কামরুল হাসানের পাঁচটি কবিতা

শামুক বাড়ি

শামুরবাড়িতে বো-কাট্টা ঘুড়ির মতো চক্কর খায় মেঘ,
কেনো তরুণী মেঘের দোপাট্টা খুলে গিয়ে আটকে যায়
দূরান্তে গ্রামের নিশানা উঁচুমাথা গাছের চূড়োয়;
বৃষ্টি হয় বিধবার একপলক স্বামীশোকের মতো।
এই গ্রামে ধন্বন্তরী, আহা, খাল ছিল কোমরের বিছা
রূপালি ঝিলিক তার ঐ পাড়ে অন্যমন্ত্র চরের সিথানে
পদ্মার বাদামি চায়ে বিকেলের বিস্কিট ডুবিয়ে
কেমন খাওয়া যেত, যুবতীর কেশগুচ্ছের বাড়ন্ত সহাস্যে
হোগলার বন আন্দোলিত যেন উড়ে আসা স্রোতে
পাখি ডেকে উঠে দক্ষিণের ঢেউয়ের সঙ্কেতে!

শামুরবাড়িতে দিন ছিল গরাদের ভেতরে গরাদ
সর্বত্র ঐ ঘের, কেউ পা চালিয়ে হেঁটে আসে
দীঘলি বাজার থেকে, বলে আছি, নিজের পায়ের
মাপে যতটা হেঁটে নেই স্বাধীন, সচকিত উদ্ধারে।
অথচ শৃঙ্খল পায়ে শৃঙ্খলিত দিগন্ত ঘিরেছে,
রাতগুলো ওম পায় নক্ষত্রের মিয়ানো আলোয়।

সন্ত্রাসের ভূত নামে, দিগন্ত মুড়ে আসে বিপন্ন ডানা
চোখ মুঁদে দেয়, জোড়া জোড়া দম্পতি জেগে থাকে
অন্য কাজ পড়ে আছে, বীজ বোনা হয়ে যাক আগে
পলিতে গর্বিতা এই মাটি আর মায়েদের দেশে।
স্বর্গীয় ব্লাকআউটের রাতে ফেরেশতাদের জঙ্গি বিমানগুলো
পায়না খুঁজে শামুকের ভেতর গুটানো ঐ গ্রামের নিশানা।

এই গ্রাম বাংলায় হাজারো আরো বেঁচেবর্তে আছে
অজ্ঞতায় অবজ্ঞায় সূর্যে ও অসূর্যে টিকে আছে
অথচ রূপালি সখ্যে জ্যোৎস্নার দিকে ঝুঁকে আছে
বুকের কাছের কলসিতে অপরূপ পদ্মাস্রোত ভরে।

 

শহর দখলের পূর্বলেখ

বাঁধরাস্তা থেকে নেমে গেল চারজন গ্রামমুখো মানুষ
মিয়ানো আলোর ভেতর তাদের তেরচা শরীর
সুস্পষ্ট বাঁকালো
দূরে কুয়াশা আর তোরসা একাকার।

বালি, ঘাস আর মাটির জুড়নে যে মাঠ
তারা সেই মাঠের ভেতরে গিয়ে নামে,
একটি সরলরেখার দাঁড়ায়।

অস্পষ্টতার ভেতর বিলীন সাদা পথ,
ওরা সেই পথের শরীরে নামে, সাদা ও সরল।

কয়েকটি স্থির বাতি— খেয়াঘাট;
একটি চলমান আলো— নৌকা;
ওরা কি পেরুচ্ছে সেই নদীর উঠোন?

