ধা রা বা হি ক আ ত্ম জী ব নী: মায়াপারাবার (পর্ব-৫)

পর্ব-১।। পর্ব-২।। পর্ব-৩।। পর্ব-৪

পাপড়ি রহমান

ভুরুঙ্গির উদ্দাম আদি-নৃত্যকলা

আমার দিদির কাছে গ্রামের নানান বয়সী নারীরা এসে ভিড় জমাতো। তাদের কেউ কেউ দীন-দরিদ্র। কেউ কেউ পেশায় ভিক্ষুক। কেউ ঠিকে-ঝিয়ের কাজ করে। কেউ বা অনাথা বিধবা। কেউ আবার স্বামী পরিত্যক্তা। দিদি তাদের সাধ্যমত সাহায্য করতো। নিজের শাড়ি দিয়ে, টাকা-পয়সা দিয়ে। গাছের ফল-পাকুড় দিয়ে। নিদেন পক্ষে ঘরের চাউল দিয়ে। দেখা যেত কার বাড়িতে হয়তো সেদিন হাড়ি উনানে চড়ে নাই! কি করা– আমার দিদি তাকে সের খানেক চাউল দিয়ে দিল। এভাবেই খই, নাড়ু, মোয়া, ছাতু, বাতাসা, মুড়কি, বেল, জাম্বুরা, আম, জাম, ডেউয়া-তাবত কিছুই ছিল দিদির বিতরনের সামগ্রী। দিদির কাছে কেউ কিছু চেয়ে খালি হাতে ফিরে গেছে-এমন দেখা যায় নাই।

আমাদের বাড়িতে যারা নিয়মিত যাতায়াত করতো তাদের মধ্যে ছিল চণ্ডীবু, (চিকা-ছোরমানের মা), কুসুমবু, ফুঁজিবু, কেতকীবু, ব্যাঙ্গারমা, ভুরুঙ্গি, শুটকি, হারুর বউ, দইসারমা, আয়শাবু, আলমেরমা, শোভাআপা এরকম অনেক নাম। আমার দিদি তাদের বু ডাকতো। আম্মা-চাচীমারাও বু ডাকতো। আমরাও বু ডাকতাম। সে এক এলাহি কাণ্ড!
শুধু দিদি নয়, বাড়ির সকলের সাথেই এদের খুব ভাব-ভালবাসা ছিল। কেউ কেউ শুধাশুধিই (এমনি এমনিই) আমাদের বাড়িতে এসে বসে থাকতো। আর দিদির সাথে গল্পগুজব করতো।

বর্ষাকালে আমাদের বাড়িটাকে মনে হয় কোনো দ্বীপ। যে দ্বীপ কচ্ছপের মতো পিঠ ভাসিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বাড়ির চারপাশে জল ডুবুডুবু অবস্থা। শুধু আমাদের বাড়ি ও আঙিনার বিশাল অংশ জলহীন।

এ বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়ার পথও জলমগ্ন। তবে তা হাঁটু বা কোমর পানির বেশি নয়।  এই পানি ভেঙে (পেরিয়ে) যাওয়ার উদ্ভট একটা উপায় চালু ছিল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পানিতে নেমেই কাপড় উপরে উঠাতে শুরু করতো! এবং পানি যাতে কাপড়ের নাগাল না পায়, অই পর্যন্ত প্রায় সকলেই নিঃসংকোচে কাপড় তুলতো। পানি ভেঙে গন্তব্যে পৌছালে ধীরে ধীরে ফের পরনের কাপড় নিম্নে নামিয়ে দিত। এইসব দৃশ্য এতটাই সহজ ছিল যে, কেউ কিছুই মনে করতো না। এতে করে কারোরই কাপড় সিক্ত হতোনা। ফলে বাড়তি কাপড় না থাকলেও কাপড় শুস্ক থাকতো!

