সেলিম জাহানের মুক্তগদ্য: তৃষিত কপাল

এ লক্ষণ বিলক্ষণ চেনা আমার। দেখেছি বহুবার আমাদের কন্যাদ্বয়ের শিশুকালে। জ্বর আসতো তাদের নানান কারণে – মাঝে মাঝে হু হু করে বেড়ে যেত সে জ্বরের মাত্রা। ছোট্ট মুখ লালাভ হয়ে যেত, চোখ দু’টো ছল ছল করত, নেতিয়ে পড়ত তারা। কোলে নিয়ে হাঁটতে হতো ধীরপায়ে ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। কচি হাতে গলা জড়িয়ে ধরত তারা, মাথা এলিয়ে দিত আমার কাঁধে, তাদের জ্বরের উত্তাপ টের পেতাম আমি।

আজ শিশুটিকে দেখে আমাদের কন্যাদ্বয়ের কথাই প্রথম মনে হল। অনেক বড় হয়ে গেছে তারা—তবু, আর সব বাবার মতো, আমার কাছে তো ছোটই রয়ে গেছে তারা। এসেছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে তার ডাক্তারের অফিসে। বন্ধু ভেতরে গেছেন ডাক্তারের দপ্তরে, আমি অপেক্ষা করছি দর্শনার্থীদের কামরায়। সে সময়েই চোখ গেল শিশুটির দিকে। উল্টোদিকের চেয়ারে মায়ের কোলে নেতিয়ে আছে সে। মুখে তার আঙ্গুল পোরা। বাকী লক্ষণ সব আমার জানা। জ্বর এসেছে তার অনেক, বুঝতেই পারছি। স্থির চোখে শিশুটি তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন চলে গেল অতীতে। শৈশবে মাঝে মাঝে জ্বর আসতো আমার। দু’বার তো ম্যালেরিয়াই হয়ে গেল। সারাদিন জ্বরের ঘোরে নিস্তেজ হয়ে থাকতাম। বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে কাপড়-চোপড় না ছেড়েই আমাকে কোলে তুলে নিতেন বাবা। তারপর মৃদুপায়ে হাঁটতেন বাড়ীর বারান্দায়— এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত।আমি তাঁর কাঁধে মাথা নামিয়ে দিতাম। কানে আসতো তাঁর জুতোর মচ্ মচ্ শব্দ। নাকে আসতো ক্যাপেস্ট্যান সিগারেট আর দিলীপ জর্দার মিশ্রিত গন্ধ—বাবা তখন পান-সিগারেট খেতেন খুব। পরে অবশ্য একদিন দু’টোই একসঙ্গে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

দেখতাম, কি অদ্ভুত শ্বেতশুভ্র তাঁর জামার কলারটি, কি কালো তাঁর চশমার ফ্রেম, তাঁর চুলের ঘনত্ব।গুনগুন করে কিছু একটা সুর ভাঁজতেন তিনি— কোনদিনই তা ধরতে পারি নি। হাঁটতে হাঁটতে আমার পিঠে আস্তে আস্তে মৃদু চাপড় মারতেন তিনি। অত জ্বরের মধ্যেও কি এক আবেশ নেমে আসতো আমার সারা দেহে, তন্দ্রায় চোখ বুঁজে আসতো, দু’হাত দিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরতাম।

ম্যালেরিয়ার সময়ে কুইনিন খাওয়ার কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে এখনো। ট্যাবলেট গিলতে পারতাম না বলে, সেটা গুঁড়ো করা হতো। বাবা আমার নাক চেপে ধরে গলায় ঢেলে দিতেন সে গুঁড়ো। সেই সাথে মুখে দেয়া হতো গ্লাসের পানি। সারা মুখ গা গুলিয়ে ওঠা তেতো হয়ে যেতো। পাশে চামচে চিনি নিয়ে মা দাঁড়িয়ে থাকতেন। সঙ্গে সঙ্গে চিনি ঢেলে দিতেন মুখে। মাঝে মাঝেই উগরে দিতাম পুরো অষুধ!

