খালেদ হামিদী: বাস্তবতা, প্রেম আর গহীন বিস্ময়

পশ্চিমা উপন্যাস প্রধানত ব্যক্তির ক্রমবিকাশ অথবা ধ্বংসের কাহিনি। প্রাচ্যেও এই রীতি অনুসৃত প্রায়। উপন্যাস বিষয়ে সচেতন সকলেই জানেন, ইউরোপে শিল্প-বিপ্লবের পর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্মের ফলে, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, উপন্যাসের আবির্ভাব ঘটে। বলা হয়, মহাকাব্যের বিশাল পটভূমিতে ব্যক্তিজীবনের অনুভূতি-ক্লেদের সন্ধান পাঠক কাঙ্ক্ষিতরূপে খুঁজে না পাওয়ার দরুন শুরু হয় উপন্যাসের যুগ। গল্পকার ও প্রধানত ঔপন্যাসিক আকিমুন রহমানের উপন্যাস সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন (আদি পর্ব) সেই অর্থে ততোটা ব্যক্তিক নয়। তাহলে কি এই রচনা সমষ্টির সম্প্রসারণ অথবা সংকোচন কিংবা বিলোপের কাহিনি? ঠিক তাও নয়। প্রথমত এটি প্রেমের উপন্যাস যা একটি লোকালয়ের আনুভূমিক বাস্তবতার দ্বারা সচকিত। সেই বাস্তবতাটি কেমন? জানতে হলে আকিমুন-বিবৃত পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচিত হতেই হয়। এ এক অদ্ভুত গ্রাম। এমন ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের গ্রাম, নাম দেওভোগ, বাংলা উপন্যাসে এর আগে চিত্রিত হয়নি, বলা যায়। প্রতিটি পরিবারের আবাসন উঁচু ভিটায় স্থাপিত। এরকম এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে এক ঢাল থেকে নেমে ক্ষেত মাড়িয়ে আরেক ঢাল বেয়ে উঠতে হয়। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই রয়েছে, এক পাশে, পুকুর, সমতলে খননকৃত, গ্রীষ্মকালে যার পানি শুকিয়ে তলায় জমে প্রায় থকথকে কাদা। কিন্তু গ্রামের নারীরা খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে গাছপালাবেষ্টিত এক আশ্চর্য পুকুর থেকে, যে পুষ্করিণীর পানি কখনো শুকায় না। তা জমিদার বাড়ির পুকুর।

কিন্তু কেমন জমিদার? আমাদের সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত নির্দয় শোষক ও অত্যাচারী ধরনের নন এই ভূস্বামী। আকিমুন জানান, তিনি জমিদারিতে প্রায়-অমনোযোগী একজন যোগী বা ঋষী। ফলে এই গ্রামের নিসর্গ ও মানুষজনের আণুবীক্ষণিক বিবরণ পাঠককে টেনে রাখে। কেননা আমাদের উপন্যাস থেকে গ্রাম প্রায় বিলুপ্ত। পুঁজিবাদের এতৎঅঞ্চলীয় বিকাশের ফলে কথাসাহিত্য থেকে গ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে। ঊনিশশো চৌত্রিশের কবিতায় জীবনানন্দ দাশ গ্রাম-বাংলায় পুঁজিবাদের শকট ঢুকে যাওয়ার প্রমাণ প্রত্যক্ষ করেন। তারাশংকর, বিভূতি ও মানিক, তিন বন্দ্যোপাধ্যায় আর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের পরে গ্রাম সেভাবে আর, এর নানা মাত্রিক বাস্তবতাসহ, কল্লোলিত হয়নি। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু-হওয়া ঢাকা শহরকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ধারায় গ্রাম তার চিরায়ত আবেদন হারায়। তবে গ্রাম ছেড়ে শহরে জীবিকা সকাশে আসা কবি-লেখকদের রচনায় গ্রাম আংশিকভাবে ফিরে আসে তাঁদের স্মৃতিকাতরতার প্রকাশ হিসেবে এবং কখনও রম্য রূপেও। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক উপন্যাসের তুলনায় গভীরতররূপে পরানের গহীন ভিতর কাব্যে গ্রামীণ জীবনকে বাঙময় করে তোলেন গ্রামের সাথে শহরের দূরত্বজনিত হাহাকারযোগেও। কিন্তু এসব রচনা রাজনৈতিক বাস্তবতাশূন্য। গ্রাম এখন শহরমুখি কেবল নয়, অনেক গ্রামও এখন দৃশ্যত চাকচিক্যময়। সেখানে ধনী বা সচ্ছল লোকদের ঘরবাড়িই শুধু রঙিন নয়, অনেক মসজিদও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেখানটায় প্রবাসীদের পুঁজিরও অনুপ্রবেশের ফলে প্রার্থনালয়ের মেঝেও ঝকঝকে, চকচকে টাইলসময়। কিন্তু এর সমান্তরালে অনেক গ্রামে নারী ও কৃষক বা গরিব মানুষ হারাচ্ছে যথাক্রমে সম্ভ্রম ও জমি। আর, সেখানকার খলপুরুষেরা ব্যবহৃত হচ্ছে শহরের রাজনীতিকদের হাতে। এই বাস্তবতা কি সুলভ আলোচ্যমান এই উপন্যাসে? না। গেলো শতকের বিশের দশকের শুরুর দিককার এই গ্রাম দেশীয় ও বৈশি^ক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন এক অতিসরল জনপদের নাম। এ ক্ষেত্রে আরেকটু উল্লেখ জরুরি। সেই জমিদারের মৃত্যুর পর অসুস্থ হয়ে-পড়া তাঁর স্ত্রীরও প্রয়াণ ঘটে। কিন্তু, অদ্ভুতভাবে। পানি নিতে আসা গ্রামের নারীরা দেখতে পায়, পুকুর ঘাটে নিথর পড়ে আছে জমিদার-পত্নী, পানিতে দুই পা ডোবানো এবং তাকে ছেয়ে আছে কাছের গাছ থেকে ঝরে-পড়া অসংখ্য বকুল। জনশূন্য জমিদার বাড়ি আগাছায় ক্রমে অরণ্যময় হয়ে ওঠে। আর, উপন্যাসের অষ্টম অধ্যায় থেকে শুরু হয় আরও বড় বিস্ময়ের অপেক্ষা।

