গলায় খুসখুসে কাশি আর জ্বর নিয়ে দুদিন আগেই হাসপাতালে নাকের সোয়াব আর গলার সোয়াব টেস্ট করবার জন্যে গিয়েছিল খুরশিদ। লম্বা লাইনের পেছনে প্রায় আড়াইঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সঙ্গে ছিল তার বড় ছেলে মোরশেদ। তারপর এই দুদিন বাড়ি বসে সোয়াব টেস্টের রিপোর্টের অপেক্ষা করছিল। এখন টেলিফোনে খবর পেল তার কভিড নাইটিন পজিটিভ এসেছে। অর্থাৎ করোনা তার শরীরে বাসা খুঁজে পেয়েছে।
খুরশিদ অবশ্য বুদ্ধিমান লোক। সে গত পরশু বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে ডেকে বলেছে, করোনা পজিটিভ বা নেগেটিভ যাই হোক না কেন আজ থেকে তুমি আর আমি আলাদা আলাদা ঘরে, যে ঘরে কাজের মেয়েটা এতদিন রাতের বেলা মেঝেয় ঘুমোতো সেটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দাও। এখন তো সে আর নেই। খাটটাও কাত করে রেখেছো, সেটাকে সোজা করো। সেখানে বিছানা পেতে দাও।
রোজিনা স্বামীর কথা শুনে খানিকটা কাঁদলো। সে একটু নার্ভাস ধরণের মানুষ। অবশ্য করোনার ব্যাপারে সবল মন বা দুর্বল সকলেই দেখা যাচ্ছে মোটামুটি সমান। মানে নার্ভাস।
তার ওপর কাজের মেয়ে নেই, করোনার ভয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সংসারের সব কাজ বলতে গেলে রোজিনার ঘাড়ে। উঠতি বয়সী দুটো ছেলে আছে বটে, কিন্তু তারা আর কী সাহায্য করবে।
একমাত্র বুদ্ধি বিবেচনা হীন মানুষগুলোই কেবল নির্বিকার।
তারাই কেবল বলছে, কি কইলেন? করোনা? এই বালাই-এর নাম তো জীবনে শুনি নাই! ঘূর্ণি ঝড়ের নাম হইলেও হইতে পারে। আইলা হইলে করোনাও হইতে পারে। তা আল্লা যা করে। এখন রোজার মাস। রোজা রাখতে হইবে। এত ঘন ঘন লবণ পানি দিয়ে গলা কুলকুচি কইরতে পারুম না, মাফ করতে হবে। আল্লা বাঁচাইলে করোনার কি সাধ্যি আছে?
বেশির ভাগ জনসাধারণের ধারণা এই রকম।
তো গত দুই দিন ধরেই খুরশিদ আলাদা ঘরে ঘুমোচ্ছে।
এখন দেখা গেল খুরশিদ করোনা পজিটিভ। সুতরাং তার বাইরে যাওয়া নিষেধ।
এখনই বাড়ির সকলকে মহাখালী গিয়ে করোনা টেস্ট করতে হবে।
খুরশিদের বাড়িও মহাখালী। সে দেড় কাঠা জমির মালিক। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত। ওপরে ছোট ছোট তিনটে শোবার ঘর। আর নিচে রান্না ঘর, ডাইনিং ও বসার ব্যবস্থা।
করোনা পজিটিভ শুনে খুরশিদ আলমের ছোট ছেলে খোরশেদ আলম দূর থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বাবাকে বলল, বাবা, তুমি বাঁচবে তো?
