ড্যাফোডিলস্: শকুন্তলা চৌধুরী                           

শকুন্তলা চৌধুরী

স্নান সেরে এসে, সোফায় গা এলিয়ে দিল মেধা।

আজকের দিনটা ছিল খুব লম্বা।
থিসিস প্রায় শেষ হওয়ার মুখে, তাই নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই এখন ওর।
সকালে ব্রেকফাস্ট করেই ইউনিভার্সিটিতে চলে গিয়েছিল, লাঞ্চব্যাগে একটা আপেল আর পিনাটবাটার স্যাণ্ডউইচ ভরে নিয়ে। নিজের অফিসে বসে একমনে কম্প্যুটারে লিখে যাচ্ছিল থিসিসের ৬ নং চেপ্টার। মাঝে একবার লাঞ্চ, তারপর আবার ঘাড় গুঁজে লেখা।

সন্ধ্যে সাতটায় বিল্ডিং সিকিউরিটি টহল দেয়—সপ্তাহান্তে থাকে জন। বয়স্ক ভারিক্কী চেহারা, মিলিটারী থেকে অবসর নেওয়ার পর এখানে কাজ করছে। দেখলে মনে হয় বয়স পঁয়ষট্টি পার হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও বেশ শক্তপোক্ত। ইচ্ছে করলে জন এখন সরকারী ভাতা নিয়ে অবসরজীবন যাপন করতে পারে, কিন্তু করবে না। খুব পরিশ্রমী এবং আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন এদেশের মানুষরা— শুধু শুধু বাড়ীতে বসে থাকবে না। যতদিন পারে কাজ করবে।

এই ক’বছরে জন মেধাকে ভালো করে চিনে গেছে— সপ্তাহান্তে মেধা ছাড়া প্রায় কেউই এতো রাত অবধি থাকে না ডিপার্টমেন্টে। আর আজ তো শনিবারের রাত, ডিপার্টমেন্টে এখন কেউই নেই। বলতে গেলে সারা বিল্ডিংই ফাঁকা। পিটার একবার এসেছিল দুপুরের দিকে, ঘন্টাখানেক কাজ করে চলে গেছে। ও পরের বছর থিসিস জমা দেবে। যাওয়ার সময় মেধার দরজায় দাঁড়িয়ে – “ডোন্ট কিল ইওরসেল্ফ অন্ দিস—লাইফ ইজ্ স্টিল ওয়ার্থলিভিং।…সি ইউ!” বলে হাসতে হাসতে চলে গেল পিটার।

মেধার ‘অতি মনোযোগ’ নিয়ে বাকী গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টরা ওকে ক্ষ্যাপায়, কিন্তু কি করবে বেচারা! ভারতবর্ষের প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে ঠেলে তোলার চেষ্টা করতে করতে এটাই অভ্যাস হয়ে গেছে ওর। স্কুল-কলেজে সবসময়ই এই চাপটা কাজ করে গেছে ওর মধ্যে। তারপর চারবছর আগে, নব্বই-য়ের দশকের গোড়ায়, পি. এইচ. ডি করতে এদেশে আসা। বিদেশে এসে তো আরই ভয়—যদি রেজাল্ট ভালো নাহয়…যদি স্কলারশিপ কাটা যায়! নিজের পয়সা দিয়ে এদেশে পি এইচ ডি করা তো সাধ্যের বাইরে! সুতরাং…!

সবে বসন্তকাল শুরু হতে যাচ্ছে আমেরিকার এই শীতপ্রধান শহরে।
মেধা জানে যে বসন্তের শুরু থেকে গরমের কটা মাস এখানে সবাই চুটিয়ে উপভোগ করে —ছাত্র-ছাত্রীরাও, শিক্ষকরাও। ইস্টারের পর থেকেই এই ছুটি-ছুটি ভাবটা চলে আসে।
সারা সপ্তাহ কাজ করলেও, শুক্রবার তাড়াতাড়ি পাট গুটিয়ে সবাই এখন সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে চলে গেছে। কিন্তু মেধা কোথাও যায়নি।

জন যথারীতি দরজায় টোকা দিলো—“হাই ইয়ং লেডি….!”
মেধা মুখ তুলে তাকাল— “হ্যালো জন, হাউ আর ইউ?”
জন হাসল— “আয়াম্ গুড…আয়াম্ গুড! জাস্ট ওয়ান্টেড টু লেট ইউ নো দ্যাট ইউ আর এলোন ইন দ্য বিল্ডিং নাউ। মে বি ইটস্ টাইম টু গো হোম?”
মেধা বলল— “আই উইল, সুন…জাস্ট ফিউ মোর মিনিটস্!”
জন বলল—“ওকে, ক্লোজ দ্য ডোর দেন—ইউ আর লিটারালি এলোন হিয়ার এ্যাণ্ড দ্য নেক্স্ট সিকিউরিটি রাউণ্ড ইজ এ্যাট টেন পিএম।”
মেধা বাধ্য মেয়ের মতো গিয়ে অফিসের দরজাটা লক করে দিয়ে এল।
যদিও ও জানে যে এটা কিছু একটা এমন বিপজ্জনক জায়গা নয়, তবু জনের এই পিতৃসুলভ সাবধানবাণীটা শুনতে মেধার ভালোই লাগে।

তবে ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা বাজতে, জোর করেই উঠে পড়েছিল ও। হাত, ঘাড় সব ব্যথা করছে— আর নয়। ফেরার পথে ‘টেস্ট অফ্ ব্যাঙ্কক’ থেকে গ্রীণ চিকেন কারী তুলে নিল—রাতের খাবার। বড়ো রাস্তার ওপর এই ছোট্ট রেঁস্তোরাটা বেশ কম দামে সুস্বাদু থাইল্যান্ডের খাবার বিক্রী করে। রান্না শেষ হয়ে গেলে, মেধা এখান থেকেই খাবার নিয়ে আসে।
সারা সপ্তাহে সময় হয়না, তাই প্রতি রবিবার ঘরের সব কাজ করে রাখে মেধা। সকালে উঠেই ঘর ভ্যাকুয়াম করে, বাথরুম পরিষ্কার করে নেয়। তারপর লন্ড্রি মেশিনে কাপড়-জামা ধুয়ে, শুকিয়ে তৈরী করে রাখে সারা সপ্তাহের জন্য। তারপর যায় বাজারে। এ’দেশের গ্রসারী স্টোর্সগুলো খুব পরিষ্কার আর সুন্দর করে সাজানো—এক দোকান থেকেই প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে নেওয়া যায় অল্পসময়ের মধ্যে। জিনিসপত্র কিনে এনে ও একবারে সারা সপ্তাহের মতো রান্না করে রেখে দ্যায়। পাঁচ-ছয়দিন সেই রান্নাতেই চলে, কিন্তু শনিবারে অনেকসময় খাবার শেষ হয়ে যায়। তখন হয় কোনো ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ীর পার্টি, নয় কেনা খাবার ভরসা। এখন তো পার্টিতে যাওয়ার একেবারেই সময় নেই, তাই কম পড়লে শনিবার খাবার কিনে আনে মেধা। একটু মুখবদলও হয়— যেমন আজও ভাতের সঙ্গে থাই চিকেন কারী খেতে ভালোই লাগল। প্লেট বার না করে, একেবারে বাক্স থেকেই খেতে শুরু করে দিল মেধা – আর পুরোটাই খেয়ে নিল মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে।ওর যে খুবই খিদে পেয়েছিল সেটা এতক্ষণে বুঝতে পারল। টেবিলটা পরিস্কার করে, স্নান করে, এবার একটু বিশ্রাম নেবে। কাল ছুটি। দেরী করে উঠলেও হবে। বাড়ীর কাজ সব সেরে, বিকেলের দিকে একবার ইউনিভার্সিটি যাবে।

২৫-তলা বিল্ডিং-এর এই ১৫ তলার ছোট্ট এক বেডরুমের এ্যাপার্টমেন্টটা মেধার খুব পছন্দের। সোফায় গা এলিয়ে দিলেই জানলা দিয়ে শহরের আলোগুলো দেখা যায়। মেধার মনে হয় ও যেন মেঘের ওপরে বসে শহরটাকে দেখছে। রাতের শহরের একটা অন্য মায়া আছে। ধোঁওয়া-ধুলোয় ভরা দিনেরবেলার ব্যস্ত শহরটা এখন যেন বাচ্চা ছেলের মতো হাতমুখ ধুয়ে চুপ করে বসেছে। চারদিক শান্ত — ১৫ তলার ওপর থেকে তো বটেই। আশপাশের এ্যাপার্টমেন্ট-এ স্টুডেন্ট নয়, বয়স্ক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলারা থাকেন। হৈ-হট্টগোল সেইজন্য কম এই ফ্লোরে। ঠিক এ জন্যেই এই এ্যাপার্টমেন্টটা পছন্দ করেছিল মেধা, যদিও দাম একটু বেশী পড়েছিল নীচের তলার এ্যাপার্টমেন্টগুলোর চেয়ে।

