টোমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা

অনুবাদ: জুয়েল মাজহার

আবহ চিত্র

পিঠে মরীচিকার ডানা।–এই নিয়ে
অক্টোবরের সাগর তুলছে তার ঠাণ্ডা ঝলক
নৌকা-দৌড়ের সেই ঝিমধরা স্মৃতিকে
উসকে দেবার মতো অবশিষ্ট কিছু আর নেই
গ্রামের উপরে হলুদাভা
আর ওই ধ্বনিপুঞ্জ ধীরে উড়ে যায়
কুকুরের ঘেউ এক গূঢ়লিপি
আঁকা আছে বাগানের উপরে হাওয়ায়
গাছকে বানিয়ে বোকা সে বাগানে হলুদাভ ফল
আপনা থেকে নিচে ঝরে পড়ে।

(Robin Fulton–এর ইংরেজি অনুবাদ Weather Picture – এর বাংলা ভাষান্তর )

দুটি হাইকু


মানুষের আদলে পাখিগুলি।
ফুলে ঢাকা আপেল গাছেরা ।
বিরাট হেঁয়ালি।


এই যে ধূসর পাতাগুলি
ততোটাই দামি
সমুদ্রের মৃত লিখনপটেরা যতোটা।

(Wolfgang Peter Menzel- এর ইংরেজি অনুবাদের বাংলা ভাষান্তর)

বাডেলুন্ডার বুলবুল

বুলবুলি পাখিটার উত্তর সীমানায় সবুজ মধ্যরাত, ভারী
পাতাগুলি ঢুলছে ঘুমের ঘোরে, বধির গাড়িগুলো সবেগে
ছুটছে নিয়নলাইন অভিমুখে। ক্রমেই চড়া বুলবুলিটার
নাছোড় গলা– থামার নামটি নেই; কাকের কা-কা-র মতো
কানফাটা সে-আওয়াজ, তবে তা ভণিতাহীন আর সুন্দর।
কারাগারে বন্দী ছিলাম আমি আর সে দেখতে এলো আমায়।
আমি ছিলাম রোগকাতর আর সে দেখতে এলো আমায়।
তখন আমি তা ঠাহর করতে পারি নি কিন্তু এখন ঠিকই
বুঝতে পারছি। সূর্য আর চাঁদ থেকে সদা টিক-টিক-ধন্যবাদময়
ঘড়িগুলোর ভেতরে স্রোতের মতো গড়িয়ে
নামছে সময়। কিন্তু সময় বলে কিছুই নেই সেখানে। আছে
কেবল বুলবুলিটার গলা, কর্কশ সুরের ওঠানামা, রাতের
আকাশের ঝিকিমিকি কাস্তেটায় শান দিয়ে চলেছে সেই সুর।

(Robin Fulton–এর ইংরেজি অনুবাদ The Nightingale
in Badelunda-এর বাংলা ভাষান্তর)

তিনটি স্তবক

১.
নাইট এবং তার মহাশয়া
শিলীভূত হয়েছেন তবে সময়ের
বাইরে এক কফিনের
ঢাকনার উপরে সুখী তারা

২.
যিশু একটি মুদ্রা দেখালেন
তাইবেরিয়াসের মুখ আঁকা
সে-মুখে প্রেমের ছাপ নেই
বৃত্তাকারে ঘুরছে ক্ষমতা

৩.
রক্তের ফোটা ঝরানো তলোয়ার
মুছে দ্যায় স্মৃতি,
মাটিতে ছাতলা ধরেছে
তরবারির খাপ আর তুর্যনিনাদ।

(Patty Crane-এর ইরেজি অনুবাদ
Three Stanzas এর বাংলা ভাষান্তর)

