ওশেন ভংয়ের একগুচ্ছ কবিতা

অনুবাদ: ফারহানা রহমান

[ওশেন ভংয় ভিয়েতনামী-অ্যামেরিকান কবি, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক ও অধ্যাপক ওশেন ভং ১৯৮৮ সালের ১৪ অক্টোবর ভিয়েতনামের স্যায়গন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানিকটিকাট রাজ্যের রাজধানী হার্টফোর্ডে বেড়ে উঠেন।

ভংয়ের নানী ছিলেন মূলত ভিয়েতনামের গ্রামের একজন কিশোরী। যার সাথে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মিশিগানের বাসিন্দা নেভির একজন সাদা সৈনিকের বিয়ে হয়। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে ভংয়ের মা একজন। মিশ্র জাতিসত্তার অধিকারী হওয়ার ফলে এই পরিবারটি ভিয়েতনামী আইনে অবৈধ ঘোষিত হয়। এবং বাধ্য হয়ে ফিলিপাইনের রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এবং ঘটনাক্রমে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের কানিক্টিকাট রাজ্যের রাজধানী হার্টফোর্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

ভংয়ের কবিতাগুলোতে তিনি প্রায়শই মানব জীবনের আকাংখ্যা, সহিংসতা এবং কবিতার গঠন ও রূপান্তর নিয়ে কাজ করে থাকেন। ২০১৩ সালে এডওয়ার্ড জে রথকে কে দেওয়া সাক্ষাত্কারে ভং তাঁর রচনার গঠন এবং বিষয়বস্তুর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় উল্লেখ করেন যে, “কবিতায় আন্দোলনের বাহন হওয়া ছাড়াও আমি এর রূপটিও দেখতে পাই… কবিতার গঠন খেয়াল করার সাথে সাথেও আমি বিষয়বস্তুকে বর্ধন করার দিকে নজর দেই। এবং এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করি যেখানে কিছুটা পরবর্তী উত্তেজনাও তৈরি হয়। এবং কবিতাটির শেষ পংক্তি পর্যন্ত উচ্চারণ, ধ্বনির অভিঘাত, অলংকার এবং পুরো কাজের গতি যেন কবিতার সম্ভ্রমের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখি।” একটি কবিতার ক্রমবর্ধমান গতিতে প্রতিটি নতুন বাঁক তৈরি হয়।

এ প্রসঙ্গে ভং বলেন, “আমি মনে করি সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতাগুলো শেষ পঙক্তিতে এসে শেষ হয়ে যেতে যেতেও পুনর্জন্ম নেয় এবং গঠনরূপের হেরফের সেই শেষ হয়ে যাওয়া অবস্থাটিরও নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।”

ভং সিটি ব্রুকলিন কলেজ থেকে উনিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যে কবিতা বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভ করেন। ২০১৪ সালে তিনি রুথ লিলি কবিতা ফাউন্ডেশন থেকে ফেলোশিপ পান। এবং ২০১৭ সালে তিনি টি.এস. এলিয়ট পুরষ্কার পান। ২০১৯ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস “পৃথিবীতে আমরা খুব কমই আড়ম্বরপূর্ণ ছিলাম” প্রকাশিত হয়। বইটি নিউ ইংল্যান্ড বুক এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছিল। ইতিমধ্যেই ভংয়ের সাহিত্যকর্ম পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।]

পৃথিবীতে আমাদের চাকচিক্য নেই

১.
পূর্বজন্মে তুমি আমাকে বলতে
দুজন মানুষ তখনই প্রেমে মগ্ন হয়
যখন তাদের গাড়িটি ব্রিজের উপরেই
বাতাসের মতো ছুটে যায়
আর সেসময় তাদের শরীরে
পাখাও গজায়
কখনো কখনো আমিও তো গাড়ি নিয়ে ছুটে যাই
কখনো কখনো আমিও ওদের মতো
প্রেমে মগ্ন হতে চাই।