এই ছেলেটি তার মায়ের মতন নার্ভাস। মনে মনে ভাবল খুরশিদ। তবু ছেলের কথার উত্তরে মোবাইলে বলল, বাঁচবো। আমরা সকলে বাঁচবো। চিন্তা করো না। এখন তোমাদের মাকে নিয়ে শিগগির টেস্ট করে আসো। যদি আমরা সকলে পজিটিভ হই, তাহলে ১৪ দিন কোয়ারেনটাইন যার যার ঘরে। তখন মিজান চাচাকে খবর দেবে সে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করবে। নিচে দরজার গোড়ায় খাবার রেখে ফোন করে চলে যাবে। আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ আছে।
বাড়ি ছেড়ে রোজিনা তাড়াহুড়ো করে ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে গেল।
খুরশিদ চিন্তিত মনে একটা বই হাতে নিয়ে জানালার ধারে বসে থেকে ওদের চলে যাওয়া দেখল। রোজিনার কাঁধে ঢাউস একটা ব্যাগ। হয়তো ওর মধ্যে খাবার দাবার ভরে নিয়েছে। যদি ফিরতে দেরি হয় সেকথা ভেবে।
খুরশিদ একটা মাঝারি সাইজের চাকরি করে। দেশে কিছু ধানের জমি আছে। সুতরাং সংসার তার চলে যায়। ছেলে দুটো এখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি।
রোজিনারা যখন বাড়ি ছাড়ে তখন সকাল এগারোটা।
ওরা বাড়ি ছাড়ার পরপরই খুরশিদ অনুভব করল তার ঝেঁপে জ্বর আসছে।
সে বই ফেলে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন ঘুম ভাঙল দেখল ঘরবাড়ি অন্ধকার।
আরে, কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? বাড়িতে কোনো সাড়া শব্দও নেই।
সাধারণত রোজিনা এই দুদিন দরজার বাইরে খাবার রেখে দেয়। রেখে দিয়ে বলে, বাইরে খাবার রেখেছি, খেয়ে নাও। কাগজের প্লেটে খাবার দেয় রোজিনা। যার ফলে বাসন ধুতে হয় না। খেয়ে সিলোফেন ব্যাগে প্লেট ভরে ফেলে সে বাইরে রেখে দেয়।
এই দুদিন এভাবেই সে ম্যানেজ করেছে।
সুন্দর ব্যবস্থা। কোনো ফাঁকফুক নেই।
এখন বাড়িতে কোনো সাড়া শব্দ নেই!
খুরশিদ ঘুম থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের লাইট জ্বাললো। তারপর মোবাইলে সময় দেখল। রাত আটটা। রাত আটটা? আরে, কেউ আমাকে ডাকেনি কেন?
একটু হতবুদ্ধি হয়ে গেল খুরশিদ। কি করবে যেন বুঝে পেল না। যদিও মুখে রুচি নেই, তবু তো কিছু খেতে হবে। তাছাড়া প্যারাসিটামল খেতে গেলে পেটে কিছু পড়া দরকার।
খুরশিদ চেঁচিয়ে রোজিনার নাম ধরে ডাকল। সাড়া পেল না। তারপর বড় ছেলের নাম ধরে ডাকল, তারও সাড়া নেই। ছোটটি নার্ভাস ছেলে, তাই তাকে না ডেকে সে ধীরে ধীরে ঘরের দরজা খুলল। ভাতের প্লেটে নিতে গেলে তো প্রতিদিন তিনবার করে সে দরজা খোলে। বাথরুমে যাওয়ার সময় দরজা খুললে কেউ তার সামনে থাকে না। সে বাথরুমে ঢুকে ব্যবহার করার পর ব্লিচিং পাউডার দিয়ে নিজেই বাথরুম ধুয়ে ফেলে।
এখন দরজা খুরে সে হতবাক। পুরো বাড়ি অন্ধকার।
দরজার বাইরে সুইচ ছিল, খুরশিদের সেখানে হাত দেবার কথা নয়। বাড়ির লোকেরা সুইচ ধরে। এখন বাধ্য হয়ে সে হাতে গ্লাবস পরে নিয়ে প্যাসেজের বাতি জ্বাললো।
বাথরুমে যাওয়ার সময়ও সে হাতে গ্লাবস পরে।
বাতি জ্বেলে খুরশিদ অবাক।
বাড়িতে কেউ নেই।
রোজিনার ঘরের দরজা বন্ধ। ছেলেদের ঘরের দরোজা বন্ধ।
এবার দ্রুত ঘরে ফিরে এসে খুরশিদ মোবাইল করল।
রোজিনা যখন মোবাইল তুলল, তার পেছনে ভীষণ ঘড়ঘড় শব্দ।
ভীত স্বরে খুরশিদ চেঁচিয়ে বলল, রোজি, তোমরা কোথায়?