চণ্ডীবু, কেতকীবু, ভুরুঙ্গি, শুটকি এই কাপড় তুলে জল পারাপারে দুর্দান্ত পটু ছিল। বিশেষ করে ভুরুঙ্গি তার পরনের সায়া-শাড়ি দরকারের চাইতেও বেশিই উপরে উঠাতো!

ভুরুঙ্গি দেখতে কালো। দোহারা গড়ন। মুখটা লাবণ্যে ঢলঢল। তবে ভয়ানক রগচটা টাইপের ছিল। কেউ তাকে ঠাট্টা তামাশা করলেও মুহূর্তে ক্ষেপে উঠতো। অনেক সময় কেউ কিছু না বললেও। তা এই ভুরুঙ্গি একদিন ভয়ানক এক নৃত্য প্রদর্শন করলো-যাকে বলে আদিমনৃত্য।

সেদিনও বাইস্যা মাইস্যা দিন। আমাদের বাড়িটা কচ্ছপের মতো পিঠ জাগিয়ে আছে। আর বাড়ির চৌপাশেই খলবল জল। জল পেরিয়ে খানিক দূরে দূরে ছোট ছোট কুমিরের মতো ভেসে আছে আরও কয়খানা বাড়ি। আমাদের বাইরবাড়িতে জল উঠে নাই। ফলে আমরা খেলছি যথারীতি-হঠাৎ বাড়ির ভেতরে তীব্র হট্টগোল শুনে সবাই দৌড় দিলাম। দেখি সে এক অদ্ভুত দৃশ্য!

ভুরুঙ্গি কি কারণে যেন বেজায় খেপেছে! আর খেপে গিয়েই শুরু করেছে অশ্লীল-উদ্দাম নাচ! অবশ্য তার নাচের ধরণ একেবারে অপ্রচলিত!

ভুরুঙ্গি ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সারা উঠান ঘুরছে। আর লাফের সাথে তার পরনের সায়া-শাড়ী পাছার উপর উঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে! অর্থাৎ তার নাচের বিষয়বস্তু ‘পাছাপ্রদর্শন’!

বড়রা যা্রা কম বয়সি তারা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে! ভুরুঙ্গির এহেন নৃত্যে আমরা ছোটরা তো তাজ্জব! বিমূঢ় ও অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করবো এখন?-এই উভয় সংকটে ভ্যাবলার মতো বিপদে পতিত হলাম।

কারণ ভুরুঙ্গির আদিম-উদ্দাম-নৃত্য দেখার লোভ সামলাতে পারছি না; ফের দেখতেও লজ্জা পাচ্ছি!

বাড়িতে যারা পুরুষ ছিল তারা যে যার মতো মাথা নিচু করে রেখেছে!

কেউ কেউ সরে গেছে দূরে। কিন্তু ভুরুঙ্গি কিচ্ছুর তোয়াক্কা না করে নেচে চলেছে তো চলেছেই।

এদিকে দিদি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছে–

‘অই ভুরুঙ্গি-মরার শুঁকি থাম থাম। কি করতেছিস অ্যাঁ? বাড়িতে পোলাপাইন আছে না? বেবাকে তো নষ্ট হইয়া যাইতেছে!’

দিদির কথা পাত্তা না দিয়ে ভুরুঙ্গি তার নাচের গতি বাড়িয়ে দিল। অতঃপর সে পেছনের কাপড় মাথায় তুলে সারাবাড়িতে নাচতে লাগলো!

আম্মা-চাচীমারা তো হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাচ্ছে! এমন নাচ কি তারা কোনোদিন দেখেছে নাকি?

