গাছ আর ফল ধর্ম হোক ১


শিবলী সাদিক

নদীর কিনারে

নদীর কিনারে এসে চেতনা হারিয়ে যায়—
তীরদেশে ইতিহাস আর নিচে নিসর্গ বহতা,
চাইলেই বুঝি আমি সীমা পার হয়ে যেতে পারি।
তবে স্রোত কি আমাকে নেবে, আর আমি পাব
কোথা সার্কাসের তাঁবু, জানোয়ার, শহরের পার্ক,
যার গাছে চুলা জ্বলে, ক্ষুধার্ত উন্মাদ কিছু ঘিরে থাকে?
বাজারে ফলের রং দেখে দিন কাটানো যাবে কি?

ঘুড়ি কাটাকাটি দেখা ছাড়াও তো আরো কিছু করি,
হাঁসের পালক নিয়ে কারবারে নামা প্রায় ঠিকঠাক,
এসব কি হবে? আর আমার অন্য পরিচয়ও তো আছে,
জামাকাপড় পরি, নাটকের পাঠ সব জানি, তা দেখাব
আর কাকে? যদি জলে ধুয়ে যায় নাম, বর্ণপরিচয়, অন্য
তীরে কেউ আমাকে চিনবে? আর কাকে কীসব বলব?

নদীর স্বভাব তত ভালো নয়, স্নানরতা রূপসির রূপ
বয়ে স্রোত কত দেশান্তরে যায়। সেখানে মাছেরা
আবহমানের রূপ নিয়ে খেলা করে, সে মচ্ছবেরও
ভয় হয়। তবু সাধ হয় ইতিহাস হতে নেমে যাই
বর্ণ-পরিচয়হীন স্রোতে, যেখানে নৌকার গায়ে
মা-দুর্গার চোখ আঁকা। মাতৃসমা জলে যাই ফিরে।

 

এসো ফিরি

এসো যাই, হাত ধরে ডাকে চালতার ডাল, মাছ।
যাই ফিরে তার কাছে যার মেঘ বহনের কাজ,
যারা সদা মাথার উপরে সূর্য, পায়ের তলায় মাটি
রাখে, ধান বোনে, আহারের দ্রব্য হয়ে, আয়নায়
গানবাজনার দল এনে আমাদের সুস্থ, সুখী রাখে।
যাই আমের বাগানে যেখানে চড়ুই আর পাতা তর্ক
করে— বায়ু কার সাথে খেলা করে, শৈশবের দিন সব
সেখানে ধূলির মধ্যে পড়ে আছে, তার কাছে চলো মন।

নদীর কিনারে যত মাঠ আছে, তার কাছে চলো মন,
পশু আর পতঙ্গের ঋদ্ধ দেশে কিছুদিন ঘুরে আসা যাক।
নতুন ভাষায় এসো ভাবি সবকিছু বায়ুসেবনের পরে,
সভ্যতার সব ছেড়ে মাছ আর পাখিদের সাথে ভাগ করি,
যাই মেঘ আর বিদ্যুতের কাছে, ফের শুরু হতে সব শেখা
শুরু করি, সব অনুবাদ ভুলে পাতাদের কথা যত শুনি
আর কোনো মাঠে গিয়ে দেহ নিয়ে পুনরায় আজ ভাবি,
শস্য ও ভূমার কাছে জেনে নিই গত জীবনের কথা।

 

দেহ

দেহকে দমন করা এক অর্থে সভ্যতার ইতিহাস। রঙিন আপেল খেয়ে
নাকি পাপ শুরু হয়। আপেলবাগানে গেলে আজও খুব উত্তেজনা হয়।
তার লাল রং কামড়ে ধরে। আর দেহ খুব প্ররোচনা দেয়, বলে — এই
ফলে আর রঙে যত সুখ, শীৎকার, তা নাকি স্বর্গেও নাই!

মনে হয় প্রত্যহ আপেল খাই খুব করে আর গুজব ছড়াই। তাহলে হয়তো
একদিন সব জায়গায়, এমনকি তীর্থে আর চার্চে চাষ হবে আপেলের।
আর দেখা যাবে সেই বৃক্ষসভ্যতায় একজন নারী একজন পুরুষকে
বিনা সংকোচে দেহ হতে বের করে খেতে দিচ্ছে ফল। তাতে দেহ নিয়ে
কোনো শরম বা সংকোচ আর থাকবে না। পাপ ও অনুশোচনা কেন্দ্র করে
কোনো ধর্ম আর শাস্ত্র দেখা দেবে না, ফলবতী এক গাছের গোড়ায়
মানব-মানবী শুদ্ধতম প্রেমে মজে রবে আর গাছ আর ফল হবে শেষ ধর্ম।

