ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স: কালের নায়ক (পর্ব-৪)

পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩

গাজী তানজিয়া

সাত
শুরু হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছফার উদ্দেশ্যহীন যাত্রা। সেখানে তার কোনো আত্মীয় নেই, স্বজন নেই, পরিচিত কারোর থাকার সম্ভাবনাও কম। এটা একদিক দিয়ে যেমন তাঁর এখনকার এই অবস্থার জন্য কিছুটা ভাল, তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। কারণ তার পকেটে টাকা পয়সা বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই। যা ছিল তা চট্টগ্রাম থেকে মুড়ির টিনের মতো বাসে চেপে বান্দরবান পৌঁছতেই তিনভাগের দুই ভাগ শেষ হয়ে গেল। এখানকার রাস্তাঘাটের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার না। পাহাড়ী খাড়াই পথ এবড়ো খেবড়ো এর থেকেই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পথ চলতে হচ্ছে তাঁকে। তবে পথ চলার ক্লান্তি তাঁকে যতটা না ভোগাতে পারছে তার চেয়ে বরং অন্ন ও কর্ম-সংস্থানের চিন্তাই তাকে বেশি ভোগাচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যেই এই দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় যে কোনো একটা কাজ জুটিয়ে ফেলতে হবে। নইলে যে ঝরণার পানি আর গাছের পাতা চিবোনো ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না। ছফা একবার ভেবেছিল যে কোনো একটা টিলা মতো বেছে নিয়ে সেখানে একটা টং ঘর তুলে থাকবে সে। কিন্তু এসব ভাবা যতটা সহজ, বাস্তব ততটাই কঠিন। একটা জিনিস জোগাড় হয়তো বাকি নয়টা জিনিস দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। ছফার অবস্থা প্রায় দিশেহারার মতো। তবে মানুষ হিসেবে তিনি আশাবাদী। এই ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যেও তিনি একটা যে কোনো কাজ জুটিয়ে নেয়ার আশা ছাড়ছেন না। গতকাল দুপুরের পর থেকে আজ প্রায় দুপুর হতে চলল কোনো খাবারও জোটেনি। এভাবে আর বেশিদিন চলতে পারে না। এলাকার দু একজন লোকজনের সাথে পরিচয় হয়েছে বটে তবে কাজ পাওয়া কঠিন। এলাকাটা কৃষি নির্ভর। কাজ কিছু জোটাতে হলে কৃষি কাজই করতে হবে। তবে তাঁর মতো একজন অপরিচিত মগদা বাঙালকে কেউ সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। পাছে আবার মাঝ পথে কাজ ছেড়ে পালায়! তারপরও এখানে এসে তাঁর যে একজন নতুন বন্ধু জুটেছে, তার নাম পালান। সে নতুন চন্দ্র কারবারী নামের একজন জোতদারের বাড়ি মোষের হালের কামলা। সে বলেছে যে তার মনিবের বাড়ি মোষের হালের একটা কাজ জুটিয়ে দেবে।

কিন্তু ছফা কি পারবে এতো কষ্টের কাজ করতে! যদিও তাদের পৈত্রিক কাজ কৃষি। কিন্তু সে তো কখনো এসব করেনি। তাদের হাল বলদ সব কামলারাই চালায়। জম্মের পর থেকে এই দেখে এসেছে সে। কিন্তু এখন ওসব আদিখ্যেতার কথা চলবে না। এই মূহূর্তে তাকে বেঁচে থাকতে হলে কামলার কাজের যে প্রস্তাবটা সে পেয়েছে সেটাকেই লুফে নিতে হবে। যত কষ্টই হোক। বেঁচে থাকাটাই তাঁর কাছে এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ।

নতুন চন্দ্র কারবারীর বাড়িটা বান্দরবান থেকে বেশ দূরের গ্রাম বুড়িঘাট বাজারের কাছে মিইশছড়ি পাড়ায়। ছফার কাজটা সহজেই জুটে গেল। যে ছেলেকে কোনদিন লাঙ্গলের মুঠিও ধরতে হয়নি মোষের হালের দিন মজুর হওয়া তার জন্য সে কতটা কষ্টসাধ্য তা বলাই বাহুল্য। তারপরও ছফা নিরলস অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এই কাজ করে যেতে লাগল। মোষের হাল ঠেলতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ছফাকে জোঁকে ধরছে। পাহাড়ী অঞ্চলের জোঁক যে-সে জোঁক নয়। একবার ধরলে তাকে সহজে ছাড়ানো যায় না। স্থানীয় চাষীদের ভাষায় এই জোঁকের নাম মইষা জোঁক। তো মইষের গায়ে লাগলেই হয়! বেচারা মানুষের গায়ে লাগা কেন। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর একেতো শরীরের রক্ত পানি হওয়ার অবস্থা তার পরে এই হাড়বজ্জাত জোঁক খেয়ে নেয় শরীরের বাকি রক্ত। মোষের হাল বইতে গিয়ে আঙ্গুলে কড়া পড়ে গেলেও ছফার দুঃখ নেই; যতটা কষ্ট পায় সে তার পায়ে জোঁক বসলে। এমনি একদিন হাল বইতে গিয়ে তার পায়ে এমন এক জোঁক লাগল যে টেনে টুনে জোঁক তুললেও রক্ত তার বন্ধ হয় না। অন্যান্য কাজের লোকেরা সবাই ঘাবড়ে গেল। রক্ত বন্ধ না হলে এই লিকলিকে রোগা মানুষটাকে বুঝি আর বাঁচানো যাবে না। তারা তাকে নিয়ে ছুটলো কারবারীর বাড়িতে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না দেখে ছফা নিজেও ঘাবড়ে গেল। তাই বেঘোরে সে বাংলার পরিবর্তে উর্দুতে বলতে লাগল, ‘শালে জোঁক মেরে খুন পি লিয়া।’ জোঁক কাটা জায়গায় নুন দিতে দিতে মগদা বাঙাল এই মজুরের মুখে উর্দু ভাষা শুনে কারবারী মশায় অবাক হলেন। বিস্ময়ে বললেন, আরে তুমি উর্দু জান?

ছফা এবার ধরা পড়ে যাওয়া গলায় বলল, জানি কিছু কিছু।

উর্দু পড়তে বা লিখতে পার? শুনেছি তুমি নাকি লেখাপড়াও কিছু জান?

জানি মশায়!

কারবারী মশায় যেন হাতে চাঁদ পেলেন। বল কি! তুমি উর্দুও জানো আর এভাবে আমার ক্ষেতে দিন মজুরের কাজ করছ! তোমাকে এ কাজ আর করতে হবে না।

কেন? ভয়ে তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরয় না। উর্দু বলার অপরাধে তার যে এভাবে কাজ চলে যাবে ভাবতে পারেনি ছফা। উর্দুর প্রতি কারবারীর এতো বিতৃষ্ণা! ছফা এবার তার চাকরি বাঁচাতে সাফাই গাইতে লাগল। আসলে কারবারী মশায় হয়েছে কি, উর্দু ভাষা আমারও পছন্দ না। রক্ত দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল তাই ঘোরের মাথায় বলে ফেলেছিলাম।

পছন্দ অপছন্দ ওসব কোনো বিষয় না। আমার ঘরে একজন উর্দু জানা লোক থাকতে আমার স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে এটা হতে পারে না।

মানে!

মানে আমার স্কুলতো তুমি দেখেছো।

জ্বী দেখেছি।

ওই স্কুল আর আমি টেকাতে পারছি না একজন উর্দু শিক্ষকের অভাবে। উর্দু শিক্ষক না থাকলে স্কুলের মঞ্জুরী পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে এই ঘোর জঙ্গলে আমাদের সাথে মাত্র ছাব্বিশ টাকা মাইনের বদলে কোনো উর্দু জানা হুজুর এখানে পড়াতে আসতেও রাজি হয় না। আর তুমি যখন এখানে এসেই পড়েছে তখন স্কুলের উর্দু হুজুরের এই চাকরীটা তুমি নাও। এখন বুঝতে পারছি ঈশ্বর আমার স্কুলটা বাঁচাতেই তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন।

ছফারও যেন চাকরীটা পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়েছে এমন অনুভূতি হলো। তবে মুখে সেটা প্রকাশ করল না। উপরন্তু সে একটা দাবী পেশ করে বসল।

তার দাবীর কথা শুনে কারবারী মশায় বললেন, দাবী যাই হোক বেতন বাড়াতে বলতে পারবে না বাপু।

না বেতন বাড়ানো না। আমাকে কথায় কথায় ‘মগদা বাঙাল’ বলা যাবে না। আমি দেখেছি আপনারা পর্বতবাসীরা আমাদের বাঙালীদের এই কুৎসিৎ ভাষায় গালি না দিয়ে কথা বলতে পারেন না। বাঙালি কী এমন অন্যায় করেছে বলেন তো আপনাদের সাথে। তাছাড়া শুধু হিন্দু-মুসলমান হলে কথা থাকতো আপনারা আপনাদের স্বজাতি বাঙালি বৌদ্ধদেরও ‘মগদা বাঙাল’ বলতে ছাড়েন না।

ওহ্ এই কথা! হেসে ফেললেন কারবারী মশায়। সে তোমাকে না হয় বললাম না। কিন্তু অন্যদের না বলে থাকতে পারব না।

কেন?

আরে বাঙালীরা লোক ভাল না।

মানে, ওরা কি করেছে?

ওরা কথায় কথায় আমাদের ঠকায়। না-না অত্যাচার করে। এ তো এক দু দিনের কথা না। সে অনেক যুগ আগে থেকে হয়ে আসছে।

কী এমন করেছে বাঙালীরা?

কী করে নাই বল। ওরা যারা এখানে আসে, প্রায় সবই চোর, প্রতারক, লম্পট, ওরা কৌশলে আমাদের ভূ-সম্পত্তি দখল করে। ব্যবসা বাণিজ্যের নামে ঠকায়।

আপনার এই কথাটা মানতে পারছি না কারবারী মশাই।

মানা না মানা তোমার ব্যাপার। আমি যা বলতেছি অভিজ্ঞতা থেকেই বলতেছি। না জেনে কিছু বলছি না। যুগে যুগে পাহাড়ীরা কম ধরা খায় নাই ছফা! তুমিতো এখন বিশ্বাস করতে চাইতেছ না। তোমারে একটা গল্প বলি শোন। গল্প না আসলে এটা সত্যি ঘটনা।

বলেন, অনেকটা অভিমানের স্বরে জানতে চায় ছফা।

কারবারী মশায় বিশুদ্ধ বাংলায় গল্প শুরু করেন, অনেকদিন আগে হেমন্তকুমার নামে এক বাঙালি মহাজন একটা ইলিশমাছ তার নতুন-পাতানো চাকমা বন্ধুকে দিয়ে বলল, ‘বন্ধু এটা পদ্মার ইলিশ, তোমার জন্য এনেছি, ঝোলে-ঝালে রান্না করে খাও। অমৃতের স্বাদ পাবে।’ চাকমা বন্ধুটি তখন বলল, ‘তুমি ঠিকই বন্ধুর কাজ করেছ। মাছটা তো তুমি কষ্ট করে এনেছ, বলো কত দাম দিতে হবে?’ বিনামূল্যে তুমি এমন বন্ধুত্ব করবে না বুঝতেই পারছি, মনে মনে বলল সে।

হেমন্তবাবু তখন দাঁতে জিভ কেটে বললেন, বন্ধু, তুমি আমাকে এত কামিনা মনে করছ কেন, আমি তোমার কাছে ইলিশ মাছের দাম চাইব! মাছটা আমি তোমাকে উপহারই দিলাম। বছরে বছরে তুমি শুধু এক আড়ি (১০ কেজি) করে ধান দেবে।’ হেমন্তবাবু যতদিন বেঁচে ছিলেন এক আড়ি ধান বন্ধুর কাছ থেকে ঠিক আদায় করেছেন প্রতি বছর। হেমন্তবাবুর মৃত্যুর পর তার ছেলে বন্ধু পুত্রের কাছ থেকে দেয়া ইলিশ মাছের শুল্ক ঠিক মতো আদায় করেছে। নাতির আমল যখন এলো চাকমাটির নাতি বিরক্ত হয়ে জানতে চাইল, ‘একটা ইলিশ মাছ দিয়ে তিন পুরুষ ধরে এক আড়ি ধান আদায় করছ, তোমার ইলিশ মাছের দাম কতো?’ হেমন্ত বাবুর নাতি হিসেব করে জানল বর্তমানের হিসেবে ছ’টাকা চৌদ্দ আনা। তখন নাতি চাকমা ছ’টাকা চৌদ্দ আনা নগদে শোধ করে বলল, আগামী বছর থেকে আর আসবেনা।”

গল্প শেষে কারবারি মশায় বললেন, পার্বত্য উপজাতিদের প্রতি যে শোষণ তা শুরু হয়েছে অনেক অনেক আগে। ভারত-পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে, কাপ্তাই বাঁধ চালু হওয়ার আগে। ভারতে বৃটিশ শাসন চালু হওয়ার আগে, নওয়াবেরা মসনদে আসীন হওয়ার আগে, মোগলেরা জঙ্গলমহাল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্পাসমহাল বলে চিহ্নিত করার আগে, আরো কত আগে থেকে আমি বলতে পারব না। সেই ধারাবাহিকতায় ওরা বাঙালিদের অবিশ্বাস করে যদি এমন কিছু বলে তাতে ওদের খুব দোষ দেয়া যায় না। তবে আমাদের এদিক থেকে তোমাকে আর কেউ মগদা বাঙাল বলবেনা। চিন্তা কর না।

ছফা ওসব চিন্তা করে না। উর্দু হুজুর হিসেবে তার দিনও ভালই কাটছে। উপরন্তু সে আরো একটা কাজ পেয়ে গেছে। কারবারির বাড়িতে থাকা খাওয়ার বদলে এই কাজটা তাকে করতে হবে। কারবারির ৪র্থ শ্রেণীতে পড়া মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতে হবে। ছফার এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। তবে ছাত্রীর বয়সটা একটু বাড়াবাড়ি ধরণের এই প্রায় পনের ষোল বছর।

থামির ওপরে ব্লাউজ বা কখনো কখনো কাঁচুলি তার ওপরে হাতে বোনা ওড়না পেছিয়ে সে পড়তে আসে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে ছফার দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। ছফার তখন অস্বস্তির সীমা থাকে না। এই অস্বস্তি কেন সে বুঝতে পারে না। মেয়েটা যথেষ্ট রমণীয়। গায়ের রঙ কাঁচা হলুদের মতো। স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়লেও বুদ্ধিসুদ্ধি কম না। তাহলে ছফার কেন এতো অস্বস্তি? তার জায়গায় অন্য কেউ হলে কী হতো, এই দুর্ণিবার আকর্ষণের প্রতি আত্মহুতি দিত না! কে জানে! সে শুধু জানে এই ঘোর অগ্রাহ্য করে তাকে বের হয়ে আসতে হবে।

