খাতুনে জান্নাতের একগুচ্ছ কবিতা

ব্যবচ্ছেদ

মানুষ শব্দটি মর্মার্থ হারিয়ে মাকাল মাকাল
ধূর্তেরা খেলছে মানবতা-মুক্ত গুঁটিবল
কতকাল কাঁটাফ্রেমে লটকানো
ব্যবচ্ছেদিত নিয়ম আর স্তূপিকৃত পাপের পাহাড়
বন্য শুকরের আস্ফালনে বারুদের রাত্রি জেগে ওঠে না
মুখপোড়া ডাহুকের দল লুকিয়ে থাকে
মাঝখানে খোলস ও ডিম…

অপারেশন টেবিলে সারি সারি অস্ত্র,
মস্তক, কঙ্কাল, পেশী, জঙ্ঘা, উরু
লউয়ের ধারা
বহমান ক্রোধ, ফনায়মান বিবমিষা

ব্যবচ্ছেদ কেবল ব্যবচ্ছেদ..

 

বাতিহীন পারাবার

আলো নিভে গেছে বহু আগে
বাতি জ্বালাবার কথা ভুলে গিয়ে সন্তানদের শোনাচ্ছি আঁধারের গল্প
গল্পগুলো সুমিষ্ট ফল আর নহরের স্রোতে প্রবাহিত
পথ চলতে চলতে পৃথিবীর মতো কাঁদে পথও
আমাদের পাথরের চোখেও কান্না থাকে
সে কান্না মায়াবী হলেও তার রেশ পৌঁছায় না কারও মনে
আসলে মন তো বহু আগেই পাথর বনের ঘোরে
আমরা আমাদের সন্তান জন্ম দিতে দিতে কখনো পাথর প্রসব করি
পাথর মাতাকে চেনে না, চেনে না বোনও
শুধু গড়িয়ে পড়তে জানে
দেশের বুকে পাথর পেরেক হতে জানে …

 

স্পর্শ-৪

তোমার ঠোঁটের স্পর্শে শহীদ হয়ে যাই, বাহুতে বিলীন
দুঃখগুলো মুছে যায় স্পর্শের ইরেজারে।
কাল ভেসে থাকে আকালের গুন হটিয়ে।
রাশি রাশি সন্ধ্যাফুল
ঘন আঁধারের ভেতর হাসিখুশি বিকেল,
সঘন খরায় বৃষ্টির কলতান।
তুমি ছুঁয়েছো,
ইচ্ছা পাহাড় হয়ে আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
তুমি বলেছো, সকালটা সুবাসে ভরপুর,
দিঘির অতলে জলের সন্তরণ; আয়নার মতো ভাসছে অতীত ভবিষ্যৎ।
কান্না ঝরছে শিশির হয়ে
গল্পগুলো অলংকারে মন্দ্রিত,
কবিতাগুলো চোখ,
প্রেমের সংগীত যেন আত্মা!
হাতের তালুতে হাত বাঁধা হলে
কে আর খুঁজে পায় জ্বলন দহন!
তোমার আকাশ চোখে আমি এক তারা।
হৃদয় ভালোবাসার সমুদ্রে এক সোনালি মাছ।

 

বিলয়

১. প্রেমের হাত ছুঁয়ে বুঝেছি ওখানে শস্যদানা আছে রাসায়নিক মেশানো। কয়েকটি ফুল পড়ার টেবিলে; শ্বাসে নিতে গিয়ে বুঝলাম বিষও ছিল সাথে –

২. রাতে ঘুমুতে গিয়ে দেখি অর্ধেক শরীর কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না
৩. স্বপ্ন স্বপ্ন করে কতই ঝরলাম। আজ স্বপ্নগুলো অন্ধের চোখে তারা হয়ে জ্বলছে…
৪. চোখদুটো অক্টাভিও পাজের বইয়ে রেখে ঘুমুতে আসলাম। তুমি হাসলে যেন আমার চোখই আমার আসল শত্রু…
৫. গায়ে হাসিচূর্ণ ছড়িয়ে দিল ভোর। এবার বদলে ফেলো দিনরাত।

 

