চিঠিটা আরেকবার ভালো করে পড়লো তিতির।
ছোট্ট চিঠি। মামা লিখেছে—‘মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা, যদি খুকু একবার তিতিরকে নিয়ে আসতে পারে তো ভালো হয়।’ তারপর অন্যান্য কথা— ওখানে সবাই কেমন…আশাকরি সকলের শরীর ভালো আছে…ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘খুকু’ মানে তিতিরের মা, যে চিঠিটা পেয়েই সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনাটা ভেবে নিয়ে চুপ করে বসে আছে আর মাঝে মাঝে চোখ মুছছে।
মামা খুব স্বাভাবিকভাবেই লেখার চেষ্টা করেছে, কাউকে হঠাৎ ব্যস্ত করতে চায়নি। তাইজন্যেই বোধহয় ফোন না করে চিঠি পাঠিয়েছে। ক্যাম্পাস টাউনের বাড়ীতে যদিও বেশীরভাগই ইন্টারনাল ফোন, কিন্তু মামাদের অফিসে ফোন আছে। ট্রাঙ্ককলে বাইরে থেকে কলকাতার লাইন পাওয়া একটু মুস্কিল হলেও অসম্ভব না—তবে মামা বেশী ফোন করে না, চিঠিই লেখে। এবারেও তাই করতে চেয়েছে…কিন্তু উদ্বেগটা পুরোপুরি আড়ালও করতে পারেনি। তিতিরের বাবা তখন থেকে মামার অফিসে ট্রাঙ্ককল করার চেষ্টা করছে, কিন্তু লাইন যাচ্ছে না।
তিতিরও মায়ের সঙ্গে একমত যে সামান্য কিছু হলে মা’কে যেতে বলতো না মামা। কিন্তু মুখে সেটা বলে মা’কে আরও উদ্বিগ্ন করতে চাইলো না তিতির। বরং উল্টোটাই বললো— “দিদুন তো এই একমাস হলো মামার কাছে গেছে, তার আগেই তো তোমার সঙ্গে দেখা হলো কলকাতার বাড়ীতে! সব তো ঠিকই ছিলো— তুমি আগে থেকেই অত ভেবো না তো! এখন তো গরমের ছুটি, কলেজ বন্ধ —ঘুরে আসবো নাহয় তুমি আর আমি। ভালোই তো!”
তিতিরের মা আস্তে আস্তে বললো— “মায়ের শরীরটা বোধহয় ভালো ছিলো না। একবার বলেছিলো যে পেটে একটা ব্যথা…সময়ে গলব্লাডারের অপারেশনটা করে নিলেই ভালো হতো…বাবা তখন ভয় পেলো…। মা তো বেশী কিছু বলে না, ব্যথা নিয়েও বেশী কথা বলেনি আর – তাই আমিও কিছু ভাবিনি তখন। এখন ভাবছি যে শরীর খারাপ বলেই কি দাদার কাছে গেলো?…বাবাও তো ওখানেই মারা গেছে। মা-ও খালি বলে যে ওখানেই মারা যেতে চায়। নাহলে হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে…মা তো বরাবর স্বাধীনভাবেই থাকতে চায় কলকাতায়…কারুর কাছেই তো গিয়ে বিশেষ থাকে না। অথচ এখন একমাস হয়ে গেলো….”
তিতির মা-কে থামিয়ে দিয়ে বললো—“তুমি এখন ঐসব উলটোপাল্টা ভাবতে বসো না তো!”
বাড়ীর ব্যবস্থা সব ঠিক করে, দু’দিন বাদে তিতির আর তিতিরের মা রওয়ানা দিলো মামার বাড়ী।
ছোট্ট ক্যাম্পাস টাউনে সুন্দর বাংলো টাইপের বাড়ী।
কাজের লোকজন, মালী, এদের নিয়ে ব্যাচেলর মামার একক সংসার।
মাঝে মাঝে তিতিররা আসে, দিদুন আসে বা অন্য অতিথি আসে। এছাড়া বছরের বেশীরভাগ সময়ই এতোবড়ো কোয়ার্টার্সের দুটো বেডরুম খালিই পড়ে থাকে।
তিতিররা এসে মামার কাছে শুনলো যে দিদুন কিছুই খেতে পারছে না, বমি হয়ে যাচ্ছে। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। পেটে একটা ব্যথা হচ্ছে মাঝেমাঝে। ডাক্তারের মতে, নন-ফাংশানিং গলব্লাডার অপারেশন না করে এতদিন রেখে দেওয়ার জন্য নানারকম কমপ্লিকেশনস্ তৈরী হয়েছে। আর এখন বয়স এবং দুর্বলতার কারণে অপারেশন সম্ভব নয়। কয়েকটা টেস্ট এবং এক্সরে করলে ভালো বোঝা যাবে—তার জন্যে হাসপাতালে দেওয়া দরকার। কিন্তু দিদুন কোনো হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কিছুতেই থাকবে না, বাড়ীতেই থাকতে চাইছে—মামাও তাই এই অবস্থায় আর জোর করছে না। মা-র সব শুনে চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করলো। তিতিরও বুঝলো যে দিদুন বোধহয় এবারে সত্যিই তার শেষ শয্যা পেতেছে। মা-কে ভালো করে বোঝালো তিতির—দিদুনের সামনে গিয়ে যেন কান্নাকাটি না করে।
