বরফের বই
মানুষকে বৃত্তাকারে মেপে দেখছে রাষ্ট্র
আইন শুঁকে দেখছে ইতিহাস
ক্ষমতা এক দুর্বোধ্য ইথার
সভ্যতার অগ্রগতি বিকল্প ট্রাজেডি
শক্তি যার সেই বাঁচে বিরুদ্ধ বাতাসে
এ চিন্তা উসকে দেয় শোষণের দার্শনিকতা
লাঠির বদলে লাড্ডু পছন্দ না কার
ভগবান অস্ত গেছে নিৎসে বার্তা পাঠালেন
মানুষের ভবিষ্যৎ বারুদের স্রোতে বৃশ্চিক
মঙ্গলের কাজে বাদ সাধে অপুত্রক গ্রহ
মানুষ রোবট হবে না কোনোদিন
কাফকার ভবঘুরে নায়ক জানবে না কেন তার ফাঁসি
নিরপরাধী ধরার জন্যে বিচারক পথে ঘাটে ঘোরে
সত্য উৎপাদন করে ক্ষমতার নৃমুণ্ডুশিকারী
প্রত্যেকের ফোনালাপ শুনছে শকুনী
সার্ভারে তাকিয়ে আছে শতচোখে ধূর্ত আর্গাস
মিডিয়া মিলিয়ে গেছে কাকজ্যোৎস্নায়
জিন বিশ্লেষণ আর জিনম সিকোয়েন্স বোঝে ধৃতরাষ্ট্রগণ
সমাজ না মানলে সে তো প্রমত্ত পাগল
যে স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব মানে সে নাকি প্রেমিক
সেবালয়ে রোগী নয় পা আকাশে
শুয়ে আছে সংক্রামক দল
উঁচুদের আচরণ ও আকাঙ্খা থেকে
উঁকি দেয় লক্ষ শুঁয়োপোকা
মারণাস্ত্র বানাতে বিজ্ঞানী হাতে পায় চাঁদ
আর মানুষ রক্ষা প্রণোদনা শূন্যগর্ভ বুলি
আধুনিক যুক্তি থেকে জন্ম নেয় কোটি কোটি ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন
যে পৃথিবী প্রতিদিন দেখি
তাতো মানুষের আঁকা উৎসব
ইতিহাস বলে কিছু নেই
সব ভাষা পৃথিবীর বিদ্যালয়ে বরফের বই
এ জন্যে প্রতিষ্ঠান গাদা গাদা গাধাদের
খেতে দেয় পোষা পাঠ্যক্রম
ক্ষমতার ইঙ্গিতে বদলে যায় প্রভুর আদল
জাতিসংঘের অধীনে জগতের জানালারা চোখ
মেলে না কখনো
সময়ের দখল নেয় পাশ্চাত্যের শুল্ক ঘড়িগুলো
সব সত্যের অলিখিত ইতিহাস থাকে
সব সত্যই নক্ষত্রের ধূ ধূ আলোড়ন
সত্ত্বঃ রজঃ তমঃ ত্রিগুণাত্মিকা
তিনগুণে ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব অসীম
প্রাণ সৃষ্টির আড়ালে কী অভিসন্ধি সমুদ্রের
মানুষের অনুভবে অতীত বর্তমান দীর্ঘ ছায়াপথ
পৃথিবীর সব ট্রয়যুদ্ধে সেনাপতিদের ট্রাজেডিই প্রিয়
মানুষ তার অবদমিত ইচ্ছার গোপন কৃতদাস
বাতাসের ঘর
কীভাবে যে দিন যায় রাত্রি চলে আসে,
আতঙ্ক কবলিত ভীত ক্যানভাসে।
সন্দেহ অধ্যুষিত চম্পক নগরে,
সর্বনাশ হানা দেয় বাতাসের ঘরে।
মৃত্যুদূত-হেডিসের পাতাল পুরীতে,
গিয়েছে প্রয়াতদের সংবাদ দিতে।
অদৃশ্য অণুজীব মেডুসা কি ফের
জন্ম নিয়ে ছিঁড়ে খাবে কণ্ঠ জোসেফের?
অভিধান ছিন্ন ক’রে আশা গেছে চাঁদে,
নির্মম মৃত্যু দেখে গ্রন্থেরা কাঁদে।
শবযাত্রার গাড়ি নৈঃশব্দ কাঁধে,
বধ্যভূমিতে গেলে অশ্রু বাদ সাধে।
ভবিষ্যৎ-অবরুদ্ধ প্রার্থনাগার,
কে কোথায় অস্ত যাবে ইচ্ছা ব্রহ্মার।
ন্যুয়র্ক প্যারিস রোম পিকিং হ্যানয়,
স্বেচ্ছা নির্বাসনে কেউ কারো নয়।
বিজ্ঞান ব্যর্থ হলে কে কাকে বাঁচায়,
বাড়ির বিমান ভেঙে পায়ে হাঁটতে চায়।
আঙুলে আকাশ পেলে অন্য দাবি নেই,
করোনা উড়িয়ে নেবে কাল বোশোখেই।
নোঙর
চোখে দিগন্ত নিয়ে যে মেয়েটি জানালায়
তাকে আগে দেখিনি কখনো
শুনেছি তার ভ্রুর ঈগল
তার কথা শুনিনি কোনো পড়শির মুখে
অদৃশ্য থেকে আসে সান্ধ্যভাষা
বাঁকানো গ্রীবার সৌন্দর্য দেখিনি
চিবুকের ঈশানে তীব্র অগ্নিপরীক্ষা
দেখিনি চোখের চূড়ায় বাষ্প
শুনেছি ক্রূশের চাপে দুমড়ে যাওয়া হৃদয়
আর মোমবাতির জমাট বাঁধা সাদা বারুদ
কপালের কপিলাবস্তু
পড়িনি তার পদধ্বনি
দেখেছি আত্মার নৈঋতে হৃৎপিণ্ডের ঘণ্টা
প্রান্তরে ভেসে যেতে সবুজ ব্যবধান
জানালা থেকে সে কখনো মুখ না সরাক
বিকেলের প্রতিরোধে ফিরে যাক সন্ধ্যা
কোনো হুইসেল ছেড়ে না যাক অজানায়
প্রতিধ্বনি জোড়া দেয়া স্বপ্নের সেতু অসমাপ্ত থাক
মমির বিস্ময় ছিঁড়ে বেরিয়ে আসুক অতীত
কেন কেবলই আত্মাহুতির কক্ষপথে
হানা দেয় ওর গ্রহ
আর দিন-রাত্রির উৎস খুঁজতে
চোখ প্রদক্ষিণ করে ভবিষ্যৎ
মেয়েটি কোনো অমীমাংসিত নগরের বাসিন্দা নয়
কিংবা কোনো বিষাদমাখা অনুপস্থিতি
ওর জানালার মুহূর্তে লেপ্টে আছে অশ্বক্ষুর
হয়তো কোনোদিন জানা হবে না নাম
পছন্দের খাদ্য তালিকা
কোন ফুলের সে প্রজাপতি
কেনো গাঙচিলের ডানার আঘাত তাকে ভেঙে ফেলে
আবার ফিরিয়ে আনে বর্তমানে
কোন দোয়েলের শিষে চমকে ওঠে ওর জানালা
ঘোর শ্রাবণের আশ্বাসে সে মেঘ
তাকে ধমক দেয় কোন বজ্রপাত
পিতাকে প্রহরীরা স্বর্গে নিয়েছে কোন প্রহরে
মা ভাইয়ের অপেক্ষায় মাছ বুনেছে উঠোনে
দীর্ঘ চুম্বনের চিতায় সে দাউদাউ
কোন শহর সিংহের গর্জনে সে অরণ্য
সে কি দেখেনি চোখ বাঁধা বন্দী কবিতা
দূরে কমলা বনে কাকের অমঙ্গল
দিগন্তে পেঁচিয়ে ওঠা ছায়ানাগের শীর্ষ
স্মৃতির উপকূলে আছড়ে পড়ে কোন নোঙর
যেখানে বারবার ফিরে আসে ফেনার রাজ্য
ওর পলক কখনো অস্ত যায় না
যতক্ষণ না চোখ থেকে খসে পড়ে অকাল বৈশাখ
পরিব্রাজক
বিস্ময়কে পরাজিত করেছে যে মৃত্যু
বাতাসে ভেসে আসা সাদা কাফনে মোড়ানো মৃত্যু
আমাদের হৃদয় এখন তাদের সমাধিক্ষেত্র
তালি দেয়া পথে পদচিহ্ন খুঁজে কি লাভ
নিজেদেরই মেরুদণ্ড যাদের পথ
বাতাসও হাঁটতে ভয় পায় যেখানে
শেষ আশ্রয় ঘরবাড়ি দরোজা জানলা
প্রাতঃ ভ্রমণ থেকে আর ফিরতে পারেনি
শ্বাসতন্ত্র বিকল করা সেই পথে
বিস্ময় কাঁধে হাঁটছে পৃথিবী
আর মানুষ কখনো প্রণয় দূর্গের চূড়ায়
কখনো আত্মার সেতুর উপর দাঁড়িয়ে
দেখছে অপরাহ্নের দেশ
তারা ভুলে গেছে কীভাবে বাতাস পিষে
বের করতে হয় অম্লজান
কী কৌশলে প্রতি সৌরবর্ষে
বদলে নিতে হয় চোখ দুটো
শুকিয়ে যাওয়া আকাঙ্ক্ষা পাঠাতে হয় নির্বাসনে
কৈশোরে কর্জ্জ করা প্রজাপতি পরিশোধ
করতে হয় বধ্যভূমিকে
করতল থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয় শঙ্খচিল
যে দেশ তার সন্তানদের দিয়েছিলো স্বপ্নের প্রমোদ তরী
আজ তা’ অভিশপ্ত মেফিস্টোফেলিস
আরব্য জিনদের গল্পের গোলকধাঁধা
ন্যায্যমূল্যের শিশির
ছেঁড়া রুটির আকাশ
আর জীবনের অনির্দিষ্ট বই
প্রতিটি পৃষ্ঠার তীরে একচক্ষু সাইক্লোপস
খুলে নিচ্ছে কর্মজীবী বৃক্ষদের মাথা থেকে পাতার বিনুণী
সম্পূর্ণ নগ্ন কিশলয়
তাদের শ্রোণীর শৈবালে আটকে আছে সময়
কোথাও কোনো ভবিষ্যৎ নেই-অতীতও না
সব দীর্ঘ বর্তমান
সময় দু’বার মুখ খোলে প্রেমে ও সঙ্কটে
বলে দেয় প্রকৃত প্রেম মৃত্যু নয় আত্ম-অন্বেষণ
ঘুম মৃত্যুর সমরূপ নিঃস্তব্ধ আগামী
মৃতদের মেঘআত্মা ভেসে বেড়ায় আকাশে-আকাশে
তবু জীবনকে ভালোবাসলে চোখে চাঁদ ওঠে
জন্মের গন্ধ নাকে এসে লাগে
তখন স্বপ্ন দ্বিতীয় জীবন ফিরে পায়
আমাদের ভেতরের শিশুরা ভিড় করে দাঁড়ায়
তাদের সমানে পোশাকের মূল্য কি
মৃত্যুরই-বা কি অর্থ
মানুষের এই বিপন্নতা দেখুক বৃক্ষ-নদী
পাখি ও পর্বত
অনুতাপ সবাইকে ক্ষমার যোগ্য করে দিক
এবং কান্না পবিত্র
প্রার্থনার পথে নীরবতা অনিবার্য উত্তর
ঐতিহাসিক অভিযানে আমরা দন কিহোতির হাওয়াকল
প্রত্যেকের নিজস্ব ঈশ্বর কান পেতে
জন্ম-মৃত্যুর পদধ্বনি শোনে
আমরা প্রত্যেকে আত্মার পরিব্রাজক
অস্তত্বিবাদ
র্স্বগ আর পৃথবিী মলিতি হয় ঝড়রে মাধ্যমে
সে প্রমত্ত মলিন ধ্বংস করে শতাব্দীর জ্যষ্ঠে বৃক্ষদল
প্লাবতি হতে পারে মাইল মাইল শূন্যতা
জগতরে উপসংহার
বজ্রপাত ঈশ্বররে সাবধান বাণী
সুমহান যোব যমেন শুনছেলিনে স্রষ্টার ভ্রূণরে আওয়াজ
প্রতটিি পরর্বিতন খুলে দয়ে জীবনরে অলৌককি স্বর
মৃত্যুর আগ মুর্হূতে আমরা জানতে পারি
সত্যকিার অস্তিত্ব আমাদের
এবং তখনই জন্ম নেয় র্স্বগ ও নরক
রেজাউদ্দিন স্টালিন
রেজাউদ্দিন স্টালিন (জন্ম ২২শে নভেম্বর, ১৯৬২) কবি, লেখক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তিনি আশির দশকের অগ্রগণ্য ও সফল কবি হিসেবে বিবেচিত। তার রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশটি। কবিতায় অবদানের জন্য তিনি ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: “পূর্ণ্যপ্রাণ যাবে”-১৯৮৩ সাল, “দাঁড়াও পথিকবর”-১৯৮৬ সাল (একটি যৌথ প্রকাশনা), “ফিরিনি অবাধ্য আমি”-১৯৮৫, “ভেঙে আনো ভিতরে অন্তরে”-১৯৮৭, “সেইসব ছদ্মবেশ”-১৯৮৯, “আঙ্গুলের জন্য দ্বৈরথ”-১৯৯২, “আশ্বর্য আয়নাগুলো”-১৯৯২, “ওরা আমাকে খুঁজছিল”-১৯৯৭, “সম্ভাবনার নিচে”-১৯৯৬, “পৃথিবীতে ভোর থেকে দেখিনি কখনো”-১৯৯৭, “আশীর্বাদ করি আমার দুঃসময়কে”-১৯৯৮, “হিংস্র নৈশভোজ”-১৯৯৯, “আমি পৃথিবীর দিকে আসছি”-২০০০, “লোকগুলো সব চেনা”-২০০১, “নিরপেক্ষতার প্রশ্ন”-২০০২, “পদশব্দ শোন আমার কন্ঠস্বর”-২০০৩, “পুনরুত্থান পর্ব”-২০০৪, “অবিশ্রুত বর্তমান”-২০০৫, “মুহুর্তের মহাকাব্য”-২০০৬ সাল, “অনির্দিষ্ট দীর্ঘশ্বাস”-২০০৮, “ভাঙা দালানের স্বরলিপি” ২০০৯, “কেউ আমাকে গ্রহণ করেনি”-২০০৯ সাল। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, উড়িয়া, রুশ, জার্মান, চীনা, জাপানী ও ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
রেজাউদ্দিন স্টালিন দীর্ঘদিন নজরুল ইনস্টিটিউটের উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন।