লাল মিয়ার রাষ্ট্র

সাখাওয়াত টিপু

‘রাষ্ট্রের আকার সার্বজনীন আর আকারের আসল উপাদান চিন্তা।’

-ফ্রিডরিক হেগেল (১৭৭০-১৮৩১)

বাংলার চিত্রসাধক শেখ মুহাম্মদ সুলতানের আদি নাম লাল মিয়া (১৯২৩-৯৪)। লাল মিয়ার চিত্রকর্ম লইয়া যে কয়খানা লিখা প্রচারিত তাহার ভিতর মনীষী আহমদ ছফার রচনাখানি বেহতর। প্রশ্ন উঠিতে পারে— ছফার এহেন রচনা থাকিতে আমরা কেন মাতিলাম? তাহার কারণ দুই। পহিলা নম্বরে লাল মিয়ার মুক্তিযুদ্ধপূর্ব তিন দশকের (১৯৪০-৬০) সৃজনকর্ম খুঁটিয়া দেখা। দোসরা কথা যুদ্ধোত্তর (১৯৭০-৯০) আধুনিক চিত্রকলার সহিত তাঁহার চিত্রকর্ম সাক্ষাৎ দ্বন্দ্বে মাতিল কোন কারণে?

জাতশিল্পী লাল মিয়াকে লইয়া নানান কিংবদন্তী কাহিনী বাজারে চালু। সেই অপর কাহিনীর কথায় আজ বিরতি রাখিব। আজ আহমদ ছফার আলোচনায় অনুপস্থিত দুই কারণের রাহা সন্ধান করিব।


কথা তুলিয়াছিলাম লাল মিয়ার প্রথম জীবনের ছবি লইয়া। বোধ করি, ৪০ দশকে তাঁহার কৃত শিল্পকর্মের বিশেষ হদিস নাই। তাই এ সময়ে তাঁহার শিল্পযজ্ঞের ধরন-ধারণ নিয়া কথা পাড়া মুশকিল। তবে নানা তথ্যে দেখা যায়, ৪০ দশকে তাঁহার কর্মযজ্ঞ প্রদর্শিত হইয়াছিল ভারতের সিমলা (১৯৪৬), পাকিস্তানের লাহোর (১৯৪৮) ও করাচি (১৯৪৯) শহরে। সেইসব কর্মের ছাপা নমুনাও বাজারে নাই। এষণা তো পরের কথা সেই সময়ের তাঁহার শিল্পকর্মের গো (ভাব) হাজির করিতে পারে নাই দেশের শিল্পকলা গবেষণা অনুষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। ৫০ ও ৬০ দশকের ১১ খানা সৃজনকর্মের নমুনা মিলিতেছে সাদেক খান সম্পাদিত এস. এম. সুলতান (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, আর্ট অব বাংলাদেশ সিরিজ-৪) বহিতে। ৫০ দশকে মিলিতেছে সাধক (১৯৫১), কাফেলা (১৯৫৩), পরামর্শ (১৯৫৩), ড্রয়িং (১৯৫৩) ও নিসর্গ ধারার কয়খানা সৃজনকর্ম। আর কলসি কাঁখে রমণী (১৯৬৯), মা ও শিশু (১৯৬৯), নায়র (১৯৬৯) ও মাছধরা (১৯৬৯) নামের কয়খানা নমুনা ৬০ দশকের নজির। ৬০ দশকের পর লাল মিয়ার সৃজনযজ্ঞে পুনরুজ্জীবন ঘটিয়াছে। সেই পাড়ার যাইবার আগে ৫০ আর ৬০ দশকের কয়খানা সৃজনকর্ম পড়িয়া লইব আমরা। লাল মিয়ার ছবির মাজেজা কি?