ঘরে ঢুকে দেখলো দিদুন বিছানায় শোওয়া। স্যালাইন চলছে, নার্স পাশে দাঁড়িয়ে।
একমাসে যে কারুর শরীর এতো রোগা হয়ে যেতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। দিদুন ওদের দেখে হাল্কা করে হাসলো। তারপর বললো— “এই পৃথিবীতে আসার সময়ও একটু কষ্ট করতে হয়, যাওয়ার সময়ও একটু কষ্ট করতে হয় — ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই। যাওয়ার সময় হয়েছে, চলে যাবো।…তোদের কষ্ট হয়নি তো আসতে? আমিই খোকাকে বললাম এবারে তোদের চিঠি দিতে। তিতিরের কলেজ বন্ধ, খুকুকে নিয়ে ঠিক চলে আসবে। আগে বললে ব্যস্ত হতি, তাই বলতে বারণ করেছিলাম খোকাকে।”
তিতিরের মা বললো— “মা, তোমার শরীর খারাপ হলে আমরা ব্যস্ত হবো না ?…ক’দিন আগে বললে আগেই চলে আসতাম।”
দিদুন বললো— “নিজের সংসারটা ছড়িয়ে রেখে, এই বুড়ো মায়ের মৃত্যুশয্যার পাশে বসে থাকতি তুই একমাস?…ওরে, যাওয়ার সময় একাই যেতে হয়! তোকে বলার তো এই মুস্কিল— কান্নাকাটি শুরু করিস না আবার এখন।”
বলার অপেক্ষা মাত্র— তিতিরের মায়ের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়লো।
দিদুন মামাকে বললো— “খুকুকে চান করতে পাঠা, তারপর খাওয়ার ব্যবস্থা কর্। হরেন রান্না করেছে তো ঠিক করে? …এতোটা পথ এসে এরা ক্লান্ত!…খুকু, তুই চান করে নে। তুই বেরোলে, তিতির যাবে।”
তিতিরের মা যেমন দুর্বল প্রকৃতির, দিদুন ঠিক তেমনই শক্ত— কোনকিছুতেই চট্ করে ভেঙে পড়ে না। এখনও দিদুনের মনের জোরটা ঠিক সেইরকমই আছে দেখে ভালো লাগলো তিতিরের— শুধু গায়ের জোরটা একটু কম, তাই গলার জোরটাও।
মামা আর মা বেরিয়ে গেলে, তিতির দিদুনের দিকে ঘুরে বসলো—“এটা কি বাঁধিয়ে বসলে বলোতো?”
দিদুন নার্সের দিকে তাকিয়ে বললো— “রমা, তুমি বাইরে বাগানে গিয়ে একটু ঘুরে এসো। দিদি আছে তো, দরকার হলে ডাকবে।” নার্স ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেলো।
দিদুন তখন তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো— “আমরা আর কি বাঁধাবো বল্? বাঁধাবার যিনি কর্তা, তিনি যথাসময়ে টিকিট পাঠিয়ে দেন। আমারও টিকিট এসে গেছে রে।”
তিতির বললো— “দিদুন, তুমি কিন্তু শুধুশুধু জেদ করছো — কেন তুমি হসপিটালে যাবে না বলো তো? কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তোমার কয়েকটা টেস্টিং করা দরকার।….মামাকে ভালোমানুষ পেয়ে তুমি জোর করেছো, মামাও শুনে নিয়েছে। আমি কিন্তু ছাড়নেওয়ালা নই!”
দিদুন হেসে বললো – “ওরে, তুই ধরবি কাকে? ঠাকুরের নৌকো যে ঘাটে এসে দাঁড়িয়ে আছে….!”
তিতির হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়লো।
দিদুন বললো— “শোন্, এ’ আমার আনন্দের যাত্রা — তাই একদম কান্নাকাটি করবি না। …. তোর দাদুন চলে গেছে আজ কতবছর হলো। ভেবেছিলাম তাকে ছাড়া বাঁচতেই পারবো না, কিন্তু ঠাকুর বাঁচিয়ে রাখলেন — সময় হয়নি যে! কিন্তু যে ক’বছর বাঁচলাম, সে ক’বছর আমার তপস্যার বছর রে! কত শিখেছি, কত বুঝেছি…..তবে না ডাক এলো! এইখান থেকে তোর দাদুন পাড়ি দিয়েছিলো, এইখান থেকেই তোদের সবাইকে রেখে আমিও পাড়ি দেবো। এই আমার তীর্থ।….হাসতে হাসতে আমায় নৌকায় তুলে দিবি বলেই তো তোকে ডেকেছি। তোর মা আর মামা তো কেঁদেই ভাসাবে।”
তিতির যে কি বলবে ভেবে পেলো না। দিদুন এমন করে কথা বলছে যেন কী একটা মজা! কোথায় যেন একটা বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কেটেছে। যেমন করে কথা বলেছিলো পাঁচবছর আগে মামার সঙ্গে আমেরিকা ঘুরতে যাওয়ার সময়।
অনেকক্ষণ টানা কথা বলে দিদুন হাঁপিয়ে গেছে।
চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে বললো—“তোর সঙ্গে আরও কথা আছে— কালকে বলবো। এখন তুই একটু বিশ্রাম কর্। রমাকে ডেকে দিয়ে যা, আমাকে ব্যথার ওষুধটা দেবে।”
তিতির বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নার্সকে দিদুনের কাছে পাঠিয়ে ও বাগানে গাছের ছায়ায় এসে বসলো। এখনো ভাবতেই পারছে না যে সত্যি সত্যি দিদুনের জন্য ঘাটে নৌকো এসে দাঁড়িয়ে আছে।
দেড়মাস আগেও কলেজ ফেরত চলে গেছে দিদুনের বাড়ীতে। শনি-রবি কাটিয়ে, সোমবার কলেজ করে বাড়ী ফিরেছে। শনিবারের বিকেলে দুজনে পূর্ণ সিনেমায় গিয়ে ‘চামেলী মেমসাহেব’ দেখে এসেছে।
সবেতেই উৎসাহ দিদুনের, কোনো কিছুতেই ক্লান্তি নেই। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনেও যাচ্ছে মহারাজের বক্তৃতা শুনতে আবার সিনেমাতেও যাচ্ছে নাতনীর সঙ্গে।
একা বাড়ীতে কাজের লোক নিয়ে, ভাড়াটেদের নিয়ে, দিব্যি নিজের মনে থাকা দিদুনের হঠাৎ কি তাড়া পড়লো টিকিট নিয়ে অচেনা দেশে যাওয়ার?…
হরেনদা’র ডাকে চমক ভাঙলো— “দিদি, এসো— চান করে নাও। খাবার দেবো।”
তিতির উঠে ঘরে এলো।
চান করে, খেয়ে, একটু ঘুমিয়ে নিলো তিতির— অনেক ভোরে উঠে ট্রেন ধরতে হয়েছিলো।
ঘুম থেকে উঠে মনে হলো, এতক্ষণে যেন মাথাটা কাজ করছে ঠিকভাবে।
দিদুনের ঘরে এসে দেখলো, মা বসে আছে। দিদুনের মাথায় হাত বোলাচ্ছে আর নীচু গলায় কথা বলছে।
তিতির বেরিয়ে এসে বাইরের ঘরে বসলো। বাবাকে একটা চিঠি লিখে হরেনদা’কে দিলো পোস্ট করে দেওয়ার জন্যে। এখানকার অবস্থাটা জানিয়ে, বলে দিলো যে ওদের ফেরার দিন এখন অনিশ্চিত। মামা কয়েকদিন ছুটিতে ছিলো, আগামীকাল অফিসে যাবে — তখন একবার বাবাকে ট্রাঙ্ককল করারও চেষ্টা করবে।
পরদিন সকালে দিদুনের ঘরে গিয়ে দেখে হরেনদা’ দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোচ্ছে আর দিদুন বলছে— “তুমি কি বলে ওদের সেদ্ধ ভাত খাওয়ালে কাল, হরেন? মেয়েটা মামার বাড়ী এসেছে কি এই খাওয়ার জন্যে?”
তিতির দিদুনকে বললো— “তোমায় কে বলেছে যে মেয়েটা মামারবাড়ী এসেছে খাওয়ার জন্যে?….আর দিদুন, তুমি অন্তত ভালো করেই জানো যে আমার কাঁচালঙ্কা দিয়ে ডালসেদ্ধ আর বেগুনসেদ্ধ ভাত খেতে খুব ভালো লাগে—হরেনদা’ ঠিক সেটাই রেঁধেছে। হরেনদা’, আজকেও তাই দেবে গো আমায়!”
হরেনদা’ একটু জো পেয়ে বললো— “আমিও তো তাই বলতেছিলুম। বাবুর একোন মাতার টিক নেই—কোতায় বাজার আর কোতায় খাওয়া?”
দিদুন বললো— “তুমি থামো দেখি, হরেন! সেদ্ধভাত তো খাবেই ক’দিন পরে। আজ বাজার থেকে ভালো মাছ নিয়ে এসো—তিতির ইলিশ ভালোবাসে, পাও কিনা দেখো। আর সঙ্গে একটু এঁচোড় এনো— খুকুটা বড়ো ভালোবাসে।…ছোটবেলায় বলতো ‘এটা মাংসের চেয়েও ভালো’।”
হরেনদা’ আমতা আমতা করে বললো— “আজ্ঞে, বাবু তো আপিসে চলি গেছেন— বাজারের টাকা…”
তিতির বললো— “সে নাহয় আমি দিয়ে দেবো। মা কিন্তু রেগে যাবে শুনলে— কিছু খেতেই চাইছে না এখন…আর তুমি….”
দিদুন বললো— “আচ্ছা, তোরা সবাই মিলে কি লাগিয়েছিস বল্ তো?…ওরে, আমি এখনো মরিনি! মরলে তোর মা যদি বা খাওয়া বন্ধ করে কাঁদতে বসে— তুই? তোকে কি বলেছি মনে থাকে যেন!…শোনো হরেন, আজ বাবু ফিরলেই টাকা চেয়ে রাখবে। দিদির থেকে টাকা নেবে না। পারলে বিকেলেও একবার বাজারটা ঘুরে আসতে পারো। কাল ভালো করে সোনামুগের ডাল, এঁচোড়ের তরকারী, ইলিশমাছ আর পাবদা মাছ রাঁধবে— বুঝেছো? সঙ্গে একটু মিষ্টি দই-ও আনবে। আজকের জন্যে ডাল বেটে একটু ধোঁকার ডালনা করো আর পোস্তর বড়া দিয়ে কলাইয়ের ডাল। সঙ্গে একটু শাকভাজা করে দিও —বাগান থেকে শাক তুলে এনো।”
“আচ্ছা” বলে ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেলো হরেনদা’।
তিতির বললো— “উফ্ দিদুন! তুমি পারোও বটে!…কালকে কি এমন, যে যজ্ঞিবাড়ীর রান্না করতে হবে!”