মেধার পাশে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত টিচার মিস্টার আরভাইন, একা। ঠিক উল্টোদিকে মিসেস্ জেনিংস, স্বামী মারা যাওয়ার পর শহরতলীর বাড়ি বিক্রী করে এখানে উঠে এসেছেন। আর কোণাকুণি থাকেন মধ্যবয়সী মিস্টার এ্যাণ্ড মিসেস ফিশার — ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন একবছরের এ্যাসাইনমেন্টে, শহরেরই আরেকটি ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেন।
মিস্টার আরভাইন খুব একটা মিশুকে নন। একাই থাকেন—স্ত্রী মারা গেছেন না ডিভোর্স হয়ে গেছে সেটা বোঝার উপায় নেই, মেধার জানার কোনো কৌতুহলও নেই। মেধার সঙ্গে যাতায়াতের পথে দেখা হয়— ঐ হাই-হ্যালো পর্যন্ত।

মিস্টার এ্যাণ্ড মিসেস ফিশার খুব হাসিখুশী এবং প্রাণবন্ত। ভারতীয় রান্না ওনাদের দারুণ পছন্দ। মেধাকে বেশ কয়েকবার উইক-এন্ডে নেমন্তন্ন করে ‘ইন্ডিয়ান কারী উইথ রাইস্’ খাইয়েছেন। বই দেখে নিজেরাই ভারতীয় রান্না শিখেছেন। আমেরিকার ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলো যে রান্নায় ইংল্যান্ডের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোর কাছে দাঁড়াতে পারেনা, সেটাও খুব জোরের সঙ্গে জানিয়েছেন।

মেধা একবারই ডেকেছিল ওনাদের—ফিশফ্রাই করেছিল, সঙ্গে একদম বাঙালী রেসিপিতে ভাজা মুগের ডাল আর সর্ষে-ইলিশ। ইলিশমাছ কিনতে অবশ্য বাংলাদেশী দোকানে গিয়ে উঠতে পারেনি, তাই লোকাল শ্যাড মাছ কিনে রান্না করেছিল—যেটা খেতে একদম ইলিশমাছেরই মতো লাগে। ফিশফ্রাইটাও করেছিল একটু বড়ো সাইজের লোকাল স্মেল্ট মাছ দিয়ে, দেশে মা যেমন করে হলুদ-নুন মেখে আদা-পেঁয়াজের রসে ভিজিয়ে রেখে তোপশে মাছ ভাজেন ঠিক সেইভাবে। খেয়ে স্বামী-স্ত্রী মুগ্ধ। রেস্টুরেন্টে এগুলো কেন পাওয়া যায় না তাই নিয়ে খুব আক্ষেপ করে শেষে মেধার থেকে ডিটেইলসে রেসিপি নিয়ে নিলেন দুজনে।

মিসেস জেনিংস খুব কম কথা বলেন, কম বাইরে বের হন — কিন্তু হাসিখুশী, স্নেহপ্রবণ। ওনার হাসিতে একটা শুদ্ধ উজ্জ্বল ভাব আছে। গত সপ্তাহে ইস্টারের দিন উনি মেধাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন ওনার সঙ্গে সাপার খেতে। একটা ফুলের ব্যুকে নিয়ে গিয়েছিলো মেধা, মিসেস জেনিংস ভীষণ খুশী হয়েছিলেন। বারবার বলতে লাগলেন— “আই লাভ ফ্লাওয়ার…আই মিস্ গার্ডেনিং….দ্যাট্ ইজ্ দ্য ওনলি থিং আই মিস্ আফটার মুভিং হিয়ার…নট্ টু টক্ এ্যাবাউট মাই ডিয়ার বব্।” মিস্টার রবার্ট জেনিংস সেলস্-এ কাজ করতেন। অবসর নেওয়ার পর শহরতলীর ছোট্ট বাড়ীতে স্বামী-স্ত্রী থাকতেন। হঠাৎ হার্ট-এ্যাটাকে মারা গেছেন পাঁচবছর আগে – মিসেস জেনিংস এখনও স্বামীকে এবং তাঁদের আটচল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনকে বুকে আঁকড়ে ধরে আছেন। কিন্তু একা একা বাড়ী মেইন্টেইন করতে না পেরে শহরের মধ্যে, যাকে এরা ‘ডাউনটাউন’ বলে, সেখানে চলে এসেছেন স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাসস্থানটি বিক্রী করে দিয়ে।
বাড়ীর কাজ তো কম না! বাড়ী পরিস্কার ছাড়াও— লন ঠিক রাখা, বরফ পরিস্কার করা……লোক দিয়ে কাজ করানোটা খুব বড়লোক ছাড়া এ’দেশীয়রা কমই করে। সাধারণ লোক নিজেরাই এইসব কাজ করে নেয়, এমনকি ঘর রঙ করা এবং বাড়ী মেরামতের অন্যান্য ছোটখাট কাজও। ভারতীয়রা আবার ঠিক তার উল্টো। সবকিছুর জন্যই তারা লোক রাখে – খুব বড়লোক হওয়ার দরকার নেই তার জন্য।