কোকিল

বাড়িটার ঠিক উত্তর দিকটায় বার্চগাছের ডালে বসে ডেকে
গেল একটি কোকিল। ওর গলার স্বর এতটাই চড়া যে
প্রথমে ভাবলাম বুঝিবা কোকিলের ডাক নকল করে গাইছে
কোনো অপেরা-গায়িকা। অবাক হয়ে পাখিটার দিকে
তাকালাম। কুহু ডেকে ওঠার সময় প্রতিবারই চাপকলের
হাতলের মতো উঠছে-নামছে ওর লেজের পালক। পাখিটা
দু’পায়ে লাফাল, ঘুরে ওড়ার প্রস্তুতি নিল আর চতুর্দিকে
ছড়িয়ে দিল গলার চিৎকার। তারপর ঝটিতি আকাশে উঠে
গজরাতে গজরাতে বাড়িটার ওপর দিয়ে উড়ে গেল দূরে
পশ্চিমে… গ্রীষ্ম বুড়িয়ে যাচ্ছে আর সবকিছু বইছে অভিন্ন
এক বিষাদের সুরে। কুকুউলাস ক্যানোরাস, ইউরোপের
কোকিল, গ্রীষ্মমণ্ডলে ফিরে যায্। সুইডেনে এর দিন
ফুরিয়েছে। এখানে ও স্বল্পকাল ছিল। এ-কোকিল আসলে
জায়ারের নাগরিক… ভ্রমণ এখন আর আমাকে টানে না ।
কিন্তু ভ্রমণ নিজেই আমাতে ভ্রমণ করে যায়। এই যে এখন আমি
ক্রমাগত কোনঠাসা, এই যে এখন বর্ষবৃত্তটি ক্রমশ বড়
হচ্ছে আর আমার দরকার হয়ে পড়ছে একজোড়া চশমা।
সর্বদাই ঘটনার ঘনঘটা আমাদের সহ্যসীমা পার হয়ে যায়।
অবাক হবার মতো কিছু আর নেই। এসব ভাবনা বিশ্বস্ততার
সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছে আমাকে, ঠিক যেমন লিভিংস্টোনের
মমি করা মরদেহ আফ্রিকার ভেতর দিয়ে সোজা
কাঁধে বয়ে এনেছিল সুসি আর চুমা।

(Malena Mörling, Patty Crane I John F Dean
–এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা ভাষান্তর)

অর্ধ সমাপ্ত স্বর্গ

হতাশা নিজের পথের বিরতি টানে
তীব্র দহন নিজের বিরতি টানে
শকুন নিজের ওড়ায় বিরাম খোঁজে
ব্যগ্র আলোক শতধারে উৎসারে
প্রেতেরাও, আহা, মদিরায় ঢোঁক গেলে ।
আমাদের ছবি দেখছে ভোরের আলো,
লাল পশুগুলি হিম-যুগ স্টুডিওর ।
সবই তাকায় চোখ মেলে চারদিকে
আমরা সবাই হেঁটে চলি রোদ্দুরে
একেকটা লোক দরোজা আধেক খোলা ,
অভিন্ন ঘরে সকলেরে নিয়ে চলে
পদতলে জাগে নি:সীম প্রান্তর
ঝিকিমিকি জল গাছেদের ফাঁকে ফাঁকে
এই হ্রদখানি পৃথিবীর বাতায়ন।

(Robin Fulton -এর করা Half-Finished Heaven-এর বাংলা ভাষান্তর)

তুষার ঝরছে

আসছে শবের যাত্রা
আরো আরো ক্রমাগত আরো
যেন তারা অবিকল ট্রাফিক সঙ্কেত
তখন আমরা সব শহরের দিকে আগুয়ান।
প্রলম্বিত ছায়াদের দেশে
হাজার লোকের চোখ রয়েছে তাকিয়ে ।
নিজেকেই গড়ে চলেছে সেতু এক–ধীরে
ওই মহা- শূন্যে,অসীমে।

(Robin Fulton -এর করা Snow is Falling এর বাংলা ভাষান্তর)

নীরবতা

পাশ দিয়ে হেঁটে যাও, এইখানে সমাহিত ওরা…
সূর্যের চাকতির উপরে ওই মেঘ ভেসে যায়।
অনাহার– সে এক উঁচু দালান, যে
ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় রাত্রিবেলা–
শোবার ঘরে এলিভেটরের একটি দরজা খুলে যায়,
অন্দর মহলপানে দণ্ড এক আছে তাক করা।
এঁদো-ডোবার ভেতরে ফুলেরা। বিউগলে সকরুণ সুর আর নীরবতা।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাও, এইখানে সমাহিত ওরা…
টেবিলের রুপোর চামচ জলতলে সুবিশাল ঝাঁকে
মিশে গিয়ে নিজেকে টেকায়;
অতলান্তিক সাগর সেখানে ঘোর কালো।

(Patty Crane–এর ইংরেজি অনুবাদ Silence -এর বাংলা ভাষান্তর)

রেলপথ

রাত ২টা: চাঁদের আলো। সমতল প্রান্তরের
মাঝপথে ট্রেন গেছে থেমে। দূরে কোনো
শহরের বিন্দু বিন্দু আলো
দিগ্বলয়ে নিরুত্তাপ মিটিমিটি জ্বলে।
যেমন, যখন কেউ স্বপ্নের অতলে ডুব দিয়ে
ফিরে আসে নিজ ঘরে
কোনোদিন তবু তার মনে আর পড়ে না সে-স্বপ্নবিহার
যেমন, যখন কেউ গভীর গভীর কোনো অসুখে নাকাল
সবই তার হাতেগোনা– ঠাণ্ডা-হিম আর ছোটো
দিনগুলি একঝাঁক মিটিমিটি আলো হয়ে যায়
এখনো সে-ট্রেন ঠায় রয়েছে দাঁড়িয়ে।
রাত ২টা: উজ্জ্বল জ্যোৎস্না, কতিপয় তারা।

(রবিন ফুলটনের করা ইংরেজি অনুবাদ Tracks-এর বাংলা ভাষান্তর)

চাপের প্রভাবে

নীলাকাশের এঞ্জিন-গর্জনে শ্রবণ বধির হয়ে আসে
আমরা এখানে এক থরথর ওয়ার্ক-সাইটে থাকি
সাগরের অতলতা যেখানে হঠাৎ খুলে যায়
হিস হিস করে চলে প্রাণীর দেহের খোল আর টেলিফোন
সুন্দর– তুমি একে কেবলি একপাশ থেকে দেখতে পাবে চকিত নয়নে
ঘনদানা শস্য মাঠে মাঠে, হলদে নদীর স্রোতে বহুতর রঙ খেলা করে।
আমার খুলির ওই অস্থির ছায়াদের কেউ যেন টানছে সেখানে।
চুপে বেয়ে উঠে তারা শস্যের ভিতরে গিয়ে সোনা হতে চায়।
আঁধার ঘনিয়ে আসে। মাঝরাতে শুতে যাই আমি।
বড় এক নৌকা থেকে ছোটো এক নৌকা বেরোয়।
জলের উপর একা তুমি।
সমাজের কালো নৌকা দূরে– আরো দূরে ভেসে যায়।

(Robin Fulton and Robert Bly-এর ইংরেজি অনুবাদ Under Pressure-এর বাংলা ভাষান্তর)

রোমের খিলান

সুবিশাল রোমান গীর্জার ভেতরের আধো-অন্ধকারে
ট্যুরিস্টদের গাদাগাদি।
খিলানের পর খিলান, পরিপূর্ণ ছবি নেই কোনো।
কেঁপে কেঁপে জ্বলছে কিছু মোমের প্রদীপ।
আমাকে জড়িয়ে ধরে মুখহীন এক দেবদূত
আর আমার সারাদেহে সঞ্চারিত তার ফিসফাস:
‘‘লজ্জিত হয়ো না, ওহে, গর্ব করো তুমি যে মানুষ!
খিলানের পর খিলান অবিরত খুলে যাবে তোমার ভেতরে।
হবে না সম্পূর্ণ তুমি কখনোই, এটাই নিয়তি।’’
দুই চোখ অশ্র-টলোমল
ভিড়ের ঠেলায় আমি বাইরের রোদেভাসা পিয়াৎসায় এসে পড়লাম্
মিস্টার ও মিসেস জোন্স, মিস্টার তানাকা আর
সেনিওরা সাবাতিনি সঙ্গী আমার,
আর প্রত্যেকের ভেতরে খিলান খিলান শুধু অন্তহীন খুলে যেতে থাকে ।

(Robin Fulton–এর ইংরেজি অনুবাদ Romanesque Arches-এর বাংলা ভাষান্তর)

খোলা আর অবারিত স্থান

দস্তানা দিয়ে ছুঁয়ে দেখবার মতো একটা লোক তার কাজের
ভেতর দিয়ে, অনুভব করে জগৎটাকে।
দস্তানাজোড়া তাকের ওপর রেখে দুপুরবেলা
খানিক জিরিয়ে নেয় সে।
হঠাৎই তারা বড় হতে, প্রসারিত হতে থাকে– আর
গোটা বাড়িটার ভেতরটা দ্যায় অন্ধকারে ঢেকে;
আঁধারে ডোবানো সেই বাড়িটা বাইরে এসে, সঙ্গী হলো
বসন্ত-হাওয়ার।
‘ক্ষমা করো অপরাধ’ ছড়ায় ফিসফিস ঘাসে: ‘ক্ষমো
অপরাধ’।
আকাশে তেরছাভাবে উঠে যাওয়া অদৃশ্য সুতোর পেছন পেছন ওই
একটি বালক দৌড়ায়
আগামীর দুরন্ত স্বপ্ন তার শহর-ছাপিয়ে-ওঠা ঘুড়ি যেন
উড়ছে সেখানে;
আরো দূরে—উত্তরে– একটি পাহাড়চূড়া থেকে
নীলাভ গালিচামোড়া পাইনের অনি:শেষ বন দেখা যাবে
মেঘেদের ছায়াগুলি হয়ে আছে সেখানে অনড়।
না না, ওই তো!– ডানা মেলছে ওরা!!