দিদুন বললো— “সে তুই বুঝবি না।…এখন শোন্ যা বলছি। তোর মা কোথায়?”
তিতির বললো— “মা এই চা খেয়ে বাথরুমে ঢুকেছে। সব সেরে, পূজো করে, আসতে আসতে অনেকক্ষণ।….কেন তোমার কিছু লাগবে?”
দিদুন নার্সের দিকে ঘুরে বললো— “রমা, তুমি একটু দেখো তো হরেন ঠিকমতো ধোঁকাটা করছে কিনা। বাগান থেকে শাকটাও একটু তুলে এনে দিও ওকে। ….আমি দিদির সঙ্গে একটু দরকারী কথা বলছি— হয়ে গেলে তোমাকে ডাকবো।” নার্স মাথা নেড়ে চলে গেলো।
তিতির বললো— “এবার বলো দেখি তোমার প্রাইভেট কথা। কাল থেকে যা সাসপেন্সে রেখেছো!”
দিদুন বললো— “আমার বালিশের তলা থেকে চাবি নিয়ে ঐ আলমারিটা খোল্।”
তিতির চাবিটা নিয়ে হেসে বললো— “বাব্বা! গুপ্তধন নাকি?”
দিদুন একটু হেসে বললো— “হ্যাঁ রে, আমার গুপ্তধন। সবাই হয়তো হাসবে, তাই লুকিয়ে…..ঐ যে ওপরের তাকের ব্যাগটা – ওটা খোল্। ওর মধ্যে একটা ছোট খাতা আছে – পেয়েছিস্? ওটা নিয়ে আয়।”
তিতির নির্দেশ মতো খাতা বের করে, আলমারি বন্ধ করে, চাবিটা দিদুনের বালিশের নীচে রেখে, দিদুনের হাতে খাতাটা দিলো। তারপর বললো – “এটা কিসের খাতা?”
দিদুন একটা লাজুক হাসি হেসে বললো—“আমি যেসব হাবিজাবি লিখতাম…কবিতা…রোজের কথা…সেইসবের খাতা। বেশী কিছু নেই। বিয়েতে উপহার পেয়েছিলাম এই খাতা আর একটা কলম—মাস্টারমশাই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন পড়াশোনা চালু রাখতে, লিখতে। তাই মাঝে মাঝে লিখতাম।…তোর দাদুনকে একবার দেখাতে গিয়েছিলাম বিয়ের পর— এমন হাসলো যে লজ্জায় আর বলিনি। বেশী লিখিওনি তারপর…এই মাঝে মাঝে খুব আনন্দ হলে বা খুব কষ্ট হলে…চার ননদে মিলে অনেক কথা শোনাতো তো…তখন হয়তো ঘরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একটু লিখতাম…ছাদের গাছে ফুল ফুটলে খুব আনন্দ হতো…..তখন হয়তো লিখতাম…এইরকম আর কি! তোর দাদুন মারা যাওয়ার পর দারুণ অভিমানে সবই ছেড়ে দিয়েছিলাম, এই খাতাটাকেও।…এইখানে আসার আগে কলকাতার বাড়ীতে সব গুছিয়ে রেখে এলাম, পরে যাতে তোর মামার অসুবিধে না হয়!..তখন এই খাতাটা হঠাৎ খুঁজে পেলাম— শেষ দু’চার লাইন লিখে, নিয়ে এলাম তোর জন্যে।….তুই তো অনেক লিখিস্, ছাপাস্ — দ্যাখ্ তোর পড়ে কেমন লাগে।”
তিতির অবাক হয়ে বললো— “তুমি লিখতে? বলো কী! এতোদিন বলোনি কেন গো?…আচ্ছা আর কি কি করেছো তুমি জীবনে বলো তো!…ক’বছর আগে হাজরা পার্কে গিয়ে মহিলাসমিতির হয়ে একবার বক্তৃতা দিয়েছো জানি, বন্যাত্রাণে টাকা তুলেছো জানি, তোমার সেইসব দজ্জাল ননদিনীদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে তাদের সাহায্য করে এসেছো একসময় তা-ও জানি, মামার সঙ্গে আমেরিকায় গিয়ে পাণিগ্রাহীদের বাড়ীতে ভারতবর্ষের মহিলাদের নিয়ে ইংরেজীতে কথা বলেছো তাও শুনেছি…আর কি কি করেছো একটু খুলে বলো তো?…”
দিদুন বললো— “ওরে, মহাকালী পাঠশালায় নয় ক্লাসে পড়তে পড়তে তোর দাদুনের সঙ্গে বিয়ে হলো — ব্যস্, হয়ে গেলো পড়াশোনা। আমার তখন চোদ্দ বছর বয়স, তোর দাদুন তখন মেডিকেল কলেজে পড়ছে। এরপর খোকা হলো, তারপর খুকু — খুকু হওয়ার পর তোর দাদুন ডাক্তারী পাশ করলো।…বিয়ের পর বাড়ীতে বই পড়া ছাড়া আর কিছুই পড়িনি — আমার অতো বিদ্যে কই যে ইংরেজীতে কথা বলবো? ঐ ঠাকুর যা বলালেন মুখ দিয়ে তাই বেরোলো— ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে। আমেরিকানরা খুব ভদ্র তো, তাই শুনেই হাততালি দিলো।”
তিতির হাসতে হাসতে বললো — “তুমি তো নেক্স্ট টু ইন্দিরা গান্ধী, দিদুন!”
দিদুন বললো— “নারে, আমি কিছুই না। খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে— বাবা সরকারী কেরাণী ছিলেন। ননদরা যে ‘গরীবের মেয়ে’ বলে খোঁচা দিতো, সে তো ভুল কথা নয়। আমার বাবার পয়সা ছিলো না, কিন্তু খুব ধর্মজ্ঞান ছিলো। …শুধু রূপ দেখে আমায় বৌ করে এনেছিলেন আমার শ্বশুরমশাই —ননদদের তাই রাগ হতো….অতো বড়োলোকের বাড়ীতে এমন বৌ।”
তিতির বললো— “এমন বৌ মানে? আবার কেমন বৌ হবে?..তোমার ননদদের যা দেখতে ছিলো, আর তেমনি ঝগড়াটি— কপাল করে তোমার মতো বৌ পেয়েছিলো।..দাদুন কিছু বলতো না কেন বোনদের? তোমায় অতো জ্বালাতন করতো ওরা! তুমিও তেমনি— আবার তাদের সংসারে গেছো সাহায্য করতে!”
দিদুন বললো— “ওরে, তোরা ঐ যে কি বলিস্ না— ‘টিট্ ফর ট্যাট্’…আমাদের সময়ে ঐসব ছিলো না। নিজের ননদরা অভাবে পড়লে সাহায্য করবো না? ওরা খারাপ কাজ করলে ঠাকুর দেখবেন— আমি দেখার কে? ‘কয়লা খেলে আঙরা হাগবে’ – এ’ তো জগতের নিয়ম। আমি কেন মাঝখানে থেকে কয়লা খেতে যাই, বল্?….আর তোর দাদুন? সে কাউকেই কিছু বলতো পারতো না — ভীতু মানুষ ছিলো। ভয়ের চোটে আমার গলব্লাডার অপারেশনই করালো না! বললো— ‘ইউটেরাস আর হার্নিয়া দুটো অপারেশন হয়েছে, আর দরকার নেই।’ তার সবেতেই ভয় ছিলো। আমার শ্বশুরমশাইও ছিলেন চুপচাপ – কাউকে কিছু বলতেন না। শাশুড়ীছাড়া ঘর— ননদরাই সব ঠিক করতো। প্রায় সারাবছরই বাপের বাড়ীতে আসাযাওয়া লেগে থাকতো তাদের— সবাই তো কলকাতার ওপর। তাদের বাবার টাকায়ই তো সংসার চলতো সেইসময়— তোর দাদুন তো তখন ছাত্র। …..ওসব কথা রাখ্। তুই আমার এই খাতাটা তোর কাছে রেখে দিস্, কাউকে কিছু বলিস্ না। ঘরে নিয়ে গিয়ে তোর ব্যাগে রেখে দে এখন, পরে পড়িস্।…তোর মা এলো বলে!”
তিতির উঠে পড়লো। স্যালাইনের বোতলটা পরীক্ষা করে দেখলো— প্রায় শেষ, পাল্টাতে হবে। রান্নাঘরে গিয়ে নার্সকে বলে, তিতির ওদের ঘরে চলে এলো। খাতাটা খুলতে গিয়েও, কি ভেবে থেমে গেলো। আপাতত ব্যাগে ঢোকানো থাক্, পরে দেখবে। হরেনদা’ টেবিলে কলা, টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ রেখে গেছে। ব্রেকফাস্ট সেরে, স্নান করতে ঢুকে গেলো তিতির।
বিকেলের দিকে দিদুনের শরীরটা খারাপ লাগছে বলে মনে হলো — চুপ করে শুয়ে আছে, বেশী কথা বলছেনা। তার ফাঁকেই একবার হরেনদা’কে ডেকে বাজার করার কথা মনে করিয়ে দিলো। হরেনদা’ মাথা নেড়ে, মামার থেকে টাকা নিতে গেলো। ডাক্তার আসার কথা আছে আজ— মামা তাই তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে এসেছে। ডাক্তার অবশ্য দেখে নতুন কিছু বললো না— খুবই দুর্বল, প্রেশার লো, এক্সরে করা দরকার। ওজন একটু না বাড়লে এবং দুর্বলতা না কমলে অপারেশনের ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। অপারেশন যদি করা সম্ভব হয় কিছুদিনের মধ্যে, তার আগে এক্সরে করতে হবে। মামা বললো যে দিন সাতেক ধরে লক্ষ্য করছে যে সকালে এনার্জী থাকে, কথাবার্তা বলে। কিন্তু দুপুরের পর ঝিমিয়ে পড়ে। ডাক্তারের মতে সেটা হতে পারে— এতোদিন স্যালাইন চলছে, শরীর ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে।
মা সারাদিন বসে রইলো দিদুনের পাশে। তিতির আর মামা, যাচ্ছে আর আসছে। দিদুনের ঠোঁটদুটোর নড়াচড়া দেখে তিতির বুঝতে পারছে যে মনে মনে ঠাকুরের নাম জপ করে যাচ্ছে দিদুন।
রাত্রি নটায় হরেনদা’ খাবার দিলো— উঠে খেতে এলো সবাই। নার্স আগেই খেয়ে নিয়েছে। দিদুনকে আরেকবার ব্যথার ওষুধ দিয়ে, পাশের ছোট খাটটায় শুয়ে পড়লো সে। সাধারণত রাতে ওঠার দরকার হয় না — ব্যথার ওষুধ নিয়ে সারারাত ঘুমোয় দিদুন।
