মোস্তফা সোহেলের উপন্যাস: ময়ূখ হাওয়া

[আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, সাহিত্য ক্যাফে  তরুণ  ঔপন্যাসিক ও গল্পকার মোস্তফা সোহেলের  উপন্যাস ‘ময়ূখ হাওয়া’ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করবে । আমরা পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি উপন্যাসটি নিয়মিত পড়ার জন্য। – সাহিত্য ক্যাফে]

  এক

রাজধানীর পল্টনে বিরোধী দলের জনসভা চলছে। কেন্দ্রীয় নেতা মুহিবুল ইসলাম মুন্না বক্তব্য দিচ্ছেন। আজ সভাপতিত্ব করছেন দলের বর্ষীয়ান নেতা সোবহান সর্দার । বয়স ষাট হয়ে গেছে। চুলে পাক ধরেছে। অন্য সব কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন তিনি। সকালে পার্টি অফিসের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার সাথে মিটিং শেষ করে সরাসরি চলে এসেছেন জনসভায়। দুপুরে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিলো পার্টি অফিসে। কিন্তু জনসভার কারণে লাঞ্চ করার সময় পাননি সোবহান সর্দার ওরফে সাবু ভাই। দুবার ঢক ঢক করে ঢেঁকুর উঠেছে। পেটের ভেতরে কিরকম পাকাচ্ছে। একটা অস্বস্তি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন তিনি। পাশে বসে ছিলেন নেতার পিএস এবং এলাকার সাবেক কাউন্সিলর আউয়াল হোসেন। একই গ্রামে বাড়ি দুজনের। গত টার্মে সোবহান সর্দার প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় পার্সোনাল এসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলো সে । সেই থেকে সাবু ভাইয়ের সাথেই আছে আউয়াল । আউয়াল পকেট থেকে একটা করে পান বের করছে আর আস্তে করে মুখে পুরে নিচ্ছে। পান চিবুতে চিবুতেই মুখ নিচু করে গম্ভীর হয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য শুনছিলো সে। ভীষণ নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে তাকে। কেনো কে জানে?

সোবহান সর্দার ইশারা দিয়ে ডাকলেন আউয়ালকে । আউয়াল খুব দ্রুত কাছে এলো নেতার। নেতা আউয়ালকে পেয়ে একটু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মিন মিন করে বললেন , আউয়াল খিদা লাগছে। ব্যবস্থা করো। এই বালের মিটিং তো শেষ হইতে হইতে রাত আটটা বাজাইবো!

আউয়াল মুচকি হেসে জামার সামনের পকেট থেকে একটা পানের খিল্লি এগিয়ে দিয়ে বলে, এইটা খান নেতা। পান খাইলে খিদা লাগে না। তাছাড়া এই ভরা মজলিসে খাবার ম্যানেজ করা যাবে না স্যার ।

আউয়ালের কথা শুনে সোবহান সর্দার ওরফে সাবু ভাই রাগে চোখ-মুখ বিকৃত করে তাকান । ওর কানের কাছে মুখ এনে বলেন , আরে ব্যাটা, রাস্তার উল্টাদিকেই সত্তর আইটেমের হোটেল আছে। কাউরে পাঠা না? শুধু দুইটা নান আর ভুনা গরুর গোস্ত হইলেই চলবো। শরীর কিন্তু খুব খারাপ লাগতেছে।

আউয়াল আবার গম্ভীর হয়ে যায়। সেকেন্ডখানিক কি যেনো ভাবে। তারপর মোবাইল তুলে দ্রুত ফোনে কাউকে খাবার আনতে বলে। ফোনের কানভার্সেশন শুনেই খুশি হয়ে যায় নেতা। এতোক্ষণে মুখে একটা মিষ্টি হাসি লাগে তাঁর। আউয়াল বলে, বস কাম খতম। একটু অপেক্ষা করেন। খাবার আসতেছে। বাটার নান, তরকা ডাল আর মাটন কাবাব।

আইচ্ছা

বসের শরীর ঘামতেছে কেনো ?

কোনো সমস্যা ?

আইচ্ছা বস ঠিক আছেন ?

তাড়াতাড়ি খাওয়া নিয়ে আস আউয়াল। কথা কম বল।

খাবার আসতেছে বস। একটু অপেক্ষা করেন।

আউয়াল নেতার মন অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য বলে, স্যার একটা কৌতুক শুনবেন ?

কি কস ? চুটকি?

জী বস

ঠিক আছে বল। লো সাউন্ডে বলিস।

আউয়াল হাসতে হাসতে শুরু করে, সিলেটে আমাদের শরিক দলের এক দাদা ভোটে দাড়াইছিলো। হের্ নাম আবার সুধির চন্দ্র। মার্কা ছিলো তলোয়ার। সিলেটের লোকজন তারে নিয়ে শ্লোগান দিতেছিলো,

আমার বাই , তোমার বাই

ছুদির ভাই। ছুদির ভাই।

আবার শ্লোগান উঠলো, ছুদির ভাইয়ের মার্কা কি ? সিলেটি ভাষায় উত্তর এলো,

তর বাল, তর বাল।

এটুকু শুনেই নেতা হা হা করে হেসে উঠলেন। ‘এই ‘তর বাল’ মানে তলোয়ার না ? বুজছি’। বলেই আবারো হো হো করে হাসেন সোবহান সর্দার। আশে-পাশের নেতারা কিছুটা বিস্মিত চোখে তাকায় সাবু ভাইয়ের দিকে। সাবু ভাইয়ের চোখে-মুখে হঠাৎ করে অন্ধকার নেমে আসে। বুক চেপে ধরে আউয়ালের দিকে নির্মীলিত চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে সে, পানি পানি। পানি খাওয়া।

এ কথা বলেই স্টেজের উপরে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যান সোবহান সর্দার।

মুহূর্তেই স্টেজের দুএকজন কেন্দ্ৰীয় নেতা উদ্বিগ্ন মুখে ঘিরে ধরলেন প্রিয় নেতা সাবু ভাইকে । একজন এসে মিনিটখানিক হাতের পালস দেখলো। প্রফেশনাল ডাক্তারের মতো চোখ দুটো টান দিয়ে ভেতরের মনি দেখলো ! তারপর হতাশ দৃষ্টিতে উৎসুক নেতাদের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি ঠিক সিওর না। তবে সাবু ভাই বোধ হয় আর দুনিয়ায় নাই। ‘

এই কথা মুহূর্তে ছড়িয়ে গেলো স্টেজের বাইরে। এতোক্ষণ বক্তব্য দিচ্ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা মুহিবুল ইসলাম মুন্না! তিনি মাইক বন্ধ করে দিলেন। তার চোখে-মুখে আতঙ্কের চিহ্ন। সামনে বসা হাজার হাজার মানুষ স্টেজের দিকে এসে সাবু ভাইকে একনজর দেখার জন্য ভিড় জমাতে থাকে। একটা অদ্ভুত রকমের অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেলো মুহূর্তে। আউয়াল এর পাশে এসে ততক্ষনে দাঁড়িয়েছে জামান। দলের ইউনিভার্সিটি শাখার সেক্রেটারি। তাঁরা দুজনেই ধরাধরি করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছেন সাবু ভাইকে । সাবু ভাই নির্জীব।

আউয়াল খানিকটা হতাশ কণ্ঠে বললো , কোন হাসপাতালে নিবো ?

বসতো মনে হয় শেষ। নো নড়াচড়া।

জামান ফিসফিস করে বললো , সপ্তর্ষি হাসপাতাল। গুলশান।

ভিড় ঠেলে বেশ সহজেই ওরা দুজনে সাবু ভাইকে আউয়ালের ব্যক্তিগত গাড়িতে উঠিয়ে নিলো । পিছনের সিটে নেতাকে নিয়ে বসেছে আউয়াল। ঠিক ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে বসেছে জামান। বিভিন্ন চ্যানেলের দুএকজন সাংবাদিক ভিড় করে দাঁড়ালো গাড়ির সামনে। কিন্তু ড্রাইভার সালাম খুব চতুরতার সাথে ভীড় ঠেলে গাড়ি নিয়ে আস্তে আস্তে বড় রাস্তায় উঠে গেলো।

সোবহান সর্দার প্রানপনে চেস্টা করছেন কথা বলার। কিন্তু তার মুখ থেকে কথা বেরুচ্ছে না। তিনি হাত-পা নাড়তে চেষ্টা করছেন। পারছেন না। কে যেনো আহাম্মকের মতো তাকে জাপটে ধরে আছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন একটা অন্ধকার ঘর। দুজন মুখোশ পরা লোক তাকে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। সামনে বিকট আর এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে ডিম। অন্য হাতে রড। সোবহান হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।

লোকটি ক্রূর একটা হাসি দিয়ে বললো, তোকে রিমান্ডে এনেছি

আইচ্ছা

এখন তোর ইয়ের মধ্যে এগুলো ঢোকানো হবে

আইচ্ছা

এই মান্দার পুত। আইচ্ছা কিরে ?

