আনোয়ারা সৈয়দ হকের গল্প: পার্লারের মহিলা

এই পার্লারটা অভিজাত একটি ফাইভ-স্টার হোটেলের। এখানে কাস্টমার কম। কারণ যে কোন সার্ভিসই আকাশচুম্বী দাম দিয়ে কিনতে হয়। তবে সার্ভিস যারা দেয় তারা অত্যন্ত বিদগ্ধ।

স্বামী হারা রাশিদা একটা ঘোরের ভেতরে ছিলেন এতদিন। স্বামী মারা গেছেন মাত্র কয়েক সপ্তাহ। এখনও জামায় কাপড়ে বালিশে বিছানায় স্বামীর শরীরের গন্ধ লেগে আছে। স্বামীর স্নেহের স্পর্শ এখনও তিনি অনুভব করেন এবং সেটা এমন জীবন্ত যে তিনি বিলাপে ক্রন্দনে হাহাকারে সারা সারা রাত জেগে বসে থাকেন। স্বামীর ফটোগুলোর দিকে তাকিয়ে অনর্গল কথা বলেন। কত কথা। কত না বলা কথা। স্বামীর অসুখের তোড়ের সময় যেসব কথা বলতে পারেন নি বা বলতে মনে ছিল না, সেগুলো তিনি এখন বলেন। আর ফটোর স্বামী হাসিমুখে রাশিদার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

বাইরে, মানুষের সমুখে রাশিদা অতিশয় গম্ভীর। যা কান্নাকাটি করার ছিল সেসবই যেন করা শেষ হয়েছে। তার কারণ এখন কিছু কিছু আত্মীয় বলছেন, রাশিদা, আর না। আরও বেশি বিলাপ করলে লোকে বিরক্ত হবে। লোকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। তুমি একাকী হয়ে যাবে। শোকের প্রবাহ মানুষের জীবনের জন্যে নয়। কারণ এই প্রবাহ স্থবির। জীবন আনন্দের রাশিদা। জীবন বেগবান ।

আরেকজন সুহৃদ বললেন, জীবন সামান্য একজন মানুষের শোকে থেমে থাকে না। দেখ, তোমার স্বামী মারা যাবার পরপরই হলি আর্টিসান হল, কত মানুষকে খুন করা হল, কত ইয়ং ছেলেমেয়েকে ছুরি দিয়ে জবাই করা হল। তোমার অসুস্থ স্বামী তখন সিসিইউতে, অচেতন হয়ে পড়ে ছিলেন, এসব চোখে দেখে যান নি, সেটা ভালই হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে ছিলাম বা আছি আমাদের সেসব তাকিয়ে দেখতে হয়েছে। এই ঘটনার পর সারা জাতি শোকে মুহ্যমান হয়েছিল কতদিন, সেখানে তোমার পরিণত বয়সের স্বামী পৃথিবী ছেড়েছেন এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তাছাড়া ভাইসাহেব কোন কষ্ট অনুভব করেন নি। ভোর রাতে বুকে ব্যথা হল, তার পরপরই অজ্ঞান হয়ে গেলেন, তার পরপরই সিসিইউতে। দেখ, সবকিছু কত পরিষ্কার ভাবে হল। এটা ছিল তার তিন নম্বর হার্ট-অ্যাটাক। এইবার তো ভাইসাহেবের বাঁচার কথাই না!

রাশিদা সবই বোঝেন। তার ছেলেমেয়েরাও এরকম কথাই বলে। তারা বিদেশে থাকে। একজন আমেরিকায় আরেকজন অস্ট্রেলিয়ায়। তবে বাবার মৃত্যুর আগে আগে দুজনই এসেছিল। ছেলে অবশ্য বাবার মৃত্যু দেখে যেতে পারেনি, তার ছুটি ছিল না। আর সিসিইউতে থাকা বাবা কবে মারা যাবেন তারও ঠিক ছিল না। মেয়ে ছিল। কিন্তু তার স্বামী আসতে পারেনি। তবু সবকিছু খুব সুচারু এবং পরিচ্ছন্ন ভাবে সারা হয়েছে। এখন তো প্রায় রোজ ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে কথা বলে। নাতি নাতনিরাও কথা বলে। ওরা যতক্ষণ, বা যতটুকু কথা বলে রাশিদা ঠিক থাকেন, তারপর ওরা স্কাইপ থেকে সরে গেলে রাশিদার বুকের ভেতরে খুব কষ্ট হয়। এ-এমন এক কষ্ট যা শুধু স্বামীহারা মহিলারাই বুঝতে পারবে। তাঁর চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবন মনে হয় যেন অপূর্ণই থেকে গেল। কত কথা যে স্বামীকে বলা হল না।

তবে আগের বার যখন সোবহান সাহেবের হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল তখন একদিন সোবহান ভালো হয়ে ওঠার পথে রাশিদাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, দেখ বুলি, আমি আর তুমি এত বছর ধরে খুব সুখের একটা দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছি। আমাদের ওপরে আল্লার রহম। তবে আমি যদি কখনো হঠাৎ চলে যাই, তো তুমি কিন্তু একেবারে ভেঙে পড়বে না। তুমি আনন্দের সঙ্গে আমার কথা স্মরণ করবে। তুমি নিজের শরীরের যত্ন নেবে। তুমি নিয়মিত পার্লারে যাবে। তুমি ছেলেমেয়েদের কাছে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। তারপর সময় পেলে, যদি পাও, তাহলে তোমার আত্মজীবনীটা লিখবে। তুমি আমাকে আগে বলতে না যে ছেলেবেলায় তোমার লেখার সখ ছিল?

বেঁচে থাকার সময় কত স্বাভাবিক ভাবেই না সোবহান সাহেব একথা রাশিদাকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু এবারে সত্যি সত্যি যখন সোবহান চলে গেলেন তখন রাশিদা দেখলেন কোন কথাই আশ্বাসের নয়। সঙ্গীহীন কোন জীবনই অর্থপূর্ণ নয়। আকাশের নিঃসীম বুক চিরে চিলের মত যে আত্মবিলাপ রাতদিন বুকের ভেতরে বাজে, বুকের খোড়লে আঁকুপাকু করে ফেটে বেরিয়ে পড়বার জন্যে, সেই নিঃসঙ্গতা তো কোন কিছু দিয়েই ভরাট হবার নয়। কোন কথা , কোন আশ্বাসের, কোন মন ভোলানো, কোন নকশীকাঁথা পাড়, কোন ঝুনঝুনি, কোন রবীন্দ্রসংগীত, কোন কিছু , কোন কিছুই বের করে নেওয়া তালের শাঁসের খোলা তখন সামান্য বাতাসেই ক্রমাগত দোল খায়। নীরস, মলিন, শুষ্ক, শ্রীহীন। কারুণ্যের একশেষ।

রাশেদা তাই আজকাল বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। একাকী রাস্তায় রাস্তায় হাঁটেন। তাদের ছোট্ট একটা টয়োটা গাড়ি ছিল, যেটি এখনো আছে, কিন্তু ড্রাইভার খুব মেজাজ মর্জি নিয়ে চলে, কোনদিন আসে, কোনদিন আসেনা, পুরনো ড্রাইভার বলে রাশিদা কিছু বলেন না। সে ও যে তার মনিব হারিয়ে শোক পেয়েছে, এটা বুঝতে পারেন রাশিদা। কারণ তার সব আবদারই এতবছর সোবহান পূরণ করেছেন।

কিন্তু ড্রাইভার আজ ডিউটিতে এসেছে। গাড়ি ধোয়া মোছা করে সে দাঁড়িয়ে আছে নিচে। একবার কলিং বেল টিপে জানান দিয়েছে সে রেডি।

রাশিদা ড্রাইভার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন আজ। চলে এসেছেন বেশ খানিকটা দূরে, যেখানে এই পাঁচতালার হোটেলটি। লিফট দিয়ে উঠে এসেছেন দশতলায়। রিপোর্ট করেছেন।
আজ সেই মেয়েটি ডিউটিতে আছে। মেয়ে না বলে মহিলা বলা ভাল। বয়স চল্লিশের ওপরে। সাধারণত এই বয়সের মেয়েরা এভাবে পার্লারে কাজ করেনা। কিন্তু এই মহিলা করে। মহিলাটিকে রাশিদার পছন্দ। বেশি কথা বলে না। কথা বেশি বলা মহিলা রাশিদার পছন্দ নয়। কারণ তিনি নিজে বেশি কথা বলেন। সাধারণত এখানে কর্মচারীরা খুব একটা স্টেডি নয়। প্রায় প্রায় নতুন মুখের সঙ্গে পরিচয় হয়।
কিন্তু এই মহিলা পুরাতন।
রাশিদা তাকে দেখে বললেন, হাই।
মহিলা বিনীত ভাবে বলল, ভেতরে আসুন ম্যাডাম।
রাশিদা ভেতরে গিয়ে বসলেন। ছোট্ট পার্লার। মনে হয় শুধু হোটেলের রেসিডেন্টদের জন্যেই। কিন্তু রাশিদা এখানে আসেন। এই হোটেলের যিনি আসল মালিক তিনি সোবহানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন।

এইরকম নির্জন পার্লারই রাশিদার পছন্দ ইদানিং। বেশি ভিড় ভাড়াক্কা আজকাল তার ভাল লাগে না। অথচ রাশিদা সারাজীবন হৈ চৈ করা মানুষ। এবং মনে হয় এজন্যেই সোবহান তাকে পছন্দ করতেন। সোবহান নিজে ছিলেন যদিও স্বল্পভাষী।

প্রথমে এই হোটেলে সোবহানই তাকে সঙ্গে করে এনেছিলেন। এমন কি সেদিনও রাশিদা যখন এই পার্লারটিতে এসেছিলেন, সোবহান ওয়েটিং রুমে চুপ করে বসেছিলেন। সামনে তার একগাদা ইংরেজি ম্যাগাজিন পড়েছিল তিনি তার একটাও হাত দিয়ে নাড়েন নি। তার পকেটে দামী হাইফাই স্মার্ট ফোন ছিল, সেটিও খোলেন নি, শুধু চুপ করে বসেছিলেন জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে।
তার কিছুদিন আগেই ভুগে উঠেছিলেন জ্বরে।

একবার রাশিদা মাথায় রঙ দেয়া অবস্থাতেই উঠে পড়ে বাইরে বেরিয়ে বলেছিলেন, মিলন, তোমার নিশ্চয় বোরিং লাগছে। তুমি নিচের লাউঞ্জে গিয়ে বসো। কোন বন্ধুর সঙ্গে কথা বল। আমার তো এখানে একটু দেরি হবে।

তো উত্তরে মিলন বলেছিলেন, আমি এখানেই বেশ আছি। তুমি চিন্তা করো না।
সোবহান পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার পর রাশিদার কেন জানি মনে হয়, সোবহান বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি আর বেশিদিন পৃথিবীতে নেই। তাই সময় বা সুযোগ হলেই রাশিদার কাছ ছাড়া হতেন না। সোবহানের সেই চুপ করে বসে থাকা রাশিদা যতবার স্মৃতির ভেতরে দেখে ওঠেন ততবার তার চোখ অশ্রুপ্লাবিত হয়ে ওঠে।
সে বুঝতে পেরেছিল!
গদিআঁটা রিভলভিং চেয়ারে বসে মনে মনে এখন বললেন রাশিদা।

তার সামনে পেছনে বাতি ঝলমল ঘরে ঝকঝক করছে বড় বড় আয়না। দেয়ালের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো। সেখানে চেহারা প্রতিফলিত হচ্ছে বড় জমকালো ভাবে। সবকিছু বড় উজ্জ্বল, বড় সৌখিন। এখানে যেন সুখ ছাড়া আর সব কিছুর প্রবেশ নিষেধ!
এতবড় ব্লাফ আর কী হতে পারে?
মনে মনে ভাবলেন রাশিদা।
ভেতরে এখন শুধু এই মহিলা। ঘরে আর কেউ নেই। রাশিদার বিস্ময় অনুমান করে মহিলা বলল, আজ মনিকা ছুটিতে আছে, ম্যাডাম। আজ সোমবার তো। ভিড় কম।
মহিলা তার চুলে পছন্দের রঙ দিতে শুরু করল। এখন সে রাশিদার পেছনে দাঁড়িয়ে কাজ করছে।

রাশিদা মহিলার উদ্দেশ্যে সমুখের আয়নার দিকে তাকিয়ে বললেন, গতবার আমার স্বামী মিস্টার সোবহান সিরাজ এসেছিলেন আমার সঙ্গে, আপনার মনে আছে?
মহিলা সে কথার উত্তরে মাথা হেলিয়ে বলল, জি।
রাশিদা আয়নায় মহিলার মুখ দেখে বুঝলেন তার মনে নেই। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দিলেন না।
বললেন, গতবার আমার স্বামী সোবহান সাহেব আমার সঙ্গে এসেছিলেন। যতক্ষণ না আমার কাজ এখানে শেষ হয়, ততক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। সেদিন মনে আছে আপনিই আমাকে সার্ভিস দিয়েছিলেন।
এরপর একটু থেমে রাশিদা বললেন,
তিনি আর নেই। গতমাসের প্রথম সপ্তাহে মারা গেছেন। খবরের কাগজে,সবকটা কাগজে, তাঁর ছবিসহ সেই খবর ছাপিয়েছে, আপনি দেখেন নি?
না, মহিলা সে খবর দেখেনি। সে একটু অপ্রভিত হয়ে মাথা নেড়ে আবার চুলে রঙের পোঁচ দিচ্ছে।
রাশিদা স্বপ্নাচ্ছনের মত বলে চললেন, জানেন আমার স্বামী খুব বড় একজন ইকোনমিস্ট ছিলেন। বাংলায় যাকে বলে অর্থনীতিবিদ। অর্থনীতিবিদ, বুঝলেন?
উত্তরে মাথার পেছন থেকে মহিলা বলল, হ্যাঁ
রাশিদা বললেন, একবার অমর্ত্য সেন এসে তাঁকে বললেন, আপনার মত অর্থনীতিবিদ যে দেশে আছেন, সে দেশের চিন্তা কি? আপনি তো দেশে থেকে এভাবে দেশের সেবা করছেন। আমি তো পারলাম না।

মহিলা তার চুলের রঙ সেরে এবার মাটিতে বসে রাশিদার পায়ের নখ পরিষ্কার করছে।
ওপর থেকে মহিলার মাথা দেখছেন রাশিদা। লালচে রঙ করা চুল। একেবারে পাট পাট করে সাজানো। দেখতে ওপর থেকে খুব পরিষ্কার লাগছে।
চেয়ারে বসে মহিলার কোলে পা রেখে রাশিদা বললেন,
আমার স্বামী মারা যাবার আগে বার বার করে বলে গেছেন আমি যেন আমার নিজের শরীরের যত্ন নিই। আমি যেন নিয়মিত পার্লারে গিয়ে নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি। আমি যেন কখনো কাতরতা নিয়ে, বিমর্ষতা নিয়ে, হাহাকার নিয়ে চলাফেরা করিনে। যেন কোন মানুষ বুঝতে না পারে স্বামী হারিয়ে আমি অসহায়!
মহিলা এবার তার নখ পরিষ্কার করে পায়ের গোড়ালি পরিষ্কার করছে। স্পঞ্জ দিয়ে পা ঘষছে। ঝুঁকে সেটা তাকিয়ে দেখলেন রাশিদা।
তারপর কণ্ঠে একটু উচ্ছলতা টেনে এনে বললেন, জানেন, আমার স্বামীর সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, আমরা যখন প্রেম করতে শুরু করি তখন একদিন আমার স্বামী, তখন তিনি বয়সে অনেকই তরুণ, তার বাবার গাড়ি চুরি করে চালিয়ে আমাকে সাভারের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে একজায়গায় বংশী নদীর তীরে আমি পানিতে পা ডুবিয়ে বসে খেলা করছিলাম। আমি নদী চিনতাম না। তিনি বললেন বংশী নদী। তিনি ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পানির নিচে আমার পা দুটোর খেলা দেখে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আমার শাদা খরগোশ দুটো এভাবে পানিতে জলকেলি করছে!
তখন আমি দেখতে খুব ফর্সা ছিলাম তো!

পার্লারের মহিলা এবার তার পায়ে যত্ন করে ক্রিম মাখিয়ে দিচ্ছে।
পার্লারের এই মহিলাটি ভাল। মনে মনে বললেন রাশিদা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম কি?
মহিলা বললেন, আমার নাম কামরুন, ম্যাডাম।
কামরুন? বেশ ভাল নাম। ভার্সিটিতে পড়তে আমার এক সতীর্থের নাম ছিল কামরুন। সে এখন স্টেটস্ এ আছে। এক মেয়ে।

তারপর ঝুঁকে পা দেখতে দেখতে বললেন, এই যে দেখেন, আমার স্বামী মারা গেছেন, কেউ দেখলে আমাকে বলতে পারবে না যে, আমি শোকাহত। কেউ আমাকে করুণা করতে পারবে না। কেউ না। আমার যত শোক সব গোপনে। গোপনের গোপন। রাতে তার মাথার বালিশে মাথা রেখে আমি কাঁদি। চোখের পানিতে আমি রোজ তাঁর মাথার বালিশ ভেজাই। আমার স্বামী বলে গেছেন, সোনা আমার, আমাকে যেন মিস করো না! আমি তোমার সঙ্গেই থাকব। তাই কখনো, কখনো, কখনোই আমি তাকে মিস করি না! কখনোই- সরি, কামরুন, আপনার স্বামী কি করেন?
কামরুনের জাম রঙের ঠোঁটে এবার যেন বঙ্কিম হাসি ফুটল।
মুখ তুলে সে বলল, আমি তো বিয়ে করিনি ম্যাডাম!
কেন? যেন হতভম্ব এবার রাশিদা।
কামরুন বলল, বিয়ে আমি হেইট করি। আমার বড় বোনকে তার স্বামী যৌতুকের জন্যে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলেছিল। বিয়ে, স্বামী, সন্তান আমি তাই হেইট করি, হেইট, হেইট!

 

পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর জেলার চুড়িপট্টি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম রফিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও মা আছিয়া খাতুন একজন গৃহিণী। শৈশব ও কৈশোর কাটে যশোরে।
লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে। তিনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চাইলেও বাবার আগ্রহে ১৯৫৯ সালে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করেন। পরে ১৯৭৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন যান। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে মনোবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে মনোরোগ বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তী ছ’বছর যুক্তরাজ্য ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার বারডেম হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত আছেন।

সাহিত্য জীবন :
আনোয়ারা সৈয়দ হকের প্রথম ছোটগল্প পরিবর্তন ১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়। কলেজে পড়াকালীন সময়ে নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প, কবিতা লিখেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াকালে লেখালেখির পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। প্রথম উপন্যাস ১৯৬৮ সালে সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত হয়। তার ‘সেই প্রেম সেই সময়’ ও ‘বাজিকর’ উপন্যাসে সাধারন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে। ‘নরক ও ফুলের কাহিনী’ উপন্যাসে লিখেছেন তার ছেলেবেলার কথা। ‘বাড়ি ও বণিতা’ উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের সামাজিক সমস্যা।
তিনি বিশাল একটি সাহিত্য ভাণ্ডার তুলে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। এপর্যন্ত ১১টি ছোটগল্প, ৩৩টি উপন্যাস, ৬টি কাব্যগ্রন্থ, ৭টি প্রবন্ধ, ২৫টি শিশুসাহিত্য, ১টি অনুবাদ, ১টি
স্মৃতিকথা ও ১টি ভ্রমণকাহিনী রচনা করেছেন। আশার কথা তাঁর কলম এখনও সচল ও বেগবান।

পুরস্কার ও সম্মাননা :
• ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক- ২০১৯
• উপন্যাস শাখায় নৃ প্রকাশনী থেকে ছানা ও নানুজান-এর জন্য পাঞ্জেরী ছোটকাকু আনন্দআলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার – ২০১৯
• উপন্যাসে অবদানের জন্য বাংলা এলাডেমি সাহিত্য পুরস্কার- ২০১০
• কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার – ২০০৭
• ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার – ২০০৬
• অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার
• মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার
• শিশু একাডেমি পুরস্কার

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিনী। তাঁদের দুটি সন্তান, কন্যা বিদিতা সৈয়দ হক ও পুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top