কী লিখবেন কিংবা লিখবেন না: দিলারা হাফিজ

‘বাংলা ভাষা ও বানানের প্রতি সৎ থাকুন’- এই কথাটি বললে কি আপনি আমার দোষ নেবেন?
নিশ্চয় নেবেন না।
জানি, বাংলা ভাষার প্রতি আপনার ভালোবাসা ও সততার শতভাগই আন্তরিক এবং অকৃত্রিমও বটে। কত না রক্ত ঝরিয়ে তবে এই ভাষায় কথা বলা এবং শিল্প-সাহিত্য রচনার অধিকার পেয়েছি আমরা। সেকথা ভুলি কেমনে?
তবু লেখার সময়ে বানানে অথবা বাক্যে কিছু যে ভুলভ্রান্তি থেকে যায়, তার কারণ সমূহের মধ্যে প্রধানত, অসচেতনতা, অন্যমনস্ক থাকা কখনো কখনো অনাভ্যাসও দায়ী।
সেইসব থেকে উত্তরণের জন্যে মনে রাখার মতো সহজ কিছু কৌশলের কথা শেয়ার করবো আপনাদের সঙ্গে।
আপনারাও জানেন এবং মানবেন যে, এই যুগের প্রায় অধিকাংশই মানুষ প্রযুক্তির দত্তক সন্তান।
সঙ্গত কারণেই বর্তমান সময়ে পত্র-পত্রিকার চেয়ে ফেসবুক অধিক গুরুত্ববহ যোগাযোগের আশ্রয়মূর্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাকস্বাধীনতারও পরম প্রতিনিধি।
সর্বজন প্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ বার্ষিকীর নোটিফিকেশন ছাড়াও নিত্য নতুন অগণিত লিখিয়েদের পাই বা পাচ্ছি। এদের মধ্যে যেমন অনেক জাত লেখক-কবি-সাহিত্যিক আছেন, তেমনি যারা কোনোদিন ভাবেননি লেখার কথা তাদের মধ্যে অনেকেই আবার বেশ ভালোও লিখছেন। অনেকেই আপ্রাণ চেষ্টা ও চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমার আজকের এই লেখা তাদের উদ্দেশ্য নয়।
লেখা তো আসলে অনবরত চর্চার বিষয়। দীর্ঘ চর্চা না থাকলে এমন একটু আধটু ভুল হতেই পারে। এই লেখাটি আমার সেইসকল বন্ধুদের জন্যে শুধু, প্রাজ্ঞজনের জন্যে নয়।
আর একটা বলে নিই, প্রথমদিকে এই মাধ্যমটি লেখার চেয়ে ছবি আপলোডের দিকে সুনজর দিয়েছিলো অধিক। এখনো অধিকাংশের ঝোঁক সেই ছবি পোস্টের প্রতি। এখন কথা হলো, নিজ নিজ ওয়ালে ছবি পোস্ট করেই তো ঘটনার শেষ নয়, সেই ছবির পরিচিতি প্রসঙ্গে বিষয়-ভিত্তিক সামান্য ২/৪ লাইন লিখতে হয়, অনেকে তা লিখছেনও সেখানে। এক্ষেত্রে অনেক ভুল বানান চোখে পড়ে প্রায়ই। আমার একজন ফেবু বন্ধুর পোস্টের লেখা এটি।-
“কাউকে ভূল বোঝার আগে সত্যিটা একবার যাচাই করে নিও, না হলে একটা সুন্দর সম্পর্ক ভাঙতে বেশিক্ষণ লাগবে না”।
বন্ধুরা, এবার “ভূল” বানানের দুরবস্থা দেখুন। এইভাবে ‘ভুল’ সামান্য দুই বর্ণের শব্দটি লিখতে গিয়ে ভুল করে দীর্ঘ-ঊকার(ূ) দিয়ে ফেলে কেউ কেউ। এতে হালকা পাতলা ওজনের ভুলের বোঝা ততোধিক ভারী হয়ে ওঠে।
এরকম ‘ভুল’ যদি প্রেমাস্পদের সঙ্গে করেন কেউ, তাহলে তো সে প্রেম তো ভেঙে খান খান হবে, তাই না? কাজেই ‘ভুল’ লিখতে ভুল করা যাবে না মোটেও। না হলে সেই গানের মতো “ভুল সবই ভুল এজীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল” হয়ে যাবে কিন্তু।