মিসেস জেনিংসের এক মেয়ে, মেরী। ডেন্টিস্ট। অন্য প্রদেশের এক শহরে থাকে। ডিভোর্সী। তার আসার কথা ছিল ইস্টারের ছুটিতে কিন্তু হঠাৎ কোনো কারণে আটকে গেছে, আসতে পারেনি। মিসেস জেনিংস চিন্তিত মেয়েকে নিয়ে।

বললেন— “শী ইজ্ ফোরটি-ফাইভ ইউ নো, ডেটিং সিন্স সিক্সটিন বাট্ স্টিল নট্ সেটলড্।…ইন্ আওয়ার টাইম, উই ওয়্যার নট্ দ্যাট চ্যুজি…নাইদার ভেরী ডিমান্ডিং…অ্যান্ড লাইফ ওয়েন্ট বাই। বাট দিস্ জেনারেশন্ ইজ্ সো ডিফারেন্ট। …শী ফাইনালী লাইকড সামওয়ান, গট্ ম্যারেড বাট্ দেন গট্ ডিভোর্সড্ ইন্ ফোর ইয়ার্স।…উইশ দিস্ জেনেরেশন লার্নড্ সামথিং ফ্রম দ্য ইস্ট — পেশেন্স এ্যাণ্ড স্টেবিলিটি।” মেধা হাসল,
তারপর কথা ঘোরানোর জন্য সামনের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল – “নাইস্ ফ্লাওয়ারস্।”

মিসেস জেনিংসও তাকালেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন – “ড্যাফোডিলস্, দ্য ফ্লাওয়ার অফ্ স্প্রিং। … বব্ বট্ দিস্ ফ্রম্ এ্যান্ আর্ট এক্জিবিশন্ অ্যান্ড গিফ্টেড মি অন্ মাই বার্থ ডে। ভেরী নাইস পেন্টিং, দ্য ফ্লাওয়ারস্ ল্যুক রিয়েল। হি নিউ আই লাভ্ ড্যাফোডিলস্ – মাই এ্যানসেস্টারস্ কেম্ ফ্রম্ ওয়েলস্… ড্যাফোডিল ইজ্ দ্য ন্যাশনাল ফ্লাওয়ার অফ্ ওয়েল।।…বব্ গেভ মি দিস্ অ্যান্ড সেইড্ ‘নাউ ইট্ উইল বি দেয়ার উইথ ইউ অল্ ইয়ার লং, ফর এভার’। …. দোজ্ ড্যাফোডিলস্ আর হিয়ার, বাট বব্ ইজ নট্।”

একমিনিট চুপ করে থেকে নিজেই কথা ঘোরালেন – কাউকে ডেকে এনে নিজের দুঃখের কাহিনী শোনাবে, এমন দূর্বল জাত এরা নয়। হাসতে হাসতে বললেন – “ড্যাফোডিল ইজ্ দ্য কুইন্ অফ্ অল্ ফ্লাওয়ারস্। ল্যুক এ্যাট্ দ্য ক্যল্যর, অ্যান্ড সো ডেলিকেট ইয়েট স্ট্রং! ইট্ ওয়েটস্ থ্রু দ্য উইন্টার মান্থস্ উইথ পেশেন্স এ্যাণ্ড ক্যরেজ, এ্যাণ্ড ব্রিংস্ দ্য ফার্স্ট মেসেজ অফ্ স্প্রিং এ্যাজ্ স্যুন এ্যাজ্ পসিবল্। …আই টোল্ড মেরী টু মেক শিওর দ্যাট দিস্ পেন্টিং অফ্ ড্যাফোডিলস্ ইজ্ ইন্ মাই কফিন। আই উইল ক্যারি দ্য স্প্রিং উইথ মী হোয়েন আই মিট্ বব্।…কাম্ অন্ ডিয়ার— টাইম টু হ্যাভ্ সাপার।”