শিল্পের চলতি ধারণা, সৌন্দর্য উৎপাদনই শিল্পের লক্ষ্য। আর সৌন্দর্যের বোলচাল আনন্দদানেই নিহিত। আনন্দ অধম নহে, উত্তম। কেননা সৌন্দর্য আনন্দেই থাকিতেছে। এহেন চল ধারণা মানিলে প্রয়োজনে সৌন্দর্য থাকিতেছে না। মানে অধমে আনন্দ নাই! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এহেন মতের সমর্থক। ‘সৌন্দর্যবোধ’ রচনায় ঠাকুর বলিতেছেন, ‘সৌন্দর্য নাকি প্রয়োজনের বাড়া।’ এইখানে ‘নাকি’ অব্যয়খানি সন্দেহবোধক, সংশয়বোধক নহে। নহে খোদ প্রশ্নবোধকও। ‘নাকি’ পদ বাদ দিলে যাহা খাড়ায়_ ‘সৌন্দর্য প্রয়োজনের বাড়া’। ঠাকুর আরো জাহির করিতেছেন সৌন্দর্য মালটা ‘উপরি পাওনা’। তাঁহার সৌন্দর্য তত্ত্বে কৌশলের ভার থাকিলেও ‘অ-ভাব’ ওরফে ‘অভাবের ভাব’ নাই। মানিয়া লইতেছি ভাবের অভাব সৌন্দর্যের এক কুঠুরি। অপর কুঠুরি কি খিলে আটা। ইহাতে মুশকিল দুই ধরনের।

পহিলা, প্রয়োজনে সৌন্দর্য নাই। প্রয়োজন মালটা যদি কাহারো অ-ভাব হয় তো, প্রয়োজনই তাহার সৌন্দর্য। দোসরা, সৌন্দর্য যদি ‘উপরি পাওনা’ হয়, তাহা হইলে ‘পরি’ পদার্থে সৌন্দর্য অনুপস্থিত। আমাদের প্রস্তাব— রবি ঠাকুরের শিল্পসংজ্ঞার মুশকিল আসান করিয়াছেন খোদশিল্পী শেখ মুহাম্মদ সুলতান ওরফে লাল মিয়া। তাহা কিভাবে?

লাল মিয়ার পরামর্শ (১৯৫৩), কাফেলা (১৯৫৩) প্রভৃতি সৃজনকর্মে মিলিতেছে পরি আর উপরির সাক্ষাৎ মিলন। স্পষ্ট করিয়া বলিলে ইহাতে খাঁটি প্রয়োজনের সৌন্দর্য নহে, মিলিতেছে প্রয়োজনের বাড়া সৌন্দর্য মালটাও। ‘পরামর্শ’ রেখাচিত্রে দেখা মিলিতেছে শীর্ণকায় আদমসন্তানের মিলন। ক্ষুধার্ত বান্দার জাগিয়া উঠিবার শলা। আর রেখাচিত্রে জাগিয়াই উঠিয়াছে ‘কাফেলা’। বাংলা শব্দবিদ্যা মতে ‘কাফেলা’ আরবি ‘কাফিলাহ’ পদের ভ্রংশরূপ। অর্থবিদ্যায় কাফেলার মানে পথিক দল/মিছিল/রঙ্গ। প্রশ্ন : কেন এই ক্ষুধার্ত মানুষের কাফেলা? পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র আদমসন্তানকে আদতে প্রভু আর বান্দা দুইভাগে ভাগ করিয়াছে। আর শোষণের যাঁতাকলে বান্দাকে বানাইতেছে দাস। লাল মিয়ার দাস শলা করে। আর জাগে অন্তহীন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। শিল্পের রূপক মানিলে বলিতেই হইবে— পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের রূপক কঙ্কালসার মানুষ। এ রূপক বীভৎস। তবুও কি সুন্দর!

লাল মিয়ার ন্যুব্জ, শীর্ণকায়, ভঙ্গুর বান্দারা শলা করিয়া কাফেলা ওরফে মিছিল করিতেছে। জাগিয়া উঠিয়া শুদ্ধ পরিতেই মন দিতেছে না, মন দিতেছে উপরি অর্থাৎ প্রভুর দিকে। কাফেলার বান্দারা প্রভুতে মন দিয়া দাস বা ঊনমানুষ থাকিতে চায় না, হইয়া উঠিতে চায় ‘সহজ মানুষ’। ইহারা উদাস কিংবা ছন্নছাড়া নহে। হাল আমলের মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ বা বিরহের গোড়া পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ। তাঁহার বান্দারা এহেন বিরহের গোড়ায় ঘটাইতেছে সাক্ষাৎ মহামিলন। তাহা নয় কি?


বঙ্গদেশে শিল্প-সমালোচনা সাহিত্য গড়িয়া উঠে নাই। তাহা এখনো দোকানি মেয়ের দর্শন! যেন তাহা বিনোদন সংবাদ। তবুও নানা বিজ্ঞাপনী পাতায় দুই-চারখানা সমালোচনা সাহিত্য মেলে। তবে লাল মিয়ার সৃজনকর্মের দুয়েকখানা নগণ্য সমালোচনা আমরা গণ্য করিতে চাহি। যথা— অধ্যাপক নজরুল ইসলাম লাল মিয়ার নিসর্গ বিষয়ক ছবির ব্যাখ্যাচ্ছলে বলিতেছেন,’পঞ্চাশের দশকে আঁকা সুলতানের নিসর্গ চিত্রের দুটি ছবির অনুলিপি পাওয়া গেছে পাকিস্তান পাবলিকেশন্স আর্ট ইন পাকিস্তান (তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৬৪) গ্রন্থটিতে। দুটি ছবিই তেল রঙে, সম্ভবত যশোহর এলাকার নিসর্গ-দৃশ্য ভিত্তিক। একটিতে গাছে ঢাকা আঁকাবাঁকা নদীর ধারে গাছের নিচে বসে আহার এবং বিশ্রামরত জনা চারেক দরিদ্র গ্রামবাসী। দুটি ছবিরই কম্পোজিশন সুষম। যদিও দ্বিতীয় ছবিতে কেন্দ্রীয় ফোকাস কিছুটা অনিশ্চিত। অঙ্কনরীতি ভ্যান গগীয় ইম্প্রেশনিস্ট। রং নির্বাচন এবং তুলির স্ট্রোকের ধরন স্পষ্টতই এরকম ধারণা দেয়।’

দার্শনিকগণ খানিক খেয়াল রাখিবেন, খানিক দেখিবেন। ইসলাম সাহেব লাল মিয়ার ছবিকে ‘ইম্প্রেশনিস্ট’ আখ্যা দিয়াছেন। কিন্তু কেন, কি কারণে তাঁহার ছবিখানায় ‘ভ্যান গগীয় ইম্প্রেশনিস্টের’ আলো পড়িয়াছে তাহার কোন বিশ্লেষণ নাই। এহেন মদ্যপ (ফেটিশা) মন্তব্য করিবার আগে ‘রঙ নির্বাচন’ কি হইলে এবং ‘তুলির স্ট্রোকের ধরন’ কেমন হইলে ‘ইম্প্রেশনিস্ট’ হইবে তাহার ব্যাখ্যা দরকার।

<br>
১৮৬০ সালের ফরাসি বাড়ির ইঙ্গিতবাদী (Impressionist) চিত্রকলা আন্দোলন লইয়া কথা তুলিতেছি না। তাহাতে তর্ক অন্যদিকে গড়াইবে। তবে তাঁহার ইম্প্রেশনিস্ট সমালোচনাকে ‘টোপরবাদী’ সমালোচনা বলাই যুৎসই হইবে। ইসলাম আরো কহেন, ‘সুলতানের ছবির একটি বৈশিষ্ট্য বাংলার কৃষকের শরীরকে অস্বাভাবিক পেশিবহুল বিশাল ও শক্তিশালী দেখানো।’ সমালোচকের ভাষায় ‘অস্বাভাবিক’ শব্দখানি এমনই রূঢ় যেন কৃষকের ‘স্বাভাবিক’ দেহের গড়ন ‘রোগগ্রস্ত’ কিংবা ‘মেদবহুল’। তিনি সত্য কিংবা মিথ্যা কোনটাই বলেন নাই। যাহা বলিয়াছেন তাহা অসত্য মাত্র। অসত্য সত্যেরই অপলাপ।

<br>

যে কেহ মানিবেন, শ্রেণীবিভক্ত বুর্জোয়া রাষ্ট্রে ‘দুর্নীতি’ স্বাভাবিক। এইখানে ‘অস্বাভাবিক’ রাষ্ট্র মানেই সামাজিক মালিকানার রাষ্ট্র। সত্য বড়ই বিস্ময়কর। শোষণ জারি থাকা রাষ্ট্রের গড়নে দুই শ্রেণীর দেহধারী আদমসন্তান থাকিতে পারে। একশ্রেণীর নাম প্রভু ওরফে মেদবহুল অতিকায় মানব। অপর শ্রেণী দাস ওরফে শীর্ণকায় বান্দা। ইসলাম সাহেবের মতে ‘স্বাভাবিক’ দেহের গড়ন ‘মেদবহুল’ কিংবা ‘কংকালসার’ নয় কি? লাল মিয়ার কৃষক আদতে ‘কংকালসার’ কিংবা ‘মেদবহুল’ নহে, বীর্যবান সহজ মানুষ মাত্র।

<br>

অপর অধ্যাপক আবুল মনসুর কহেন, “একে বলা চলে শহুরে ‘নাইভ’ শিল্পের কাছাকাছি কিছু, আমাদের রিকশা পেইন্টিংয়ে যে ধরনটি দেখা যায়।” প্রশ্ন জাগিতেছে, রিকশার পাছার শিল্পকর্মের সহিত লাল মিয়ার শিল্পকর্মের সম্পর্কই বা কি? মনসুর সাহেব ‘নাইভ’ (Naive) শব্দকে ‘অপটু’ অর্থে ধার করিয়াছেন। তবে পশ্চিমা সমালোচনা সাহিত্যে ‘নাইভ’ শব্দখানির শিল্পহীন (Artless) অর্থেও কখনো সখনো ব্যবহার হয়। সমালোচনা বিদ্যা মানিলে নাইভ শব্দের সহজ বাংলা অর্থ ‘সরল’। তবে লাল মিয়ার ছবি সরল নহে, সহজ। সহজ মানে অপরের সহযোগে। স্বরূপ আর অরূপ— দুই রূপেরই মিলন। একথা সত্য— মনসুর সাহেবের চোখে ‘পটু’ শিল্প কি বস্তু তাহা কহিলে তাহার অপটুভাব ধরা পড়িত না। শুধু তাহা নহে, লাল মিয়াকে ‘প্রান্তিক মানস’ বলিতেও কসুর করেন নাই তিনি। এহেন রাজনীতির শিকার জাতীয় ভাবধারার কবি জসীমউদ্দীনও। ‘পল্লীকবি’ অভিধায় তিনিও জাতীয় ভাবধারা হইতে বিচ্যুত। আর লাল মিয়াও কি সেই একই অপরাজনীতির শিকার নহেন?

জিজ্ঞাসা জাগে, লাল মিয়ার শিল্পকর্ম ‘অপটু’ কেন? তাঁহার মানস কি প্রান্তিক? রীতি মোতাবেক পশ্চিমা শিল্প সমালোচকগণ ‘Marginality’ ওর্ফে ‘প্রান্তিক’ শব্দখানার ধানাই ধরেন। তাই পানাই করিতে উদাহরণ টানিতে হয়। পশ্চিমের ধুরন্ধর ধানাই-রসিক ফ্রাঙ্ক মিলনার প্রান্তিক ছপ্পরখানি ব্যবহার করিয়াছেন। ধানাই-রসিকের মত, মেক্সিকোর শিল্পী ফ্রিদা কাহলো ‘আধুনিক’, তবে ‘প্রান্তিক’। এহেন প্রান্ত মানে যা কেন্দ্রে নাই। মানে কেন্দ্র যাদের দখলে বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান তাদের হাতে! কিন্তু প্রশ্ন উঠিতেছে, যে শিল্পের ভাষার কেন্দ্রে মানুষ তাহাকে প্রান্তিক বলা হইতেছে কেন? এই হইতেছে আধিপত্য সংস্কৃতির বালাই। বঙ্গ সমাজেও এহেন তরতরানি দেখা যায় সুশীল নামধারী উন্নয়ন ব্যবসায়িদের ‘প্রান্তিক তত্ত্বে’। তবে লাল মিয়ার শিল্পের ভাষা তো সেই সাক্ষ্য দিতেছে না। সাক্ষ্য মিলিতেছে কি?

তাহার ভাষার কেন্দ্রে মানুষ আর প্রকৃতি। ভাষার গঠনতন্ত্র মানিলে লাল মিয়ার শিল্পকর্ম সহজ হইয়া উঠে। আদমসন্তান ভাষার বান্দা। ভাষার ভিতরে আদমসন্তানের বাস, ভাষার ভাব মাত্র প্রকৃতির সহিত সম্পর্ক গড়িয়া থাকে। ভাষা শুধু প্রকৃতির সহিত সম্পর্ক গড়িতেছে না, গড়িতেছে বস্তুর সহিতও ভাব। আরো আছে আদমের ভাষার স্বভাব। সেই স্বভাব কি? প্রকৃতি ও বস্তুর অর্থদান। আর অর্থদানের সার আর সংসারের নামই বাসনা। কেননা আদমসন্তান ভাষার ভিতর ঢুকিলেই হয় মানব।


মনোবিদ্যায় কহে, অজ্ঞানের কুঠুরিতেই ভাষার জন্ম। কেননা অজ্ঞান মাত্রই বিস্ফোরণ উন্মুখ। অজ্ঞান বিস্ফারিত হইলে কি প্রকৃতি কি বস্তু কি খোদ ব্রহ্মাণ্ড ধরা পড়িতেছে সহজ মানুষ হিসাবে। লাল মিয়ার শিল্পে বীর্যবান মানুষই সহজ মানুষ। কেননা তাঁহার ক্যানভাসের বীর্যবান পেশিবান মানুষই বুর্জোয়া সমাজে প্রশ্ন আকারে হাজির হয়। ফ্রানৎস ফানোঁ (১৯২৫-৬১) তাঁহার ‘কালা চামড়া সাদা মুখোশ’ বহিতে সেই প্রার্থনার কথাই বলিয়াছেন। ফানোঁর প্রার্থনা, ‘ও মোর দেহ, আমাকে বানাও সর্বদা এমন মানুষ যে প্রশ্ন করে।’


এখন আধুনিক সাম্রাজ্যের যুগ চলিতেছে। একচেটিয়া পুঁজি সাম্রাজ্যের খুঁটি। শ্রেণীশোষণ জারি রাখিয়া এ পুঁজি প্রকৃতি ও মানুষকে নিঃশেষ করিতেছে। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের বটিকা ‘সুফলা বীজ’ কেমন নিষ্ফলা তাহা বঙ্গের কৃষক কি টের পায় নাই? আলোক ধানে বীজ হয় না, হয়তো তক্তা হয়। বিজাতীয় সেই তক্তায় শুধু প্রভুরই মুনাফা। কৃষক হয় নিঃস্ব। আর এই হাইব্রিড সংস্কৃতির নামই সাম্রাজ্যবাদ।

লাল মিয়া জানিতেন, শপথ করিয়া সত্য বদলানো সম্ভব নহে। ঠিক তেমনি সাম্রাজ্যবাদের বটিকা দিয়াও সমাজ বদল সম্ভব নহে। তাই তো অন্তঃসারহীন আধুনিকতার পথে হাঁটেন নাই তিনি। ১৯৭০-৯৪ সাল বিস্তৃত তাঁহার সৃজনকর্ম সেই সাক্ষ্য দেয়। সাক্ষ্য দেয় তাঁহার ‘নিসর্গ ও মানুষ’ আর ‘প্রকৃতি ও জীবন’ শিল্পকর্মের প্রদর্শনী।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বঙ্গের শিল্পীকুল যখন পশ্চিমা শিল্পের মোটামুটি ঈমানদার পুনরুৎপাদনে মত্ত, লাল মিয়ার ক্যানভাসের মানুষেরা তখন চর দখল করিয়া জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় মগ্ন। অধিকার প্রতিষ্ঠা করিয়া জাতীয় শিল্প উৎপাদনেও মন দিতেছে তাহারা। জীবন সাধনার এ উৎপাদনের নামই সাম্য। কর্মযজ্ঞের মহাসমারোহে তাহারা সকলে সমান সমাজের সমান ভাগিদার। পরখ করিলে দেখা যায়, জমিকর্ষণ, ধানকাটা, ধান মাড়াই, ধানভানা, মাছধরা, মাছকাটা, ইতি আদি শিল্পকর্মে আধুনিকতার দোচুয়ানি ব্যক্তি ‘আমি’র বালাই নাই। একদল সামাজিক মানুষ উৎপাদন, বণ্টন আর জীবনসাধনায় মাতিয়া আছেন। তাহারা প্রকৃতির সহিত সংঘাতে লিপ্ত হয় না। প্রকৃতির কোলে বসিয়া প্রকৃতির লালন-পালন করিতেছে। কর্মযজ্ঞের এহেন আনন্দযাত্রার নাম হয় তো হইবে— কৃষিমাতৃক বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি। জাতীয় সংস্কৃতির এই প্রতীক হইতেছে লাল মিয়ার শিল্পের মানুষ বা বলবান কৃষক।


‘বাঙালী মুসলমানের মন’ বহিতে ‘বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা’ নামের আহমদ ছফার (১৯৪৩-২০০১) মর্মমধুর রচনায় লাল মিয়ার ঠিকুজি চিনিয়া লওয়া একদম সহজ। ছফা তাঁহার শিল্পের বিচার করিয়াছেন বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্যের নিক্তিতে। খানিক ইতিহাসের ঝরনাধারায়। তাঁহার দরদী রচনায় লাল মিয়ার যুগের শিল্প ও শিল্পীসভার বিশ্লেষণও বাদ পড়ে নাই। অন্তত বাংলাদেশের চিত্র সমালোচনা সাহিত্যে ইহা একমেবাদ্বিতীয়ম। দেশে চারুকলার নামে যে সকল অনুষ্ঠান চলিতেছে তাহাতে রচনাখানি পাঠ্য হইবার অধিকার রাখে।

আহমদ ছফা বলিতেন, ‘তাঁহার আগেও কেহ নাই, পরেও কেহ নাই।’ প্রশ্ন জাগাই স্বভাব, তাহা হইলে লাল মিয়ার শিল্পকর্ম কি আসমান হইতে পাতালে পড়িয়াছে? না না তাহা পড়িবে কেন। তাঁহার চিন্তা রাষ্ট্রের মাটি ভেদ করিয়া জাগিয়াছে। এই জাগা চিন্তারই ‘অ-ভেদ’ অর্থাৎ যাহা ভেদের ভাব পূর্ণ করিয়া অপর পদকে জাগাইয়া তোলে। প্রশ্ন ছোঁড়ে, পথ দেখায়। কেন না তাঁহার শিল্পের রূপ আর অরূপ— দুই-ই সার্বজনীন। ইহার নাম আমরা দিয়াছি রাষ্ট্র। অর্থবিদ্যা মতে রাষ্ট্র মানে রাজ্য বা দেশ আর অপর অর্থে জানাজানি। চিন্তার রাজ্যে লাল মিয়ার শিল্পকর্মকে আমরা এই দুই অর্থেই রাষ্ট্র করিলাম।
আজ আমরা বলিলাম। বাকি ভবিষ্যতই বলিবে।

সহায়
১. Hegel’s Philosophy of Right, T.M. Knox tr, Reprint (London: Oxford University Press 1969).
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্য পুনমর্ুদ্রণ (কলিকাতা, বিশ্বভারতী১৪১১)।
৩. সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত, জাক লাকাঁ বিদ্যালয় (ঢাকা : এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ২০০৫)।
৪. সুবীর চৌধুরী সম্পাদিত, এস. এম. সুলতান, (ঢাকা : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ২০০৩)।
৫. আহমদ ছফা, বাঙালী মুসলমানের মন, (ঢাকা : উত্থানপর্ব ২০০৮)।
৬. Frantz Fanon, Black Skin White masks, (New York: Grove Press 1968)|
৭. নজরুল ইসলাম, সমকালীন শিল্প ও শিল্পী, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা : পাঠক সমাবেশ ২০০৯)।
৮. Frank Milner, Frida Kahlo, (London: PRC Publishing Ltd., 2001)|

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top