শিশু, কিশোর এবং তার চল্লিশ বছর বয়সী জীবনে দেখতে পাই। একিসাথে তার আশেপাশের দুনিয়ার বিষয়-আশয়, চিন্তাভাবনা, আবেগ এবং স্মৃতিগুলির বর্ণনাও এখানে দেখানো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক আলেক্সকে শুধুমাত্র অল্পসময়ের জন্য দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু বেশিরভাগ দৃশ্যে কথোপকথনের ভঙ্গিতে ভয়েস-ওভার হিসাবে তার উপস্থিতি দেখি। চলচ্চিত্রের গঠনটি প্রচলিত প্লটে না ফেলে এতে নানা স্মৃতি ও স্বপ্নগুলোকে বিছিন্নভাবে দেখতে পাওয়া যায়। সিনামাটি তিনটি ভিন্ন সময় ফ্রেম অর্থাৎ যুদ্ধের আগের ১৯৩৫ সালের শৈশবের স্মৃতি, ১৯৪০ সালের যুদ্ধকালীন সময় এবং যুদ্ধের পরের ১৯৬০/৭০ সালের মধ্যে পরিক্রমণ করতে থাকে। মিররে তারকোভস্কি প্রকৃতপক্ষে নিজের শৈশবের ছবিই আঁকেন। মস্কো থেকে যুদ্ধের সময় গ্রামাঞ্চল এলাকায় ফিরে যাওয়া তার বাবার সংসার ত্যাগ করা, একজন মুদ্রণযন্ত্রের প্রুফ-রিডার হিসেবে তার মার জীবন সংগ্রাম ইত্যাদিকে ঘিরেই মিরর সিনামাটি গড়ে উঠেছে। ছবিতে যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত একটি শিশুর শৈশবের দুর্দশা চিত্রিত করা হয়েছে। আন্দ্রেই ১৯৬৭ সাল থেকেই ফিল্মটির স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তখন স্ক্রিপ্টির শিরোনাম ছিল কনফেশন, হোয়াইট ডে এন্ড অ্যা হোয়াইট, হোয়াইট ডে। সিনামায় কাজ করার সময় তিনি কখনোই অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাথে বেশি আলোচনায় যেতেন না। তিনি মনে করতেন সামগ্রিক স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে অভিনেতা জেনে গেলেই সে সচেতনভাবে চরিত্রটি অভিনয় করার চেষ্টা চালাবে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ‘মিরর এর প্রথম দৃশ্যে যখন প্রধান চরিত্রাভিনেত্রী বেড়ার উপর বসে সিগারেট খেতে খেতে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে, আমি চেয়েছিলাম যে অভিনেত্রী মারগারিটা তেরোকোভা যেন চিত্রনাট্যের বিশদ কিছু না জানতে পারে। তার মানে, সে জানেই না যে মানুষটা শেষ পর্যন্ত ফিরবে, নাকি সে চিরকালের জন্য চলে গেছে । এটা করা হয়েছিলো এই উদ্দেশ্যে যে যার চরিত্রে সে অভিনয় করেছে তিনি একদা যেভাবে থাকতেন ঠিক সেইভাবে সে ওই মুহূর্তে থাকবে ভবিষ্যৎ জীবনের ঘটনাবলির কথা না জেনেই। অভিনেত্রীটি যদি জানতো যে তার স্বামী আর কখনই ফিরবে না তাহলে নিঃসন্দেহে সে তার আগাম আশাহত অবস্থাটিকে অভিনয়ের মধ্যে আপনা আপনিই প্রকাশ করে ফেলত এবং না চাইলেও বড় পর্দায় তার হতাশার ভাব কখনো লুকানো যেত না।’ শুরুতে এই ফিল্মটিকে খুব একটা ভালভাবে নেননি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ । সিনামাটির উপর অভিজাততন্ত্রের দায় চাপানো হয়। কর্তৃপক্ষ এটিকে তৃতীয় শ্রেণীর ফিল্ম হিসেবে গন্য করেন এবং শুধুমাত্র তৃতীয় শ্রেণীর সিনামা হলগুলোতে এবং শ্রমিক ক্লাবে দেখানোর অনুমুতি দেন। সোভিয়েত সমাজে সেসময় কোন সিনামা তৃতীয় শ্রেণীর তালিকাভুক্ত হলে সেটি ফিল্মমেকারের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়াৎ। এবং পরবর্তীতে সেই ফিল্মমেকারের কোন সিনামাতে কেউ আর টাকা লগ্নি করতেন না। ফলে এ সময় কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তারকোভস্কিকে এবং সেই সময়টিতেই তিনি দেশের বাইরে গিয়ে সিনামা তৈরি করার কথা ভাবতে থাকেন।

