মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য এক দলিল: আমি বীরঙ্গনা বলছি

১.

চোখ মেললেই দেখতে পাই, স্বাধীনতার পঞ্চাশ— সূচিস্নিগ্ধ অপরূপ এক রজনীগন্ধ্যার মতো সুবাস ছড়িয়ে আগত প্রায় বাঙালির প্রাণে-প্রাণে। পেছনে তাকালে মনে হয়, খুব বেশি দূরবর্তী নয় সে পথ, এই তো সেদিন ভয়াল রক্ত-সমুদ্র থেকে উত্থিত হলো স্বপ্নের সোনালি সূর্যমাখা প্রাণের গাঙ্গেয় এই বদ্বীপ। আমাদের ভালোবাসায় তার নাম রাখা হলো বাংলাদেশ। আমাদের সকলের মনের আনন্দ-রঙ দু’হাতে মেখে, উদ্বেলিত পাখার উচ্ছ্বাসে তাকে ফুটিয়ে তুললাম লাল-সবুজের অনিন্দ্য রঙে। প্রাণের পতাকা এবার আকাশে উড়লো অসীম উচ্চতায়, সাহসী বাঙালির পরিচয়ে, যেন আমাদেরই প্রাণের বাতাস ধারণ করে, আকাশের রূপে ও রেখায় সে উড়ছে সগৌরবে।

আমি এবার সার্বভৌম।

সাহসী বাঙালি জাতি সকল শর্ত পূরণ করে পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্বের ঘোষণা দিলো যেদিন, সেই দিনটি আমাদের বিজয় নিশ্চিত হলো। ১৬ ডিসেম্বরের নাম দিলাম বিজয় দিবস, বীর বাঙালির বিজয় দিবস। পুরো ডিসেম্বর মাস হয়ে উঠলো আমাদের অস্তিত্বের বিজয়-গাথা। তিরিশ লক্ষ শহীদের নামে রচিত হলো সাভারের অম্লান স্মৃতি সৌধ।

ভাষাশহীদের রক্তের ঋণে রচিত শহীদ মিনার এখন সারাদেশে, বিশেষভাবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আলোর মিছিলে যুক্ত হয়েছে বাংলা মায়ের বাংলা ভাষার গৌরব।

স্বদেশ, স্বজাতি, স্বদেশপ্রেম আজ নতুন করে দৃষ্টি খুলে দিচ্ছে আমাদের। এই অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উত্থান এবং অবিস্মরণীয় তার প্রতিযোগিতা। উনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীতে যে অগ্রগতি শতবছরে সাধিত হয়েছে, একবিংশের প্রযুক্তি উন্নয়ন একশো বছরকে দশ বছরের মিরাকেল অগ্রগতির অংশ করে নিয়েছে।

উনবিংশ শতাব্দীর রবীন্দ্রনাথ যে গতি বা অগ্রগতির কথা তিনি তাঁর বলাকা কাব্যের কবিতাসমূহে ব্যক্ত করেছিলেন, তাকে অতিক্রম করে এই গতি যেন সর্বোপরি অন্য এক গতিময় পৃথিবীকে নির্দেশ করে।

তবে কেবল দেহে নয়, সংবেদনশীল একজন মানুষ হিসেবে মনে-প্রাণে সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে রবীন্দ্রনাথের মতো আমাদেরও বলতেই হবে,‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর  বছরে এই বাংলাদেশ আজ অন্য এক বাংলাদেশ, উন্নয়নের মহাসড়কে উপনীত। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মাধ্যম আয়ের দেশ, এশিয়ার মহাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের অংশীদার। অনেক পিছিয়ে পড়া উন্নয়নশীল দেশের সামনে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। এই অর্জন কম কথা নয়। স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মধ্যে জাতির পিতাকে হত্যা, পেছনের কুড়ি বছরের অন্ধকার উজিয়ে সেই রাহুগ্রাস থেকে পুণরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসা।

সরকার গঠনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত নেতৃত্বে রয়েছেন বাবা-মা-ভাই-বোনসহ সর্বস্ব হারানো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশ আজ নিজের অর্থবলে স্বপ্নের পদ্মাসেতুর মতো দুরূহ কাজ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। আর এক স্বপ্ন, জনবহুল দেশের জানজট কমাতে মেট্রোরেলের বাস্তবায়ন, সেই অর্জনও আমাদের দোর গোড়ায় আজ। গাঁয়ের প্রতিটি মানুষের পায়ে স্যান্ডেল জুড়েছে, নৌকায় ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে, ভিক্ষুকের হাত কর্মীর হাতের শক্তি পেয়েছে। মানুষের গড় আয় এবং আয়ু দুটোই বেড়েছে অবিশ্বাস্য রকম।

২.

