ডায়েরির শায়েরি
ফুয়াদ হাসান
*
আসমান ও জমিনের মাঝখানে যে সব অনুভূতি ঝুলছিল, তাদের কিছু খুঁজে পাবে এখানে। আর কিছু ছেড়া কাগজের টুকরো, দীর্ঘদিন বইচাপা পড়ে শুকিয়ে চেপ্টা হওয়া পাতাসহ একটি গোলাপ, হলুদ চিঠিপাতার ফাঁকে ফসিল হয়ে থাকা পুরাতনী ঘ্রাণ অথবা রঙহারা কোন প্রজাপতির খোলস। ওসব কথা জিজ্ঞেস করলে, কিছুই বলতে পারবো না। হয়তো এমন কিছু ঘটেইনি। খোদার আরস ঘুরে আসাটাকেও চমৎকার খোয়াব মনে হয়েছিল। অথবা একটি শুকনো পতঙ্গ ও ফুল কী আর ভূমিকা রাখতে পারে ঝরা পাতাদের জীবনে! এখন ও-সবকে একটি বারের জন্যও বাস্তব মনে হয় না, মনে হয় না–কল্পনাও। অতীত একজন নিহত সৈনিকের নাম। যে শহিদের এপিটাফে অশ্রুপাপড়ি ছিটানো বড় কাজ।
*
একপশলা বৃষ্টিতে যেন সব মেঘ শেষ। সেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে জানলা দিয়ে একটা একটা হারানো দিনলিপির পাতা ছিড়ে প্লেন বানিয়ে ভাসিয়ে দিতে গিয়ে ছেলেটা, মেঘের উড়ুক্কু ঢালে হাত আটকে ফেলেছিল। ভাতঘুম শেষে সবে এককাপ চা-নিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি, দেখি–রঙধনুর মতো সাতটি শিশু দিগন্তে ঝুলে রয়েছে, পূর্ব আমলের সন্তানদের আমিও চিনতে পারিনি। কারও চেহারা প্রতিসন্ধ্যায় কবরের পাশের শিমুলবৃক্ষ চূড়ায় বসে থাকা পেঁচাটির চোখ, মায়ের গোপন বাক্স থেকে রঙীন সুতো এনে লেজে লাগিয়ে দেওয়া পতিত ফঙিং, এন্টিনাতে ঝুলতে থাকা ঘুড়ি…, ঘুড়িটির মতো ছেলের আহত হাত ভাইদের জন্যে কাঁদছে।
*
কত তারিখ, কী বার, বাংলা কোন মাস চলছে তা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। লেখা আছে, “সেই রকম একটি দিন”! কেন লিখেছিলাম, কিছুতে মাথায় আসছে না। সেদিন আর আসবেও না।
*
যেসব দুঃখকষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম, ছেঁড়া হলুদপাতারা তা মনে করিয়ে দিল। রাতভর ব্যর্থতা ও দিবসের অক্ষমতাগুলো ফিনিক্স পাখির মতো নতুনরূপে জেগে উঠলো। সোজা হৃৎযন্ত্রণার পাশে। এখন আর সে আগের আদলে নেই, আমূল বদলে গেছে। তবুও তোমার উপেক্ষারা আবার আমার ভেতর বিরহের সুর বুনে দিচ্ছে। সেও তো এক প্রাপ্তি, পরন্তকালে পরম পুলক। আজকাল কেও আর উপেক্ষাও করে না, ফিরিয়েও দেয় না। এ-কালে আর কোন বিরহ নেই।
*
অনেক বছর তো লিখলাম। এতো হিসাব-নিকাশ লিখে রেখে কী লাভ হলো, জীবনের হিসাবই মিললো না। আর কিছু লিখবো না। বাকি যে ক’টাদিন টিকে থাকি শুধু সে-সব পড়ে, লেখা কাটাছেঁড়া করে, অতীতের ভুলগুলো শুধরে পার করে দেবো।
*
এ যেন টিভিতে পুরাতন খেলা দেখা। ফলাফল জানা, তবুও—দেখতে বসে পুনরায় আপসোস করা, ঐ ক্যাচটা যদি ধরা যেত, অতিরিক্ত সময়ের শেষ গোল। কারো আপসোসের প্রতি আজন্ম লোভ।
*
বনের আরো গভীরে চলে যাই তবে। সেখানে অন্তত কোন যান্ত্রিকতার যন্ত্রণা থাকবে না। টিভি, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটহীন। প্রকৃত অর্থে এমন কোন জায়গাই নেই এখন পৃথিবীতে। উচ্চতম জঙ্লা পাহাড়ের শেষ টংঘরটাতেও দেখা মিলবে লম্বা এন্টেনা। পল্লীবিদ্যুৎ এসে অর্ধেক যান্ত্রিক করে ফেলেছে আমাদের বাকি অর্ধেক জোকার্সবার্গের দুনিয়া। ‘অযান্ত্রিক’ স্রেফ একটা সিনেমার নাম—ঋত্বিক ঘটকের।
*
একবার ও-কে নিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিলাম, সঙ্গে সেও ছিল। মধ্যদুপুরেও সন্ধ্যের মতো ঘনবন। কাঁটালতাগাছ সরিয়ে হাঁটতে হচ্ছিল। সত্যিকার সন্ধ্যা নামার আগে অন্ধকার নামক অভূতপূর্ব এক ভূতের ভয়ে ও-সটকে পড়েছিল। অগত্যা সে-সহ বহুকষ্টে পথ খুঁজে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম। তারপর থেকে আর কোথাও ও-র কথা লেখা নেই।
