দানাকিল ডিপ্রেসনের বেস ক্যাম্পে

মঈনুস সুলতান

ইথিওপিয়ার বালুকায় বিস্তীর্ণ— কাঁটাঝোপ ও আগ্নেয়শীলায় পরিকীর্ণ এ প্রত্যন্ত অঞ্চল দানাকিল ডিপ্রেসন নামে পরিচিত। লাভাখন্ড ছড়ানো উপত্যকায় গ্রাম-বস্তি কিছু নেই, তবে আরতে আলে নামক আগ্নেয়গিরিতে ট্র্যাকিং করার জন্য আছে ভারি রক কেটে-কুঁদে তৈরী একটি বেস ক্যাম্প। গাছ-বৃক্ষহীন পরিবেশে লু হাওয়া বয় হামেশা, তাতে ওড়ে ছাইরঙের বালুকা। এখানে এসে পড়ে প্রথমেই মনে হয়— জনবসতি থেকে এত দূরে, এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসাটা কী ঠিক হলো?

কিন্তু এসে যখন পড়েছি, এখানকার পরিবেশটা অনুভব করার উদ্যোগ নেই। কিছুক্ষণ আমি ঘুরে ঘুরে শিলাপাথরে ঘাসের প্রলেপ দেয়া স্টোন-কটেজগুলো খুঁটিয়ে দেখি। পাশাপাশি জোড়া কটেজের দাওয়ায় বসে দুজন মেহনতি মানুষ জিরিয়ে নিচ্ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে সুন্দর করে হেসে বলেন, ‘ওয়েলকাম.. থ্যাংকয়্যু.. গুডমর্নিং..।’

স্টোন-কটেজের দাওয়ায় বসে দুজন মেহনতি মানুষ

বুঝতে পারি, এরা বেস ক্যাম্পে উটের সহিস হিসাবে কাজ করেন। বিকাল তিনটার দিকে না হয় বললেনই গুডমর্নিং, উষ্ণ সম্ভাষণটুকু ভালো লাগে। গাইড চিনুয়া আলিমায়ুকে জিজ্ঞেস করি, একটি কটেজে ঘন্টা খানেক একা বিশ্রাম করতে পারি কী? চিনুয়া তৎক্ষনাৎ ছুটে যায়, বেস ক্যাম্পের ম্যানেজারের সঙ্গে বাতচিত করে কটেজ এলটমেন্টের বন্দোবস্থ করতে।

চিনুয়া ফিরে আসতে একটু সময় নিচ্ছে। অধৈর্য হয়ে আমি এক পা-দু পা করে পায়চারি করি। ঘন্টা কয়েক পর লাভাস্তরের উপর দিয়ে ট্র্যাক করে আমরা যাব আরতে আলে আগ্নেয়গিরির দিকে। সকালে পারিপার্শিক পরিবেশে অনেকক্ষণ ট্র্যাক করেছি, পা দুটি যেন আর চলতে চাচ্ছে না। ঝড়-বৃষ্টির পর যে রকম মৃত্তিকার স্তরে স্তরে চুঁইয়ে যায় জলকণা, সে রকম দাঁড়িয়ে পড়তেই শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ছে ক্লান্তি। বুঝতে পারি, পায়ের মাসোলগুলোকে জিরানোর সুযোগ না দিলে— সন্ধ্যাবেলা আরতে আলে আগ্নেয়গিরির দিকে ট্র্যাকিং করা মুশকিল হবে।

স্টোন-কটেজগুলোর ছায়ায় দাঁড়িয়ে, আজকের আচানক গন্তব্যের সাথে আমার নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত ভবিতব্যের সম্পর্ক নিয়ে চুাপচাপ ভাবি। পেছন থেকে কার যেন দীর্ঘশ্বাসের মতো হাওয়ায় ভেসে আসে ‘ ওম মণি পদ্মে হুম..।’ বৌদ্ধ ঘরানার এ হেন মন্ত্রোচ্চারণে রীতিমতো চমকে আমি গর্দান ফিরিয়ে তাকাই!

