দিলারা হাফিজের মক্তগদ্য: বাংলা বানানে—যুক্তবর্ণের কানাগলি

বাংলা ভাষায় যুক্তবর্ণের তালিকা বেশ দীর্ঘ।
আমরা জানি ভাষা হলো মানব জীবনকে স্পর্শের অসীম এক বাহন। মানুষের মুখেই ভাষার জন্ম, নদীর মতোই গ্রহণ বর্জনের মধ্যেদিয়ে তার বিকাশ, বিস্তার এবং স্রোতের মতোই গতিময়। অপূর্ব কথন শৈলিতেই ভাষার রূপ-মাধুর্য নিহিত।

যুক্তবর্ণ বলতে একাধিক ব্যঞ্জনবর্ণের সমষ্টিকে বোঝানো হয়ে থাকে।
বাংলা লিখনপদ্ধতিতে যুক্তবর্ণের একটি বিশেষ স্থান আছে। এগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর্ণগুলির চেয়ে দেখতে ভিন্ন, ফলে নতুন শিক্ষার্থীর এগুলি লেখা আয়ত্ত করতে সময়ের দরকার হয়।
একটি বর্ণ প্রায়শ অন্য বর্ণের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিকভাবে সংযুক্ত হয়ে অনেকগুলো যুক্তবর্ণ সৃষ্টি করেছে আমাদের বাংলাভাষায়। যুক্তবর্ণগুলো সংখ্যায় প্রায় দুই শতাধিকের অনেক উপরে।
ছোটবেলায় না বুঝেই অনেকের মতো আমিও তা মুখস্থ করেছি, লিখতেও শিখে গেছি।
তবে, অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তবর্ণগুলোর বিচ্ছিন্নরূপ আলাদা করে শিক্ষকেরা শেখায়নি বলে অনেক কিছুই জানার বাইরে ছিলো। কিন্তু নিজে যখন শিক্ষকতায় যুক্ত হলাম, তখন মনে হলো, আর তো ফাঁকি ঝুঁকি চলবে না। এবার প্রকৃত সত্যটা জেনে শ্রেণীকক্ষে যেতে হবে। নইলে কে জানে কবে কোন্ এক জ্ঞানী শিক্ষার্থীর সামনে পড়ে নাজেহাল হতে হয়।
লজ্জা-শরমের ভয় থেকেই অজানাকে কিছুটা জানতে চেষ্টা করেছি, তবে ভাষার শৃঙখলা ও তুমুল জ্ঞানের জগতে আমার সামান্য এই জানা নুন-সমুদ্রের নস্যি মাত্র।
বাংলা ভাষায় অনেক যুক্তবর্ণের সমাহারের মধ্যে প্রথমেই মনে হলো খীয়(ক্ষ)এর কথা। আমাদের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক বর্ণটির নাম শিখিয়েছিলেন আমাকে যুক্ত(খ+খ) ক্ষ। আমিও বহুদিন মনের আনন্দে যুক্ত খ বলে এসেছি। অবিশ্বাস করারও কারণ ছিলো না। কেননা পরীক্ষা, শিক্ষা, দীক্ষা, নিরীক্ষা, অপেক্ষা— লিখে তো আমি মূলত উচ্চারণ করতে শিখেছি (পরীখ+খা), শি+খ+খা/ দী+খ+খা/ এবং নি+রিখ+ খা।
কিন্তু গোল বাঁধলো ’আকাঙ্খা’ বানানটি এভাবে দেখে। আবার ‘আকাঙ্ক্ষা’র সংহত এই রূপেও দেখি বিভিন্ন লেখকের বিচিত্র সবরচনায়। কোনটি সঠিক?
একদিন আমার গুরু কবি রফিক আজাদকে প্রশ্ন করে জানলাম—একমাত্র শুদ্ধ বানান হলো— ‘আকাঙ্ক্ষা’।
কেননা, হিন্দি সিরিয়ালে দেখবেন আকাঙ্ক্ষার উচ্চারণ হলো ( আকাক+ষা)।
কারণ কি?
কারণ এই যে, ‘ক্ষ’ খীয় নামক এই বর্ণটি যুক্ত হয়েছে (ক+ষ) দুটি বর্ণ মিলে।
যে কারণে বাংলা উচ্চারণে হলিউড নায়িকা মাধুরী দীক্ষিতকে বলি (মাধুরী দী+খ+খিত)।
মোটামুটি এভাবেই উচ্চারণ শোভা পায় আমাদের মুখে।
কিন্তু হিন্দিতে বলা হয় মাধুরী (দীক+ষিত= ক+ষ) যুক্ত দুটি বর্ণ ক এবং মূর্ধণ্য ষ এর উচ্চারণ এখানে হুবহু লক্ষণীয়। কিন্তু বাংলাভাষায় এসে তিনি রূপ পাল্টে যুক্ত খ এর মতোই উচ্চারণ হয়ে থাকে। তবে আমাদের মনে রাখতে যুক্ত বর্ণটি মধ্যে লুকিয়ে আছে দুটি ব্যঞ্জন বর্ণ, (ক+ষ)। এবং এই যুক্ত বর্ণটির নাম খীয়।
লক্ষ্মী লিখতেও ‘ক্ষ’ বর্ণের সঙ্গে ম যুক্ত করে লিখতে হয়। কিন্তু ‘ক্ষ’দিয়ে যেসব শব্দ আরম্ভ হয়, তার উচ্চারণ কিন্তু খ এর মতোই থেকে যায়। যেমন,
ক্ষমা, ক্ষতি, ক্ষত্রিয়, ক্ষুধা, ক্ষণ ইত্যাদি।

