দারা মাহমুদের গল্প: জীবন গাছ

দারা মাহমুদ

হাটের শেষ বাতিটা যখন নিবল তখন রাত বারটা। গ্রামদেশে বারটা মানে গভীর রাত। পুরো এলাকায় বিদঘুটে অন্ধকার, আর রাতের শব্দ। তারা পাঁচ দোকানি গল্প করতে করতে গ্রামের রাস্তা ধরল। গল্প আর কি! কার কিরকম বিক্রি বাট্টা হলো। এভাবে চললে দেশের কি হবে, অথবা সাকিব-অপুর প্রেম বিয়ে ঝগড়া এই সব। গ্রামের কাছাকাছি এসে আবদুল রশীদ প্রথমে প্রশ্ন তুলল, কালভার্টের ওপর তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না! ওরা প্রতিদিনই দেখে জীবন কালভার্টের ওপর বসে বিড়ি টানছে, টেনেই যাচ্ছে অদ্ভুত লোক জীবন আলি। গ্রামের সবচে গরিব, এক্কেবারে দিনমজুর। আধপাগল লোক হিসেবে চরণপুরের সবাই তাকে চেনে। সন্ধের পর থেকে রাত দু’তিনটা অবদী কালভার্টের ওপর বসে একা একা বিড়ি খায় আর বিলের ওপারে বাড়–লি গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজই ব্যতিক্রম দেখা গেল, কালভার্টের রেলিংয়ের ওপর কেউ নেই। কালভার্টের কাছাকাছি এসে হাটুরের দল যা দেখল তাতে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। রেলিং ঘেঁষে জীবন পড়ে আছে। আব্দুল মজিদ মোবাইলের আলো জ্বেলে নিশ্চিত হলো জীবনই এবং এটা নিশ্চিত হলো জীবনের দেহে প্রাণ নেই।
পাঁচজন হাটুরে, যারা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত, বাড়ি ফিরে দুটো মুখে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়বে, তাদের সামনে কি আপদ এসে হাজির হলো! একজন বলল, চল আমরা ফিরে যাই, আমরা কিছু দেখিনি।
আব্দুল খালেক বলল, দেখিনি বললেই হবে? গ্রামের সবাই জানে সোমবার হাটের দিন আমরা রাত করে ফিরি। এভাবে চলে গেলে আমাদের ঘাড়ে দোষ আসতে পারে। কাউন্সিলর কে ফোন দাও। আব্দুল মজিদ ফোন দিল। কাউন্সিলর রফিক গোলদার জানাল, সে শহরে গিয়ে ছিল চলে এসেছে প্রায়। দূরে মোটরসাইকেলের আলো দেখা গেল। কাউন্সিলর ও তার সাথে বডিগার্ড মহসিনকে দেখে হাটুরেরা জানে পানি পেল। কাউন্সিলর ঘাঘু লোক, মোটেই ভয় পেল না। চর্ট জ্বেলে অনেকক্ষণ জীবনের দেহ দেখল, তারপর বলল, কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, মনে হয় হার্টফেল করেছে। তোমরা হাত লাগাও, লাশটা কালভার্ট থেকে সরিয়ে রাস্তার পাশে রেখে চল আমরা যাই। সকালে এসে দেখা যাবে কি করা যায়।
কাউন্সিলরের সিদ্ধান্তে পাঁচ হাটুরের স্বস্তি হলো। এখন দায়দায়িত্ব সব কাউন্সিলরের। তবুও জীবন চাষি বলে কথা, গ্রামের প্রবীণ চাষি, একাকী ভালো মানুষ এবং দুখী মানুষ। উপস্থিত সাতজনেরই মনে কষ্ট হলো। সেই রাতে সাতজনই বাড়ি ফিরে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ওই রাতেই গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল জীবন চাষি মারা গেছে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে গ্রামের লোকজন এলজিইডি রাস্তার দিকে দৌঁড়াল। তারা যেভাবে গেছিল সেই ভাবেই ফিরে এল, মুহূর্তে গ্রাম মাথায় করে ফেলল, রাতের ওই সাতজনকেও ডেকে তোলা হলো। সেকি উত্তেজনা! কোনো লাশ নেই। একটা গাছ দেখা যাচ্ছে কালভার্টের পাশে। যে গাছ আগে কেউ কখনো দেখেনি।
রাতের সাতজনসহ পুরো গ্রাম ফের ছুটল এলজিইডি রাস্তার দিকে। কাউন্সিলর রফিক গোলদার গত রাতে লাশ দেখে ভয় পায়নি, কিন্তু আজ একটা গাছ দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। ঠিক যেখানে ওরা লাশটা রেখে গিয়েছিল সেখানে উঁচু লম্বা একটা সেগুনগাছ। রাতারাতি এত বড় গাছ হওয়া সম্ভব নয়, এমন কি ত্রিশ চল্লিশ বছরেও সম্ভব নয়। এরকম একটা গাছ হতে ৫০/৬০ বছর সময় লাগবে। রফিক সরকারি দলের লোক। সে এমপিকে ফোন করলেন, দলের নেতাদের ফোন করলেন, থানায় ফোন করলেন, সাংবাদিকদের ফোন করলেন না। কিন্তু সাংবাদিকরাই এলো আগে। তারা গাছের ছবি তুলতে লাগল। একটা চ্যানেলের মেয়ে সাংবাদিক লোকজনের সাক্ষাৎকার নিতে লাগল। আব্দুল রশিদ ক্যামেরার সামনে ব্যা ব্যা করতে থাকল। কাউন্সিলরের লোক তাকে সরিয়ে কাউন্সিলরকে দাঁড় করাল। কাউন্সিলর রসিয়ে রসিয়ে ঘটনার বর্ণাটা দিতে লাগল। আশপাশের দশ গ্রামের লোক জড়ো হলো। শুধু বাড়–লি গ্রামের ইজিবাইক চালক মামুন ও তার স্ত্রী ময়মুনাকে কোথাও দেখা গেল না।
কাউন্সিলর গাছ দেখে ভয় পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এখন সামলে উঠেছে। রাজনীতিকদের সবকিছু থেকেই ফায়দা ওঠানো দরকার। কাউন্সিলরের টাকায় একটা টিউবওয়েল বসল। দোকান বসে গেল কয়েকটা, চা সিগারেট বিড়ি, পান, বিস্কুট, চিপস সবই মিলতে লাগল। যেন একটা মেলা বসে গেছে। এই অবস্থা চলল সাতদিন। এরপর লোক আসা কমে গেল। এর মধ্যে খবরের কাগজে জীবন গাছের ছবিসহ নিউজ ছাপা হয়েছে। টিভি চ্যানেলেও দেখিয়েছে, তবে তা খুব কম গ্রামবাসীর কপালে জুটেছে। কারণ সব বাড়িতে তো আর ডিশলাইন নেই। আর যাদের আছে তারাও দেখতে পারিনি। যখন খবরটা দেখাচ্ছিল তখন স্টার জলসায় ‘পটল কুমার গানঅলা’ সিরিয়াল চলছিল। দিন সাতেক পর গাছটা নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমে গেল। মাস খানেক পর মানুষ আসা একেবারেই কমে গেল। মাঝেমধ্যে শহর থেকে ঢাকা থেকে চকচকে গাড়ি করে কিছু লোক আসে অ™ভুত গাছ দেখার জন্য। কাউন্সিলরের বাড়িতে তাদের খাওয়ার আয়োজন হয়। তারা গ্রাম ঘুরে গাছের ছবি তুলে ফিরে যায়। আস্তে আস্তে মানুষ সব ভুলতে শুরু করল। শুধু মায়েরা শিশুদের খেলতে যাওয়ার সময় বলে দেয়, খবরদার জীবন গাছের কাছে যাবি না।
জীবন চাষির পূর্ব-পুরুষ সম্পন্ন ছিল। জীবনের বাবা মোতালেব আলি অকর্মণ্য ছিলেন। সবকিছু বেচে যখন তিনি গত হন, তখন জীবনের বয়স পনের। দু’জন বড় বোন ছিল, বিয়ের পর দু’জনই মারা গেছেন। একজন ফুরাডান খেয়ে, অন্যজনকে নাকি স্বামী গলাটিপে মেরে ফেলে, যৌতুক না পেয়ে। পিতৃ-মাতৃহীন জীবন ডাক্তার বাড়িতে রাখালের কাজ পায়। এরপর সে কৃষি শ্রমিক হিসেবে খ্যাতি পায়। জীবনের পারিশ্রমিক সব সময় অন্যদের থেকে একটু বেশি ছিল কারণ সে একাই দেড়জনের কাজ করতে পারত। একদিন জীবন ৫ গ্রাম দূরের বদনপুর থেকে মায়মুনা নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনে, মায়মুনাও গরিব ঘরের মেয়ে কিন্তু বেশ সুন্দরী। দু’জনের মিল ছিল খুব। গ্রামের লোকেরা সুখী দম্পতি বলেই জানত। কিন্তু বছর খানেক পর হঠাৎ একদিন মায়মুনা বাডুলি গ্রামের টেম্পোচালক মামুনের সাথে চলে গেল। জীবন সব জেনে একেবারে চুপ হয়ে গেল। মামুন ছিল জীবনের দূর সম্পর্কের ভাগ্নে। বিয়ের সময় জীবন কিছু টাকা ধার করেছিল মামুনের কাছ থেকে। সেই সূত্রে মামুনের আসা-যাওয়া ছিল। জীবন একটা সময় ধার শোধ করে দিয়েছিল। কিন্তু মামুনের যাতায়াত বন্ধ হয়নি। তারপর একদিন…

গ্রাম একটা অদ্ভুত জায়গা, সব কিছুরই একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা তৈরি করে নেয়। একদিন বাজারের চা খেতে খেতে ইয়াকুব চাষি বলে ফেলল, জীবনের আসলে ‘পাওয়ার’ নেই। কেউ কেউ দ্বিমত করল, তার জবাবে ইয়াকুব বলল, পাওয়ার থাকলি কি বউ চলে যায়! আমি বিয়ে করেছি সাত বছর বউ গেছে? বল, বল। মোবাইল দোকানি হায়দার বলল, এত বড় করে বলো না গো, যেদিন বাড়ি যেয়ে দেখবা… অবশ্য তোমার বৌয়ের যা চেহারা… যা হোক কোনো রকম সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই জীবন পাওয়ার লেস হয়ে গেল। জীবনও এসব কথার প্রতিবাদ করল না। বিশেষ করে জীবন যখন আবার সংসারী হলো না তখন গ্রামের লোক ধরে নিল ইয়াকুবের কথাই ঠিক। জীবন সন্ধ্যার পর যেয়ে এলজিইডি রাস্তার কালভার্টের ওপর বসে গভীর রাত অবদী বাড়–লি গ্রামের দিকে তাকিয়ে বিড়ি ফুঁকত। সমবয়সীরা কেউ কেউ ঠাট্টা করার চেষ্টা করেছে। কি জীবন, মায়মুনা ফিরে আসে কি না সে জন্য পথ চেয়ে আছো?

জীবন কোনো পাত্তা দেয় না। বলে, বৃষ্টির ভাব ভালো না গো। এবার ধান ভালো হবে না, দেখো।

গ্রামের কেউ মারা গেলে, অথবা বড় কোনো ঘটনা ঘটলে অথবা ঝড় বৃষ্টির রাতে জীবনকে কালভার্টে দেখা যেত না। আর সবদিন এমনকি মাঘের হাড় কাঁপানো শীতেও জীবনকে বিড়িরত অবস্থায় দেখা যেত। যে বার বাঁধ ভেঙে গেল, গভীর রাতে গ্রামের মানুষ ঘটনাস্থলে যেয়ে দেখল একটা লোক একাই বাঁধ রক্ষায় চেষ্টা করে যাচ্ছে। কাছে যেয়ে দেখা গেল জীবন চাষি। জীবন এরকমই ছিল। গ্রামের কারো বিপদ হলে আগে পৌঁছাত জীবন। এ জন্য জীবন যেসব পাগলামো করত তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতো গ্রামের মানুষ। আর জীবনের একটা হবি ছিল গাছ লাগানো। রাস্তার পাশে নিজ খরচে নিজ শ্রমে গাছ লাগাতো ও। ওই একাকী লোকটাকে চরণপুরের আধিবাসীরা ভালোবাসত। আহা সেই জীবন আজ গাছ হয়ে গেল।
॥ দুই ॥
গ্রাম তো আর আগের গ্রাম নেই। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা এলজিইডির রাস্তা হয়েছে। ৪ মাইল পথ পেরুতে বর্ষাকালে একবেলা সময় লাগত। সেই পথ এখন গ্রামের যুবারা ১৫ মিনিটে চলে যাচ্ছে মোটরসাইকেলে। ইলেক্ট্রিসিটি এসেছে। ঘরে ঘরে রঙিন টিভি, ডিশ চলছে। হাতে হাতে সেলুলার ফোন, ইন্টারনেট চলছে। গ্রাম জীবন নিস্তরঙ্গ নেই। প্রচণ্ড গতিশীল। এই জীবনস্রোতে কোনো কিছুই আটকে থাকে না। লোকজন জীবন ও জীবন গাছের কথা ভুলতে বসেছে। গ্রামের শিশুরা ওই গাছে ওঠে, ডালও ভাঙে, কিছুই হয় না। গাছটা যেন এই গ্রামেরই গাছ হয়ে উঠেছে। এরকম সময় এক সোমবার গভীর রাতে সেই পাঁচ হাটুরে দোকানের ঝাপ বন্ধ করে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরছিল। এবারো সেই রশিদ দোকানির চোখেই প্রথমে এল। সে চিৎকার করে উঠল। জীবন গাছ নেই। সবাই আঁৎকে উঠল। তাই তো জীবন গাছ নেই। নেই তো নেই-ই।
পাঁচ দোকানি। গ্রামের সহজ সরল পাঁচজন ছা পোষা, নিঃস্তব্দ মধ্যরাতে হতভম্ব হয়ে গেল। আব্দুল মজিদ মোবাইলের টর্চ জ্বালাল। দেখা গেল যেখানে গাছটা ছিল ঠিক সেখানে একটা মানুষের কঙ্কাল পড়ে আছে। যেন সবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পাঁচ হাটুরে এখন কি করবে? হাসবে না কাঁদবে না ভয় পাবে বুঝে উঠতে পারছিল না। অবশেষে চেয়ারম্যানকে ফোন দেয়া হলো। সেই কাউন্সিলর রফিক গোলদার এখন চেয়ারম্যান। রফিক এলেন সাথে দুই মোটরসাইকেল সাঙ্গপাঙ্গ। রফিক সব দেখে শুনে যে রায় ঘোষণা করলেন, তাতে সবাই খুশি হতে পারল না। বিশেষ করে পাঁচ হাটুরে। কারণ তারা ক্লান্ত শ্রান্ত ছিল। রফিক বললেন, এই কঙ্কাল এখানে রেখে যাওয়া যাবে না। তোমাদের একটু কষ্ট হবে, কিন্তু রাতের মধ্যেই দাফনের কাজ শেষ করতে হবে। এভাবেই চরণপুর গ্রামের একটা পরিবার একটা জীবন ও একটা জীবন গাছের পরিসমাপ্তি ঘটল। সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। শুধু ওই পাঁচ হাটুরে গভীর রাতে ফেরার সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছে একটু জোরে জোরে গল্প করে, অথবা গলা চড়িয়ে গান করে। যদিও আর অস্বাভাবিক কিছুই দেখা যায়নি। ০০
Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top