জুয়েল মাজহারের কবিতা

।। মেগাস্থিনিসের হাসি ।।

নি:শব্দ কামানে তুমি একা বসে ভরছো বারুদ।
শীতকাল গেল;
নি:শব্দ কামানে তুমি একা কেন
ভরছো বারুদ?
আমি ভাবছি:
মেগাস্থিনিসের হাসিও কি মেগাস্থিনিস?

শক্তিচালিত এই তামাশার মধ্যে বহু
বাদামি ঘোটক উড়ে যায়
—এঞ্জিনের শব্দ আর রোবটের কাশি শোনা যায়।
নি:শব্দ কামানে তুমি এখনো কি ভরছো বারুদ?

 

।। সাধুবচনের ভার ।।

সোনার পুত্তলি, আমি প্রেমবশে তোমাকে জানাই
সাধুবচনের ভার আজি আমি স্কন্ধে তুলি লব
আর, রচিব যতেক মনোকথা

কেননা সে প্রসারণক্ষম, কেননা সে স্প্রিং
রাত্রির জীবাশ্মমাখা ক্রমরোমাঞ্চিত তার ডানা।

পদদ্বয় বিদ্রোহপ্রবণ; তবু সেই স্প্রিংয়ের প্রসার
পরখ করিতে বলি তাহাদের;

যেন বাড়ে অভিজ্ঞতা, যেন ফাঁকা রাত্রির রেস্তোরাঁ
উদ্ভাসিত হয়, আর, বহুগুণ মন্ত্র বিরাজে গৃহে গৃহে।
অগণিত স্প্রিংসহ আজি আমি তোমার ফটকে দিব হানা
—এই মত অভিলাষ মনে।

অপিচ জানাই, লাক্ষাগৃহের পথ আজি বড়ো অগ্নিপ্রবণ;
সোনার পুত্তলি, তুমি চক্ষু মেলি দ্যাখো, তার পাশে সরোবর
হেঁতাল কাঠের তরী নৃত্যপর, ঊর্মি-উজল।

অনন্তর, টিলার উপরে যতো ছায়ালিপ্ত বর্ণবিথার
লতিকাসম্মত তারা বিস্তারিয়া অগণিত বাহু
তোমারে ধরিতে চাহে সংকেতে, ভাষায়।

সোনার পুত্তলি, আমি ইহার অধিক আর কিছু বলিব না
শুধু তোমাতে অর্পণ করি যাবো তার ধনাত্মক স্প্রিং;
যদি পারো তার মর্ম ধরি দাও টান!

 

।। তন্দুরের পাশে বসে ।।

হেরাক্লিতাসের নদীতে, দ্যাখো, ভেসে চলেছে
অটো হানের লৌহ-ময়ূরেরা;

সকালের রেস্তোরাঁয়, দ্যাখো, টনকে টন গমদানা
ফুলে উঠছে সূর্য-তন্দুরের আঁচে

চাঁদের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে স্বচ্ছ-শাদা মেঘ
আর, স্বনির্মিত ভুট্টাবাগানের মধ্যে
উবু হয়ে আছেন বিনয় মজুমদার!

মনে পড়লো তাকে
যখন আত্মধিক্কারের মতো মাথা নাড়ছে ঝাউবন;

পাতারা অকারণেই ঝরছে আর দিনভর
কেশে চলেছে ভূতগ্রস্ত আশ্চর্য মেশিন!
কতো রকম তাস উড়ছে বাতাসে
চাষাধরাকলে ক্রমশ ভরে উঠছে আমাদের রক্তপলিটান;
আর, কবি দাঁড়িয়ে আছেন জ্বলন্ত গ্যাস বার্নারের সামনে

অহো, সিলভিয়া প্লাথ! নিজেকে পোড়ালে তুমি কাচের মতো!!
—নড়ে উঠলো ভ্রম-দুর্বিপাক!
যারা পেরিয়ে এসেছো বহু ট্রাফিক-সংকেত
তাদের কার কি চেহারা?
কে তৈলাক্ত ভুট্টার প্রচারক আর কে নিজেরই পাখা
ঠেসে ধরেছিল উনুনে?

আপাতত তন্দুর থেকে কী বেরোয় দ্যাখো;
দ্যাখো, কোথায় ঘাপটি মেরে আছে ধাঁধা
‘লুনাটিক ইছাইলামে’ কে গো তুমি রয়েছ তন্ময়!
কি তোমার অভিজ্ঞতা এই নগ্ন তন্দুরের পাশে?

আগুন নিভল কিনা দ্যাখো,
দ্যাখো, দিনের আশ্চর্য রুটি কার দিকে প্রথমে দৌড়ায়!

।। দর্জিঘরে এক রাত ।।

শূন্যতা বল্লম এক, গেঁথে আছে দর্জিমহলে!

রাশি রাশি বস্ত্র ফেলে দর্জিদল গোপনে উধাও;
শুধু দেয়ালের গলদেশে ঝুলে আছে
একটি পুরনো ঘড়ি; –মৃত!

দশবস্ত্রে-দিগম্বর বেশ্যার ইশারা আজ মেঘেতে উত্থান

তাই, লক্ষ শিশ্ন হাতে চেপে দর্জিদল মেঘে ধাবমান
শৃঙ্গারের গোলাপি আরকে আজ প্রতিপার্শ্ব ঢাকা;

আঁধারে ঝর্নার মতো বেজে ওঠে গণিকামহল।

সবুজ প্রিজমে আমি চোখ রেখে সবকিছু দেখি:
দর্জিদের অনুপস্থিতির এই দীর্ঘ অবসরে
আতশি কাচের গুঁড়ো জড়ো করে চুপে

ঢেকে রাখি ফাঁকফুঁক, দর্জিঘর, ঘড়ি ও জানালা।

 

।। চাঁদেপাওয়া গাধা ও উজবুক ।।

একটি নৌকায় যেকোনো সন্ধ্যায়
সবার অগোচরে সুদূরে যেতে চাই
অথচ নদী নেই দখলি জল ঘিরে
উঠেছে বাবেলের হর্ম্যমিনার;

নৌকা? সে-ও নেই; আকাশগঙ্গায়
থুবড়ে পড়ে আছে চন্দ্র সদাগর
তোমাকে ধরা যেতো একটি শব্দে
সান্দ্র মেঘস্বরে তোমাকে বলা যেতো
লম্বা মেহগনি গাছের শীর্ষে
তোমাকে বসিয়ে দিলেই উড়তে

ক্লান্ত পরিযায়ী পাখিরা আসতো
লম্বা লেজঝোলা আসতো দলে দলে;
শিশুর মতো তারা
নিতো কি বিশ্রাম
তোমার কুচযুগে

নিবিড় আশ্রয়ে?

শব্দ নেই তাই তুমিও নেই আর
সাঁতরে চলে গেছ অধরা পিচ্ছিল;
অনেক জলসিঁড়ি অনেক ঘুরপথ
স্নান ও সাঁতারের অনেক কৌশল
রপ্ত করে তবু বনেছি উজবুক;

ঘুরছি দিশেহারা চাঁদের রাস্তায়
বক্র ঘেরাটোপে একাকী মিনোতার;
– সস্তা হোটেলের করুণ খদ্দের

চাঁদ সে দূরে বসে
দিচ্ছে টিটকারি
করছে পরিহাস
তরল ঠাট্টা;

চাঁদের নিচে আর
আকাশগঙ্গায়
জাহাজ ভাসাবার
আঁটছি ফন্দি;

— আপাদমস্তক আদার ব্যাপারী

কিছুই হবে না বকছি নিজেকে
খিস্তিখেউড়ে তুবড়ি ছুটিয়ে
কানের পর্দায় শরম লাগছে
[গরম লাগছে কানের পর্দায়]
গাধার কান যেন টানছি প্রাণপণ!