স্কুলের উঁচু ক্লাসে বা কলেজে পড়ার সময়ে গলায় ঠান্ডা লেগে যেত আমার— শীতকালে বরিশালে শীত পড়ত খুব। গলায় ঠান্ডা লেগে জ্বর আসতো যখন-তখন। জ্বর এলেই মাঝের ঘরে মায়ের খাটে টান টান হয়ে শুয়ে থাকতাম পাতলা সুজনি গায়ে টেনে। উল্টোদিকের দেয়ালে বড় দেয়াল ঘড়িটা ঘন্টায় ঘন্টায় বেজে উঠতো। ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে দেখতাম। চারদিকটা কেমন যেন হলদে বিবর্ণ মনে হোত। চোখ বুঁজতাম অবসাদে।

মধ্যদুপুর পার হলে টের পেতাম মা ঘরে ঢুকছেন। খস্ খস্ শব্দ উঠতো পাটভাঙ্গা শাড়ীর। সাবানের মৃদু মিষ্টি সুরভি ছড়িয়ে পড়তো চারদিকে। বুঝতাম সদ্যস্নাতা তিনি। আমার শিয়রের কাছে এসে আমার কপালে হাত রাখতেন তিনি। জ্বরতপ্ত কপালে মা’র ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ সমস্ত উত্তাপ যেন শুষে নিত। সারা শরীরে কেমন একটা শান্তির ধারা বয়ে যেতো। আমি চোখ বুঁজে তার পরশটুকু নিতাম।

বিদেশে পড়াকালীন সময়ে ক্যানাডার শীতে বোকার মতো বীরত্ব দেখাতে গিয়ে বাজে রকমের নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে বসলাম। প্রচন্ড জ্বর উঠে গেল, প্রায় আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকলাম বিছানায়। আমাদের শিশু কন্যাটি আর তার তরুণী মাতা আমার শিয়র থেকে নড়ে না। কি করে যে আমার রোগের উপশম ঘটাবে, তার জন্যে সব কিছু নিরলসভাবে করে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার, অষুধ ও সেবার মাধ্যমে সেরে উঠলাম। কিন্তু এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, আমার মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে আছে একটি শিশু আর একটি তরুণী মুখ। দু’জন অসম বয়সের মানুষ কখনো উদ্বিগ্ন, কখনো মায়াময়, কখনো জল টলোটলো চোখে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। মনে হতো, পারলে তারা ঐ দৃষ্টি দিয়ে শুষে নিতো আমার জ্বরের সব উত্তাপ, সব কষ্ট, সব আচ্ছন্নতা।

আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াই, তখনো জ্বর হতো। ক্লাশ নিতে পারতাম না, বাড়ীতেই থাকতাম, জ্বরতপ্ত শরীরে বিশ্রাম নিতাম বিছানায়। আমাদের কণিষ্ঠা শিশু কন্যাটি গুটি গুটি পায়ে বিছানায় উঠে পড়ত। শুয়ে থাকত আমার বালিশের একাংশ দখল করে। অসুস্থ মানুষের পাশে শুলে আমার থেকে তার অসুখ হতে পারে— এতো সব ভয়-ভীতি কোন কিছুই তাকে নিবৃত্ত করতে পারতো না।

শোবেই সে। তারপর কচি হাতটা আমার কপালে রাখত, রিন রিনে গলায় জিজ্ঞেস করতো, ‘ব্যথা করছে’? প্রথম প্রথম বুঝতেই পারতাম না, কেন সে সব সময়ে জ্বর হলেই ব্যথার কথা বলে। পরে বুঝলাম এর রহস্য। বেশীর ভাগ সময়েই তার নিজের জ্বর আসতো কোন প্রদাহ থেকে—তা সে কানেরই হোক কিংবা গলারই হোক। আর প্রদাহ হলে ব্যথা হতোই। তাই জ্বরের সঙ্গে ব্যথার সূত্রিতা।

আজো মাঝে মাঝে জ্বরে পড়ি। আমার এক ডাক্তার বন্ধু জানিয়েছেন, বছরে একবার জ্বর হওয়া ভালো। কে জানে ঠিক কিনা। তবে, এখন জ্বরে পড়লে যখন বিছানায় একা চোখ বুঁজে চুপচাপ শুয়ে থাকি, তখন সব পুরোনো ছবিগুলো কথা কয়ে ওঠে। জ্বরতপ্ত কপালে একখানা ঠান্ডা হাতের স্পর্শের জন্য বড় তৃষিত হয়ে থাকি।

 

সেলিম জাহান

ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top