তার আগে উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক ও নগর-জৈবনিক উপন্যাস এবং ফ্যান্টাসি ও সায়েন্স ফিকশনের এই যুগে, ঔপন্যাসিকগণ গ্রামে যেতে এবং একই সঙ্গে গ্রামকে উপন্যাসের উপজীব্য করতে চান না। হুমায়ুন আজাদ বলেন, ‘গ্রাম নিয়ে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি বিভূতিভূষণ লিখে ফেলেছেন, তাই আর এ নিয়ে উপন্যাস লিখতে চাই না।’ কিন্তু গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব অনুধাবন মানে তো সামন্তবাদের প্রতি অনুরাগ নয় মোটেও, আত্মপরিচয় পোক্ত করবার শ্রমসাধ্য প্রয়াস মাত্র, খানিক ভিন্নতাযোগে যার জ¦লজ¦লে নমুনা আমাদের উপহার দেন শওকত আলী। আকিমুন অবশ্য সেরকম কোনও ব্রত নিয়ে এই উপন্যাস লেখেননি। তাহলে এই অতীতচারিতা কেন? ঐতিহাসিক উপন্যাসের জনক ও উপন্যাসসাহিত্যে রোমান্টিক মনোভঙ্গির যোগ্যতম প্রতিনিধি বলে খ্যাত ওয়াল্টার স্কট কি এ ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেন আকিমুন রহমানকে? কিন্তু স্কটের মতো তিনি তো মধ্যযুগবিহারী নন। তাহলে?