সাথে সাথে দৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু গোছর হয় না। তবে এবার চ্যান্টিং এর কায়দায় পরিষ্কার ইংরেজীতে শোনা যায়,‘ হেইল টু দি জুয়েল ইন দ্যা লোটাস।’ আমি ইতি-উতি তাকিয়ে সামনে বাড়ি। ফের শোনা যায়,‘ হেইল টু দি জুয়েল ইন দ্যা লোটাস।’ অপরাহ্ণের পড়ন্ত রোদে ফুটে ওঠা ঝিঙে ফুলটির মতো আমার ভেতরে জেগে ওঠে তুলকালাম কৌতূহল। তন্ত্রমন্ত্রের আওয়াজ দেয়া সাঙ্গাতটির তালাশ করতে হয় এবার।

স্টোন-কটেজেগুলোর পেছন দিকে আসতেই সন্ধান মেলে তার। মানুষটি চেনা,সপ্তাহ দিন আগে ইথিওপিয়ায় লবনের তেপান্তর পাড়ি দেয়ার সময় সাক্ষাৎ হয়েছিল। বৌদ্ধ শ্রমণদের কায়দায় মাথা মুড়ানো এ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানের নাম কোডি মিলৎজ। নওল তারুণ্যে খৃষ্টান মিশনারী হিসাবে ইনি বছর দুয়েক থাইল্যান্ডে কাটান। যিশু খৃষ্টের বাণী প্রচার করতে গিয়ে পরিচয় ঘটে তারাবাদা ঘরানার বৌদ্ধ শ্রমণদের সাথে।

গৌতমের অমর বচন তাকে এমনভাবে মোহাচ্ছন্ন করে যে, শুধুমাত্র ধর্মান্তরিতই হননি,মস্তক কামিয়ে ইনি তামাম অঙ্গে উল্কি করে আঁকিয়ে নেন বৌদ্ধধর্মের পবিত্র প্রতীক যথা শ্বেতশুভ্র ছত্র, ধ্বজা, শঙ্খ, ধর্মচত্র, যুগলমৎস্য ও পদ্মফুল প্রভৃতি। কোডি মিলৎজ এ মুহূর্তে লাভাস্তরে উবু হয়ে বসে ‘ওম মণি পদ্মে হুম’ জপে জপে নিদারুণ নিষ্ঠার সাথে খড়িমাটি দিয়ে আঁকছেন এ সব প্রতীকরাজি। আমি কদম কয়েক সামনে বেড়ে বিষয়টির তসবির খিঁচতে যাই। তিনি জোড় হাতে চোখেমুখে অনুনয় ফুটিয়ে ইশারায় নিষেধ করেন। অতঃপর ফিরে যান আঁকাজোকায়।

আমি খাজুল হয়ে এদিক-ওদিকে তাকাই, কী করবো ঠিক বুঝতে পারি না। আংকন থামিয়ে—ধ্যানভাঙ্গা গাঢ় নীল চোখে কোডি আমার দিকে তাকান। তারপর ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে, জোড়হাতে বিনম্র প্রণাম জানিয়ে বলেন,‘ ম্যান .. ইউ লুক সো টায়ার্ড এন্ড বার্নড্ আউট।’ তিনি একটু দূরে রাখা বয়ামের মতো জার থেকে প্লাস্টিকের পেয়ালায় পানীয় ঢেলে আমাকে তা অফার করে বলেন,‘ আই মেড দিস সান-টি, ড্রিংক ইট অ্যাজ তীর্থসলিল।’

রোদের নিদারুণ তজল্লায় তপ্ত হয়ে ওঠা সূর্য-চা বা কোডির ভাষায় তীর্থসলিলে চুমুক দিয়ে মুহূর্তে জান তর হয়ে ওঠে। পান করতে করতে আমরা টুকটাক বাতচিত করি। পুনর্জন্মের সম্ভাবনায় কোডি সাহেব আতঙ্কিত। ফের জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসার ঝুঁকি অনেক। জীন্দেগীতে কোডি পাপ করেছেন প্রচুর, চোর-চোট্টা বা খুনি-দাগি হয়ে পুনরায় জন্মালে কপালে হয়তো জুটবে কারাবাসের গর্দিস। তাই সর্বত্র বুদ্ধ-বচনের প্রতীক এঁকে চেষ্টা করছেন খানিকটা পূণ্য কামাই করতে।

 

ভারি বিনম্র ভাবে কোডি জানতে চান,‘আরেকবার জন্মানো নিয়ে তোমার কী কোন ভয়ভীতি নেই?’ পুনর্জন্ম কেনসেপ্টটা সঠিক হলে আমারও যে ঝুঁকি নেই, তা নয়, খরগোশ কিংবা খাটাশ হয়ে জন্মালে তো মস্ত মুশকিল হবে। তাই বলে যত্রতত্র খড়িমাটি দিয়ে গৌতম বুদ্ধের নামগান লিখবো, অতোটা ধর্মপ্রবণ আমি নই। খালি পেয়ালাটি ফিরিয়ে দিয়ে কোডিকে প্রতি-নমষ্কার জানাই।