ঝড়

হাঁটতে গিয়ে বিশাল একটা বুড়ো ওকগাছের সঙ্গে
হঠাৎ তার দেখা , শরৎ-সমুদ্রের কালচে সবুজ
দুর্গ-দেয়ালের পটভূমিতে অতিকায় শাখা-শিঙের মুকুট নিয়ে
পাথর-হয়ে-যাওয়া এক হরিণ যেন ।
উত্তুরে ঝড়ের দিন এলো। এসময় পেকে উঠবে
রোয়ানবেরি ফল। রাত্রি জেগে সে শোনে
ওকগাছটির অনেক উপরে নিজের আস্তাবলে
তারাপুঞ্জ বাজিয়ে চলেছে খুরধ্বনি।

(Robert Bly-এর ইংরেজি অনুবাদ The Storm -এর বাংলা ভাষান্তর)

রশ্মিপাত

জানালার বাইরে ওই বসন্তের দীর্ঘ জানোয়ার
–স্বচ্ছ ড্রাগন ওই সূর্যালোকের।
শহরতলির এক অন্তহীন ট্রেন যেন
পাশ দিয়ে দ্রুত ছুটে যায়;–আমরা দেখিনি এর মাথাটি কখনো।
পথপাশে বাড়িগুলি সাগরের তীরে এলোমেলো
কাঁকড়াদের মতো তারা গর্বে চৌচির।
রোদ পড়ে মূর্তিদের চোখ পিট পিট।
মহাশূন্যে আগুনের উন্মত্ত সাগর
প্রেমময় হাতের আদর হয়ে যায়
–শুরু হলো ক্ষণ-গণনার ।

(Patty Crane-এর ইংরেজি অনুবাদ The Light Streams In -এর বাংলা ভাষান্তর)

জুলাই ’৯০

এ-ছিল অন্ত্যেষ্ঠিক্রিয়া
আর আমি আঁচ করলাম মৃত লোকটি
আমার চেয়েও ঢের ভালোভাবে
পড়ছে আমাকে।
অর্গান নীরব হল, গাইল পাখিরা।
গনগনে সূর্যের ভেতরে এক রয়েছে বিবর।
মুহুর্তের দূরতম দিকে দীর্ঘ-দীঘল ওই
বন্ধুর গলা শোনা গেল।
দেখা গেল গ্রীষ্মের ঝলমলে আলোয়
গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছি আমি
দেখা গেল বৃষ্টি আর স্তব্ধতার মধ্যে
–চাঁদের আলোয়।

( Patty Crane-এর ইংরেজি অনুবাদ From July ’90-এর বাংলা ভাষান্তর)

সন্ধ্যা-সকাল

চাঁদ– মাস্তুল এর পচে গেছে, এর কুঁচকে গিয়েছে পাল
গাঙচিল– স্রোতের ওপরে, মত্ত-মাতাল, দূরে উড়ে চলে যায়
জেটি– আয়তাকার এ-বস্তুপুঞ্জ পুড়ে পুড়ে অঙ্গার। ঘন
জঙ্গলে নেমেছে অন্ধকার।
বাইরে দোরগোড়ায়। সাগরের যতো গ্রানিট-ফটকে ভোর
এসে ধাক্কায়
আর সূর্য পৃথিবীর খুব কাছে এসে পড়ে তার
ফুলকি ঝরিয়ে যায়। আধমরা যতো গ্রীষ্মের দেবতারা
শুধু হাতড়ায় সাগরের কুয়াশায়।

(Evening-Morning নামে Robert Bly এবং Robin Fulton-এর
পৃথক দুটি ইংরেজি অনুবাদের বাংলা ভাষান্তর)

