হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংসের অন্তরালে: প্রবীর বিকাশ সরকার

হিরোশিমা-নাগাসাকি শহরদ্বয়ে পৃথিবীর প্রথম আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ৭৬ বছর পূর্তি এই বছর। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এই দুটি শহরে অকস্মাৎ দুটি অপরিমেয় শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করা হয় যথাক্রমে ৬ এবং ৯ আগস্ট। দুটো বোমার নাম যথাক্রমে লিটল বয় এবং ফ্যাটম্যান।
বোমা দুটি বিস্ফোরণের পর থেকে ৪ মাসের মধ্যে হিরোশিমায় ৯০ হাজার থেকে ১লাখ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকিতে ৬০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ সরাসরি বিকিরণ এবং তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

একসঙ্গে ‘হিবাকুশা’ অর্থাৎ বিস্ফোরণজনিত তেজস্ক্রিয়তা দ্বারা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দুটো শহরেরই জনবসতি, ঘরবাড়ি-ভবনাদি ধূলিসাৎ হয়েছিল নিমিষে। প্রকৃতি, নদীনালা, পশুপাখি ঝলসে গিয়েছিল। কাচ গলে গিয়েছিল! ধাতব বস্তু দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল! মানুষের চামড়া তেজস্ক্রিয়তা এবং গামারশ্মির আগুনে ঝলসে গিয়ে গলেগলে পড়ছিল! এমনকি, পাথরের সিঁড়িতে ছায়া রেখে জ্বলজ্যন্ত মানুষটাই উবে গেছে! ঘনঘোর কালো আকাশ থেকে কালো রঙের অগ্নিবৃষ্টিতে মানুষের মাথা-শরীর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল ফলে মানুষ যন্ত্রণা উপশমের জন্য নদীতে, জলাশয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কিন্তু তাতে ফল হয়েছে আরও মারাত্মক–জ্বালা-যন্ত্রণা আর সারাশরীরব্যাপী ফোস্কা দেখা দিয়েছিল! চারদিকে চিৎকার আর হাহাকার! বহু মানুষ মূক হয়ে গিয়েছিল। আহত শিশুদের শরীর কালোবর্ণ ধারণ করেছিল, থরথর করে কাঁপছিল! মানুষের সৃষ্ট নারকীয়-যজ্ঞের শিকার হয়েছিল শান্তিপ্রিয় হিরোশিমা এবং নাগাসাকি। দগ্ধ, গলিত, দুর্গন্ধযুক্ত বিভীষিকাময়, বীভৎস!

মারাত্মক আণবিক তেজস্ক্রিয়তা শরীরে ধারণ করে আজও যারা লড়াই করে চলেছেন বিভিন্ন মরণব্যাধির সঙ্গে তাদের সংখ্যা জাপান সরকারের স্বাস্থ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৪ সালের মার্চ মাসে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮০ জন। যাদের গড় বয়স এখন ৮০.৮৬ বছর। অন্য এক উৎস থেকে জানা যায় বহির্বিশ্বে হিবাকুশার সংখ্যা ১ লাখ ৯২ হাজার ৭১৯ জন ওই একই বছরে প্রকাশিত তথ্য থেকে। বোমা বিস্ফোরণের কালে ২০০০ থেকে ৬৫০০ অনাথ শিশুর খোঁজ পাওয়া যায় যারা বাবা-মা বা পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে। তারাও অসুস্থ শরীর নিয়ে বেওয়ারিশ জীবনযাপন করেছে মানুষের জুতো পালিশ করে, রেস্টুরেন্টের বয়, কলকারখানায় শ্রমিকের কাজ করে। আর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরবর্তীকালে জন্ম নিয়েছে অনেক পঙ্গু, বিকলাঙ্গ এবং অপরিণত মানবসন্তান। অগণন ভুক্তভোগী মানসিক বিপর্যয়ের শিকার তো হয়েছেই।
এই যে বিপুল-বিপুল জানমালের ধ্বংসজনিত ক্ষয়ক্ষতি তার সব দায় নিতে হয়েছিল পরাজিত, বিধ্বস্ত, পর্যুদস্ত এবং ক্ষমতাহীন জাপানের সরকারকে। সেইসঙ্গে ক্রমবর্ধমান লক্ষ লক্ষ ‘হিবাকুশা’র ভরণপোষণ, সেবা এবং চিকিৎসার দায়িত্বও। মিত্রবাহিনী বা আমেরিকা কিছুই বহন করেনি, ক্ষতিপূরণও প্রদান করেনি আজ পর্যন্ত।