স্বপ্নে উপহার পেয়েছি গাধাটিরে
নিজের মুকুরেই পেয়েছি একে আমি
চড়বো এর পিঠে মওকা মোক্ষম;
বলবো চলো ভাই, এখানে আর নয়

আমায় করো আজ তোমার সওয়ারি;
চলো হে, চলো ভাই যে-তুমি তৃণভোজী
দ্যুলোক ত্রিলোকের অমর ভারবাহী;

চলো হে, চলো ভাই
সেখানে যাই চলো
যেখানে মাঠে মাঠে
মেঘের গোরু চরে;
বাতাসে মাথা নাড়ে শষ্প, ফুল

তৃণের গালিচা সেখানে প্রসারিত
ঘাসের উৎসব সেখানে অবারিত
সেখানে গিয়ে তুমি চরবে দিলখোশ
দুলিয়ে শিশ্ন পেন্ডুলাম;

শর্ত একটাই!
শিশুর মতো এই
অবুঝ শিশ্নকে
পাড়াতে হবে ঘুম;
রাখতে হবে একে
ত্বকের খাপে ভরে
[ও বড়ো বেয়াড়া, অনেক আব্দার!]

চলো হে, চলো ভাই
অনেক পথ বাকি
চড়াই উৎরাই
খানা ও খন্দ
অতল গহ্বর
লম্বা পথ বাকি;

চলো হে, চলো ভাই ভোরের আগে চলো;
প্রচুর ভাঁটফুল সেখানে ফুটে আছে
হ্রদের পাড়ে গাছ ঝাঁকড়া উন্নত
জলের আয়নায় মীনেরা কেলিরত
মণি ও মরকতে পরিরা হাই তোলে

কোমল শয্যায় পরির মনভার
– রাতের জঙ্গলে মোরগ ডাকছে;
গাজর শালগম সাজানো থরে থরে
ভরেছে কান্তার ভরেছে মাঠঘাট
মটরশুঁটি আর সবুজ গুল্মে;

সেখানে পৌঁছে
তোমার দিলখোশ!
তোমাকে ডাকছে
নবীন দূর্বার
আগামী মহাভোজ
আকাশ, রামধনু তোমাকে ডাকছে
— একটু পা চালাও।

ক্লান্তি যদি পায়
গাঁজলা ঝরিয়ে
একটু থামো আর
জিরিয়ে নাও এই
কল্পহ্রদপাড়ে;

জিরিয়ে নাও আর
জিরনো হলে শেষ
আবার পা চালাও
— জিরোবে আর কতো?

কিন্তু এ কী তুমি হঠাৎ মরীচিকা!
আমায় একা ফেলে কোথায় কই গেলে
— স্বপ্নসম্ভব চতুষ্পদ?

রাতের শ্রোণিতলে তোমায় নিলো টেনে
শ্বাপদ-পিশাচের নিবিড় অশনি?

এ-গিরিসঙ্কটে আমার কেউ নেই!
আমার চারপাশে ছায়ার দৈত্যেরা
হাঁ-মুখ জতুগৃহ। হাঁ-মুখ আজদাহা
খুন্তি হাতে ওই ভল্ল তাক করে
মিত্ররূপে আজ আসছে দুশমন;

— আসছে কিরাতেরা উঁচিয়ে বাঁকনল

আমায় ঘিরে আজ আগুন গ্লেসিয়ার
ভল্ল পাশুপত ছায়ার অশরীরী;
পত্রমোচী গাছ ঝরায় ভয়পাতা
প্রলয় মেঘজালে আমায় ঢেকে দিতে
দৈত্য দুরাচার দিচ্ছে হুঙ্কার;

আমার ঘাড়ে আজ গরুড়-নিশ্বাস
প্রেতের পাখসাটে উড়ছে রাত্রি;

কাঁপছে থরো-থরো আকাশে শামাদান
রাত্রি-রৌরবে আমার বলিদান!
আমায় ঘিরে আজ মুখোশবন্ধুরা
তাদের উপহার ভ্রামরী মিত্রতা

সৌর মাকড়ের
ধর্ষকামী জাল
হচ্ছে প্রসারিত
আমার চারপাশে

আমায় ঘিরে আজ
ঘুরছে অবিরাম
ঘুরছে পিপাসায়
পর্নো ডাইনিরা;

ঈষৎ পিঙ্গল তাদের কুচযুগ
তাদের জঘনের তীব্র আলোড়নে
কাঁপছে কৈলাস
চূড়ায় মহামুনি

আমার বন্ধুরা চেয়েছে বলিদান
আমার স্বজনেরা আমার লোহু চায়
অশ্বমেধ আর স্বপ্নমেধ চায়;

রাতের টেবিলে আমাকে চায় তারা
সোমের গেলাসে আমাকে ভরে নিয়ে
চেয়েছে চেখে নিতে আমারই রক্ত!

কম্বুগ্রীবা নেড়ে তাহারা হাসছে
এনেছে ক্রুশ আর খড়্গ হাড়িকাঠ
আমার বলিদানে নড়ছে কপিকল!

–কার্পেথিয়া থেকে আসছে ড্রাকুলাও

হে মাতঃ বঙ্গ তাপিত অঙ্গ
বক্ষে তব আজ দাসেরে ঠাঁই দাও
স্বপ্নপরাহত এ-মহাপাতকীরে
তোমার নিদালির দাও হে, পরশন

দুঃখতাপহরা তোমার পয়োধরে
শান্ত করো আর করো হে, মশগুল

ফিরিয়ে নাও মোরে
এ-হেন কীটাণুরে
তোমার জরায়ুর
অশেষ নির্ঝরে

 

।। জন্মান্তর ।।

নিজেকে সরিয়ে দূরে, আলগোছে,

গাছের গোপন কোনো ডালে রেখে আসি;
নানা রকমের হাওয়া, রোদবৃষ্টি হিম-কুয়াশায়
পাখি এসে ঠোকরায়। ভাবে:

পেয়েছি কেমন ফল। বোঁটকা-ঘ্রাণ।
তবু কাছে টানে!

মৃত্যু-অশ্রু-হাওয়ার নিস্বন থেকে
তৈরি হয় গান। বাজে পাতার মর্মর
বিশাল ছাতার নিচে।

হয়তোবা আনে শিহরণ
পরিযায়ী ডানা;

নিজেকে ঘুমন্ত রেখে, ছায়ারূপে, বেরিয়েছি
সূর্যহীন কান্তারের পথে
নিচে গিরিখাত, নিচে পতনশীল হিমবাহের
ভেতর দিয়ে আধো-ভোরে নৌকা চলেছে একা।
বুঝিবা তারও গায়ে এসে লাগছে
বাঘের লাল ক্ষুধার আঁচ;

আর এখানে, এই সূর্যহীন অচেনা প্রদেশে, এই মৃগমদ-লালায়িত দেশে
অপণা মাঁসের পানে ছুটে যাচ্ছে তীর-ভল্ল, পাশুপত সহস্র বৃশ্চিক। আর
চতুর্দিকে জমে উঠছে রক্ত-ফেনিল শুধু শিকার! শিকার!

রক্ত-মাংসপরিতৃপ্ত শকুন-চিতা-হায়েনাদের ঘুমের বুদ্বুদ নিয়ে
নবদশাপ্রাপ্ত এই পৃথিবীতে ফিরে আসি যদি,
নিজেকে কি ফিরে পাবো
এরকমই চেনা রোদে, পাতায়-ছত্রাকে মেঘে মেঘে?

এ-আমার লুপ্তদেহ ধূমায়িত পাতার শিহরে!

।। সংসারে যাবো, পাহাড়েও যাবো ।।

১.
দুটো দিন সংসারে যাবো
বাকি দিন পাহাড়ে কাটাবো
যেখানে মেঘের নিচে সদা

জ্বলে চূড়া। প্রভূত ইশারা;
পরকীয়াঘন এ-চূড়ায়
আলবত ভেসে যাবো মেঘে
–মানা কোরো না হে, পরাঙ্মুখ!

পরকীয়াঘন এই বীজ
গোপনে বোনার আশা করি
গোপনে যখনই বীজাধার
মেঘে মেঘে চায় বিস্ফার
অসময়ে কোত্থেকে এসে
কড়া নেড়ে চলেছে সংসার

ভদ্রতার কাঠহাসি জ্বেলে
দোর খুলি। খুলতে হয় খুলি;
কেমন বিচিত্র এক স্রোতে
সংসার-তরণী চলে ভেসে;

২.
কিশলয় ভেদ ক’রে আলো
এ-বিহানে করে ঝলোমলো

চৌকিতে শয়ান তিন মায়া
প্রাণাধিক স্ত্রী-পুত্র-দুহিতা

সমস্বরে তারা বলে: যাও,
খাও-পিয়ো সংসারের মধু;
–পরধনে তাকায়ো না সাধু

হোক যতো মধুক্ষরা হেম
মজো না হে, অনুচিত প্রেমে

আর-সব অবিহিত, মায়া;
যতো পারো করো নিজকিয়া
সংসার করো হে, মন দিয়া!

থাকো পোষা, থাকো সুখী সঙ

–সংসারে ঘুমাও, পাদ মারো;
ভুলে কোথা পলায়ো না যাদু!

সংসার কেবলই ডাকে হায়!
অসময়ে কড়া নেড়ে যায়:
দেশে দেশে সদা জায়মান
বেশুমার সংসারের কলি

৩.
দুটো দিন স্বপ্নে পাবো ছুটি
দুটো দিন বুনবো দুটো বীজ
–ভাবি। ভেবে পুলকিত হই;

সংসারে এ-ওর কাছে যাবো
যে চায় তাকেই বীজ দেবো;

সংসার এ-ওর কাছে থাকে
আমি থাকি মেঘ বরাবর

বাস্তবে না হলেও ঠিক
প্রতিদিন মেঘ বেয়ে উঠি;

বাস্তবে না হলেও ঠিক
দুটো দিন পাহাড়ে কাটাবো;

মেঘের ঠিক নিচেই ঘুমাবো!!

 

।। স্টেশনের নাম যশোদল।।

স্টেশনের নাম যশোদল
রূপবান বাষ্পের এঞ্জিন
রাতে এসে হিস্ হিস্ থামে

–এটুকুই স্মৃতি-সম্বল

ক্ষতনীল তৃতীয় বিশ্বের
প্ল্যাটফর্ম ভ’রে আছে লোকে;

ক্ষণ পরে ফাঁকা, চুপচাপ
ঘন রাত যেন স্ফটিকের

দিগম্বর নওল কিশোর
মরাসোঁতা নদীতে সদল
ঝাঁপ দ্যায়, সাঁতরায় জলে

ছোটো তরী ভাসে অবিরল;
–এতটুকু স্মৃতি, সম্বল!

বটপাতা দুপুর-বাতাসে
ঝিরিঝিরি স্বর মনে আসে;

বোঝাখানি নামিয়ে পথিক
গামছায় মুখ মোছে, কাশে;

লাল পাকা ফলের গতরে
ঠোক্রায় পাখি ডালে ব’সে

ফ্লোরোসেন্ট চোখ নিয়ে যদি
এ-আঁধারে খুঁজি শ্রীচরণ
সলিলে কী ওহে, কালাচান
চলমান নৌকাই নদী?

মোরে ফের ডাকে যশোদল
মম হৃদি হয়েছে উজল

মোরে আর কাটবে না নাগে
মম চিত ভরে আছে ফাগে

 

।। চান্নিপশর রাইতের লৌড় ।।

চান্নিপশর রাইত, লিলুয়া বাতাস। সুমসাম
আন্ধা গলির চাইর পাশ আচানক ফকফকা শাদা।
চাক্কা-নাই-রিকশা-এক রাইতে একা হইছে মাতেলা;
যেমুন জোয়ান লৌড়ের টাট্টু!
রিকশার গতরে খালি ফাল্ পাড়ে আল্‌গা মর্দামি

দুই চউখে সুরমা দিয়া
বুড়া চৌকিদার কালা মিয়া
পাহারা শিকায় তুইলা
নবাবের হুমুন্দির লাহান
চৌকিতে পুটকি উঁচায়া ঘুম যায়।

গল্লির ঘাউড়া কুত্তা, হে-ও ভি ঘুমায়
এই মওকা লা-জওয়াব!
গ্যারেজের খিড়কি দিয়া,
সরু হয়া,সরু হয়া-হয়া,
চিকনে সে আইছে পলায়া।

বাবরিচুল, আ-বিয়াইত্তা, চানখাঁরপুলের কেরামত;
হালায় এক আজিব মিস্তিরি!
মহল্লার হগলে ওরে ‘‘আর্টিস্ট সা’ব’’ কয়া ডাকে।
রিকশার পাছায় একদিন খুবসুরত ছবি একখান
বড় মহব্বতে আঁইকা দিছে খানদানি হাতে

আসলে হালায় এক আউলা চান্দি
ইস্কুরুপ ঢিলা। মাগার খাসদিল্।
ওর ওই ফাগলাগা দিলে
নানান রঙের তেলেস্মাতি ;
মখলুকাতের বেবাক সুন্দর জিনিস
জিন্দেগিভর ওর দিলের জমিনে আঁকা।

কেরামত বহুত যতনে আঁকে আজগুবি ছবি বেশুমার
সেই ছবির জমিন জুইড়া গাছপালা নাও-নদী, পশুপঙ্খী,
লায়লা-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ভাল্লুক-উল্লুক সব, বান্দর-উন্দর হনুমান
ডানাঅলা বোর্‌রাক, পক্ষীরাজ, ঘোড়া, জিনপরি
ছিনেমার নায়িকা মৌছুমী আর পপি-ছাবনুর
ফুল-পাতা আসমানের চান ও সিতারা।

মনে অয়, ওরা সব বোবার লাহান
চায়া চায়া দেইখা যায় দুনিয়া ও আসমানের
আন্ধাউন্ধা তামাম খেইল।

মনে অয় রাইতের লিলুয়া বাতাস তারে, রিকশারে,
উড়ায়া নিবার চায় দূরে
হীরা-পান্না সোনাদানা মায় জহরতের পিদিম
জ্বলে তার দিল-পিঞ্জিরায়।

আর ওই তারার জেওরে ভরা আসমানের নীল সিংহাসনে
বেহুদা বইসা এক আকেলা সুলতান
খালি খালি ভাব লয়, গাইল পাড়ে
দুনিয়ারে দিমাগ দেখায়।

আউলা কেরামতের লাহান ওই হালারও ভি
ছিলা চান্দির তলে দুই একখান
ইস্কুরুপ ঢিলা মনে অয়

চান্নি-পশর রাইতে লাখে লাখে গুলবদন পরি
রিকশার গতরে খালি খুশবু ছিটায় আর
চউখ মাইরা ডাকে ইশারায়

রাইত এক সমুন্দর। আলিশান ঢেউ তার দিলের কপাট
চাবি ছাড়া খুইলা দিয়া যায়। দেখায় তেলেসমাতি।
গতরের পানসি তার সেই ঢেউয়ে খালি লৌড় পাড়ে ;

লৌড় পাড়ে না উইড়া চলে?
ঠাহর মিলে না ওর মালেটাল, বেচইন দিলে।

আর্মানিটোলার রাস্তা, ডাইলপট্টি, ডুরি আঙুল লেন
নবাবপুর, সুরিটোলার গতরে জোনাকি জ্বলে আর
দিলখোশ চান্দের পিদিম লড়েচড়ে

র্মোজ্বালা! এইটা খোয়াব না খোয়াবের
মাঞ্জামারা আজগুবি ঘুড্ডি একখান

—জানে কোন্ হউরের পুতে?