এইমাত্র নেমে গেল কারা ওরা গ্রামের জমজ?
কাল কাকভোরে মাঠ হতে কেটে নেবে অঘ্রানের ধান,
স্বরমণীর উত্তাপের ভেতর চলে গেল চারজন যুবক,
সন্তানের করতাল কোলাহলে আপ্লুত চারজন জনক।

ওরা কি আসবে ফিরে এই শহরে আবার?
‘আসব তোমাদের শহর দখলে’, বলে গেল
গ্রামের চারজন দৃপ্ত কৃষক।

 

বইমেলায় এক সন্ধ্যায়

বইয়ের স্তূপের উপর অতঃপর স্থির হয় পাখি
ধূলির পাখার স্তর, চূর্ণকাচ খুলে খুলে পড়ে
কাঁকন কাহিনী তামাশার শীতার্ত প্রভাতে
অতি দ্রুত মেলেছিল পরীর শরীর,
আর মৌনযৌন বাঁক
বইয়ের স্তূপের উপর অতঃপর লিপ্ত হয় ঠোঁট।

মেধার বুনন শোক, পূর্ণচাঁদ ঝুলে ঝুলে নাচে
কোমল কাব্য তার কোমরের আর্তময় বাঁকে
বিদ্যুৎউদ্ভাসিত রেখা শব্দের সোনালি সড়কে
অতিফর্সা ঊরুর উপমা দিগি¦দিক ছুটন্ত হরিণ
বাঘকেন্দ্রে আশ্চর্য দ্যুতিময়;
বইয়ের স্তূপের উপর অতঃপর তপ্ত শোয়া-বসা।

 

লোকালয়ের কবিতা

প্রত্যহ রমণপ্রিয় পিতাদের সাথে অনিচ্ছুক মাতাদের শোয়া
তাতে অবাক মিছিল ধরে চলে আসে অপূর্ব শিশুরা;
অমন কাণ্ড থেকে এত আশ্চর্য স্বর্ণচ্ছটা ছোটে?
কোথা থেকে আসে ওরা, রমণেগমনপ্রিয় পিতাদের ক্ষণিক বিলাসে
আর মাতাদের কাষ্ঠদেহ, কাষ্ঠশয্যাপাতা
ভেতরে নবীন পাতা, বিস্তারিত সবুজের অঢেল আন্দোলন
সেখাইে ফোটে কুঁড়ি? আগ্রাসী ভ্রমরবীর্যদল আসে ঝাঁকে ঝাঁকে—
ইংলিশ চ্যানেল, আমাজান বা বাংলার ভরা যমুনায়
পড়িমড়ি সাঁতারের শেষে অনেকে পথশ্রান্ত, বহুজন ডুবে যান জলে
কেবল বিজয়ী যিনি চলে আসেন পতাকা উড়িয়ে,
মাতৃপ্রান্তরের শ্রান্ত সেনাদল, তখন তাঁকিয়ে দেখি
এ যে আশ্চর্য অনল!

 

শিরোনামহীন

অতিপষ্ট মুখখানি, মুহূর্তখানিক, চলে গেল মিলিনিয়া দূরে
মুখস্ত চতুর্পাশ হতে দৃষ্টি তুলে দেখেছিল অবিশ্বের তারা
নীহারিকা মুখ তুলেছিল, এখন পৃথক শোবে
মাটির নম্রতা, তাও জাগতিক, পরলোকে কেন ক্রদ্ধ মাটি?
কেন সাঁড়াশি দাঁতের ক্ষিপ্র চাপ তুলে ভেঙে দেবে
যে পাঁজর আয়ুশূন্য, আর যাতে লৌহপ্রিয়, সবুজাভ অক্সিজেন নেই।

 

কামরুল হাসান 

জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১, শরীয়তপুরে। তিনি মূলত কবি। অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ গদ্যকার হিসেবেও খ্যাত। আছে নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

ভারতের বিশ্বখ্যাত খড়গপুর আইআইটি থেকে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সমাপ্ত করেন। এছাড়াও স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যের ব্রাডফোর্ড ও এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কামরুল হাসান শিক্ষকতা করছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। কামরুল হাসান  দু’হাতে লেখেন। এপর্যন্ত ১৪ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি ছোটগল্প, ১টি প্রবন্ধ, ৪টি ভ্রমণ গ্রন্থ, ২ টি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সমীর রায় চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে পোস্টমর্ডান বাংলা পোয়েট্রি ২০০৩ সম্পাদনা করেছেন।

[email protected]

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top