“সুবিমল, একবার চোখ বুঁজে ভাবো দেকিনে, ময়রার হাতে ঘণ্টা ঘণ্টা কচলানোর পর গরম সিরায় জ্বাল দিয়ে তোলা নরম একটি রসগোল্লা টপ করে মুখে ফেললে কেমন সুরার মতন রস লাগে প্রাণে!”
“ভায়া, আমাদের সৈয়দপুর বাজারের পেহেলওয়ান মিষ্টান্নের একখানি রসগোল্লা যদি খেতে একদিন! বুঝলে, তোমার এই শরীরে জিভের জন্মটাই সার্থক হয়ে যেতো, তা বলে দিতে পারি।”
“এখন শরীরে সেই শক্তি নেই আর আগের মতন, নইলে লকডাউনটা খুলে দিলেই যেতাম তোমার সঙ্গে একটিবার, চেখে আসতুম একখানি পেহেলওয়ান…”
“আহ: দুই হাতের তোলায় ছানাকে গোল্লা বানিয়ে ডুবো তেলে ভাজার দারুণ সেই সুঘ্রাণ মনটাকে পাগল করে দেয় একেবারে। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম! আহা হা হা, ঝনঝন করে বেজে উঠলো গো দিলটা। শুনেছিলুম ধলেশ্বরীর তীরের গ্রাম পোড়াবাড়িতে প্রথম তৈরি হয়েছিল এই চমচম, সেই দেড়শ বছর আগে, রাজা রাম গোরার হাতে।”
চমচমের কারণে, নাকি রসগোল্লার রসের কথা মনে করে কে জানে, সুবিমল বাবুর মুখ ভরে গেলো জিভের জলে। থুক করে একদলা থুতু ফেললেন পাশের ঝোপে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নেন ঠোঁটের দুই কোন, তারপর বললেন,
“মিষ্টির ইতিহাসের কথাই যদি বলো তবে বলতে হয় আমাদের ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মণ্ডার কথা। শুনেছি ১৮২৪ সালে মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামের গোপাল পাল নামে এক ময়রা তৈরি করেন এই মন্ডা৷ পাঁচ পুরুষ ধরে গোপাল পালের পরিবার এখনো বানিয়ে যাচ্ছে এই বিখ্যাত মিষ্টি। ”
আবুল মিয়ার একটি পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। বন্ধু সুবিমলের মুখের কথা থামিয়ে দিয়ে বলে,
“তোমাকে একটি ঘটনা বলি। আমি তখন সবে আই.এ পরীক্ষা দিয়েছি। আমাদের মহল্লার এক মেয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে আমার গ্রামের এক চাচার ছেলের। বিয়েটা হচ্ছিলো আমাদের বাড়িতেই। তারা সিরাজগঞ্জ থেকে আসার সময় এক মণ মিষ্টান্ন নিয়ে এসেছে। গায়ে হলুদের দিন মেয়ের বাড়ির জন্য উপহার পাঠাবে। মিষ্টির মধ্যে দশ কেজি নাটোরের কাঁচাগোল্লাও ছিলো। আমি ভাবলাম, এতো মিষ্টি রয়েছে এখানে, আমি কয়েকটি গোল্লা খেয়ে নিলে কেউ কিছু টের পাবেনা।”
কথা থামিয়ে হা হা করে হাসতে লাগলেন আবুল মিয়া। হাসির দমকে চোখে পানি চলে এসেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন।
তারপর আবার গল্প বলতে শুরু করলেন, “একটি দুটি করে আমি একাই দশ কেজি কাঁচাগোল্লা সাবাড় করে দিলাম। চিন্তা করো, কি বিপদের মধ্যে পড়েছি তখন! এদিকে খাওয়া তো হজম, কিন্তু মিষ্টির বাক্সের মিল করি কেমন করে! হঠাৎ করে মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। কি করলাম জানো? দশটি খালি মিষ্টির বাক্সে ইটের সুরকি ও খোয়া ভরে সুন্দর করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলাম। সময়মতো আসল মিষ্টির সাথে আমার তৈরি করা নকল মিষ্টির বাক্সগুলোও উপহার হিসেবে পৌঁছে যায় কনের বাড়ি। তারপর সেখানে যখন মিষ্টির বাক্সে ইটের ঢেলা পাওয়া গেলো, বেচারার বিয়ে ভেঙে যায় যায় আরকি। হি হি হি, তবে রক্ষা যে তেমন কিছু হয়নি শেষ পর্যন্ত।”
দুই বন্ধু প্রাণ খুলে হেসে নিলো কিছুক্ষণ।
তারপর সুবিমল বলে, “তাহলে আমারও একটি গল্প বলি তোমাকে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমাদের বাজারের সেই পেহেলওয়ান মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে রোজ দাঁড়িয়ে থাকি। প্রতিদিন মিষ্টি কিনে খাবার পয়সা থাকে না পকেটে। কিন্তু অমন সরেস মিষ্টান্ন দেখেও সুখ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেবলার মতো হা করে দেখি ভেতরে মিষ্টির কারবার। একদিন মনে হলো আমাকেও দেখছে আরেক জোড়া চোখ। দোকানের উপরে থাকতো দোকানের বিহারি মালিক, তার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা। মনের মধ্যে দারুণ এক বুদ্ধি খেলে গেলো আমার। বুঝলে! আমি ইতং-বিতং করে পটিয়ে ফেললাম বালিকা মেয়েটিকে। একবার যদি বিয়ে করতে পারি তাহলে আর আমার মিষ্টি খাওয়া ঠেকায় কে, হা হা হা …..”