বলে রাখা ভালো, ঔপন্যাসিকের এই গ্রামটি, যা অনন্য, নারায়ণগঞ্জ জেলাভুক্ত এবং ১৩৩০ বঙ্গাব্দের, ইংরেজি ১৯২২-২৩ সালের, রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বজয়ী। প্রথম মহাসমরও তখন সমাপ্ত। কিন্তু রবি ঠাকুরেরও অবগতির বাইরে থাকা গ্রামখানি, অধিকাংশেই ধর্মভীরু নিরক্ষর মুসলিম অধ্যুষিত হলেও আশ্চর্য রকমের অসাম্প্রদায়িক, রাজনীতি ও সংশ্লিষ্ট সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ভূমিদস্যুতামুক্ত। ওই জমিদার বাড়ি ছাড়াও গ্রামত্যাগী আরও অনেক হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি পড়ে থাকে, জঙ্গলাকীর্ণ। কিন্তু তারা গ্রাম ছেড়ে কোথায় যায় কিংবা কেনই বা যায়, এই উপন্যাসে এর কোনও হদিস মেলে না। যদিও জানা যায়, ১৯২০-২১ সালের দিকে ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এক নতুন মোড় নেয়। খেলাফত এবং ভারতীয় কংগ্রেস সমঝোতায় আসে। খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলন এগিয়ে চলে সমান তালে। পাশাপাশি চলে উভয় মিছিল। একই সাথে ধ্বনিত হয় ‘আল্লাহু আকবার’ এবং ‘বন্দেমাতরম’। সৃষ্টি হয় তরঙ্গের পর তরঙ্গমালা। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে আন্দোলিত জনতার এ উত্তাল তরঙ্গের ঢেউ লাহোর, করাচি, দিল্লি, লখনৌ, বোম্বে, কলকাতা, ঢাকা প্রভৃতি বড় বড় শহরের গণ্ডি অতিক্রম করে লাগে গ্রামে-গ্রামান্তরেও। বিশেষ করে, বাংলা প্রদেশ আন্দোলনের উত্তপ্ত ভূমিতে পরিণত হয়। এখানে মিলিত হয় হিন্দু-মুসলমান। কিন্তু তাই বলে আকিমুন-চিত্রিত গ্রামটির সমাজ কি সুষম? না, বলা বাহুল্য, তা বিষমই। উপন্যাসের মংলার মা চরিত্রটি একেবারেই সর্বহারা, যে কেবল শাক তুলে, এর বিনিময়ে পাওয়া খাদ্যযোগে, বেঁচে থাকে। আরেক দিকে, ইসুফ মিয়ার মা পুত্রের, জুলেখাকে বিবাহের ইচ্ছা, জানা মাত্র সজোরে বলে ওঠে: “ডাইনের ঘরে ডাইন! বিনা কড়ি দিয়াই কিন্না নিছে গা আমার পুতেরে!” এতে তার শ্রেণীঘৃণার টগবগে প্রকাশ ঘটে।

আরও লক্ষণীয়, দেওভোগ-এর পুরুষেরা সদরে কামলা খাটে। সেরকম একজন মজুরের একমাত্র আদুরে কন্যা জুলেখার (সকলে যাকে ডাকে জুলি; বয়স ১৪) প্রেমে পড়ে গ্রামের একমাত্র সম্পন্ন ঘরের ছেলে ইসুফ (বয়স ১৭)। ইসুফ জুলেখাকে মাছ শিকারের কৌশল শেখানোর সময় হাতের স্পর্শ পায়। তখন থেকে মোট সাতবার তারা পরস্পরকে ছুঁতে পারে। এই ছোঁয়া একেবারেই অযৌন। বহুলপরিচিত প্রেম-কাহিনির দুই কিংবদন্তি ইউসুফ ও জুলেখার কাউন্টার ডিসকোর্স কি এই ইসুফ-জুলি? দেড় হাজার বছরেরও আগের মরুদেশের সেই কামজর্জর জুলেখা তো এক অপবাদের প্রতিশোধ নিতে আমন্ত্রিত বান্ধবীদের সামনে অসম্ভব রূপবান ইউসুফকে ডেকে আনে। তার রূপের ঝলকে সমাগত নারীরা ফল কাটতে গিয়ে কেটে ফেলে নিজেদের আঙুল। এতে কারাবন্দি হয় ইউসুফ। প্রসঙ্গটির অবতারণা এ জন্যে যে, এই ইসুফ তেমন সুদর্শন বলে জানানো হয় না। আর, জুলি একেবারে শীতল এরং প্রেমানুভবে কাঁদে। তবে বিপরীত হলেও কিছুটা সমমাত্রিক মিল পাওয়া যায় ইউসুফ ও ইসুফের মধ্যে। একসময় কারামুক্ত প্রথম জন রাজসভায় বসে। প্রেয়সীর বিয়ের সম্বন্ধ আসার সংবাদে গ্রাম-গ্রামান্তরে এলেমেলো হাঁটতে শুরু-করা দ্বিতীয় সে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। অন্য এক আবাসনের নিচ দিয়ে, পাশ ঘেঁষে যাওয়ার সময় স্ত্রী নির্যাতনের শব্দ এবং নারীর আর্তনাদ শুনেই দ্রæত সে ওই বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ায় এবং তীব্রতম ক্ষোভে ওই অত্যাচারী স্বামীটিকে (ফালানির বাপ), কয়েকবার ধাক্কাধাক্কির পর, প্রতিহত করে। আকিমুনের এই ক্ষুদে নায়ক প্রেমিক হিসেবে কীভাবে, তার প্রাগুক্ত ‘বেয়াদব’ পরিচয়ের তুলনায়, সম্পূর্ণই বিবর্তিত এবং বয়সের তুলনায় ঢের অগ্রগামী মহৎ মানবিক সত্তায় উত্তীর্ণ হয় তা লক্ষযোগ্য।