গ্রহণ

উড়ছি খাতার ছেঁড়া পাতা
তোমার নজরে পড়ব বলেই
কত কাটাকাটি আঁক, দাগ— তুমি পড়ে নিও—
পড়ে নিও জলের গেলাসে মিশে থাকা চোখের দ্রবণ।
সন্ধ্যার প্রমোদে-
টুটে যাওয়া নূপুরের আর্তনাদ।
বুঝবে ক্ষতের মিশে থাকা-
ভারী কসমেটিকসের আড়ালে,
হাসির আড়ালে বেদনা গ্রহণ!
তোমার আত্মায় মিশবো বলেই
ডুবছি জলের স্রোতে অহরহ চিতা বহ্নিমান…

 

ভষ্ম

প্রতিদিন খুন হয়ে যাই
প্রতিদিন জন্ম নিই নতুন জীবন
তুমিহীন এ জীবন ডানাভাঙা রোদ,
নদীর গভীরে থাকি নয় নিজেই এক নদী আবহমান…

মাটি আর বালিতে মাখামাখি জীবনের স্বাদ
আঙুলে শব্দের জমি
রক্তাক্ষরে চাষ দিই ফসলের বরাভয়
কাল কেটে চিত্র আঁকি লুপ্ত অবসর।

চোখের পাতায় ঝড়
দহন দিঘিতে খেলাঘর
প্রতিদিন আলোড়ন
প্রতিক্ষণ সূক্ষ্ণতর অনুভব নাদ।

তুমিহীন এ জীবন ভষ্মসম,
ভষ্ম থেকে উঠে এসে ভষ্মে বিলীন…

 

পতন

নীচে নেমে আসছে আকাশ
আর ভাগ্য
পৃথিবীর জন্য শোক প্রস্তাব গ্রহণ করছে জাতিসঙ্গ

করোনার উচ্চাঙ্গ নৃত্য।

এ সময়-
পলায়নপর পথের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কোমরবাঁধা নারী
পুরুষেরা বেদম পেটাচ্ছে?
ছেঁড়া বাতাসের শাড়ি পরা কাল।
বহুদিনের বস্তাবন্দী কথারা বাসি হয়ে গেছে ঢের আসে…

কী কথা শোনাতে চাও কার্তিকের পূর্ণিমা,
মেঘের সোনালি দল?
ঘরবন্দী সন্তানেরা ঘুমিয়ে পড়েছে
উড়তে ভুলে গেছি আমরাও…

 

জন্মদিন

প্রতিটি জন্মদিন পেছনে ফেলে দেয় একটি বছর
মুছে যেতে থাকে কত কত শব্দের আগর
গহীন স্পর্শের আবহ
হেলেঞ্চা ঝোপের ভেতর লুকোচুরি খেলা ফাল্গুন-শীত
দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিমার মতো একটি জীবন, একটি সহচর।

হৃদয়টাকে খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও
রাসায়নিক বিষে মেশা শস্যের মতো কাতরাচ্ছে কোথাওবা!
বন্ধু থেকে প্রেমিক. প্রেমিক থেকে প্রতারকের প্রবঞ্চনা
কালচে খয়েরি হয় বেশ আগেই…

শব্দের ডামাডোলে বধির শ্রবণেন্দ্রিয়
ঝরে ঝরে পড়ছে স্বপ্নগুঁড়ো

মা বলতেন,
হাভাতীদের স্বপ্ন থাকতে নেই
দিদি বলতেন, প্রেম এক দুর্গম পাহাড়ের নাম
বাবা মেলে ধরতেন পৃথিবীর জটিল শব্দ পুরাণ

তবুও স্বপ্ন আঁচলে ধরে রাখি
জলের লহরে গড়িয়ে পড়ে তারা
পাথরের বুকে জন্ম নেয় ঘাস-লতা
জীবজগতের কান্না প্রাতরাশের টেবিলে উঠে আসে
টেবিলের কাঠের আত্মায় জমা হয় সংলগ্ন সমাচার।

উইকলেনের বঞ্চনার টুকরো টুকরো কাচ
বাসমতী চালের সুঘ্রাণে গেঁথে থাকে
মাসিক ভাতার সাথে সমূহ আর্তনাদ জড়ো করে সবুজ চায়ের সাথে পান করি;
পান করি ষড়যন্ত্রের দীর্ঘশ্বাস…

চলন্ত দিনে চুমু ভাঙার শব্দ আর বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।

বিকেলের বাহারি হাওয়ায় হতাশায় গলে যাওয়া রোদের রুমালে চোখ মুছি

আকাশের বানান লিখতে লিখতেই জেগে থাকি প্রজাপতি ডানা
যদিও আকাশ মানে শূন্যতা কে না জানে!