এই আলোচনায় আমরা সামান্য জ্ঞান অর্জন করলাম বটে, কিন্তু জ্ঞানের প্রথম বর্ণটি একটি যুক্ত বর্ণ। এক্ষেত্রে কোন্ বর্ণটি ভালোবেসে কার গলায় মালা পরালো, বলুন তো বন্ধুরা। তবে প্রেমের ব্যাপারে ছেলে বুড়ো সবারই আগ্রহ প্রায় সমান, ধরে নিচ্ছি আপনারা সবাই তা জানেন। তবু আপন মনেই বলে রাখি দুইজনের সংযুক্তিটা কিন্তু মন্দ নয়।—(জ+ঞ)জ্ঞান বলে কথা!
অর্থাৎ দু’জন ব্যঞ্জন বর্ণ, জ এর সঙ্গে ঞ এর আলোকিত প্রেমেই সৃষ্টি হয়েছে (জ+আ+ঞ+ন) জ্ঞান নামক প্রেমের জ্ঞান ও গরিমা।
বিজ্ঞান, অজ্ঞান লেখা ছাড়াও সজ্ঞানে যদি কোনো কাজ করেন, তাহলে যেতে হবে যুক্ত বর্ণ ‘জ্ঞ’কাছে।

পঞ্চম লিখতে দরকার হবে(ঞ+চ)।
চকিতে চঞ্চল হলেও সেই একই যুক্ত বর্ণ( ঞ+চ)।
মায়ের শাড়ির অঞ্চলের মায়া কে ভুলতে পারে? কাজেই অবশ্যই মনে থাকবে যে, সরস হাওয়া খেতে গভীর বনাঞ্চলে যেতে হলেও(ঞ+চ=ঞ্চ) শেষ ভরসা।

আমার পুত্র অভিন্ন তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। বাংলা খাতায় তার শিক্ষক ‘মঙ্গল বার’ এবং সঙ্গে’ বানান লিখে দিয়েছেন চন্দ্রবিন্দুসহ- মঙ্গঁল এবং সঙ্গেঁ।
আমার সন্তান এই বানানকে শুদ্ধ বলে শিখে নিচ্ছে। আমি যখন বুঝিয়ে বললাম, বাবা তোমার শিক্ষক ভুল করেছে। বানানটিতে(ঙ+গ) সংযুক্ত থাকায় অনেকেই ঙ বর্ণের মস্তকের অংশকে চন্দ্রবিন্দু (ঁ) মনে করে ভুল করে, সঙ্গেঁ ও মঙ্গঁলের উপরে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে থাকে।
আমার এই ব্যাখ্যা তার মনপুত নয়। কিছুতেই তা সে বিশ্বাস করতে রাজি নয় যে, তার শিক্ষক ভুল করতে পারে। ঐ বয়সে অবশ্য আমাদেরও শিক্ষকের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিলো।
ভাবলাম, আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। সে ভুল শিখবে, এটা মানি কি করে? ছেলে যখন আমার বলা শুদ্ধ বানানকে গ্রহণ করছে না, তাহলে আমি বরং বাংলার ঐ শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে সংশোধন করে দেবো তাকে।
যেই না এমন সিদ্ধান্ত নিলাম, ওমা, আমার ছেলে কিছুতেই রাজি নয়। সে বলে, মা তুমি এটা বললে, আমার শিক্ষক আমার উপর ক্ষেপে যাবে, নম্বর আরো কমিয়ে দেবে। আমার সঙ্গে মিসবিহেভ করবে। প্লিজ, মা তুমি এটি করো না।