তিতিররা খাওয়ার ঘরে এসে দেখলো টেবিলে হরেনদা’ সব সাজিয়ে রেখেছে। হাত ধুয়ে সবাই খেতে বসে গেলো। মামা আর মা দু’জনেই চুপচাপ—মুখ দেখেই ওদের মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পারছে তিতির। দাদুনের মৃত্যুর পর, মামার একক জীবনে দিদুন অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিলো—সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় মামা অসম্ভব চুপ হয়ে গেছে। কোনো কথাই বলছে না। মা-ও তথৈবচ।
তিতির পরিস্থিতিটা হাল্কা করার জন্যে বললো— “দিদুন না, আজ সকালে খুব গল্প করছিলো — কত পুরোনো কথা বলছিলো! বিয়ের পরের কথা, তোমাদের ছোটবেলার কথা।” মা আর মামা উৎসুক চোখে তাকালো।
তিতির হাসতে হাসতে বললো —“দিদুন কিন্তু ভীষণ স্ট্রং আর পজিটিভ মাইন্ডেড….ইলেকশনে দাঁড়ালে ঠিক জিতে যেতো! দক্ষিণ কলকাতার বিধায়ক শ্রীমতি বীণাপাণি ঘোষ দস্তিদার!…শী হ্যাজ ইট্ ইন্ হার, তোমরা একটু উৎসাহ দিলে ঠিক নেমে পড়তো— শুধু ঘরের চারদেওয়ালে আটকে থাকতো না!”
মা আর মামা শুধু আবছাভাবে একটু হাসলো।
বসার ঘরে বসে কিছুক্ষণ এলোমেলো কথা হলো— দিদুনের অবস্থা এবং ডাক্তারের রেকমেন্ডেশন নিয়ে।
মা আর মামা দু’জনেই জানে যে দিদুন যখন ‘না’ বলেছে, তখন তাকে আর ‘হ্যাঁ’ করানো যাবে না।
জোর করার সত্যিই কোনো মানে হয় কিনা, সেটাও আরেকটা প্রশ্ন। হাসপাতালে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করে হয়তো শুধু কয়েকটা দিনের আয়ু বাড়ানো যাবে— যেটা খানিকটা স্বার্থপরতা, কারণ দিদুন সেটা একেবারেই চাইছে না। কলকাতা থেকে দিদুন এবারে শরীর খারাপ নিয়েই এসেছে— কাউকে কিছু বলেনি। ওজন কম, খাওয়ার অসুবিধে এগুলো ছিলই, কিন্তু ডাক্তারের কাছে না গিয়ে এখানে চলে এসেছে। অথচ এই দিদুনই বছরখানেক আগে, কাজের লোক সঙ্গে নিয়ে গিয়ে চোখের অপারেশন করিয়ে এসেছিলো একা। অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের জানিয়েছিলো। এবারে কিছুই করেনি, করতে চায়নি। এখানে আসার সপ্তাহদুয়েকের মধ্যেই শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়লো— দিদুন যেন সেটা জেনেই চলে এসেছিলো এখানে। সুতরাং দিদুনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে হাসপাতালে দিলেও, শেষরক্ষা হবে কিনা সন্দেহ। …
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে, মা আর মামা শুতে চলে গেলো। তিতির তার বইয়ের তলায় দিদুনের খাতাটা নিয়ে এসে বসার ঘরে বসলো— মা’কে বললো শুয়ে পড়তে। হরেনদা’ খাওয়া শেষ করে, সব গুছিয়ে, রান্নাঘর মুছে, সার্ভেন্টস্ কোয়ার্টারে চলে গেছে। বাইরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মামাও শুয়ে পড়েছে।
খুব সন্তর্পণে দিদুনের খাতাটা এবারে খুললো তিতির। এতো পুরোনো যে ধরতেই ভয় লাগছে – একটু চাপ লাগলেই যেন ঝুরঝুর করে সব ঝরে পড়বে। প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগের খাতা, লেখাও পুরোনো— অনেক জায়গায় কালি অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
তারিখ দিয়ে দিয়ে লেখা— প্রথম শুরু হয়েছে বিয়ের দু’মাস পরে। প্রায় প্রতিমাসেই কিছু না কিছু লেখা আছে। তারপর আবার বেশ অনেকদিন ফাঁকা— কিছু লেখা নেই। সময়টা দেখে তিতির বুঝলো যে মামা এবং মায়ের জন্মের পর লেখা কমে গিয়েছিলো। তারপর আবার ছোট ছোট লেখা— বেশীটাই পদ্যে, ছড়ার মতো করে। বেশ ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে লেখা। দিদুনের লেখার হাত ছিলো, এটা মানতেই হবে।….. কিন্তু ক্রমশঃ উৎসাহের জল-হাওয়ার অভাবে, লুকোনো গাছটি শুকিয়ে গেছে— বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো দিদুনের লেখা। দাদুন মারা যাওয়ার পর থেকে আর কিছু নেই, শুধু একমাস আগে লেখা চারলাইনের একটা পদ্য। পুরো খাতাটা পড়া শেষ করে, তিতির স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো খানিকক্ষণ।
সে নিজে লেখে, তাই জানে যে নিজের সৃষ্টির ওপর মানুষের কী ভীষণ মায়া থাকে! আজকের তিতিররা যাই লিখুন না কেন, তাই নিয়ে কতো আলোচনা কত লাফালাফি হয়। আর তিতিরদের জন্মদাত্রী দিদুনরা, নিজেদের লেখাকে শুধু ঘরের কোণে লুকিয়ে রেখে দিল চিরকাল! এটা কি মেয়েদের সঙ্কোচের দুর্বলতা, নাকি উদারতার শক্তি? পুরুষরা যেখানে ‘পৃথিবী আমারে চায়….’ বলে বিশ্বজয়ের ইচ্ছেতে ঘরের থেকে বেড়িয়ে পড়ে, মেয়েরা সেখানে তাদের সব মহার্ঘ্য গুণগুলোকে আটপৌরে করে নিয়ে সংসারের আঁচলে ঢেকে হাসিমুখে জীবন কাটিয়ে দেয়।
পরদিন সকাল থেকে দিদুনের আবার খুব উৎসাহ। হরেনদা’কে ডেকে পাবদা মাছ রান্নার প্রক্রিয়া বারবার বুঝিয়ে দিলো, মা-কে বললো ভাপা ইলিশটার একটু তদারকি করতে, আর হরেনদার রান্নাঘর থেকে বাটিতে বয়ে আনা এঁচোড়ের ঝোলের রং বার বার পরীক্ষা করে দেখে তবে রায় দিলো উনুন বন্ধ করার। এত রান্নার কিছুই কিন্তু দিদুন খেলো না। কিন্তু খুব আনন্দ পেলো তাদের খাইয়ে।
পরেরদিনও দিদুনের শরীরটা ভালোই মনে হলো সারাদিন। মা আর মামা আশা করে থাকলো যে কয়েকদিন শরীরটা এইরকম ভালো গেলে হয়তো দিদুন একটু একটু করে খেতে শুরু করবে। দিদুন সেদিন জোর করে সব ইলিশমাছ আর পাবদামাছ শেষ করালো তাদের খাইয়ে।
হরেনদাকে ডেকে বললো— “হরেন, বেশী বাসি করো না রান্না। আজকে এঁচোড়, মাছ সব শেষ করে দাও।” মা বললো— “কেন? দুটো মাছ একসঙ্গে না বের করে, কালকে একটা খাওয়া যায় তো!”
দিদুন বললো—“না, না। অত বাসী রান্না খাওয়ার দরকার নেই। কাল আবার কিছু রেঁধে দেবে হরেন। নাহলে তো সেদ্ধভাত আছেই, কি বলো হরেন?” হরেনদা’ আর কি বলবে! সুতরাং সেদিনও পেট ঠেসে খাওয়া হলো সকলের। মা একটু শুয়ে নিতে গেলো খাওয়ার পর। তিতির এসে বসলো দিদুনের কাছে, নার্সকে বললো একটু বাইরের বাগানে ঘুরে আসতে— সকাল থেকে ঘরের কোণে বসে আছে বেচারা একভাবে।
দিদুনকে একা পেয়ে তিতির বললো—“তোমার লেখাগুলো তো দারুন দিদুন! ছাপানোর চেষ্টা করোনি কেন কখনো? তোমাদের সময়ে মহিলা লেখক তো কম ছিলেন, খুব আদর করে ছাপতো সবাই। তোমার ছড়াগুলোতে তো তোমার জীবনের গল্পটাই পুরো বলা আছে!”
দিদুন একটু হেসে বললো— “তোর ভালো লেগেছে? তাহলে খুব খারাপ লিখতাম না—কি বল্!”
তিতির বললো— “মোটেই না, রীতিমতো ভালো লিখেছো। … সেরে ওঠো তাড়াতাড়ি, তোমাকে দিয়ে আমি আবার লেখাবো— আর সেই লেখা ছাপাবো।”
দিদুন বললো—“আর লেখা! তবে তুই যে বললি এটাই আমার অনেক পাওয়া। …. কাল তোর দাদুনের মৃত্যুদিন জানিস্? এইখান থেকেই সে গিয়েছিলো।”
তিতিরের মনে ছিলো না, দিদুনের কথা শুনে মাথা নাড়লো।
দিদুন আর বেশী কথা বললো না। চোখ বন্ধ করে জপ করতে লাগলো।
মা ঘরে ঢুকতে, তিতির বেরিয়ে এলো বাইরের বাগানে।
মামার বাগানটা খুব সুন্দর। পেছনের দিকে যত শাকসব্জির মেলা, আর সামনে রঙবেরঙের ফুল।
সন্ধ্যে অবধি বাগানে ঘুরে বেড়ালো তিতির।
দিদুনকে একটু ভালো দেখে সবাই সেদিন তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলো। পরদিন রবিবার, ওঠার তাড়া নেই। সবাই একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোবে।
কিন্তু ভোররাত্রে নার্সের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেলো।
দিদুনের শ্বাসকষ্ট উঠেছে।
মামা আর মাকে দেখে, দিদুন অতি কষ্টে আস্তে আস্তে বললো— “ইঙ্গিত এসে গেছে।”
তারপর চোখ বন্ধ করলো, ঠোঁট নড়তে লাগলো।