তিনি হলুদাভ খড়িতে আঁকা জোড়া মাছের দিকে ইশারা দিয়ে বলেন,‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, দিস সিম্বল রিপ্রেজেন্টস্ দি সংগম অব গ্রেট রিভারস্ গেনজেস্ এন্ড ইয়ামুনা, ইউ সি.. লাইফ গৌজ অন, উইথআউট সংগম.. দেয়ার ইজ নো লাইফ।’ সাহেব কুলের সদ্য ধর্মান্তরিত সন্তানটি তো দেখি, ‘লিংগম’ বা ‘সংগমের’ উচ্চারণও সঠিকভাবে আয়ত্ব করেছেন, অত্যন্ত ইমপ্রেসিভ!

কোডি ফের প্রতীকের মাহাত্ম ব্যাখ্যা করেন,‘ লাইফ ইজ অল আবাউট সংগম, মেক শিওর ইউ হ্যাভ সাম অ্যাজ ইউ গো এলং।’ আমি প্রাপ্তবয়স্ক, এ নিয়ে কোডির কাছ থেকে সবক নেয়ার কোন জরুরত দেখি না। আরতে আলে আগ্নেয়গিরির পাদদেশে এ মুহূর্তে সঙ্গম-সঙ্গী জোগাড় করে নতুন কোন প্রাণ তৈরী করা নয়, কোন ক্রমে নিজের জান রক্ষা করাটা প্রায়োরিটি, তাই কিঞ্চিত রূঢ়ভাবে তাকে থামিয়ে দিয়ে ফিরে যাই নির্ধারিত স্টোন-কটেজটির সামনে।

দেখি, ঝুড়ি ও রোল করা চাটাই হাতে দাঁড়িয়ে আছে গাইড চিনুয়া। তাকে কিছু বলতে হয় না, ফকফকে শাদা দাঁতে হেসে সে কটেজের ফ্লোরে ঝুড়িতে করে আনা শুকনা ঘাস ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর পেতে দেয় চাটাইখানা। আমি পা লম্বা করে সটান শুয়ে পড়ি। চাটাইয়ের নিচে সম্ভবত উটের জাবনা জাতীয় ঘাস থেকে ছড়াচ্ছে সোঁদা গন্ধ। কটেজটির বাতাবরণ শীতল, আলগা একটু আলো এসে পড়ছে, আমি স্লিপমাস্ক পরি। ঘন্টা দেড়েকের বেশি ঘুমানো ঠিক হবে না, তাই টাইমপিসে এলার্ম দিয়ে অতঃপর চোখ বন্ধ করি।

চমৎকার সুরেলা ঝংকারে ঘুম ভাঙ্গে। হামিং ভয়েসে কাছে-পিটে কেউ গাইছে,‘ ও.. ওম পা পা/ ট্রা লা লা..।’ টিউনটি চেনা। কোথায় আমি? ভারি বিভ্রান্ত লাগে। বছর কয়েক আগে প্রাগ নগরীতে ভ্রমণের সময় স্রেফ সময় কাটানোর অসিলায় পর্যটকনন্দিত একটি বিয়ার পাবে গিয়ে বসে থাকতাম। লাইভ ব্যান্ডে এ টিউনটি প্রায়ই বাজতো। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার অবস্থান তো চেক রিপাবলিকের প্রাগ নগরীতে না, আমি না ইথিওপিয়ায় দানাকিলে এসেছি লাভা-ট্র্যাক করতে?

চোখ খুলে ছাদের দিকে তাকাই। পাশের কটেজ থেকে এবার স্পষ্ট আওয়াজে ভেসে আসে লোকপ্রিয় চেক সংগীতটির ইংরেজী ভার্সন,‘ ট্রা লা লা../ দেয়ার ইজ অ্যা গার্ডেন/অনলি হ্যাপি ফেইসেস ব্লুম দেয়ার../ ও.. ওম পা পা..।’ গলার স্বরটিও তরতাজা স্মৃতির মতো চেনা মনে হয়। আমি পাশ ফিরি।

একটি বোল্ডার সরে গিয়ে তৈরী হয়েছে ফোকর। ওপাশে মনে হয়, শ্বেতাঙ্গ এক নারী বোতলের জলে রুমাল ভিজিয়ে শরীর ঘষে ঘষে স্পঞ্জ-বাথ নিচ্ছে। আওয়ারা কিছু আলো পড়ে মৃদুভাবে উদ্ভাসিত হয় জলে আর্দ্র উর্দ্ধাঙ্গ। আমি চোখ ফেরাই, অনেক বছর আগে পড়া শহীদ কাদরীর একটি কবিতার বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ছত্র ফিরে আসে স্মৃতিতে,‘ দেয়ালের ঘুলঘুলি ফোকর দিয়ে.. সন্তের নিঃসঙ্গতায় দাঁড়িয়ে.. ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায়/ দেখি স্নানরত/ একটি নারী,/ নগ্ন।’

ওপাশের কটেজে দোয়েল পাখির সীমিত জলে গোসল সারার মতো চোখেমুখে ভেজা রুমাল মুছে মেয়েটি গেয়ে যাচ্ছে,‘ লা ডি হ..হ ডা../ অহ দেয়ার ইজ মিউজিক/ এন্ড দেয়ার ইজ ড্যান্সিং/ এন্ড অ্যা লট অব সুইট রোমানসিং.. লা ডি হ..হ ডা../ ও ওম পা পা..।’

চন্দনের ফোঁটার মতো এবার রোদের কিছু বিন্দু এসে পড়ে তার সদ্য সিক্ত হওয়া মুখে। টিকলো নাকের ব্লন্ড মেয়েটিকে চিনতে কোন অসুবিধা হয় না। দিন দশেক আগে আমরা— পর্যটকবৃন্দ ইথিওপিয়ার মেকলে নগরীর একটি আপস্কেল হোটেলে জড়ো হয়ে চেষ্টা করছিলাম লবনের তেপান্তর ও লাভা-হ্রদে ট্র্যাকের বন্দোবস্থ করতে, তখন দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। আদিতে চেক রিপাবলিকের নাগরিক, বর্তমানে কানাডার টরেন্টোতে অভিবাসী হওয়া এ নারীর নাম বারুনকা পেট্রাদিতা। সে চেক পেইন্টারদের চিত্রাদি বিক্রির এজেন্ট হিসাবে কাজ করে। তেমন করে চেনাজানা হয়নি, তবে তার সঙ্গে একই টেবিলে বসে ডিনার করেছি, ইথিওপিয়া ট্রাভেলস্ এর দফতরে ছোটাছুটির সময় টুকটাক কথাবার্তা হয়েছে।

ভিনদেশী কারো সঙ্গে মায়-মোলাকাত হলে আমি তাদের ভাষার কয়েকটি শব্দ শেখার চেষ্টা করি। বিষয়টা হবির মতো। তো পেট্রাদিতার কাছ থেকেও আমি চেক ভাষার পাঁচটি শব্দ ও তিনটি বাক্য আমার নোটবুকে টুকে নিয়েছি। আমার হাতে সে তার আর্টডিলার লেখা বিজনেস কার্ডটিও ধরিয়ে দিয়েছে। কোঁকড়া চুলের ছত্রছায়ায় পেট্রাদিতার অভাল শেপের মুখখানাকে দেখায় অষ্টাদশ শতকের নামজাদা ফরাসি পোর্ট্রেটিস্ট জোঁ মাক নাতিয়ের আঁকা তৈলচিত্র ‘পোর্ট্রেট অব অ্যা লেডি’র মতো। তাকে এ কথা বললে সে ইন্টারনেটে জোঁ মাকের চিত্রগুলো দেখে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে।

তার বিজনেস কার্ডে সোনালি হরফে লেখা ‘লিবারেটেড গার্ল উইথ কালারফুল ভার্চ্যু’, বাক্যটিতে ঘোষিত ‘বর্ণাঢ্য নৈতিকতা’ আমাকে ব্যাপকভাবে কৌতূহলী করে তুলেছে। আমি নোটবুকে তার মুখশ্রীর বর্ণনায় ‘অনফরগেটেবোল ফেস’ শব্দ দুটিও টুকে রেখেছি।