এত সহজ একটি বানান অসাবধানতাবশত ভুল করা একদম উচিত নয়।
লক্ষ করুন, এই যে আমি লিখলাম ‘একদম উচিত নয়’। এই ‘উচিত’ শব্দটি লিখতে গিয়ে প্রায় অনেকেই ‘ত’-এর স্থলে খণ্ড-ৎ দিয়ে ‘উচিৎ’ লিখে চূড়ান্ত রকম ভুল করে বসে। অপরদিকে ‘ভবিষ্যৎ’ লিখতে গিয়ে ভুলবশত খণ্ড-ৎ এর স্থলে ‘ত’ লিখে দিয়ে ভুলের খেসারত দ্বিগুণ করে তোলে। ভুল বানানে এভাবে ‘ভবিষ্যত’ লিখলে সেই ভবিষ্যৎ কিন্তু ঝরঝরা হবেই হবে। কাজেই বানান দুটি মনে রাখার সুবিধার্থে এই দুটো-শব্দের বানান পাশাপাশি লিখুন কয়েকবার=
উচিত, উচিত, উচিত। এবং
ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ।
তাহলে আপনার বানানে ‘ত’ এবং খণ্ড-ৎ এর (দ্বিধা দ্বন্দ্ব) কেটে যাবে এবং আপনার শুদ্ধ বানান লেখার প্রচেষ্টা ও ভবিষ্যৎ (উত্তর+উত্তর) উত্তরোত্তর উজ্জ্বল হবেই হবে।
যখন আপনি সর্বসাধারণের উদ্দেশে কিছু লিখছেন, তখন কিন্তু আপনি লেখক। কাজেই শুদ্ধ বানানে লিখে ভাষার প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখানো উচিত।
নয় কি? আপনিই বলুন।
বাংলাভাষা আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম হলেও এত হেলাফেলা করে অনাদরে অবহেলায় যেনতেন-ভাবে ব্যবহার করার কিন্তু কোনো অধিকার নেই আপনার/আমার কারুরই। সে বিষয়টি মনে রাখতে হবে আমাদের সকলেরই।
তাই নয় কি?
মুহূর্তে মুহূর্তে আমরা আরো একটা ভুল বানান লিখে থাকি।
এই ‘মুহূর্ত’ শব্দটি লিখতে গিয়ে প্রায়ই আমাদের অনেকেই ভুল করে ম-এর নিচে দীর্ঘ- ঊকার (ূ)দিয়ে ফেলি, আর হ-য়ে দিই হ্রস্ব-কার। এই যখন অবস্থা, তখন এর চেহারা দাঁড়ায়—‘মূর্হুত’—তাই না?
কিন্তু শুদ্ধ বানানটি হলো—‘মুহূর্ত’।
একই রকম কাছাকাছি আরো একটি বানান—মুমূর্ষু। এই বানানটি মনে রাখার জন্যে আমি কি করি, জানেন?
মধ্যেখানে দীর্ঘ-ঊ-কার বাকী দুইপাশে হ্রস্ব-উ-কার মনে রাখি। এবার মনে থাকবে নিশ্চয়। প্রয়োজনবোধে ৫/৭ বার বানানটি কাগজে লিখে লিখে মনের মধ্যে গেঁথে নিন।

বানান ভুলের কথা ভেবে এখন যদি কান্নাকাটি বাদ দিয়ে কেবলই আমি একলা একলা বসে ‘কাঁদি’ তখন সেই ‘কাঁদি’ শব্দ লিখতে কেন চন্দ্রবিন্দু দিতে হয়, বলুন তো।
এই প্রশ্ন আমার একলার নয়, আপনারও, তাই তো?
এসব কথার উত্তর দেবার আমি কেউ নই, সব বলে গেছেন বাঘা বাঘা বৈয়াকরনিকগণ। আমি কোন ছাড় এসব বড় বড় কথাবলার!
আপনারা তো জানেন, সংস্কৃত ভাষা থেকে বেশ কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহার হয়। তার কিছু শব্দকে তৎসম এবং কিছু তদ্ভবশব্দ হিসেবে ব্যবহার করি।
এই দুই নামে ডাকার কি দরকার ছিলো? কিংবা এতে তফাৎই বা কি?
শুনুন তাহলে, তৎসম শব্দের অর্থ= তার সমান। মনে প্রশ্ন উদয় হতেই পারে আপনার, কার সমান?