এই বিজয়ের মাসে অবশ্যই সেই সূর্যসন্তানদের কথা আমাদের মনে পড়বে, যাদের আত্মত্যাগে এই স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে। তাঁদের সেই আত্মত্যাগের ইতিহাস যারা লিপিবদ্ধ করে গেছেন, ঘটনার সত্যতা উন্মুক্ত করে গেছেন লেখনীর অনিবার শক্তিতে, তাদের কথা জানাতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে, বিজয়ের এই মাহেন্দ্রক্ষণে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নামক যে আধুনিক মহাকাব্যটি রচিত হয়েছে ৪৯ বছর আগে। সেই মহাকাব্য রচনায় সাতকোটি বাঙালির অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি বিশেষ বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি বিশেষের অবদান, কখনো অতি মূল্যায়িত, আবার কখনো তা প্রদীপ শিখার বাইরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। যেমন আমরা কথায় কথায় বলি, ‘তিরিশ লক্ষ শহীদ এবং দুলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা পেয়েছি। এই বাক্যটি আসলে তাদের ত্যাগ, আত্মদান, রক্তদানের মর্মন্তুদ বেদনা, যৌন নিপীড়নের যে ঐতিহাসিক হিংস্রতা, সেভাবে তা বহন করে না।প্রসঙ্গত আমি ‘আমি বীরঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থটির কথা বলতে চাই।

কালজয়ী এই গ্রন্থটির রচয়িতা সেই মহিয়সী নারী, আমার সৌভাগ্য আমি তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম।

ড. নীলিমা ইব্রাহিম (১৯২১—২০০২)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তাঁকে পেয়েছিলাম ১৯৭২-৭৩ সেশনের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্রী হবার সুবাদে। তিনি শুধু বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ছিলেন না, ছিলেন অত্যন্ত বড় মাপের সাহিত্যিক এবং মানবদরদী সমাজকর্মী।

আমার জন্মের এক বছর পরে ১৯৫৬ সালে তিনি প্রভাষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যোগদান করেন, অধ্যাপক পদে উন্নীতহয়েছেন ১৯৭২ সালে। কাজেই আমি তাঁকে পেয়েছিলাম বিভাগীয় প্রধান হিসেবে।

আমার মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করায় বলেছিলাম, মিস দিলারা হাফিজ। আমার জবাব শুনে ধমকের সুরে বললেন, মিস কি, কেন মিস বলতে হবে?

এমনিতে মফস্বল শহর মানিকগঞ্জ থেকে এসেছি, ভয়, জড়তা সবই অলঙ্কারের মতো যেন সর্বাঙ্গে শোভা পাচ্ছে। নগর রাজধানী ঢাকার হালচালও তেমন বুঝি না, কী বলতে কী হবে, তারও ধারণা নেই। আমাদের সেই সময় নামের আগে মিস শব্দটি ব্যবহার করার একটা রেওয়াজ ছিলো বলেই, বলেছি, কিন্তু এই নারীবাদী হৃদয়ের খবর তো তখনও জানিনে।

ভাবলাম এই রে, আমাকে বোধ হয় নেবে না। বাংলা কেন পড়তে চাও, তার যে কী উত্তর দিয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। ভয়ের একটা ফ্যাকাশে দলা যেন বিমর্ষ চিত্তে কোনো রকম বোর্ড থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম।

বড়মামার বাসায় জয়কালি মন্দির চলে গেছিলাম। ভর্তিইচ্ছুক আমার মতো অনেকেই তখন করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে, পরস্পরের সঙ্গে কথাও বলছে। কিন্তু আমার সাহসে কুলাচ্ছে না যে, আগ বাড়িয়ে আমি তাদের কারু সঙ্গে কথা বলবো। একমাত্র তালেব ভাইকে চিনেছিলাম, এই জন্যে তার কাছে জেনে নিয়েছিলাম যে, বিভাগে ভর্তির তালিকা টাঙ্গিয়ে দিবে ৯ জুন তারিখে।