আমরা দেশে যাচ্ছি। আমার ভাইয়ের বাড়ি।
রোজিনার কথা শুনে খুরশিদের গালে মাছি পড়ার জোগাড়।
সে কোনরকমে ঢোক গিলে বলল, বলো কি? তোমরা করোনা টেস্ট করোনি?
না। করে লাভ নেই। ওখানে গিয়ে যে অবস্থা দেখলাম, আমাদের সকলেরই করোনা হয়ে যাবে। তাই ছেলেদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি।
আর আমি? হতভম্বের মতো বলে উঠল খুরশিদ।
তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। চাল ডাল তেল নুন ডিম আলু মশলা কালোজিরা হলুদ লেবু সব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে এসেছি রান্নাঘরের তাকে। ফ্রিজ খুললে মাছ মাংসও পাবে। দুধ, দুধও পাবে।
রোজিনার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল খুরশিদ।
তাহলে করোনা এতদূর মানুষের ভেতরে বিভেদ সৃষ্টি করে ফেলেছে?
তারপরও সে একবার বলল, কিন্তু তোমাদের টেস্ট? সেটা করবে না?
আমরা উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে করাবো। তুমি চিন্তা করো না।
এতবড় একটা কাজ করলে, আমাকে বলে গেলে না কেন ?
কথাটা বলতে গিয়ে অভিমান করবে না ভেবেও গলা কেমন যেন বুজে এলো খুরশিদের।
এই তাহলে আমার ভালোবাসার বউ? এই তাহলে আমার ভালোবাসার সংসার? মনে মনে ভাবলো খুরশিদ।
দিন দশেক যেতে না যেতে খুরশিদ দেখল আসলে সে সব করতে পারে। ভাত রান্না করতে পারে। সরসের তেল দিয়ে আলুভর্তা করতে পারে। চালে ডালে জবর খিচুড়ি রান্না করতে পারে। নিজের হাতে লেবুর রস, কালোজিরা ভর্তা, সুজির হালুয়া করতে পারে। আর চাই কি।
তারপরও হাতে সময় থাকে। ছেলেদের ঘর থেকে গল্পের বই বের করে পড়ে দিব্যি সময় কাটাতে পারে। বেশির ভাগই হরর বই। আর কিছু হ্যারিপটার। তাই সই। খুরশিদের নিজেরও কিছু কালেকশন আছে, যেমন রবীন্দ্র নজরুল বুদ্ধদেব বিভূতিভূষণ, এগুলো তার ছাত্র জীবনের কালেকশন। সে বাংলায় বিএ পাশ। কতবার এগুলোকে রোজিনা ঝামেলা মনে করে বাড়ি থেকে দূর করতে চেয়েছে। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলত, বইগুলো কোনো লাইব্রেরিতে দিয়ে আসো না কেন। আমাদের এই ছোট্ট বাড়িতে এসব বই রাখার জায়গা কোথায়।
তারপর বলে, ছেলেরা তো সব সায়েন্স পড়বে। ওদের তো এসব পড়ার কোনো শখ নেই।
কথাটা ঠিক।
রোজিনারও সখ ছিল না। সে পাসকোর্সে বিএ পাশ করেছিল। তারপর ঘরসংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
তবে রোজিনা রান্না করে ভালো।