এরই মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসনজারির পর ছাউনি থেকে বের করে আনা সৈন্যদের কুকুরের ল্যাজ সোজা করার মতো একটা সার্বক্ষণিক কাজ দিলেন। তিনি জনগণের প্রতি সর্বাত্বক ঘোষণা দিলেন যে ঝোপ-জঙ্গল সাফ করো, বাড়ি-ঘর পরিস্কার করো নইলে সৈন্যরা ডান্ডা দিয়ে পেটাবে। ডান্ডা খাবার ভয়ে অনেক গেরস্ত অন্যান্য গাছের সাথে ফলের গাছ, তরিতরকারির গাছ কেটেও ছাফ করে ফেলেছে সারা বাংলায়। ওই ‘সাফা করো’ নির্দেশ যখন পাহাড়ীদের কাছে গেল তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল। তারা সাফা করায় রাজি হলো না। তারা বলল, ডান্ডা খেতে রাজি আছি তবে সাফা করে লাভ কী? এতোদিন ধরে তারা যতো জঙ্গল কেটে যত জমি ছাফ করে নাল জমি বের করেছে, দশ বছর না যেতেই সে জমি মগদা বাঙালদের হাতে চলে গেছে। সাফা তারা আর করবে না। গবমেন্টের নির্দেশ মানব না। যদি সৈন্যরা ডান্ডা পেটাতে আসে, বাল বাচ্চা নিয়ে আরো গভীর জঙ্গলে চলে যাব। ওরা নাগালই পাবে না। তা বলে ওই মগদা বাঙালদের হাতে সব চলে যাওয়ার জন্য আর বন-জঙ্গল সাফাই নয়।

সত্যি বলতে কি পাহাড়ীদের এই স্পিরিট ছফার বেশ ভাল লাগল।

পাহাড়ীরা যুগে যুগে শোষকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তাদের অধিকার রক্ষায়। সেই মুঘল আমলে কার্পাস দিয়ে রাজস্ব ধার্য করার সময়কাল থেকে। যখন জঙ্গল মহল পরিচিত হয় কার্পাস মহাল হিসেবে। পাহাড়ী চাকমা জাতি প্রধানত জুম চাষ করত। সেখানে উৎপাদিত হতো কার্পাস। আর সেই কার্পাস দিয়ে তাদের রাজস্ব ধার্য্য করা হতো। এরপর ইংরেজ এলে তাদের রাজস্ব চাহিদা আরো বেড়ে যায়। তারা ইজারাদারদের ওপর এই কার্পাস খাজনা তোলার দায়িত্ব দেয়। যার ফলে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পেত না। ফলে তারা শের দৌলত ও সেনাপতি রামু খাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। ইজারাদারদের কর দেয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের গুদাম লুট করে। ওদের বড় বড় ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। ফলে একসময় ইজারাদাররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বৃটিশ সরকার বিদ্রোহ দমনে সৈন্য বাহিনী পাঠায়। বিদ্রোহীরা গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নিয়ে গভীর জঙ্গলে অবস্থান নেয়। তারা সৈন্যদেরকে পরাস্ত করে ফেলে। ফলে চাকমা এলাকায় ইজারাদারদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। বছরের পর বছর ধরে চাকমাদের এমন ক্লান্তিহীন সংগ্রাম ও গেরিলা আক্রমনে পর্যুদস্ত হয়ে ইংরেজ শাসক এক সময় ইজারা প্রথা তুলে দিয়ে চাকমা সর্দারদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হন। পাহাড়ীদের এই নিরন্তর সংগ্রামের ছবি ছফার সামনে জ্বল জ্বল করে প্রতিক্ষণ। রাষ্ট্র এবং প্রকৃতি বার বার বিরুপ হয়ে তাদের সামনে এলেও তারা থেমে থাকেনি।
একা একা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে সে দেখেছে তাদের লড়াই করে টিকে থাকার হররোজ প্রচেষ্টা। যে ঐতিহাসিক ধারাক্রম অনুসারে রণরক্ত সফলতার মধ্য দিয়ে শক্তিমান জনগোষ্ঠীর কাছে মার খেয়ে দুর্বল মানব গোষ্ঠী পালিয়ে গিয়ে কোনোরকমে আত্মরক্ষা করছে, এরাও তারা। কাপ্তাই বাঁধ চালু হওয়ার আগে থেকে চালু হওয়ার পর পর্যন্ত। রাঙামাটি শহর ছিল কর্ণফুলী নদীর তীরে। নদীর জলস্তর থেকে বাজারের উচ্চতা ছিল সত্তর-আশি হাতের মতো। বাঁধ যখন চালু হলো বাজার পানিতে ডুবে গেল। আরো একশো হাত উঁচুতে সরিয়ে নিতে হলো। সে জায়গাও পানির তলায় চলে গেল। আরো দূরে, আরো উঁচুতে সরিয়ে নিতে হলো বাজার। পর্যায়ক্রমে এমন চলতেই থাকল। চীনের দুঃখ হোয়াংহোর মতো পার্বত্য অঞ্চলের দুঃখ কাপ্তাই হয়ে দাঁড়ালো। কাপ্তাই বাঁধ পাহাড়ীদের জীবনে মারাত্মক অভিশাপ বয়ে এনেছিল। এক একবার পানি ওঠে আর মানুষ তার বসত ভিঠা ছেড়ে ঘর বাড়ি ছেড়ে এক বস্ত্রে ছোটে উঁচু শুকনা জায়গার সন্ধানে। সর্বহারা মানুষের মিছিল দেখেছে ছফা কয়েক বারই এখানে এসে। মাঝবয়সী মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ছুটে যায় তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হাতে করে। কারো হাতে ঝাড়ু, কারো হাতে বারোমাস ফল দেয়া বেগুন গাছের চারা। কারো হাতে মুরগী, কারো হাতে প্রিয় কুকুর ছানা। এভাবেই ছোটে তারা নিরন্তর। তাদের এই নিরন্তর ছুটে চলা, তাদের এই নিরন্তর সংগ্রাম তাদের প্রতি ছফার আগ্রহ ও শ্রদ্ধা বাড়িয়ে তোলে।

হাঁটতে চলতে উঠতে বসতে এখানকার সব কিছুই ছফার ভালো লাগে। তবে কষ্ট একটাই এখানে পড়বার জন্য কোনো বই বা পত্র-পত্রিকা পাওয়া যায় না। এটা তাকে ভীষণ পীড়া দেয়। সে এমন কিছুই পড়ার জন্য পাচ্ছে না যা তার জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাতে পারে।

হালের পেছনে ছোটার হাত থেকে না হয় উদ্ধার পাওয়া গেল। কিন্তু এই তৃষ্ণা মেটাবে কে?

কিন্তু ভাগ্য যে তাকে এভাবে করুণা করবে ভাবতেই পারে নি সে। একদিন কারবারী মশায়ের মাচান ঘরের উঁচু জায়গায় দেখতে পেল কাপড়ে মুড়িয়ে একটা বইয়ের মতো কি যেন তুলে রাখা হয়েছে।

তার ছাত্রী কারবারীর মেয়ে লক্ষণাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলল, ওটা শুধাং এর বই।

শুধাং মানে শাস্ত্র। তার মানে ওটা রামায়ণ বা মহাভারত কিছু?

হ্যাঁ, ওইটা মহাভারত। তেমনি নির্নিমেশ তাকিয়ে বলল লক্ষণা।

কিন্তু ওটাকে ওখানে তুলে রেখেছ কেন? কেউ পড়ে না?

না। কেউতো পড়তে পারে না সংস্কৃত ভাষা, আর এখানে সেখানে থাকলে পাছে অপবিত্র হয়ে যায় তাই বাবা কাপড়ে মুড়িয়া ওখানে তুলে রেখেছে।

ছফা সেই দিনই কারবারী মশায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করল, আপনার শুধাংয়ের বইটা কি কখনো পড়ে দেখেছেন?

তিনি হতাশভাবে বললেন, বুড়িঘাট বাজারে অমূল্য কবিরাজ শুধাং পাঠ করে কথার মাহাত্ম বুঝিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর মৃত্যুর পর শুধাংয়ের মাহাত্ম ব্যাখ্যা করার মতো কোনো লোক পাওয়া যায়নি।

ছফা তখন বলল,

“দিবং স্পৃশতি শব্দঃপুণ্যেন কর্মণা।
যাবৎ স শব্দো ভবতি তাবৎ পুরুষ উচ্যতে।।
তুল্যে প্রিয়া প্রিয়ে যস্য সুখদুঃখে তথৈব চ।
অতী নিগাতে চোভে স বৈ সর্বধনেশ্বরঃ।।”

যক্ষ যখন যুধিষ্টিরের কাছে জানতে চাইলেন, পুরুষ কে? তখন যুধিষ্টির জবাব দিলেন, পুণ্যকর্মের শব্দ (প্রশংসাবাদ) স্বর্গ ও পৃথিবী স্পর্শ করে; যতকাল সেই শব্দ থাকে ততকালই লোকে পুরুষ রূপে গণ্য হয়। প্রিয়-অপ্রিয়, সুখ-দুঃখ, অতীত ও ভবিষ্যৎ যিনি তুল্য জ্ঞান করেন তিনিই সর্বধনেশ্বর।

তুমি মহাভারত পড়েছ! বিস্ময়ে হতবাক কারবারী মশায়।

হ্যাঁ শুধু পড়িই নি। ওর নানাঅংশ আমার মুখস্ত। এবং চেষ্টা করলে এর মাহাত্মও বুঝিয়ে দিতে পারি।

পুরাণে উল্লেখ আছে, “গৌতম বংশীয়া জটিলা সাতজন ঋষির পত্নী ছিলেন। আবার মুণিকন্যা বার্ক্ষীর দশ পতি ছিল তাদের সবার নাম প্রচেতা।”-এটা দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী গ্রহণের স্বপক্ষে যুধিষ্ঠিরের সুপারিশ। মহাভারতে আছে।

একজন মগদা বাঙাল উর্দূ জানে আবার সুধাং পড়ে তার মাহাত্ম বুঝিয়ে দিতে পারে! এতো বিস্ময় লুকিয়ে থাকে পৃথিবীতে। হে ঈশ্বর! কারবারী মশায় এ কথা অতিদ্রুত সবার মাঝে ছড়িয়ে দিলেন। তিনি তার এই বিস্ময় এক মুহূর্ত  চেপে রাখতে পারলেন না।

এ কথা জানাজানি হওয়ার পর ওই পাড়ায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব লোকের চোখে ছফা রাতারাতি এক বিশেষ সম্মানের আসন পেয়ে গেল।

সে প্রায় প্রতিদিন গ্রামের মানুষকে সুধাং এর মাহাত্ম বিশ্লেষণ করে শোনায়। রাতের আকাশের উজ্জল তারাগুলো উপত্যাকার নির্জন ভূমির দিকে তাকিয়ে আছে। আর কেরোসিনের আলোয় মাচান ঘরের সামনের আঙিনায় সুর করে মহাভারত পাঠ করছে ছফা । অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছে, আর নর-নারী, যুবা-বৃদ্ধ অবাক হয়ে যুঠিষ্ঠির-অর্জুন- দ্রৌপদী-দুর্যোধনের কাহিনী শুনে যাচ্ছে।

ছফার জন্য লক্ষণার অনেক আগে থেকেই দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল। এই লোকটা কত কিছু জানে! কত সুন্দর করে গল্প করতে পারে। চোখটোখ ঘুরিয়ে কত কায়দা করে এক একটা ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারে। যত দিন যাচ্ছে লক্ষণার ততই মনে হচ্ছে। সে না থাকলে, সে সারাজীবন তার সাথে না থাকলে সে বাঁচবে কী করে!

মাঝে মাঝেই লোকটা কোথায় যেন চলে যায়। বিশেষ করে যেদিন স্কুল ছুটি থাকে সেই দিনতো তার খোঁজই পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও অন্যান্য ছুটি ছাটায়। লক্ষণার তখন মনে হয় যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাকে না দেখলে এমন কেন হয় তার! অথচ লোকটা তাকে পাত্তাই দেয় না। সারাদিন কীসের এক নেশায় যেন ছুটে বেড়ায়। মনে হয় যেন কী এক গভীর ঘোর তাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। একদিন সে বিলাইছড়ি বাজার থেকে গোটা একদিন আধারাত দুর্গম পাহাড়ী পথ পায়ে হেঁটে ফারুয়া অবধি গিয়েছে। কী বড় বড় সব পাহাড় তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। একেকটা পাহাড়ের চূড়ায় চড়লে দূর চন্দ্রঘোনার কাগজের কল পর্যন্ত দেখা যায়। সেই কাগজের কলে যে শ্রমিকেরা কাজ করে, আর ওখানে যাওয়ার রাস্তা নির্মানের জন্য কাজ করে যে সব শ্রমিক তাদের দুর্দশার কথা শোনায় এসে সে তার বাবাকে।

তাদের প্রতি মালিকের নির্যাতনের কথা, ঠকানোর কথা। লক্ষণার তখন বুক ভেঙ্গে যায়। যতটানা-ওই শ্রমিকদের জন্য তার চেয়ে বেশি ওদের জন্য কষ্ট পাওয়া ওই মানুষটার জন্য।

লক্ষণার কী হয়েছিল কে জানে! সে ছফার এই কৃতিত্বে আরো দিশেহারা হয়ে গেল। বোঝাই যায় এর নাম গভীর প্রেম। তাই একদিন সে বলেই ফেলল, আপনি সুধাং জানেন? জানেন এতোদিন আমার ভেতরে এক ধরনের দ্বিধা সংকোচ ছিল আপনার জাতধর্ম নিয়ে এখন আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ রইল না। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে। আমরা তো একই! আমাদের মধ্যে কোনো বাধা নেই।

ছফা এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লক্ষণা জানে না বাধাটা কোথায়। বেচারা! সে অর্জুন নয় যে যেখানে যাবে সেখানেই চিত্রাঙ্গদা, উলুপী…এদের হবে। অথচ লক্ষণার সরলতা..! এমন জটিলতাহীন নারী আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রেমের বেলায় এমন জান্তব অনুভূতি সমতলের নারীর ভেতরে কই?

একদিন এই সুধাং পড়তে গিয়ে হঠাৎই সম্বিত ফিরল ছফার। কুন্তি যখন কৃষ্ণকে বিদুলার উদাহরণ দিয়ে বলছেন, “লোকে যার মহৎ চরিত্রের আলোচনা করে না সে পুরুষ নয়, স্ত্রীও নয়। সে কেবল মানুষের সংখ্যা বাড়ায়। যার দান, তপস্যা, শৌর্য, বিদ্যা বা অর্থের খ্যাতি নেই সে তার মায়ের বিষ্ঠা মাত্র।”

আর তখনই ওই মুহূর্তে ছফার মনে হলো তাকে আবার ফিরতে হবে জ্ঞানের সন্ধানে। লেখা পড়াটা কমপ্লিট করতে হবে। এ জীবন তার জন্য না। তাই দীর্ঘ তের মাসের অজ্ঞাতবাস ও এক ব্যর্থ বিপ্লব শেষে ছফা ফিরল তার কবিতার কাছে। লেখার কাছে। এবার তার মনে হলো, কলমই বিপ্লবের প্রকৃত হাতিয়ার।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপনে থাকার সময় নীরবে একদিন ছফার বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। বাড়ি ফিরে এসে তার আর বাবার সাথে দেখা হলো না।

 

আট
দুপুরবেলা ঠা-ঠা রোদ্দুর। চৈত্রের দুপুর। পল্টনের রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে ছফা। সূর্যের তেজ এতোটাই প্রবল যে মনে হচ্ছে রাস্তার পিচ গলে স্যাণ্ডেলের সাথে লেগে গেছে। স্যাণ্ডেলটা কেমন ভারী আর উঁচু-নিচু মনে হচ্ছে। ছফার একবার মনে হলো, স্যাণ্ডেলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু সেটা সম্ভব না, তাহলে পা বাঁচানো সম্ভব হবে না। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় হাইকোর্টের সামনে চলে এসেছে এমন সময় সে বেশ শব্দ করেই বলল, শালা! কিন্তু কাকে বলল বোঝা গেল না। হাইকোর্ট মাজারের পাশে কিছু স্থায়ী ভিক্ষুক, ও প্রতিষ্ঠিত ভিক্ষুক বাসন পেতে বসে সুর করে, চিৎকার করে, হুমকি-ধমকি দিয়ে যে যার ভঙ্গিতে ভিক্ষা করছে। ছফা ফিরছে স্বামীবাগে তার বন্ধু শামসুর বাড়ি থেকে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে এসে ওদের বাড়িতেই উঠেছিল সে প্রথমে। ওখানে দু’দিন থাকার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য গিয়ে উঠল ইকবাল হলে। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে ভর্তি হওয়া।

আজ এতোদিন পর সে যখন শামসুদের ওখানে গেল তখন সে বাড়িতে ছিল না। বাড়িতে থাকা ওর বাবা এমন ভাব দেখালেন যেন ছফাকে চিনতেই পারছেন না। দরজা খুলেই বললেন কাকে চাই?