ঝাড়া বিশ মিনিট নাচার পর ভুরুঙ্গি বেরিয়ে গেল আমাদের বাড়ি থেকে। এবং পাছা উন্মুক্ত রেখে! পানিতে খলবল তুলে সে যেতে লাগলো অন্য কোনো বাড়ির উদ্দেশ্যে। একবাবের জন্যও সে পেছন ফিরে তাকালো না! তবে যতক্ষণ তাকে দেখা গেল এক মিনিটের জন্য সে পেছন ঢাকার কোনোরকম চেষ্টাই করে নাই!…

 

পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল

আমার বড়চাচীমা খাস্তগীর ইশকুলের তুখোড় ছাত্রী ছিলেন। প্রাইমারি ক্লাসে পড়তে পড়তে চাচাজানের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের পরও বই পড়ার প্রতি ছিল তার প্রবল ঝোঁক। এই তীব্র পড়ার নেশার জন্য তার মনোজগত অন্যভাবে তৈরি হয়! ফলে প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের জন্য তাকে ইশকুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি নির্ভর করতে হয় নাই! আমার নিজের জীবন বা লেখক জীবনের উপর বড়চাচীমার প্রভাব যথেষ্ঠ। আমার প্রতি তার যে অকৃত্রিম স্নেহ, তা অনেক সময় আমার আম্মার চাইতে কোনো অংশে কম নয়! বরং তা কখনো কখনো আম্মাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

বড়চাচীমার একটা আজন্ম শিক্ষিত মন ছিল বলে আমার ধারণা। কোথা থেকে তিনি এমন মুক্ত অন্তঃকরণ পেয়েছিলেন, তা আমার কাছে এখনো বিস্ময়! তিনি খুব গোছানো ও পরিপাটি ধরণের মানুষ ছিলেন। ঈশ্বর তাকে তেমন রূপ দেন নাই, কিন্তু তার রূপের ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছিলেন নানাবিধ গুন দিয়ে।

বাড়ির বড় বউ হিসাবে প্রতিদিনের রান্না তিনিই করতেন। তাও দুই বা এক পদ নয়, প্রায় ১৫/১৬ পদের তরকারি। তিনি কীভাবে পারতেন প্রতিদিন এত এত রান্না করতে কে জানে? তবে তার রান্নার যোগান দিত আম্মা/ফুপুরা না অন্য শরীকের দিদি/চাচীমারা।

রান্না-গোসল-খাওয়া শেষ হলে বিকেল বেলায় বড়চাচীমা নিজের যত্নে বসতেন। দীর্ঘ চুলের রাশিতে তেল মেখে বিনুনি করতেন। বিনুনি শেষ হলে মুখে,ঘাড়ে,গলায় তিব্বত কোহিনুর পাউডার মেখে ক্রুশকাটা বুনতে বসতেন। অথবা উলের গোল্লা নিয়ে সোয়েটার বানাতে বসতেন।

তিনি ছিলেন আমাদের সবার শিক্ষক। আমাদের ঘরের প্রায় সব বাচ্চার হাতেখড়ি হয়েছে তার হাতে। বড়চাচীমা নিজের তিন ছেলেকে পড়াতেন, ছোটকাকে পড়াতেন, আমাকে পড়াতেন। কখনো সখনো বড়ফুপুর ছেলেকেও পড়াতেন। আজ আমি সত্যি আশ্চর্য্য হই, কতোটা ধৈর্য্য থাকলে তিনি একই সংগে পাঁচ/ছয়জনকে পড়াতে পেরেছেন!

আমার তখনো হাতেখড়ি হয় নাই, বড়চাচীমার পড়ানোর কায়দা দেখি। শুনি। তিনি যখন বড়দের পড়ান আমি আশেপাশে ঘুরঘুর করি আর সবার পড়া আপন মনে পড়ি। মনে মনে ভাবি আমি কবে এদের সাথে পড়তে বসবো?

একদিন বিষ্যুদবার হাট থেকে ফিরে দাদাজান আমার হাতে একটা বই দিলেন। দিয়ে বললেন–

‘ বইনে শুন, এই বইডার নাম ‘শিশুশিক্ষা’। এখন থিক্যা তুমি রোজ সন্ধ্যায় বড়চাচীআম্মার কাছে এই বই নিয়া পড়তে বসবা, বুঝলা?’

আমি প্রচণ্ড খুশি ও আগ্রহ ভরে বইটা নিলাম। উল্টে-পাল্টে দেখি গোলাপী মলাটের একটা বই। খুব সরু আর ছোট্ট। বইটা থেকে কেমন যেন ঘ্রাণ বেরুচ্ছে। পরে বড় হয়ে জেনেছিলাম ওটা নতুন বইয়ের গন্ধ!