মেধা ডাইনিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে হেসে বলল – “ইওর স্মাইল ইটসেল্ফ ঊড্ রিমাইন্ড এভরিওয়ান্ অফ্ স্প্রিং।”

মিসেস জেনিংস হেসে বললেন— “ইউ আর ট্যু কাইন্ড অ্যান্ড জেনেরাস্, ডিয়ার!”

মেধা বুঝতে পারে যে মিসেস জেনিংস স্বামীর মৃত্যুতে খুব একা হয়ে গেছেন, কিন্তু মেয়ের কাছে গিয়ে থাকার কথা তিনি একেবারেই ভাবেন না। মেয়েও কখনো বলে কিনা জানা নেই – তার নিজের জীবনেও হয়তো সমস্যা আছে যার জন্যে সে একাই থাকতে চায়! অত্যন্ত স্বনির্ভর এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন জাতি এরা— সেই ব্যাপারে কিন্তু এরা প্রাচ্যের অনুসরণে দুই-তিন প্রজন্ম একছাদের তলায় থাকার কথা ভাবতেই পারেনা। এদের মতে, তাতে সব প্রজন্মেরই ক্ষতি হয়— কোনো ব্যক্তিত্ব বা সম্পর্কই সঠিকভাবে আলো-হাওয়া পেয়ে বেড়ে উঠতে পারে না।
মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিশারও তাই— ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো আছে, ওনারা ওনাদের মতো।

নিশ্চয়ই মিস্টার আরভাইনেরও একই গল্প— স্ত্রী না থাকলেও সন্তান হয়তো বা আছে, কিন্তু যে যার মতো।

 

মেধা অনেক ভেবেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল।
দেশে ওদের নিজেদের সংসারের কথা মনে পড়ে ওর। নিজেরা তিন ভাইবোন ছাড়াও, জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো-পিসতুতো-মামাতো-মাসতুতো ভাইবোনদের নিয়ে বিরাট পরিবার। সবার সঙ্গেই একটা মনের টান অনুভব করে মেধা, আজও।

সবাই মিলে তাসখেলা, ভূতের গল্প, সিনেমা দেখতে যাওয়া—এসবের মজাই আলাদা। অবশ্য বকার জন্যও মা-বাবা ছাড়া আরও বহু লোক ছিল। কে কার ছেলে বা মেয়ে সেটা বড়ো কথা নয়, কতটা কি দোষ করেছে বা আদৌ দোষ করেছে কিনা সেটাও বড়ো কথা নয় – বকার দরকার মনে হল তো বকে দিল, এমনও হয়েছে বহুবার। তাতে কি ওদের ব্যক্তিত্ব পূর্ণ বিকশিত হতে পারেনি? একটু ভীতু ভীতু ভাব রয়ে গেছে? …আর অন্য প্রজন্মরা? মা-কাকীমা-জেঠিমাদের সঙ্গে যে পিসীমাদের একটা চাপা টেনশন চলত, সেটা অনেকসময়ই লক্ষ্য করেছে মেধা— সেই চিরকালীন ‘বৌ সাপ্রেশন’ এর ব্যাপার। তবে বাড়বাড়ি কিছু দেখেনি— সবাই মানিয়ে নেওয়াতে বিশ্বাস করত। বিশেষ করে বৌ হয়ে যে আসছে, তাকে শ্বশুরবাড়ীর ‘সবকিছু’ মানিয়ে নিতে হবে— এমন কথা তো বাপের বাড়ী থেকেই তাদের বলে দেওয়া হত। অতএব…!

সম্পর্কের এইসব টানাপোড়েনে মনের ওপর যে কোনো প্রভাব পড়ে না, এমন কথা বলতে পারে না মেধা। তবে, ভালো-মন্দ দুই নিয়েই ভারতীয় সমাজব্যবস্থার পুরো প্যাকেজটা – এইরকমই বরাবর ভেবে এসেছে সে। প্রশ্নটা মনে জাগছে এখন – এদের কথা শুনে, এদের দেখে। আত্মবিশ্বাস এবং ঋজুতা এদের মধ্যে খুব বেশী— সেটা কি এদের সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন? অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা কি এদের সম্পর্কের গোড়ায় জলসিঞ্চন করে? কে জানে — হবেও বা!

