সেলিম রেজা নিউটনের তিনটি কবিতা

শুভ  বিরহ

বিরহ শুভ হোক। আমাদেরকে নবজন্ম দিক। নতুন পাতার মতো কোমলসবুজ হোক বিরহের ব্যথা। যেমন ব্যথাকে জানি, না জেনে যা উপায় থাকে না, সে রকম করে যেন বিরহকে জানি। তার  চেয়ে বেশি নয়। বুদ্ধি দিয়ে নয়। বিরহ সহজ হোক শিশুর প্রশ্নের মতো। বিরহ স্বাভাবিক হোক পাখির ওড়ার মতো। বিরহ অবাধ হোক আগুনের মতো। দহনের আলো নিয়ে আমরা যেন নিজেরাই উজ্জ্বলতা হই। সহজ শবনম আর সুদূর সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করুক বিরহ।

বিরহ স্বচ্ছন্দ হোক। যখন আমরা সাঁতার কাটি, এবং যখন আমরা নিজের ভেতরে ডুবে যাই, বিরহ তখন আমাদের সাথে থাকুক। বিরহকে সাথে নিয়ে আমরা যেন কাজে বেরুতে পারি। আমাদের পথ আগলে না দাঁড়াক সে। আমরা যেন মুক্ত থাকি, আমরা যেন লগ্ন থাকি—বিরহলগনে। আমাদের আত্মাকে অক্ষম না-করুক বিরহ। আমরা প্রাণের মতো স্বাধীনতা নিয়েই জন্মেছি।

বিরহ বিরাট হোক। সীমাহীন হোক। আমাদেরকে ছোট করে না ফেলুক সে। অন্তত প্রেমের চেয়ে আমরা যেন ক্ষুদ্র না হই। বিরহকেও ছোট যেন না করি আমরা। আমরা যেন বিরহকে অপমান না করি।

বিরহ আত্মস্থ হোক। বিরহ আমাদের জন্য নির্ভার হোক। আমরা যেন বিরহের উপযুক্ত হই। আমাদের মাপমতো বিরহকে আমরা যেন কাটছাঁট না-করি কখনো। বিরহের মধুস্বাদ আমাদের জিভে যেন তিক্ত না ঠেকে। আমাদের জিহ্বা আর পাকস্থলী বিরহের যোগ্য হয়ে উঠুক। বিরহের বিষ যেন আমাদেরকে হত্যা না করে। আমরা যেন সে গরলে নীল হয়ে উঠি। বিরহতে আমরা যেন অভ্যস্ত না হই।

রাবি: ৫ই আগস্ট ২০১৩

 

অবলোকনের নিচে

মুগ্ধ পৃথিবী ফিরবে না আর, মিনাজেল উসিটেরন,
তবু থেকে যাবে অকারণ কত পিরিতি-দগ্ধ পীড়ন।
অদৃশ্যময় চিহ্ন তাহার সে ঠিক রাখবে লিখে
ব্যর্থ-ব্যাকুল ভালোবাসা দিয়ে মেখে।
তুমি কি চাখো নি সেই দাগ, সেই অন্তিম অনুরাগ?
আজও কেন ফের চেয়ে দেখ তাকে আনমনে অনিমিখে?

কত বার তার স্তব্ধ চাউনি, মৌনমুখর ধ্বনি
ব্যথার আড়ালে সে গেছে হুবহু এঁকে
কিছু না-চাওয়ার অপেক্ষা দিয়ে ঢেকে।
তুমি কি দেখ নি বিষাদ-বিলাসী উদাসীন মিছে-হাসি
পথের প্রান্তে শালিক-রঙের অচেনা পাখির চোখে?
অবলোকনের নিচেই কেঁদেছে আকুলতা-কানাকানি।

ফারাক মুছেছে দিবসের সাথে নিশির:
একলা রাতের হাহাকার-মোড়া হারমোনিকার বাঁশি
ভাঙায় নি ঘুম। নীরব-নিঝুম উপেক্ষা-আঁকা শশী
শাদা জোছনায় একা একা গেছে ভিজে।
কেউ তা দেখে নি। রাতের রাগিনী নিঃসীম ঠাটে বেজে
সেজেছে ভোরের শিশির।

বিগত কাল তো রেখে গেছে তার স্মৃতি।
আবছা আলোর চোখছলোছলো ঘোলাটে মেঘের গানে
অবধারিত সে বিফল বিকাল কে আজ ফিরিয়ে আনে?
সে কি ভুলে গেছে কার্তিক মাসে কুয়াশার উল্লাসে
মাধবীলতার মায়া দিয়ে ঘেরা সুদূর শোকের রাতি
কেড়ে নিয়ে গেছে সব স্বাদ, অনুভূতি?

রাবি: ৮ই মার্চ ২০১৩

 

ভূতের শহর

মাথার ভেতর ভূতের শহর আঁকা।
শহর ঘেঁটে প্রেতের আরাধনা:
সারা দিবস গালিগালাজ শেখা,
মধ্যরাতে টেপরেকর্ডার শোনা।

সন্দেহাতিগ বাতিক-মাথার বিকার
নিখিল নিম-অভিমানের দিনে
রিকশা চেপে শিখছিল গান দোকার
বৃষ্টিভেজা পাগলা হাওয়ার সিনে।

কোথায় কবে বৃষ্টি ছিল আঁধার–
আপেলবনে হাহাকারের হাওয়ায়
বাদলঘন বরিষণের ধাঁধা
বলছিল শ্লোক কাঁদনচাপা চাওয়ার।

মাথার-ভেতর-টেপরেকর্ডার রাতে
কান্নাট্র্যাকের রাত্রিকানা গীতি–
ননডিজিটাল লংপ্লেয়ারের পিঠে
আনকোরা-লাল আন্কাশহরস্মৃতি।

সেলিম রেজা নিউটন। রাবি: ১১ই আগস্ট ২০১৩ সকাল ৫টা

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top