সংস্কৃত শব্দের সমান।
তদ্ভব শব্দের অর্থ= তার থেকে উদ্ভূত। কার থেকে? সংস্কৃত শব্দ থেকে।
একটা উদাহরণ লক্ষ করুন, কোনটা তৎসম আর কোনটা তদ্ভব- এবার ধারণা স্পষ্ট হবে সকলের।
যেমন= সংস্কৃতের মূলশব্দ—চন্দ্র, ক্রন্দন, হণ্টন ইত্যাদি। এই শব্দগুলোকে আমরা তৎসম শব্দ হিসেবে জানি। কোনো পরিবর্তন বা রূপান্তর ছাড়া এই শব্দগুলো যখন সংস্কৃত থেকে বাংলাভাষায় আমরা হুবহু ব্যবহার করি তখন তাকে ‘তৎসম-শব্দ’ নামে ডাকি।
উদাহরণ:—
এত ক্রন্দনের কি আছে?
এটা কি চন্দ্রমাসের হিসাব?
কিন্তু একটু পরিবর্তন করে যখন= চন্দ্র> চন্দ> চাঁদ হয়ে যায়। তখন সেই চাঁদটি হলো তদ্ভব শব্দের কাতারে পড়ে যায়।
আহা, চাঁদে কি জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ রাতে!
এরকম আরো কটি উদাহরণ লক্ষ করুন, প্লিজ।
একই নিয়মে= ক্রন্দন> কান্না> কাঁদা। চন্দ্রবিন্দু সমেত ‘কাঁদা’ শব্দটি মনে রাখতে হলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেই বিখ্যাত চরণ দুটি নিশ্চয় মনে পড়বে আপনার।
‘কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে–
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে’॥

কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, পলিকাদায় কিন্তু চন্দ্রবিন্দু নেই। কেন নেই?
মূল শব্দ ‘কর্দম’ থেকে কাদা শব্দটির উদ্ভব, এখানে কোনো নাসিক্য বর্ণ নেই কাজেই চন্দ্রবিন্দু ব্যবহারের সুযোগ নেই। শব্দের উদ্ভব উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের শব্দের উৎস খুঁজতে হবে। তাহলে বানানটি মনে থাকবে শক্তপোক্ত হয়ে। সহজে শিক্ষা, খুব সহজেই মানুষ ভুলে যায় কিন্তু।
একই নিয়মের আরো একটি উদাহরণ:—
হণ্টন> (থেকে) হাঁটা>, এখানে নাসিক্য বর্ণ মূর্ধণ্য-ণ-এর সংযুক্তি ভেঙে তার পরিবর্তে ‘হাঁটা’ শব্দটি সরল হয়েছে এবং চন্দ্রবিন্দু যুক্ত হয়েছে।
কাজেই তৎসম থেকে উদ্ভূত—চাঁদ, কাঁদা, হাঁটা তিনটি শব্দই তদ্ভব শব্দে পরিণত হয়েছে। একারণেই হাঁটাহাঁটির উপরে চন্দ্রবিন্দু না দিলে আপনার পা দুটো যে চলবেই না মহাশয়, তা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়?
কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রমিত বানান রীতির অনুসরণে ইতোমধ্যে দৌড়াদৌড়ি থেকে কিন্তু চন্দ্রবিন্দু (ঁ) বিদায় নিয়েছে।
বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান রীতির নির্দেশেই আমরা তা মান্য করছি। বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের মধ্যে দিয়ে পূর্ববর্তী প্রচলিত-বানানেও পরিবর্তন আসে। প্রথম প্রথম সেসব মেনে নিতে একটু কষ্ট হয়। এতোদিন যা শুদ্ধ জেনে লিখেছি, হাত এবং মন ও অভ্যস্ত তাতে।
যেমন, আগে প্রচলিত ভুল হিসেবে লিখেছি ‘ইতিমধ্যে’, বর্তমানে শুদ্ধ বানানে লিখি ‘ইতোমধ্যে’ (ইতঃ+মধ্যে)।
আগে আমারা তারিখ লিখতাম ৩০/৪/২১ ইং এটি ছিলো প্রচলিত বানানের ভুল ব্যবহার। কেন ভুল?
যখন আমরা জানি ইংরেজি সাল বলে কোনো সাল নেই, সময় গণনা শুরু হয়েছে যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে ও পরের সময় গণনা করে। হয় খ্রিস্টপূর্ব নয় তো খ্রিস্টাব্দ। কোনোমতেই ইংরেজি সাল নয়। কাজেই তারিখ লেখার পরে এখন আমরা ‘ইং’(ইংরেজি-অর্থে)লিখি না। প্রয়োজনে ৩০/৪/২১ খ্রিস্টাব্দ লেখা যেতে পারে, নয়তো কিছুই লেখার দরকার নেই।
ভাষা যেহেতু নদীর স্রোতের মতো গ্রহণ বর্জনের মধ্যে দিয়েই বয়ে চলে। তাই হঠাৎ করে বৈয়াকরণবিদেরা যখন কোনো পরিবর্তন চান, সেসব আমাদের মেনে চলাই হলো ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ।
ভাষা তো আপনার আমার পরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য। তাই না? তার প্রতি খেয়াল না রাখলে কী চলে?
আপনারা জানেন, মানুষের যেমন আলাদা আলাদা নাম আছে এবং সেই নামে তাকে চিনতে হয়, তেমনি বাংলা বর্ণের প্রত্যেকের আলাদা নাম আছে। সেই নামেই ডাকি তাদের।
ক খ গ ঘ ঙ —এই পাঁচটি বর্ণের আলাদা নাম আছে, তারপরও এই পাঁচটি বর্ণকে একনামে ডাকতে হলে বলি, ‘ক-বর্গ’। ক-বর্গ বলবার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে এখানে পাঁচটি বর্গেরই উল্লেখ আছে। একইভাবে আমরা বাকীদেরও ‘ট-বর্গ’ এবং ‘ত-বর্গ’ নামে ডাকি।
প্রতিটি বর্গের পঞ্চম বর্ণের নাম নাসিক্য বর্ণ। লক্ষ করুন, এই বর্ণগুলো উচ্চারণের সময় নাক দিয়ে বাতাস নির্গত হয় বলে এদের নাম দেয়া হয়েছে নাসিক্য বর্ণ।
যেমন: ঙ, ঞ, ণ, ন, ম ইত্যাদি।
যেসব শব্দের যুক্তবর্ণে নাসিক্য বর্ণ আছে, তা ভেঙে সরল হবার সময়ে নাসিক্য বর্ণের বদলে তার পূর্ববর্তী অক্ষরে চন্দ্রবিন্দু (ঁ) বসে। এ কারণেই যেমন, হণ্টন> হাঁটা, চন্দ্র> চাঁদ, ক্রন্দন> কাঁদা, বংশ> বাঁশ, দণ্ড> দাঁড়ি-এর মতো শব্দগুলোতে চন্দ্রবিন্দু বসেছে।
এছাড়া বাক্য গঠনের সময় কিছু কিছু সর্বনামে আমরা চন্দ্রবিন্দু (ঁ) ব্যবহার করি। কেন বলুন তো? তাকি এমনি এমনি?
না, তারও কারণ আছে।
যেমন, তাঁহার(সাধু ভাষা), তাঁর, ওঁর (চলিত ভাষা)।
প্রশ্ন জাগতেই পারে কখন, কাদের ক্ষেত্রে সর্বনামে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করবো আমরা।
সম্মানিত ব্যক্তি, কারা সেই সম্মান পাবে?
লেখক, কবি সাহিত্যিক, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। এছাড়া গুরুজন বা বয়োজ্যেষ্ঠ পিতা-মাতা এবং মান্যজনের ক্ষেত্রেও সর্বনামের এই সম্মান আমরা দেখাতে পারি।
তাঁদের বিষয়ে যখন কোনো রচনা তৈরি করি। বাক্যে তাদের নামটি বার বার ব্যবহার করলে শুনতে একঘেয়ে ও বিরক্তিকর মনে হয়, ভালোও লাগে না। বাক্যের সৌন্দর্য ও শ্রবণে শ্রুতি মাধুর্য সৃষ্টির লক্ষে প্রতিটি বাক্যে নাম ব্যবহার না করে সর্বনাম ব্যবহার করি এবং সেই সর্বনামে ‘সম্মানার্থে তার(সর্বনাম)না লিখে চন্দ্রবিন্দু সমেত ‘তাঁর’ লিখি।
উদাহরণ:——
১।: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর ছদ্মনাম ছিলো ‘ভানুসিংহ’। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। ভানুসিংহ ঠাকুর তাঁর ছদ্মনাম। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম ‘মরণ’।
‘মরণ রে,
তুঁহুঁ মম শ্যামসমান’।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্ত কমলকর,রক্ত অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান
তুঁহুঁ মম শ্যামসমান॥
এই কবিতাটি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত। কাজেই সেই ভাষার নিয়মানুযায়ী তিনি চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করেছেন তার কবিতায়। কিন্তু আমি যে ক’টি বাক্য লিখেছি তাঁর সম্পর্কে, সেই বাক্য-বন্ধের একটিতে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এর নাম ব্যবহার করেছি মাত্র। বাকী বাক্যে ’তাঁর’ সর্বনাম ব্যবহার করেছি তাই না?