স্থানীয় জাপানি চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবী এবং সাহায্যকারী সাধারণ নাগরিকরা দিনরাত লড়াই করেছে অসুস্থদের সেবা, চিকিৎসা দিতে সাধ্যমতো চরম যাবতীয় সংকটের মধ্যেও। কিন্তু স্পর্শজনিত, নিঃশ্বাসজনিত, ঘাজনিত কারণে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কয়েক মাসের মাঝেই মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকেই। দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত অগণন। মারাত্মক প্রাণহরণকারী লিকুমিয়াতে ভোগে মৃত্যুর দিকে যাত্রা করেছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে কিশোরী ‘সাদাকো’, যে মাত্র দুবছর বয়সে তেজস্ক্রিয়তা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। তার অশ্রুসজল জীবনকাহিনী আজও মানুষের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তোলে। হিরোশিমা আর কিশোরী সাদাকো আজ সমার্থক, অবিস্মরণীয়! কিন্তু কেন হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে এই ভয়াবহ বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হল? কী কারণে? সবটাই কী রাজনৈতিক আর যুদ্ধভিত্তিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা? আর এইজন্য একটি জাতিকে পৃথিবীর মাটি থেকে ধুলির মতো উড়িয়ে দেবার জন্য এত বড় দুটি বোমা নিক্ষেপ করতে হল আমেরিকার! অবিশ্বাস্য! বিস্ময়কর! আরও রক্তহিমকরা বিস্ময় হচ্ছে যে, আরও একাধিক আণবিক বোমা জাপানের ওপর নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের! কারো কারো মতে ২৯টি! ভাবতেই মাথার ঘিলু গলে যাওয়ার মতো উপক্রম! কারণ একটাই রাজনীতি। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় কব্জা করা। পুঁজিবাদ আর সাম্যবাদ তথা সমাজতন্ত্রের স্নায়ুযুদ্ধ। এই যুদ্ধে বিশ্বের সমস্ত অর্থ হস্তগতকারী অজেয় একটি সম্প্রদায়ের কারসাজি বা কূটখেলা।

মানবকল্যাণের জন্য প্রদত্ত নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের আহবানে বা পরামর্শে উগ্রযুদ্ধবাদী হিটলারকে পরাভূত করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি.রুজভেল্ট হাতে নিলেন ব্যয়বহুল আণবিক বোমা তৈরির ‘ম্যানহাটেন প্রকল্প’–দায়িত্ব অর্পণ করলেন আরেক উগ্রবিজ্ঞানী-গবেষক ড.ওপ্পেন হাইমারকে কিন্তু লক্ষ্য ঘুরে গেল নাৎসি জার্মানির দিকে নয়–অপেক্ষাকৃত দুর্বল সাম্রাজ্য জাপানের দিকে। কেন? এশিয়া মহাদেশে আধিপত্য বিস্তারের জন্য। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এশিয়া মহাদেশকে হাতছাড়া করা যাবে না। আর এশিয়ায় প্রবেশ করার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থান করছে জাপান–যা একমাত্র বাধা। একে সরিয়ে দিতে হবে। ফলে চলতে লাগল ‘এটমবোমা’র দ্রুত উন্নয়ন এবং আমেরিকার সঙ্গে জাপানকে যুদ্ধে জড়ানোর গভীর এক ষড়যন্ত্র।

১৯২৯-৩০ থেকেই চলছে আমেরিকায় অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক মন্দা। নতুন সমরবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জাপানও উত্তর-পূর্ব চীনের খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল মাঞ্চুরিয়ায় উপনিবেশিক সম্প্রসারণে ব্যস্ত। কিন্তু ওটা নিয়ে বহু বছর ধরে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে লড়াইও চলছে। জাপান ওদেরকে হটিয়ে দিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতা অধিষ্ঠিত করেছে মাঞ্চুরিয়াতে যা শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মনঃপূত নয়! ষড়যন্ত্রের অনলে এই ঘটনা এবার ঘৃতবর্ষণ করল। এর আগে–প্রায় ২০০ বছর পূর্ব থেকে যখন সামুরাইশক্তি জাপান বহির্বিশ্ব থেকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্ন–নিষিদ্ধ রাষ্ট্র–তাকে উন্মুক্ত করার ষড়যন্ত্র শুরু করে আমেরিকা–তারই কার্যকর প্রক্রিয়া ছিল হাওয়াইই প্রদেশের নৌঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রমণে উত্যক্তকরণ। যুদ্ধে জড়ানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না জাপানের, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও জড়ায়নি। কিস্তু জাপানকে যুদ্ধে না জড়ালে তো আমেরিকার স্বার্থ উদ্ধার হবে না!

প্রমাদ গুনলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়ার জন্য জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কোনো যুদ্ধে জড়াবেন না। কিন্তু যুদ্ধে না জড়ালে, “ওয়ার মেশি “ চালু না হলে মার্কিন রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে স্থবির হয়ে যাবে। তাই একই পথের পথিক শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী জাতিভাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সঙ্গে সমুদ্রবিহারে গিয়ে গোপনে পরিকল্পনা করেন, আর সেটা হল, পেছনের দরজা দিয়ে মহাযুদ্ধে জড়াতে হবে। তা না হলে সমূহ ক্ষতি! কী ক্ষতি?

প্রথমত, বিশ্ব-অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরম অর্থনৈতিক মন্দাকে দূর করা যাবে না।

দ্বিতীয়ত, রাশিয়ায় সম্রাট জারের আমল থেকে নির্যাতিত, নিপীড়িত লক্ষ-কোটি ইহুদি জাতি-জ্ঞাতিভাইকে উদ্ধার এবং ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করা যাবে না।

তৃতীয়ত, এশিয়ায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য হস্তগত হয়ে যাবে কমিটার্ন-কমিউনিস্ট-বিরোধী নাৎসিদের হাতে।

চতুর্থত, বিশ্ব-রাজনীতির হর্তাকর্তা বলে পরিচিত আমেরিকার প্রভাব-প্রতাপ বিলীন হয়ে যাবে।

পঞ্চমত, রাষ্ট্রহীন ইহুদিদের স্বর্গরাজ্য আমেরিকাও দখল হয়ে যাবে পরাক্রমশালী নাৎসিদের দ্বারা। কাজেই জাপানকে যুদ্ধে জড়াতে পারলে সব কেল্লা ফতে!
বস্তুত তাই হয়েছিল। গভীর-গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রমণের আয়োজন করেছিল আমেরিকাই কুখ্যাত “ভেননা প্রজেক্ট” এর উদ্গাতা মার্কিন প্রশাসনের ইহুদি কর্মকর্তা “জায়োনিস্ট” হারি ডেক্সটারের মাধ্যমে নকল “হার্ল নোট” জাপান সরকারের কাছে প্রেরণ করে। যাতে প্রবল চাপ ছিল চীনে জাপানের উপনিবেশ ‘পাপেট রাজ্য’ ‘মাঞ্চুকুও’ তথা ‘মাঞ্চুরিয়া’ থেকে সরে আসার জন্য। যা ছিল অসম্ভব ব্যাপার প্রাকৃতিক সম্পদ তথা এনার্জির দিক দিয়ে একেবারেই দরিদ্র জাপানের জন্য–কারণ সাম্রাজ্য চালানোর জন্য মাঞ্চুরিয়া ছিল লাইফ-লাইন বা আয়ুরেখা। কাজেই জাপান আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার গুপ্ত মহাফাঁদে পা দিতে বাধ্য হল ১২বার আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতা (negotiation)প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর।
যুদ্ধের ঘোষণাপত্র পাঠানো হল আমেরিকার প্রশাসনের কাছে কিন্তু সেটা জাপানি রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে যথাসময়ের বদলে পৌঁছানো হল এক ঘণ্টা পরে রহস্যজনকভাবে! আজ পর্যন্ত এই রহস্যের কূলকিনারা করা যায়নি। এই অপ্রত্যাশিত বিলম্বই কাল হয়ে দাঁড়ালো জাপানের জন্য। ততক্ষণে কোনো প্রকার বাধাবিহীন সমুদ্রপথে তরতর করে এগিয়ে গিয়ে জাপানি নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল ইয়ামামোতো ইসোরোকুর নেতৃত্বে পার্ল হারবার লণ্ডভণ্ড এবং নরক করে দেয়া হল যুদ্ধজাহাজ থেকে অবিরল বোমাবর্ষণে! এরকম ক্রোধান্বিত বারুদজ্বলা আক্রমণ আধুনিক যুগে মানবজাতির ইতিহাসে দুটিই ঘটেছে এক পার্ল হারবারে অন্যটি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে। দুপক্ষেরই রাজনৈতিক প্রতিশোধের উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই দুটি ঘটনা!