এপিলগ

ডিসেম্বর, সুইডেন– উপকূলে টেনে আনা পালহীন
এক জাহাজ। গোধূলিতে রয়েছে দাঁড়িয়ে তার
সটান মাস্তুল। আর দিনের আয়ুর চেয়ে
দীর্ঘ এই গোধুলির আয়ু। পাথুরে এখানে এই পথ:
দিনের আলো– দুপুর অব্দি অপেক্ষায় থাকে। তারপর
মেলে ধরে অবাস্তব মেঘে দীপ্ত
শীতের কলিসিয়াম। তারপর গ্রামগুলো থেকে
সহসা শাদা ধোঁয়া বেয়ে ওঠে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। অন্তহীন
উঁচু, মেঘমালা।
সমুদ্র অন্ধের মতো, একমনে, স্বর্গের শেকড় হাতড়ায়,
মগ্ন আর শুনছে কিছু– যেন সে বিভোর।
(আত্মার অন্ধকারের উপরে কতো গোপন ভ্রমণ
পাখিকে ঈষৎ এড়িয়ে চলে যায়,– যে পাখি সহজে পারে
ঘুমন্তের ঘুম ভেঙে দিতে। তারপর কাচটি
সরানো হলে অন্য এক সময়, দ্যাখো, তাতে ধরা পড়ে:
এটা গ্রীষ্মকাল, কতো না পর্বত নিচে
আলো ঝলমল, স্বচ্ছতোয়া হাতে তার
সূর্য-ঝিলিক নিয়ে নদী বয়ে যায়…কিন্তু সকলি উবে যায়
অন্ধকারে সিনেমায় ছবি শেষ হলে যেরকম)
এখন সন্ধ্যাতারা পুড়ছে মেঘে মেঘে।
বড় হতে থাকে গাছ, বেড়া আর ঘরবাড়িগুলি, আঁধারের
খাড়াপতনের
শব্দহীন পতনের সঙ্গে তারা বড় আরও বড় হতে থাকে,
এবং তারার নিচে অন্য গোপন সেই ভূদৃশ্য ক্রমশ উজ্জ্বল.
রাত্রির এক্স-রে প্লেটে দেহরেখা হয়ে তার জীবনের দিন
গুজরান
বাড়িগুলির মাঝ দিয়ে ছায়া তার স্লেজখানা টেনে নিয়ে যায়
অপেক্ষা তাদের
সন্ধে ছয়টা বাজে, আর পথে পথে
হট্টগোলসহ হাওয়া আসছে লাফিয়ে
অন্ধকার ভেদ করে যেন এক অশ্বারোহী দল ছুটে চলে।
কৃষ্ণ বিপর্যয়– কেমন বেসুরো বেজে তারপর নীরবে মিলায়।
এ-বজ্রগর্জনে কাঁপা বাড়িগুলি নেচে চলে ঠায়
স্বপ্ন-গর্জনের মতো অবিকল এই গর্জন, দমকা হাওয়া
বয়ে চলে থেকে থেকে এই উপসাগরের বুকে আর ওই খোলা
সুদূর সাগরে– আঁধারের গর্ভে যে নিজেকেই ছুড়ে দ্যায় নিজে।
মাথার উপরে ওই তারাদের মরিয়া চমক,
নেভে আর জ্বলে তারা দ্রুতচলা মেঘের কারণে
যখন মেঘেরা এসে ঢেকে দ্যায় আলো, কেবল তখুনি,
অতীতের মেঘ যেন, নিজ নিজ উপস্থিতি তারা সব দিচ্ছে
জানান।
আত্মার ভেতরে তারা ইতস্তত ঘোরোফেরা করে। আস্তাবলের পথ
পেরোতে পেরোতে ওই হট্টগোলের ভিড়ে রোগা ঘোড়াটির
অন্তর্গত খুরধ্বনি শুনতে পাই আমি।
ইতস্তত আছড়ে আছড়ে পড়ে ভাঙা এক ফটক বারবার,
হাতেধরা যে-লন্ঠন ইতস্তত নড়ে, পর্বতের ওপরে বসে যে-পশুটি
ভয় পেয়ে কাঁদে– ঝড়ের ভেতরে ওই মোড়বিন্দুটিকে
তারা করছে সবাই নির্দেশ। বজ্রমেঘ ধরে আসে
গোয়ালের ছাদের ওপরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই বাজ,
ক্রমাগত টেলিফোন তারকে বাজিয়ে সপাং, প্রতিটি টালিতে আর
রাতের প্যানেলে শুধু কানফাটা অবিরাম সাঁই সাঁই তোলে
আর ওই বেচারা গাছেরা শুধু দিগ্বিদক ডালপালা ছোড়ে।
সানাইকে ছেড়ে চলে গেছে এক সুর!
একটি সুর সকরুণ সানাইয়ের দিকে ক্রমে
স্বাধীনতাসহ আগুয়ান। একটি মিছিল চলে যায়। কুচকাওয়াজে মাতে বনভূমি!
নৌকার গলুই ঘিরে মুহূর্মুহূ জলের ঝাপট, আর
অন্ধকার করে নেয় তার নিজ জায়গা বদল,
জল আর স্থল মিলে বেরোয় ভ্রমণে। আর মৃত যারা
ডেকের ওই যে নিচে চলে গেছে, তারা সব এখানে হাজির
আর আমরা চলি নিজ পথে: একটি সমুদ্রযাত্রা, পথসন্ধি এক
শান্ত সেই পথসন্ধি, উন্মাতাল নয়।
আর এ-পৃথিবী অবিরাম খাটায় নতুন
তাঁবু তার। একটি গ্রীষ্মের দিন, হাওয়া
আঁকড়ে ধরে ওকগাছটিকে আর পৃথিবীকে টেনে নিয়ে যায়।
লুকানো হাঁসের পায়ে পদ্মফুল হাঁটে
এই ছোট্ট হৃদখানি– এরই অন্ধকার দ্রুত আলিঙ্গনে।
মহাশূন্যের কিনারা থেকে কে যেন গড়িয়ে নিয়ে যায়
পাথরের প্রকাণ্ড-বিশাল এক চাঁই।
গ্রীষ্মকালীন সন্ধ্যায় এই দ্বীপ দিগন্তের
অনেক উপরে উঠে যায়। পুরনো সে গ্রামগুলি ক্রমে সরে
যায়,
দোয়েলের কাতরতা সঙ্গে নিয়ে ঋতুর চাকায় তারা
আরো দূরে বনের গহীনে চলে যায়।
যখন বছর তার বুটজোড়া পা থেকে ঝরায় আর
সূর্য জ্বলে অনেক উঁচুতে, ওই গাছে গাছে পাতারা গজায়,
হাওয়াভর্তি হয়ে তারা কী স্বাধীন নৌকা ভাসায়।
পর্বতের সানুদেশে পাইনগাছ ভস্মীভূত আর ঝড়ে কাৎ ,
গ্রীষ্মের সুদীর্ঘ উষ্ণ ফেনিল ঢেউয়েরা তবু ঠিক এসে যাবে,
গাছেদের পতিত শিখর যতো– এসবের মধ্য দিয়ে
নিজেকে সে টেনে নেয় ধীরে,
কিছুটা জিরোয়, তারপর আরো বেশি অতলে হারায়, আর
গড়ায় ভাটায়
সাগরের বেলাভূমি পাতাহীন খা খাঁ পড়ে থাকে। আর
অবশেষে
ঈশ্বরের আত্মাখানি যেন নীলনদ: উপচে পড়ে জলে আর
শুকিয়ে চৌচির সেই নদ, যুগে যুগে সকল কিতাবে যার
ভুরি ভুরি রয়েছে বয়ান।
তবু নিত্য-অপরিবর্তনীয়ও বটে তিনি,
এবং সেহেতু তার দেখা মেলে এখানে কদাচ।
কুচকাওয়াজের পথ বাঁকাভাবে পার হন তিনি।
কুয়াশার মধ্য দিয়ে যে-জাহাজ চলে তারই মতো
কোনো দিকে মন নেই সেই কুয়াশার। নীরবতা।
লন্ঠনের টিমটিমে আলোটাই হয়েছে সংকেত।