তারপরও আমি ছেলেকে না জানিয়ে ঐ শিক্ষকের সঙ্গে বানানটির শুদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছি এ কারণে যে, আমার সন্তান ছাড়াও তার ক্লাসের অগণিত ছাত্র এই ভুল বানান শিখে সারা জনম তা বয়ে বেড়াবে।
তার সঙ্গে কথা বলার পরে দেখি, আমার ছেলের কথাই সত্যে পরিণত হয়েছে। ভুল বানানের শুদ্ধতা নিয়ে কথা বলায় কৃতজ্ঞ না হয়ে সে বরং অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। এরকম বহু সমস্যাই বাঙালির মজ্জাগত। আমার ধারণা এসব ইগো অতিক্রম করে ধীরে ধীরে আমরা সামনের দিকে যেতে পারি।

একজন শিক্ষক হিসেবে যে বিদ্যা নিয়ে আমরা বড়াই করতে ছাড়ি না, সেই বিদ্যা এবং বিদ্বান বানানের তফাৎটাই অনেক সময়মাথায় থাকে না। অনেকেই বিদ্যা বানানের অনুকরণে ’বিদ্যান’ লেখে ভুল করে।
এজন্যেই বিদ্যা আর বিদ্বানের তফাৎটা যেমন মনে রাখা দরকার, তেমনি তার সূত্রটিও।
‘ব’ফলা যদি শব্দের মধ্যবর্তী বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় তবে ঐ বর্ণ দ্বিত্ত অর্থাৎ দু’ বার উচ্চারিত হবে। যেমন—
বিদ্বান—(বিদ+দান)
বিশ্বাস(— বিশ+ শাস)
শাশ্বতী—( শাশ+শতি)
সরস্বতি—( সরস+ সতি)।( যুমনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে/ যুমনা যাবে শ্বশুর বাড়ি ছাতা মাথায় দিয়ে।
নিশ্চয় এই ছড়াটি মনে আছে আপনাদের।
কিন্তু যদি কোনো শব্দের প্রথম বর্ণে ব-ফলা যুক্ত হয় তবে তা উচ্চারিত হবে না, অলংকার হিসেবে অঙ্গে শোভা পাবে শুধু।
যেমন—শ্বশুর( শ+শুর)
স্বধর্ম—(স+ ধর্ম)
স্বীকার—( সী+ কার)।
হ্যা, আমি স্বীকার করছি, সেই আমার শ্বশুর।
আপনি পরক্ষণেই যদি বলেন যে,
বিষয়টি আমি এখন অস্বীকার করছি, তখনই শব্দের মধ্যবর্তী চাপে পড়ে ‘ব’ফলা এবারও আবার দ্বিত্ত উচ্চারণে আপনাকে বাধ্যকরবে।(অস+সীকার)।