মেধার চিন্তাসূত্র ভেঙে গেল টেলিফোনের আওয়াজে। রাত দশটা বেজে গেছে – এখন কে ফোন করবে? মা-বাবাকে মেধা বলে রেখেছে যে প্রতি রবিবার রাতে ও ফোন করবে। এর মাঝে যদি হঠাৎ কোনো দরকার হয় তাহলে বলা আছে পরপর দু’বার ফোন ক’রে ঠিক তিনটে রিং হলেই ছেড়ে দিতে, দু’বারই—তাহলেই মেধা বুঝবে যে ওটা বাড়ীর ফোন আর ও কল্ ব্যাক করবে। ইন্ডিয়া থেকে অত পয়সা দিয়ে কল্ করতে বারণ করেছে মেধা। মনে হয় না এটা বাড়ীর ফোন, তবু মেধা অপেক্ষা করল — না, একবারই বাজলো ফোনটা আর পুরো পাঁচবার রিং করে ‘আন্সারিং মেশিন’-এ চলে গেল। কিন্তু কেউ মেসেজ ছাড়ল না। যাক্, তাহলে দরকারী ফোন নয়। আজকাল মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা ফোনও আসে, তাই বাজলেই গিয়ে ফোন ধরে না মেধা। মেশিন তো আছেই লাগানো ফোনের সঙ্গে – দরকার হলে মেসেজ ছাড়, মেধা সময় মতো উত্তর দেবে। ব্যক্তিস্বাধীনতার এই সম্মানটা এদেশে এসেই দেখছে, আর একটু একটু করে যেন ভালোবেসে ফেলছে মেধা।

ও বড়ো হয়েছে যাতায়াতের পথে নীচের বাড়ীর কাকীমা আর পাশের বাড়ীর দিদির সঙ্গে দুমিনিটের কথা ছুঁড়ে দিতে দিতে, স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথে ওয়াটার বোটলের জলটা না খেয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে গিয়ে উল্টোদিকের কাকুর ধমক খেয়ে থেমে যেতে যেতে, ছুটির দিনে খেতে বসার আগে হঠাৎ কোনো অতিথির আগমনে মাকে রান্নাঘরে গিয়ে নতুন করে রান্না বসানোয় সাহায্য করতে করতে…।

অথচ আজ মনে হয় যেন একটু নীরবতা খারাপ নয়, সবাই সবার জন্য একটু জায়গা যেন ছেড়ে রাখা দরকার, ‘প্রাইভেসী’ শব্দটা যেন খুব কিছু নিন্দনীয় নয় … মেধা কি তবে এ্যামেরিকান হয়ে গেলো?

নিজের মনেই একটু হেসে, ঘড়ির দিকে তাকাল – রাত সাড়ে দশটা। উঠতে হবে এবার। কাল সকাল থেকে আবার অনেক কাজ।

পরেরদিন ঘুম থেকে উঠতে তবু একটু দেরীই হয়ে গেল মেধার। সপ্তাহে একদিন বোধহয় শরীরটাও একটু বিশ্রাম চায়। দাঁত ব্রাশ করে এসেই কাজে লেগে পড়ল মেধা, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা নিয়ে। আজ বাজার করতে হবে না, গত সপ্তাহে একটু বেশী করে গ্রসারী করে রেখেছিল— সুতরাং একটু সময় বাঁচল। রান্না সেরে, লাঞ্চ খেয়ে, সোজা ইউনিভার্সিটির দিকে হাঁটা দিল ও। অন্তত চার-পাঁচ ঘন্টা কাজ করতেই হবে আজ। সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে সুপারভাইজারকে থিসিসের ফার্স্ট ড্রাফ্ট দেওয়ার কথা আছে — ডেডলাইন মিস্ করা চলবে না।

কাজ শেষ করে যখন ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোল, ঘড়িতে তখন রাত ন’টা। যদিও ক্লান্ত লাগছে, তবু একটা চ্যাপ্টার পুরো শেষ করে এসেছে ভেবে একটু হাল্কা লাগছে মেধার। কাল নতুন চ্যাপ্টার শুরু করবে। থিসিসের কাজ তো সবই শেষ, নোটও লেখা আছে — এখন শুধু পরপর সাজিয়ে চ্যাপ্টারগুলো লিখে যাওয়া। তাতেও সময় কম লাগে না।