স্লামালাইকুম চাচা, শামসু বাড়িতে আছে?

না নেই বলে দড়াম করে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

ভদ্রলোকের এই ব্যবহারে ছফা যারপরনাই বিব্রত হলো। বরং তার চেয়ে বেশি হতভম্ব। তার পরপরই তার মনে হলো, এমন ব্যবহার করলেন কেন ভদ্রলোক! তাহলে কি তার চেহারায় ভিকিরি ভিকিরি একটা ভাব এসে গেছে? সে যে এখন কপর্দকহীন এটা কি তার চেহারায় এখন স্পষ্ট? সে যাই হোক। চেনা মানুষের এমন ব্যবহার ছফাকে ভীষণ মর্মাহত করেছে। এই অপমানের ভার যেন কয়েক টন বোঝার মতো তার মাথার ওপর চেপে বসেছে সেই মুহূর্তে। চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। গাল গরম। কানের ভেতরে রি রি করছে। মাথার দুপাশের শিরা দপ দপ করে লাফাচ্ছে। আর পা দুটোও ভারী মনে হচ্ছে ভীষণ। ওভাবে ওখানে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থেকে সে জোর বেগে হাটতে শুরু করল।

কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সে এই নিষ্ঠুর শহরটাকে বেছে নিয়েছিল কেন? পার্বত্য চট্টগ্রামে মহাভারতের কাহিনী একদল অশিক্ষিত, আলোর দিশাহীন মানুষের সামনে ব্যাখ্যা করতে করতে তার যখন মনে হয়েছিল তাকে এভাবে বসে থাকলে হবে না। তার শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে হবে। তাকে কবি হয়ে উঠতে হবে। তখনই এই নিষ্ঠুর শহরটার ছবিই মানসপটে ভেসে উঠেছিল। কিন্তু ছফার সামনে তখনো ঘোর বিপদ। স্যার আশুতোষ কলেজে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। স্বৈরশাসকের হুলিয়া তখনো খড়গের মতো মাথার ওপরে ঝুলছে। অন্যদিকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করাটাও জরুরী। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা যেতে হবে তাকে। ভর্তি হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাকে কবি হতে হবে। কবি হওয়ার এক তীব্র নেশা তার শিরায় শিরায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। শিল্প সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্রস্থল ঢাকা, সেখানে তাকে পৌঁছাতেই হবে। এভাবে সুখের আসরে ঘুরপাক খাওয়ার জন্য তার জম্ম হয়নি। এখন আর সেই রবীন্দ্রনাথ নজরুলের যুগ নেই। লেখকের নামের পাশে বড় বড় ডিগ্রী না ঝুললে তার লেখা কেউ পড়ে না। লেখকের ব্যক্তিগত জ্ঞানের পাল্লা যতই ভারী হোক না কেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওজন প্রায় আয়নস্ফিয়ারের সমান।
দক্ষিণমুখো হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে পাড়ি জমাল ছফা। ভর্তি হয়ে গেল নাজির হাট কলেজে। এখান থেকেই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করল সে, তখন উনিশ’শো বাষট্টি সাল। বাবা বেঁচে থাকতেই আর্থিক স্বচ্ছলতায় ভাটির টান ছিল, মৃত্যুর পর অনেকটা ধ্বস শুরু হয়েছে।

ছফাকে ঢাকা যেতে হবে পড়তে। কাঁচা পয়সা তেমন একটা নেই যে তাকে পড়তে পাঠাতে পারে বড় ভাই। অন্যদিকে ছফার ঢাকা তাকে যেতেই হবে। যতটা না পড়ার জন্য তার চেয়ে বেশি কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।

তখন সে বাঁধনহারা। কারো শাসন মেনে চলার মতো ছেলে সে কখনোই ছিল না। বাবা বেঁচে থাকতে ওখানেই একমাত্র ভয়টা ছিল। মারা যাওয়ার পর সে প্রশ্ন আর নেই। তাঁর মৃত্যুর পর সম্পত্তিও দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেছে। ছফা বুঝতে পারে না এইসব জায়গা জমি দিয়ে সে কী করবে! তার চেয়ে বরং এ সব বিক্রি করে দিয়ে ঢাকা চলে যাওয়াই ভাল। যেই চিন্তা সেই কাজ। ছফা তার নামে বরাদ্দ প্রায় সব জমি বিক্রি করে দিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমাল। ছফাকে নিবৃত্ত করার জন্য তার রাস টেনে ধরার জন্য বড় ভাই একটা বিয়ের প্রস্তাবও করেছিলেন, কিন্তু ওই বয়সে যখন কবি হওয়ার এক তীব্র আকাঙ্খা তাকে পেয়ে বসেছে তখন কে সংসারে জড়াতে চায়! বিয়ের প্রস্তাব ভেস্তে গেল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছফার মাথায় এক বুদ্ধি এলো। তার হাতে তখন জমি বিক্রির পয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হাজার টাকা। এমনিতেই তার খরচের হাত তার ওপরে হাতে এতোগুলো নগদ টাকা। সে দেদারসে খরচ করতে লাগল। এবং স্বভাবতই তার কিছু উটকো বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেল। তারা যখন তখন তার কাছে টাকা ধার চায়। এটা সেটা উপলক্ষ করে টাকা খরচ করায়। তখন ছফা দেখল অবস্থা বেগতিক। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই টাকা শেষ হয়ে যাবে। ওদিকে এস এম হলে সে সিট পায় নাই। লুকিয়ে চুরিয়ে থাকে। তাই একদিন সে হোটেলে গিয়ে উঠল। টাকা যখন তার আছে তখন আর এভাবে এখানে লুকিয়ে থেকে পাতলা ডাল আর অখাদ্য পর্যায়ের মাছ-মাংস খেয়ে থাকা কেন। তার চেয়ে বরং নিজের টাকায় কিছুদিন তেলে-ঝোলে খাওয়া যাক। ইচ্ছে মতো আরাম আয়েশে থাকা যাক। সেই চিন্তাতেই হোটেলে উঠলেও তার ওই উটকো বন্ধুরাতো আর তার পিছু ছাড়ে না। তাছাড়া বন্ধুহীন, আড্ডাহীন জীবনের কথা সে ভাবতেও পারে না। তাই তারাও তার সঙ্গে প্রায় ছায়ার মতো লেগে রইল। তখন তার দু’একজন শুভাকাঙ্খীও জুটে গিয়েছিল। তারা তাকে বলেছিল ঢাকায় একটা জায়গা কিনে ফেলতে। কেউ কেউ জায়গার খোঁজ খবরও নিয়ে এলো। কিন্তু ছফা তখন কিছুতেই বুঝতে পারে না ঝামেলা এড়াতে যে জমি বিক্রি করা হয়েছে, সেই টাকায় আবার জমি কিনতে হবে কেন? তার চেয়ে বরং এই বিচিত্র শহর এবং এর হাবভাব ঘুরে দেখাই ভালো।

তাছাড়া টাকা-পয়সার কারণেই হোক আর তার ব্যক্তিগত ক্যারিজমার কারণেই হোক বন্ধু বান্ধব যারা জুটেছে তারাও যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। এদের সঙ্গে হররোজ আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া ঘোরাঘুরি চলছেই।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলে। রাজার ভাণ্ডারও এক সময় ফুরিয়ে যায়। সেখানে তো মাত্র ওই ক’হাজার টাকা! কয়েকদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল সব। তার এতোদিনের বন্ধুরাও ততোদিনে সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে। ছফা আবার একা। ওদিকে তার মাথার ভেতরে কবিতারা তখন দলবেঁধে সাঁতার কাটছে। তাদেরকে কুলে টেনে তুলতে হবে। অথচ তার চারপাশে অথৈ জল। ঢাকায় তখন সে কীভাবে থাকবে সেই এক বিরাট চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় কবিতার এমন বান ডাকা! অথচ যখন দু’হাত ভর্তি টাকা ছিল তখন এই কবিতারা কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে! তবে যা গেছে, গেছে। সেই দুঃখ নিয়ে এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। তাকে যে করেই হোক টিকে থাকতে হবে ঢাকায়। তার কবিতার জন্য তার লেখকসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তার দুধের মাছি-টাইপ বন্ধুরা পালালেও নরেন বিশ্বাস, ফজলুল হক, অরুনেন্দু এরা রয়ে গেছে অকৃত্রিম। আবার সে এস এম হলে গিয়ে ওঠে বন্ধু আবুল কাশেম ফজলুল হকের রুমে।

ভরদুপুরে গনগনে রোদের মধ্যে রাস্তায় হেঁটে ক্ষুধা, তৃষ্ণাও জোরাল হয়ে উঠেছে। হলের ক্যান্টিনে এখন ধুমছে খাওয়া দাওয়া চলছে। ওখানে গেলে খাওয়া যায় কিন্তু তার পকেটে একবেলা খাওয়ার টাকা নেই। কারো কাছে টাকা ধার চাইতে ভাল লাগে না। বাড়ি থেকে টাকা কবে পাঠাবে তার ঠিক নেই। অল্পস্বল্প যা বাড়ি থেকে এখন আসে তাতে তো মাসের পনের দিনও চলে না। এখন সে কি করে!

কার্জন হলের ভেতর থেকে রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে এমন সময় ছফার মনে হলো যেন এই ‘প্রচণ্ড খরায় এক পশলা বৃষ্টির মতো’ ওপাশ থেকে হেঁটে আসছেন নরেন’দা, নরেন বিশ্বাস। উপমাটা কি ঠিক হলো? একজন ক্ষুধার্থ মানুষের কাছে খাদ্যের আশ্বাস পাওয়াটাই কি সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক উপমা নয়! নরেন’দা যেন ‘এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর তার ওপরে ছড়িয়ে দেয়া ঘি আর একটা ভাজা শুকনো মরিচ’ হয়ে এগিয়ে আসছেন তার দিকে।
মুখে দাড়ি আর গভীর চাহনীর এই মানুষটা যেন দেবদূতের মতো হেঁটে আসছেন তার দিকে। কাছাকাছি আসতেই নরেন বিশ্বাস হাসিমুখে বললেন, কি ছফা, এখানে কি, ক্লাস নাই আজ?

ছফা কি বলবে!… ক্লাস সে তেমন একটা কখনোই করে না। ওই ধরা-বাঁধা ভাল ছাত্রের মতো প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়া নিয়মিত পরীক্ষা দেয়া তার ধাতে সয় না। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন তার কাছে অনেকটা কালাকানুনের মতো মনে হয়।

ক্লাস আছে, ছিল বোধ হয়,… তবে আমি যাইনি।

আছে। ছিল বোধ হয় মানে কি? তুমি জানো না? হেসে ফেললেন নরেন’দা।

না মানে, নরেন’দা আপনি তো জানেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটা গ্রান্ডফাদারের নাতির মতো। গ্রান্ডফাদারের কাছ থেকে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা আদায় করব তবে তার চাপিয়ে দেয়া কোনো নিয়মশৃঙ্খলা মানতে পারব না। সোজা কথা।

তোমার সোজা কথা তো বুঝলাম, তবে পাশ টাশ করতে হবে তো, না কি? এখন তো সেকেন্ড ইয়ার অনার্স চলছে।

হবে হবে, সব হবে। আপনি ওই নিয়ে ভাববেন না তো। এই বললাম না আপনার কাছে।

দুপুরে খাওয়া হইছে?

না।

চলো হলে যাই। আমিও তো খাব।

ছফা মনে মনে ভাবল নরেনদাকে বলে, ‘নরেন’দা আপনি একজন আকাশের মতো মানুষ।’ কিন্তু বলল না তাহলে ব্যাপারটা নাটুকে হয়ে যাবে। তাছাড়া নরেন’দা হেসে ফেলতে পারে। যে মানুষ আকাশের মতো তাকে সে কথা বলার প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীর সবাই তা জানতে পারে।

নরেন বিশ্বাস এই নামটার মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে সবার আত্মবিশ্বাস। যারা তাকে চেনে বা যাদেরকে তিনি চেনেন। সবার এক ভরসাস্থল যেন তিনি। তার দরাজ হাত আর উদার হৃদয়ের কথা ক্যাম্পাসের প্রায় সবার জানা। তিনি খুব অবস্থাসম্পন্ন ঘর থেকে আসেন নি তার পরও কেউ কোনো আর্থিক সংকটে পড়লে বা কোনো বিপদে পড়লে উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় তাকে দেখা যায়। ছফার আর্থিক সংকটের কথা সে কখনো মুখ ফুটে বলতে পারে না। দু’একদিন হয়তো নরেনদার কাছে ধার-টার চেয়েছে। পরবর্তীতে নরেন’দা তার মুখ দেখলেই বুঝতে পারেন। কিছু বলতে হয় না। অথচ ছফা যে খুব বিনয়ী বা তেল মেরে চলে তাও না। তার চাল চলনে সব সময়ই একটা উদ্ধত ভাব। কথায় কথায় মতবিরোধ বা তর্ক বেধে যেতে সময় লাগে না। তারপরও তাকে নরেন’দা বিশেষ পছন্দ করেন অনেকটা আপন ছোট ভাইয়ের মত। ছফার প্রতি নরেন’দার এই স্নেহের সম্পর্ককে অনেকেই ভাল চোখে দেখে না। অনেকেই তাকে ছফার বিরুদ্ধে কানভাঙ্গানি দিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। ছফার সাথে তাঁর সম্পর্ক অকৃত্রিমই রয়ে গেছে। ওইবেলা নরেনদার সঙ্গে খেয়ে এক সন্ধ্যা আড্ডা দিয়ে ছফা আবার নিরুদ্দেশ।

ছফার জ্ঞানের গভীরতা এমন যে সে যেখানে থাকে, যে আড্ডায় থাকে সেখানকার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তাই তার সাহচর্য সহজে কেউ এড়াতে পারে না। কিন্তু ছফা এমনই ছটফটে যে এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। তার জীবন স্বভাব বোহেমিয়ানের মত। তবে সেবার সে ভীষণভাবেই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল। কিন্তু রোজ রোজ বন্ধুদের কাছে ধার দেনা করতে তার আত্মসম্মানে লাগে। যদি কেউ ‘না’ বলে, যদি ফিরিয়ে দেয়! তাই সে কোনোদিন দুপুরে বা কোনোদিন রাতে ঢাকা হলে বন্ধু মোঃ আবুজাফর বা এস এম হলে বন্ধু ফজলুল হকের মেহমান হিসেবে খেতে লাগল। ছফা খেতে যায় আর গেষ্ট হিসেবে ওদের খাতায় নাম লিখিয়ে রাখে। ব্যাপারটা কিছুদিনের মধ্যেই দু’জনেই বুঝতে পারলেও ছফাকে কিছু বলল না। পাছে সে আবার অভিমান করে। তারা বুঝতে পারল বেচারা সত্যিই কষ্টে পড়েছে। অথচ মুখফুটে বলতেও পারছে না। ওর মতো একজন বন্ধুর জন্য এটুকু অত্যাচার নীরবে সহ্য করে নেয়া যায়। তবে যত কষ্টই হোক ছফা দৃঢ়সংকল্প ছিল যে সে বাড়ি ফিরে যাবে না। লেখক তাকে হতেই হবে। এই আধ-খাওয়া আধ-পেটা অবস্থাতেও প্রতিদিন রুটিন করে পত্রিকা অফিসগুলো চষে বেড়ায় সে। কবিতা লিখে, গল্প লিখে সাহিত্য সম্পাদক বরাবর খামের পর খাম পাঠায়। কিন্তু কারো অনুকম্পা তার ভাগ্যে জোটে না। ছফা তখনো বুঝতে পারে না যে এঁদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করাটা জরুরি। কিন্তু সে কথাটা সে কারো কাছ থেকে জানতেও পারছে না। কারণ, তার লেখা যে বার বার প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এই কষ্টের কথা অপমানের কথা সে কারো কাছে জানাতেও পারছে না। সাহিত্য সম্পাদক সাহেবরা তার খাম ছুঁয়েও না দেখুক। উপরন্তু বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিক। এটা প্রায় সব হবু লেখক বা নবীন লেখকের ললাট লিখন। কিন্তু সে ব্যাপারটা যদি অন্যেরা জেনে যায় তাহলেই বিপদ। ওই হবু লেখককে নিয়ে তখন আর হাসিঠাট্টার অন্ত থাকবে না। সে তখন অনেকটা সার্কাসের জোকারে পরিণত হবে। তবে যতই রাখ-ঢাক করার চেষ্টা করুক কিছু দিনের মধ্যেই অনেকেই জেনে ফেলেছিল যে, তার লেখা কেউ ছাপেন না। বার বার তাগাদা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। এই ব্যাপারটা তাকে বন্ধু বান্ধবের মধ্যে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। অনেকেই ঠাট্টার ছলে বলে, ‘কী ছফা-কবিতা লিখতেছ কেমন?’