প্রখ্যাত সোভিয়েত লেখক স্ক্রুগাৎস্কি ভ্রাতৃদ্বয়ের বিজ্ঞ্যান কল্পকাহিনী ‘রোডসাইড পিকনিক’ অবলম্বনে স্টকার সিনামাটি তৈরি হয়। এই লেখক দুই ভায়ের সাথে তারকোভস্কির দেখা হয় ১৯৭১ সালে। কিন্তু সিনামার শুটিং শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। ছবিটিতে সমকালীন কিছু নৈতিক সমস্যাকে তুলে ধরা হয়েছে। মানব জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের যে চিরন্তন দার্শনিক জিজ্ঞাসা সেটার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সিনামাটিতে। সুখের অনুসন্ধ্যানে মানুষ যে ব্যর্থ হতে বাধ্য, তারকোভস্কির উদ্দেশ্য ছিল সে কথাটিকেই স্টকারের মাধ্যমে তুলে ধরা। সিনামাটিতে বাস্তব ও কল্পনা, লিরিকাল ও এপিক, মনোজগৎ ও বাস্তব জগতের মেল বন্ধন দেখানোর প্রয়াস পেয়েছে। কোন একটি শুভ ব্যাপারে বিশ্বাস স্থাপন করে সেই লক্ষে পৌঁছানোর চেষ্টা করাই মূলত স্টকার সিনামাটির মূল বক্তব্য। একটি কাল্পনিক ভবিস্যত সময়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে পৃথিবীতে একটি বিস্ময়কর অঞ্চলের উদ্ভব ঘটে যেখানে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। মানুষের মাঝে এমন একটি বিশ্বাস আছে যে এখানকার একটি পরিত্যক্ত ভবনের কক্ষে প্রবেশ করলেই মনের সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়। জায়গাটিকে জোন নামে ডাকা হয় এবং কক্ষটিকে বলা হয় রুম। এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে স্টকার নামে পরিচিত কিছু লোক আছে যারা অর্থের বিনিময়ে জোনে নিয়ে জেতে পারে। এমনই একজন স্টকার একজন বিষণ্ণ লেখক যিনি লেখার ইন্সপিরেশন খুঁজে চলেছে তাঁকে এবং একজন প্রোফেসর যিনি নোবেল প্রাইজ পেতে ইচ্ছুক এমন দুজন মানুষকে পথ দেখিয়ে নিষিদ্ধ ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে রুমে ঢোকার আগেই তাদের বিশ্বাস টলে যায়। জোনের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের মনে প্রশ্ন জাগে। এমনকি স্টকারও সন্দিহান হয়ে ওঠে। তাই তারা জোনে প্রবেশ না করেই ফিরে আসে। চলচ্চিত্রে স্টকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলেকজান্দার কাইদানোভস্কি। বিশ্বের সেরা ৫০টি সিনামার একটি হিসেবে স্টকারকে ধরা হয়।