পার্ল হারবার আক্রমণের পর মার্কিন কর্তৃপক্ষ হাতে পেয়েছিল জাপানের বিলম্বিত যুদ্ধঘোষণাপত্র। ততক্ষণে জাপানের ভাগ্যে “আগ্রাসী আক্রমণে“র হোতা হিসেবে কলঙ্কতিলক লেপটে গেছে! এই আগ্রাসনের যথার্থ জবাব দেবার লক্ষ্যে সমগ্র আমেরিকা যুদ্ধংদেহী মনোভাবে জ্বলে উঠল! রুজভেল্টের কল্লা ফতের পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। যুদ্ধ তো বেঁধেই গেল আমেরিকার সঙ্গে সুতরাং এখন বাঁচা-মরার লড়াই। বাঁচতে হলে এনার্জি ও খাদ্য দরকার। উপায়ন্তর না দেখে জাপান রাতারাতি প্রায় সমগ্র এশিয়াকে পদানত করল। প্রায় চারটি বছর আগলে রেখেছিল এশিয়াকে। এও কম কথা নয়! কিন্তু ভেতরে ভেতরে জাপান ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। তার সমস্ত গুপ্ত চিন্তা ও পরিকল্পনাই চলে যাচ্ছিল গুপ্ত “অরেঞ্জ কোডে”র মাধ্যমে আমেরিকার হাতে। আমেরিকা যে খুব শক্তিশালী বোমা তৈরি করছে এ সংবাদও জাপান পেয়েছিল। এটম বোম তৈরি ও পরীক্ষার খবরও তার অজানা ছিল না। অজানা ছিল না জাপান সরকারের যে, সেই বোমা জাপানের একাধিক শহরে নিক্ষেপ করা হবে। হিরোশিমা ও নাগাসাকি যে লক্ষ্যবস্তু জানাই ছিল তাই হিরোশিমাতে প্রচুর সৈন্যসমাবেশ ঘটানো হয়েছিল। যুদ্ধবন্দি মার্কিন সেনাদেরকে শহরের বাইরে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছিল শোওয়া সম্রাট হিরোহিতোর নিরদেশে। শহরে মানুষের জন্য রেশনের খাদ্য তলানিতে পৌঁছেছিল। কিন্তু নাগরিকদেরকে বোমার বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।

১৯৪৫ সালের দিকে ক্রমশ যুদ্ধ পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে লাগল। হিটলার পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। ইতালির অবস্থাও তথৈবচ। রাশিয়ার উত্থান এবং জার্মানি ও চীনের দিকে ধাবমান পরিস্থিতি জাপানের ভিত নাড়িয়ে দিল। দেখা দিল সেনা ও খাদ্য সঙ্কট। মাঞ্চুরিয়ার দিকে ধাবমান চীনা ন্যাশনালিস্ট সেনাপতি চিয়াং কাইশেক। জাপান অশনিসংকেতের আভাস পেয়ে মিত্রশক্তির সঙ্গে মধ্যস্থতা করার জন্য রাশিয়ার শরণাপন্ন হল। নিজেরাও আণবিক বোমা তৈরি করার মতো দক্ষতা অর্জন করেছিল জার্মানিকে অনুসরণ করে। বেগতিক দেখলে আমেরিকার বুকেও ফেলে দিয়ে আসবে তার দুরন্ত-অপ্রতিরোধ্য ‘তোক্কোবুতাই’ বা ‘কামিকাজে’ অর্থাৎ “মানববোমা”র দেববায়ু যুবযোদ্ধারা’–কিন্তু সম্রাট সে পরিকল্পনা বাতিল করে দেন বলে শোনা যায়। যথেষ্ট হয়েছে! আর রক্তের হোলিখেলা তিনি দেখতে নারাজ। কারণ ১৯৪৫ সালের শুরু থেকেই আমেরিকা ক্রমশ আক্রমণ বৃদ্ধি করে চলেছে জাপানের ওপর। মার্চ মাসের ১০ তারিখে রাজধানী টোকিওকে প্রায় ধূলিসাৎ করে দেয় বোমারু বিমান দিয়ে চিরুনি-আক্রমণে! এক রাতে এক লক্ষ লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়, জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। দেড় লক্ষ মানুষ জখম হয়। সাড়ে আট লাখ বাড়ি বিধ্বস্ত। এই আক্রমণের শিকার হয় প্রায় ৩ কোটি ১ লক্ষ টোকিওবাসী।

ইয়োরোপে ১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যায়ের বাতি জ্বালিয়ে দেয়। ৮ সেপ্টেম্বর মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ইতালি। পরাজয় ঘটে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনী সরকারের। সম্রাট তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল তাকে বরখাস্ত করলে তিনি উত্তরাঞ্চলের একটি রাজ্যে জার্মানির সহযোগিতায় নিজের সরকার গঠন করে নাম দেন ‘ইতালিয়ান সোস্যাল রিপাবলিক।’ কিন্তু নিজেকে বেশিদিন সুরক্ষা করতে পারেননি, বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হন ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল। এদিকে ইতালি আত্মসমর্পণ করলে এতে ক্রুদ্ধ হয়ে অক্ষশক্তির (জার্মানি, ইতালি ও জাপান) প্রধান শক্তি নাৎসি জার্মানি ইতালি দখল করে নেয়। এর পর থেকেই সঙ্কট ঘনীভূত হতে থাকে। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলারও বার্লিন যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সমাপ্তির দিকে যায় ইয়োরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ।

এদিকে ১৯৪৪ সাল থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরের সাইপানসহ ছোটছোট দ্বীপগুলো জাপানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে থাকে মিত্র বাহিনী আমেরিকা। ১৯৪৩ সালে ভারতের স্বাধীনতার জন্য ইম্ফল অভিযানে নেতাজির নেতৃত্বে ধাবমান ৫০ হাজারের বেশি জাপানি সেনা। চীন, মোঙ্গল সীমান্তসহ এশিয়ার বিভিন্ন উপনিবেশে বিপুল সেনা নিয়োজিত থাকায় প্রশান্ত মহাসাগরে সেনা সঙ্কট দেখা দেয়। দ্বীপগুলো বেদখল হয়ে গেলে জাপান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন ১৯৪৫ সালের মে মাসে মিত্রদেশ জার্মানি রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়।

জুলাই মাসের ২৬ তারিখে জার্মানির পোসডেম শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলন যাকে সংক্ষেপে বলা হয় ‘ডোসডেম ডিক্লারেশন’ বা ‘প্রকলেমেশন ডিফাইনিং টার্মস ফর জাপানিজ সারেন্ডার’ অনুযায়ী জাপানকে শর্তহীন আত্মসমর্পণের আহবান জানায় ব্রিটেন, আমেরিকা এবং চীন। যদি প্রত্যাখ্যান করা হয় তাহলে জাপানের বিরুদ্ধে কঠোরতর অভিযান চালানো হবে।

কঠোরতার নমুনা হিসেবে গত ১০ মার্চে টোকিওতে চিরুনি-বোমা বর্ষণ করা হয়েছে। তবে উক্ত ডিক্লারেশনে কোথাও আণবিক বোমা ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা ছিল না।
কিন্তু জাপান এই আহবানকে অপমান বা অপদস্থ বিবেচনায় প্রত্যাখ্যান করে। বরং রাশিয়ার মাধ্যমে একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন সম্রাট হিরোহিতো যে, জাপানের রাজকীয় শাসনব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না, রাজকীয় সেনাবাহিনী বিলুপ্ত হবে স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তভাবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে জাপানি আইনে। কিন্তু রাশিয়া এর আগে ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টা শহরে অনুষ্ঠিত ইয়াল্টা সম্মেলনে প্রতিজ্ঞাস্বরূপ জাপান-অভিযানের কথা স্পষ্ট করে। মিত্রশক্তিপ্রধান আমেরিকা গোপনেই সিদ্ধান্ত নেয় জাপানকে যুদ্ধবিরতিতে আনার জন্য আণবিক বোমা ফেলার। এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ আগস্ট হিরোশিমা এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপ করেই ফেলে!