হঠাৎ, আজ থেকে এক শ বছর আগে, চৈত্র মাসের এক দিন, মায়ের অগোচরে জমিদার বাড়ির পুকুরে গোসল করতে গিয়ে, জুলেখা হারিয়ে যায় আশ্চর্যজনকভাবে। জুলেখা কেন যায় ওই ছায়ানিবিড় স্বচ্ছ পুকুরে? নারী গ্রামবাসীরা প্রায় ধরেই নেয় যে, অলৌকিক কোনো অপশক্তি জুলেখাকে গাছের মগডালে তুলে ঘাড় ভেঙে মেরে ফেলেছে। এই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় গ্রামবাসীর প্রতিক্রিয়ার ঔপন্যাসিককৃত বিবরণ এক নিবিড় কাব্যিক আবহ তৈরি করে। যেমন, মুরুব্বিদের হুকুমে দেওভোগের জোয়ান ছেলেরা সব উঁচু গাছে উঠেও জুলেখাকে দেখে না। কিন্তু পুরুষেরা হতোদ্যম হয় না। তারা, সন্ধ্যার আগে একেক হারিকেন হাতে, পার্শ্ববর্তী গ্রামে জুলেখার সন্ধানে ব্যাপৃত হয় সারা রাত ধরে। কোরাসে উচ্চারিত তাদের অনুসন্ধানের শব্দরাশির ধ্বনিব্যঞ্জনা দেওভোগেও নদীর মতো বয়ে আসে। আকিমুন রহমান, লক্ষণীয়, অতীতকে এমন বিশ্বস্তরূপে বাঙময় করেন যে তা কিছুটা জাদুবাস্তব আবহ তৈরি করে। জমিদার বাড়ির পুকুরে আরেক গ্রামের জেলে এনে জাল ফেলে জুলেখাকে খোঁজার মধ্যেও জাদু পরিলক্ষিত হয়। অসংখ্য সাদা মাছের বর্ণবিভা আর পাড়ে ছড়িয়ে পড়া ছোট মাছগুলোকে জুলেখার সন্ধানে পাতালে পাঠানোর বিবরণ একই সঙ্গে কাব্যিক ও ক্যারিশম্যাটিক। এদিকে জুলেখাকে হারানোর অপরিসীম বেদনায় ভেঙে-পড়া ইসুফ গুটি বসন্তে আক্রান্ত হলে শুরু হয় আরেক মর্মান্তিক ইতিবৃত্ত। সেই বিয়ের বিষয়টি ওভাবে প্রত্যাখ্যানের ফলে সৃষ্ট পুত্রসেবায় নিবিষ্ট ইসুফের মায়ের অনুতাপ, শেক্সপীয়রীয় পরিতাপের অনুরূপ হয়ে দাঁড়ায়, যখন সে নিজেকেই প্রশ্ন করে: ‘তুই কি গভ্ভধারিণী না ডাইন? ক! তুই কি!’ বাইরে তখন অঝোর বর্ষা। আর, ‘তার পোলার চোখ থেকে নামছে দেখো সেই ঢলের চেয়েও আরো গহন ঢল!’ উপন্যাসে সুলভ পাঠকের সঙ্গে কথা বলার এরকম আরও দৃষ্টান্ত ব্রেশটীয় নাট্যপদ্ধতিরও সমতুল প্রায়।

ইসুফ-জুলির এই পরিণতি শরৎচন্দ্রের দেবদাস-পার্বতীর অন্তিম দশা থেকেও প্রায় ভিন্ন হয়ে ওঠে। দেওভোগ গ্রামের সেই সময়কালের বছর পাঁচেক আগে প্রকাশিত দেবদাস (১৯১৭) উপন্যাসের নায়ক পরিণত হয় শ্রেণিবৈষম্যের চাপে সদ্যযৌবনের প্রেমাবেগ দলিত হওয়ার করুণতম দৃষ্টান্তে। উভয় জুটির মধ্যে সূ² মিল শুধু এই, ইসুফের মায়ের সেই অসম্মতি শ্রেণিঘৃণার নামান্তর।

