দারা মাহমুদ
কবিতা সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো কথা বলা সমীচীন নয়। কারণ, কবিতা পৃথিবীর একটা অমীমাংসিত বিষয়। যেটা ঘটছে মানুষ যখন জঙ্গল থেকে গুহায় উঠে এসেছে, পেটে চারটে খাবার জুটেছে, মনে কিছুটা ফূর্তি জেগেছে তখন থেকে। মানুষের সাথে সাথে কবিতারও বিবর্তন ঘটেছে যুগে যুগে। অনেকেই কবিতা কী, কবিতা কেন তার একটা মীমাংসা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। কবিতাকে অনুভব করা যায়। কিন্তু এর ব্যাখ্যা সেইভাবে হয় না। এ জন্য কবিতা সম্পর্কে যখন কেউ কিছু বলবেন, তার প্রথমেই বলা উচিত, ‘According to my opinion কবিতা হচ্ছে এই।’ কবিতা সম্পর্কে সকলেই তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রাখেন। আমিও। বক্ষ্যমাণ লেখায় আমি কবিতা সম্পর্কে বেশ কিছু মতামত তুলে ধরবো, যা হয়তো অনেকের কাছে গ্রহণীয় না-ও হতে পারে। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কবিতার সাথে থাকার ফলে আমার ভেতর বাংলা কবিতার মুক্তির ব্যাপারে যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে সেটাই আমি ব্যক্ত করছি। এটা সম্পূর্ণই আমার নিজস্ব অভিমত বলে গণ্য করলে বাধিত হব।
বাংলা কবিতার মুক্তির প্রসঙ্গ আসছে কেন? প্রশ্ন আসতে পারে বাংলা কবিতাকে কেউ কি বন্দি করে রেখেছে? বিষয়টা ঠিক সেরকম নয়। তবে বাংলা কবিতা এক কঠিন পাঁকে আটকে রয়েছে। পাঁকটা হচ্ছে আমাদের ত্রিশের মহান পাঁচ কবি যে কবিতা ঘরানার প্রবর্তন করেছিলেন তার থেকে বাংলা কবিতা মুক্ত হতে পারছে না। জীবনানন্দ দাশের ভয়াবহ প্রভাব দীর্ঘদিন বাংলা কবিতাকে শাসন করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। এখন মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ নতুন কোনো কাব্যভাষা নিয়ে এসেছেন, মনে হচ্ছে বাংলা কবিতা নতুন কিছু পেয়ে গেছে। কিন্তু একটু সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, তিনি জীবনানন্দকে ছেড়ে বিষ্ণু দেকে ধরেছেন, অথবা তার কবিতায় সুধীন দত্তর পুনর্জন্ম ঘটেছে। কারো নাম উল্লেখ করে আমি কাউকেই ছোট করতে চাই না। যারা কবিতায় আছেন এবং নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন, তারা সকলে নমস্য, শ্রদ্ধেয়। কারো প্রচেষ্টাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। তবে প্রচেষ্টা একটু সংগঠিতভাবে করলে, একটু লক্ষ্য ঠিক করে করলে হয়তো ভালো সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না বলে আলোকিত মানুষ ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির ভাষায় বলতে হচ্ছে, ‘No way out’ বা বেরুনোর রাস্তা নেই। আসলেই কি বেরুনোর রাস্তা নেই? নাকি আছে! থাকলে সেটা কোন রাস্তা? রাস্তাটা খোঁজার জন্যই এই লেখন চেষ্টা। এমনও হতে পারে এই লেখার শেষ অবদি পৌঁছে আমরা বলতে পারবো, ‘Yes, there is a way out.’ অর্থাৎ আছে, রাস্তা আছে। মানবজাতি জন্মের পর থেকে রাস্তায় নেমে পড়েছে, হাঁটছে, এবং এখনও হাঁটছে, কিন্তু রাস্তা শেষ হচ্ছে না। নতুন নতুন রাস্তা খুলে যাচ্ছে তার সামনে। কবিতারও পথ চলা মানুষের সাথে। কবিতারও নতুন নতুন রাস্তা খুলে যাচ্ছে এবং যেতে থাকবে। সময়ের নিয়মেই ‘ওয়ে আউট’ হয়ে যেতে বাধ্য।
কেন সাইবার যুগ?
সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে কবিতারও বাঁকবদল হয়। কারণ, কবিতা সময়কে ধারণ করে, পরিবর্তনগুলোকে ধারণ করে সামনের দিনগুলোর সংকেত দেয় আর তখনি কবিতা সফল হয়ে ওঠে। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন আধুনিক কবিতা, উত্তরাধুনিক কবিতা? এরকম নির্ণয় কেন, কবিতা তো কবিতাই। এটা ঠিক কবিতা কবিতাই, তবে সময়ের সাথে সাথে কবিতার চারিত্র লক্ষণে কিছু পরিবর্তন আসে। সেটাকে চিহ্নিত করার জন্য পণ্ডিত ব্যক্তিরা এক একটা সময়ের কবিতাকে (অবশ্য যে কবিতা সময়কে ধারণ করতে পারে) এক একটা সময়কালের মধ্যে চিহ্নিত করে থাকেন। যেমন প্রাচীন যুগের ধ্রুপদী কবিতা, মধ্যযুগের কবিতা, রোমান্টিক কবিতা, আধুনিক কবিতা, উত্তরাধুনিক বা অধুনান্তিক কবিতা। উত্তরাধুনিকতার শুরুও তো ৭০/৮০ বছর হয়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিগত ৭ দশকে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পুঁজিবাদের চরম বিকাশ সাধিত হয়ে তা অনিবার্য সংকটের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে কম্পিউটার আবিষ্কার, উপগ্রহের বহুবিধ ব্যবহার এবং ইন্টারনেট বা আন্তর্জালের সর্বগ্রাসী বিস্তৃতি, মানব সভ্যতাকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে। প্রযুক্তির এই চরম বিকাশ মানুষের জীবনযাপনকেও নানাভাবে প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে মানুষের চিন্তার জগতকে ওলট-পালট করে ফেলেছে এবং তা নানাভাবে প্রভাবিত করছে, এসব কিছু কবিতাতে আসতে পারে যা থেকে নতুন কবিতার জন্ম হতে পারে।
এক সময় সমাজে তীব্র দারিদ্র্য ছিল। যা কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। সুকান্ত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে একেবারে এ কালের ইন্দু সাহা পর্যন্ত। শঙ্খ ঘোষের ‘যমুনাবতী’ কবিতাটার কথা নিশ্চয় মনে আছে, ‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা/একটু আগুন দে/আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি/বাঁচার আনন্দে।’ (দিনগুলি রাতগুলি; শঙ্খ ঘোষ; প্রথম প্রকাশ: ১৯৫৬)। খুঁজলে এরকম অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে। তখনকার সমাজ বাস্তবতায় ওই কবিতাগুলো নিঃসন্দেহে পাঠকদের আলোড়িত করেছে। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় পরিবর্তন আসছে। দারিদ্র্য কমছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দারিদ্র্য নির্মূল সম্ভব নয়; কিন্তু কমিয়ে আনা সম্ভব। এই কিছুদিন আগে ’৯০ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৯ শতাংশ, যা এখন ২০১৫তে ৩০ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এক সময় যমুনাবতীর উনুনে আগুন জ্বালানোই ছিল একটা ভালো খবর, কিন্তু এখন স্টার জলসার দেখা ‘বোঝে না সে বোঝে না’ নাটকের পাখি চরিত্রের পোশাক পাচ্ছে না বলে হালিমা মনোকষ্ট পাচ্ছে এবং আত্মহত্যা করছে। এক তরুণ আর এক তরুণকে খুন করে ফেলছে একটা অ্যানড্রয়েড ফোনের জন্য। মধ্যবিত্তের অনেক চাওয়াই এখন পূরণ হচ্ছে, কিন্তু প্রত্যাশিত স্কুলে শিশুটাকে পড়াতে পারছে না, হাল ফ্যাশনের ঝাঁ চকচকে গাড়িটি অন্যের হয়ে যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত অ্যাপার্টমেন্টটা কেনা হলো না, ভাড়া বাড়িতেই থেকে যেতে হলো। এরকম নানা সঙ্কট। সমাজে অপরাধেরও ধরন পাল্টে যাচ্ছে, পরকীয় প্রতারক প্রেমিককে এক মৃত ধনী ব্যক্তির হিসেবের সব গোপন পিন নম্বর দেয়ার পর কোটি টাকার প্রতারণা হয়ে গেল। শেষ অবদি জেলে গেলেন সুন্দরী ব্যাংকার মেয়েটি। সাইবার অপরাধ অপরাধ বিজ্ঞানকে নতুন মাত্রায় নিয়ে চলেছে। আবার মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অনেক অপরাধী ধরা পড়ে যাচ্ছে। যেটাও সাইবার যুগের অনুষঙ্গ। এ এক নতুন সমাজ বাস্তবতা, যা মানুষ ৪০ বছর আগে দেখেনি। এই নতুন সময় বাস্তবতার চিত্র এখন কবিতায় তুলে আনার সময় এসেছে এবং ইতোমধ্যে আসতে শুরু করেছে। এই নতুন সময় পর্বের কবিতার একটা নতুন সময় শিরোনাম দেয়ার সময় এসেছে। কেউ কেউ এটাকে বলেছেন ‘পুনরাধুনিক’, কিন্তু শব্দটি হালে তেমন একটা পানি পাচ্ছে না। কারণ, এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বলা যেত ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল যুগের কবিতা। কিন্তু তাতে প্রযুক্তির গন্ধ বেশি। হতে পারতো উচ্চ প্রযুক্তি যুগের কবিতা। সেটা বেশি খটমট হয়ে যায় আর প্রযুক্তির তো শেষ নেই, সহসাই আরো উচ্চ প্রযুক্তি পৃথিবীর জন্য অপেক্ষা করছে, তখন? বরং আমরা যদি বলি ‘সাইবার যুগের কবিতা’ সেটা অনেক বেশি কাব্যিক হয় এবং সর্ব অর্থে নতুন সময়কে নির্দেশ করে। এই সাইবার যুগের কবিতায় কি কি পরিবর্তন আসতে পারে? সেটা আলোচনার বিষয় হতে পারে। সে আলোচনা নানা দিক দিয়ে হতে পারে। নিচে কিছু ধারণা তুলে ধরা হলো।
বিষয়গত নতুনত্ব
পৃথিবী এখন সবচেয়ে সঙ্কটময় সময়ে উপস্থিত হয়েছে। পৃথিবীর সবচে’ বড় ধনতান্ত্রিক শক্তি ইউনাইটেড স্টেটস বা যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক সঙ্কটে পড়ছে। এটা কার্ল মার্কস নির্দেশিত ‘ধনতন্ত্রের আনিবার্য সঙ্কট।’ নিজের অন্তর্গত সঙ্কট থেকে বাঁচার জন্য তারা পৃথিবীতে একের পর এক যুদ্ধ বাধিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের অস্ত্রের বাজার চাঙ্গা রাখার জন্য সবকিছুই করছে। এটা খানিকটা আগুন নিয়ে খেলার মতো, এই খেলা খেলতে খেলতে তারা পৃথিবীতে পারমাণবিক যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। যা অনিবার্যভাবে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। এরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পৃথিবী আগে কখনো পড়েনি।
এক সময়, এমনকি গত শতকের প্রথমার্ধে পৃথিবীতে যৌথ পরিবার ছিল। যৌথ পরিবার ভেঙে স্বামী-স্ত্রীর একক পরিবার হলো। এখন সেই স্বামী-স্ত্রীর পরিবারও ভেঙে যাচ্ছে। এটা আশির দশকে ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছিল সুইডেনে। পরবর্তীতে তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে এমনকি আমাদের দেশেও। বাংলাদেশে এখন একাকী মায়ের (Single mother) সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা থেকে দেশ পুঁজিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধ তীব্র হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর একক পরিবারে যেটুকু সহনশীলতা ছিল, এখন তা আর থাকছে না। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন এটা বহুকাল ধরে পৃথিবী দেখেছে; কিন্তু এখন দেখছে স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন। গত ফুটবল বিশ্বকাপের সময় ২০১৩ সালে নাটোরের এক গৃহবধূ তার স্বামীকে গলা কেটে খুন করেছিল, কারণ স্বামী রাত জেগে খেলা দেখছিল। ঘুমের ব্যাঘাত হওয়াতে কলহের একপর্যায়ে গৃহবধূটি ধারাল দা’য়ের কোপ মেরে স্বামীকে খুন করে। এখানে লক্ষণীয় যে, ঘুমের সময় টেলিভিশনের শব্দ গৃহবধূটির ব্যক্তিস্বাধীনতায় আঘাত করেছিল। এটা শুধু গ্রামে ঘটছে তা নয়, শহুরে শিক্ষিত পরিবারেও এরকম ঘটনা ঘটছে। কয়েক বৎসর আগে আমি মতিঝিলে এক বন্ধুর অফিসে গিয়ে দেখি সেখানে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে চলেছে। আমার বন্ধুটি এবং তার স্ত্রী তাদের ব্যবসায়িক দপ্তরে সকল কর্মচারীর সামনেই মারামারিতে লিপ্ত হয়েছে এবং মারামারি রক্তারক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। অথচ এদেশে যুগ যুগ ধরে বিষয়টা একতরফা হয়েছে। অর্থাৎ পুরুষরাই নারীদের নির্যাতন করেছে। কিন্তু এখন ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে এদেশের নারীরা এই বার্তা পেয়ে যাচ্ছে যে, তারাও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
আমরা যৌবনে পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে টলস্টয়, চেখভ, গোর্কি, মোপাসাঁ এমিলি জোলা প্রভৃতি মহান লেখকদের রচনার প্রথম পাঠ সেরে নিয়েছি। এখনকার ওই বয়সী ছেলেরা এ সময় ইন্টারনেট নিয়ে মেতে থাকছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে দেখি, ল্যাপটপ, ট্যাব অথবা সেলুলার ফোন নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিছু একটা করছে। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘বাবা, টাইম পাস করছি।’ এরা টাইম পাসকে জীবন বলে জানে, আর জীবনকে টাইম পাস।
সাইবার যুগ জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। ফুটে উঠছে নতুন নতুন অভিব্যক্তি। এই নতুন সময়কে কবিতায় লিখতে হবে। এটা সাইবার যুগের কবিতার দাবি।
কবিতার আকার, শব্দপ্রয়োগ
এক সময় মহাকাব্যের যুগ ছিল। ছিল বড় বড় কবিতা লেখার প্রচলন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কবিতার আকার ছোট হয়ে আসছে। শুধু কবিতা কেন? বলা হয় ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী।’ আমেরিকায় প্রথম যে কম্পিউটারটি বানানো হয়েছিলো তার আকার ছিল একটা ঘরের মতো। আর সেখানে যে লাইট ব্যবহার করা হয়েছিল তা দিয়ে নিউইয়র্ক শহর আলোকিত করা যেত। মাইক্রো চিপস্ আবিষ্কারের ফলে কম্পিউটার ছোট হতে হতে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কিন্তু কম্পিউটারের শক্তি অনেক বেড়েছে। এক সময় একটা বড় গ্রামোফোন রেকর্ডে একটা গান রেকর্ড করা হতো। ক্যাসেট প্লেয়ার এলে মানুষ অভিভূত হয়ে পড়লো। ছোট একটা ক্যাসেটে ১২/১৪টা গান শোনা যায় অনায়াসে। এখন একটা নখের আকৃতির মেমোরি কার্ডে ১২/১৩শ’ গান রেকর্ড করা যাচ্ছে। কিন্তু ওই বিশাল রেকর্ডের তুলনায় ক্ষুদ্র মেমোরি কার্ডের সাউন্ড কোয়ালিটি অনেক ভালো পাওয়া যাচ্ছে। কবিতার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সেরকমই হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন মানুষ আরো যান্ত্রিক হচ্ছে। মানুষের সময় কমে যাচ্ছে। এখন কবিতার আকার আরো ছোট হবে; কিন্তু তার গভীরতা অনেক বেড়ে যাবে। অল্প জায়গার মধ্যে কবিরা এখন অনেক কিছু দেবেন ওই মেমোরি কার্ডের মতো। কবিতার আকার ছোট হবে; কিন্তু কবিতা শক্তিশালী হবে ওই কম্পিউটারের মতো।
ছন্দের শৃঙ্খল নয়
ছন্দ বাংলা কবিতার একটা অনিবার্য অংশ হিসেবে শত শত বছর ধরে কবিতাকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে আছে। আমি ছন্দের ব্যবহার বন্ধ করার পক্ষপাতী নই। তবে নতুন দিনের কবিদের একটা সহজ সত্য মেনে নিতে হবে, সেটা হলো ‘কবিতার জন্য ছন্দ, ছন্দের জন্য কবিতা নয়।’ সেটা হলে সত্যেন্দ্রনাথ সবচে’ বড় কবি হতেন। প্রশ্ন আসতে পারে ছন্দ নিয়ে কথা কেন? ছন্দ নিয়ে কথা এই জন্য যে অক্ষরবৃত্ত আমাদের কবিতাকে একটা বৃত্তে আটকে ফেলেছে। ‘বেজোড়ে বেজোড় মিলাও, জোড়ে মিলাও জোড়’ এটা করতে গেলেই তিরিশের গন্ধ চলে আসে কবিতায়। যদি নতুন কিছু করতেই হয় তাহলে ছন্দ নিয়ে ভাবতে হবে। কবিতার বিশ্ব অঙ্গনে ছন্দের বিষয়টা এখন ফিকে হয়ে আসছে। আমরা নেটে যেয়ে যখন ল্যাটিন কবিতাগুলো পড়ি অথবা ভিয়েতনামের অথবা কেনিয়ার, তখন কিন্তু আমাদের মাথায় ছন্দের শৃঙ্খলের কথা থাকে না। কিন্তু যখনি একটা বাংলা কবিতা পড়ছি তখন এটা মাথায় নিয়ে শুরু করছি যে ছন্দটা ঠিকমতো অনুসরণ করা হলো কি না। আশির দশকে রিডার্স ডাইজেস্টে ইন্দোনেশিয়ার কবি ডাব্লিউ এস রেন্দ্রার ওপর একটা প্রতিবেদন পড়েছিলাম, সেখানে কিছু কবিতাও ছিল সেখানে একটা পঙ্ক্তি ছিল এরকম, ‘And as the day/takes form./Our questions will become a forest.’ অনুবাদে এরকম হয়, ‘এমন দিন আসছে, যখন আমাদের প্রশ্নগুলো একটা অরণ্যের রূপ নেবে।’ পঙ্ক্তিটি ৩০ বৎসর আমার মনের মধ্যে কাজ করছে। দেখুন এ ধরনের কবিতা আমরা যখন পড়ি তখন কিন্তু এর ছন্দ নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমরা যা পড়ি তা হচ্ছে কবিতা। পঙ্ক্তিটি ছোট; কিন্তু তার ব্যাপ্তি মহাকাব্যিক।
বাংলা কবিতার ছন্দের বিষয়টি কিন্তু খুব সহজ নয়। তরুণদের বিষয়টি নিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়। শুধু বেজোড়ে বেজোড় আর জোড়ে জোড় মিলানোই সব নয়। ‘য়’ ‘ই’ এগুলো অনেক সময় অক্ষর হিসেবে গণ্য হয় না। আবার হয়ও। তরুণরা ছন্দ নিয়ে বিপাকে পড়েন অনেকে হতাশ হন। আমি বলবো আপনারা কবিতা লিখুন, ছন্দ আস্তে আস্তে এসে যাবে। কেউ কেউ বলবেন, ‘ছন্দ ছাড়া কবিতা হয় নাকি?’ আর কোনো কোনো পণ্ডিত বলবেন, ‘আগে ছন্দ শেখো, তারপর ছন্দ ভাঙো।’ এসব কথা কোনোটিই সত্যি নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একেবারে গদ্য ছন্দে লিখেছেন ‘পৃথিবী’র মতো মহান কবিতা (সঞ্চয়িতা; পৃষ্ঠা-৭০৫; বিশ্বভারতী)। পরবর্তীতে অনেক বড় বড় কবিরাও গদ্য ছন্দে কবিতা লিখেছেন। কবি শামসের আনোয়ারের সব কবিতাই গদ্য ছন্দে লেখা (শামসের আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ কবিতা; দে’জ পাবলিশিং)। সম্প্রতি কবি মাসুদ খানের ‘দেহ অতিরিক্ত জ্বর’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ বেরিয়েছে ছোট কাগজ চৈতন্য থেকে। এই গ্রন্থের সব কবিতাই নিরেট গদ্য ছন্দে লেখা। বলার অপেক্ষা রাখে না শামসের আনোয়ার এবং মাসুদ খান দু’জনই উত্তীর্ণ কবি। তাদের জন্য বাংলা কবিতায় স্থান তৈরি হয়ে গেছে। সুতরাং ছন্দ ছাড়া কবিতা হয় না সেটা ঠিক নয়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার পদাতিক গ্রন্থে বাংলা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রারীতিতে যে বৈপ্লবিক বদল এনেছিলেন, তার জন্য বুদ্ধদেব বসু এবং প্রবোধচন্দ্র সেন অনেক প্রশংসা করেছিলেন। অথচ ছন্দের মাত্রারীতিতে যে পরিবর্তন তিনি এনেছিলেন, সেটা সচেতনভাবে করা হয়নি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্য অনুযায়ী তখন পর্যন্ত তিনি ছন্দ শিখেছেন বাড়ির পেছনে ধোপাদের কাপড় কাঁচার ছন্দ থেকে (সময়ের জলছবি; শঙ্খ ঘোষ, পৃষ্ঠা ৬৯/৭০; প্রকাশক: কবিতা পাক্ষিক) সুতরাং ছন্দ না শিখে ছন্দ ভাঙা যায় না এটা একটা মাস্টারিসুলভ কথা, যার কোনো ভিত্তি নেই।
প্রশ্ন আসতে পারে ছন্দের মধ্যে কীভাবে নতুনত্ব আনা যায়। স্বরবৃত্ত নিয়ে কিছু বলার নেই, এটা এখন ক্রম অপস্রিয়মান। কারণ, স্বরবৃত্ত ছন্দ সাইবার যুগে এসে মানুষের জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। তবে এখনো মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কখনো সখনো মানুষের জীবনে বেজে ওঠে। এক্ষেত্রে মিশ্র মাত্রাবৃত্তের চর্চা করা যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি ভাবা দরকার অক্ষরবৃত্ত নিয়ে। এটাই বাংলা কবিতায় সবচে’ চর্চিত একটি ছন্দ মাধ্যম। যা বাংলা কবিতাকে একটা বৃত্তে আটকে ফেলেছে। অক্ষর গোনাগুনির মধ্যে থাকলে এই বৃত্ত ভাঙা যাবে না। আমার মনে হয়, অক্ষরবৃত্ত আর গদ্য ছন্দের একটা মিশ্রণ করতে পারলে সেটা নতুন পথের দিশা দিতে পারে। যেখানে যুক্তাক্ষর বেশি সেখানে সচেতনভাবে মাত্রা কমিয়ে দেয়া যেতে পারে। আর ছন্দ মিলাতে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসা শব্দটি যদি বাদ পড়ে যায়, বা কবিতার মূল ভাব বিনষ্ট হয়, তাহলে জোর করে ছন্দ মিলানোর দরকার নেই। এভাবে অক্ষরবৃত্তের পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন ধোপাদের কাপড় কাচার শব্দ থেকে ছন্দ শিখেছেন, সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমান শ্রমিকদের ছাদ পেটানোর শব্দ থেকে সুর খুঁজে পেয়েছেন, আমাদের চার পাশ থেকে ছন্দ খুঁজে নিতে হবে। যা হতে পারে অতি গদ্যময় ছন্দ।
সবচে’ বড় কথা হচ্ছে─ আমাদের লিখতে হবে কবিতা, সেটা লিখতে গিয়ে যদি ছন্দ আসে, তাহলে আসবে। আর যদি ছন্দ না আসে তাহলে আসবে না। রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ যদি গদ্য ছন্দে লিখতে বলা হতো, তাহলে হয়তো তা কিছুই হতো না, ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা/কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।’ এই কবিতা যেমন গদ্যে লেখা সম্ভব নয়, তেমনি শামসের আনোয়ারের, ‘এইভাবে ঘোরে।/আঙুল ঘোরে আঙুলের চারি পাশে/চোখের মণি ঘোরে/ প্রোটন, ইলেকট্রন এবং নিউট্রনের চারিপাশে ঘুরে যায়।/ ভিখিরিরা ঘোরে ভিখিরিদের চারিপাশে।’ (অবিশ্রান্ত-মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে; পৃষ্ঠা-৩১) অক্ষর গুণতে গেলে এই কবিতা হতো না। কিন্তু লক্ষণীয় এখানে ছন্দের কোনো কমতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে গদ্য ছন্দ, এটাও একটা ছন্দ, যেখানে অক্ষর গোনাগুনি নেই। তবে শব্দের দ্যোতনা পরিমাপের বিষয়টি কবির মনের মধ্যেই থেকে যায়, যা লেখা হয় এবং এটা পড়তে যেয়ে পাঠক কখনোই হোঁচট খান না। পরিশেষে বলতে চাই যদি কবিতাটি ছন্দেই লেখার হয় তাহলে ছন্দে লিখুন, ছন্দে লেখার না হলে জোর করে ছন্দে লেখার প্রয়োজন নেই। শুধু ছন্দের শৃঙ্খল কেন, কবিতার জন্য কোনো শৃঙ্খলই কাম্য নয়।
কিছু পরিহারের চেষ্টা
উত্তরাধুনিক কবিতার চর্চাকারীরা কিছু বিষয় নির্দিষ্ট করে দেন, যেমন এটা লেখা যাবে, ওটা লেখা যাবে না। (উল্লেখ্য, ‘পোস্টমডার্ন শব্দাভিধান’, রুদ্র কিংশুক, কবিতা পাক্ষিক, কলকাতা অথবা ‘পোস্টমডার্ন বিড়ালের সন্ধানে’ সমীর রায় চৌধুরী ও রুদ্র কিংশুক, কবিতা পাক্ষিক কলকাতা) সাইবার যুগের কবিতায় তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। কারণ, কবিতা হচ্ছে কবির প্রচেষ্টাজাত স্বতঃস্ফূর্ত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। কোনো শর্ত দিয়ে কবিতা হয় না। তবে কবিতায় নতুন স্বাদ আনার জন্য কিছু কিছু বিষয় পরিহার করলে ভালো হয়, যেসব বিষয় প্রকরণ, শব্দ ভাব ভাষা বেশি ব্যবহার হয়েছে সেগুলোকে পরিহার করা। যেমন, ফুল, পাখি, প্রেম, জীবনানন্দীয় শব্দ─ পাখিদের, নদীদের, আমি অর্থাৎ উত্তম পুরুষ, তুমি অর্থাৎ দ্বিতীয় পুরুষ, বিভিন্ন মহাকাব্য, ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির চরিত্রের নাম, ইমেজ, বিষয়, এগুলোকে পরিহার করাই শ্রেয়। প্রশ্ন আসতে পারে এত কিছু বাদ দিলে কবি লিখবেটা কি? এই নিবন্ধের প্রথমে ‘কেন সাইবার যুগ’ পর্বে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিশ্বায়নের এইকালে পৃথিবী পরিণত হয়েছে একটা গ্রামে, ফলে এই বিশ্বায়ন, ইন্টারনেট, তথা স্যাটেলাইটকেন্দ্রিক যা কিছু আমাদের জীবনে এসেছে, তার সবই সাইবার যুগের বিষয়। শপিংমল, সুপার স্টোর, সিনেপ্লেক্স, ফুডপার্ক এসবই নতুন দিনের বিষয়। খুঁজলে এসব জায়গায় অনেক শব্দ ইমেজ পাওয়া যাবে। ৯০ দশকের গোড়ায় যশোর সাহিত্য পরিষদে এক আড্ডায় কবি একরাম আলি এক তরুণের কবিতায় ‘জোছনা’ শব্দটি ব্যবহারে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। তার মতে, জোছনা শব্দটি বেশি নরম এবং বেশি ব্যবহৃত বরং ‘জ্যোৎস্না’ শব্দটি কম ব্যবহৃত, পাঠকের অন্তরের মধ্যে গুঁতো মারার মতো একটা শক্তিশালী শব্দ। এরকম শব্দ ধরে ধরে দেখতে হবে কোনটা বেশি ব্যবহৃত, সেটা বদলে নতুন শব্দ খুঁজতে হবে। অর্থাৎ বিষয়, ছন্দ, প্রকরণ, শব্দ, এই সবকিছু নতুন করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই প্রচলিত কবিতার খোলস ছেড়ে নতুন রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসবে কবিতা।
নতুন কবিতা বলে কিছু হয় কি?
আমাদের রাজধানীর ধানমণ্ডি মোহাম্মদপুর এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে ’৯০-এর পর থেকে নতুন নতুন খাবারের দোকান হয়েই যাচ্ছে। বিশেষ করে ফাস্ট ফুডের দোকানগুলো। প্রথম দিকে সাধারণ বেকারিতে চিকেনপেটিস, কলিজা সিঙ্গারা, সামুচা, এরপর এল বিএফসি, আলবাইক, ইয়াম ইয়াম এর মতো আর একটু অগ্রসর দোকান, তারপর এল ইউরোপীয়ান চেইন শপ ‘হেলভেশিয়া’। এখানকার মুরগি ভাজার গন্ধে রাইফেলস চত্বর ম ম করে উঠল, সব তরুণরা ওই দিকে ছুটলো। সব শেষে এল উত্তর আমেরিকার চেইন শপ, কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন বা কেএফসি। তরুণরা এবার এদিকে ছুটল। কিন্তু ইতোমধ্যে যে দোকানগুলো চালু হয়েছিল তা কিন্তু বন্ধ হলো না। এখনো বেকারিতে তৈরি ফাস্ট ফুডের ক্রেতা আছে। এই সব দোকানের খাবার তৈরির উপকরণ উপাদান (Ingredient) মূলত একই। সেই চিকেন, আলু, ময়দা মসলা, সবজি প্রভৃতি। কিন্তু রেসিপি আর পরিবেশনার নতুনত্বে, খাবারের স্বাদ বদলে যেতে থাকলো। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, এ দেশীয় হাজির বিরিয়ানি, ফখরুদ্দীন, নান্না, ইউসুফ এগুলো ৬/৭ দশক পার করেছে। কিন্তু সমানভাবে জনপ্রিয় রয়ে গেছে। আমেরিকার কেএফসি ষাটের দশক থেকে চলে আসছে। যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলছে এবং জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সম্ভব হচ্ছে সেগুলোর স্বাদে একটা ধ্রুপদী ব্যাপার আছে। জেলা শহরগুলোতে কিছু কিছু মিষ্টির দোকান পাওয়া যাবে, যারা শত বৎসর ধরে লুচি আর লাবড়া খাইয়ে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এই পুরো ব্যাপারটাই ক্ল্যাসিক। ১৯৩৮ সালে হাজি তখনকার উপকরণ উপাদান দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে একটা ক্ল্যাসিক স্বাদ তৈরি করেছিলেন। এখনও নাকি সরিষার তেল দিয়ে হাজির বিরিয়ানি তৈরি হয়। ক’দিন আগে একটা এফএম রেডিওতে একজন তরুণী বললেন, ‘এখন আমরা মান্না দের কণ্ঠে একটি ক্লাসিক্যাল গান শুনবো। ‘তুমি কি সেই আগের মতো আছো’। এই গানগুলো তো আমরা স্বর্ণযুগের আধুনিক গান হিসেবে জানি। আর রাগাশ্রয়ী প্রাচীন গানগুলোকে ক্লাসিক্যাল গান বলে জানি। আমার সংশয় হলো, মেয়েটি কি ভুল করলো! খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, না, সে ভুল করেনি। ৬ রাগ ৩৬ রাগিনীনির্ভর প্রাচীনকালের গানগুলো সেকালের ক্ল্যাসিক। রবীন্দ্র, অতুল প্রসাদ, ডিএল রায় এবং নজরুলের বেশিরভাগ গান ঔপনিবেশিক যুগের ক্ল্যাসিক, আর মান্না দে, হেমন্ত, সতীনাথ, সন্ধ্যা, আরতি প্রভৃতিদের অনেক গানই স্বর্ণযুগের আধুনিক গানের মধ্যে ক্ল্যাসিক বা ধ্রুপদী। ধ্রুপদী তাই যে শিল্পকর্ম মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেয় এবং যার একটি চিরন্তন আবেদন তৈরি হয়। কবিতার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সেরকমই। কবিতার মূল লক্ষ্য ক্ল্যাসিক হয়ে ওঠা, সেটা যে সময়ের লেখা হোক না কেন। আধুনিক কবি বলতে প্রথমেই যার নাম আসে, তিনি টি এস এলিয়ট। অথচ এলিয়ট সাহেব নিজেই দাবি করেছেন, তিনি কবি হিসেবে ‘ক্ল্যাসিসিস্ট’ ও ব্যক্তি হিসেবে ‘রয়্যালিস্ট’। অর্থাৎ কবির মূল লক্ষ্য ধ্রুপদী কবিতা রচনা করা। সেটা হতে হবে তার সময়ের ধ্রুপদী। বিরিয়ানি এবং ফাস্ট ফুডের উপকরণ উপাদান যেমন প্রায় একই, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও। হাজার হাজার বছর আগেও কবিতার মূল উপাদান ছিল মানুষ, মানুষের সুখ-দুঃখ বেদনা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এখনও তাই আছে। যেমন মধ্যযুগের ইংরেজ কবি চসার বলেছিলেন নতুন ফ্যাশন বলে কিছু নেই। ফলে একেবারে নতুন কবিতা বলেও কিছু হয় না। যা হয় তা হলো প্রচলিত ধারার বাইরে যেয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা। কবিতার রেসিপিতে, পরিবেশনায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা। রোমান্টিক, আধুনিক, অধুনান্তিক, সাইবার যুগ, সবার লক্ষ্যই এক। তার তার সময়ের উপকরণ, উপাদান, ব্যবহার করে এমন কিছু সৃষ্টি করা, যা পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা তৈরি করে নিতে পারবে এবং যার আবেদন চিরন্তন হবে।
যাদের কবিতা বেশি বেশি পড়া দরকার
একজন কবি অথবা কবিতার পাঠককে সকলের কবিতাই পড়তে হবে। সেই সাথে ইতিহাস, ঐতিহ্য, নৃতত্ত্ব, সমাজ বিজ্ঞান সবই। সব কিছুর মধ্যেই কবিতার উপাদান আছে। তবে যারা কবিতায় নতুন কিছু খুঁজবেন তাদের জন্য ত্রিশের দশক থেকে পুরো বিশ শতকের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উল্লেখ করছি যাদের কবিতা বেশি বেশি পড়তে হবে। বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, হেমেন্দ্র বাগচি, অরুণ মিত্র, দিনেশ দাস, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আহসান হাবীব, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু, শহীদ কাদরী, আজীজুল হক, শঙ্খ ঘোষ, আলোক সরকার, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মানিক চক্রবর্তী, শামসের আনোয়ার, সাফদার সিদ্দিকী, রণজিৎ দাশ, অনন্য রায় (অকাল প্রয়াত), একরাম আলি, মৃদুল দাশ গুপ্ত, পার্থ প্রতীম কাঞ্জিলাল, গৌতম চৌধুরী, উজ্জ্বল সিংহ, সুতপা সেনগুপ্ত, বিশ্বজিৎ পাল, শ্রীজাত, জাফর সাদেক (অকাল প্রয়াত), ফরিদ কবির, মাসুদ খান, আবদুর রব, সাজ্জাদ শরিফ, জুয়েল মাজহার, ব্রাত্য রাইসু, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মজনু শাহ, নান্নু মাহবুব। শূন্য এবং এক এর দশকে বেশ কিছু সম্ভাবনাময় কবি এসেছেন; কিন্তু তাদের সম্পর্কে বলার সময় এখনো হয়নি।
স্বীকার করছি এটি পূর্ণাঙ্গ নয়। বাংলা কবিতা সারাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় লিখিত হয়। এখানে তিন বাংলা, অর্থাৎ বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরার কবিতের নাম এসেছে, সেটাও আমার পাঠের সীমার মধ্যে। হতে পারে এর বাইরে অনেক কবি রয়ে গেছেন, যারা শক্তিশালী এবং নিজের মতো করে কবিতায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন। প্রশ্ন আসতে পারে, জীবনানন্দ, শক্তি, শামসুর, সুনীল এবং আল মাহমুদের মতো বড় বড় শক্তিশালী কবির নাম কেন এখানে নেই। এদের কবিতা পড়া যাবে না, তা কিন্তু বলা হয়নি, এখানে যাদের কবিতা বেশি বেশি পড়া প্রয়োজন শুধু তাদের নাম এসেছে। যাদের কবিতা পড়লে নিমজ্জিত হওয়ার ভয় আছে আর যারা ‘জনপ্রিয়’ হওয়ার জন্য কবিতা লিখেছেন তাদের নাম এই তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত কবিরা সাইবার যুগের কবিও নন। শুধুমাত্র যে সব কবি তার সময়ে প্রচলিত ধারার বাইরে একটু আলাদা কিছু করার চেষ্টা করেছেন বা করছেন, শুধুমাত্র তাঁদের নামই এখানে এসেছে।
শেষ কথা বলে কিছু নেই
উপ্পালুরি গোপালা কৃষ্ণমূর্তি বা ইউ জী কৃষ্ণমূর্তি হলেন ২০ শতকের একজন আলোকিত মানুষ। তার জন্ম ১৯১৮ সালে ভারতে এবং মৃত্যু ২০০৭ সালে ইতালিতে। ইউ জীকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশেষ নতুন চিন্তার জনক। অদ্ভুত রোমাঞ্চকর এই লোকটি এমন কিছু নতুন কথা বলেছেন, যা নতুন দিনের কবিদের জন্য চিন্তার খোরাক হতে পারে। নেটে গেলে ইউ জীর ধারণাগুলো পাওয়া যায়; যা তিনি সাক্ষাৎকার আকারে বলে গেছেন। আমরা জেনে এসেছি মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু ইউ জী বলছেন মানুষ সৃষ্টির সবচে’ নিকৃষ্ট জীব। এমন কি একটা মশা, পিঁপড়ে, ডাঁশ পোকামাকড় সবই মানুষের থেকে উৎকৃষ্ট। মানুষও এক সময় উৎকৃষ্ট ছিল, কিন্তু যেদিন মানুষ চিন্তা করলো এবং আমিত্ব আবিষ্কার করলো সেদিন মানুষের পতন হলো। ‘এই রাজ্য আমার, এই বাড়িটি, গাড়িটি, এই সুন্দরী নারীটি ওই সুন্দর ছেলেটি আমার।’ এভাবে আমিত্ব অর্জন করতে গিয়ে মানুষ নিকৃষ্ট হয়ে গেল। খারাপ খারাপ কাজ শুরু করলো। জেরুজালেম নগরটিকে ৩টি ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের নিজেদের বলে দাবি করাতে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে কত নিরপরাধ লোক প্রাণ দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এই ধারাবাহিক রক্তপাতের যেন কোনো শেষ নেই। এখন যদি শুধু এই তিন ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকের মধ্য থেকে অমিত্বকে উঠিয়ে দেয়া যায় তাহলে এই রক্তপাত, মানবিক বিপর্যয় শেষ হয়ে যাবে। মানুষের বিপর্যয় শুরু হয়েছে সভ্যতার সূচনা হওয়ার সময় থেকে। মানুষ যদি আমিত্বকে ত্যাগ করে আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে পারে তাহলে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সেটা বোধ হয় আর সম্ভব নয়। তবে এর অনেকটাই অর্জন করা সম্ভব মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। যা হোক এই যে পৃথিবীর নিকৃষ্ট জীব ‘মানুষ’ সেই মানুষ নিয়েই কবিদের কারবার। বলার অপেক্ষা রাখে না কাজটি সহজ নয়। একটা সময় ছিল মানুষের সুন্দরকে, প্রকৃতির সুন্দরকে কবিতায় সুন্দরভাবে তুলে আনতে পারলেই তা উত্তীর্ণ কবিতা হয়ে যেত। কিন্তু সেই ১৯ শতকে বোদলেয়ার যখন নর্দমার মধ্যে যেয়ে কবিতা খোঁজা শুধু করেছেন, তখন সনাতন ধারণা বদলে যেতে শুরু করে এবং আধুনিক যুগের সূচনা হয়। ‘প্রকৃত পাপও চৈতন্যের ফল: তাই পাপকে তিনি প্রশ্রয় দেননি; কিন্তু শ্রদ্ধা করেছেন।’ (শার্ল বোদলেয়ার ও আধুনিক কবিতা, প্রবন্ধ সংকলন, বুদ্ধদেব বসু পৃষ্ঠা-১৮৫)
বিশ্ব কবিতায় কত জটিল জটিল বিষয় এসেছে কত আগে। আর আমরা যদি এখনো ফুল, পাখি, প্রেমপ্রীতি, নিসর্গ ঋতুচক্র নিয়ে কবিতা লিখি সেটা বোধ হয় সময়ের অপচয় হবে। যে ধারণা সময়ের সাথে বদলায় না, সে ধারণা বিষাক্ত হয়ে যায়। সাইবার যুগের কবিদের এই মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে, আজকে যে ধারণার উদ্ভব হচ্ছে, কালকে তা বদলে যেতে পারে। আমরা যদি কোনো ধারণায় স্থির হয়ে পড়ি, তাহলে সেটা বিষাক্ত হয়ে যাবে। কবিতায় শেষ কথা বলে কিছু নেই।
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল ২০১৫