ঘুমের চটকা ভেঙ্গে গেছে। বুঝতে পারি, চাটাইতে সটান শুয়ে আর বিশ্রাম নেয়া সম্ভব না। তাই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি। নোটবুকখানা নিয়ে বেরিয়ে আসি স্টোন-কটেজের দাওয়ায়। দেখতে পাই, পাশের কটেজটির ছায়ায় প্লাস্টিকের টুলে বসে পেট্রাদিতা। আইফোনের স্ক্রীনে ফুটে ওঠা নিজস্ব প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সে ভুরু প্লাক করছে।

পদশব্দে গ্রীবা বাঁকিয়ে বলে,‘ হেই.. গেটিং রেডি ফর লাভা ট্র্যাক?’ আমি দায়সারাভাবে বলি,‘হাই।’ আমাকে যেন খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে পেট্রাদিতা, অস্বস্থি লাগে। মেকলে শহরের একটি রেস্টুরেন্টে আমরা যখন একত্রে ডিনার সারছিলাম, পেট্রাদিতা ওই দিনও খুঁটিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। আমি অসাবধানতাবশত শার্টের বোতাম উল্টাপাল্টা করে লাগিয়েছিলাম। সে কানের কাছে মুখ এনে তা ঠিক করতে অনুরোধ করেছিল।

আমার পোষাক-আশাকে হয়তো সামান্য কিছু অসঙ্গতি থাকে, কিন্তু এটা কেউ শুধরে দিক, আমি তা পছন্দ করি না। তো সৌজন্যবশত কিছু একটা বলতে হয়, আমি কষ্টেসৃষ্টে একটি চেক শব্দ মনে করে বলে ওঠি,‘ ডবরি ডেন।’ রোদপড়া পোখরাজের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে তার চোখের মণি। ফিক করে হেসে সে বলে,‘ ওহ্ ডিয়ার, ইউ রিয়েলি লার্ন হাউ টু সে গুড ডে ইন চেক।’ সে ‘ডিকুই’ বলে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে চোখ ফেরায় আইফোনের স্ক্রীনে, আমি হাত নেড়ে ওয়েব করে সামনে বাড়ি।

স্টোন-কটেজগুলোতে ট্র্যাক করনেওয়ালাদের তৎপরতা দেখা যায়। বেশ কিছু পর্যটক জড়ো হয়ে যোগাড়যন্ত্রে বেস ক্যাম্প গুলজার করছেন। ফোল্ডিং-টুলে বসে জমেছে অলস আড্ডা। একটি কটেজের সামনে মজলিশ বসানো জনা কয়েক পর্যটকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এদের সাথে মিলেঝুলে আমি লবনের তেপান্তরে ঘোরাফেরা করেছি। সকলের সাথে মুখ চেনাচেনি আছে, কারো কারো সাথে তৈরীও হয়েছে যৎসামান্য ভাব।

আমাকে দেখতে পেয়ে এনারা রীতিমতো উচ্ছসিত হন। একজন গলার স্বর বাড়িয়ে আওয়াজ দেন,‘ কামঅন আপ এন্ড হ্যাংআউট উইথ আস সুলতান।’ পনিটেইল দুলিয়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে আসেন মিস্টার কর্নেলিয়াস। ঠোঁট থেকে থুঁতু সিক্ত সিগার-এন্ডটি সরিয়ে বলেন,‘হোয়ার আর ইউ গোয়িং, হ্যাভ অ্যা সিট হিয়ার।’

আমি বসে পড়তে ইতস্তত করছি দেখতে পেয়ে তিনি প্রলোভন ছড়িয়ে বলেন,‘ লুক..আই অ্যাম প্রিপেয়ারিং অ্যা কুল বেভারেজ.. চিলড্ বিয়ারে লেমন-জুস মিশিয়ে তৈরী করছি মিচিলাদা।’ আমি বেস ক্যাম্পে রাউন্ড মেরে চটজলদি এখানে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলি,‘ মি. কর্নেলিয়াস, ডোন্ট ড্রিংক অল দ্যা মিচিলাদা.. আই অ্যাম কামিং ব্যাক ইন অ্যা ফিউ মিনিটস্।’

এক-পা দু-পা করে আগ বাড়ি। কর্নেলিয়াস সাহেব সংক্রান্ত একটি ‘আনফিনিসড্ বিজনেস’ মনে ফিরে আসে। বিলাতের নাগরিক পনিটেইল-ওয়ালা মানুষটি আদতে কাঠমিস্ত্রি। তাঁর দক্ষতা ক্যাসোলগুলোর ঔককাঠে তৈরী ঘুরানো সিঁড়িগুলোর মেরামত করা। বছরের বেশীরভাগ সময় তাঁর কাটে ইউরোপের নানা দেশের মধ্যযুগে নির্মিত কেল্লাগুলোর শানদার সিঁড়ি মেরামত করে। তাঁর দিনযাপন সম্পর্কে আমি আরেকটু জানতে চাই, আমার প্রয়োজন আছে তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়ার। আরতে আলেতে ট্র্যাক করার সময় তাঁকে পাকড়াতে না পারলে, আর কখনো তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হবে কি না, বলা মুশকিল।