“তা সফল হয়েছিলে নাকি?”
“আলবৎ সফল হয়েছি। যাকে বলে মিশন সাকসেসফুল। সেই বালিকা মেহনাজ চৌধুরী ওরফে সঞ্জনা দে, আমার স্ত্রী। তোমার বৌদি।”
“মানলো তোমার সাথে বিয়ে দিতে তারা, সেই যুগে!”
“এমনি এমনি কি আর মানতে চায়! হাত কাটো, পা কাটো, রক্ত দিয়ে সুইসাইড নোট লিখো, ঘুমের ওষুধ খাও, গলায় দড়ি দেয়ার ভয় দেখাও – আরো কত কি … হি হি হি…. ”
“সুবিমল, তোমার বাড়ি যেদিন প্রথম গিয়েছিলাম, মনে আছে তুমি আমাকে রসমালাই খাইয়ে ছিলে! অত্যুৎকৃষ্ট স্বাদ ছিল উহার ভায়া, কছম বলছি”, গলায় আঙ্গুল ঠেকায় আবুল মিয়া।
“হুম মনে থাকবেনা আবার! ওটা ছিলো কুমিল্লার রসমালাই। কুমিল্লার মনোহরপুরে মাতৃভান্ডারের আসল দোকান থেকে আনা হয়েছিল সেই মিষ্টি, আমার বড় ছেলের জন্ম হওয়া উপলক্ষে। কড়াইয়ে ১ মণ দুধ প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিয়ে ঘন করে ১৩-১৪ কেজি ক্ষীর তৈরি করে তাতে টক দিয়ে ছানা কেটে বানানো হয় মিষ্টি আর তারপর সেই রসমালাই… ”
“ঘিয়ে ভাজা ছানার জিলাপি খাই না কতদিন!” মনটা খারাপ হয়ে যায় আবুল মিয়ার।
“সাতক্ষীরার সন্দেশ, যশোরের জাম-তলার রসগোল্লা বা সাদেক গোল্লা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, নওগাঁর প্যারা সন্দেশ……..”
“কালোজাম, গোলাপজাম, মতিচুরের লাড্ডু, ছানার সন্দেশ ………. ”
“আমার তো মনে হয় এই বাংলায় আমি জন্মেছি কেবল এইসব স্বর্গীয় মিষ্টান্নয়ের লোভে লোভে ”
দুই বন্ধু বুকে হাত দিয়ে ব্যথা হবার ভাব করে। “আহা রসের ডিব্বারে …”
এমন সময় দুইজনের মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে উঠলো একসাথে। সকাল নয়টা বেজে গিয়েছে। বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ায় দুই বন্ধু।
“আজ যাই, ভগবানের কৃপায় কাল সকালে আবার দেখা হবে আবুল। ভালো থেকো।”
“হ্যাঁ, তুমিও সুবিমল। আল্লাহ যদি চান, বেঁচে থাকলে কাল সকালে আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।”
সত্তরোর্ধ এই দুই বন্ধু সুবিমল দে ও আবুল মিয়া বর্তমানে ঢাকা শহরে বসবাস করেন। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউন চলছে ঢাকার অনেকগুলো এলাকায়। রোজ সকালে মর্নিংওয়াকের পর রমনা পার্কের বেঞ্চিতে সোশ্যাল ডিসটেন্স রেখে বসে তারা ঘণ্টাখানেক এই একটি বিষয়েই কথা বলেন। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন জীবনের মিষ্টিমাখা রসের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ। স্মৃতিরোমন্থন করেন আর সুবাসিত হন খেয়ালি পোলাওয়ের সুগন্ধে। ফিরে যান পুরনো দিনে যেখানে ইচ্ছে মতন টপাটপ মুখে পুরতে পারতেন সবরকমের মিষ্টি। সকাল নয়টায় মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে উঠলে দুই বন্ধু আবার ধীরে ধীরে পা বাড়ান যার যার বাড়ির দিকে। তাদের বৌমা-রা অপেক্ষা করছে ইনসুলিনের ইনজেকশন নিয়ে। ইনসুলিন নিয়ে তারপর তারা নাস্তা করবেন – লাল আটার দুটি রুটি আর পালং কিংবা লেটলেটে ঢেঁড়সের ভাজি। দুজনেরই বয়স হয়েছে। তুলতুলে রসগোল্লার সিরার টলটলে সুগার এখন বাসা বেঁধেছে তাদের রক্তে।
লুনা রাহনুমা
কলেজে পড়ার সময় থেকে লেখা শুরু। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকীতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন বছর খানেক। তারপর দৈনিক যায়যায়দিনে ছয় মাস কাজ করার পর স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস আরম্ভ করেন ২০০৬ সাল থেকে। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও লিখতে শুরু করেছেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুইটি। “ভালোবেসে এঁকে দিলাম অবহেলার মানচিত্র”(১৯৯৮), “ফু”(২০২০), দুটোই বিশাকা প্রকাশনী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত। লেখার শুরু কবিতা দিয়ে হলেও বর্তমানে বেশ কিছু অণুগল্প, গল্প, ও ধারাবাহিক গল্প প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিনে। কর্মজীবনে তিনি একজন পে-রোল একাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।