তিনি যুক্তরাজ্য ও সুইডেন ভ্রমণ করেন। সুইডেনে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষের তৈরি বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনভাবে ফিল্ম তৈরি করার কথা ভাবেন। এবং সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৯ এর গ্রীষ্মে অর্থাৎ ১৬ জুলাই তিনি ইটালির রোমে যান। সেখানে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু কবি টনিনো গুয়েরার সাথে যৌথভাবে তৈরি করেন ভয়েজ ইন টাইম নামের একটি ডকুমেন্টরি । ১৯৮০ সালে দুবন্ধু মিলে তৈরি করেন নস্টালজিয়া সিনামাটির স্ক্রিপ্ট। ১৯৮২ সালে নস্টালজিয়া ফিল্মটা বানানো শুরু করেন। কিন্তু সামনে এসে হাজির হয় ভীষণ বিপদ। মসফিল্ম কর্তৃপক্ষ আর অর্থলগ্নি করবেন না বলে জানিয়ে দেন। হাল ছাড়েন না তারকোভস্কি। তিনি ইতালির পাবলিক ব্রড কাস্টিং কোম্পানি আরএআই ( রেডিওটেলিভিশন ইতালিয়ানা) এর আর্থিক সহায়তায় ফিল্মের কাজ শেষ করেন। পরে এটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় এবং সেখানে এটি ফিপ্রেস্কি প্রাইজ এবং প্রাইজ অব দ্য ইকুমিনিক্যাল জুরি জিতে নেয়। রোবের ব্রেসোর সঙ্গে গ্র্যান্ড প্রিন্স স্পেশাল জুরি প্রাইজটিও জিতে নেন। একজন রুশ লেখক ও প্রোফেসর আন্দ্রেই গোরচেকভ রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতালির রেনেসাঁ স্থাপত্যের ইতিহাস পড়ান অথচ তিনি কখনো ইতালিতে যাননি। একসময় গবেষণার জন্য তিনি ইতালিতে যাওয়ার মনঃস্থির করেন। একজন দোভাষীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ইতালির নানা প্রাসাদ ও স্মৃতিসৌধ দেখা শুরু করলে তাঁর নিজের সমস্ত জ্ঞ্যান, গবেষণা ও পড়াশোনা সবকিছুই তাঁর কাছে একসময় নিরর্থক, মৃত ও শূন্য মনে হতে থাকে। তাঁর মনে হতে থাকে যে যারা এইসব স্মৃতিসৌধ, প্রাসাদ গড়ে তুলেছেন বা কল্পনা করেছেন তাদের আত্মা, হৃদয় এখানেই রয়ে গেছে, তারা সবকিছু বুঝতে পারেন, অবলোকন করতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করেন শুধুমাত্র বইপত্র, পুঁথি পড়ে এতদিন তিনি যা কিছু ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছেন তা আসলে কখনো পূর্ণত্বে পৌঁছাতে পারেনি। আসলে এইসব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি সবই উপলব্ধির ব্যাপার, এগুলো কোন ক্লাসঘরে ছাপানো বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি বুঝতে পারেন না, দেশগুলোর মধ্যে এতসব দেয়ালের কারণটা কি? সেইসব কৃত্রিম রীতিনীতিসমূহ যা মানুষকে অপরের থেকে আলাদা করে দেয় সেগুলোকে তিনি গ্রহন করেন না। আর এগুলোই তার আতঙ্কগ্রস্ত যন্ত্রণাকে উসকে দেয়। দুনিয়াদারি সম্পর্কে তার এই অপাপবিদ্ধ দৃষ্টি এবং দেশ ছেড়ে আসার বাস্তব অবস্থার সংঘাতের মধ্যে একদিন ডোমেনিকো নামের একজনের সাথে তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। লোকটি প্রকৃতপক্ষে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও বিষণ্ণ একটি মানুষ যিনি সাত বছর ধরে তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে পৃথিবীর খারাপ সংস্পর্শ থেকে বাঁচানোর জন্য গৃহবন্দী করে রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে একটি জলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে মিনারেল পুলের বা খনিজ পুকুরের একপাশ থেকে অন্যপাশ পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারলে এই পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। ডোমেনিকো তাঁর এই স্বপ্নটি পূরণ করার দায়িত্ব সে গোরচেভকে দেয়। গোরচেভ একসময় বিশ্বাস করতে থাকে যে তাঁর ভেতর ডোমেনিকো প্রবেশ করেছে ফলে সে একাধিক চেষ্টার পর জ্বলন্ত মোমবাতিটি পুকুরের অপর প্রান্তের একটি দেয়ালে প্রতিষ্ঠাপন করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। তারকোভস্কি নস্টালজিয়া সিনামাটিতে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত আবেগকে তুলে ধরতে চাননি বরং এটিকে তিনি একটি রোগ বা এমন একটি অসুস্থতা হিসেবে দেখিয়েছেন যা মানুষের আত্মার শক্তি, কাজ করার ক্ষমতা, বেঁচে থাকার আনন্দকে নিঃশেষ করে দেয়। তিনি বলেন, ‘ একটি কাহিনীর অবয়বে সমস্যাটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ইতালিতে আসা একজন সোভিয়েত বুদ্ধিজীবীর মধ্যে, আমি এই নস্টালজিয়ার ধরণ ও প্রবনতাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করতে চেয়েছি।’ নস্টালজিয়া কি ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারকোভস্কি বলেছিলেন, “নিছক অতীত সম্পর্কে শোকাচ্ছন্নতাই নস্টালজিয়া নয়। নিজের অন্তরের প্রতিভাকে গণ্য না করে, তাকে ঠিকভাবে সাজিয়ে না তুলে ব্যবহার না করে এবং এইভাবে নিজের কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে যে সময়কে বয়ে যেতে দিয়েছে তার জন্য বিষাদের অনুভূতিই নস্টালজিয়া।”