চলে আসি পার্কিং-লটের থানে। একটি এসইউভি গাড়ি থেকে গাট্টি-বোচকা ও ব্যাকপ্যাক নামিয়ে আফার শ্রমিকরা তা উটের পিটে লোড করছেন। বুঝতে পারি, আরতে আলের দিকে ঘন্টা চারেকের ট্র্যাকিং হবে কষ্টসাধ্য। কোন কোন পর্যটক চাচ্ছেন না লাভাখন্ডের উপর দিয়ে হাঁটার সময় পিটে ভারি বোঝা বহন করতে। যৎসামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে উটচালকরা তা পৌঁছে দিচ্ছেন লাভা হ্রদের পাড়ে।

আগে যারা এ পথে ট্র্যাক করেছেন, তাদের ব্লগ পড়ে সচেতন হয়েছি যে, প্রচন্ড গরমে পানীয় জলের কাহাত হতে পারে। ট্যুর কোম্পানি এ যাত্রায় জন প্রতি মাত্র চার বোতল করে পানীয়জল সরবরাহ করছে। যদি কোথাও কারো প্রয়োজন হয়, এ বিষয়টা মাথায় রেখে সাথে করে ক্যারি করছি দেড় ডজন একসট্রা ওয়াটার বটল। এগুলো ক্যারি করে আমার জখমি পা দুটিকে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। উট দিয়ে এক্সট্রা পানির বোতল প্রভৃতি পাঠিয়ে দিলেই হয়। ভাবি, গাইড চিনুয়াকে এ দ্বায়িত্ব দেবো।

আরেকটু সামনে বাড়ি, ফের সাক্ষাৎ হয় জনা কয়েক উটচালকদের সঙ্গে। লাভা হ্রাদের পাড়ে, তারাজ্বলা ছায়াপথের ঠিক তলায় আমরা তাঁবু-ফাবু ছাড়াই শুয়ে-বসে রাত কাটিয়ে দেবো। বিত্তবান টুরিষ্টদের পিট যাতে জখম না হয়, এ জন্য ট্র্যাভেল কোম্পানী বন্দোবস্থ করেছেন মেট্রেসের। একটি উটের পিটে বোঝাই দেয়া হচ্ছে ফোমের মেট্রেস।

আমি দাঁড়িয়ে পড়ে আফার সম্প্রদায়ের মেহনতি সুপুরুষদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার কোশেশ করি। এরা প্রাণ খুলে হাসেন, বাড়িয়ে দেয়া হাত মুঠো করে শেকহ্যান্ডও করেন, কিন্তু ইংরেজী না জানার কারণে মতবিনিময় কিছু হয় না। আমি বিদায় নিয়ে বেস ক্যাম্পের প্রান্তিকের দিকে আগ বাড়ি । যেতে যেতে কেবলই মনে হয়, সহযাত্রী পর্যটকদের সঙ্গে ইংরেজী ভাষার হিল্লা ধরে যে হারে আমি তথ্য আদান প্রদান করছি, সে অনুপাতে স্থানীয় আফার সম্প্রদায়ের দিনযাপন সম্পর্কে জানতে পারছি খুবই কম। এ সীমাবদ্ধতাকে কোন বনেদী বাড়ির দেউড়িতে এসে ভেতরের ইমারতটি দেখতে না পারার মতো দুঃখজনক মনে হয়।

এ দিকে পাথর খুঁড়ে তৈরী বেশ কয়েকটি পার্মান্টেন্ট বাংকার। তার আড়াল থেকে ভুঁইফোঁড়ের মতো বেরিয়ে আসে চিনুয়া। হাসিমুখে সে প্রস্তাব করে,‘ওয়ান্ট সাম লাইভ ক্যামেল পিকচার, স্যার, কাম.. কাম..নো প্রবলেম।’ জিন্দা উটের ছবি আমার তোলা হয়ে গেছে, তাই বিশেষ একটা আগ্রহ দেখাই না। তবে তাকে নিয়ে এ দিককার সেনাছাউনিতে একটু ঘুরপাক করি।