কাজেই দ্রুত স্থান পরিত্যাগ করাই লক্ষ ছিলো। ১৯৭৩ সালের ৯ই জুন বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম, অনেক কিছু ভুলে গেলেও স্বর্ণ মুদ্রার মতো দৃশ্যমান এই তারিখটি স্মৃতির তাবিজ হয়ে ঝুলে আছে আমার কণ্ঠদেশে।

বিভাগীয় প্রধান নীলিমা আপাকে দেখি দূর থেকে, কাছে যাবার সাহস পাইনে। যেমন রাশভারী, তেমনি জ্ঞান-গরিমা, কর্তব্য কাজেও অনমনীয়। আমাদের প্রথম বর্ষে তিনি পড়াতেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন। একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ। পড়াতে পড়াতে মাঝে মধ্যেই পারিবারিক গল্প করতেন, কখনো নিজের কখনো আবার লেখকের ব্যক্তি জীবনের নানা প্রসঙ্গে। ক্লাস শেষ করেই  দ্রুত চলে যেতেন বাংলা একাডেমির দায়িত্ব পালন করতে।

৩.

স্বাধীনতাত্তোর দেশ, সর্বত্রই পুর্নগঠনের কর্মযজ্ঞ চলছে।

বাংলা বিভাগের দায়িত্ব সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭৪ সালে নীলিমা ইব্রাহিম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই সময়ে বাংলা একাডেমিতে চলছিল চরম অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা। দৃঢ় হাতে এসব অনিয়ম দূর করেছিলেন। মকবুল নামে এক ভণ্ড খাদেম বাংলা একাডেমির চত্বর দখল করেছিল। প্রথমে ছিল একটি কবর এবং তার পাশে মাত্র ৪ শতক জায়গা। মকবুলের হাতের কারসাজিতে তা বেড়ে হয়ে গেল একশত চুয়াল্লিশ শতক। আর একটু চাপ দিলেই আরও জায়গা বেড়ে বাংলা একাডেমিকে গ্রাস করবে। প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে দৃঢ় হাতে বেদখল জায়গা তিনি পুণঃউদ্ধার করেছিলেন।

অধ্যাপনা জীবনের শুরু থেকেই ষাটের দশকের রাজনৈতিক উত্তাল সেই সময় তিনি একজন স্বদেশ প্রেমিক দৃঢ়চিত্তের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে নানাবিধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

আমরা জানি, ষাটের দশকটি ছিল বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ক্রান্তিকাল। এ সময় থেকেই বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে।

এই ষাটের দশকেই নীলিমা ইব্রাহিমের বেশ কিছু উপন্যাস ‘বিশ শতকের মেয়ে’, ‘একপথ দুইবাঁক’, ‘কেয়াবন সঞ্চারিণী’ প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ এ সময় সাহিত্যিক সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ‘শরৎ প্রতিভা’, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, ‘বাংলার কবি মধুসূদন’ এবং তাঁর গবেষণাধর্মী বই ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ ও বাংলা নাটক’ সুধীমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংশিত হয়। তিনি শক্তিশালী লেখিকা হিসেবে নিজের আসনটি পোক্ত করে নিয়েছিলেন। এসব উপন্যাস ও প্রবন্ধে তিনি সমাজ সচেতনতার কথা তুলে ধরেছেন মূলত।

পুরুষের পাশাপাশি নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গীর কথাই যেন তার গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় ছিল। বাঙালি নারী-পুরুষকে তিনি দেখতে চেয়েছেন সমতার ভিত্তিতে।

সাহিত্যের বিবেচনাবোধ থেকে তিনি একজন মানবতাবাদী লেখক হিসেবে স্বীকৃত।

স্বাধীনতার পরেও তার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে বহ্নিবলয় (১৯৮৫), যে অরণ্যে আলো নেই (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক), রোদজ্বলা বিকেল (১৯৭৪) এবং গুরুত্বপূর্ণ তাঁর একটি রচনা’ আমি বীরঙ্গনা বলছি’।