বন্ধুরা, এবার আসি ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে।
নিশ্চয় ইতোমধ্যে আপনারা কেউ ভুলে যাননি যে, বাংলা ভাষায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শব্দ থেকে নতুন শব্দ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার উপসর্গ নতুন শব্দ গঠনের অন্যতম এক হাতিয়ার হিসেবে তারা খুবই গুরুত্ব ভূমিকা পালন করছে বাংলাভাষার আদিকাল থেকেই।
প্রায় বিশ প্রকার উপসর্গ বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি অর্থের সম্প্রসারণ ও সংকোচনের মধ্যে দিয়ে শব্দের অর্থেও নিত্য নতুন বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে চলেছে।
’প্র’ একটি উপসর্গ হলেও পাশাপাশি তিনি কিন্তু একটি সরল যুক্তবর্ণও বটে।
তবে, একথা বলাই বাহুল্য যে, ‘উপসর্গ’ নামেই তার জনপ্রিয়তা ও খাতিরও অধিক।
‘উপসর্গ’ কথাটির মূল অর্থ ‘উপসৃষ্ট’।
এর কাজ হলো অন্য শব্দের আগে ভাগে প্রযুক্ত হয়ে নতুন নতুন শব্দ গঠন করা।
আপনারা সবাই জানেন, প এর প্রাণের মধ্যে কে বাস করে। ’প’-এর সঙ্গে ‘র’ ছাড়া আর কেইবা গাটছড়া বাঁধবে, বলুন!
(প+র)= ‘প্র’ এই উপসর্গটি অন্য শব্দের প্রথমে বসে কি লঙ্কা কাণ্ড ঘটাতে পারে, লক্ষ করুন। যেমন—তাপ, হার বা চার প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা একটি শব্দ। এই শব্দ ত্রয়ের প্রথমে যদি ‘প্র’ উপসর্গ যোগ হয়, তাহলে কি হয়?
প্র+তাপ=প্রতাপ,
প্র+হার= প্রহার,
প্র+চার=প্রচার।
এই যা! গেলো তো অর্থ পাল্টে। তাপ একটা নিরিহ শব্দ। যার অর্থ উষ্ণতা বা উত্তাপ। কিন্তু যখনই তাপের আগে ‘প্র’ উপসর্গটি জায়গা দখল করে নিলো তখন শব্দটি নতুন মাত্রা পেলো এবং তার অর্থ পাল্টে দাঁড়ালো— পরাক্রান্ত বা বীরত্ব।

এছাড়াও একই নিয়মে প্রসার, প্রবল, প্রবীন—নতুন আরো কিছু শব্দ তৈরি হলো, তাই না?
তবে মনে রাখতে হবে যে, (প+র+আ+ণ)= প্রাণ।
(প্রবীন লিখতে যদি দন্ত্য ন দিলে চলে তবে ‘প্রাণ’ লিখতে কেন মূর্ধণ্য দিতে হবে, তাই না?)
ণ-ত্ব বিধানের নিয়মানুযায়ী ‘র’এর পরে মূর্ধণ্য হবেই হবে। ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না। একারণেই নিম্নোক্ত শব্দসমূহে আমি মূর্ধ্যণ-ণ দিতে বাধ্য হই।
যেমন—হরিণ, তরুণ, তরণী, ধরণ, ধরণী, বারণ, অরুণ, আবরণ, আভরণ এমন কি প্রণিধান লিখতেও সূত্র অনুযায়ী প্রথমে মূর্ধণ্য, ধ পরে দন্ত্য ন।
শুধুমাত্র বাংলা ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে ‘র’ থাকলেও তারপরে দন্ত্য-ন হবে। উদাহরণটি লক্ষ করুন —
ভালো কাজ করুন। ফুলটি হাতে ধরুন।
কীযে করেন না আপনি? ক্রিয়াপদের এসব ক্ষেত্রে ‘র’ পরে দন্ত্য ন হবেই হবে।
নিশ্চয় মনে থাকবে এবার।

তেরশত নদীর দেশ আমাদের। কত চমৎকার তাদের নাম। আমার তো প্রথমেই মনে পড়ে পদ্মা নদীর নাম। আমার বাড়ির কাছ দিয়ে বয়ে গেছে বলেই কিনা জানি না।
তবে প্রমত্ত শব্দের পরে ‘পদ্মা’ নামটি এসেই যায়। তাই না?
পদ্মা (প+দ+ম+আ), ইংরেজিতে (padma) উচ্চারণ হবে পাদমা। কিন্তু বাংলায় লিখবো (প+দ+মা) কিন্তু উচ্চারণ করি (প+দ+দ+আ) এই জন্যে তো বলি যুক্তবর্ণের রঙ ঢঙ অনেক। লেখে এক, উচ্চারণে আরেক।
আবার দেখুন সহজ বানানে কত বিশাল বড় নদী আমাদের মনের মধ্যে বাস করে। মেঘনা, যমুনা। কিন্তু আমার স্বামী রফিক আজাদের জেলা টাঙ্গাইল তথা ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্য দিয়ে একটাই বড় নদী প্রবাহিত হয়েছে যার নাম ব্রহ্মপুত্র নদ—যা ভৈরব বাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পড়েছে।
‘ব্রহ্মপুত্র’ নদী না হয়ে ‘নদ’হলো কেন? সে যে স্বয়ং ব্রহ্মার পুত্র। (ব+র+হ+ম)=
ব্রহ্ম + পুত্র । অর্থাৎ ব্রহ্মার পুত্র ভগবান বা ঈশ্বর যে নামেই তাকে ডাকি, তিনি যে পুংলিঙ্গ। কাজেই ভগবানের পুত্র অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র নদও যে পুং লিঙ্গ হবে, এতে আর বিস্ময়ের কি আছে, তাই না?
নদ-নদীতেও যদি লিঙ্গে বিভেদ থাকে, তাহলে নারী নদীটি কে?
নিঃসন্দেহে সে যে, গঙ্গা।
যুক্তবর্ণে গঙ্গার বানান লক্ষ করুন।
(গ+ঙ+গ+আ)=গঙ্গা নদী যে নারী, তা বলে দিতে হয় না। কেননা, পৌরাণিক কাহিনী সূত্রে জানি, গঙ্গার জন্ম হয়েছে দেবতা শিবের জটা থেকে। কাজেই সে তো নারী হবেই। এজন্যে গীতিকার নারীর স্বভাবের সঙ্গে নদীর তুলনা করে গান বাঁধেন।
‘এখানে রমণীগুলো নদীর মত
নদীও নারীর মত কথা কয়’।