সেই শেষ কথা। মামা মুখে গঙ্গাজল দেওয়ার একমিনিটের মধ্যে সব হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো।
ঘড়িতে তখন ভোর ঠিক সাড়ে পাঁচটা।
মামা এবং মাকে বলে, দিদুনের খাতা থেকে নির্বাচিত কয়েকটা ছড়া নিয়ে একটা দু’পাতার লিফলেট ছাপালো তিতির।
দিদুনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দিন, দিদুনের ছবির সামনে রেখে দেওয়া হলো সেই লিফলেটের দু’শোটা কপি ।
লোকের হাতে হাতে ছড়িয়ে গেলো শ্রীমতি বীণাপাণি ঘোষ দস্তিদারের দিনলিপি— ‘একদা গৃহকোণে’।
তিতির স্পষ্ট শুনতে পেলো দিদুন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে— “এইজন্যেই তো তোকে ডেকেছিলাম। …. যেমন হাসতে হাসতে আমার কবিতা ছাপিয়ে তুই আমায় বিদায় দিলি, তেমন হাসতে হাসতে আমিও চললাম কবিতায় সাজানো আমার জীবন নিয়ে ঠাকুরের পায়ে দিতে।”
একদা গৃহকোণে
চাঁদের আলো কালকে রাতে সারা আকাশ জুড়ে—
খানিক আলো তারই এলো আমার শোবার ঘরে।
গলার গোঠে নিয়ে আমার, ছোট্-ঠাকুরঝির বিয়ে—
বলবো কি আর, বলবো কাকে? রইনু শুধু চেয়ে।
শাশুড়ী নেই, শ্বশুরঘরে ঠাকুরঝিদের রাজ—
নিজের বাড়ী ছেড়ে তাদের বাপের বাড়ী কাজ।
ছাদের গাছে কালকে আমার ফুটেছিলো ফুল—
দুটো জবা, পাঁচটা ছিলো সাদা বেলের ফুল। …
মেজ্-ঠাকুরঝি বললো আমি গরীবঘরের মেয়ে—
রান্নাতে তাই তেল ঢেলেছি হাতের কাছে পেয়ে।
ঠাকুরঝিরা আজকে সবাই বেঁধেছিলো দল
খাবার কিছু দ্যায়নি খেতে, পান করেছি জল।
ঠাকুরমশাই পূজো করেন, নেইকো পেটে ভাত,
দিলাম তাঁরে এক ধামা চাল – ঠাকুরঝিদের রাগ।
ঠাকুরঝিরা ঝগড়া করে, শ্বশুরমশাই চুপ ।
স্বামী আমার পড়তে গেছেন – কাকে জানাই দুখ?
স্বামী দিলেন কালকে রাতে আতরের এক শিশি—
গন্ধে তারই আজও দেখি ভরা দিবানিশি। …
ঠাকুরঝিদের ঘরে আজকে লেবেঞ্চুসের ঘটা—
খোকা শুধু দেখলো চেয়ে, পেলো না একছটা।
খুকুর বয়স একমাসেতে স্বামী করলেন পাশ—
পশার হলো ডাক্তারিতে, ঘরে লক্ষ্মীর বাস।
একটি বছর শয্যাশায়ী শ্বশুর গেলেন চলে—
সেবা করেও রাখতে তাঁরে পারলাম না ধরে।
ঠাকুরজামাই পা ভেঙেছেন বাসের তলায় পড়ে।
চারটি ছোট বাচ্চা নিয়ে ননদিনী ঘরে। …
দিলাম তাকে পাঁচশো টাকা, হাতটি ধরে বলে—
মাপ করে দাও বৌদি আমার, রাগ কোরো না ভুলে।
আকাশ দেখি ভরে আছে অগাধ সোনার আলোয়—
কালোরা সব ধুয়ে গেছে ঠাকুর, তোমার ভালোয়। …
খুকুর বিয়ে হলো, জামাই পড়ান কলেজেতে—
বিলেতফেরত ইঞ্জিনীয়ার, পড়া নিয়েই থাকে।
খোকা করলো গ্লাসগো থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ—
স্বামীর সাথে বিলেত গিয়ে পুরলো মনের আশ।…
মেয়ের ঘরে লক্ষ্মী এলো – আমার তিতিরসোনা।
‘দিদিমায়ের ধাঁচ পেয়েছে’ বললো জনা জনা। …
ঠাকুর, তোমার অসীম দয়া – আজ বুঝেছি মনে।
এই সাধারণ মেয়েকে তুমি দাওনি রেখে কোণে।
জগতসভায় দিয়েছো স্থান, আনন্দে বিভোর
তোমায় নমি – পার করে দাও শেষ খেয়াটি মোর।
— শ্রীমতি বীণাপাণি ঘোষ দস্তিদার
জন্ম কলকাতায়, বড় হয়েছেন বি. ই. কলেজ ক্যাম্পাসের প্রফেসস্ একদা গৃহকোণকোয়ার্টারে। পড়াশোনা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিয়ে এবং তথ্যবিজ্ঞানে পিএইচডি করার সূত্রে বিদেশগমন। কর্মসূত্রে বর্তমানে মিশিগানের বাসিন্দা।
স্কুলজীবন থেকেই নিয়মিত লেখেন। বাতায়ন, পরবাস, ঋতবাক এবং আরো বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শকুন্তলার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস।
শকুন্তলার লেখা গান ভিডিওতে পরিবেশন করেছেন রূপঙ্কর বাগচী, নচিকেতা চক্রবর্তী, কায়া ব্যাণ্ড।
প্রকাশিত গ্রন্থ পৃথা (ঋতবাক প্রকাশনী)।