কামরুল হাসানের ছোট গল্প: বিপরীত যাত্রায়

সবশেষে এলে যা হয়, অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে প্রায় লাফ দিযে ঘাট থেকে স্টামারে উঠল সরল। ডেক জুড়ে যাত্রীরা ঢালাও বিছানা পেতেছে, কোথাও সম্ভাবনা দেখল না সে। হাতের ব্যাগটা এতক্ষণ ভারী ঠেকেনি, জায়গা না পেয়ে ঠেকল। ইন্টার-ক্লাশগুলোর মাঝে দিয়ে সরল যাচ্ছিল প্রায় নিচের দিকে তাকিয়ে। তখন মোটা পেটটা ঘোরাচ্ছে স্টামার, তার পাশের রেলিঙের বাইরে সদরঘাট টার্মিনাল কম্পাসের কাঁটার মত ঘুরে গেল। সেই মুহূর্তে অজান্তেই থমকে দাঁড়াল তার পা দুটো, এই দাঁড়িয়ে পড়ার বৈশিষ্ট্য সে জানে। না তাকিয়েও বুঝল হালকা নেট দিয়ে ঘেরা কামরাগুলোয় এমন কেউ আছে যার মনন চুম্বকের টান থমকে দিয়েছে তাকে। চোখ ফেরাল সরল, কেবিনে বসে থাকা মুখগুলোর উপর দিয়ে সার্চলাইটের মত দ্রুত খেলে গেল দৃষ্টি। ভেতরে ‘শক’ খাবার মত ভীষণ চমকে উঠল সে অচিন্তনীয় একজনকে আবিস্কার করে। লোপা তার এত কাছাকাছি এই হঠাৎ করে মিলে যাওয়া যাত্রায় সে কখনো ভাবেনি। ঝুঁকে আছে লোপা, একটি শিশুর উপর ঝুঁকে আছে লোপার মাতৃময়ী মুখ। কপালের দু’পাশ হতে চুলগুচ্ছ ঝুলে পড়েছে কপোলে, সারামুখে একটা মমতাময়ী আভা। বহু বছর পর লোপার মুখে একটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দ্যুতি ফুটে থাকতে দেখল সরল। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল সে জানে না, শিশুটিকে আদর করাও শেষ করা হয় না লোপার। অবশেষে মুখ তুলল সে, আর মুখ তুলেই সরলের চোখবন্দী। সরল ভেবেছিল বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠবে লোপা, বিস্মিত হল যখন চিৎকার দূরে থাক, নাম ধরে একটা ডাক পর্যন্ত দিল না সে, শুধু বার কয়েক কেঁপে উঠল চোখের পাতা, এছাড়া আর আর পাঁচটা সাধারণ যাত্রীকে দেখার মতই তাকে দেখল লোপা। ডাক দূরে থাক, ছুটে আসা দূরে থাক, একটা ইশারাও ফুটল না তার মুখে, যেন সরলকে কোথাও কখনই দেখেনি সে। যত কথা এতদিনের অদেখা দিনগুলোয় সরলের মাঝে নিখুঁত সাজানো ছিল—সবই যেন ভুলে গেল সে, তার মনে হল এ লোপা নয়।

শিশুটি পুনর্বার কেঁদে উঠল দুধের জন্য, ঘুরে আঁড়াল তৈরি করে শিশুর মুখে দুধের বোঁটা তুলে দিতে লোপা যেই ফিরেছে, সেই মুহূর্তে প্রায়অবশ পা দুটো টেনে উপরের ডেকে উঠে গেল সরল।

কৈশোরেই সরল লক্ষ করেছে, স্মৃতিদের সে একবিন্দু ভোলে না, সামান্যতম ঝাপসা হয় না সেই দিনগুলোর কথা। জলকাটা স্টিমারের রেলিঙে ভর করে সে তখন স্মৃতির এ্যালবামের প্রিয় কিছু পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করেছে।

একটু আগে যে লোপাকে দেখে প্রথমে বিস্ময়, পরে অসম্ভব আনন্দ আর শেষে কষ্ট পেল সে, তার কাছে খণী হয়ে আছে সরল। কৈশোরের মধুবয়সে যে মোহছন্দে যৌবনের বিস্ময় আবিষ্কার করে মানুষ তার সবটাই লোপার কাছ থেকেই শিখেছিল সে। দুধের মত স্বাদু আর মোমের মত নরম ছিল লোপা-অনেক বছর পরে সেই স্পর্শসুখ পুনর্বার চেতনা হতে বিদ্যুৎ হয়ে সরলকে নাড়া দিয়ে গেল। একদিন সরলের মনে হতো লোপার কুসুমকোমল দেহের ঘ্রাণ না পেলে পাপড়ি ডাল ঝরিয়ে কোনদিন ঘুমপাতা নামবে না তার চোখে।
শিশু ঘুমিয়ে পড়লে লোপা বর্তমানে ফিরতে পারল। সরল যে সামনে কোথাও নেই, আগেই বুঝেছে। তবু এই স্টিমারে একই সাথে ওর সাথে সেও আছে ভাবতেই সুখের ছোঁয়া লাগল বুকে। চুপিচুপি চলে যাওয়ার আগে সরল যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। সে নিজেও কি খুব বেশি বদলেছে? নিজেকে পরখ করার সেই মুহূর্তে লোপা দেখল শিশুটি গভীরভাবে ঘুমাচ্ছে, লোপার রক্ত আর স্নেহ জড়ানো একটি অস্তিত্ব নিরাপদ তন্দ্রায়।

লোপা কিছুই টের পায়নি। শেষদিকে কেমন যেন বদলে যাচ্ছিল সরল। কথা দিয়ে তাকে অপেক্ষায় রাখত, উদভ্রান্ত কি সব ভাবত। তাকে ভুলে যাচ্ছে ভেবে কাঁদত লোপা। অথচ সে ঘুর্ণাক্ষরেও টের পায়নি ভয়ঙ্কর রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে সরল, লোপার অবলম্বন বিপ্লবকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চাইছে।

অস্থির পাখির মত ছটফট করত লোপা। মনে হত সারাক্ষণ তার দম আটকে আছে।
‘তোমার কী হয়েছে সরল?’
‘কই, কিছু হয়নি তো!’
‘আমায় লুকাচ্ছ তুমি, কী হয়েছে আমায় বলতো। আচ্ছা, আমাকেও কী তোমার বলতে মানা?
সরল আবার বলে, ‘কই কিছু হয়নিতো আমার, তুমি শুধু শুধুই অস্থির হচ্ছ, আমি সেই আমিতেই রয়েছি।’
‘বদলে যাচ্ছ তুমি,’ লোপার গলায় অভিমান আর শঙ্কার একটি মিশোল ফুটে ওঠে। ‘কোথায় যাও, সময়মত দেখা পাই না, রাতে কখনো কখনো বাসাতেও নাকি ফেরো না, আমার জন্য মায়াও কেমন জানি কমে যাচ্ছে।’ লোপার দু’চোখে দু’বিন্দু অশ্রু দেখা দেয়।
যুতসই কোন জবাব যোগায় না সরলের ঠোঁটে। সরল সোজাসুজি চোখ রাখে লোপার চোখে। বুঝতে পারে দীঘিটা টলছে আর একটু হলেই উপচে পড়বে। সরল যা জানে তাই করে— দুহাত দিয়ে লোপার গলা জড়িয়ে ধরে মালার মত আর আদুরে গলায় বলে ‘শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ লক্ষ্মীটি’ ।

এমনিভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে বদলে যাচ্ছিল সরল। একদিন কাউকে কিছু না বলে কোথায় উধাও হয়ে গেল সে। তার পরিবারে উদ্বেগ কান্নাকাটিতে পৌঁছালেও লোপার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল সরল ভুল শোধরাবে। একবার এসে অন্ততঃ বলে যাবে, ‘লোপা, যাই।’
‘বলে যাওয়া সহজ ছিল না, লোপা’, ঘুরে যাওয়া স্টিমারের প্রপেলারের আলোড়ন তোলা গতির দিকে তাকিয়ে অস্ফুট নিজের মনেই কথাটা বলল সরল। বললে কোনদিন যাওয়াই হতো না আমার, অথচ লোপা আমি তোমাকেও চাই, মানুষের মুক্তিও চাই। পরেরটা চাই আরও বেশি করে। জানিয়ে গেলে সেই সরল আজকের এই সরলে এসে দাঁড়াত না। একটি জোৎস্নাসুন্দর শিশুকে কোলে রেখে প্রায় ছয় বছর পরে সরলকে দেখে লোপাও চমকে না উঠে পারত না।
‘আচ্ছা ধরো…’ লোপার মনোভাবটা বোঝার জন্য সরল কখনো জিজ্ঞেস করেছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা সে তখনো নেয় নি।
‘কী ধরতে বলছ তুমি?’ লোপার গলায় স্পষ্টতই দুষ্টুমি । সরল গম্ভীর।
‘ধরো, তোমার মতন ঠিক এমনি বয়সের হাজার হাজার মেয়ে এ দেশে আছে।’
‘আছে।’ লোপা বুঝতে পারে না, সরল কেন সরল পথে যাচ্ছে না।
‘তারা তোমার মত নিরাপত্তা-মানে ভাত, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষার নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। পেটের ক্ষুধায় কখনো সর্বস্ব বিকিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, ছেঁড়া কাপড়ে লজ্জা ঢাকতে পারছে না, ঠিক ‘ সরলের চেতনার ভেতর লক্ষ লক্ষ অর্ধউলঙ্গ অর্ধভূক্ত মানুষের একটা দেশ শুয়ে থাকে।
‘ঠিক’, লোপা দূরের একটা দোয়েলের গলার পেলব কারুকাজ দেখতে দেখতে আনমনাভাবে উত্তর দিল।
‘তাদের জন্য তোমার ভাবনা হয় না?’
‘কী হবে ভেবে? আর সত্যি বলতে কি ওদের নিয়ে ভাবার আমি কে? না ভাবিনা আমি’। মাথা দোলায় লোপা। দোয়েলটা লেজ নেড়ে উড়ে যায় চোখের আড়ালে ।
সরল বুঝল লোপাকে বোঝানো অসম্ভব । তবু সে চেষ্টা করে।
‘আচ্ছা তাদের জন্য আমাদের কি কোনও দায়িত্ব নেই? আমরা কি চোখ বন্ধ করে থাকব?’
‘কিন্তু তুমি করবে? দরকারটাই বা কী? আমাদেরই কি সব দায়?’ স্পষ্ট বিরক্ত লোপা।
ভিতরে ভিতরে এভাবে সরল ক্রমশ সরেছে। লোপার ছোট্ট জগৎটা ছেড়ে বৃহত্তর এক আলো হাওয়ার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, সহস্র লোপার মুক্তির জন্য এসে দাঁড়িয়েছে এক বৃহত্তর বোধের চত্বরে।

চলে আসবার প্রথম তিন বছর সরল কোন যোগাযোগ রাখেনি তার অতীত জীবনটার সাথে। লোপাকে পাঠানো চিঠিতে কোন ব্যাখ্যা বা আত্মপক্ষ সমর্থন ছিল না। কোন ঠিকানাও ছিল না যেখানে লোপার উত্তর পৌছতে পারে। শুধু মিনতি ছিল, ‘ক্ষমা করো আমাকে, ভুল বুঝ না।’

কোনদিনই ক্ষমা করবে না লোপা, অথচ সময় তবু মখমল তৃণ বিছিয়ে রাখত সরলের ফিরে আসার পথে, অভিমানের বৃক্ষে ফুটে উঠত প্রাণের কৃষ্ণচূড়া সরলের প্রত্যাবর্তনের উৎসব প্রতীক্ষায়। সরল তবু ফিরল না।

অন্ধকার নদীর দিকে পিঠ ফিরিয়ে ঘড়ি দেখল সরল। মিইয়ে যাওয়া রেডিয়ামে সময়টা বুঝতে বেগ পেতে ছালেওধু বুঝতে পারল মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে সময়। যাত্রীদের মধ্যে একমাত্র সরলই বোধকরি সে মুহুর্তে সারেং ও নিচের ইঞ্জিন রুমের লোকটির সঙ্গী। সরল জানত না শিশুটিকে আড়াল করে লোপার মুঁদে থাকা চোখ দুটিতেও ঘুম ছিল না।
তবু একসময় তন্দ্রা নেমে আসে। সকলকে ফাঁকি দিয়ে সরলকে সারাটা স্টিমারে তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করার ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে যায়। শেষরাতের দিকে একটা অখ্যাত ঘাটে নেমে যায় সরল। লোপাকে নিয়ে নদীর নির্দিষ্ট রেখা ধরে ফিরে যায় স্টিমার। লোপার জীবন জাহাজ। আর ভিন্ন পথে কুয়াশা মোড়ানো ভোরে সূর্যাদয়ের পথে হাঁটতে থাকে সরল। কাল ভোরে এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল লঞ্চঘাটে লোপার চোখ সরলকে কোথাও খুঁজে পাবে না।

 

কামরুল হাসান 

জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১, শরীয়তপুরে। তিনি মূলত কবি। অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ গদ্যকার হিসেবেও খ্যাত। আছে নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

ভারতের বিশ্বখ্যাত খড়গপুর আইআইটি থেকে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সমাপ্ত করেন। এছাড়াও স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যের ব্রাডফোর্ড ও এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কামরুল হাসান শিক্ষকতা করছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। কামরুল হাসান  দু’হাতে লেখেন। এপর্যন্ত ১৪ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি ছোটগল্প, ১টি প্রবন্ধ, ৪টি ভ্রমণ গ্রন্থ, ২ টি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সমীর রায় চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে পোস্টমর্ডান বাংলা পোয়েট্রি ২০০৩ সম্পাদনা করেছেন।

[email protected]

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top