এই সময়ের প্রযুক্তি পুত্র-কন্যাগণ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অদৃশ্য মানুষের সঙ্গে সংযোগে বিশ্বাসী। কাছের মানুষ, পাশে থাকা মানুষের বাজার মূল্য খুবই নেমে গেছে একথা সবাই স্বীকার করবেন। আমি হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই এই সত্যতাকে দেখি কাছ থেকে। গতবছরের দেখা ঘটনাটি বলছি—
লংআইল্যান্ড থেকে ক্রুসবোটের আনন্দ-ভ্রমণ শেষে এপারে অন্টারিও লেক সংলগ্ন হারবারফ্রন্টের খোলা মাঠে বসেছে একদল তরুণ বয়েসী প্রেমিক প্রেমিকা। পরস্পরের শরীর-সংলগ্ন হয়েই বসেছে তারা। কিন্তু পাশাপাশি থেকেও প্রত্যেকের দৃষ্টি মোবাইল স্ক্রিনে, প্রত্যেকে তারা আলাদাভাবে তাদের অদৃশ্য ফেবু বন্ধুদের প্রতি নিবেদিত। তখন মনে পড়লো কবি শহীদ কাদরীর কবিতাটির বিখ্যাত চরণটি,
‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না’…

এই সব অদৃশ্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ মানেই তো লেখালেখির পাঠশালা। কোন বর্ণের সঙ্গে কোন বর্ণ যুক্ত করলে তবে সঠিক বানানটি বের হয়ে আসবে—তা তো অনেকেরই জানা নেই। এতদিন তা জানবার বিশেষ দরকারও ছিলো না। কিন্তু ফেবু এসে জান কবচ করে দিচ্ছে।
বলাই বাহুল্য যে, মোবাইলে লেখালেখি আমাদের নানাভাবে প্রশিক্ষিত করে তুলছে।
তবে অনেকের ক্ষেত্রে তা বিড়ম্বনার কাল হয়েছে। আমার এক প্রিয় ফেবু বন্ধু কল দিয়েছে, – আপা, স্মৃতি লিখতে পারছি না। কিভাবে লিখবো?
মন্ত্রীও লিখতে পারছি না। বলে দেন।
বললাম, তোমার যদি আইফোন হয় তবে, প্রথমে দন্ত্য-স তে চাপ দাও তারপর দেখো দ্বিতীয় লাইনের বাম দিকে হসন্ত আছে ওখানে চাপ দিয়ে ম তে চাপো, এবার ম এর নিচে ঋ—ৃ-কার দাও। এখন ত লিখে হ্রস্ব-ি কার দাও পেয়ে যাবে তবে স্মৃতির সঠিক বানান।
মন্ত্রী লিখতেও প্রথমে ম চাপো, এরপর দন্ত্য-ন এবং আগের মতো হসন্ত চাপ দিয়ে ‘ত’ চাপো আবার হসন্ত চেপে ‘র’ দাও। এবার দীর্ঘ-ী চেপে দিলেই তোমার কাছে চলে আসবে সঠিক বানানের মন্ত্রীমহোদয়।

আমি নিজে আইফোন মোবাইল নোটে লিখি। অনেকদিন পর্যন্ত আমি আর ড় খুঁজে পাই না। গাড়ি বাড়ি লিখতে ড দিয়ে চালিয়ে দিই। খুঁজে না পেলে আমি কি করবো। পাঠকেরা নিশ্চয় বুঝে নেবে।
অনেকদিন পরে ‘ড’ বর্ণে চাপ দিয়ে পেয়ে গেলাম তিনটি বর্ণ—ড, ঢ, ড়। এবার বুঝে গেলাম। বাড়ি, গাড়ির বানান তো ঠিক হলো। কিন্তু আরো সমস্যা তো রয়েই গেছে অনেকদিন আমি ‘ঞ’ খুঁজে পাই না। পঞ্চম, অঞ্চল কিছুই লিখতে পারি না। কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছি এভাবে—পন্চম, অন্চল।
ভালো শিক্ষকও খুঁজে পাই না যে, আমাকে শেখাবে। সন্তানেরা ইংরেজি নিয়ে কাজ করে কাজেই বাংলা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। কিছু জিজ্ঞেস করলে উল্টো বলে, তুমি বাংলার শিক্ষক তুমি না পারলে আমি পারবো কি করে।
তা তো ঠিক।

পরে নিজেই খুঁজতে খুঁজতে পেলাম যে, দন্ত্য-ন-তে চাপ দিলেই ম্যাজিকের মতো—ণ, ঞ, ঙ অতিরিক্ত এই তিনটি বর্ণ চলে আসে।

এরপর আর এক হাঙ্গামা বাঁধলো বিসর্গ নিয়ে। পাই না, পাই না তো, পাই না। দুই : ডট দিয়ে নি:শব্দ, নি:শ্বাস লিখে কোনো রকম ভুল-ভালই চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
কী করবো? আমার মতো অনেকের লেখায় একই ভুল ব্যবহার দেখি। কিন্তু আমার মনে তো শান্তি নেই। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম যে, হ—বর্ণে আঙুলটি পলে বিসর্গ ঃ চলে আসে। বাহ্। সেদিন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, এইবার নাকের দুই বাঁশিতেই যেন নিঃশ্বাস নিলাম আরাম করে।

রফিক আজাদ বলতেন, এই টেপাটেপির সংস্কৃতি বোঝা খুব মুশকিল—আমাদের মতো এ্যানালগ যুগের মানুষের জন্যে।
তাই নয় কি?
তবে আমাদের ভুলগুলো নেবেন না, আপনারা শুদ্ধ লিখুন। সেটি দেখে আমার বাকী ভুলটুকু শুধরে নেই—কেমন???

 

দিলারা হাফিজ

কবি দিলারা হাফিজ। ১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগন্জের গড়পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা বখশী হাফিজ উদ্দিনআহমেদ, মা রহিমা হাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি. এ অনার্স ও এম এ করেছেন। ১৯৯৮ সালে ঢাবি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রিলাভ করেন। ৩৭ বছর শিক্ষকতা জীবনে সরকারি কুমুদিনী কলেজ, ইডেন কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায় ছাড়াও মিরপুরের সরকারি বাঙলাকলেজ ও তিতুমীর কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যানহিসেবে চাকুরি থেকে অবসরে যান।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:

১।ভালোবাসার কবিতা, ২।পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক ৩। প্রেমের কবিতা ৪। কে নেবে দায় ৫। খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান ৬। অবিনশ্বর আয়না ৭। নির্বাচিত কবিতা
৮। নারী সংহিতা
গবেষণা গ্রন্থ: বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ (১৯৪৭–১৯৭১)
স্মৃতি গদ্য: আনন্দ বেদনাযজ্ঞে রফিক আজাদ
স্মৃতি উপন্যাস: কে প্রথম কাছে এসেছি
শিশুতোষ:সুষমার গল্প
অনুবাদ:মার্কিন কবি ক্যারোলাইন রাইট ও ভারতীয় বহুভাষাবিদ পণ্ডিত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তাঁর অনেককবিতার অনুবাদ করেছেন।
সম্পাদনা : গদ্যের গহন অরণ্যে
১৯৮৩ সালে কবিতার জন্যে লা ফর্তিনা সম্মাননা ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেণ্ডশীপ সম্মাননা লাভ করেন। বিটিভির বহুল প্রচারিত ও জননন্দিত গণশিক্ষামূলক অনুষ্ঠান “সবার জন্যে শিক্ষা” গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন ২২ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ (প্রয়াত) এর স্ত্রী। দুই পুত্র সন্তান অভিন্ন ও অব্যয় এর জননী।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top