(May Swenson–এর ইংরেজি অনুবাদ Epilogue -এর বাংলা ভাষান্তর )

ভোরের পাখিরা

আমি আমার গাড়িকে জাগিয়ে তুলি।
এর উইন্ডশিল্ড ঢেকে আছে ফুলের পরাগে।
রোদচশমা পরে নিই আর
পাখিদের গানে গানে নামছে আঁধার ।
এদিকে অন্য এক লোক রেলরোড স্টেশনে
খবরকাগজ কিনছে
অতিকায় এক মালগাড়ির পাশে,
জং ধরে লালে লাল এর সারা গা
আর সে জ্বলছে একা রোদের ভেতরে।
এখানে কোথাও নেই ফাঁকা-খাঁ-খাঁ স্থান
বসন্তের উষ্ণতার বরাবর এক হিম করিডোর আছে
সেখানে কে একজন পড়িমরি দৌড়ে এসে বলে
কারা যেন হেড অফিসে গিয়ে
তার নামে রটিয়েছে আকথা-কুকথা।
ভূদৃশ্যের পেছন-দরজা দিয়ে
–নরকের শাদা কালো পাখি–এক ম্যাগপাই আসে
আর সেই কালো পাখি ততক্ষণই চলে এঁকেবেঁকে
যে অবধি দড়িতে শুকাতে দেওয়া শাদা কাপড়গুলো ছাড়া
আর সবি হয়ে ওঠে কাঠকয়লায় আঁকা ছবি:
–প্যালেসট্রিনা বন্দনাগীতির ঐকতান।
নেই কোনো ফাঁকা স্থান এখানে কোথাও।
যখন নিজে আমি কুঁকড়ে যাই, কী করে গজিয়ে ওঠে
কবিতা আমার– সে সময় কী যে ভালো লাগে!
বেড়ে ওঠে, সে আমার স্থান নিয়ে নেয় ।
ধাক্কা মেরে আমাকে সরায়।
সে আমাকে নীড় থেকে বাইরে ছুড়ে ফ্যালে ।
কবিতাটি এখন প্রস্তুত।

(Robin Fulton, Gunnar Harding ও rederic Will-এর
করা Morning Birds শিরোনামের তিনটি পৃথক ইংরেজি অনুবাদের ভাষান্তর)

মাঝরাতের মোড়বিন্দু

বনে এক পিপিলিকা, চেয়ে থাকে অর্থহীন অনড়
নিশ্চল। আর ঘন শ্যামলিমার ভেতরে পোকার গুঞ্জরণ
কিছু শোনা যায় না এছাড়া । গ্রীষ্মের গভীর খোড়লে ওই
সারারাত বাজছে মর্মর।
সুশোভিত গাছটির সূঁচালো আগাটি যেন ঘড়ির কাঁটার মতো
খাঁজকাটা। পাহাড়ের ছায়ার ভেতরে ওই পিঁপড়ার চেহারা
রক্তিম।
একটি পাখি ডাকে আর্তরবে, অবশেষে ! ধীরে
চলা শুরু করে মেঘের শকট ।

(Robert Hass–এর ইংরেজি অনুবাদ
-Midnight turning point – এর বাংলা ভাষান্তর )

প্রান্তরের পথে

হেমন্তের গোলকধাঁধা
বনের প্রবেশপথে পড়ে আছে.ফেলে দেওয়া একটি বোতল
ভেতরে প্রবেশ করো হেঁটে। এ-ঋতুতে বনভূমি পরিত্যক্ত
কভেরা সুমসাম একটি প্রাসাদ। সুনির্দিষ্ট সূক্ষ্মধ্বনি শুধু
কতিপয়; যেন কেউ চিমটা দিয়ে তুলে নিচ্ছে পাতা ও পল্লব;
প্রতিটি গাছের গুঁড়ি– তাদের ভেতরে এক
দরজার কব্জা যেন ধীরে মিহি ক্যাঁচক্যাঁচ তোলে ।
ব্যাঙের ছাতার ’পরে বরফের পড়েছে নি:শ্বাস, আর তারা
কুঁচকে গেছে হিমে;
যে-গেছে-হারিয়ে তার রেখে যাওয়া বেদনার মতো যেন
তারা।
সন্ধে প্রায় হয়ে এলো । যেতে হবে তোমাকে এখন,
সীমানানির্দেশ তুমি খুঁজে নাও এখন আবার; পড়ে আছে
মাঠে মাঠে মরচে ধরা কতো হাতিয়ার
আর হ্রদের ওপারে ওই বাড়িখানা ধূসর-রক্তিম
আর চতুষ্কোণ আর এক ঘনকের মতো সে তো বিশুষ্ক
কঠিন।

২.
আমেরিকা থেকে এক চিঠি এলো, সেটি পড়ে
সাততাড়াতাড়ি
জুনের ফকফকা এক রাতে শহরতলীর ফাঁকা ফাঁকা রাস্তায়
গাড়ি নিয়ে
বেরিয়ে পড়লাম , দুইপাশে নক্সার মতো বাড়িঘর, এতোই
নতুন তারা স্মৃতি নেইকোনো ।
সেই চিঠি আমার পকেটে। আমার অশান্ত উন্মত্ত পদপে সে
এক প্রার্থনা
এখন কোথায় তুমি, আসলেই শুভাশুভ এ দুয়ের আছে দুটি
মুখ।
এখানে, শেকড়, সংখ্যা , আলোছায়া–ভেতরে মূলত তারা
সংগ্রাম এক।
মৃত্যুর বার্তা যারা বয়ে আনে দিনের আলোয় তারা পায় না
তো ভয়।
কাচের অফিসঘরে বসে তারা করছে শাসন। ফুলেফেঁপে
ওঠে তারা রোদে।
টেবিলের ওপরে ঝুঁকে সন্দেহের চোখে তারা দেখছে তোমায় ।
এ-থেকে অনেক দূরে, নতুন দরদালান কতো– এদেরই
একটির সামনে নিজেকে পেয়েছি আমি খুঁজে।
অনেক জানালা মিলে হয়ে যায় একটি জানালা।
সেইখানে গ্রীষ্মরাত্রির এই প্রান্তসীমায় রাতের আকাশে ওই আলো
আর ওই গাছেদের দোলা এই শান্ত-আয়না-হ্রদে ওই হয়েছে
বিম্বিত।
মনে হয় সহিংসতা
ক্ষণিকের জন্য সে যেনবা অলীক।
৩.
সূর্যটা ঢালছে আগুন। এরোপ্লেন নিচু হয়ে
অতিকায় ক্রুশের আকারে তার ছায়াখানি ছুড়ে মেরে মাটির উপর দিয়ে
দ্রুত উড়ে যায়।
একটা কিছুর ’পরে গুটিসুটি বসে আছে মাঠে এক লোক।
ছায়াটি এগোয় তার দিকে।
ক্রুশটির মধ্যিখানে এক-নিমেষ তাকে দেখা যায়।
গির্জার ঠাণ্ডা খিলান থেকে সেই ক্রুশ ঝুলে থাকতে আমিতো
দেখেছি।
মাঝে মাঝে মনে হয় এ-যেনবা মত্ততার কোনো এক চটজলদি
তুলে-ফেলা ছবি।