পাশের দেশ ইরিত্রায় সাথে লড়াইবিড়াইয়ের বিরতি চলছে, তাই সৈনিকরা রিল্যাক্স হালতে চারপাইতে শুয়ে-বসে, তাস খেলে, রেডিও শুনে, হো হো হেসে গুলতানিতে মশগুল হয়ে আছে। চিনুয়া বেস ক্যাম্পের পরিচিত বান্দা, মনে হয় সকলে তার ধান্দা সম্পর্কে সচেতন, একজন সৈনিক জানতে চান— কতগুলো দেশ থেকে ট্র্যাকাররা আজ এখানে এসেছে? অন্যরা আমার খামোকা হাত নাড়ার জবাবে ফিক ফিক করে হাসেন।

একটি বাংকার মতো সেনা-কটেজের ছাদে স্তূপ করে রাখা ত্রিপল। তাতে পাথরে ঠেকা দিয়ে বসানো এন্টেনাওয়ালা ক্যাসেট-স্টিরিও, হেমন্ত্ কুমারের গলায় বাজছে,‘ নাহি মাঙ্গে সোনা চান্দি/ মাংগে দেবি দরশন তেরি..দুয়ারে খাড়ায়ে এক যোগি..।’ তাঁর বহতা কন্ঠের স্বর্ণালি ঝংকার আমার কলিন্জা ছুঁয়ে যায়। আফ্রিকার বেশ কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমি হিন্দি মিউজিক বাজতে শুনেছি, বোম্বাইয়ের চিত্রতারকারাদের পারফরমেন্সও বয়স্ক কিসিমের স্থানীয় নাগরিকদের স্মৃতি থেকে এখনো বিলুপ্ত হয়নি। আমি ফের হেমন্তের আকুতি-নিবিড় কন্ঠস্বরে আর্দ্র হতে হতে ভাবি, উনি কী জানতেন— বিপুল সুদূরেও হামেশা মোহাচ্ছন্ন হচ্ছে তাঁর সুরছন্দে ঘোরতর কৃষ্ণ গাত্রবর্ণের প্রচুর মানুষজন?

এসে পড়ি ছাউনির রসুইঘরের কাছাকাছি। এদিকে হাল্কা লু হাওয়ার সাথে মিশে আছে পোড়া রসুনের পানজেন্ট গন্ধ। পথ আগলে দাঁড়ায় এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী। ঘোমটা পরা নারীটির গলায় সাত রঙের বিডে তৈরী ইলাবরেট হার। খুব ইনোসেন্টভাবে হেসে, হাতটি বাড়িয়ে বিশুদ্ধ ইংরেজীতে অনুরোধ করে,‘ গিভ মি ওয়ান ইউরো এন্ড বি অ্যা গুড-বয়।’ ভাবি, মাত্র এক ইউরোতে যদি আমার বখাটে বদনাম কাটিয়ে গুড-বয়তে রূপান্তরিত হতে পারি, খারাপ না, প্রক্রিয়াটি তো বেশ শস্তা।

ওয়ালেট থেকে অতঃপর ইউরোর দুখানা নোট বের করে সাওয়াল করি,‘ মিস, হাউ আবাউট টু ইউরো ?’ খপ করে নোট-দুটি তুলে নিয়ে সে জবাব দেয়,‘নাউ ইউ আর অ্যা লাভলি বয়।’ ভাটিবয়সে এসেও কোন তরুণীর কাছ থেকে তারিফ-সিগ্ধ হাসিটি পেতে কিন্তু দারুণ লাগে। তাকে ‘থ্যংকয়্যু’ বলে পা বাড়াই।

ছাউনির এদিকে পাথরে সেঁদিয়ে থাকা ব্যারাকের খুপরি বেশ কতগুলো। আরো তিনটি তরুণীকে ঘোরাফেরা করতে দেখি। তাদের শরীরের গঠন, চলাফেরার ভঙ্গি, ভরাট নিতম্বের ব্যাপক হিল্লোল ও বঙ্কিম চাহুনিতে স্পষ্টত উদ্দীপ্ত হচ্ছে বিশ্রামরত জোওয়ানরা। হাসাহাসির সাথে শিস কাটার হিড়িকও চোখে পড়ে। চিনুয়া লাজুক হেসে যেন অজুহাত দেয়,‘সৌলজারস্ নিড গার্লস্।’