একইভাবে আর একটি উদাহরণ:—-
২।: কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো। তাঁর বিখ্যাত কবিতার একটি কাব্যচরণ,
“মম/ এক হাতে বাঁকা/ বাঁশের বাঁশরী / আর হাতে রণ/ তূর্য”।
তৃতীয় উদহারণঃ—-
৩।: বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ‘হাসু’ নামে ডাকতেন। এখানে দুজন ব্যক্তিত্বই একটি জাতির সর্বোচ্চে অবস্থানে আছেন, কাজেই সম্মানার্থে সর্বনামে চন্দ্রবিন্দু (ঁ) ব্যবহার করা হয়েছে।
এছাড়া গুরুজন, নিজের বাবা মায়ের ক্ষেত্রেও সর্বনামে এই সম্মান জানানো যায় বৈকি।
তবে, ইদানীং অনেক পত্রিকা বা ওয়েবজিন সম্মানার্থে সর্বনামে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহারের পক্ষে নয়, সেটি ভিন্ন কথা।
নিয়ম কিন্তু নিয়মই।
কাজেই আপনি মানবেন কি মানবেন না সেটি নির্ভর করবে ভাষার প্রতি আপনার দখল ও ভালোবাসা বিচারে।
লেখাটি যদি আপনাদের ভালো লাগে এবং সামান্য কাজে আসে তবে, তবে বানানের ভিটে-মাটি চষে বেড়াতে পারি আপনাদের সঙ্গে নিয়ে, কেমন? জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।
সবাই ভালো থাকুন,
মাস্ক পরুন, নিরাপদ থাকুন।
৩০/৪/২০২১
টরন্টো, কানাডা

 

দিলারা হাফিজ

কবি দিলারা হাফিজ। ১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগন্জের গড়পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা বখশী হাফিজ উদ্দিনআহমেদ, মা রহিমা হাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি. এ অনার্স ও এম এ করেছেন। ১৯৯৮ সালে ঢাবি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রিলাভ করেন। ৩৭ বছর শিক্ষকতা জীবনে সরকারি কুমুদিনী কলেজ, ইডেন কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায় ছাড়াও মিরপুরের সরকারি বাঙলাকলেজ ও তিতুমীর কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যানহিসেবে চাকুরি থেকে অবসরে যান।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:

১।ভালোবাসার কবিতা, ২।পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক ৩। প্রেমের কবিতা ৪। কে নেবে দায় ৫। খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান ৬। অবিনশ্বর আয়না ৭। নির্বাচিত কবিতা
৮। নারী সংহিতা
গবেষণা গ্রন্থ: বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ (১৯৪৭–১৯৭১)
স্মৃতি গদ্য: আনন্দ বেদনাযজ্ঞে রফিক আজাদ
স্মৃতি উপন্যাস: কে প্রথম কাছে এসেছি
শিশুতোষ:সুষমার গল্প
অনুবাদ:মার্কিন কবি ক্যারোলাইন রাইট ও ভারতীয় বহুভাষাবিদ পণ্ডিত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তাঁর অনেককবিতার অনুবাদ করেছেন।
সম্পাদনা : গদ্যের গহন অরণ্যে
১৯৮৩ সালে কবিতার জন্যে লা ফর্তিনা সম্মাননা ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেণ্ডশীপ সম্মাননা লাভ করেন। বিটিভির বহুল প্রচারিত ও জননন্দিত গণশিক্ষামূলক অনুষ্ঠান “সবার জন্যে শিক্ষা” গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন ২২ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ (প্রয়াত) এর স্ত্রী। দুই পুত্র সন্তান অভিন্ন ও অব্যয় এর জননী।

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top