এদিকে মিজান দু একদিন পরপরই ভাইয়ের জন্যে কিছু বাজার করে বাড়ির বাইরে রেখে দিয়ে ফোন দেয়। বলে, ভাইজান, কিছু লাগলেই আমাকে খবর দেবেন। চালডাল আরও কিছু ঘরে রাখতে হতে পারে। এই খতরনাক অসুখ কবে যে দেশ ছাড়বে কেউ বলতে পারছে না। ইয়োরোপ, আমেরিকা তো হেঁদিয়ে গেল।
উত্তরে খুরশিদ বলে, তুই চিন্তা করিস নে। আমি ম্যানেজ করতে পারবো।
মিজান বলে, দেশে ধান কাটার সময় হয়ে গেল। আমি তাহলে দেশ থেকে একটু ঘুরে আসি।
খুরশিদ বলে, খুব সাবধানে যাবি। এখন তুইই আমার ভরসা।
মিজান বলে, আমার প্রাইভেট গাড়িতে যাবো, আপনি চিন্তা করবেন না।
১৪ দিন দিব্যি পার হয়ে গেল। খুরশিদ সেরে উঠল। এদিকে রোজিনা দুইবেলা ফোন দেয়। খুরশিদ কখনো ধরে কখনো ধরে না। কারণ সে তখন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ব্যস্ত। খুরশিদ এই বয়সে এসে উপলব্ধি করে সে জীবনকে মোটেই ঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পারে নি। এখন সে যত বেশি করে এইসব বই পড়ছে যেন তার অন্তরের দৃষ্টি খুলে যাচ্ছে। কী সর্বনাশ, এতদিন ধরে খুরশিদ কীরকম জীবন যাপন করছিল?
এখন এই ছোট্টবাড়ির সমস্ত কিছু তার হাতের নাগালের ভেতরে। সে সারাদিনে কতবার করে যে ওপর নিচ করে। বই হাতে নিয়ে ছোট্ট এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করে। ছেলেবেলায় কবিতা আবৃত্তি করে কতবার যে সে পুরস্কার পেয়েছিল।
এখন ভাবছে অবস্থা ভালো হলে সে একটা আবৃত্তির ক্যাসেট বের করবে। বয়স বেশি হয়ে গিয়েছে? সে যাক। ক্যাসেট দিয়ে তো তার সংসার চলবে না। অফিস থেকে তাকে আরও কিছুদিন বাড়ি থাকতে উপদেশ দিয়েছে। সুতরাং সেদিক থেকেও কোনো সমস্যা হবে না।
আজ বিকেলে রোজিনা ফোন করল। বলল, সামনের সপ্তাহে আমরা শেরপুর থেকে রওনা দেবো। তুমি তো আল্লার রহমতে ভালো আছো। আমরাও আছি। বাচ্চারা এখন ঢাকায় ফিরতে চায়।
রোজিনার কথা শুনে মনে মনে যেন আঁতকে উঠল খুরশিদ। বলল, খবরদার এখন ঢাকার দিকে পা-ও বাড়াবে না। গতকালই একজন বাঙালি ডাক্তার যিনি আমেরিকায় চাকরি করেন তিনি ফেসবুকে সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন, একজন মানুষ যদি করোনায় ভোগে তাহলে ৩১ দিন পর্যন্ত তার শরীর থেকে করোনা ঝরে পড়তে থাকে। তাই সাবধান।
তার কথা শুনে রোজিনা বলল, তাহলে কি আরও দেরি করে আসতে বলো?
উত্তরে খুরশিদ বলল, অবশ্যই। যত দেরি করে পারো।
তোমার কষ্ট হচ্ছে না? মন খারাপ করে ওপ্রান্ত থেকে বলেই উঠল রোজিনা।
উত্তরে খুরশিদ বলল, নাহ, কেন কষ্ট হবে? তুমি তো সবকিছু গুছিয়ে রেখে গেছো। তাছাড়া ছেলেদের স্কুল বন্ধ। এসে কী লাভ?