হাঁটতে হাঁটতে আফার কৌমের রক্ষণশীল পরিবেশের বিষয়টা মাথায় রেখে চিনুয়ার কাছে জানতে চাই,‘ তরুণী মেয়েদের কাছাকাছি হওয়ার কোন উপায় আছে কী?’ নির্লিপ্তভাবে সে জবাব দেয়,‘থাকবে না কেন, মুতা পদ্ধতিতে সাময়িকভাবে অবশ্য বিবাহিত হতে হবে, আপনার আগ্রহ থাকলে বলবেন, মুতা পড়ানোর জন্য মোল্লা জোগাড় করা কঠিন কিছু না।’ শুনে প্রতিক্রিয়ায় আমি নিশ্চুপ থাকি। আরতে আলের কাছাকাছি এসে, লাভাস্তরের উপর হাঁটাহাঁটি করে আমার জুতা খুলে যাওয়াও উপক্রম হয়েছে, এ হালতে মুতা-ফুতা থেকে বিরত থাকাই উত্তম।

লাভাখন্ড ছড়ানো প্রান্তরে ভাস্কর্যপ্রতিম আকৃতি

ছাউনি ছাড়িয়ে বেস ক্যাম্পের দিকে ফিরতে ফিরতে বুদ্ধি করে চিনুয়াকে কাটাই, তারপর ঘুরপথ ধরি। সামনে পড়ন্ত বিকালে ট্র্যাকিং শুরু করার টেরেইনটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। একটু দাঁড়াই। চোখের সামনে লাভাখন্ড ছড়ানো প্রান্তরটিতে মনে হয় কোন খামখেয়ালি ভাস্কর কুচকুচে কালো কয়লা দিয়ে তৈরী করেছেন কয়েকটি বিমূর্ত ভাষ্কর্য।

সচেতন হই, এ পাথুরে আকৃতিগুলো অতিক্রম করে আজ সন্ধ্যে লাগার মুখে আমাদের ট্র্যাক করতে হবে কমসে-কম ঘন্টা চারেক। পায়ের মাসোল অলরেডি টাটিয়ে আছে, ক্রমাগত টনটনাচ্ছে। কিন্তু সামনে বাড়া ছাড়া আর উপায় কী, আরতে আলেতে তো পৌঁছতে হবে। দিস ইজ ইনডিড টু লেট টু ব্যাকঅফ।

স্টোন-কটেজের সামনে নোটবুক হাতে লেখক

ভারি বোঝার মতো দু-কাঁধে উদ্বেগের টেনশন নিয়ে ফিরে আসি বেস ক্যাম্পে। স্টোন-কটেজটির সামনে একটু নীরবে দাঁড়াই। এখনই পর্যটকদের মজলিশে সামিল হয়ে মিচিলাদা পানে মাতেলা হতে ইচ্ছা হয় না। নির্বাক জামানার স্লাইডের মতো করোটিতে ভেসে যাচ্ছে বেস ক্যাম্পের নানাবিধ দৃশ্যপট। তাদের সাথে যেন জোট বেঁধেছে আমার অবচেতন থেকে উঁকিঝুঁকি দেয়া হরেক কিসিমের অনুভূতি।

আমি সচেতন যে, এ তরতাজা অভিজ্ঞতাকে এ মুহূর্তে রেকর্ড করতে না পারলে স্মৃতি থেকে বেশ কিছু ইমেজ ও চমকপ্রদ সব ডিটেইলস্ মুছে যাবে। ভীষণ অস্থির লাগে। খানিক ভেবেচিন্তে অতঃপর হাতে তুলে নেই নোটবুকখানা। তাতে এ মুহূর্তের অনুভব ও অধীর চঞ্চলতাকে শব্দ-বাক্যে তর্জমা করতে খারাপ লাগে না।

 

মঈনুস সুলতান

জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট করেন। বছর পাঁচেক কাজ করেন লাওসে-একটি উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে। খণ্ড-কালীন অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস এবং স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস এর। কনসালটেন্ট হিসাবে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, মেসিডোনিয়া ও কিরগিজস্তান প্রভৃতি দেশে কাজ করেন অনেক বছর।

ইবোলা সংকটের সময় লেখক ডেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস নামে একটি ফান্ডিং কর্মসূচির সমন্বয়কারী হিসাবে সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা শহরে বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচীন মুদ্রা, সূচিশিল্প, পাণ্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top