( Robin Robertson-এর ইংরেজি অনুবাদ OUT IN THE OPEN- এর বাংলা ভাষান্তর )

স্মৃতিরা আমায় দ্যাখে

জুনের সকাল, জেগে ওঠার ঢের রয়েছে বাকি
ফের ঘুমাবার সময় তো নেই আর
বাইরে আমায় যেতেই হবে–স্মৃতিতে ভরপুর,
নিবিড় শ্যামলিমা; দৃষ্টি হানে পেছনে আমার–স্মৃতিরা পথ
চলে
দেখতে পাওয়া তাদের অসম্ভব,
তারা আসল গিরগিটি
পটভূমির মধ্যে মিশে সবাই একাকার
এতোই কাছে তারা, শুনি তাদের নি:শ্বাস
যদিও পাখির গান এখানে কানে লাগায় তালা।

(Patty Crane এর ইংরেজি অনুবাদ Memories Look at Me-এর বাংলা ভাষান্তর)

কালো পোস্টকার্ড

১.
বিক্রি হয়ে গেছে ক্যালেন্ডার, ভবিষ্য অজানা ।
দেশহীন এক লোকগান নীরবে গুনগুনিয়ে
বাজছে ক্যাবলে। ধূসর সাগরে ওই ঝরছে তুষার। ছায়ারা
ডকের ’পরে কুস্তি লড়ে যায়।
২.
অর্ধেক জীবন তুমি পার করে দিলে;– তারপর
মৃত্যু এসে অতীব জরুরি কিছু মাপজোক নিয়েছে তোমার।
এঘটনা বেমালুম কবে ভুলে গেছি! জীবন চলেছে তার
নিজের নিয়মে।
তবুও নিরবে কেউ সে-পোশাক করছে সেলাই।

(Robert Bly-এর ইংরেজি অনুবাদ Black Postcards- এর বাংলা ভাষান্তর)

আল্লেগ্রো

কালো একটা দিনের পর আমি বাজাই হাইডন
আর আমার দু’হাতে লাগে কিছুটা আরাম।
পিয়ানোর চাবিরা প্রস্তুত। দয়ালু হাতুড়ি দেয় ঘা।
প্রাণবন্ত সেই ধ্বনি সবুজাভ নীরবতাভরা ।
ধ্বনি বলে আছে স্বাধীনতা, আর
সিজারের খাজনাপাতি কে যেনবা রেখেছে বকেয়া।
হাইডন-পকেটে আমি পুরে দিই হাত
আর শান্ত-আর-অবিচল লোকটির মতো আমি ভাব করে চলি।
হাইডন-ফ্ল্যাগ আমি উঁচিয়ে ধরে আছি। রয়েছে সংকেত এতে লেখা:
‘‘ আমরা মানি না পরাজয়। তবে করি শান্তি কামনা।’’
গান-পাহাড়ের উপরে এক ঢাল আছে–তাতে সেই কাচঘেরা বাড়ি;
পাথরেরা উড়ে চলে, পাথরেরা চলেছে গড়িয়ে।
পাথরেরা সোজা ওই বাড়ির ভেতর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায়
জানালার সবক’টি কাচ তবু এখনো অটুট রয়ে যায় ।

(Robert Bly–এর ইংরেজি অনুবাদ Allegro- এর বাংলা ভাষান্তর )
[ঈষৎ পরিমার্জিত]

 

Facebook Comments

3 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top