মনের পলিতে নদীদের নাব্যতা সারিয়ে তুলছি
নর্দমা কাঁদছে গুটে-জমানো বেদনায়…
সূচীপত্রের নকশায় কাটাকুটি
একচোখ চশমার কাচ মুছতে মুছতে
ডিনারের সাথে আগামী দিনের পরিকল্পনা চিবিয়ে চিবিয়ে খাই।

হাঁটছে জীবন…
পেছনে পড়ে থাকে পুকুরের ঘাটকুলে ননদ ভাবীর গল্পের আয়োজন
শুনিনি লটকা জবার ঝাড়ের আত্মকথা
পাখিদের কান্নার রোল
বৈশাখ বাতাসের দমকা হাওয়ায়
গৃহস্থালি কর্কশতা মিলেমিশে আলকাতরা হয়ে যায়
শোনা হয়নি ঘাসের জীবন

খোলা আর বন্ধ করা বাতায়নের কষ্ট,
দরোজার অপেক্ষার আত্মকথন
প্রেমপত্রের উত্তর দিতে না পারার অক্ষমতা

হে সময়–জ্বলনে গলনে রোদনে মালিন্যে দিশেহারা হিসেবি হৃদয়
কে না জানে জীবন তো কেবল শুরু ও শেষের উপাখ্যান!

 

আত্ম পরিচয়

পিতাকে খুঁজতে খুঁজতে ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি

যা কিছু অর্জন সবই ভুল পরিচয়ে
অচেনা অভিক্ষেপে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে
কোথায় কোন শস্যদানার ভেতর আমাদের পরিচয় লুকানো রয়েছে?
কোথায় কোন জলসাঘর সাক্ষী রেখেছিল জন্মের কান্নার?

শুধু হাসি, অট্টহাসি দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া
লাঙ্গলের ফলায় বা কোদালের কোপে ছিঁড়ে ফেলা মাটি
কামারের হাপরের ভাপে জেগে উঠা আগুন

জ্বলছি তো জন্ম থেকে বিভেদ আগুনে…
পাথর সভ্যতা চরায় জংধরা পা
কোথায় মাতাদের পরিচয় হারানো কাহিনী বিধৃত জানায়নি কেউ
অর্ধেক পরিচয় নিয়ে অর্ধ-অঙ্গও দৌড়াতে গিয়ে প্রায়ই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে নক্ষত্র, ছড়িয়ে পড়ে হাতে ধরা আলোর মশাল।
ছুটতে ছুটতে এডিসনের মতো উঠে পড়ি ট্রেনে
ট্রেন চলতে থাকে অচেনা অভিমুখে।
ফেরার দরোজা বন্ধ হয়ে যায়..

 

পরকীয়া উঠোন

পড়ে আছি সভ্যতার ক্রুশকাঠে যিশুর জীবন
শিল্পের মাঠে গড়াগড়ি শুকনো তৃণ
ইচ্ছারা আকর্ষী বাড়াতে বাড়াতে নুয়ে পড়েছে বহু আগে…
তবুও ঘুরছি পাতা বাহারের অলিন্দে
ফুলফোটানো অভিপ্রায়।
তুমি আসো ভালোবাসার মলম লাগিয়ে গুম হয়ে যাও।
প্রতিদিনের ভগ্নতা আর দমনে নিঃস্ব চিৎকার গ্লাসে গ্লাসে পান করি।
বিবেকের মেরুদণ্ড ভাঙার মড়মড় শব্দ শুনতে পাই।
কারও গলিত মাংসের গন্ধে দলিত হয় শ্বাসযন্ত্র।
চিরহরিৎ শ্যামলতায় বাস করে রুক্ষতা
শব্দেরা নিজস্ব ট্রেনে চড়ে চলে যায়…
অনুভূতি আঙুল কামড়ে পড়ে থাকে পরকিয়া আঙিনা।

 

প্রশ্ন

জ্বলে যাচ্ছে জলজ জনম
সরে যাচ্ছে কাম ও স্মরণ
ক্ষরণের ঘুণপোকা খাচ্ছে রঙ ও তাবিজ
টেনে টেনে কাকের চিৎকার ও পিঁপড়ের শ্রমে ঘামে নেয়ে ওঠা
চলমান বিক্ষত ও ভয়ের যাঁতাকল