২.
আর কিছুই তো নয়
এসবই হয়েছে শুধুই বুভুক্ষের তাড়নায়।
দেহ জেনে গেছে
সে কখনো পারে না ধারণ করতে
ক্ষুধার ঐশ্বর্য
আমার দুহাত যেভাবে আঁকড়ে ধরে
তোমার বুকের খাঁচাটিকে
তেমনিভাবেই
গোধূলির এই বিস্ময়কর আলোও তো
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
নিদারুণ কোনো সংকটে।
তুমিও তো ডুবেই মরেছ
সেই কবেই আমার বুকের গভীরে-
চিরদিন তবে এভাবেই থেকো।
আর তাই তো নিজেকে
আড়াল করতেই বুঝি
নদীর ভেতরে দেহটিকে এভাবেই ঠেলে দাও

তবে তাই হোক।

৩.
মনে করো একেবারে হেরে বসে আছ,
ধরো চিনামাটির মতো কোমলতা পেয়ে গেছো
অথবা স্প্রিং দেওয়া ছুরি হয়ে গেছো।
হয়ে গেছো কোনো ফুলের ঝাড় সূর্যমুখীর,
মনে করো এটি শরৎকাল
ভাবো তোমার চোখের গভীরে এতোটা
সবুজ বিছিয়ে থাকা সত্তেও এটি শরৎকাল ই!
আহা! এতো যে সুন্দর!
তবু এটি তো দিনের আলোই তাই না?
ধরো, তুমি এর জন্য মরতেও রাজি ছিলে
অথচ তোমার কণ্ঠ জড়িয়ে ধরছে অবিচ্ছিন্ন ঊষাকাল
এভাবেই তোমার অবগাহনের মাঝে
আমি নিমজ্জিত হয়ে রই
যেভাবে করে ভূতলে আছড়ে পড়ে
মূর্ছা যায় কোনো
উড়ন্ত চড়ুই পাখী…

৪.
কেন আমরা ক্ষমার অযোগ্য ছিলাম সেটা বলবো। মাকে যেদিন পিঠমোড়া বাবা পিটালেন আর রান্নার টেবিল থেকে কড়াত তুলে নিয়ে গিয়ে তিনি বাথরুমে হাঁটু গেঁড়ে বসে অবিরাম কেঁদে চলেছিলেন। দেয়াল ভেদ করে বাবার গোঙানি সেই কান্না আমাদের কানের পর্দায় এসে লেগেছিল। এবং এ কারণেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে চূড়ান্ত মুহূর্তে পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

 

ফারহানা রহমান

প্রধানত কবি, গল্পও লিখে থাকেন। চলচ্চিত্র সমালোচনাতেও আগ্রহ অনিঃশেষ। ১৯৭২ সালের ১৩ আগস্টে ঢাকায় জন্ম। বেড়েও উঠেছেন ঢাকায়। পড়াশোনা প্রথমে পল্লবী মডেল হাই স্কুলে, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পরে ইডেন মহাবিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। উদার সংস্কারমুক্ত উচ্চ শিক্ষিত পিতা শেখ রহমতউল্লাহর ছায়ায় নাগরিক অনুষঙ্গে বেড়ে উঠবার কারণে সংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। মাঝে কয়েক বছর শিক্ষকতা এবং একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার পর এখন পারিবারিক ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অপরাহ্ণের চিঠি (২০১৬), অপেরার দিনলিপি (২০১৭) ও লুকিয়ে রেখেছি গোপন হাহাকার (২০১৯), শ্রেণীশত্রু (গল্পগ্রন্থ) ২০২০, বিশ্বসেরা সিনামা কথা(চলচ্চিত্রের উপর লেখা গদ্যের বই) ২০২০। এছাড়া, দিপাঞ্জলি (যৌথ) ২০১৭ ও মনোরথ (যৌথ) ২০১৮। তিনি বই পড়তে, মুভি দেখতে ও বেড়াতে ভালোবাসেন।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top