বই পেয়ে আমি কি আর তাকে ছাড়ি? সারাক্ষণ বুকের কাছে ধরে রাখি। আর অপেক্ষা করি কবে বড়চাচীমা আমাকে পড়াতে ডাকবেন। এবং তিনি একদিন ডাকলেন। শুরু হলো আমার প্রথম পাঠ। বইয়ের সাথে এলো পেন্সিল। চাচাজান সীতাকুণ্ড থেকে কিনে পাঠালেন টিনের শ্লেট। শ্লেট-পেন্সিলে শুরু হলো আমার লেখালেখি!

খুব দ্রুত আমি অক্ষর চিনে ফেললাম। আমার শিক্ষক আমাকে পড়া ধরলেই আমি পটাপট উত্তর বলে দিতাম। এজন্য বড়চাচীমা যে আমাকে কত শত চুমু খেয়েছেন! পড়া না পেরে কোনোদিন মার খেয়েছি আমার এমন মনে পড়ে না!

বড়চাচীমার পড়ানোর কায়দা ছিল অভিনব! একটা হারিকেনের চারপাশে আমরা গোল হয়ে পড়তে বসতাম। পর্যাপ্ত আলো যাতে থাকে সেজন্য প্রতিদিন হারিকেনের চিমনী ছাই-সাবান-পানি দিয়ে ভালো করে মাজা হতো।

বড়চাচীমা সংগে সবসময় দুইটা স্কেল রাখতেন। রাখতেন শ্লেট মুছার জন্য ভেজা ত্যানা। আর তার পানের বাটা। দুইটা স্কেল দুইরঙা-একটা মেরুণ আর অন্যটা অফ হোয়াইট। তবে বড়চাচীমা স্কেলকে বলতেন ‘দাগানি’। এই দাগানি দিয়ে তিনি শ্লেটে দাগ কেটে দিতেন। বলতেন–

‘অক্ষর যেন দাগের বাইরে না যায়। মনে থাকে যেন। দাগের বাইরে গেলে তোর লেখা কিন্তু ঢক পাবেনা।‘

তার মানে লেখায় ঢক থাকতে হবে! ঢক মানে সৌন্দর্য!

এই স্কেল দুইটার কথা আমার বিশেষভাবে মনে থাকার কারণ-যে পড়া না পারতো তাকেই স্কেলের বাড়ি খেতে হতো। এবং বাড়ি খেতে হতো হাতের তালুতে। আমার বড়চাচীমা টোলের পণ্ডিতদের চাইতেও কড়া ছিলেন। তার চক্ষু ফাঁকি দেয়া ভারি দুস্কর ছিল!

পড়তে বসলে মনে মনে পড়া নিষেধ ছিল। বড়চাচীমা রেগে বলতেন–

‘মনে মনে কি পড়া হয়? অ্যাঁ? জোরে পড়স না কেন? গলায় কি জোর নাই?’

মনে মনে পড়াকে তিনি ভাবতেন ফাঁকি দেয়া। ফাঁকির পড়া। রেগেমেগে স্কেলের বাড়ি লাগিয়ে বলতেন, ‘অই বিড়বিড় করে কি পড়িস? বিড়বিড়িয়ে কি সাপের মন্তর পড়িস?’

সাপের মন্ত্র যে কি জিনিস তা আজও আমার জানা হয় নাই! তবে জোরে জোরে পড়ার কারণেই কিনা ‘শিশুশিক্ষা’ শেষ করতে আমার বেশি টাইম লাগে নাই। অই বইয়ের প্রতিটা পাতা আমার মুখস্থ ছিল!

বইটা যতবার পড়তাম আমার মন আনন্দে ভরে উঠতো! বইটার শেষ পাতায় চমৎকার ছন্দোবদ্ধ লাইন ছিল–

পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল…

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top