তিনি যে অত্যন্ত সংবেদনশীল মানবতাবাদী লেখক, এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া ‘আমি বীরঙ্গনা বলছি’ রচনাটি আদ্যপান্ত পাঠ করে যদি আমরা তার সামান্য বিশ্লেষণে যাই।রচনাটির নেপথ্যের বাস্তবতা হলো যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের অধীনে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠিত হলে নীলিমা ইব্রাহিম সেখানে একজন সম্মানীত সদস্য হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

শ্রদ্ধেয় বিচারপতি কে এম সোবহান এর প্রধান দায়িত্বে ছিলেন। নীলিমা ইব্রাহিমের এই কাজের বিশাল অভিজ্ঞতার খানিকটা ফসল আমরা পেয়েছি তাঁর অমূল্য গ্রন্থ ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’-এর মাধ্যমে। এই গ্রন্থের মাধ্যমে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত বাঙালি নারীর কান্না-দুঃখ-শোকের ইতিহাসই কেবল পাই না, এখানে এক নারীর মানবাধিকার—সচেতন শক্তিশালী লেখককে আমরা খুঁজে পাই।

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’—এই গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন: ১৯৭২ সাল যুদ্ধ জয়ের পর যখন পাকিস্তানি বন্দীরা ভারতের উদ্দেশে এ ভূখণ্ড ত্যাগ করে, তখন আমি জানতে পারি প্রায় ৩০-৪০ জন ধর্ষিতা নারী এ বন্দীদের সঙ্গে দেশ ত্যাগ করছেন। অবিলম্বে আমি ভারতীয় দূতাবাসের সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার অশোক ডোরা এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত মরহুম নুরুল মোমেন খান, যাঁকে আমি মিহির নামে জানতাম, তাঁদের শরণাপন্ন হই। উভয়েই একান্ত সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এসব মেয়ের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ আমাদের করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নওসাবা শরাফী, ড. শরীফা খাতুন ও আমি সেনানিবাসে যাই এবং মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা লাভ করি। পরে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে নারকীয় বর্বরতার কাহিনি জানতে পারি। সেই থেকে বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মে। এই ক্ষুদ্র গ্রন্থে সে আগ্রহের খণ্ডাংশ মাত্র। তাঁর এই ভূমিকা থেকেই পাঠক বুঝতে সক্ষম পাকিস্তানিরা আমাদের মা-বোনের ইজ্জতের ওপর কি বীভৎস হামলা চালিয়েছিল। বইটি একটি প্রামাণ্য দলিল। তাই বইটি সর্বত্র পঠিত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার কথা ভুলতে পারি কি?

৪.

এই গ্রন্থটির মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসব্যপী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর যে পাশবিকতা,নারীর নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনাঘটেছে, সেই মর্মন্তদ শোক-দুঃখ-কষ্ট-হাহাকার সম্পর্কে আমরা যেন সম্মুখভাবে জানতে পারি তখন, আবৃত্তি ও অভিনয় শিল্পী লুতফুন নাহার লতার কণ্ঠে যখন ‘আমি বীরঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থের  অংশ বিশেষের পাঠ শুনি।

১৯৯৬ সাল থেকে লতাফুন নাহার লতা যুদ্ধাপরাধীর বিচার তরান্বিত করতেই পাক-আর্মিদের বর্বরতার স্বীকার আমাদেরই মা-বোনের একজন তারা, একজন শেফা, একজন উন্মুল শেফালির কষ্টের জবানকে তুলে নিয়েছে তার কণ্ঠে। তাদের কান্নাকে ধারণ করেছে অন্তরে, অতপর প্রবাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিরলসভাবে মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা দেশপ্রেমের বিনি সুতোয় গেঁথে বিস্মৃতি প্রবণ জাতি এই,আমাদেরকেই অশ্রুজলে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, কিছুতেই যেন ক্ষমা না করি সেই বর্বরদের। যারা বাংলা মায়ের সম্ভ্রম ধুলায় লুটিয়েছে সেদিন।