১৯৮৪ সালের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটান সেক্রিফাইস ফিল্মটির প্রস্তুতির কাজে। ইতালিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আর কখনো সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরবেন না বলে ঘোষণা দেন। নিজ দেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার কষ্ট থেকে তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন। সিনেমার জন্য সর্বচ্চো আত্মত্যাগেও তিনি পিছুপা হননি কখনো। স্টকার চলচ্চিত্র করার সময় ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়েই পরিত্যাক্ত পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের কাছে শুটিং চালিয়ে গেছেন। ধারণা করা হয় এরই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনভাবে ফিল্ম তৈরি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা মানুষটির ১৯৮৫ সালে লাং ক্যান্সার ধরা পড়ে। অবশ্য এতো কিছুর পরেও তিনি ৮৫ সাল পুরোটাই সুইডেনে ছিলেন এবং দ্য স্যাক্রিফাইস সিনামার কাজ চালিয়ে যান। সিনামাটিতে আমরা মানুষিকভাবে যন্ত্রণাক্লিষ্ট অ্যালেকজান্ডার নামের একজন মানুষকে দেখি যিনি পারমাণবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে তাঁর সবকিছু আত্মত্যাগে প্রস্তুত। তিনি মনে করেন যা কিছু তাঁর প্রিয় অর্থাৎ তাঁর বাড়ি, এমনকি তাঁর সন্তান লিটিল ম্যান তাঁকেও তিনি এই পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য স্যাক্রিফাইস করতে রাজি। ফলে একদিন তিনি তাঁর পরিবারের সবাইকে বাইরে বেড়াতে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সমুদ্রের পাশে অবস্থিত নিজের অত্যন্ত প্রিয় বাড়িতিতে আগুন ধরিয়ে দেন। অ্যালেকজান্ডার ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন অথচ আমরা দেখতে পাই আকস্মিক এক দুর্বিপাকের ঘোষণায় তাঁর জীবনে চরম দুর্দশা ঘনিয়ে আসে। তখন সে তাঁর শেষ আশ্রয় হিসেবে ভাগ্যবানকেই আঁকড়ে ধরে এবং ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য তাঁর নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করেন।

স্যাক্রিফাইস সিনামাটির শুটিং শেষ হওয়ার পর ৮৬ সালের জানুয়ারিতে। এরপর তিনি প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। নানাবিধ ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ছেলে আন্দ্রিয়ুস্কা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ছাড়া পেয়ে এসময় বাবার কাছে আসে। তারকোভস্কির হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ১৯৮৬ সালের ৯ মে মুক্তি পায় দ্য স্যাক্রিফাইস ছবিটি। এটিও কান চলচ্চিত্র ফেস্টিভ্যালে জিতে নেয় গ্রান্ড প্রিন্স স্পেশাল জুরি প্রাইজ, ফিপ্রেস্কি প্রাইজ, এবং প্রাইজ অব দ্য ইকুমেনিক্যাল জুরি। বাবার অসুস্থতার কারণে ছেলে বাবার হয়ে পুরষ্কারগুলো গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্যারিসের একটি হাসপাতালে আন্দ্রেই তারকোভস্কি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি ফ্রান্সের রাশিয়ান সেমেন্ট্রি সেন্ট জেনেভিয়েভ-দেসবোয়ারে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে।

এপিটাফে লেখা হয় ‘দেবদূতের দেখা পেয়েছিলেন এই মানুষটি’।

 

ফারহানা রহমান

প্রধানত কবি, গল্পও লিখে থাকেন। চলচ্চিত্র সমালোচনাতেও আগ্রহ অনিঃশেষ। ১৯৭২ সালের ১৩ আগস্টে ঢাকায় জন্ম। বেড়েও উঠেছেন ঢাকায়। পড়াশোনা প্রথমে পল্লবী মডেল হাই স্কুলে, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পরে ইডেন মহাবিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। উদার সংস্কারমুক্ত উচ্চ শিক্ষিত পিতা শেখ রহমতউল্লাহর ছায়ায় নাগরিক অনুষঙ্গে বেড়ে উঠবার কারণে সংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। মাঝে কয়েক বছর শিক্ষকতা এবং একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার পর এখন পারিবারিক ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অপরাহ্ণের চিঠি (২০১৬), অপেরার দিনলিপি (২০১৭) ও লুকিয়ে রেখেছি গোপন হাহাকার (২০১৯), শ্রেণীশত্রু (গল্পগ্রন্থ) ২০২০, বিশ্বসেরা সিনামা কথা(চলচ্চিত্রের উপর লেখা গদ্যের বই) ২০২০। এছাড়া, দিপাঞ্জলি (যৌথ) ২০১৭ ও মনোরথ (যৌথ) ২০১৮। তিনি বই পড়তে, মুভি দেখতে ও বেড়াতে ভালোবাসেন।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top