অবশ্য সেও নেই এখন।
*
বৃষ্টিবনে হারিয়ে ফেলেছি অচেনা ফুলের নাম লেখা খয়েরি মলাটের খাতা। আধভেজা পৃষ্ঠাগুলো ঢেউ হয়ে মিশে গিয়েছিল অশোক, কাঠগোলাপ, কাঁঠালচাঁপা পাতাদের সাথে। ভাটার টানে যখন তারা ফিরে এলো—একদম অন্যরকম। পাতাদেরও কখনও ফুলের মতো দেখায়।
*
এদো পুকুরের সাথে লাগানো লিকলিকে খরস্রোতা নদীটির কথা লেখা আছে। হলুদভাতের পাশে টুকটুকি নাম ডাকতে পারা ময়নাটিরও। দু’জনই নেই এখন। ময়নার মায়ের দেয়া কাঁথারা নক্সী কেটেছে হারানো খাতায়। দুপুরের ভাতঘুম বিছানায় হেগে দেওয়া পায়রাযুগলের গান, সুমিআপার রাতামোরগের গল্প বা টিনের ছাদে নারকেলগাছের ঝাপটা—সবই লেখা আছে। খাবার নিয়ে মায়ের বসে থাকার পাশে দেরি
করে বাড়ি ফিরতাম বলে, যে কালো কুকুরটি
শুনসান কাঁচারাস্তার মোড়ে রাতভর অপেক্ষা করতো তার কথা কোথাও লেখা নেই।
*
দুধমাখা ভাইটি মায়ের একপাশে থাকতো। তার কাজ ছিল কিছুক্ষণ পরপর কাঁদা আর কাঁথা ভিজিয়ে দেওয়া। হারিকেলের মিনমিনে আলোর নিচে শীতের রাতগুলো তখন বড্ড একঘেয়ে ও দীর্ঘ। অন্যপাশে বুবু আর আমি মেতে থাকতাম এক ভিন্ন খেলায়। যার ঘুম ভাঙতো, সে—অন্যজনকে সরিয়ে চলে আসতাল মায়ের পাশে। সেই মা এখন তালপুকুরপারে একলা ঘুমায়।
*
বড় মসজিদের প্রধান ফটকে আতরওয়ালার সামনে জুমাবারে বায়োস্কোপের জটলা। চোখে সুরমা, হাতে-জামায় আতরখুশবো মেখে কানে গুজে দিত জর্দাভাতে মোরব্বার টুকরা সমান তুলো। দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম, নাটকের মেকাপম্যানের ছোঁয়ায় কীভাবে বদলে যায় দৃশ্যাবলী; নুরানি চেহারাগুলোর ঘোরাঘুরি দেখে আমারও হাতে-বুকে আতর লাগাতে ইচ্ছে হতো কিন্তু সাহস পেতাম না। পরিচিত ঘ্রাণ সব মিশে যেত দূর কুয়াশায়
*
যেসব বন্ধুরা স্কুল ছেড়ে চলে যেত তাদের কিছু একটা লিখে দিতে বলতাম। কী লেখবো বলে কেউ লিখতে লিখতে পুরো পৃষ্ঠাটাই শেষ করে ফেলত, কেউ লিখে রেখে যেত একটি নাম। ওসব দেখাতে গেলে হয়তো আজ বিশ্বাসই করবে না তারা। কে কোথায় চলে গেছে এখন। হাতের লেখার আদর্শ বাণীসমগ্রের মত কথাগুলো শুধু লেপ্টে আছে যেন রোলটানা বাংলা খাতায়।
*
নামের প্রথম বর্ণ নীলরঙে আঁকা,—থালের পিছনে, মগের তোড়ায়। প্রত্যেকের আলাদ টিনের মগ ও থালা। চারবেলা রান্নাঘরে ভাঙাপাটি বিছিয়ে বসে যেতাম পাঁচ ভাইবোন। বাবার সাদাগ্লাস আর কাচের বাসনের প্রতি ছিল শকুনের চোখ। লুকিয়ে কতোবার মিটিয়েছি সুধা। সাপ্তাহান্তে ফিরতো বাবা, বাকি দিনগুলোয় সুতির গামছায় খুঁজে নিতাম তার গায়ের গন্ধ।
*
বৃষ্টির দিনে খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার চেয়ে সুখের তুলনা আর কিছু হতেই পারে না। মানুষ যতো আধুনিক হচ্ছে বাথরুম তত কাছাকাছি চলে আসছে। প্রথমে ছিল খোলা আকাশের নিচে, দূরের জঙ্গলে, এরপর পুকুরের ওপারে। তারপর কলতলা হয়ে ঘরের পেছন থেকে সোজা বেডরুমের সাথে চিরতরে যুক্ত হয়ে গেল কখন,—কে জানে। মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে ততটা অসভ্য হয়ে যাচ্ছে। আদতে কোন কালে যে সভ্য ছিল—অনলি গড নোজ।
ফুয়াদ হাসান
জন্ম: ২ নভেম্বর ১৯৭৯ সাল; ধূরুং, বিবিরহাট, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
মোবাইল : ০১৮১৯৬২৩৯৮৬।
ই-মেইল : [email protected]
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। পেশা : শিক্ষকতা।
বাংলা বিভাগ, পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন মহিলা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
মানুষ মানুষ নয় হোমোসেপিয়ানস (২০০৪), রাফখাতার কাটাকুটি (২০১০),
অ্যা জার্নি বাই অ্যাম্বুলেন্স (২০১৮)।