সরি স্যার। গুড। যা বলছিলাম, আমার একহাতে ডিম। অন্য হাতে রড। চয়েস ইজ ইওরস। কোনটা দেবো ?

স্যার আমার অপরাধ ?

তুই নিজেই একটু চিন্তা-ভাবনা করে বল। কনফেশন টাইপ।

স্যার, স্ত্রীর সাথে সদ্ভাব নাই। বাপের বাড়ি চইলা গেছে এক বছর। মেয়েটা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমি বড় একা স্যার। কাজলি আমাদের গ্রামের মেয়ে। স্বামী ছাইড়া চইলা যাবার পর আমার বাড়িতেই থাকে বছর দুয়েক। সেই আমারে স্বইচ্ছায় দেয়। কোনো জোরাজুরি নাই। ইনফ্যাক্ট সে আমারে বাঁচাইয়া রাখছে। খুব ভালো মেয়ে। চেহারাও সুন্দর। শ্যামলা। স্লিম। আমিও স্যার খুব আদর-যত্ন করি ওরে। এইটা কি স্যার কোনো অপরাধ? বলেন স্যার ?

গো এহেড। তাড়াতাড়ি শেষ কর। সময় কম।

স্যার মন্ত্রী থাকার সময় অবশ্য কিছু দুর্নীতি করছি। অস্বীকার করবো না স্যার।

কি দুর্নীতি ?

মানে দুই/তিনটা প্রজেক্টের টাকা ভাগাভাগি। আর ঐ মন্ত্রণালয়ের কিছু কাজের জন্য ওপর মহলে তদবির-এই আর কি । তবে স্যার কাউরে বঞ্চিত করি নাই ।

কতো টাকা ?

স্যার, সব মিলায়া ৩০০ কোটি হবে। খুব বেশি না স্যার।

ঠিক আছে বুঝেছি। এখন রেডি হ।

মানে ?

পা ফাঁক কর। রড ঢুকাবো।

স্যার প্লিজ স্যার। আমার মেয়েটা এতিম হয়ে যাবে। ওরে স্যার। আমারে মাইরেন না স্যার। বুড়া মানুষ। না না না।

সাবু ভাইয়ের জ্ঞান ফিরেছে। তিনি নবজাতকের মতো এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছেন।   আউয়াল একটু একসাইটেড। সে চিৎকার করে বললো , সাবু ভাই বাঁইচা আছে। স্যারবাঁইচা আছে। স্যার একটু অপেক্ষা করেন। আমরা হাসপাতালে আইসা পরছি। ‘ কোনো ভয় নাই স্যার !

সাবু ভাই আউয়ালের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো , চুতমারানির পোলা। আমার খাওয়া কই ? আনছস ?

আউয়াল সে কথা শুনতেই পারলো না।

 

মোস্তফা সোহেল

জন্ম ১২ জানুয়ারি, ১৯৭০। যশোর শহরে। মা এবং মেঝো ভাই মোশতাক শাকিলের অনুপ্রেরণাতেই নিজেকে লেখালেখির ভুবনে প্রোথিত করেন নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশায় উন্নয়নবিদ। ঔপন্যাসিক, গল্পকার। মাঝে মাঝে কবিতাও লেখেন তিনি। এ পর্যন্ত মোস্তফা সোহেলের ১৫ টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত উপন্যাস: তুমি আমায় প্রথম ছুঁয়েছিলে, রূপালি রাত (২০১১, পলল ), আনন্দবাড়ী, (২০১২, জনান্তিক), বুনো জোৎস্নায় (জনান্তিক), মুখোশ (২০১৩, বিজয় প্রকাশ), নেতা (২০১৪), ভালবাসা ও একটি জলফড়িং (বিজয় প্রকাশ,২০১৫), বধূ কোন আলো (বিজয় প্রকাশ, ২০১৭), আমি কান পেতে রই, একদিন ঝুম বৃষ্টিতে (বাংলানামা ), মনপাহাড় ২০১৮, চোখের আলোয় দেখেছিলাম এবং সুন্দর তুমি এসেছিলে। ২০১২-২০১৩ সালে উপন্যাস নেতার জন্য তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুরস্কার লাভ করেন।

কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নিঃসঙ্গ টারমিনাল, সাদা মেঘে ওড়াই মৌনতা এবং শহরে রটে গেছে আমাদের প্রেমের কথা।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top