কথা শেষ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল খুরশিদ। যাক, এখন কিছুদিন পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। সে আরও একটু সময় হাতে পাবে। বিয়ের পর এই আঠারোটা বছর যে কোত্থেকে পার হয়ে গেছে!
হাতে এককাপ গরম চা, তার ভেতরে আদাকুচি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল খুরশিদ।
ঘরের ভেতরে ঢুকে চায়ের কাপ বিছানার পাশের টেবিলে রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
ভাবল, এরপর থেকে এই ঘরেই সে ঘুমোবে।
চা খুব গরম। ঠান্ডা হতে একটু সময় নেবে। খুরশিদ বালিশ টেনে নিয়ে মাথায় দিয়ে আধো শোয়া অবস্থায় বিছানার চারপাশে দৃষ্টি ফেলল। এখন তার বিছানা জুড়ে বই। এই লাক্সারি সে বহুবছর ভোগ করতে পারেনি। বইয়ের স্তূপ থেকে সে এবার গীতবিতান হাতে নিলো। গীত বিতানের পাতা খুলে খুরশিদ চিৎকার করে গান জুড়ল, আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা, আলো নয়ন-ধোয়া আমার, আলো হৃদয়–হরা।
খুরশিদের গলা মোটে ভালো নয়। কিন্তু তাতে কি আসে যায়। কে আর তার গলা শুনছে। তাছাড়া আমরা প্রত্যেকেই জীবনে কখনো না কখনো আমাদের উৎসের দিকে ফিরি।
পরিচিতি
কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর জেলার চুড়িপট্টি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম রফিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও মা আছিয়া খাতুন একজন গৃহিণী। শৈশব ও কৈশোর কাটে যশোরে।
লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে। তিনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চাইলেও বাবার আগ্রহে ১৯৫৯ সালে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করেন। পরে ১৯৭৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন যান। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে মনোবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে মনোরোগ বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তী ছ’বছর যুক্তরাজ্য ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার বারডেম হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত আছেন।
সাহিত্য জীবন :
আনোয়ারা সৈয়দ হকের প্রথম ছোটগল্প পরিবর্তন ১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়। কলেজে পড়াকালীন সময়ে নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প, কবিতা লিখেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াকালে লেখালেখির পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। প্রথম উপন্যাস ১৯৬৮ সালে সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত হয়। তার ‘সেই প্রেম সেই সময়’ ও ‘বাজিকর’ উপন্যাসে সাধারন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে। ‘নরক ও ফুলের কাহিনী’ উপন্যাসে লিখেছেন তার ছেলেবেলার কথা। ‘বাড়ি ও বণিতা’ উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের সামাজিক সমস্যা।
তিনি বিশাল একটি সাহিত্য ভাণ্ডার তুলে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। এপর্যন্ত ১১টি ছোটগল্প, ৩৩টি উপন্যাস, ৬টি কাব্যগ্রন্থ, ৭টি প্রবন্ধ, ২৫টি শিশুসাহিত্য, ১টি অনুবাদ, ১টি
স্মৃতিকথা ও ১টি ভ্রমণকাহিনী রচনা করেছেন। আশার কথা তাঁর কলম এখনও সচল ও বেগবান।
পুরস্কার ও সম্মাননা :
• ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক- ২০১৯
• উপন্যাস শাখায় নৃ প্রকাশনী থেকে ছানা ও নানুজান-এর জন্য পাঞ্জেরী ছোটকাকু আনন্দআলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার – ২০১৯
• উপন্যাসে অবদানের জন্য বাংলা এলাডেমি সাহিত্য পুরস্কার- ২০১০
• কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার – ২০০৭
• ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার – ২০০৬
• অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার
• মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার
• শিশু একাডেমি পুরস্কার
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিনী। তাঁদের দুটি সন্তান, কন্যা বিদিতা সৈয়দ হক ও পুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক।