রেজাউদ্দিন স্টালিনের তিনটি কবিতা

পাথরের জবান
দরোজার গ্রন্থি খুলে একদিন
সাঁই সাঁই  বাতাস ঢুকে পড়বে
আর পাথরের জবান খুলে যাবে
স্যাঁত স্যেঁতে কথার ভেতর থেকে
উড়ে আসবে কবুতর
আঙুল দিগন্তের বুক চিরে দিলে
আকাশে রঙধনু উঠবে
অদৃশ্য চাবিতে কারাগারের
দরোজা খুলে বেরিয়ে
আসবে নিরপরাধীরা
কৃষকের পায়ের মানচিত্র চিৎকার
করে জানিয়ে দেবে শস্যক্ষেত্রে লুকানো গুপ্তধন
শূন্যতাকে ভোট দিলে
চৌকাঠের চিমনি ভরে উঠবে স্ফুলিঙ্গে
পুঞ্জ পুঞ্জ চিরুনির আক্রোশ
আঁচড়ে দেবে এলোমেলো ঘুম
প্রশাসনের পোষা সোড়িয়ামগুলো
একদিন চিনিয়ে দেবে প্রকৃত
হত্যাকারীকে
অপরাধের বিচার করতে বিদ্যুতের
চাবুক পাঠাবে আকাশ
ভূমিহীনদের বুঝিয়ে দেবে প্রান্তর
আর  করতালিতে ডুবে যাবে  দলিলের কব্জি
কাগজের গীর্জাগুলো পাঠ করবে
বৃষ্টির স্তোত্র
পাগল নদীর পায়ের শেকল খুলে যাবে
দরোজার তলায় এসে দাঁড়াবে
মহীসোপান
পদক্ষেপের নিচে চমকে উঠবে
প্যারাফিনের  মরুভূমি
প্রতিধ্বনির পাঁজর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে হাজার হাজার ঘোড়া
আর বজ্রের জিন পরিয়ে দেবে ফেরেশতারা
দারিদ্র্য রেখার নিচে প্রবাহিত হবে
রুদ্র রেলপথ
আর হাতুড়ির আনন্দাশ্রু গড়িয়ে
পড়বে সংবিধানের শেকড়ে
দুগ্ধপোষ্য শিশুর সাথে চুক্তি করবে
প্রেসনোটের স্তন
ক্রসফায়ারের সৎকার হবে সম্মুখ সমরে
 বিতাড়িতদের বাড়িতে পুনর্বাসনপ্লেটে
 সাজিয়ে দেয়া হবে  প্রাতরাশ
জানালার শিৎকারে জেগে উঠবে ফুটপাত
ইস্পাতের অলিভ সাজানো থাকবে
নৈশভোজে
বেহুশ বধ্যভূমিতে ফুটবে চিলেকোঠা
মরচেপড়া মানুষ লবণস্নান করবে
আর ব্লেডের বাড়ির মধ্যে
গড়ে তুলবে প্রতিরোধ

অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত

প্রথম পাঠের বর্ণগুলো হানা দিচ্ছে
অ- তে অজগর কানের কাছে
ফোঁস-ফোঁস করে
আর ঈ- এর ঈগল এসে ছোঁ মেরে
নিয়ে যায়
ঋ-বর্ণটি সবাইকে ঋষি বানাতে ব্যস্ত
কিন্তু ক-সমস্ত শক্তি দিয়ে
কবি হওয়ার মন্ত্র দেয়

গ-বলছে সমাজে বাঁচতে হলে
সব ছেড়ে ছুঁড়ে গাধা হও
সর্বংসহা হও,টু -শব্দ করো না
নত হতে শেখো
কিন্তু ঘ-যারপরনাই ক্ষ্যাপাটে
সে ঘাড় মটকে দিতে চায়
কাপুরুষ বলে

দ -দেয়ালের জামা পরিয়ে দেয়
বাড়ির গায়ে আর
ফ-সব ছিঁড়ে ফাঁক করে দিলে
সূর্য ঢুকে পড়ে
ট- খুব টানাটানিতে ওস্তাদ
বাড়িটির জরায়ু টেনে লম্বা করে ব্রহ্মাণ্ড অবধি
দ্যাখো কাকে বলে অসীম শূন্যতা

বরাবরের মতোই ঠ সিগারেটের মাথায় আগ্নেয়গিরি নিয়ে বসে থাকে
উচ্চারিত হবার সুযোগ বঞ্চিতদের মন্ত্র দেয় ঐক্যবদ্ধ হতে
স-স্বাধীনচেতা-হাতে তাঁর
এ কে ফরটিসেভেন – দিগন্ত ফুটো করে দেবে
সে মুহূর্ত পরমতসহিষ্ণু ভ-খৃস্টের নামে
ভালোবাসার স্তনের চাপে অস্ত্র
ভেঙে গুড়ো করে দেয়

ঘাসমানুষ
আমার ভ্রুর মধ্যে একটা শীতকাল
চোখের মধ্যে নিরবতার তাঁবু
 বুক বরফের পম্পেই
শীতবস্ত্রের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ঘাসমানুষ
 উষ্ণতা  অধরা পণ্য
হাজার হাজার আলোর কণা জোড়া
দেয়া এক সেতু
জুডাস  যিশুর কপালে চুমু দিলে যেটুকু উষ্ণতা  তার চেয়ে
বেশি কিছু নয়
আমরা বাঁচি সব ঋতুর অপেক্ষায়
 আর ভাবি অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে
আমরা অতীতে নেই
থাকবো না ভবিষ্যতে
তবু প্রতিটি শীতের জন্য প্রস্তুতি নিই
জানি না আমরা সাহসী না কাপুরুষ

 

রেজাউদ্দিন স্টালিন

রেজাউদ্দিন স্টালিন (জন্ম ২২শে নভেম্বর, ১৯৬২) কবি, লেখক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তিনি আশির দশকের অগ্রগণ্য ও সফল কবি হিসেবে বিবেচিত। তার রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশটি। কবিতায় অবদানের জন্য তিনি ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

রেজাউদ্দিন স্টালিনের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: “পূর্ণ্যপ্রাণ যাবে”-১৯৮৩ সাল, “দাঁড়াও পথিকবর”-১৯৮৬ সাল (একটি যৌথ প্রকাশনা), “ফিরিনি অবাধ্য আমি”-১৯৮৫, “ভেঙে আনো ভিতরে অন্তরে”-১৯৮৭, “সেইসব ছদ্মবেশ”-১৯৮৯, “আঙ্গুলের জন্য দ্বৈরথ”-১৯৯২, “আশ্বর্য আয়নাগুলো”-১৯৯২, “ওরা আমাকে খুঁজছিল”-১৯৯৭, “সম্ভাবনার নিচে”-১৯৯৬, “পৃথিবীতে ভোর থেকে দেখিনি কখনো”-১৯৯৭, “আশীর্বাদ করি আমার দুঃসময়কে”-১৯৯৮, “হিংস্র নৈশভোজ”-১৯৯৯, “আমি পৃথিবীর দিকে আসছি”-২০০০, “লোকগুলো সব চেনা”-২০০১, “নিরপেক্ষতার প্রশ্ন”-২০০২, “পদশব্দ শোন আমার কন্ঠস্বর”-২০০৩, “পুনরুত্থান পর্ব”-২০০৪, “অবিশ্রুত বর্তমান”-২০০৫, “মুহুর্তের মহাকাব্য”-২০০৬ সাল, “অনির্দিষ্ট দীর্ঘশ্বাস”-২০০৮, “ভাঙা দালানের স্বরলিপি” ২০০৯, “কেউ আমাকে গ্রহণ করেনি”-২০০৯ সাল। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, উড়িয়া, রুশ, জার্মান, চীনা, জাপানী ও ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

রেজাউদ্দিন স্টালিন  দীর্ঘদিন নজরুল ইনস্টিটিউটের উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top