কবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের ‘চন্দ্রবীক্ষণ ও নগ্নপদ‍্য’: নিবিড় অবলোকন

খসরু পারভেজ

মধ‍্যযুগে কবিতাই ছিল মূলত গান। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবিতা থেকে গানকে আলাদা করলেন। কিন্তু তাঁর চতুর্দ্দশপদী কবিতার অনেকগুলোই গান ও সুরের উপযোগী। অন‍্যদিকে তাঁর ‘ব্রজাঙ্গনা কাব‍্য’ এর সবকটি কবিতা নব‍্যধারার গীতিকবিতা। যা গানের জন‍্য যথার্থ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে অমিত্রাক্ষর ধারা প্রবর্তনের মধ‍্য দিয়ে তিনি গান থেকে মুক্তি দিলেন কবিতাকে। এই অমিত্রাক্ষরের পথ ধরে জন্ম হল গদ‍্য কবিতার। তারপরও কবিতার ভেতরে গানের যে গোপন যোগাযোগ সেটা রয়েই গেল। মধুসূদনের সার্থক সৃষ্টি আমিত্রাক্ষর ধারায় গ্রথিত ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ এর প্রতি ছত্রে ছত্রে গীতিমুখরতা অনুরণিত। সচেতন পাঠক মাত্রই তা অনুধাবন করতে পারেন। গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘গীতিকবি মধুসূদন’ গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দের মধ‍্যে অর্থাৎ ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ এর মধ‍্যে কতখানি গীতিমুখরতা। আর গবেষকের এই কথা সত‍্য বলে প্রমাণিত হয়েছে, যখন খ‍্যাতিমান সংগীতশিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদ মেঘনাদবধ বধ কাব‍্যের রাবণের বিলাপ অংশের সুরারোপ করে তা পরিবেশন করে হাজার শ্রোতাকে বিমোহিত করেছিলেন। *

কবিতার ভেতর গান থাকে কখনও প্রকাশ‍্যে, কখনও লুকিয়ে। তাই কবিতা থেকে গান আলাদা হলেও গান থেকে কবিতাকে মুক্ত করা কঠিন। কেননা ভালো গানের কাব‍্যগুণ থাকা জরুরি। এ কারণেই একজন ভালো কবি ভালো গান লিখতে পারেন। গান যাঁরা রচনা করেন আমরা তাঁদের গীতিকার বলি। এই অভিধাটি ভালো শোনায় না। বড়জোর আমরা গীতিকবি বলতে পারি। একজন কবি গান লেখেন না, লেখেন গানের কবিতা। বাংলাদেশের খ‍্যাতিমান গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এমনটিই মনে করেন। নিজেকে কবি বলতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কেননা, তিনি গানের জন‍্য যে বাণী রচনা করেন, সেটি আগে কবিতা, তারপরে গান। তাই আমিও তাঁকে গীতিকার নয়, কবি হিসেবে বিবেচনা করতে চাই।

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের একটি গানের কবিতা এরকম:

কথা ছিল নাকি!
নগরীর ওই পারে নেমে এলে রোদ
আশ্চর্য বিকেল হয়ে নরম আঙুলে
আমার গভীরে তুমি বাজাবে সরোদ
কথা ছিল নাকি!

এই দৃষ্টান্ত একইসঙ্গে গান, একইসঙ্গে কবিতা। আমরা যদি গান আর কবিতাকে আলাদা করতে অভ‍্যস্থ হয়েও থাকি তাহলেও বলব, তিনি আগে কবি তারপরে গীতিকবি।

আমাদের সাহিত‍্যের ইতিহাসে এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত আছে, একটি পরিচয়ের আড়ালে প্রকৃত পরিচয় ঢেকে যায়। মোহাম্মদ রফিকউজ্জানের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে বলে আমি মনে করি। কেননা, গীতিকার হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত, প্রচলিত অর্থে কবি হিসেবে ততটা নয়। বাংলা কবিতার প্রচলিত দশকওয়ারি বিবেচনায় সমালোচক, গবেষকদের কবিতা বিচারে তাঁর নামটি আমরা উচ্চারিত হতে শুনি না। গান রচনায় পুনঃপুনঃ জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি ও কালজয়ী অসংখ‍্য গানের জন‍্য আকাশছোঁয়া পরিচিতির আড়ালে তাঁর কবি পরিচয় হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু প্রকৃতঅর্থে মোহাম্মদ রফিক উজ্জামান একজন উল্লেখযোগ্য কবি। আর কবি বলেই তিনি অসংখ্য হৃদয় ছোঁয়া গানের স্রষ্টা।

২.
ছাত্র জীবন থেকেই মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান কবিতা রচনা শুরু করেন। সেসব কবিতা ছাপা হত বিভিন্ন ম‍্যাগাজিনে। তাঁর অগ্রজ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খ‍্যাতিমান কবি। তাঁর দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হতে পারেন। যশোরে বসবাস করতেন ষাটের দশকের আর একজন শক্তিমান কবি আজীজুল হক। তাঁর দ্বারা তিনি বরাবরই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। যৌবনে তাঁর লেখা কবিতা সমকাল পত্রিকাসহ বিভিন্ন বিখ‍্যাত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হত।

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ ‘কোথায় লুকোবো মুখ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে। এই কাব‍্যগ্রন্থ পাঠকনন্দিত হয়েছিল, যা আমরা অনেকেই জানি না। এই কাব‍্যগ্রন্থে তাঁর সমাজবীক্ষণ, গভীর জীবনবোধ একজন অনিবার্য কবির অবস্থানকে নিশ্চিত করেছিল। ‘কোথায় লুকুবো মুখ’ কাব‍্যের একটি কবিতা এখানে তুলে ধরছি:

‘দিনান্তে ক্লান্তির মদে নেশাগ্রস্ত বিবর্ণ অস্থির
ফিরে আসি। শ্লথ হাতে অন্ধকার কড়ি কাঠ থেকে
নামাই আড়ষ্ট লাশ; চেয়ে দেখি আয়নায় নিজেকে
দু’চোখের কান্না, এক হাস‍্যকর প্রেতের শরীর।

ষাটের কোনো কবি যাঁরা এখনও সচল, তাঁদের অনেকের রচনায় এতখানি গভীর ও তাৎপর্যময় পংক্তিমালা চোখে পড়বে না।

প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ প্রকাশের সাফল‍্যের পর প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব‍্যগ্রন্থ ‘চন্দ্রবীক্ষণ ও নগ্নপদ‍্য ( ২০০৮ ), কবিতা ভাসান আমার ( ২০১৪ ), বাংলা শায়েরী ( ২০১৬ )। অনুবাদকাব‍্য ‘গালিবের শের-শায়েরী। তাছাড়া রয়েছে ‘ঘোর’, ‘প্রেম,সুখ-অসুখের পদাবলী’, ‘দেহখেয়া দেব পাড়ি’সহ ‘নির্বাচিত গান’ ও কয়েকটি গানের সংকলন। তাঁর বহুল আলোচিত দুটি গদ‍্যগ্রন্থ ‘বাংলা গান: বিবিধ প্রসঙ্গ’ এবং ‘ বাংলা গান: রচনা কৌশল ও শুদ্ধতা।

৩.
আমার আলোচনার বিষয় মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের দ্বিতীয় কাব‍্যগ্রন্থ ‘চন্দ্রবীক্ষণ ও নগ্নপদ‍্য’। এই কাব‍্যের কবিতা নিয়ে আলোচনার আগে কাব‍্যগ্রন্থের প্রাককথন সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। এখানে তিনি লিখেছেন :
… প্রভাবমুক্ত স্বভাব কৃতিতে
প্রকৃত কবিরা প্রকৃত রীতিতে
খুঁজুক নতুন মুক্তি
কবিতার দিকে চরণ বাড়াক
মাথার ভিতরে থাক না থাক
বোদলেয়ারের উক্তি।

একটা প্রশ্ন মনের ভেতর উঁকি দিতে পারে, কবি কীভাবে প্রকৃত রীতিতে কবিদের নতুন মুক্তি খুঁজতে বলেছেন! তিনি প্রকৃত রীতি বলতে কি সেই পয়ার-ত্রিপদীর কালে ফিরে যেতে বলছেন! আমার বিশ্বাস তিনি শুদ্ধ প্রকরণ, ছন্দ, অলংকার, প্রকৃত কাব‍্যরুচির যে রীতি, সেখানেই নতুন মুক্তির সন্ধানের কথাই বলেছেন। আমরা তাঁর কবিতার আলোচনার মধ‍্য দিয়ে এই চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাব।

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কবিতায় এই সমাজ, সমকাল, সমকালের অসঙ্গতি, নাগরিক জীবনের যন্ত্রণাবোধ শিল্পীতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি দেখতে পান পায়ের নখের সামনে ভেংচি দেয়া পথ। তখন সদ‍্য পদ‍্য নিয়ে তাঁর ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। চারপাশে শুধু উড়তে থাকে পতনবাহী বাতাস । বহু যুগের অন্ধকার মাখা চোখের দৃষ্টি খোঁড়া হয়ে যায়। ঘৃণার চেয়ে ক্রোধের দিকে তাকাতে ভয় পেলে পরিচয়ের প্রতিকৃতি আত্মাকে কাঁপায়। চতুর্পাশে ধোঁয়ার আড়াল। এ যেন বোদলেয়ারের সেই পাপিষ্ট নগরী। তিনি বলেন:

মাথার ভেতরে মৃত জোনাকির স্তূপ
বধির কানের পাশে শব্দেরা এখন শব্দহীন,—শক্তগাল
মগজের আলোহীন কালো
কবরে শবের ক্রমাগত
পচনে পচনে গলে পড়া,
ঢলে পড়া নষ্টকাল—কষ্টবোধ মেরে ফেলে
শুয়ে আছে নিজে মৃত হয়ে।
( মানুষ এগোয় )

চতুর্দিকে পতনবাহী বাতাস যখন ওড়ে। এমন অবস্থায় কবি একটি লোককে দেখেন, সে ভীষণ রাগী। তার থুথু ছোড়ার স্বাধীনতা, প্রতিবাদী পদক্ষেপ দেখে কবি অবাক হন। কে সেই যুবক! সে তো কবিরই অস্তিত্ব। তিনি লেখেন:

ভীষণ রেগে অনেকগুলো পাথর ছোড়ে কথার,
অবাক লাগে এখনো কেউ রাগতে পারে দেখে
থুথুর চেয়ে পাথর ভালো, ছোড়ার স্বাধীনতার
প্রয়োগ গুণে প্রতিরোধের পাহাড় গ’ড়ে রেখে
দাঁড়ায় একা বুক চিতিয়ে ক্রান্তি খোঁজা মোড়ে;
( প্রতিকৃতিকে ভয় )

এই দুর্বত্ত সময় যত্ন করে পায়ে যেন সেঁটে দিয়েছে খচ্চরের খুর। তার পিঠে চেপে পশ্চিমী বোঝা হয়ে আলেয়া উজিয়ে পথ হাঁটছেন কবি। জটাজুটধারী বটবৃক্ষের তলায় এক জহীনবৃদ্ধ, জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত চোখের কোঠর থেকে অবশিষ্ট আগুন খুঁটিয়ে সে আগুনে হুঁকো সাজিয়ে টেনে টেনে ধোঁয়াটে নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। এই পথে যেতে যেতে একে দেখেছিল চণ্ডিদাস। কবিতায় :

ধোঁয়াটে দৃষ্টির হাসি প্রশ্ন করেছিলো,
কত দূরে যাবে
কত দূরে যেতে পারো আলেয়া উজিয়ে
‘হাজর বছর ধরে’ পথ হাঁটিতেছো
কত পথ হেঁটে তবে পার হবে ধোঁয়া ধোঁয়া নেশার নাগাল?
আলেয়া উজিয়ে আমি কত দূরে যাবো?
ধোঁয়ার আড়ালে ধোঁয়া—তারপর ধোঁয়ার আড়াল—
( ধোঁয়ার আড়াল )
কবিদের আলেয়া উজিয়েই তো পথ চলতে হয়। ধোঁয়ার আড়াল শেষে তো মিলবেই অমেয় রোদ্দুর!

বসন্ত আসে না তাই জ্বলন্ত সূর্য থেকে রোদ্দুর নয়, যেন পুঁজ নেমে আসে। ডুবিয়ে দেয় নম্র সবুজ নিঃশ্বাস। চারপাশে রক্তাক্ত চিৎকার শুধু। চায়ের টেবিলে, সম্পাদকের ফাইলে, প্রকাশকের দপ্তরে, দোকানে দোকানে, যে যার চিৎকার রেখে কোরাসের অপেক্ষায় ওৎ পেতে বসে আছে। অশ্লীল শব্দের ঘামে ভিজে যাচ্ছে অলৌকিক ইচ্ছের কাগজ। পাতকীরা একে একে কৃষ্ণগহ্বরে জননাঙ্গ খুলে রেখে অদৃশ‍্য স্বর্গের ঠিকানাবিহীন লক্ষে আত্মসমর্পিত।

এমন অবস্থায় কবি ক্রুসেইডের স্বপ্ন দেখেন। প্রত‍্যাশা করেন,স্বর্গের দরজা খুলে শান্তির সুশীতল ছায়া ঢেকে দেবে সমস্ত পাপের দগদগে ক্ষত। কোরাস চলছে:

প্রভু আমরা তোমার চরণতলে
সমবেত আজকে দলে দলে
এই যে দ‍্যাখো শিশ্নবিহীন দেহ
ব‍্যাভিচারের পাপ করিনি কেহ
তবু আমরা মরছি অনুতাপে
নপুংসকের খুচরো কিছু পাপে
শপথ প্রভু, তোমার চরণ ছুঁয়ে
সমস্ত দাগ ফেলবো এবার ধুয়ে।
( ক্রুসেইড )

কী বীভৎস সেই প্রেক্ষিত! কবি যখন কবিতায় সেই অনভিপ্রেত-ভয়াল পরিস্থিতি তুলে ধরেন, তখন এক কল্পিত অথচ আমাদের স্বচক্ষে দেখা যেন ক্রুসেইড।
কবির কবিতায়:

এদিকে এখন সেই মহাপ্রভু-শুক্রজাত এক
অতিকায় বিকলাঙ্গ ভ্রুণ
সময়ের নষ্ট গর্ভে বিকট বেঢপ বৃদ্ধি পেয়ে
জরায়ু রক্তাক্ত করে স্বচিৎকারে ভূমিষ্ঠ হবার
প্রতীক্ষায়। আর তার আগমন বার্তা ঘোষণায়
মহান গ্রন্থের যত পবিত্রতা ক্ষিপ্র ঈগলেরা
স্বর্গীয় ডানার থেকে শ্লোকের মতন অবিরাম
ছুড়ে দিচ্ছে মানুষের বসতে বসতে
সেসব স্বর্গীয় শ্লোক অগ্নিস্নাত ক’রে
নগর প্রান্তর জুড়ে বিছিয়ে চলেছে ক্রমাগত
প্রভুজ্বীর প্রিয় খাদ‍্য – মন্ত্রদগ্ধ লাখো লাখো লাশ।
( ক্রুসেইড )

কী অসাধারণ দৃশ‍্যকল্প, আর উচ্চকিত চেতনার বহিঃপ্রকাশ! একজন কবির শক্তিময়তা এই ধরনের তুমুল সত‍্য উম্মোচনকারী কবিতায় প্রতিভাত হয়। আমরা চাই, এই ক্রুসেইডে নিপীড়িতের জয় হোক। কবিও প্রকান্তরে সেই প্রত‍্যাশাই লালন করেন।

সৃষ্টির শুরু থেকেই সুসময় ও দুঃসময় পাশাপাশি অবস্থান করে । যা কাল থেকে কালান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে একজন সচেতন কবিকে আক্রান্ত করে। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের ক্ষেত্রেও তার ব‍্যতিক্রম ঘটেনি। দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবি বলেন:

আমার সময়টুকু ছিনতাই ক’রে নিতে হামাগুড়ি দিয়ে
নীরবে এগিয়ে আসে কালো এক রাত
যে কোনো মুহূর্তে পড়বে কালো বিড়ালের থাবা পাতে
দু’চোখ ধনুক ক’রে ছুড়ে দেয়া ধূর্ত লোভী তীর
সরাসরি বিদ্ধ হবে বুকের সেখানে
যেখানে বিশ্বাস এসে হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়েছে
( কালো বিড়ালের থাবা )

অথবা

কতিপয় ভাঁড় দেখি তলোয়ার সাদৃশ‍্য আঙুলে
অনায়াসে কেটে দিচ্ছে সময়ের মাথা
প্রতিটি রজনী গর্ভবতী
মরে যাচ্ছে সকালের জন্ম দিতে দিতে
প্রতিটি সকাল হচ্ছে কবন্ধ দানব
দিনগুলো ভাল যাচ্ছে না হে —
( দিনগুলো )

এমন অবস্থায় নির্মল কবিতার অচলায়তনে দগ্ধ কবি তাই শান্তি খুঁজে পেতে চান। কবিতায় তিনি বলেন:

এখনো আমার বুক হতে পারে কবিতার মাঠ
নগরীর অন্ধকারে খুলে দিলে দক্ষিণের কপাট।
( কতদিন পরে তুমি )

ইচ্ছে করলেই অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু করাটা কি ঠিক! কবি বলেন :
কোনো কোনো পথ আছে যেখানে পা রাখা অনুচিত, –
তবুও পা রাখো যদি, ওহে বিভাজিত সত্তা শোনো—
পেছনে দরোজা বন্ধ হয়ে যাবে, ফিরে আসা যাবে না কখনো;
চন্দ্রের প্রতীক্ষা শুধু, চন্দ্রের ভেতরে
ডুবে গিয়ে চন্দ্র খোঁজা —অথবা চন্দ্রের মাঝে চন্দ্রকে ধারণ —
ওহে বিভাজিত সত্তা, কোথায় এগিয়ে যাও তুমি
তথ‍্যের ছুরিতে নাকি তত্বের শয‍্যায়
নে’ল আর্মস্ট্রং নাকি লালনের চোখে —
( চন্দ্রবীক্ষণ )
আমার মনে হয়, একজন সত‍্যনিষ্ট কবির এর চেয়ে শক্তিশালী ও গভীর কোনো পংক্তি আর হতে পারে না। বিভাজিত সত্তার কাছে কবির এই প্রশ্ন যেন আমাদের চেতনার কাছে অসংখ্য প্রশ্ন রেখে যায়।

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কবিতায় যতখানি না নান্দনিকতা, ভাষার পেলবমুখরতা, তার চেয়ে বেশি যুক্তি ও মনোবিশ্লেষণ। তিনি যখন বলেন:
নদী ফিরে এলে
চর ভেসে যায়
ঘর ভেঙে যায়
নদী ঘর ভাঙে
শুধুই কি নদী
মানুষ ভাঙে না…
( ঘর ও অন‍্যান‍্য )
অথবা
ভেঙে দেয়া অনেক সহজ
গড়াটা কঠিন
দেখাও তো গড়ে – দেখি পারো কি পারো না
ইঃ, অত সহজ নয় গড়া।
( পোয়াতির সংলাপ )

পোয়াতির সংলাপ কী আটপৌরে আঙ্গিকে কবি ব‍্যক্ত করেছেন! কবিতায় মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান খুব সহজ – সরল ভাষা ও ভঙ্গি ব‍্যবহার করেছেন, যে কারণে তাঁর কবিতা জটিলতা মুক্ত, দুর্বোধ‍্য নয়। আমাদের চারপাশের নানা বিষয়গুলো তাঁর কবিতায় উঠে আসে। যেমন ঘর- দোর, নদী, চর, পাখি, গাছ, আলো, অন্ধকার, শৈশব, সংসার, দেহযন্ত্র, নারী সবকিছু।

আমাদের সাহিত‍্যে আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত‍্যরচনা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। যে বা যারা আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা রচনার পথিকৃৎ বলে দাবি করেন,তাদের এই কবিতা থেকে জেনে নেয়া দরকার, কীভাবে আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা বুনতে হয়। স্বদেশ-স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে লেখা তাঁর চেনা-জানা একজন যোদ্ধার কথা কবিতায় উঠে এসেছে যশোরের আঞ্চলিক ভাষায়। তিনি লিখেছেন:
ডাকায়াত বন্দুক পালি ভাষা কায়ড়ে নেয়
কথা কায়ড়ে নেয়
কেউ জুবান নাড়ালি
ফুটো কোয়রে দেয়।
( কেউকেটার ভাষ‍্য )

কবিতায় আঞ্চলিক ভাষায় এই উৎকৃষ্ট ব‍্যবহার খুব কম কবির কবিতায় দেখা যায়।কবি রফিকউজ্জামান তাঁর পূর্বসূরিদের কাছে সমর্পিত। এটি মহৎ কবির ধর্ম। তিনি মহৎ কবি, যে কারণে তিনি তাঁর অগ্রজতুল‍্য একজন ঋদ্ধ কবির খোঁজে কম্পাস হারানো নাবিকের মত ব‍্যাকুল হয়ে ওঠেন। প্রিয় অভিভাবক, প্রিয় কবির অনুপস্থিতিতে কবির স্বপ্নের শহর একান্ত নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে। তাঁর অগ্রজতুল‍্য কবি আজীজুল হক স্মরণে তিনি তাঁর অভিব‍্যক্তি ব‍্যক্ত করেন এভাবে:

একজন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
ভীষণ শূন‍্যতা ভরা অচেনা যশোরে
একা, বড় একা হ’য়ে স্বপ্নে দেখা কোন এক ঋজু
বাতিঘর খোঁজে।
… … …
বাতিঘরের খোঁজে কবি যখন উদভ্রান্ত, তখন নিজেকে অভিহিত করেন বিপন্ন জাহাজ বলে। তিনি যেন দিনরাত হ‍্যালুসিনেশনে ভোগা দারুণ ক্ষ‍্যাপাটে রোগী। যে সমস্ত বিপন্ন পথে, পুরনো দালানে, মরানদী পার হওয়া দড়াটানা পুলে, অসংখ‍্য রিক্সার ভিড়ে,চৌরাস্তায় মধুর দোকানে সর্বত্র বিক্ষুব্ধ কোনো আগ্রাসী তরঙ্গ দেখে আর একা একা শোনে নিজের ভয়ার্ত চিৎকার। এ অবস্থায় নিজেকে হাসপাতালের ডিসেকশন টেবিলের কাছে সমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। আবেগ নয়, প্রকৃতির নিয়মে জীবন চলে। কেউ যখন কোনো কবি কিম্বা কবিতা খোঁজে না; তখন কবি বাকযন্ত্র, চোখ-কান-হলুদ মগজ এক এক করে খুলে দেখেন–
আজীজুল হক নামে কেউ ছিল— কেউ নেই ব’লে
বিন্দুমাত্র আক্ষেপের ঘন্টাধ্বনি বেজে ওঠে কিনা—

যখন বেজে ওঠে না কোনো আক্ষেপের ঘন্টাধ্বনি। তখন নিজেকে প্রশ্ন করেন, কেন তিনি বোধ নামে কোনো এক অবাস্তব বন্দরের খোঁজে ব‍্যাকুল হয়ে কেঁদে ফেরেন! তিনি নিজেও জানেন না, কেন তাঁর এই আক্ষেপ! নিজেকে বলেন:
কেন সেই কান্না দিয়ে যশোর শহরে
যশোর শহর কিম্বা জগত সংসারে
বাতিঘরহীন এই অচেনা সাগরে একা তুমি
নিঃশব্দ চিৎকারে শুধু তীব্র থেকে তীব্রতর করো
আজীজুল হক
আজীজুল হক
আজীজুল হক —
( বাতিঘর )

কোনো কবি তাঁর অগ্রজতুল‍্য কোনো কবির অনুপস্থিতির বেদনায় নিজের বোধ, সময়ের নিষ্ঠুরতা, বা সময়ের অকৃজ্ঞতাকে বোধের নিরিখে ব‍্যবচ্ছেদ করে নিজের শ্রদ্ধাচেতনাকে এমনভাবে জাগ্রত রাখতে পারেন; এমনটি কোনো কবির কবিতায় আমি এর আগে আর প্রত‍্যক্ষ করিনি।

স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। পরিস্থিতি এমনই- শুকনো চোখের চরা নিষ্পাপ তাকিয়ে খোঁজে এতটুকু জল। যে চোখ দেখেছে দুরন্ত দাঁড়াশ তার মায়ের দুধের বাঁট শুষে নিয়ে গেছে। জীর্ণ অচঞ্চল অস্থি-চর্ম পড়ে আছে শুধু। চেতন জেলে জালে টান দিলে সে জাল ছিড়ে যায়। জালে ধরা পড়ে না ইলিশ। সকাল যেন রাতের চেয়েও গাঢ় আঁধার, যা জালের সুতোয় ঝুলতে থাকে। জালের সুতোয় যেন জড়িয়ে থাকে নিজের কঙ্কাল। কী ভয়াবহ, দুর্বিষহ সে চিত্র! ১৯৭৪ সালে মানবসৃষ্ট সেই দুর্ভিক্ষের প্রতিচিত্র ফুটে ওঠে কবির কবিতায়। তিনি বলেন:

আচমকা চেতন জেলে টান দিয়ে ছিড়ে ফ‍্যালে জাল।
জালে তো ইলিশ নেই—বাসন্তীর উদোম শরীর
রাজার চোখের থেকে নিজেকে সে নিস্ফল আড়াল
করেছে বুঝি এভাবে, লাখো লাখো সর্পচক্ষুতীর
নিশানা করেছে তাকে—অথচ অস্থির
হতেও সে ভুলে গেছে—যেন পৃথিবীর
বিস্তীর্ণ জলায় এক জালে পড়া লাশ
( ফিরে দেখা ১৯৭৪: চেতনার কঙ্কাল)

কবির কাছে এই দুঃসময় – দুর্বিনীত প্রতিবেশ প্রতিবাদ হয়ে ফুটে ওঠে কবিতায়, যে কারণে পিকাসোর বিখ‍্যাত গোয়ের্নিকা কবির কাছে হয়ে যায় ভিন্ন গোয়ের্নিকা। আশাবাদী কবি নিঃসংকোচে বলতে পারেন:

অন্ধকারে এলোমেলো হাত মেলে আমি ছুঁতে চাই
কবিতার উদোম শরীর
যেমন কখনো ছিলো সমর্পিত শয‍্যায় সত্তায়
শরীর আসে না হাতে—জ্বলে ওঠে অন্ধকার ফুঁড়ে
কি এক আশ্চর্য আলো, মনে হয়ে কবে যেন আমি
এ আলোয় পুড়িয়েছি চোখ—
( কবিতা কেমন আছে )

শুধু কবিতার ভালো থাকা, না ভালো থাকা নিয়ে কবি চিন্তিত নন। কবি কবিদের দুরাবস্থার কথা সবিস্তারে তুলে ধরেন তাঁর কবিতায়। কবিরা সত‍্যদ্রষ্টা। কবিরা বিবেককে জাগ্রত করার কথা বলেন। কিন্তু কবিরা আজ দ্বিধাবিভক্ত। নিজেদের ভেতরে কোন্দলে লিপ্ত। আর এই সুযোগে সুযোগসন্ধানীরা কবিদের নিয়ে উপহাস করে। এমন পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান প্রত‍্যক্ষ করেন কৌতুক মেশানো কবিদের শোকসভা। কবিতায় তার দৃপ্ত উচ্চারণ:
কি সৌভাগ্য তোমার হে কবি,
নাগরিক শোকসভা হচ্ছে আজ তোমাকে নিয়েই—
এবং তারাই
তোমার দুঃসময়ের দারুণ সুযোগ সেই যারা
তোমার নামের পরে অবিরাম রাবার ঘসেছে,
অকস্মাৎ রাবার লুকিয়ে
হয়ে গেছে কার্টুনের নখর লুকানো
হাসি হাসি মুখ করা কতিপয় অতিবন্ধু নিরীহ হায়েনা।
( শোকসভা কৌতুক )

দুর্বিনীত সময়ের প্রেক্ষাপটে কবি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। দেহটাকে শুষে নিয়ে মাথা মগজ জুড়ে শয়তানেরা হোলি খেলে, কবি তখন উচ্চারণ করেন:
বিজ্ঞানীরা মাফ করে দেন অজ্ঞানী এই তুচ্ছ মুখে উচ্চকিত গলায়
কথা বলায় পাপ যদি হয় ; আমার থেকে থেকে
ইচ্ছে করে, প্রবল ইচ্ছে,পৃথিবীর বোতল ঠ‍্যাঙের নলায়
দড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেই, বিজ্ঞানীদের ডেকে
মধ‍্যাকর্ষণ নামে যত ইসক্রু গাঁথা আছে মাথার ছাতে
সবগুলোকে খুলিয়ে নেই, দেখি কেমন করে
মগজগুলো ছিটকে নামে কোথায় অধঃপাতে।
( ইচ্ছে করে )

কবির এই প্রতিবাদ যেন আমাদেরও প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।

আমাদের বাংলা কবিতার এক অবিসংবাদী কবিপুরুষ শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন:

যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?

আর আমাদের কবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান যেতে চান একরাত কুয়াশার কাছে জীবনের পথটাকে বাঁধা রেখে, ভোরের সূর্যের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে। তিনি যেতে চান পথ রেখে গহীন গভীরে। রক্ত আর কাদা এবং অস্ফুট চিৎকার সমস্ত শরীরে মেখে।

সত‍্যদ্রষ্টা কবির এই যাওয়া যেন নিজেকে নিঃস্ব করে পৃথিবীর জন‍্য, সভ‍্যতার জন‍্য তাঁর রেখে যাওয়া অমর অস্তিত্ব। কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন:

সোনালু ফুলের থেকে ফনা তুলে সাপ
জিহ্বায় বাতাস চিরে ছোবলে ছোবলে
আমার শরীরটাকে নীল করে দেবে – তারপর
প‍্যাচাবে – প‍্যাচাবে।
বিষ আর প‍্যাচ আর নেশা আর নেশা
আমি তো যাবোই যাবো গহীন ভিতরে।
( যাবো )

এই যাওয়ার জন‍্য প্রয়োজন প্রস্তুতির। জগত-সংসারের শত আড়ষ্ঠতা কবিকে আক্রান্ত করে। বুকটা জড়িয়ে ধরে শিশিরপাতের মতো শব্দেরা। অশরীরী হীম জীবনকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। কবি শয‍্যা নিতে চান জ্বলন্ত আগুনে। নক্ষত্রেরা গলে গলে অগণিত অক্ষরের ছবি হয়ে যায়। তখন আড়ষ্ঠতা কবির পথরোধ করে। কবি বলেন:

অগণিত অক্ষরের ছবি সেঁটে সেঁটে
আমি চাই অন‍্য এক শরীর বানাতে
যেখানে ম‍্যাচের কাঠি ঠুকে দিলে জ্বলন্ত আগুন
শয‍্যা পেতে দেবে, শরীর বানাতে চাই
তবু কোন অশরীরী হীম এসে এসে
এফোঁড় ওফোঁড় করে আমাকে এবং
শিশির-পাতের শব্দ সম্মোহে জড়ায়
হে আড়ষ্ঠতা ক্ষমা করো, দোহাই তোমার।
( হে আমার আড়ষ্ঠতা )

কবি কি কোনো অলৌকিক জগতের বাসিন্দা! কেননা, কবি যে জগত-সত‍্য উচ্চারণ করেন, উম্মোচন করেন অন্ধকারের পর্দা, সে তো অনিবার্য, শাশ্বত । কিন্তু এই বাস্তব জগতের ভোগবাদী মানুষেরা কবির সত‍্যকে উপেক্ষা করবে, এটাই স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে কবি নিজের সাথেই নিজেই কথা বলেন। নিজের সাথে কথা বলতে বলতে বিদীর্ণ আকাশ আর বিক্ষুব্ধ সময় অতিক্রম করে যান কবি। তখন ঘন কুয়াশায় ঢাকা প্রদীপের মত এক আচ্ছন্ন আলোর অবয়ব দেখেন। সেখানে নিজেকে অবিকল নিজেকেই দেখতে পান। কবি যেন সত‍্যিই এক অলৌকিক জগতের বাসিন্দা। তিনি দেখতে পান, সময়ের কষাঘাত তীক্ষ্ম শিস কেটে অবিরাম চলছে সময়ের গায়ে। কবিতায় সেই অলৌকিক উচ্চারণ :

সহস্র আলোকবর্ষ আগে কার, অথবা পরের
সে কথা জানি না আমি—আমার সে মুখ—
সেই আলো বিষণ্ন অথবা
কোমল পবিত্র সেই আলো—সেই আলোকিত মুখ
নিষিদ্ধ কি আকাশের—সময়ের ঘোষিত বিচারে?
তবুও আমাকে ছাড়া আমি আর কাকে বলতে পারি
অলৌকিক এই সব কথা?
( অলৌকিক কথা )

কবির এই কবিতা আমাদেরকে একটি ঘোরের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। আসলেই কবি তাঁর মনের কথা, তাঁর বেদনার কথা নিজের সাথে ছাড়া কাউকে বলতে পারেন না। ক্ষতবিক্ষত মুখ নিজেকে ছাড়া কাউকে পারেন না দেখাতে। নিজের সাথে নিজের কথা বলা তখন যেন হয়ে ওঠে অলৌকিক।

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান ছন্দসচেতন কবি। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ; এই তিন ছন্দেই তিনি সিদ্ধহস্ত। মুক্তকেও তিনি সাবলীল। তিনি যখন গদ‍্যে তাঁর কবিতাকে সঞ্চালন করেন, সেখানেও এক অন্তর্গত ছন্দমাধুরী পাঠককে মুগ্ধ করে।
অক্ষরবৃত্তের দৃষ্টান্ত:

কতিপয় হাস‍্যকর লোক বসে বসে
কথার পিঠের সাথে কথা জুড়ে জুড়ে
উদ্ভট মজার খেলা দেখাবার নির্লজ্জ সাহসে
মূল‍্যবান কাগজের শুত্রতাকে খুঁড়ে
কবরের মত শুধু গহ্বর বানিয়ে চলেছে।
( সাদা অন্ধকার )

মাত্রাবৃত্তে চমৎকার কবিতার দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন:

নীচের থেকে নাড়া দিলেই সর্বনাশ
মুখ থুবড়ে পড়বে যত দৈত‍্য দানো
খিল খিলিয়ে উঠবে হেসে দুর্বাঘাস
মানবে না তো উর্ধ্ব থেকে চোখ রাঙানো

( চার টুকরো ছড়া: ভূমিকম্প স্বরবৃত্তের দৃষ্টান্ত :

চিত্রা পাড়ের লালমিয়া তার দেশজ ক‍্যানভাসে
এমন মানুষ আঁকে যাদের আকাশমুখো পেশী
চাষাভুষোর এমন শরীর বড়োই বেশি বেশি
চালান করা যায় না ওদের প্লেনে-ট্রেনে-বাসে
( চার টুকরো ছড়া :স্থির সত‍্য )

‘চন্দ্রবীক্ষণ ও নগ্নপদ‍্য’ কাব‍্যটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমভাগে ‘চন্দ্রবীক্ষণ’। এতে আছে ছত্রিশটি কবিতা। দ্বিতীয় ভাগে ‘নগ্নপদ‍্য’। এখানে আছে সতেরটি পদ‍্য। নগ্নপদ‍্যে চমৎকার সব ছন্দোবদ্ধ পদ‍্য।

এসব পদ‍্যে সময়ের যন্ত্রণাবোধ, সময়ের হাহাকার, গভীর জীবনবোধ অথবা জীবনের গূঢ়তম সত‍্যের উম্মোচন, প্রেম, আধ‍্যাত্ম চেতনা উদ্ভাসিত হয়েছে। কয়েকটি পদ‍্যের উল্লেখ করা যেতে পারে।

১.ভিতর থেকে ছুড়ছে ক্ষুধা
হিংস্র থাবার নখ;
বিজ্ঞজনের বাক‍্যে আছে
গ্রন্থে দেয়া সাক্ষে আছে
এসব ক্ষুধা, তওবা করো,
অর্বাচীনের সখ।

২. অস্থিরতায় জ্বলছি যখন এ‍্যাকা
হঠাৎ তখন তোমার সাথে দ‍্যাখা।।

৩.কোথায় যাবো সাঁই—
ভেতর থেকে যন্ত্রণা দেয়
দ্বিতীয় সংকেত
কোন জমিনে চাষ দেব সে
কোথায় সোনার খেত!!

৪. ভাঙলে ভাঙুক
ছিড়লে ছিড়ুক
কোনটা নয় ভুল।
একটু ভাঙায়
একটু ছেড়ায়
প্লাবিত দুই কূল।।

৫. ওষ্ঠ থেকে নষ্ট চাঁদের
রং মুছে নাও যাত্রী
শব্দহীনা অন্ধকূপে
ভাঙতে হবে রাত্রি।।

৬. আর কতকাল টেনে নিবি
আর কতটা পথ
জলে – ডাঙ্গায় – শূন্যে কোথাও
থামাবি তোর রথ!!

নগ্নপদ‍্যের সবকটিই গানের কবিতা। কবিতা যে গান; আবার গানই কবিতা, এ পদ‍্যগুলো তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে।
—–
* ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে যশোর-সাগরদাঁড়ীতে মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকীতে শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদ ‘মেঘনাদবধ কাব‍্য’ থেকে অংশবিশেষ নিজের সুরে গান হিসেবে পরিবেশন করে হাজার হাজার দর্শকদের বিমোহিত করেছিলেন। তিনি গেয়েছিলেন এই কাব‍্যের নবম সর্গে রাবণের খেদোক্তি:

“ছিল আশা, মেঘনাদ, মুদিব অন্তিমে
এ নয়নদ্বয় আমি তোমার সম্মুখে;—-
সঁপি রাজ‍্যভার,পুত্র,তোমায়, করিব
মহাযাত্রা! কিন্তু বিধি—–বুঝিব কেমনে
তার লীলা? ভাঁড়াইলা সে সুখ আমারে!
ছিল আশা, রক্ষঃকুল-রাজ-সিংহাসনে
জুড়াইব আঁখি, বৎস, দেখিয়া তোমারে,…

———–

খসরু পারভেজ

কবি ও গবেষকখসরু পারভেজের জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২, যশোর জেলার শেখপুরা গ্রামে। সাহিত্য সাময়িকী ও ছোটকাগজ সম্পাদনা ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিষয়ে গবেষণায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। সংগঠক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন মধুসূদন একাডেমী ও পােয়েট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।  

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: কবিতা- পালকখসা বলাকার আর্তনাদ, নিহত বিভীষিকা, নিরুদ্দেশে, মুক্তিযুদ্ধে কুকুরগুলো, ভালবাসা এসো ভুগোলময়, পুড়ে যায় রৌদ্রগ্রাম, ধর্ষণ মঙ্গলকাব্য, রূপের রিলিক, প্রেমের কবিতা, জেগে ওঠো প্রত্মবেলা, হৃদপুরাণ। গবেষণা: পদ্য: কবিতার ছন্দ, আমাদের শিল্পী এস এম সুলতান, আমাদের বাউল কবি লালন শাহ, এস এম সুলতান, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত।

পুরস্কার ও সম্মাননা : সুকান্ত পদক, মনোজ বসু স্মৃতি পুরস্কার, কণ্ঠশীলন সম্মাননা, বিবেকানন্দ পদক, মধুসূদন সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, জীবনানন্দ গ্রন্থাগার সম্মাননা।

ইমেইল :[email protected]

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top