এই ঘটনায় জাপান সরকার ১০ আগস্ট তারিখে সুইজারল্যান্ড সরকারের মাধ্যমে মার্কিন সরকারের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠায়। যুদ্ধে পরাভূত, বিপর্যস্ত এবং বিধ্বস্ত জাপানের সর্বক্ষমতার অধিকারী সম্রাট ১৫ আগস্ট আত্মসমর্পণের ঘোষণা জারি করেন বেতারযোগে। এই তারিখেই রাশিয়া দুদেশের নিরপেক্ষ সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে জাপান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মাঞ্চুরিয়া, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

আণবিক বোমা জাপানকে একেবারেই ভস্মীভূত করে দেয়। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে জাপানের সাধারণ মানুষসহ সারাবিশ্বের মানুষ! অথচ এই বোমা নিক্ষেপণ থেকে বিরত থাকার জন্য অনেক বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী ও গবেষক আবেদন জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের কাছে। কিন্তু সেটা প্রত্যাখ্যাত হয়ে ট্রুম্যান পরিকল্পনা-মাফিক দু-দুটো বোমা নিক্ষেপের নির্দেশ দেন।

যুদ্ধের ৫০ বছর পর বহু সুপ্ত, হিমায়িত তথ্যাদি দেশবিদেশের রাষ্ট্রীয় হিমাগার থেকে উন্মুক্ত করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সেসব গবেষণার পর সহজেই বোঝা যায় যে, ইচ্ছে করলেই আমেরিকা এই পদক্ষেপ গ্রহণ না করলেও পারত। যেখানে দুর্বল হয়ে আসা জাপানকে প্রচলিত বোমাবর্ষণে কাবু করা যেত সেখানে কেন আণবিক বোমার মতো ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র ব্যবহার না করলে নয় তার কারণ সম্পর্কে অনেক গবেষণাই হয়েছে এবং হচ্ছে। আর সর্বজনস্বীকৃত কারণ হিসেবে আমেরিকার রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ এবং মানবপরীক্ষার বিকৃত মানসিকতা কাজ করেছে তা না বললেও চলে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জাপানে এসে বোমার ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি দেখে কাঁদলেও আমেরিকার তাতে কিছু যায়-আসেনি।

যুদ্ধের পর জাপানে হিরোশিমা-নাগাসাকি নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি তবে হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক এবং জাপান কমিউনিস্ট পার্টির আমৃত্যু সক্রিয় সদস্যকর্মী শিবাতা শিনগো এই ঘটনাকে ‘ইকিতেরু নিন্গেন জিক্কেন’ বা ‘জীবন্তমানবপরীক্ষা এবং ‘দোওবুৎসু জিক্কেন’ বা ‘জীবজন্তুপরীক্ষা’ বলে অভিহিত করেছেন। তার কারণ ভবিষ্যতে যদি আমেরিকা কখনো আণবিক বোমাদ্বারা বিধ্বস্ত হয় তাহলে কী রকম অবস্থা দাঁড়ায় সেটাই পরীক্ষা করে নিলো।