ডিপার্টমেন্ট থেকে মেধার এ্যাপার্টমেন্ট ঠিক সাত মিনিটের হাঁটা পথ। ঠাণ্ডা হাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে মাথাটা ছেড়ে গেল। খুব রিফ্রেশিং লাগে এই হাঁটাটা মেধার, শীতকালেও।
রাস্তাটা পার হতে গিয়ে একটুক্ষণ দাঁড়াল মেধা। লাল আলো জ্বেলে পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনে, একটা এ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে গেল। ব্যাপার কি?

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে ডনের সঙ্গে দেখা হল, বিল্ডিংয়ের জেনিটার। ওকে দেখে মনে হচ্ছে আপসেট।
মেধা জিগেস করলো— “হোয়াট হ্যাপেনড্, ডন্?”
ডন্ সংক্ষেপে শুধু বললো— “ইওয়োর নেবার – মিসেস্ জেনিংস্…!”
থমকে গেলো মেধা। …. মিসেস্ জেনিংস্?!
লিফটের সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন বিল্ডিংয়ের আরও কিছু বাসিন্দা, মিঃ আরভাইনও ছিলেন সেখানে। মেধাকে দেখে এগিয়ে এলেন। যা বললেন তার সারমর্ম হল এই যে, কিছুক্ষণ আগে মিসেস্ জেনিংসের এ্যাপার্টমেন্ট থেকে ওনার মৃতদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উনি মারা গেছেন গতকাল রাতে কোনো সময়ে – ডাক্তারের রিপোর্ট না এলে বোঝা যাবে না যে ঠিক কখন ঘটনাটা ঘটেছে। মেয়ের সঙ্গে প্রতিদিনই দু’বার ফোনে কথা হত মিসেস্ জেনিংসের — একবার সকালে আর একবার সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। আজ সকালে ফোনে মা’কে না পেয়ে, আন্সারিং মেশিনে মেসেজ ছেড়েছিল ওনার মেয়ে। বলা বাহুল্য যে কেউ কল্ ব্যাক করেনি। বিকেল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত আরও দু’-তিনবার চেষ্টা করেও যখন পায়নি, তখন এ্যাপার্টমেন্টের অফিসে ফোন করেছিল ওনার মেয়ে এবং বলেছিল দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে।

ডন্ ওপরে এসে দরজায় নক্ করে উত্তর পায়নি। তারপর ঐ ফ্লোরের অন্য সবাইকে ডাকার চেষ্টা করেছে। মিস্টার এ্যাণ্ড মিসেস্ ফিশার শুক্রবার বিকেলে বেড়িয়ে গেছেন কোনো ট্রিপে আর মেধা এ্যাপার্টমেন্টে ছিল না। মিস্টার আরভাইনও ছেলের বাড়ী গিয়েছিলেন, তক্ষুণি ফিরেছেন। দু’জনে গিয়ে আরো কয়েকবার দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে শেষে জেনিটারের মাস্টার কী দিয়ে দরজা খুলে, হাতুড়ি দিয়ে ভেতর থেকে লাগানো চেইনটা ভেঙে, এ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিলেন। মিসেস্ জেনিংসের বডিটা পড়েছিলো হলওয়েতে, টেলিফোনের ঠিক সামনে। হঠাৎই হার্ট-এ্যাটাক হয়েছিল বলে মনে হয়। মিঃ আরভাইন্-ই এ্যামার্জেন্সী নাম্বার ৯১১ কল্ করে পুলিশ এবং এ্যাম্বুলেন্স ডেকেছেন। ওনার মেয়েকেও জানানো হয়েছে, কালকের ভোরের ফ্লাইটে সে আসছে। তারপর শেষকৃত্য হবে। ততক্ষণ ঠাণ্ডাঘরে রাখা থাকবে মিসেস জেনিংসের মৃতদেহ।

মেধা বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে নিজের এ্যাপার্টমেন্টের দিকে পা বাড়াল।
এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না যে শান্তশিষ্ট হাসিমুখের ওর সেই প্রতিবেশী মিসেস জেনিংস আর নেই। ঠিক উল্টোদিকের দরজার পেছনে এই কাণ্ডটা ঘটে গেছে, আর ও কিছু বুঝতেই পারেনি! নাকি বোঝার চেষ্টাই করেনি! … কালকে রাতের ফোনটা কি ওর ধরা উচিত ছিল? শরীর খারাপ লাগছে বলে কাউকে কি ফোন করতে গিয়েছিলেন মিসেস্ জেনিংস্? শনিবারের রাতে মেয়েকে না পেয়ে, প্রতিবেশীদের?…ভেবে কোনো লাভ নেই এখন। কেউ তো মেসেজই ছাড়েনি! মেসেজ ছাড়লে নিশ্চয়ই মেধা কিছু করত!