রাত্রি বাতিহীন
দিন আশক্তিবিহীন
আশঙ্কার আসমান মেঘহীন

হে শিল্পের শাবক
নির্মাণ সামগ্রীর অভাবে কী
এভাবেই পড়ে রবে সম্পর্কের দীর্ঘতম বাঁধ!
সামাজিক প্রহর ছায়াহীন
মাঠ জলা ও জঙ্গল ভরে উঠছে শবদেহে
প্রেম নিবেদনহীন
শিশুদের দৃষ্টি প্রশ্নহীন
মায়েরা শব্দহীন

পরজীবী সতর্কতা গণ্ডগোল,
ভুল ও ভুলের মহাবোল…

 

নাব্যতা

যেদিন মাকে মিশিয়ে এসেছি মাটির সাথে
সেদিন থেকে নিজেকে মাটি মনে হয়
এ দেহে ফুল ফল কতই তো হলো
তোমরা ছড়িয়ে দাও তীর্যক রাসায়নিক
বিষে আক্রান্ত পলল ভূবন
আমি তো বহন করছি হাজার বছর ধরে
পরকিয়া পিতাদের বিষ!
নর্তকীর ঘুঙুরে টুটে গেছে স্বপ্ন জ্বালাবার ঝাড়বাতি।
ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজ, তুর্কী, আরবি
বিষে বিষে বিষ স্কয়ার, কিউব বা টু দি পাওয়ার।
তাই তো সন্তানেরা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষের জারক রস
জাহাজ ঘাটায়, নগর, ভাটায়, বাজারে, ময়দানে
ক্রিয়া ও কর্মনাশের নীলনকশায় নাব্য জলসা….
যেদিন মাকে হারিয়ে পথ খোঁজা শুরু
নদীর উৎস দেখি চোখে…
অন্তত ছুঁড়ো না ধুলোবিষ উৎস অভিমুখে…

 

যত্ন

অতিথি পাখির নামে টিপসই দিয়ে
ফিরে আসো দ্রুতগামী ট্রেন
স্লিপারে পায়ের কাদা মুছো শব্দাতুর রেলওয়ে জংশন
তুমি পেন্টাগন ; নিজেই কর নিজের অপরাধ চুরি
ধুলা উড়বে বলে জল ঢেলে খালি কর নদী
কতটা ভরন্ত হলে তুমি ডুবে যাবে—
ডুবে যাবে জল ডুবডুব পাখি?
কেউ জানে না তোমার উড়াল যত্ন করে রাখি…

 

মৃত্যুফুল

কাছে আসো মৃত্যুফুল
হেঁটে যাবো অরণ্যের ছায়া
আলোর গুহায় জুঁটিবাঁধা
তুমি-আমি যমজ বকুল…

 

খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাতের জন্ম সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ থানায় ১২ জুলাই ১৯৬৯।

পেশাগতভাবে শিক্ষকতা ও সমাজকল্যান মূলক সংগঠনের প্রধান হিসাবে বাংলাদেশের ৪টি জেলায় কর্মকান্ড চালান দীর্ঘদিন। ২০০৭-২০১৪ সাল পর্যন্ত বিলেতে বসবাস করার পর বর্তমানে বাংলাদেশে বাস করছেন।

১৯৮৯ সালে একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় তাঁর লেখা ছড়া , গল্প প্রকাশিত হয়।  দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৭ সাল থেকে বিলেতে অবস্থানকালে আবার সাহিত্যচর্চা শুরু করেন নতুনভাবে। তাঁর কবিতা নস্টালজিক অনুভূতি, নারী মুক্তি, প্রকৃতি, বোধ ও বিভেদ আবহ, ও উজ্জীবনমূলক।

কবিতাগ্রন্থ: দিনান্তে দেখা হলে (২০০৯) জীবনের কাছে ফিরে (২০১০), নিরন্তর রোদের মিছিলে (২০১২), মুঠো খুলে দেখি(২০১৬)। নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ‘ দ্য রে অফ লাইফ এন্ড নেচার‘ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে।  এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, জার্মান, স্পেন ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় বাংলা কবিতা ও তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে। উপন্যাস :শিউলির কথা (২০১৯)।

পুরস্কার: লক্ষীপুর সাহিত্য সংসদ পুরস্কার ২০১৬, কবিবরণ সম্মাননা ২০১৬ , বিশ্বশান্তি পদক ২০১৮ এবং কৃত্তিবাস স্মারক সম্মান।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top