চিপা গল্লির ভিতর থিকা, ইবলিসের চেলা যেমুন,
দল বাইন্ধা আৎকা-আচানক ঘাউড়া কুত্তা ভি আহে।
খামাখা চিক্কুর পাড়ে, পিছে পিছে খালি লৌড়্ পাড়ে।

মান্দির পোলারা এলা লৌড় পাড়ে ক্যালা?

 

।। শীতের দৈত্য ।।

‘‘কেননা তোমার দ্বারা আমি সৈন্যদলের
বিরুদ্ধে দৌড়াই,
আমার ঈশ্বরের দ্বারা প্র্রাচীর উল্লঙ্ঘন করি’’
—স্যামুয়েল ২২/বাইবেল

আর দ্যাখো, ভৈরবে মেঘনার তীরে আমি বাদাম ফলাই
আর, শাদা বালুর ভিতরে হাত গলিয়ে
ক্রম-বর্তুল বীজের স্নেহ কুড়িয়ে চলি– ধীরে,

কুলিয়ারচর থেকে মাছ আর
তাদের সম্ভাবনাময় তরুণ ডিমগুলিকে
উপহার হিসেবে পাঠাই নানাদিকে
নানা রিরংসাঘন শহরের ঠিকানায়

অসংখ্য বনঘুঘু আর পায়রার লাশ মাড়িয়ে
আমাকে পৌঁছাতে হয় তোমার উঁচু প্রাকারঘেরা শহরে

সেখানে ঝাঁ-ঝাঁ রোদের ভেতরেও
করমর্দনের উষ্ণতাগুলি হয়ে আছে
ঠাণ্ডা-হিম ঘুমন্ত কামান
আর, প্রেম সেখানে ছেঁড়া ও পুরনো তাঁবুর ভেতরে
মৃত্যুর তরঙ্গ-বেষ্টিত

দূর,ধ্বস্ত, মলিন, কাতর মফস্বলে আমি থাকি!
রাত্রির অসংখ্য মরানদী উজিয়ে ভাবি:

স্মৃতি-ভস্মের ধু-ধু প্রান্তর পেরিয়ে
বিপুল দামামাসহ আমি আবার
এক শীত থেকে অন্য শীতে
তোমার ক্রূর সৈন্যদলের পেছনে দৌড়াবো

 

।। ঈর্ষার এঞ্জিন ।।

(সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের জন্য)

ঈর্ষার এঞ্জিন গরজি ওঠে আজ; ঘুরছে মঞ্জুল মেঘাঙ্কুর;
ঘুম এক চিৎকার! আকাশে চুনিলাল সূর্য-ক্রন্দন ঝরায় খুন।
উন্মাদ চায় তার অধরে অনিবার স্বর্গবেশ্যার স্তনাগ্র।
কোন্ মন্‌কির কোন্ নকিরে লিখে মোর কোন সে-পাপ কোন অধর্ম?

অন্ধের তন্দ্রায় ক্রমশ খ’সে যায় রাত্রে বর্তুল ডালিমফল;
জন্মের-জঙ্ঘায় অঝোরে ঝরে মেঘ;– ফুটছে ফুল এক অলক্ষ্যে।
নি:সীম কান্তার ঘুমে ও তৃণে পার। রজ্জুপথ–দূর— গভীর ডাক;
এক-ক্লোন-চণ্ডাল ঢুঁড়েছে পিপাসায় নফ্‌সে আম্মার–কি লান্নত!

বোর্‌রাক জন্মায় জেগেছে চিঁহি তার; শুনছে তন্ময় মদনটাক !
লোল্‌জিভ রাক্ষস আঁধারে খুঁজে যায় কূর্মপৃষ্ঠের আ-নীল মদ।
আর কার চরকায় কে এসে ঢালে তেল কার আপনজন কে কার পর?
রক্তিম জল্লাদ চেয়েছে রতি আজ বন্য রাত্রির আলিঙ্গন।

কোন মান্দাস কোন গরলে অচেতন ভাসছে ঘুম-নীল লখিন্দর?
কোন মৎসীর লেজ নিমেষে হয়ে সাপ বক্ষে বিষদাঁত ছোবল দ্যায়?
এক হিঙ্গুল মুখ ক্রমশ জোড়া চোখ ফুটছে ঘোর লাল এ-রাত্রে!
ঝঞ্ঝার মেঘ ধায় ছুটিয়ে ঘোড়া তার হানছে মৃত্যুর অপস্মার!

আজ তোর স্কন্ধের গরিমা খ’সে হায়! ছিন্নমস্তার তাথৈ নাচ!!
মনসুর হাল্লাজ জপেছে দমেদম মাংসে মজ্জায় ‘আ’নাল হক্‌’
ষণ্ডের তিন শিং খুঁজেছে যোনিকূপ অন্ধ মুদ্গর আসন্ধ্যা
বল তোর উড্ডীন ডানাটা চাটে কোন ধূর্ত জম্বুক—মানিক মোর!

শিশ্নের উদগম! পেতো যে উপশম জাগতো হররোজ বালার্ক
ছম্‌ছম্‌ রাত্রির বেভোলা পথিকের রক্তে রম্ভার রতির স্রোত
চুপ-শ্যাম দাঁড়কাক দ্যাখে না কোনো চাঁদ উষ্ণ ফল্গুর সে-উদ্গার!
শয্যায় চুপচাপ দু’জনে দুটি লাশ ক্লান্ত, প্রেমহীন, নিরুত্তাপ!

স্পন্দন শেষ হায়! নদীতে ভেসে যায় কার গো কার লাশ মুখের ডৌল?
অস্থির খুর তার কাঁপিয়ে গিরিপথ রক্তে চঞ্চল ঘোটক ধায়।
হায় কোন খঞ্জর বাঁকানো খরশান চায় ঘুমন্তের লোহুর মদ?
দুগ্ধের নির্ঝর নোনা এ-শরাবের পাত্র উপচায় আ-সৎকার।

দিলখোশ পক্ষীর ঠোঁটে যে ধরা মাছ তারচে’ উজ্জ্বল কে ঝল্‌মল্‌?
স্পর্শের বিদ্যুৎ ছড়িয়ে কুহরণ রাত্রি বন্ধুর—উড়ালময়!
নিষ্ফল পুষ্পল কাননে মদালস জমছে হিম-নীল লিথির জল
বঙ্কিম চন্দ্রিম হেরো হে, এ-আনন– একটি ফল্গুর একুশ মুখ!

সুমসাম প্রান্তর!—বু কে কুহু গায় শূন্য মঞ্চের নেপথ্যে?
তবলায় তিনতাল বেজেছে অনিবার নৈশযুদ্ধের আমন্ত্রণ!
অদ্ভুত বর্ষার জঘনে ঝরে নুন লক্ষ তীবরীর তীরাস্ত্র।
ভঙ্গুর মুখ যার বোতলে ভরো তার তপ্ত নিশ্বাস ব্যথার ক্ষার।

পঙ্গুর ঈর্ষার কতো না গুরুভার মৃত্যু-মুদ্রণ আকৈলাস!
অদ্ভুত পিঞ্জর পাখিরে ফিরে চায় স্বপ্ন-সম্ভব অলিন্দে;
মর্মের সংক্ষোভ বেদনা হাহাকার করছে মশগুল ভূমণ্ডল
ডুম্বুর পুষ্পের স্মরণে অনিবার মন্দ স্পন্দন এ-অঙ্গার!!

 

।। অভিজ্ঞান ।।

১.
চোখ দুটো দেখাও আমাকে। আমি
রাত্রির বাতাস, ঘ্রাণ
তবেই না বয়ে নিয়ে আসি

২.
কোথায় আশ্চর্য মেঘ?
কোথা গেলে ভিনদেশি?
আমি যে কাতর!
তোমার বাড়ির পাশে
দুপুরে কোকিল হয়ে
বসন্তে গোপনে এসে ডাকি

 

।। বীতশোক ফিরে এসো ।।

১.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ ঢেলেছে আগুন;
জ্যোতিরথে চোখ রেখে চেনা পথ শান্ত পায়ে হেঁটে
নিজেকে শুনিয়ে কোনো গূঢ়কথা, গোপন মর্মর
বীতশোক, চলে গেছে। পশ্চিমের প্রত্যন্ত প্রদেশে।

আমার ‘সামান্য ক্ষতি’?– বিপর্যয়! খসে পড়ে ফল!
বহুঘুম-রাত্রিব্যেপে অনৃত ঢেউয়েরা!— তরী ডোবে!

২.
পুরাতন বিষণ্নতা, গোপনে যে আঙুরলতায়
ফল রূপে পেকে ওঠে, সারারাত তস্করের ভয়ে,
শুষ্ক তৃণে ঢেকে তারে সযতনে দিয়েছে প্রহরা।

৩.
প্রত্যহের দুঃখ-দৈন্য বেদনা ও ক্লেশে–- হয়তো সে–
বসন্ত-রুধির এনে চেয়েছিল কিছুটা মেশাতে;

–যেন নীল প্রজাপতি এসে তার কাছে চায় মদ;
অধীর মক্ষিকা শুধু দ্রাক্ষা মেগে উড়ে উড়ে চলে।

৪.
সন্তর্পণে একা বসে পানপাত্রে দিল সে চুমুক;
লম্বা ঢোঁক গিলে নিয়ে স্তনলোভী শিশুর নিয়মে
আলগোছে মৃগনাভী ভরেছে উদকে– স্বার্থপর!!
‘শিশির-চোঁয়ানো রাতে, মধ্যদিনে দহনের শেষে’
অন্যরা ঘুমিয়ে ছিলো?— এ-সুযোগে হলো সে কর্পূর?

৫.

হেমন্তের মঞ্চ থেকে গরুড়ের ছড়ানো ডানায়
অতর্কিতে চড়ে বসে শরীর সারাতে গেছে– দূরে।

কত দূরে? কাউকে বলেনি; শুধু উপশমহীন
অনন্ত গোধূলিপথ ছেয়ে আছে হলদে পাতায়!

–এই তবে গূঢ়লেখ? বৃথা তব নর্তকী ও মদ ?

৬.
বীতশোক, তুমি আছো! অনন্ত পশ্চিমে নাকি পুবে?
অসম্ভব ভুলে থাকা; লিথিজলও স্মৃতিসমুজ্জ্বল!

অফুরান দ্রাক্ষা থেকে অন্ধকার প্রশীর্ণ আঙুলে
নিজের ভিতরে, চুপে, শমদায়ী পেড়ে আনো ফল?

৭.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ! জ্বলছে আগুন!
ফিরে এসো সেই পথে;– ঝরাপাতা-মুখর সরণি–
কিছুটা যবের মোহে, কিছু প্রেমে, শর্করার টানে।

৮.
উপশম হলো ব্যথা? পিঞ্জিরার ভেতরে পাখির?
দ্রুত তবে চলে এসো, পরিত্যক্ত আঙুরের বনে;

অনন্ত গোধুলিপথ ভরে দিয়ে পাতায়, মর্মরে।

।। ভিন্ন রণ-অভিজ্ঞতা হইতে আসি ।।

[[ও হে, মানুষের ভালোবাসার চোরসকল, যে তোমরা আমা হইতে উত্তম,

সেই তোমাদিগের প্রতি অসমাপ্ত রূপে– নিবেদন করি–ভয়ে–এই পংক্তিসকল।আমেন]]

এই বাঙ্ময় পংক্তিসকলকে—যাহা অপরের—আমি ঈর্ষা করি!
তৎহেতু, গোপনে, একাগ্রচিত্তে, তাহার না-দেখা বার্লিক্ষেতের ছায়ায়,
তৃণ-আড়ালে বসিয়া, ক্রমাগত, আপন খড়্গ শানাই!

অপরের হস্তলালিত আর গৃহলালিত হে, পংক্তিসকল!
তোমাদিগের রচয়িতা যে-শাহানশাহ, আর যে তোমাদিগের পালয়িতা
সমূহ বিনাশ তাহার—এই আমাহস্তে! যে আমি অব্যর্থ আর কঠোর, আর তোমরা
অপারগ হইবে আপনাদিগকে রক্ষায়। যতক্ষণ লাবণ্য তোমাদের ঘিরিয়া রহে। তাহা উবিয়া
যাইবে! কর্পূরের ন্যায়। কিন্তু আমি, মেঘ-বিদারক আমি বজ্রের গুরু আর তাহার পালয়িতা
আমি; পর্বতের ন্যায় বরফসমেত আমি। রূঢ়-শীতল! চূড়ায় বজ্র আর লৌহ-শলাকাসহ মৌনী
আমি সদানিম্নগামী প্রপাতের নির্ঘোষসহ বিরাজি করি।

আর আমার ধ্যান ও ধাবন সত্য—চৈত্রদিনে সূর্যের ন্যায়; যাহা আয়নার ভিতর বর্ণকে
পাঠায় তার গরিমাসহ। যে সমুদয় রঙের আধার আর বিচ্ছুরক। আর যে উদয়াস্তের
রূপকার; দিবাভাগে সেই সূর্য আমার ললাটশোভা!

আমি চক্ষু নিবদ্ধ করিয়াছি অসীম অতিতিক্ষায় তোমাপানে; আর, তোমার নধরকান্তি
পালয়িতার বক্ষপিঞ্জরের পানে— ক্রূর বাজপক্ষীর ন্যায়!

মম ঈগলচঞ্চুপ্রতিমানাসিকা দূর হইতে তোমারূপ শিকারের প্রতি ক্রমধাবনশীল। আর তোমরা
নিমেষেই ছিন্নভিন্ন; প্রধূমিত তোমাদের দুর্গশিখর ও ত্রিপলাচ্ছাদিত গোপন সৈন্যনিবাস! নিশ্চয়
তোমরা অচিরেই অজস্র বাজের ভক্ষ্য, যেমতি তোমাদিগের নগ্ননধরকান্তি পালয়িতা;
আর আমি ক্রূর আর অ-তিতিক্ষু বাজের পালয়িতা। সকল পক্ষবিধুনন আমার। কেননা
সর্বত্রগামী আমি। আর অবধান করো যে, আমার খরবেগ নদীতটের অতি সন্নিকটেই
তোমাদিগের বসতি;

বৃক্ষ আর পত্রশোভিত, সৌন্দর্যলালিত গৃহের অলিন্দে তোমাদের দেখি। আর আমি ধাবন করি
ধীরে—যেমতি শশকের প্রতি ধাবন করে বাজপক্ষী। আর আমি পাঠাই তাহাকে—ক্রূর
বাজপক্ষীকে–তাহার বক্র নখরসহ, যাহার অক্ষিগোলকের ভিতরে ফলিত এক শীতল চাহনি;
আর তাহা সদা-নিবদ্ধ তোমাদিগের প্রতি আর তোমাদিগের পালয়িতার প্রতি!

আর জানিবে, এই আমাহস্তে অত্যাসন্ন আর অবধারিত তোমাগের বিনাশ।যে তোমাদের
পালয়িতা—যে তোমাদের শাহান শাহ–তাহার বিনাশ এই আমাহস্তে—জানিবে!

আর তাহা সত্য!
আর স্বচ্ছ তাহা দিবালোকের ন্যায়;
আর তাহা অবধারিত!

জীমূতে বজ্র যেমতি!

এবে আইস, তোমাপানে এক্ষণে পাঠাই প্রাচীন ব্যাধজাতি কিরাতগণের অব্যর্থ অস্ত্রের ন্যায়
লক্ষ্যনির্দিষ্ট শব্দসকল;
যাহা আমারচিত আর সুন্দর!