এই একটা জিজ্ঞাসায় ছফা যেন মরমে মরে যায়। লজ্জায় নুয়ে পড়ে। তাই একদিন একটা কবিতা নিয়ে সে সরাসরি ‘সংবাদ’  পত্রিকার সম্পাদক সন্তোষ গুপ্তের কাছে চলে গেল।

সন্তোষ গুপ্ত বেশ ব্যস্ত মানুষ। তার ঘরে সারাক্ষণ লোকজন ঢুকছে বের হচ্ছে। ছফা দীর্ঘক্ষণ ধরে তার সাথে দেখা করার জন্য বাইরের ঘরে বসে আছে। অবশেষে লাঞ্চ আওয়ারের পর তার ডাক পড়ল। সন্তোষ গুপ্ত একটা চিকন সাপের ল্যাজের মতো টাই পরে চেয়ারে বসে আছেন। ছফা ঘরে ঢুকে তার দিকে খামটা এগিয়ে দিল।
তিনি কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, কি এটা?

ছফা বলল, খুলে দেখুন। ভঙ্গিটা এমন যেন খুব জরুরী কোনো বিষয়ে তলব নিয়ে এসেছে ।

তিনি খামটা খুলে ভেতরের কাগজে একবার চোখ বোলালেন কি বোলালেন না, ছফার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, বাপ আছে?

না নাই।

ভাই আছে?

হ্যাঁ আছে।

ঠিকানাটা বল, একটা চিঠি দেব।

মানে?

মানে তোমার বাড়ির ঠিকানাটা বল, তোমার ভাইকে একটা চিঠি দেব।

কেন?
তোমার ভাইকে লিখব তোমাকে যেন অতি শিগগির একটা বিয়ে করিয়ে দেন। একে কি কবিতা বলে? যেন মিনি বিড়ালের সঙ্গী-খোঁজা। নাও ঠিকানাটা এখানে লিখে দিয়ে বিদায় হও। আমার অনেক কাজ আছে।

রাগে ছফার মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল। কান থেকে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। তার কবিতা হয় না! লোকটার এতো বড় ঔদ্ধত্য। কিন্তু শত হলেও পত্রিকার সম্পাদক, তাকে এখন কিছু বলা যাবে না। তবে একে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে; এবং সেটা আজই। এই লোকটাকে আচ্ছা মতো পেটাতে হবে। তাহলেই তিনি বুঝতে পারবেন যে ছফার কবিতা মিনি বিড়ালের সঙ্গী-খোঁজা নয়।

সন্তোষ গুপ্তকে একটা আচ্ছামতো শিক্ষা দেয়ার জন্য ছফা ‘সংবাদ’ অফিসের সামনে সেলুদার রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকল। লোকটা বের হয়ে এদিকে হেঁটে এলেই গিয়ে পিটুনি দিতে হবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্তোষবাবু সেলুদার রেষ্টুরেন্টে ঢুকলেন। সেই ব্যস্ত ভঙ্গি। সঙ্গে আরো দু’জন লোক। তিনি রেষ্টুরেন্টে ঢোকামাত্র বেয়ারা চা নিয়ে গেল। এই অবস্থায় কাউকে পেটানো যায় না। ছফা আবারো অপেক্ষা করতে লাগল। তার সঙ্গে লোক দুজন সমানে কথা বলে যাচ্ছে আর তিনি শুনে যাচ্ছেন। একজন আবার হাত-পা নেড়ে কথা বলতে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসের পানি ঢেলে দিল। দ্রুত সেই পানি গড়িয়ে সন্তোষবাবুর প্যান্ট ভিজিয়ে দিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে উঠে দাড়ালেন। এবং দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে অফিসে ঢুকে গেলেন।

না, এখনো পেটানো গেল না! কিন্তু ওকে একটা উচিৎ শিক্ষা না দিয়ে ছফা এখান থেকে যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আবার সন্তোষবাবুর অফিসে ঢুকে গেল।
সন্তোষবাবু টেবিলে ঝুঁকে কিছু একটা লিখছেন, এ অবস্থায় ছফা তার কবিতাটা টেবিলের ওপর মেলে ধরে বলল, আচ্ছা এটাতো কোনো প্রেমের কবিতা না, কিন্তু আপনার কেন মনে হলো যে এটা মেনি বেড়ালের সঙ্গী-খোঁজা?

তুমি আবার! তোমাকে কে ঢুকতে দিয়েছে? সন্তোষবাবু প্রায় হুঙ্কার করে উঠলেন।

কেউ না, আমি নিজেই ঢুকেছি। আমার এটা জানতেই হবে কেন আপনার এটা মনে হলো।

আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই। গেট লস্ট।

না, আপনি যখন কবিতাটা রিজেক্ট করেছেন তখন আপনি বলতে বাধ্য কেন এটা রিজেক্ট হলো।

হ্যাঁ। ও.কে.। আমি এটা রিজেক্ট করেছি এজন্য যে আমার মনে হয়েছে ওটা কোনো কবিতাই না। নিছক প্যানপ্যানানিতে ভরা। আর প্রেমের কবিতা হলেই যে সেটা কবিতা হবে, না, তোমার এই ধারণা ঠিক না। রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য প্রেমের কবিতা লিখে রেখে গেছেন। আর পড়ে দেখো সেগুলো কী অসাধারণ সব কবিতা। নাও গেট লষ্ট।
ছফা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় ঘরে ঢুকলেন আর একজন। ঢুকেই ছফার হাতটা ধরে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে আসুন প্লিজ। ইশারায় তিনি মাথায় আঙ্গুল ঠেকিয়ে একটা ভঙ্গি করলেন যার মানে ওই সম্পাদক লোকটা একটা পাগল। ছফা এই ভদ্রলোকের সঙ্গে বাইরে চলে এলো। রাগে তার মাথার শিরা তখনো দপদপ করছে।

সম্পাদকের পাশের ঘরেই ভদ্রলোকের বসবার ঘর। তিনি ছফাকে তার ঘরে বসিয়ে বললেন, ভদ্রলোক একটু পাগলা কিসিমের। কিন্তু লোকটা ভাল। পরে কখনো আলাপ পরিচয় হলে দেখবেন। কই দিন আপনার কবিতাটা দিন। ভদ্রলোক তার কবিতাটা পড়লেন, বেশ মন দিয়েই পড়লেন। তারপর বললেন, কবিতাটা বেশ ভালো হয়েছে তবে বুঝতেই পারছেন, আপনি নবীন কবি তাই বলছি। আরো কয়েকটা কবিতা কি জমা দিতে পারেন?

নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। তাই ছফা তার কথায় রাজি হয়ে গেল।

ধন্যবাদ। আর ওনার কথায় কিছু মনে করবেন না। বুঝতেই পারছেন সারাদিন কত ধরনের চাপের মধ্যে থাকতে হয়। এরপর এই অফিসে এলে সরাসরি আমার ঘরে চলে আসবেন। আমার নাম রণেশ দাশগুপ্ত।

কিছুদিনের মধ্যেই রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে ছফার বিরাট ভাব হয়ে গেল। সে ঘন ঘন রণেশ’দার কাছে যাওয়া আসা করতে লাগল। তিনি ছফার তিন চারটা কবিতা সংবাদের সাহিত্যের পাতায় ছাপলেন। ততদিনে সন্তোষ গুপ্তের সাথেও তার ভাব হয়ে গেছে। সন্তোষবাবুকে সে মনে মনে গুরুও ভাবতে শুরু করেছে।

এমন সময় একদিন রণেশ দাশগুপ্ত তাকে অফিসে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমার তো বেশ কয়েকটা কবিতা সংবাদের সাহিত্যের পাতায় গেল। তুমি এখন খুশি? হাসছেন তিনি।

ছফা বলল, খুশি তবে আরো ছাপা হলে আরো খুশি হবো।

রণেশ’দা বললেন, এটা তো লোভের কথা হলো।

এ কথা শোনার পর আর কিছু বলা যায় না। তাই ছফা চুপ করে রইল।

আচ্ছা তুমিতো এক সময়ে কৃষক সমিতি করতে। তাহলে ওই সব শ্রমজীবী মানুষের সম্পর্কে গদ্যে কিছু লিখ না কেন?

একথা শুনে ছফা একটু চমকালো। তার মানে! আমার কি কবিতা হয়না? তাই কবিতার ব্যাপারে আমাকে নিরুৎসাহিত করছেন!

হাসলেন রণেশ’দা। না, মোটেই না। শোনো লেখালিখির শুরুতে সবার কবিতার প্রতি একটা ক্রেজ থাকে। কিন্তু তাই বলেতো শুধু কবিতা লিখলেই চলে না। লেখক হতে গেলে গদ্য, সমালোচনা-সাহিত্য, প্রবন্ধ-নিবন্ধ সবকিছুই লিখতে হয়। তাছাড়া তুমি শ্রমজীবী মানুষের হয়ে কাজ করেছ। তুমি তাদের সম্পর্কে অনেক কিছু লিখতে পার। যারা শুধু কবিতা লেখে তাদের পক্ষে সেটা অনেক সময় সম্ভব হয় না। সুতরাং গদ্যে শ্রমজীবী মানুষের জন্য কিছু লিখতে চেষ্টা কর।

রণেশ’দার কথায় ছফা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। থিওরীটা সে জানে, কিন্তু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করবে কীভাবে? ও দিকে চ্যালেঞ্জটা তাকে নিতেও হবে। সে শুধু কবিতা লিখতে পারে অথচ গদ্য লিখতে জানে না। এটা তো হবে মহা মুর্খতা। দেশে এমন আম-কবি তো কয়েক লক্ষ হবে। কবিয়ালও বাদ যাবে না তালিকা থেকে। তাহলে লেখক হিসেবে সর্বোপরি বুদ্ধিজীবী লেখক হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা পাওয়া হবে না। তার দায়িত্ব আছে লেখক হিসেবে সমাজকে কিছু দেয়ার। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসা। প্রচলিত ধারণা বোধে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়া একজন লেখকের কাজ। কিন্তু কবিতা! ওই কবিতার ভাবনায় এসে বড় দুর্বল হয়ে যায় সে। তাহলে কি তার কবিতা রণেশ’দার পছন্দ হচ্ছে না! তাই এমন পথ বাতলে দিচ্ছেন তিনি? না কি তার ভার্সেটিলিটি পরীক্ষা করছেন! কিন্তু ওই কবিতার চিন্তাটা আবারো ঘুরে-ফিরে আসে। যথেষ্ট যুক্তি নিয়েই উপস্থিত হয় এবার। সন্তোষবাবু তার এই কবিতা নিয়ে তিরস্কার করেছিলেন, তিনি কবিতার নামে এই অখাদ্য হজম করতে পারেন নি। সেই একই অবস্থা কি এতোদিন পর রণেশবাবুরও হলো? কিন্তু রণেশদার কথা ফেলা যায় না। তিনি তাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখেন। তিনি যা বলবেন তার ভালর জন্যই বলবেন। ছফা তখন ভাবছে কি নিয়ে লেখা যায়। কিভাবে শুরু করা যায়। সমস্যার মূল ভিতটা তুলে ধরতে হবে। আর ভাবতে ভাবতেই তার মাথায় এলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে শ্রমিক নিষ্পেষণের কথা। সে যখন পুলিশের ভয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে লুকিয়ে ছিল তখন নির্যাতনের দৃশ্য সে স্বচক্ষে দেখেছে। কর্ণফুলি কাগজের কলে কাঁচামাল যোগানের সুবিধার জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরী হচ্ছিল। ওই রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদার ছিল পাকিস্তানি পাঞ্জাবীরা। ওই সব ঠিকাদার ও তাদের পাণ্ডারা বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক জোগাড় করে এনে সেখানে কাজ করাত। কিন্তু তাদের যোগ্য পারিশ্রমিক দেয়া হত না। উপরন্তু তাদের ওপর চলত নানা অত্যাচার নির্যাতন। তারা কাজ ছেড়ে পালিয়েও যেতে পারত না। কারণ সব সময়ই তাদের পারিশ্রমিকের এক অংশ বকেয়া রাখা হতো। রক্তে ঘামে প্রাপ্য সেই পারিশ্রমিকের আশা ছেড়ে কোথাও নড়াও যায় না।

শ্রমিকের প্রতি মালিক শ্রেণীর এই অবিচার তার মর্মমূলে তখন যে আঘাত হেনেছিল সেটাই এখন লিখবার সুযোগ পেয়ে ছফার বুকের ওপর থেকে যেন পাথর নেমে গেল। সে ‘‘কর্ণফুলীর ধারে’’ শিরোনামের লেখাটি দু’দিনের মধ্যে রণেশ’দার কাছে জমা দিয়ে এলো।

এর দু’দিন পরই ক্যাম্পাসে তাকে খুঁজে বের করলেন নরেন বিশ্বাস। দেখা মাত্রই বললেন, আরে ছফা, তুমি তো একদম ফাটাইয়া দিছ মিয়া! মানে? কি ফাটাইলাম আবার।

আরে, আজকের ‘সংবাদ পত্রিকা’ দেখ নাই? ওর উপসম্পাদকীয় তে তো তোমার লেখা বের হইছে। চমৎকার হইছে কিন্তু লেখাটা।

ছফার মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল তখন। ছফা তখনই ছুটল সংবাদ অফিসে।

ছফাকে দেখেই রণেশ’দা একগাল হাসি দিয়ে বললেন, তোমার লেখাটা দেখেছে?