হিবাকুশা-নারী কবি হাশিজুমে বুন (১৯৩১-) এর ভাষ্য থেকেও অধ্যাপক শিবাতার অভিমতের অনুরণন পাওয়া যায়। হাশিজুমে যখন হিরোশিমায় তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হন তখন তিনি ১৪ বছরের কিশোরী। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে জানান, যুদ্ধের পর আমেরিকা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ‘গেনবাকু শোওগাই চোওসা ইইনকাই (এবিসিসি–এটমিক বোম কজালিটি কমিশন) গঠন করে। সেখানে আমরা যারা জীবিত তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের শরীর থেকে রক্ত নেয়া, ক্ষত ও কেলোয়িডের ছবি ধারণ, বাড়ন্ত মেয়েদের স্তনাগ্র এবং নতুন গজানো লোমের পরীক্ষা করা হয়। যারা তেজস্ক্রিয়তায় মারা গেছেন তাদের তন্ত্রের গ্রন্থিসমূহ নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। মানুষ হিসেবে আমাদের আদৌ কোনো বিবেচনা করেনি কর্মকর্তারা বরং গিনি পিগের মতো পরীক্ষা চালানো হয়েছে। কোনো প্রকার চিকিৎসাই আমরা পাইনি। খাদ্যও ছিল না। বৃষ্টির জলে ক্ষুধা নিবারণ করেছি। প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতগুলো ভালো হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমেরিকার অনুসন্ধান দল নিজেদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাইরের চিকিৎসক, গবেষক বা স্বেচ্ছাসেবীকে শহরে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তেজস্ক্রিয়াতাজনিত অবস্থা এবং পরিস্থিতির কোনো সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশের ব্যাপারেও কড়াকড়ি আরোপ করে। জাপান সরকারও তাতে সহযোগিতা করেছিল।

কবি হাশিজুমের বক্তব্য আজও শোনা যায় হিরোশিমা দিবসে কোথাও না কোথাও। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, হিরোশিমা ও নাগাসাকির আণবিক ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস জাপানের কোনো পাঠ্যগ্রন্থেই পড়ানো হয় না! এমনকি, শান্তির কথা বললেও, জাপান সরকার বা জনসাধারণ ৬ আগস্টকে “আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস” হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আবেদন বা আন্দোলন করতেই পারে কিন্তু রহস্যজনকভাবে সেটাও নীরব বিগত ৭৬ বছর ধরে!

তবু ইতিহাসকে মুছে ফেলা যায় না। আর যায় না বলেই মনে করি, ৬ আগস্টকে স্বীকৃতি দেয়া হোক ‘বিশ্বশান্তি দিবস’ হিসাবে! যাতে মানুষের বিবেক আরো একবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় শান্তি ও মানবতার স্বপক্ষে।

 

প্রবীর বিকাশ সরকার

জন্ম ১৯৫৯ সালে। সাহিত্যচর্চার শুরু ১৯৭৬ সালে। জাপানে গমন ১৯৮৪ সালে।
‘বাংলাদেশ সোসাইটি জাপানে’র সাংস্কৃতিক এবং প্রকাশনা সম্পাদক (১৯৮৭-৯০)।
‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখা’ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা (১৯৯০)।
‘আড্ডা টোকিও’সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য (১৯৯৪)।
‘সাংবাদিক-লেখক ফোরাম জাপানে’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক (১৯৯৮)।
মাসিক ‘মানচিত্র’ প্রকাশ ও সম্পাদনা (১৯৯১-২০০২)।
জাতীয় শিশু সংবাদপত্র ‘কিশোরচিত্র’ প্রকাশ ও সম্পাদনা (২০০৭)।
জাপানের তাকুশোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি গবেষক (২০০৪-৫)।
গিফু মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দক্ষিণ এশিয়া গবেষণা কেন্দ্র জাপান এর বিশেষ অতিথি গবেষক (২০২০-২১)।
গ্রন্থ : অসংখ্য গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থগুলো- জানা অজানা জাপান ১.২.৩
খণ্ড, জাপানের নদী নারী ফুল, জাপানে গণিকা সংস্কৃতি, Rabindranath Tagore: India-Japan Cooperation Perspectives, রবীন্দ্রনাথ ও জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক ১.২.৩ খণ্ড, জাপানে রবীন্দ্রনাথ, জাপানি ব্যবসায়ীদের মননে রবীন্দ্রনাথ, সূর্যোদয়ের দেশে সত্যজিৎ রায়, অতলান্ত পিতৃস্মৃতি, কলকাতার স্মৃতিকথা এবং নিহোন গা আজিয়া অ মেজামে সাসেতা (জাপানি)।
সম্মাননা : নিহনবাংলা.কম বিশেষ সম্মাননা ( ২০১৫)
গুনমা, সাইতামা এবং তোচিগি প্রবাসী বাংলাদেশী বিশেষ সম্মাননা (২০১৯)
বিবেকবার্তা বিশেষ সম্মাননা ( ২০১৯)

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top