এই উপন্যাস রাজনীতিশূন্য হলেও ইসুফ যে ওর বাবার ইচ্ছায় বেশ কিছুদিন ওর মামাদের গদিতে (আড়তে) বসে বাণিজ্য শেখে সাফল্যের সঙ্গে, তাতে, ওই বিচ্ছিন্ন গ্রামের কাছে-দূরেও পুঁজির তৎকালীন সঞ্চালনের বিষয়টি চিত্রিত হয়। যদিও, অর্থশাস্ত্রের ভাষায় তা অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাজ। গভীর নারীবাদী লেখক-চিন্তক আকিমুন রহমানের এই সংবেদী রচনায় জুলেখা নিরব এবং শেষে হৃত অথবা গুম। কিন্তু ইসুফের বা পুরুষের প্রেমানুভূতি আশ্চর্য সংবেদনশীলতায় বিশদরূপে প্রতিষ্ঠিত। গুটি বসন্তে নিজের চেহারা কেবল নয়, নিজেকেও হারিয়ে ফেলা ইসুফের অপরিসীম বেদনার যে অনুবাদ ঔপন্যাসিক উপহার দেন তাতে সচেতন পাঠকেরও চোখ ভিজে আসে। অর্থনৈতিক বঞ্চনা ছাড়াও মানুষ যে সর্বহারার সর্বহারায় পরিণত হতে পারে, এই সত্য ভাগ্যবিড়ম্বিত ইসুফের অন্তর্লোক যথার্থরূপে উন্মোচনের মাধ্যমে, আকিমুন প্রতিষ্ঠিত করেন। নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার সংলাপ আর লেখকের প্রমিত ন্যারেশনেও ওই ভাষার শব্দের অন্তর্ভুক্তি এই রচনার আরেক বিশেষত্ব।

উপন্যাসটির এই আদি পর্বের শেষ পরিচ্ছেদে জুলেখা ফিরে আসবে বলে জানানো হলেও পাঠকচিত্তে জেগে ওঠে হিশাম মাতারের অ্যানাটমি অব এ ডিজ্যাপিয়ারেন্স উপন্যাসের (এতে ১২ বছর বয়সী এক কিশোরের পিতার রহস্যজনকভাবে গুম হওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয় শৈল্পিক কুশলতায়) প্রথম বাক্য: “কিছু কিছু সময় আসে, যখন বাবার অনুপস্থিতিকে আমার বুকের উপর বসে থাকা শিশুর মতো ভারী মনে হয়।”

সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন আদি পর্ব; প্রথম প্রকাশ : ফেব্রæয়ারি ২০১৬; প্রকাশক : খড়িমাটি; প্রচ্ছদ : খালিদ আহসান; বিনিময় : ২০০ টাকা

১৮-১৯ অক্টোবর ২০২২
পরিমার্জনা: ২০ অক্টোবর ২০২২
চট্টগ্রাম

খালেদ হামিদী

জন্ম: ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৩। জন্মস্থান: বাদামতলী, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম। শিক্ষা: ব্যবস্থাপনায় স্নাতক (সম্মান): ১৯৮৫; স্নাতকোত্তর: ১৯৮৬; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা: প্রকাশনা বিভাগের প্রধান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।

প্রকাশিত গ্রন্থ:
কাব্য (০৭টি): আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো (ডিসেম্বর ১৯৯৯; একান্তর); হে সোনার এশীয় (ফেব্রুয়ারি ২০০৪; অনন্তর); মুখপরম্পরা (ফেব্রুয়ারি ২০০৭; লিটল ম্যাগাজিন); ধান থেকে শিশু হয় (ফেব্রুয়ারি ২০১০; বাঙলায়ন); স্লামমডগ, মিলিয়নার নই (ফেব্রুয়ারি২০১৩; প্রকৃতি); তুমি কি রোহিঙ্গা মাছি (ফেব্রুয়ারি ২০১৮; খড়িমাটি) এবং
ঘুমোই চশমা চোখে (জানুয়ারি ২০১৯; ঋতবাক; কলকাতা; ভারত)।
গল্প (০১টি): আকব্জিআঙুল নদীকূল (ফেব্রুয়ারি ২০১২; প্রকৃতি)
উপন্যাস (০১টি): সব্যসাচী (ফেব্রুয়ারি ২০১৭; বেহুলাবাংলা)
প্রবন্ধ (০৩টি): কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে (ফেব্রুয়ারি ২০০৭; অনন্তর); না কবিতা, হাঁ কবিতা (ফেব্রুয়ারি২০১৬; খড়িমাটি এবং চেনা কবিতার ভিন্ন পাঠ (ফেব্রুয়ারি ২০১৯; খড়িমাটি)।
অনুবাদ (০১টি): ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা (ফেব্রুয়ারি ২০১৬; খড়িমাটি)
কাব্যঃ আমি কি টাকা তবে (ফেব্রুয়ারি ২০২২; তৃতীয় চোখ) এবং
ডকুফিকশনঃ কিছুই যাবে না ফেলা (ফেব্রুয়ারি ২০২১; অভিযান)।
পুরস্কার: চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মহান একুশে স্মারক সম্মাননা পদক ২০১৯ ও  শালুক বিশেষ সম্মাননা পদক ২০১৯।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top