আর, আমি তাহাদিগকে পাঠাই তোমাদিগের আর তোমাদিগের পালয়িতার বক্ষপিঞ্জরের
নিশানায়!
তোমাদিগের আর তোমাদিগের পালয়িতার পৃষ্ঠদেশের দিকে
চরম রূঢ়তায় আর পরম অনুরাগের সহিত!!

তুমি আমার শত্রু; তথাপি আমি পরমাত্মীয় তোমার।— অতএব, আমি
গরলেরে অমৃত করি, আর অমৃতেরে গরল।
ইত্যবসরে মৎরচিত শব্দসকলকে পাঠাই তোমাসকাশে,— তোমার বক্ষের নিশানায়!
পরম যত্ন আর অনুরাগের সহিত!
—কিরাতগণের বাঁকনলের ন্যায়!

জানিও, রণদামামার ভিতর মুহূর্মুহূ যে জাগিয়া ওঠে
সে অন্য কেহ নহে—সে আমি।
জানিও, যখন রণলিপ্ত তখন স্বজনহন্তা আমি;
—কেননা ইহাই কর্তব্য আমার!
কেননা ক্ষত্রিয় আমি!

প্রেমাস্পদ আমি হননের।

লোহার বাসরঘরে কালিদহে, সাঁতালি পর্বতে দ্বিভাঁজ জিহ্বা লইয়া গোপন ছিদ্রপথে যে আসে,
সে আমি!

আর জানিও, রণবাদ্যের ভিতরেও যে ফুল্ল আর অনির্বচনীয়— সে আমি;
আর, অসিসঞ্চালন-মুহূর্তেও কপালে শিশুর চুম্বনের স্মৃতি আর বিষাদ লইয়া যে—সে আমি!
আর, আমার অভিন্ন আনন তোমাদের সকলের আনন লইয়া
বহুরূপে ঘুরিতেছে —শোভাদারুণ বহু-বহু রূপে:
আর, ভীষ্ম—যে ছিল অভেদ্য—শরশয্যায় সে এখন নিথর—আর, পরমাত্মীয় সে
আমার;

তথাপি ইহাই আমার কর্তব্য যে, তাহাকে বধ করি—পরম আদরের সহিত—আর
সহস্তে!

কিন্তু কেন এমত হইল যে, সহসা চক্ষু জ্বালা করিয়া উঠিল, আর আমি অন্যদিকে মুখ
ফিরাইয়া লইলাম?
এক নিমেষমাত্র! বৈকল্য হইল। কিন্তু পরক্ষণেই আমাতে ফিরিয়া আসি আমি;
আর ফিরি আমার রণ-কর্তব্যের প্রহরায়!

কেননা ক্ষত্রিয় আমি! কেননা পাষাণে রচিত আর শীতল আমি। আর, আমার সুদৃঢ় সুপ্রাচীন
বক্ষপিঞ্জর চিরঅভেদ্য; আর, তাহাতে সুরক্ষিত যে-হৃদয় তাহা, কে না জানে, গ্রানিটে
নির্মিত!

তথাপি, ক্ষণকালের তরে, কেন কাঁপিয়া-নড়িয়া উঠিল সে
কলিঙ্গের রণময়দানে রাজা অশোকের ন্যায়?

অত:পর আমি তাহাকে—আমার সহসা-অবাধ্য হৃদয়কে থামাই—যে ভুবনাধিপতি
সেকান্দরের পিতা, মাকিদোনিয়ার রাজা ফিলিপের তেজি অশ্ব বুকিফেলাসের মতো অবাধ্য।
–আমার ক্ষণবিচলিত হৃদয়কে!

কেননা, ইহা আমায় সাজে না। কেননা ক্ষত্রিয় আমি!

অতএব প্রেম নহে, হাস্য, করুণা কিংবা অশ্রু নহে; আমার রহিয়াছে কেবল কর্তব্য আর
ক্ষাত্রতেজ!

ইত্যবসরে দিবস আইসে আর দিবস চলিয়া যায় আর আইসে আর চলিয়া যায়;
আমার রণবাদ্য সদা বাজিয়া চলে! অজস্র মেঘবাহিনীর ন্যায়!!
আর বিলক্ষণ জানিও,

একদা সকল মরালগ্রীবা, সকল প্রশস্ত আর উঁচু স্কন্ধের গরিমা আমার বাণে বিদ্ধ হইবে!
আর লুটাইয়া পড়িবে
হেক্তরের ন্যায়
ধূলিতে!!

হেকুবার আর্তনাদের মতো অফুরান দিবস আর রাত্রি!

আর, তোমাদিগের হৃতযৌবন জনয়িতাকে, দ্যাখো,
পরাজয়ে নতদৃষ্টি আর ভূপাতিত;
ধূলিলাঞ্ছিত আর করুণ,
জরদ্গব তোমাদের পালয়িতাকে দ্যাখো:
—উল্টাইয়া পড়া কিস্তিসহ!—তীরে!!

ইহাই ঘটিবে,
আমি বলিতেছি,
ইহা অবধারিত,
আর ইহা সত্য!!

আমি ছিন্নবস্ত্র,
তথাপি সরোবরে দীর্ঘগ্রীব মরালের ন্যায় ক্রম-উজল হে!
আমি শাহান শাহের শাহান শাহ!
সদানিবিষ্ট আর স্থিরদৃষ্টি
ক্রমধাবনশীল আপন লক্ষের প্রতি

আর তোমাদিগের জনয়িতা আমার সদালক্ষ্য, —আমার নির্মম নখরবর্তী—সদা।
ষণ্ডের চোখের মণি যথা! যাহাকে নিশানা করিয়াছিল অর্জুন
সেই ষণ্ডের ডাগর চোখের মণির প্রতি যথা।

সদা রিরংসু আর হননেচ্ছু অমি!
তোমাদের জনয়িতা একমেবাদ্বিতীয়ম নিশানা আমার;
আর ভক্ষ্য আমার অসীম ক্ষুধার!
আর, আমি তাহার দুশমন;
আর, সখাও আমি তাহারই!

আর জানিবে উভয়ের ক্ষেত্র একই—তাহার আর আমার—তথাপিও,
উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন রণ-অভিজ্ঞতা হইতে আসি!!


।। সহোদরার জন্য একটি লাজুক টিট্টিভ ।।

টিট্টিভ পাখি: দূর অতীতের লোবানে ডোবানো পাখা
নিয়ে এসেছিল; তার মুখ আজো উঁকি মারে জানালায়।

কামার্ত স্রোত খসাচ্ছে কার বসন্ত-আঙরাখা?
মা-মেরি তোমার? এ-রাম এ-রাম কী বাতাস বয়ে যায়!

দূর নেব্যুলার খাঁজে খাঁজে শুধু ইশারার উপহার
তীব্র প্যাশন! উড়ছে মেদিনী স্পর্শের বিদ্যুতে;

আর টিট্টিভ উগরে দিচ্ছে নীল বিষ জিহ্বার।
ওগো সহোদরা, জ্বালো যোনিপোকা ঘুমন্ত পর্বতে!

বিশাল-বিপুল বরফের চাঁই ঘুমের কারখানায়
নিজেকে ভাঙছে; আর দিকে দিকে একাই একশোখান
হয়ে উঁকি দ্যায়। দূর-দূর দেশে অলিন্দে-জানালায়;

শীৎকারময় অসীম ধুমল গ্লেসিয়ারে জাগে গান!

স্মৃতি-টিট্টিভ, যোনিপোকা আর বাতাসের উৎপাত
স্রোতে ভেসে আসে ওই দ্যাখো, ওই, অযুত-নিযুত পাখা!