হ্যাঁ, থ্যাংক ইউ রণেশ’দা।

আরে এতে ধন্যবাদ দেয়ার কি আছে? তোমার লেখাটা ভালো হচ্ছে। এক কাজ কর, এটা ধারাবাহিক লিখে ফেল। ছাপাব আমরা।

সত্যি! এতো বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করছিল ভাবতেই পারে নি সে। কারণ তখন সংবাদে কারো লেখা ছাপা হওয়াটা ছিল অনেক বড় ব্যাপার।

চা খাবা তো?

হ্যাঁ, অবশ্যই।

আচ্ছা তুমি এখানে বসে চা খাও, আমি এক্ষুনি আসতেছি। বলে রণেশ’দা ঘরের বাইরে চলে গেলেন। আবার ছফার চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই তিনি আবার ফিরে এলেন। তার পিছু পিছু ঘরে ঢুকলেন ক্যাশিয়ার আইয়ুব সাহেব। তিনি একগাল হেসে ছফার দিকে পঁচিশটা এক টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলেন।

ঘটনার আকস্মিকতায় ছফা কিছু বুঝতে না পেরে রণেশ’দার দিকে তাকাল। রণেশবাবু আবারও হেসে বললেন, নাও, তোমার যৎসামান্য পারিশ্রমিক।

বলেন কি রণেশ’দা এতোটাকা! ওটুকু লেখার জন্য। এ দিয়ে তো আস্ত একটা খাশি কিনে ফেলা যায়।

খাশি কেনো, গরু কেনো, যা খুশি কেনো, লেখাটা চালিয়ে যাও।

লেখাটা তো সে চালাবেই। লেখার জন্যই তো তার নিরন্তর ছোটাছুটি। এত কষ্ট। আর মাত্র দু’ঘন্টা পরিশ্রম করে যদি এত্তো টাকা পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। তার খাওয়া পরার খরচটাও মিটবে। ছফা যেন হাতে চাঁদ পেল। সে ওই টাকায় তার সব বন্ধুদের ডেকে খাওয়াল। দু’একজনকে ধারও দিয়ে বসল। তার বরাবরই খরচের হাত। রেখে ঢেকে খরচ করা, ভবিষ্যতের জন্য জমা করার চিন্তা কখনো তার মাথায় আসে না।

ছফা মহা উৎসাহে লিখে যাচ্ছে। আর লেখাটি সংবাদে সপ্তাহে দু’বার করে ছাপাও হচ্ছে। টাকাও আসছে নগদ! নগদ। এভাবে ছয় কিস্তির টাকা পেয়ে গেল নগদ নগদ।
কিন্তু সাত থেকে দশম কিস্তির লেখা টাকা আনতে ক্যাশিয়ার আইয়ুব সাহেবের কাছে গেলে বাধল এক বিপত্তি।

আইয়ুব সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, টাকা দিতে পারব না।

কেন? এই যে আমার সপ্তম কিস্তি থেকে দশম কিস্তি পর্যন্ত লেখা তো ছাপা হয়েছে।

কিন্তু আপনার নামে টাকা বরাদ্দ হয় নাই।

কেন, এতদিন বরাদ্দ হয়েছে এখন হঠাৎ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে গেল কেন? এ কেমন কথা!

দেখেন, আমি এখানকার ক্যশিয়ার আমার তো এতো কথা জানার কথা না। আপনার নামে কোনো বরাদ্দ নাই দেখতে পাচ্ছি ব্যাস। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
ছফার এবার মাথায় আগুন চড়ে গেল। সে বলল, বলতে পারবেন কি করে? আমার বয়সটা নিতান্ত কম তাই আপনি আমার টাকাটা দিতে চাচ্ছেন না। আপনার কূটচাল আমি ধরতে পারিনি মনে করেছেন? ছফার এ কথা শোনার পর আইয়ুব সাহেব আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি বলেই ফেললেন কথাটা। শোনেন, ‘সংবাদের’ একটা নিয়ম আছে। এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাইরে কাউকে টাকা দেয়া হয় না। কিন্তু আপনাকে কেন দেয়া হলো? আপনার কি এমন বিশেষত্ব আছে?

ছফা এবার কিছু না বলে চুপ করে ভাবতে থাকে।

আইয়ুব সাহেব এরপর যা বললেন তাতে ছফার বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

আপনার টাকাটা আসলে রণেশবাবু ওনার বেতনের টাকা থেকে দিয়েছেন। আপনার যেদিন লেখা ছাপা হলো সেদিন উনি এসে আমাকে বললেন, তাঁর বেতনের টাকাটা যেন আমি আপনার ধারাবাহিক লেখা বাবদ দিয়ে দেই। রণেশবাবু বেতন পান মাসে একশ’ পঞ্চাশ টাকা। ছ’কিস্তির মাথায় সে টাকা শেষ। এখন আমি কোত্থেকে টাকা দেব আপনাকে?

বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রইল ছফা। রণেশ’দা কেন করলেন তার জন্য এতোটা! তাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য? শুধু কি তাই? এর গভীরে কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে আছে একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে সেটাও উপলব্ধি করতে পারে ছফা। তাই টাকা না পেলেও সংবাদে লেখা ছাড়ে নি সে। সে একটার পর একটা লেখা লিখে যাচ্ছিল।
(পাদটিকা: এবং মজার কথা হলো তিনি যতদিন সংবাদে লিখেছেন ততদিন অন্য কোনো পত্রিকায় লেখা পাঠান নি।)

এদিকে সংবাদে লেখা ও সেখানে ঘনঘন যাতায়াত ও আড্ডা দেয়ার ফলে লেখক মহলে তার বেশ পরিচিতি বাড়ল। সংবাদ অফিসের পাশেই ছিল বন্ধু অরনেন্দু বিকাশ দেবের বাসা। সেখানেও নিত্য আসা যাওয়ার কারণে ওই এলাকায় তাঁর একটা আড্ডা গড়ে উঠেছিল। সালোজা ও আমিনিয়া উল্টে পাল্টে এই দুই রেষ্টুরেন্টে বসত তাদের আড্ডা। সেই আড্ডায় আরো আসতেন নরেন বিশ্বাস, জামাল খান, পবিত্র কুমার দাস, অরুণ সেন। মাঝে মাঝে সন্তোষ গুপ্ত, সত্যেন সেন এরাও আসতেন ওদের আড্ডায়। সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই আড্ডাটা বেশি করে জমত। এই আড্ডার একটা নামও ছিল। ‘নটিকর্ণার’। এই ‘নটিকর্ণারের’ আড্ডাতেই একদিন কথাটা তুলল ছফা।

আচ্ছা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা তাঁদের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে যে সব গল্প-উপন্যাস লেখেন, এগুলো আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমরা কি লিখতে পারি না?

ফিল্ম সোসাইটির জামাল খান বললেন, না এটা সম্ভব না।

ছফা বলল কেন?

আমাদের সাহিত্যিকদের সেই কেলি নেই।

চাইলেই পারা যায়। কেউ চায়নি তাই…।

জামাল খান এবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, তুমি পারবে?

হ্যাঁ, পারব।

পারবে না, শুধু শুধু বাগাড়ম্বর।

যদি পারি?

আমি চ্যালেঞ্জ করছি পারবে না। আর যদি পার তাহলে ১০০ টাকা বাজি। আমি তোমাকে ১০০ টাকা দেব।

ওকে ডান।

তবে একটা শর্ত আছে। শুধু লিখলেই হবে না সেটা সংবাদের সাহিত্য পাতায় লিখে দেখাতে হবে।

হ্যাঁ তাই হবে। এ শর্তে আমি রাজি। বেশ দৃঢ় প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে বলল ছফা।

এর পর শুরু হলো তার উপন্যাস লেখা–

‘‘বৈশাখের শেষ। আধা বছর জুড়ে বিশাল নীলাকাশে সূর্যের রূপালী আক্রোশ-সহস্র শিখায় শ্যামল পৃথিবীতে আগুন ঢেলেছে। অগ্রহায়ণের শেষাশেষি একদিন আসমানের চার কোণে জমাট বাঁধা কালো মেঘ কালো গাইয়ের ওলানের বরণ ধরেছিল। বজ্রেরা চিৎকার করে ফেটে পড়েছিল। মেঘের বুক চিরে চিরে বিজুলীর শাণিত ছুরি ঝিকঝিকিয়ে জেগেছিলো। লোকজন আতঙ্কে ফরিয়াদ করেছিলো অগ্রহায়ণ মাস পাকা সোনারঙ ধান ঘরে আসার মৌসুম। এমনি সময়ে যদি বৃষ্টি নামে…..।’’
বর্ণনাশৈলীতে যেন তারাশংকরের ছায়া। সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক এক বাক্যে ছাপাতে রাজি হয়ে গেলেন। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে লাগল আহমদ ছফা’র উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী।’

কিন্তু জামাল খানের কোনো খবর নাই। সে তার চ্যালেঞ্জের কথা, ১০০ টাকা বাজির কথা দিব্যি ভুলে বসে আছে। টাকা দেয়ার আর কোনো প্রশ্নই নেই।

দুটি অধ্যায় লিখে ছফাও আর লেখাটা শেষ করেনি। বাজির টাকা না পাওয়ায় উৎসাহে ভাটা পড়েছিল হয়তো।

ওদিকে রণেশ’দা সমানে তাড়া দিচ্ছেন। এতো ভালো একটা উপন্যাস লিখে শেষ করছ না কেন? লিখ। লিখে শেষ কর জলদি।

এভাবে রণেশ’দার তাড়াতেই আবার লেখা ধরতে হলো বাকীটা। এভাবে দু’বছর পর শেষ হলো উপন্যাসটা।

 

নয়

লেখক হওয়ার বাইরে ছফার জীবনে এর মধ্যে ঘটে গেল অনেক অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস সে নিয়মিত করত না ঠিকই। তবে ছাত্র হিসেবে সে বেশ মনোযোগী ছিল। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা বিশেষ করে শিক্ষকদের সাথে তার কিছু মান-অভিমানের ব্যাপার ঘটত হামেশাই। এমনিতে ছফা মানুষ হিসেবে ভীষণ অভিমানী তার ওপরে স্পর্শকাতর। তার ওপরে সব সময় তার ভেতরে একজন স্ট্রাগলিং রাইটার কাজ করে। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াতো মূলত চাকরি পাওয়ার জন্য কিছু ডিগ্রী জোগাড় করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সে এসেছিল শিখতে। সত্যিকার অর্থে সমাজ-রাষ্ট্র ও সাহিত্যকে জানতে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সহপাঠীদের সাথে বা কখনো কখনো শিক্ষকদের সাথেও মতোবিরোধ ঘটতে পারে। ঘটাই স্বাভাবিক। আদর্শগত বা দৃষ্টিভঙ্গীগত কিছু পার্থক্য কখনো কখনো দেখা দেয় মতবিরোধ হিসেবেও। ছফা একদিন যখন তার স্কুল জীবনে লেখা কবিতাগুলো প্রফেসর ড. মনিরুজামানকে দেখাল। তিনি কবিতাগুলো দেখে বললেন এগুলো কিছু হয় নাই। এ কথা শুনে ছফা ভীষণ মর্মাহত হয়েছিল। রাগ না এক্ষেত্রে দুঃখটাই এসে ভর করেছিল তার ওপরে। এমন সব ক্ষেত্রে তার হুট করে যে রাগটা মাথায় চড়ে যায় সেটা আসেনি দু’টো কারণে, এক তিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আর দুই তাঁর লেখা কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়। তাই সে ভাবল স্যারের কথার একটা মূল্য আছে বৈকি! তাছাড়া তার নিজের লেখা একটা কবিতাও তখন কোনো পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে না। সে রকম একজন মামুলী, লেখক হওয়ার আশায় সদাজাগ্রত মানুষের রাগ অভিমান বা প্রতিবাদে জ্বলে ওঠার কোনো মানে থাকতে পারে না। তাই ছফা সেদিন নীরবে তার এতোদিনের, তার গোটা শৈশব-কৈশোর কালের লেখা সব কবিতা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। যা একসময় ‘প্রভাত সঙ্গীত’ ‘শৈশব সঙ্গীত’ হতে পারত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে যেমন স্নেহ করেছেন তেমনি কখনো কখনো কেউ কেউ তাচ্ছিল্যও প্রদর্শন করেছেন। তবে সবারটা সে মনে রাখেনি। কিন্তু একদিন যখন ড. আহমদ শরীফ স্যার তীব্র বকুনি দিলেন তখন অভিমানে ছফার চোখে পানি এসে গিয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসে সে প্রথম যে মানুষটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল তিনি ড. আহমদ শরীফ। সেই সন্ধ্যাটার কথা তার সারাজীবন মনে থাকবে। আরমানিটোলায় তাঁর বাড়ির সামনে ছিল এক বিশাল বটগাছ। সেই বটগাছের যাবতীয় বাসিন্দারা তখন তাদের ঘরে ফেরার বার্তা ঘোষণা করছে। বহু দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল পাখিদের সেই কলতান। সেই গাছের সামনে দাড়িয়ে ছফা পাখিদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলল, স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। ভীষণ এঙ্াইউড বুঝলি! স্যারের লেখা আমার ভালো লাগে, দেখি এবার মানুষটা কেমন।’

স্যারের বাসায় বসার ঘরে অপেক্ষা করছে ছফা। এমন সময় ঘরে ঢুকলেন তিনি। ছফা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। দীঘল গৌরবর্ণের মহেন্দ্র নন্দিত সুন্দর চেহারার মানুষটাকে দেখে সে তো ভীষণ খুশি আবার একই সাথে তাঁর কর্কশ কণ্ঠস্বরে সে হতাশও হয়েছিল। যাই হোক তার পরও তাদের সম্পর্ক খুব একটা খারাপ ছিল না কখনো। কিন্তু ওই যে ছফার তীব্র অভিমান। এটা মাঝে মাঝে কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য।

একদিন ড. আহমদ শরীফের টিউটোরিয়াল ক্লাসে সে একটা এ্যাসাইনমেন্ট করেছিল। ‘বাংলা সাহিত্যে বাঙালীর লড়াই’ বা ‘সাহিত্যে তাদের সম্প্রদায়গত চরিত্র’ নিয়ে লিখেছিল। সেখানে এক পর্যায়ে সে লিখেছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে বিশ্বসমাজে, বাংলাভাষা এবং সাহিত্যকে বিশ্বের চিন্তাভাবনার জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।’
রবীন্দ্রনাথের প্রতি ড. আহমদ শরীফের এক ধরনের এ্যালার্জি ছিল। তিনি প্রায় হু‍ঙ্কার করে উঠলেন। ‘শুধু রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাও বঙ্কিমচন্দ্রকে দেখতে পাওনা? ওই লোকটা যেন সবার মাথা কিনে নিয়েছে। বঙ্কিম যে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক জীবন, আধুনিক চিন্তা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন সেটা তো কোথাও লিখ নাই!’