শিল্পী লতার হিরন্ময় কণ্ঠে, বেদনার অশ্রুজলে নগ্ন নারীর অন্তর্দাহ ও নিপীড়নের নিষ্ঠুরতার বয়ান যখন শুনি, তখন আমরা শিউরে উঠি, সেই ভয়াবহ অগ্নিদহনের বীভৎসতায়  যেন বাংলার নারীকুল অস্তিত্বহীনতায় তড়পায়। তুলনাহীন পাশবিক এই অভিজ্ঞতায় মরমে মরে যাওয়া আত্মত্যাগী এই নারীদের ভালোবেসে নাম দেয়া হয়েছিলো বীরঙ্গনা নারী, কিন্তু বীর নারীর প্রকৃত সেই সম্মান কি দিতে পেরেছে এই সমাজ-ব্যবস্থা। না, মোটেই তা পারেনি। নারীর অসম্মানের এই কষ্ট আজো বহন করি আমরা বাংলাদেশের নারীকুল।

ড. নীলিমা ইব্রাহিমের কালজয়ী, অন্যতম এই গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের দলিল মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর আত্মোৎসর্গের করুণ গাথা।

সাহিত্যের অবদান হিসেবে ১৯৬৯ সালে তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এছাড়াও জয়বাংলা পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, বেগম রোকেয়া পদক, অনন্য সাহিত্য পদক, বঙ্গবন্ধু পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সর্বশেষ ২০০০ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।

নীলিমা ইব্রাহিম ১৯২১ সালের ১১ জানুয়ারি খুলনার বাগেরহাটে জমিদার প্রফুল্ল রায় চৌধরী ও কুসুম কুমারী দেবীর কোল আলোকরে জন্মেছিলেন নব সূর্য দর্শনে।

১৯৪৫ সালে মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে ভালোবেসে দাম্পত্য জীবন শুরু করেছিলেন।খুকু, ডলি, পলি,বাবলি, ইতি নামের পঞ্চকন্যার মমতাময়ী জননী তিনি।

বর্ণাঢ্য জীবনের এই মহিয়সী, কৃতি নারী ২০০২ সালের ১৮ জুন পৃথিবী ছেড়ে তিনি অনন্তলোকের যাত্রী।

বিজয়দিবসের এই শুভদিনে তাঁর অবদান সকৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি  আমি, তাঁরই একজন নগন্য ছাত্রী।

১৩/১২/২০২০

আইসবোট টেরেস, টরন্টো

 

দিলারা হাফিজ

কবি দিলারা হাফিজ। ১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগন্জের গড়পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা বখশী হাফিজ উদ্দিনআহমেদ, মা রহিমা হাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি. এ অনার্স ও এম এ করেছেন। ১৯৯৮ সালে ঢাবি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রিলাভ করেন। ৩৭ বছর শিক্ষকতা জীবনে সরকারি কুমুদিনী কলেজ, ইডেন কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায় ছাড়াও মিরপুরের সরকারি বাঙলাকলেজ ও তিতুমীর কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যানহিসেবে চাকুরি থেকে অবসরে যান।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:

১।ভালোবাসার কবিতা, ২।পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক ৩। প্রেমের কবিতা ৪। কে নেবে দায় ৫। খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান ৬। অবিনশ্বর আয়না ৭। নির্বাচিত কবিতা
৮। নারী সংহিতা
গবেষণা গ্রন্থ: বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ (১৯৪৭–১৯৭১)
স্মৃতি গদ্য: আনন্দ বেদনাযজ্ঞে রফিক আজাদ
স্মৃতি উপন্যাস: কে প্রথম কাছে এসেছি
শিশুতোষ:সুষমার গল্প
অনুবাদ:মার্কিন কবি ক্যারোলাইন রাইট ও ভারতীয় বহুভাষাবিদ পণ্ডিত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তাঁর অনেককবিতার অনুবাদ করেছেন।
সম্পাদনা : গদ্যের গহন অরণ্যে
১৯৮৩ সালে কবিতার জন্যে লা ফর্তিনা সম্মাননা ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেণ্ডশীপ সম্মাননা লাভ করেন। বিটিভির বহুল প্রচারিত ও জননন্দিত গণশিক্ষামূলক অনুষ্ঠান “সবার জন্যে শিক্ষা” গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন ২২ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ (প্রয়াত) এর স্ত্রী। দুই পুত্র সন্তান অভিন্ন ও অব্যয় এর জননী।

Facebook Comments

One comment

  1. Pingback: মহান বিজয় দিবস সংখ্যা - সাহিত্য ক্যাফে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top