মুচকি হাসেন মা-মেরি, এবং, বুনেই চলেন তাঁত!
কে এসে খসায় ভগিনী তোমার বসন্তে আঙ্‌রাখা?

 

।। মম প্রিয় বন্ধুগণ ।।

[আশির দশকের কবি-বন্ধুদের জন্য]

১.
মম প্রিয় বন্ধুগণ তপ্ত লাল শলাকা শানায়। আর
রক্তজবা কানে গুঁজে শব্দ করে ভয়ানক হাসে

মাঝেমাঝে বক্ষো’পরে বসে তারা
মোর পানে উঁচায় খঞ্জর।

তাদের চেহারাগুলি ঘোর লাগা
লাল আর বিভীষিকাময়

আমাকে তারাই ফের পিঠে নিয়ে চলে বহুদূর।
আমারে তারাই ফের তৃপ্ত করে
লেহ্য-পেয়ে, সুরায় আরকে!

দিন ক্রমে নত হয়!
সূর্যের গ্রীবা ঢলে পড়ে
যখন সবাই ঘুমে
বদ্দিরাজ গাছে এক চোর
মগডালে রুপালি, বর্তুল।

সাদা-নীল পরচুলা, উঁচু টুপি
লাল মোজা, কালো মোকাসিন
বিনোদক বাঁশি নিয়ে
রাতেই নীরবে তারা আসে;

সময় হলেই তারা অবলীলাভরে
বুকে উঠে দ্রুত হাতে চালায় খঞ্জর!

(সূর্মাটানা চোখজোড়া প্রপীড়িত অন্ধ খোড়লে!)

রুপালি নদীর জলে ভিস্তি ভরে
দল বেঁধে কারা আসে, কারা যায় হেঁটে
মোগলটুলিতে আর আরমানিটোলায়?

—বৈকালিক পথে-পথে বাজখাঁই হাঁক দিয়ে যায়!

আর আমি, হয়তো চোখের ভ্রম, দেখি:
খাম্বিরা তামাকে তৃপ্ত পুরান ঢাকার সব
রাংতা-মোড়া জানালার কাচ ভেঙে পড়ে।

২.
এ সময় তুষারঝড়ের গ্রীবা নড়ে যদি সমূহ বিপদ
সুবিস্তীর্ণ স্তেপজুড়ে ঠাণ্ডা হিম করাতের দাঁত
তারপর শান্ত সবই। গর্জনেরা হঠাৎ নীরব!

চতুর্দিকে অসীম বরফ আর ধ্বংসরেখা!
পাহাড়ের উচ্চাবচ চূড়া
যেন এক বিমর্দিত স্তনের কাফেলা

ঝড় শেষ হওয়া মানে
আকাশে রুপালি তাঁবু ফুলে উঠবে এখন আবার।
ধারালো নখের নিচে ঈগলেরা লুকায় শিকার।
আর তারা বিপুল ডানার তলে, ছানাদের আগলে রাখে
সুকোমল লোমের আদরে।

অপর্যাপ্ত খাদ্যকণা, যবদানা, ঠাণ্ডা মাংস পথে-পথে এখন সম্বল;
মিতব্যয়ী, সচেতন তারা জানে রসদ সামান্য, কিন্তু
সামনে আরো লড়াই লড়াই শুধু! লড়াই! লড়াই!!

ঠাণ্ডা রুটি ধেনো মদ যবদানা তারা তাই ভাগ করে খায়।
নিজে খায়, পশুকে খাওয়ায় আর
পালান নামিয়ে রেখে ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেয় ঘাসে।

ত্রস্তে তারা জড়ো হয়
চমরি গাইয়ের ত্বকে তৈরি এক দড়াটানা তাঁবুর ভিতরে;

মধ্যরাত। বাইরে হু-হু হাওয়ার ঝাপট
তাদের ক্লান্ত হাতে অভ্যাসের তাস জমে ওঠে!

তাঁবুর ভেতরে তারা
খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!!

৩.
ক্রূর, বক্র, ভীতিপ্রদ অতিকায় তাদের নাসিকা।
গুম্ফ নেড়ে নেড়ে তারা
ত্রাহিরবে দুনিয়া কাঁপায়!

তাদের করাল ঠোঁটে রক্ত-চর্বি, ছিন্নমাংস চুনিগাঢ় লাল!
বক্র-শ্যেন-ঘোরলাগা রক্তজবা তাদের নয়ান!!

তাদের চক্ষু থেকে ক্ষণে ক্ষণে ঝরে শুধু
শত শত মৃত্যু আর শব
তারাই আমার সখা
সদাহাস্য তাহাদের কপালে তিলক;

যুদ্ধ আর খুনে লাল তরবারি দিয়ে তারা ক্রমাগত আমাকে শাসায়!!
আস্তিনের ভাঁজ খুলে বের করে খড়্গ-চাকু, জংধরা বাঁকা তলোয়ার;
কল্লাবালু দিয়ে তারা, সঙ্গোপনে, ছুরি-কাঁচি ধার দিয়ে যায়।

আর আমি ঈশ্বরের প্রিয়তম ভেড়া যেন
প্রতিদিন দিবালোকে বলি হয়ে যাই

কপালের ফেরে হায়, এ-যেনবা শেষ নিশিভোজ
সকলের মধ্যে আমি নীলমণি-যিশু!

নিজের কলবে আমি কান পেতে রই আর শুনি:
পাপাল বুল-কে ঘিরে টানা দীর্ঘ চারশো বছর
কোটি কোটি মার্জারের অবিরাম মরণ-চিৎকার!

৪.
অভ্রভেদী লাফ দিয়ে ভয়ে আমি অবিরাম দ্রুত উড়ে উড়ে
শত শত ক্রুশ আর সূচ্যগ্র শলাকা থেকে নিজেকে বাঁচাই।

ক্রমাগত ভিক্ষা করি লক্ষ নিমেষ আর একটি নিমেষ!
আর আমি দুই চোখ মুদে
প্রেমপূর্ণ রিরংসায় মম প্রিয় বন্ধুদের দেখে যেতে চাই:

মধ্যরাত। তাঁবুর ভেতরে তারা
খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!!

 

।। রুবিকন ।।

আমার সামনে এক রুবিকন, পুলসিরাত, ভয়ানক ক্রূর অমানিশা

এর সামনে একা আমি;
কিস্তিহীন, নিরশ্ব, রসদহীন
পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি!

আর আমার ভাঙা হাড়, থ্যাঁতলানো খর্বকায় দেহের ভেতরে যতো
রক্ত-পিত্ত-কফ-থুথু-বীর্য-লালা সবই
অসীম বরফে-হিমে গ্রানিটের মতো ক্রমে হতেছে জমাট;

আর ওই থেকে-থেকে ফুঁসন্ত ব্লিজার্ড এক
আর এক আনক্যানি করাল হিমানী

আমাকে আদ্যন্ত ঘিরে আছে।
সান্নিপাতিক হেতু নাসিকার ছিদ্র বেয়ে
চোখ বেয়ে যে-জল গড়ায় আর মাটিতে পড়ে না;

শূন্য থেকে বর্শা হয়ে সিগ্নি ঝুলে রয় যেন নর্স দেবতার!

সারি সারি শতশত বল্মীকূট পেছনে আমার।
তাদের আড়াল হ’তে জুলজুল চেয়ে থাকে লোম-কর্ণ শিবা।
লোলজিভ, অভ্রংলিহ জিভ নাড়ে মেদুসা-মনসা আর কালী।

আমার তরবারি নাই। তাই
দু’হাতে নখর আমার তরবারি!

আমি কি ডরাবো?
না, আমি ডরাবো না।
অসীম হিম্মত লয়ে এক পায়ে হয়ে আছি খাড়া।

কিস্তিহীন, শস্ত্রহীন, নিরশ্ব, রসদহীন— আমি একা;

পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি।
আমি ফুঁ দিচ্ছি হাপরে আমার।

আমি আমাকে বলছি: ওঠো, জাগো!

আমার অশ্ব নাই।
এক দুর্বিনীতাশ্ব জন্ম নিচ্ছে ভেতরে আমার।

থ্যাঁতলানো ভাঙা পায়ে আমি লাফ দিচ্ছি। আমি সাঁতরে চলেছি
আমার আয়ুর চেয়ে দীর্ঘ এক গন্ধকের নদী।

আমি ভেদ ক’রে যাবো ক্রূর অমানিশা
আমি জয়ী হবো
আমি পার হবো রুবিকন!!

 

।। পাহাড়ে বেড়াতে যাবার পর ।।

পাহাড়ে বেড়াতে যাবার পর ক্রমশ তরঙ্গবহুল হয়ে উঠল তোমার গ্রীবা। রজস্বলাদের গুরু
নিতম্বের ক্রম শিহরণ গাছেদের গায়ে এসে লাগে। আর আমি, ঝুলন্ত ডেউয়াফলের মতো
তোমার গরিমাময় কুচযুগের দিকে তাকাই নতুন করে।

আমার লোভের চাহনি, গ্রীষ্মদিনে তপ্ত স্বেদবিন্দুর মতো ক্ষীণ ধারায় গড়িয়ে শুধু নামে।
উপত্যকায় হাজার রাত্রিশেষের রাত্রি আর হাজার দিনশেষের দিনে লোহু-রঙিন জবাফুলের
মতো উপহার তুমি। কালচে-সবুজ পাতার আড়ালে বসে তোমাকে জারিত করি ক্রমাগত
চোখের লবণে। তুমি শাদা-শাদা অপার্থিব কাচের মিনার থেকে উঁকি দাও। লহমায় লহমায়
তোমার মুখ জ্বলে উঠতে দেখি এই অরণ্য-প্রদোষে।

যখন পাহাড়ে যায় লোক, ভালুকদের কাছ থেকে তাদের ভারী চলনগতি আর যূথবদ্ধতার
মন্ত্র শিখে নেওয়া ভালো। এসবের কিছু নমুনা নিয়ে এসেছি। বরফে, বক্ষবন্ধনীর ভেতরে
সেসব তুমি বহুদিন যত্নে রেখে দিও। আর চলো চিরখল, চিরলোভাতুর, চিরকুটিল আর

চিরবদমায়েশ শহরে ফিরে না যাই আবার। চলো শীতরাত্রে গোপনে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি
সরল অসভ্যতার দিকে। চলো ঘুমের ভেতরে! চলো পরস্পরকে কাঁধে নিয়ে ছুটি আবছা
ভোরের কুয়াশায়।

শাদা ফসিলের মতো বৃষ্টিতে ট্যাক্সিরা গর্জন করে ওঠে–শুনি। আর দেখি, হাতের তালুর
মতো ঢালু উপত্যকায় ভোর-সন্ধ্যার আভারূপে ক্ষণে-ক্ষণে হেসে ওঠো তুমি; আর, কেঁদে
ওঠো ভালুকশিশুর মতো। কেঁদে ওঠো যেন দূর সাইবেরিয়ায়।

সেসব কান্নাকে এখন জড়ো করছি; আর ভাবছি, এঞ্জিন-রব আর খুরধ্বনি থেকে দূরেই
রয়েছে তোমার অভিজ্ঞান। তুমি এক লম্বা দৌড়; তুমি পত্রালির ভেতরে সাঁতার—
বায়ুবাহিত বেলুনে বেলুনে।

পাহাড় গোপন জলধারা নামায় আর ডাকে তোমায়। আর তাতে শব্দ করে ওঠে রাত্রি;—
যেন একাকী তক্ষক। যেন ছল। এটুকু ছলই একদিন আমাদের জোড়া ঠোঁটের কাছে প্রেম
হয়ে আসবে কামের পেয়ালায়। সেখানে রঙিন পাথর থেকে পাথরে, চূড়া থেকে চূড়ায় লালাভ
সূর্য আর মেদুর রাত্রির চুপ-সিরাপ ছল্‌কে পড়বে তোমার গুরু নিতম্বে; আর তোমার
তরঙ্গবহুল গ্রীবায়, ডেউয়া ফলের মতো ঈষৎ-ঝুলেপড়া তোমার স্তনে আর গ্রানিট পাথরে
গড়া নাভিনিম্নদেশে।

।। দিওয়ানা জিকির ।।


আমারে পড়বো মনে, জানি তুমি, ডাকবা আমায়
খাড়া-সোজা-উপ্তা হয়া দিওয়ানা জিকিরে অবিরাম;
বাঁশের ঝিংলা দিয়া, জালিবেত-সুন্ধিবেত দিয়া
কানমলা দিয়া মোরে আর কতো করবা প্রহার।

আমি এর প্রতিশোধ নিব ঠিক। খাল-বিল-নদীনালা বাইদ
পার হয়া চলে যাব একশো ক্রোশ দূরে একদিন।
যেন, কনফুসিয়াসের স্বপ্নে বিভোর কোনো চীনা
সারাদিন একা একা খালেবিলে কিস্তি ভাসায়

২.
ডাকবা আমারে তুমি লুকায়া লুকায়া একদিন!
যেন এক ভেকশিশু, হাইঞ্জাকালে কচুর বাগানে
ডর পায়া, চিল্লায়া, মায়েরে একলা তার ডাকে।
যেমতি বাদলা দিনে পাইতা মোরে হাকালুকি হাওরে হাওরে
সাড়া তবু পাইবা না। যেনো বোবা কালেঙ্গাপাহাড়
চুপ মাইরা বইসা রবো; আর দেখব তোমার জিল্লতি

যতো জোরে ডাক পাড়ো কোনোদিন পাবা না আমায়।
লক্ষ ক্রোশ দূরে গিয়া তোমা হতে থাকব স্বাধীন!
খেলব, খেলার ছলে একা বসে তাস সারাদিন।

৩.
আমারে খুঁজবা তুমি হবিগঞ্জে, তেকোনা পুকুরপাড়ে,
মিরাশির মাঠে আর উমেদনগরে,

করবা তালাস চুপে পুরান মুন্সেফি আর বগলা বাজারে।
দুই হাত উঁচা কইরা হাঁক দিবা যেন ক্যানভাসার:

চিফ রেইট,
দুই টেকা,
হলুদি ব্যাটাটা!

৪.
বেফিকির উড়াধুড়া আমি এক ফকিন্নির পোলা
আন্ধা-কানা ঘুইরা মরি লালনীল স্মৃতির বাগানে;
চান্নি-পশর রাইতে জারুলের নিচে বেশুমার,
আবালের সর্দি যেন অবিরাম ফুল ঝরে পড়ে

৫.
মগরা নদীতে আর লাফুনিয়া-কইজুরি বিলে
তোমার নাকের মতো বেঁকা ঘোলা জলে নাও লয়া,
মনভরা গোস্বা লয়া, পেটভরা ভুক লয়া আমি
অলম্ভুত কালা বাইদে ভাইসা রবো একলা স্বাধীন।

যেন আমি বাচ্চা এক উদ
খিদা লাগলে উপ্তা ডুবে আচানক কালবাউস ধরে
কুশার-খেতের ভিত্রে বইসা খাব ফুর্তি লয়া মনে;

৬.
আসমানে লেঞ্জাহাঁস উইড়া চলে হাজারে-বিজারে
চিতলের পেটি যেন কলকলাবে সামনে ধনুগাঙ;
তার বুকে ঝাঁপ দিব, করবো আমি সেখানে সিনান

৭.
আমারে না পায়া যদি নিজের জাগ্না চউখে মাখো তুমি নিদ্রাকুসুম,
আমি তবে পুটকিছিলা বান্দরের মতো

বসে রবো চুপচাপ
বদ্যিরাজ
গাছের
আগায় !!

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top