ঘাড়ে একটা ঝাঁকানি দিয়ে জোর করেই নিজেকে আবেগ থেকে বাস্তবের মাটিতে টেনে আনলো ও।

স্নান করে এসে, সকালের রান্না করে যাওয়া চিকেনের ঝোল ভাত আর স্যালাড দিয়ে ডিনার সারল।
তারপর অভ্যাসমতো সোফায় গা এলিয়ে দিল।
মনটা কিন্তু ঘুরেফিরে সেই মিসেস্ জেনিংসের দিকেই চলে গেল।
তিয়াত্তর বছর বয়স হয়েছিলো ওনার। প্রায় মেধার দিদিমা’র বয়সী।

ও এখানে পড়তে আসার ঠিক একবছর আগে, সত্তর বছর বয়সে, মেধার দিদিমা মারা যান।
নিজের বাড়ীতে, আত্মীয়স্বজন পরিবৃতা হয়ে।
দিদিমা’র বলা ছিল যে মৃতদেহ যেন ‘বাসী’ না হয়। ভোররাত্রে মারা যান, বিকেলে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল—বেলফুলের মালা আর চন্দনে সাজিয়ে। কি বৃষ্টি সেদিন! আকাশও যেন কাঁদছিল।
সারাজীবন সংসারের সব প্রতিকূলতার সঙ্গে মানিয়ে চলা দিদিমা, সেই একদিনের জন্য যেন রাণী!
সবাইকে কাঁদিয়ে, নিজে হাসতে হাসতে, রাণীর মতো বিদায় নিয়েছিলেন তিনি সংসারের রঙ্গমঞ্চ থেকে।
মিসেস্ জেনিংস্-ও কি রাণীর মতোই বিদায় নেবেন? আরেক রঙ্গমঞ্চের রাণী হয়ে, অন্য দেশে!
স্বনির্ভরতায় মাথা উঁচু করে চলা, নির্জন একাকিত্বে সাহসের সঙ্গে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া, হিমশীতল মর্গে মেয়ের শেষকৃত্যের অপেক্ষায় ‘বাসী’ হয়ে যাওয়া শরীর নিয়েও, তিনি হেসে চলে যাবেন রাণীর মতো?!

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সোফাতে, বুঝতেই পারেনি মেধা। ঘুম ভাঙল চোখে রোদ পড়তে।
বাইরে আজ ঝকঝকে দিন। সোমবারের সকাল।
ব্যালকনির দরজাটা একটু খুলল — নাতিশীতোষ্ণ হাওয়া বইছে।
বসন্ত এসে গেছে, ড্যাফোডিলসরা সব ফুটে উঠছে।

শকুন্তলা চৌধুরী

ডঃ শকুন্তলা চৌধুরীর জন্ম কলকাতায়, বড় হয়েছেন বি. ই. কলেজ ক্যাম্পাসের প্রফেসরস্  কোয়ার্টারে। পড়াশোনা কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিয়ে এবং তথ্যবিজ্ঞানে পিএইচডি করার সূত্রে বিদেশগমন। কর্মসূত্রে বর্তমানে মিশিগানের বাসিন্দা। 

স্কুলজীবন থেকেই নিয়মিত লেখেন। সানন্দা, শনিবারের আসর, ইরাবতী, বাংলা ওয়ার্ল্ডওয়াইড, বাতায়ন, সাহিত্যকাফে, পরবাস, ঋতবাক এবং আরো বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শকুন্তলার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস।  শকুন্তলার লেখা গান ভিডিওতে পরিবেশন করেছেন রূপঙ্কর বাগচী, নচিকেতা চক্রবর্তী, কায়া ব্যাণ্ড। প্রকাশিত গ্রন্থ পৃথা (ঋতবাক প্রকাশনী)।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top