স্যার উনি তো সাম্প্রদায়িকতার সূত্রপাতও ঘটিয়েছেন সাহিত্যে।

সাট আপ বুরবাক! আবার মুখে মুখে তর্ক কর। গেট লষ্ট।

বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যপারে ড. আহমদ শরীফের এক বিশেষ দুর্বলতা ছিল, প্রায় জান কুরবান অবস্থা। সেই তাঁর সমালোচনা তিনি যেমন সহ্য করতে পারেননি তেমনি ছফাও সবার সামনে এই কড়া ধমক হজম করতে পারেনি। ছোটবেলা থেকে সে অনেক আদরে বড় হয়েছে। এভাবে কেউ কখনো তাকে ধমকায়নি। কেউ অকারণে তার অনুভূতিকে আহত করতে পারে একথা সে ভাবতেও পারেনি কখনো। তাই সে ভাবল শরীফ স্যারের ক্লাস আর সে করবে না কখনো। যে কথা সেই কাজ। শরীফ স্যারের ক্লাস এবং টিউটোরিয়াল অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে বর্জন করতে লাগল সে। অন্যান্য ক্লাসেরও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

ছফার তখন লড়াই চলছে অন্য জায়গায়। এই লড়াই নামের লড়াই। সংবাদে লেখার পর লেখক হিসেবে দু’এক জায়গায় তার গুরুত্ব একটু বাড়লেও এবং অন্যান্য পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হলেও নাম নিয়ে বাধল এক বিপত্তি। যে তার নাম দেখে সেই ওটাকে শুদ্ধ করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। কিন্তু ছফা এই ব্যাপারে ভীষণ কঠোর অবস্থান নিল। যে যাই বলুক সে কিছুতেই তার নামের বানান পরিবর্তন করবে না। আর তাই নিয়ে আরো গোল বাধতে লাগল।

একদিন ‘সাপ্তাহিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় তার একটা কবিতা ছাপা হয়েছে কিন্তু নিজের নামের বানানটা দেখেই ছফার মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে তৎক্ষণাৎ ছুটল পত্রিকা অফিসে। সেখানে সম্পাদকের চেয়ারে বসে আছেন প্রবীণ সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস। তিনি খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা এডিট করছেন। এমন সময় রাগে আগুন হয়ে যাওয়া ছফা তার হাতের মুঠোয় ভাঁজ করা পত্রিকাটা সম্পাদক সাহেবের সামনে দোলাতে দোলাতে বলল, কার কথা মতো আমার নামের বানান পাল্টে ফেলা হলো জানতে পারি?

হঠাৎ কাউকে কথা বলতে শুনে চমকে উঠে সামনে তাকালেন সম্পাদক সাহেব। দেখলেন, হালকা পাতলা চেহারার এক রাগী তরুণ গনগনে চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।

আপনার… মানে তোমার পরিচয়টা? ভদ্রলোক বিব্রত গলায় জিজ্ঞেস করলেন তাকে।

আমার নাম আহমদ ছফা।

এই উত্তেজিত তরুণ আর কিছু বলার আগেই পুরো ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন সম্পাদক সাহেব। এমন অনেক ঘটনাই তাকে হ্যাণ্ডেল করতে হয় তাই তাড়াতাড়ি তিনি বললেন, আরে তুমিই আহমদ সফা? আজকের সাহিত্য পাতায় তোমার একটা কবিতা ছাপা হয়েছে। আর আমি তোমার নামের ভুল বানানটা শুধরে দিয়েছি। ‘ছফা’ আবার কি। ‘সফা’ই তো ঠিক! তাতে এমন খেপে যাওয়ার কি আছে বলত? বসো চা খাও।

ছফা দাড়িয়েই রইল।

আরে বসো না! দাড়িয়ে আছো কেন?

বসতে পারি, চা-ও খেতে পারি তবে একটা শর্ত আছে।

শর্ত! বিস্মিত কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস। এ কেমন ছেলে? তার সাথে এভাবে উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে এতো বড় ঔদ্ধত্য! তিনি এবার যারপরনাই বিরক্ত হলেন। বললেন, কি শর্ত? কিসের শর্ত?

আপনাকে এ ব্যাপারে একটা সংশোধনী ছাপতে হবে আগামী সংখ্যায়।

বলে কি এ ছেলে, সাহস তো কম না! তিনি সহজ ভঙ্গিতে বললেন, পারব না।

পারবেন না মানে? যে ছেলের নামকরণ উপলক্ষে সাতটা গরু জবাই করে খাওয়ানো হয়, তার নাম আপনি কলমের এক খোঁচায় পাল্টে দেবেন! তার বাবা-মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করবেন, সেটাতো হতে পারে না। আপনি এটা করবেন কি করবেন না, বলেন।

কাজী সাহেব আর কোনো কথা বললেন না। নিপাট এই ভদ্রলোক টেবিলে ঘাড় গুঁজে আবার এডিট করতে লাগলেন।

ছফাও তার মাথায় চড়ে চাওয়া রাগ সম্বরণ করতে না পেরে তার হাতে ধরা ‘পূর্বদেশ’টা ছিড়ে কুটিকুটি করে মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
এভাবে চলছে একই সাথে তার লেখক হবার ও নামের বানান প্রতিষ্ঠা করার লড়াই। তার মধ্যে ঘটল আর এক ঘটনা। ছফার জীবনে প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল ইসলামি একাডেমি প্রকাশিত এবং শাহেদ আলী সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকা ‘সবুজ পাতা’য়। সেখানে ছাপা হওয়া তার প্রথম গল্প ‘অপূর্ব বিচার’ ছোটবেলায় তার বাবার মুখে শোনা। গল্পটা ছিল সোলায়মান নবীর জীবনের একটা কাহিনী। সেই গল্প ‘সবুজ পাতা’য় ছাপা হয়েছিল ভাল কথা। কিন্তু ঝামেলা বাধল অন্য জায়গায়। ছফা একদিন জানল প্রিন্সিপল মিন্নাত আলী সম্পাদিত অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে গল্পটা সংকলিত হয়েছে। কিন্তু লেখকের নাম হিসেবে ছফার নাম পরিবর্তন করে মিন্নাত আলী তাঁর নিজের নাম দিয়ে দিয়েছেন।

বিষয়টা জানা মাত্র তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। তার লেখা পাঠ্য বইয়ে সংকলিত হয় এই ব্যাপারটা লেখক হিসেবে তার আত্মবিশ্বাস যতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিক নাম পাল্টে যাওয়াটা ততটাই তার মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল। এ কেমন দেশ! একজন প্রিন্সিপল মানুষ, যিনি আবার পাঠ্যবই সম্পাদনার দায়িত্ব পান, তিনি এতোবড় একটা অন্যায় করতে পারেন! এর একটা মোক্ষম জবাব দিতে হবে। এছাড়া তার গল্পটা অন্যের নামে ছাপা হয়েছে সেই কষ্টে তার রাতের ঘুম হারাম। রাতভর শুধু পায়চারী করছে ক’দিন ধরে। চোখ একটু বন্ধ হলে কী যেন হারিয়ে গেছে এমন একটা শূন্যতাবোধ এসে আঘাত করে তাকে। আবার উঠে বসে সে। কিছু একটা বিহিত করতে হবে এর। কিন্তু কি করা যায়!

ছফা একদিন গিয়ে ইসলামী একাডেমীর ডিরেক্টর আবুল হাশিম সাহেবের কাছে নালিশ ঠুকে দিল। এমনিতে ছফা আবুল হাশিম সাহেবের ভীষণ ভক্ত ছিল। তাঁর `Creed of Islam’ পড়ে সে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর গদ্যরীতি, যুক্তির শক্তি, পঠন পাঠনের ব্যাপ্তি এবং সুগভীর মননশীলতা তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তো সেই আবুল হাশিম সাহেবের কাছে নালিশ জানালে তিনি বিষয়টা তেমন গুরুত্ব দিলেন না। তারপর আবুল হাই সাহেবকে জানালে তিনিও বললেন ওটা কোনো ব্যাপার না, ফরগেট ইট।

কিন্তু বললেই হলো- এতো সহজে সব ভুলে যাওয়া যায়! ‘অপূর্ব বিচার’ যে ‘অবাক বিচার!’ হয়ে বার বার তার মর্মমূলে ধাক্কা দিয়ে যায়। এর একটা ন্যায় বিচার তার পাওয়া চাই। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাকে এখনই হেরে গেলে চলবে না। তাই সে গিয়ে ধরল কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী বেগমকে। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। একথা সত্যি যে ছফার বুদ্ধির দীপ্তি ও কথা বলার স্টাইলের কারণে সে সুদর্শন না হলেও চালচলনে গ্রাম্যদোষ থাকলেও সহজে মানুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করতে পারত। আর সব কিছুর ওপরে ছিল তার মন। এই অসম্ভব সুন্দর মনের মানুষটাকে সবাই সহজেই পছন্দ করে ফেলত। তাই কথাটা ফেরদৌসী বেগমকে জানালে তিনি তার ভাই মোস্তফা কামালকে দিয়ে মিন্নাত আলী বরাবর একটা উকিল নোটিশ পাঠাতে সক্ষম হলেন।

উকিল নোটিশ পেয়ে মিন্নাত আলী সাহেবেরতো লবেজান অবস্থা। তিনি কোর্টের নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের ছয় হাজার টাকার মধ্যে তিন হাজার টাকা পাঠালেন একদিন।

ছফা বিজয়ীর ভঙ্গিতে সেই টাকা গ্রহণ করলেন। কিন্তু তার পর মিন্নাত আলী সাহেবের আর কোনো খোঁজ খবর নাই। বাকি টাকা আর পাঠান না।

ছফাও তার ন্যায্য পাওনা ছাড়বে কেন? তাই বাকি টাকা আনতে একদিন পাড়ি জমাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানেই থাকেন মিন্নাত আলী সাহেব।

কিন্তু ক্ষতিপূরণের টাকা আনতে গিয়ে ছফা যা দেখল তাতে সে মরমে মরে গেল। কারণ প্রিন্সিপাল বলতে তার যে ধারণা ছিল মিন্নাত আলী মোটেই সে রকম কোনো মানুষ নন। চট্টগ্রাম কলেজের প্রিন্সিপাল যিনি ছিলেন তার বাড়িতে টেনিস কোর্ট ছিল, তিনি গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন। আর এ দেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য। মিন্নাত আলী সাহেব ভাড়া ঘরে থাকেন। নিজের হাতে বাজার করেন। দূর বাজার থেকে সেই ভারী বাজারের ব্যাগ বহন করে হেঁটে হেঁটে বাড়ি পৌঁছান। ঘরে তাঁর পাঁচটা মেয়ে একটাও ছেলে নেই। এমন কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র শিক্ষকের কাছ থেকে আর ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় না; তাই তার সব দোষ মনে মনে ক্ষমা করে দিয়ে ছফা ঢাকায় ফিরে যাবে এমন সময় পথে দেখা হয়ে গেল কবি আসাদ চৌধুরীর সাথে। আসাদ চৌধুরী তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে ঢুকেছেন শিক্ষক হিসেবে।

ছফাকে দেখেই তিনি খুশি হয়ে উঠলেন, আরে ছফা এখানে!

আসছিলাম একটা কাজে।

কি কাজ?

ওই মিন্নাত আলী সাহেব……।

এখন যাচ্ছ কোথায়?

এই দেখি ঢাকা ফিরব ভাবছি।

আরে এখনই ঢাকা যাবা কি, চল আমার সাথে, থাক এখানে দু’একদিন। মাশুকুর রহমান, মাহবুব-উল-করিম, মাখন-টাখন এরা সবাই আছেন তো এখানে এদের সাথে দেখা-টেখা কর।

ছফা আসাদ চৌধুরীর সাথে রিকশায় চেপে বসল। আসাদ চৌধুরীর ছোট্ট একলা সংসার। কাজিপাড়ায় এক উকিল সাহেবের ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করে থাকেন তিনি। মাঝে মাঝে তার মা-ও আসেন। ছেলের সঙ্গে থাকেন কিছুদিন।

আসাদ ভাইকে সে বরাবরই পছন্দ করে। তিনিও ছফাকে স্নেহ করেন। না করে উপায় নাই। ছফা এমন একটা ব্যক্তিত্ব যে লোকে তাকে পছন্দ করুক আর না করুক মনোযোগী তার প্রতি হতেই হবে।

বিকেলে তিতাস সাহিত্য পরিষদের অফিসের আড্ডায় পৌঁছলে, মাশুকুর রহমান চৌধুরী, আতিকুল ইসলাম খোকন, জাহাঙ্গীর কবির খান, মুহম্মদ সিরাজ, আব্দুল খালেক, আব্দুর রহিম এরা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। তিতাস সাহিত্য পরিষদের এবার একটা কুলকিনারা হবে ভেবে মুহম্মদ মুসা, অমূল্য সরকার এঁরাও আশাবাদী হয়ে উঠলেন।

ছফাও এঁদের পেয়ে মেতে উঠল। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় সে একরকম ইস্তফা দিয়েছে তাই ঢাকায় ফেরার কোনো টান অনুভব করছে না। এখানে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই থেকে যাবে মনস্থির করল। তার থাকাথাকিরও কোনো স্টেশন নেই। এরই মধ্যে সে তার পার্টির লোকদেরও পেয়ে গেল। কিছুদিন আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে থাকে তো কিছুদিন ওদের সাথে। তবে আসাদ চৌধুরীর ওপরেই উৎপাতটা বেশি। তাকেই সে লোকাল গার্জিয়ান হিসেবে মেনে নিয়েছে। কবি সাহেবকে সে ডাকে পিতাজি। ছফা কখনো গোছানো বা হিসেবি ধরনের মানুষ না। সে স্বভাব বোহেমিয়ান তারপরও কবি সাহেবের সাথে তার সংসার বেশ জমে উঠেছে। ছফা এমনই, তার নিজের ঘর পরের ঘর এমন কোনো বাছবিচার নেই। যেখানে যখন যায় সেটাকেই সে নিজের করে নেয়। তাই সে কবি সাহেবের বিছানা গুছিয়ে রাখে, টেবিল গুছিয়ে রাখে, আবার তার খরচের হাতও তো দারুণ তাই সে মাঝে মাঝে মুদি দোকানে, লন্ড্রির দোকানে বাকি ফেলে। সেই টাকাও কবি সাহেবই শোধ করেন। তারপরও সাথী হিসেবে ছফা অসাধারণ! তার উৎপাতে তিনি বিরক্ত হন না। বরং কলেজের লাইব্রেরী থেকে তার জন্য প্রতিদিন বই নিয়ে আসেন। তবে সমস্যা হয় এক জায়গায়। কোনো কোনোদিন কলেজে যাওয়ার আগে গোসল করে ঘরে এসে দেখেন ধোপাফেরত ধোয়া পাজামা-পাঞ্জাবী উধাও। অগত্যা তাকে ময়লা কাপড় পরেই ছুটতে হয় কলেজে। পরে দেখতে পান তার পাজামী-পাঞ্জাবী রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার মধ্যে ঢুকে বসে আছে ছফা। ছফার এইসব ছোটখাটো উৎপাত লেগেই আছে। তার মধ্যে একটা শিশুসুলভ ভাব আছে, যে কারণে তার আচার-আচরণে অতিষ্ঠ হওয়া যায় কিন্তু তাকে মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলা যায় না।

ছফা কয়েকদিনের মধ্যেই সাহিত্যের আসর থেকে জুটে গেল তার রাজনৈতিক সতীর্থদের সাথে। তবে সতীর্থ বলতে সম্পূর্ণ নয়। পার্টি ততদিনে ভেঙ্গে গেছে। ছফা মস্কোপন্থী কমিউনিষ্ট। এদিকে এরা পিকিংপন্থী তারপরও কাজ তাদের সঙ্গে চলছে। যেমন ওখানে ছিল কৃষক-শ্রমিক ফ্রন্ট, মহিলা ফ্রন্ট, ওমেনসলীগ, কৃষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ মহিলা সমিতি এদের সঙ্গে সেও আছে লাবড়ার মতো মিলে মিশে। ছফা আর্টিস্টেটিক্যালি সত্যেন সেন, রণেশ দাসগুপ্ত এঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিন্তু এখানে চীনপন্থীদের সঙ্গে থাকতে হয়। তারপরও সে ভাবল এখানে থেকেই বিপ্লব করতে হবে। এর মধ্যে একবার মতিন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হলে তিনি বললেন, তোমরা ওখান থেকে কাজ কর, আমরা ঈশ্বরদী থেকে করছি।

কিন্তু মস্কোপন্থী হয়ে পিকিংপন্থীদের সাথে কাজ করা নিজেকে স’মিলে নিয়ে দু’টুকরো করার মতো অনুভূতি। সব কিছুতে মতদ্বৈততা। ওখানে ছফার কোনো সাপোর্ট নেই। কেউ তার মতামতকে সমর্থন করে না। উপরন্তু ওরা ঘুরিয়ে পেচিয়ে তাকে অপমান করতেও ছাড়ে না। তাকে দিয়ে এটা সেটা কাজ করায়। বড় নেতারা কেউ কেউ বাজার টাজারও করায়। ছফা এটা ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারে না।

মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় আসাদ চৌধুরীর আস্তানায় ছুটে যায়। ওটাইতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তখন পর্যন্ত তার স্থায়ী ঠিকানা!

কখনো মন-মেজাজ খারাপ দেখলে আসাদ ভাই জানতে চান, কি ব্যাপার ছফা? হালত তো ভাল ঠেকতেছে না।

না, আসাদ ভাই। যা করতে চাইতেছি। করতে পারতেছি না। ওরা ভাবে কি আমাকে! ফাঁক পাইলেই সূক্ষ্ন অপমান করে।

অপমান তো করবেই, একেতো আদর্শগত পার্থক্য তার ওপরে তোমার আছে কি যে তোমাকে ওরা রেসপেক্ট করবে? অনার্স পরীক্ষাটাও তো দিলা না।

ওই গৎবাঁধা পড়া পড়তে আমার ভাল লাগে না। আমি যেই আমার মতামত এ্যাপ্লাই করতে যাই শিক্ষকরা ক্ষেপে যান। তারা ভাবেন তাবৎ জ্ঞান তাঁরাই অর্জন করে বসে আছেন। তার ওপরে কথা চলবে না। গরুর মতো পড়া মুখস্ত করতে তো আর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই নাই।

কিন্তু তুমি যতই পণ্ডিতি দেখাও ছফা, সেই তো তারা সব পণ্ডিত আর তুমি হইলা গিয়া ইন্টারমিডিয়েট পাশ। বলার বেলায় লড়াইয়ের বেলায় ওদের ওপরে তো উঠতে পারবা না। উনাদের কথাই লোকে আগে শুনবে। সমাজে উনাদের গুরুত্বই বেশি।

তাহলে কী হবে? ওসব গুরুত্বের আমি গুষ্টি কিলাই।

তুমি মনে মনে গুষ্টি কিলাইতে পার। পিণ্ডিনাশ করতে পার কিন্তু প্রাকটিক্যালি? প্রাকটিক্যালি ইউ আর জিরো। এই যে দেখো- এখন এই একটু আগে তুমি মুখ ভার করে বসেছিলে।

কারণ কি?

কারণ কি?

তুমিই ভালো জানো কারণ কি। ওরা তোমাকে টেকনিক্যালি অপমান করছে। এমন টেকনিক্যাল অপমান তোমাকে বার বার হতে হবে। ট্রাই টু গেট আউট ফ্রম দিস।
বাট হাউ?

পড়, পরীক্ষা দাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় না বসো এখান থেকে পরীক্ষা দাও। প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষাটা দিয়ে দাও।

ছফা তাই করবে মনস্থির করল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল অন্যখানে সেই তার চিরাচরিত থাকা খাওয়ায় সমস্যা। আসাদ ভাইয়ের ওপর তো আর পার্মানেন্টলি অত্যাচার করা যায় না। আর এটা তার স্বভাবও নয়। তাই আবার অন্নের সংস্থানে বেরতে হবে।

সংস্থান একটা জুটেও গেল দু’এক দিনের ভেতরেই। ওখানেই এক বন্ধুর বাড়ি তার নিত্য যাতায়াত। তো একদিন তাদের বাড়িতে গিয়ে বারান্দায় বসেছে। ভেতরের ঘরে শোনে কেউ কোরান পড়ছেন। তবে উচ্চারণ ভুল। পড়ার রীতিটাও ভুল। ভুল শোনামাত্র সে হুট করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। দেখল তার বন্ধুর মা এই ভুলভাল উচ্চারণে কোরান পড়ার চেষ্টা করছেন। ছফা বলল, চাচী আপনি যে কোরান পড়ছেন এতো ভুল। এভাবে পড়লে তো আরো পাপ হবে।

ভুল পড়তেছি? ও আল্লাহ! তিনি সাথে সাথে ভয়ে আতঙ্কে ছোট হয়ে গেলেন।

এতে এতো ভয় পাওয়ার কী আছে?

পাপের ভয়।

পাপের এত্তো ভয়!

ভয় হবে না বাবা, তবলীগে যাইতেছি। সেখানে তো শুধু ভয়ের কথাই যেন বয়ান করে। সেই ভয় কাটাতে কোরান পড়তে বসেছি এখন তুমি দেখাও আরো পাপের ভয়। না পড়লে পাপ, ভুল পড়লে পাপ। এখন করি কি!

আরবী ভাষার অর্থ জানেন?

না।

তো না জেনে পড়ে যাওয়ার মধ্যে মাহাত্ম্যটাই বা কি আছে?

জেনে পড়া আর ভুল পড়াতো একই হলো।

এখন এই বুড়া বয়সে ভুল-শুধরাইতে যাব কোথায়। এই বয়সে কোরান শেখার জন্য একজন মৌলবী ডেকে আনব। তাও কি সম্ভব!
সম্ভব না হয় মৌলভীর কাজটা আমি করে দিতে পারি।

তুমি?

হ্যাঁ, আমি তো শুদ্ধটা জানি। কিছু ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যাও জানি, আপনি আমার কাছে শিখতে পারেন পড়াটা। তাতে নিশ্চয়ই আপনার সম্মান যাবে না।

ও বাবা, বল কি, তুমি পড়াইলে তো আর কোনো চিন্তাই থাকে না।

তবে একটা শর্ত আছে।

আবার শর্ত কি?

বিনা পয়সায় পড়াতে পারব না।

বেতন নিতে চাও? সে কোথা থেকে দেব? নগদ পয়সা হাতে থাকে কই।

না ঠিক বেতন না। নগদ পয়সার দরকার নাই।

তাহলে?

আমি আপনাকে পড়াব। বিনিময়ে আপনি আমাকে খাওয়াবেন। পেটে ভাতে আর কি। গেরস্ত ঘরে নগদ টাকার অভাব থাকলেও খাওয়ার নিশ্চয়ই অভাব নাই।
না, তা নাই। তাহলে তো ভালই হয়।

আর একটা কথা। আমি যে আপনাকে কোরান পড়া শিখাই এটা যেমন কাউকে বলব না। ঠিক তেমনি আপনি যে আমাকে বিনা পয়সায় খাওয়ান এটাও কাউকে বলবেন না।

তাহলে কি বলব?

ইংরেজিতে একটা কথা আছে পেয়িং গেস্ট।

কি?

ও আপনি বুঝবেন না। যা খুশি তাই বইলেন।

কিন্তু শুধু দুবেলা খাবারই তো মনুষ্যজীবন চালানোর প্রধান উপাদান হতে পারে না আরো তো রয়েছে কত প্রয়োজন।

এরই মধ্যে ভর্তির ফরম ফিলআপের সময় এসে গেল সেজন্য ফিস্ জোগাড় করতে হবে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থেকে সেটা কিছুতেই সম্ভবপর ছিল না।

হঠাৎ করেই তার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। আসাদ চৌধুরী কলেজ লাইব্রেরী থেকে যে সব বই তাকে পড়বার জন্য এনে দিতেন তার মধ্যে একদিন রুশ ঔপন্যাসিক পি.লিডভের ‘তানিয়া’ পড়ে মনে হলো এই বইটা অনুবাদ করলে কেমন হয়! এবং সে অনুযায়ী দু’রাতের মধ্যে ‘তানিয়া’ উপন্যাসটা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে ফেলল। অনুবাদ কর্মের দু রাতের মধ্যে এক রাত ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর একরাত কমলাপুর রেলষ্টেশন। তাকে যত শীঘ্র সম্ভব টাকা জোগাড় করে নিয়ে ফিরতে হবে নইলে পরীক্ষা দেয়া হবে না।

রুশ বিপ্লবী কন্যা তানিয়াকে নিয়ে দিনের পর দিন হাঁটাহাঁটির পর মিলল ফিসের টাকা। প্রকাশকের কাছে অনুবাদ সাহিত্যের গুরু ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। নইলে যে লেখকের কোনো বই প্রকাশিত হয়নি তার পাণ্ডুলিপির জন্য টাকা পাওয়া সব কালেই দুর্লভ ঘটনা।

কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর স্থায়ীভাবে থাকা সম্ভব ছিল না কারণ সেখানে না না কাজ কর্মে জড়িয়ে গেলেও অর্থের সংস্থান কোনো জায়গাতেই ছিল না। তাই কিছুদিন পর পরই ঢাকায় ফেরা আর সেখানে দিনরাত ঘুরে ঘুরে চাকরি খোঁজাই ছফার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল।

কিন্তু চাকরি পাওয়াটা সহজ ছিল না কোনোভাবেই। এরই মধ্যে তখন ১৯৬৫ সাল ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ‘লাহোর শেল্ড’ খরবটি সংবাদ পত্রিকায় পড়ে পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সে ভাবল পাকিস্তানের পক্ষে কিছু একটা লিখতে হবে।

পরদিনই মোনায়েম খাঁর পত্রিকা ‘পয়গাম’ অফিসে গেল সে। ওখানে কাজ করতেন সৈয়দ আসাদুজ্জামান বাচ্চু। যাঁকে সে তাঁর জার্নালিজমের গুরু মনে করে।

পয়গাম অফিসে বাচ্চু ভাইয়ের সাথে একথা-সেকথা বলার পর এক পর্যায়ে বলল, একটা কাজ খুব দরকার বাচ্চু ভাই।

চাকরি ছফা, দেখছেন তো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে চাকরি… দেখি….।

ঠিক আছে, যুদ্ধ বিষয়ে একটা লেখা আনছি, এটা দেখেন।

ছফার লেখায় চোখ বোলাতে বোলাতে বাচ্চু ভাইর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। টেবিলে কলম ঠুকে বললেন, লেখাটা কিন্তু দারুণ হয়েছে। এটা আমাদের পোস্ট এডিটোরিয়ালে ছাপা হবে। আর আপনি আপাতত রোজ এসে এই কাজটাই করেন। অর্থাৎ তখন থেকেই এসিস্ট্যান্ট এডিটর হয়ে গেছে সে। বাংলাদেশের ইয়ংগেষ্ট এসিস্ট্যান্ট এডিটর। দুইটা লেখা যখন ছাপা হলো সবাই খুব তারিফ করতে লাগল। ছফা প্রতি সংখ্যাতেই গরম গরম কথা লিখতে লাগল, ‘কেন আমরা ব্যারাকপুর ভেঙ্গে দিচ্ছি না, হাওড়ার উপর বম্বিং করছি না। ইত্যাদি’।

তার পরের সংখ্যায় লেখার আগে সম্পাদক বললেন, আপনি রামায়ণ-মহাভারতের সমালোচনা করে লিখেন, ভারতবর্ষকে গালাগালি করে লিখেন।

ছফা মহা উৎসাহে রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত ধোলাই করে লিখতে লাগল। এভাবে একটা লেখা লেখার পর সম্পাদক সাহেব খুশি হয়ে তার সহকারীদের ডেকে বললেন, এই তরুণের লেখা এডিট করার কোনো দরকার নাই। সরাসরি প্রেসে দিলেই চলবে।

ছফার লেখা নির্জলা এক তরফা নিন্দা; ওই লেখা আবার বর্তমান সময়ের একজন প্রগতিশীল শিক্ষক পাঠ করে শোনান টিভিতে। কিন্তু ছফার হঠাৎ মত বদলাল, তাই তিনি তার পরবর্তী লেখায় লিখলেন, ‘‘সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার জার্মানি আর ইংল্যান্ড করে। কিন্তু জার্মানি কি কখনো শেক্সপীয়রকে বাদ দিতে বলেছে, গাল দিয়েছে? আবার ইংল্যান্ড কি কখনো গ্যেটেকে গাল দিয়েছে? শত্রু র সঙ্গে যুদ্ধ করা ভাল কিন্তু তার উজ্জ্বল সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে ক্রমাগত নিন্দা প্রচার এগুলো খারাপ কাজ।’’
তাঁর লেখা কেউ পড়ে দেখত না, এডিট করত না তাই লেখাটা যথারীতি ছাপা হয়ে গিয়েছে।

একে তো সরকারী পত্রিকা তার ওপরে এমন একটা উপসম্পাদকীয়। বুড়ো সম্পাদকের তো চাকরী যাওয়ার ঘন্টা বেজে গেছে। এখন প্রাণ রক্ষা পেলেই বাঁচোয়া। কম্পোজিটররা সব থরথর করে কাঁপছে। ছফার খোঁজে বের হয়েছে একদল লোক। তাকে এক্ষুনি অফিসে ধরে নিয়ে যেতে হবে।

কিন্তু যেহেতু তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না, তাই তাকে কোথায় পাওয়া যাবে!

দুপুর বেলা ছফা নিজেই অফিসে এলে, অফিসে ঢোকার মুখে কেউ একজন তাঁকে ভেতরের পরিস্থিতি জানালে সে ওখান থেকেই প্রাণ বাঁচিয়ে ছুটলো। কিন্তু যাবে কোথায়! সে যুদ্ধের মজা টের পেয়ে গেল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। গোয়েন্দা বিভাগের লোক তাকে খুঁজছে।

সারাদিন ঢাকা শহরের এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে এখানে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কিন্তু এমন একজনকেও পাওয়া গেল না যাকে এই মনের বেদনা খুলে বলা যায়। কেউ তার কথা বুঝতে চাইল না। বন্ধুবান্ধব যাদের আশ্রয়ে বিভিন্ন সময়ে ছিল তারা কেউ আশ্রয় দিতে রাজি হলো না। ছফার তখন ঘোর বিপদ। নিজেকে এমন অসহায় আর বন্ধুহীন তার কখনো মনে হয়নি। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর কোনো উপায়ান্তর না দেখে হঠাৎ মনে পড়ল বন্ধু রফিক সন্যামতের কথা। নারিন্দার গৌড়ী মঠের বিপরীত দিকে ৪৯ নম্বর বাড়িটা ওদের। আর ওই বাড়ির চিলেকোঠাটি হলো তখনকার তাবৎ ছন্নছাড়া লেখক, কবি, গায়ক আর রাজনৈতিক কর্মীদের স্থায়ী আড্ডাস্থল। যখন কারও কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকে না-তখন তারা গিয়ে হাজির হয় ওখানে। ছফাকে দেখেই রফিক বুঝতে পারল; আর বিনা বাক্যব্যয়ে থাকা শুরু হলো ওখানে। কিন্তু সারাদিন চিলেকোঠায় বসে বসে দিন আর কাটে না। ওদিকে রাস্তায় বের হবার কোনো উপায় নেই। কতক্ষণ একজন মানুষ এভাবে চিলেকোঠায় কাটিয়ে দিতে পারে! বিশেষ করে সৃষ্টিশীল একজন মানুষের পক্ষে এভাবে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকা অসম্ভব। মনের মধ্যে প্রচণ্ড অস্থিরতা। সারাক্ষণ মনে হয় যেন সে কুয়োর মধ্যে ডুবে গেছে বা শূন্য থেকে ঝুলছে। দাঁড়াবার মতো মাটি নেই কোথাও। অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে সময় কাটানোই একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এমন সময় তাকে পথ দেখালেন বার্ট্রান্ড রাসেল। অর্থাৎ বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘স্কেপটিক্যাল এসেস’ বইটা তার সঙ্গে ছিল। বইটা আসাদ চৌধুরী তার কলেজের লাইব্রেরী থেকে পড়ার জন্য ছফাকে তুলে দিয়েছিলেন। ছফা বইটা অসংখ্যবার পড়েছে। বইটা তার ভীষণ প্রিয় হয়ে গিয়েছে তাই সে ভাবল এই বইটা অনুবাদ করলে হয়! যেমন চিন্তা তেমন কাজ। সে বইয়ের প্রবন্ধগুলো অনুবাদের কাজে লেগে গেল। ঢাউস সাইজের একটা ডিকশনারি নিয়ে শুরু হলো অনুবাদ কর্ম। তবে কর্মটা খুব সহজ হয়নি কারণ ওই সময়ে তার কতটুকু আর ইংরেজি জ্ঞান। তাই প্রতিটি বাক্যেই তাকে ডিকশনারি খুঁজতে হচ্ছে। এক সময় দেখা গেল যে অনুবাদ কর্মটি কল্পনাতীত কষ্টসাধ্য ও শ্রমসাপেক্ষ হয়ে গেছে। তার পরও একটা বিশাল কাজ তো করা হয়েছে। একেই বলে আল্লাহ যা করেন ভালর জন্যেই করেন। `Sceptical Essays’ অনুবাদ করতে গিয়ে আর যে কাজটা হয়েছে সেটা হলো বার্ট্রান্ড রাসেলের সাথে পত্র যোগাযোগ হয়েছে। রাসেল তার দুটো চিঠির জবাব দিয়েছেন।

অনুবাদ কর্ম শেষ হতে হতে দেশের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলো। ছফা আবার বাইরে যাতায়াত শুরু করে দিয়েছে। তাই একদিন এই অনুবাদ কর্মটি নিয়ে ‘দৈনিক পাকিস্তানে’ গিয়ে হাজির হলো। দৈনিক পাকিস্তানের তখন সম্পাদক ছিলেন কবি আহসান হাবীব। তিনি আবার তরুণ কবিদের খুব পছন্দ করতেন তাই ছফার এই অনুবাদটি ছাপাতে রাজি হয়ে গেলেন।

কিন্তু বিপত্তি বাধল লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পর। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ ছিল আইয়ুব খানের পত্রিকা। তার ওপরে ছফা হলো অলরেডি সরকারের চোখে বিতর্কিত লেখক। তাই আহসান হাবিব খুব মনোযোগ দিয়ে এডিট করলেন তার লেখা। এমনিতে আহসান হাবিব এডিট করেন খুব যত্ন করে। কিন্তু লেখাটা ছাপা হওয়ার পরই ছফার মাথায় সেই রক্ত উঠে গেল। দেখা গেল বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রবন্ধের যে সব জায়গায় অটোক্র্যাটদের কথা আছে, ডিকটেটরদের কথা আছে সেগুলো তিনি কেটে বাদ দিয়েছেন।

ছফা সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে সরাসরি জানতে চাইল, আপনি এগুলো বাদ দিলেন যে!

আহসান হাবীব নির্বিকার গলায় বললেন, আমার পছন্দ হয়নি তাই বাদ দিয়েছি।

তার বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখার ওপরে আপনি আপনার মতামত এ্যাপ্লাই করতে পারেন না। বর্তমান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফিলোসফার। তাঁর লেখা বাদ দেয়ার অডাসিটি কি আপনার থাকা উচিৎ?

কি উচিৎ অনুচিৎ সেটা আমি বুঝব। তুমি না।

আপনি আবার কি বুঝবেন? আপনি তো আইয়ুব খানের গ্যাজেটের কেরানী। আপনার বোঝা না বোঝার ওপর কে ডিপেন্ড করে। বলে ওখান থেকে হন হন করে হেঁটে বাইরে চলে গেল সে। যেতে যেতে আর একটা চিন্তা তার মাথায় খেলে যায়। সে যদি এই আহসান হাবীব ভাইয়ের দরবারে রোজও যাওয়া আসা করতে থাকে, তার ওখানে যে লম্বা কিউ তাতে একটা লেখার পর আর একটা লেখা ছাপা হতে ছয়মাস এক বছর লেগে যাবে কিন্তু তার একটা বই বের করা বিশেষ করে পরীক্ষার ফিসের টাকা জোগাড় করাটা খুব জরুরী।

তাই সে রাসেলের স্কেপটিক্যাল এসেস বা সংশয়ী রচনাবলি নাম দেয়া অনুবাদ কর্মটির পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমীতে জমা দিয়ে দেয়। কিন্তু বাংলা একাডেমী একে ভুল অনুবাদ বলে প্রত্যাখ্যান করে। ছফা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসে। এবং পাণ্ডুলিপি আবারো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে যে এতে এমন কোনো ভুল নেই যাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়।(পাদটিকা: তাঁর এই বইটি পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়)।
বাংলা একাডেমী থেকে প্রত্যাখাত হয়ে ছফা বাংলা বাজারে প্রকাশক ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো প্রকাশক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ওদিকে সময়ও ভীষণ কম আছে হাতে। এ বছর পরীক্ষার ফিস জমা না দিতে পারলে বিএ পরীক্ষাটা আর দেয়া হবে না। ছফা মন খারাপ করে পাণ্ডুলিপি নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তার এই অবস্থা দেখে বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ বলল, ছফা মফিজ চৌধুরির কাছে যাও। দেখ উনি উনার পত্রিকার জন্য তোমার ম্যানুস্ক্রিপ্টটা নিতে পারেন। টাকাপয়সাও কিছু পেতে পার, উনি আবার নতুন লেখকদের এনকারেজ করেন নানা ভাবে।

কিন্তু মফিজ চৌধুরী কে?

ওই যে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। সাইকেলের ইন্ডাস্ট্রি আছে।

ঠিক ভরসা পাচ্ছিল না ছফা। ওখানে গেলে আদৌ কোনো কাজ হবে কি না! তারপরও বন্ধুদের কথা একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না। তাই একদিন সে ঠিকানা ধরে ধরে গিয়ে পৌঁছল মফিজ চৌধুরীর অফিসে।

জিপিও’র অপজিটে তাঁর বিশাল অফিস। ছফা এই প্রথম বুঝতে পারল শিল্পপতিদের সাথে দেখা করা খুব সহজ কাজ না। ওনার সাথে দেখা করার জন্য তাকে কয়েক দফা ইন্টারভিউ দিতে হলো। অতঃপর ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে থাকতে হলো দীর্ঘক্ষণ। দীর্ঘ অপেক্ষায় ছফার প্রায় ঘুম এসে যাচ্ছিল। একবার ভাবল চলে যায়। কিন্তু এভাবে হাল ছাড়লে তো চলবে না। শুধু পরীক্ষার চিন্তা থাকলেও না হয় একটা কথা ছিল সাথে থাকা খাওয়ার চিন্তা। একটা কিছু উপায় তো বের করতে হবে। তাই হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। একটা সিগারেট খেতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু সিগারেট খেতে বাইরে গেলে ঠিক ওই সময়ে যদি তার ডাক পড়ে। এমনিতে তো ওঘরের লালবাত্তি নিভছেই না। ভদ্রলোক এতক্ষণ ধরে কী মিটিং করছেন কে জানে! এভাবে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ছফা প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল এমন সময় ডাক পড়ল তার।
একটা বড় ঘরে বিশাল একটা টেবিলের ওপাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন মফিজ চৌধুরী সাহেব। ছফা তার হাতে ম্যানুস্ক্রিপ্টটা দিলে তিনি ওখানে চোখ রেখে বললেন, আহমদ ছফা সাহেব কে?

জী আমি।

তুমি? তুমি তৈরী করেছ এই ম্যানুস্ক্রিপ্ট! বয়স কত তোমার?

কেন, এর সাথে বয়সের সম্পর্ক কি?

তোমার বয়সী একটা ছেলে, এ ধরনের একটা প্রবন্ধের বই অনুবাদ করেছে আমাকে এই কথা বিশ্বাস করতে বল?

আপনি বিশ্বাস করেন আর না করেন আমি এটা করেছি।

কেন?

ইচ্ছে হয়েছে। বইটা পড়ে ভাল লেগেছে, মনে হয়েছে রাসেলের এসব দর্শন এদেশের মধ্যবিত্তের জানা উচিৎ তাই।

মফিজ চৌধুরী এবার একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আস্তে আস্তে বললেন, আমার তো মনে হচ্ছে লেখাটা তুমি কোনো জায়গা থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছ।

অন্য কোনো সময় হলে ছফার মাথায় রক্ত চড়ে যেত। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে এবার চড়ল না। তবে সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,আপনারা সব বুর্জোয়া এক রকম।

কী রকম?

সন্দেহ বাতিক, ধান্দাবাজ।

এটাকি শুধু এদেশের জন্য প্রযোজ্য?

আমি সব দেশের কথা বলছি। সারা পৃথিবীর বুর্জোয়া।

রাসেল এ প্রসঙ্গে কী বলেছেন?

রাসেল এ প্রসঙ্গে কী বলেছেন সে পরীক্ষা আমি আপনার কাছে দেব না। রাসেল উন্নত সমাজ ও জীবন গড়তে কি বলেছেন সেটা শুনুন। ‘‘বুদ্ধিবৃত্তিক ও মৌলিক সৃষ্টির পথে অন্যান্য কোনো বাধা থাকবে না। মানুষে মানুষে গঠনমূলক সম্বন্ধের মধ্যে এবং যে পথে মানুষের উন্নতি হতে পারে তার প্রতিকূল কোনো প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই থাকবে না। যদি সমস্ত ব্যবস্থা এমন হয়ে যায় এবং শিক্ষা ব্যবস্থা যথার্থ হয়ে থাকে তবেই একটা সিরিয়াস ও উত্তেজনাপূর্ণ জীবন যাপন করার অবকাশ যারা অনুভব করেন তারা সেটা অর্জন করতে পারবেন। জীবনে শ্রেষ্ট দোষগুলোকে পরিহার করে যদি সমাজ গঠন করা যায় তবেই সেটা টিকে থাকবে।’’

কথা শেষ হতেই ছফা তার স্বভাবসুলভভাবে হনহন করে হেঁটে বের হয়ে আসে ওখান থেকে।

কি ভেবে মফিজ চৌধুরীও বের হন তার পিছু পিছু।

শোন!

ছফা ঘুরে দাঁড়ায়।

এভাবে কথা শেষ না করে চলে যাচ্ছ কেন? ওঠো আমার সাথে গাড়িতে ওঠো।

অন্য সময় হলে হয়ত ছফা গাড়িতে উঠত না। কিন্তু এখন সে অনেকটা নিরুপায় তাই এই লোকটার কথার অবাধ্য হলো না।

ছফা গাড়িতে উঠে মফিজ চৌধুরীর পাশে বসল। তার কান থেকে তখনো আগুন বের হচ্ছে। তবে তার তেজ কম।

চৌধুরী সাহেবকে এভাবে হুট করে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে দেখে তার অফিসের ক্যাশিয়ার এক তাড়া টাকা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ধরলেন তাঁকে। স্যার চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

পেমেন্টের টাকাটা যে নিতে চেয়েছিলেন।

এনেছো?

জী স্যার।

দাও। তিনি বসা অবস্থাতেই টাকাগুলো পকেটে ঢোকালেন এক তাড়া একশো টাকার নোট।

ছফা ভাবল, এই লোকগুলো এতো টাকা এভাবে তাচ্ছিল্যভরে সাথে নিয়ে ঘোরে আর সে টাকার অভাবে খেতে পায় না, পরীক্ষা দিতে পারে না।

গাড়ীটা গিয়ে এক সময় থামল মফিজ চৌধুরীর ইন্দিরা রোডের বাড়ির সামনে।

মফিজ চৌধুরী সাহেব গাড়ি থেকে নেমে ছফাকে বললেন, কই আসো!

ছফা তার ম্যানুস্ক্রিপ্টটা গাড়িতে রেখে বের হয়ে এলো, এবং কোনো রকম সময় না নিয়েই চৌধুরীর সাহেবের পকেট থেকে উঁকি মারতে থাকা টাকার বাণ্ডিলটা দ্রুত তুলে নিয়ে বলল, আমার ম্যানুস্ক্রিপ্টটা জমা রইল। আমি টাকাটা নিয়ে যাচ্ছি। বলে ছফা দ্রুত হাঁটা ধরল।

আরে, আরে যাচ্ছ কোথায়? এদিকে এসো, পেছন থেকে প্রায় ছুটে এলেন মফিজ চৌধুরী।

না। এখন আসা সম্ভব না। বলে সে যথা সম্ভব দূরে গিয়ে দাঁড়াল যাতে পিস্তলের রেঞ্জের মধ্যে না পড়তে হয় তাকে। সে শুনেছে ধনী লোকেদের কাছে সব সময় পিস্তল থাকে। তাই এই দূরত্ব।

আরে শোনোই না, আমি তোমাকে কিছু বলব না। কাছে আসো।

না, আমি ওখানে ম্যানুস্ক্রিপ্টটা রেখেছি ওটার দাম দশ হাজার টাকা। আমি আপনার টাকা হাইজ্যাক করছি না।
কিন্তু, তোমাকে একটা কথা শুনতে বলছি সেটা শুনছো না কেন?

কি শুনব, আপনাকে তো বলেছি বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।

তুমি বলেছ, কিন্তু সেটা আমি মেনেছি সে কথা কি বলেছি?

গেটের কাছে দাড়িয়ে স্বামীকে এভাবে জোরে জোরে করে কারো সাথে কথা বলতে শোনেন নি এর আগে বেগম চৌধুরী। কার সাথে কথা বলছে মানুষটা? কাকে এভাবে মানানোর চেষ্টা করছে? সেই কৌতূহলবসে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। দেখলেন, রোগা মতন একটা তরুণ বয়সী ছেলেকে ডেকে কাছে আনতে চাইছেন তিনি। কিন্তু ছেলেটা দূরে দূরে ভাগছে। কিছু একটা যে অঘটন ঘটেছে বুঝতে পারলেন মিসেস চৌধুরী।

তিনি গেটের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে বললেন, এসো কোনো ভয় নেই বাবা। উনি তোমাকে কিছু বলবেন না। ছফা তারপরও ঠিক ভরসা করতে পারছে না দেখে বললেন, এভাবে বাড়ির সামনে এসে ফিরে যাবে? আসো একবেলা খাওয়াই তোমাকে, তার পরে যাও। আমি কথা দিচ্ছি তোমার কিছু হবে না।

একথা শোনার পর ছফার বিশ্বাস হলো। সে গুটি গুটি পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।

সেদিন অনেক গল্প হলো উনাদের সাথে, খাওয়া দাওয়া হলো। কিন্তু টাকার ব্যাপারে তাঁরা কিছু বললেন না, চাইলেনও না, ও প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন যেন কিছু হয় নাই।
ছফা মনে মনে ভাবল পরীক্ষা দেয়ার পর টাকাটা সে ফেরত দিয়ে যাবে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top