ধুলাবালির ভেতরে সারা দিন লুকিয়ে থাকতে, জলাশয়ে ভেসে যেতে দেহ চাই।
একদিন শিশুকালে কত মোহময় দেহ ছিল। সরলতা দিয়ে শিশু জানে কী করে
নিমেষে গাছ আর মাছ হয়ে যাওয়া যায়। এক দেহ হতে অন্য দেহে যাতায়াত
তারা করে নেহাত খেলাধুলা করে। সহজেই তারা বাতাসকে বন্ধু ভাবে, ধুলাবালির
ভেতরে নেমে কত বন্ধু খুঁজে পায়। জলে তারা জাহাজ ভাসায়, কাগজের নৌকা
করে খেলাচ্ছলে সব সীমা পার হয়ে যায়। নিজের শিশুর কাছে এমন একটি নৌকা চাই।

কেন বৃষ্টি হয়, কারো জানা নেই, পদ্মপুকুরে চিরকালের বৃষ্টি পড়ে।
প্রতিবার বৃষ্টি শেষে আমি ভাবি এবার কুড়িয়ে আনি হাঁসের পালক।
হাঁসগুলো বিস্ময়ের মতো সাদা, আমার  শৈশবে দেখা হতো প্রায়ই,
তারা ছিল ব্যক্তিগত, তাদের পালকে আমি ঘুমাতাম, স্বপ্ন দেখতাম।
তখন আমার দেহ জলময়, জলে ভরা ছিল, যাকে পদ্মের পুকুর বলা যায়।
পালকের সাদা রঙে লোভ আজও খুব বেশি আছে,
বৃষ্টি হলে আজও হাহাকার জাগে।
হারানো দেহের কথা খুব মনে হয়, পদ্মপুকুরের রূপ মনে জাগে,
পালক কুড়িয়ে আনবার জন্য চিরকালের বৃষ্টিবাদলে বারবার ছুটে যাই।

মাঠ এলে দেহের ভেতরে বহু কথা শোনা যায়, গোপনে নদীর সাথে
যেসব আলাপ চলে, মেঘবাতাসের প্রীতিশব্দ শোনা যায়,
জানা যায় দেহ কেন ফল দেখে খুব উত্তেজনা বোধ করে—
যেন মাটি ভাগ করে এখনই সে নেমে যাবে বীজ হয়ে—
আর টের পাই প্রতি ফসলের চারা জানে কোন দিকে
কত দূরত্বের হতে সূর্য ঢেলে দেয় জীবনের দিকে আলো।

এই মাঠে কৃষক লক্ষ্মীর সাথে কথা বলে, চায় গম,
ফল চায়, সন্তানের হাতে দিতে চায় গরম ভাতের বাটি।
আর দেবী নিজে রাঙা রত্নবান হয়ে ধানের ফুর্তিতে মূর্ত।
তার বুক হতে ঝরে-পড়া শালিধান প্রাণপণে কুড়াও কৃষকপ্রাণ,
তারপর নত হও দশদিকে, দশটি মেঘের জলে ভিজে নৃত্য করো।

 

হাওয়া

আজ হাওয়া এমন অরণ্য পার হয়ে এল
যার গাছে পাতা নেই, শাখায় শাখায় জ্বলে বাতি;
এমন উপত্যকায় হয়ে এল যার বাড়িঘরগুলি
দানবের উপকথা হতে তৈরি, সারা দিন লোকে
মেঘে মেঘে তীর ছুঁড়ে যত জাদু আর যুদ্ধবিদ্যা শেখে।
সার্কাসে ভাঁড়ের মৃত্যু হয়ে, বাঘের রিংয়ে লাফ দিয়ে,
জলদস্যুদের স্বপ্ন নেড়ে, হাডুডু খেলার মাঠ পার হয়ে,
জলের প্রাণীকে এক ঝাপটায় শূন্যে বিস্ফোরণে ঠেলে,
বাজারের দরদাম, মেয়েদের গয়নার ঘ্রাণ নিয়ে,
জলের গভীরে ঘণ্টা আর শিকলের শব্দরাশি শুনে,
ফলের দোকানে লাভ-লোকসান ও সৌন্দর্য টুকে,
আজ হাওয়া বয়ে যায় শোভাবাগানের মধ্য দিয়ে
একটানা, সবিশেষ বিশেষত্ব সহকারে।

এই হাওয়া চাইলেই সব মৃত ঘণ্টাকে বাজিয়ে দিতে পারে,
সব গাছ দীর্ণ করে গানের পাখিকে বের করে আনতে পারে,
জলে কশাঘাত করে আগুনের ফোয়ারা ছোটাতে পারে,
প্রাচীন জাহাজ তুলে দিতে পারে আছড়ে ডাঙায়,
গুহাচিত্রের অশ্বকে পারবে জাগাতে নিমেষেই প্রাণবায়ু দিয়ে,
সমস্ত বৈঠার শব্দে পারে সব তছনছ করে দিতে মুহূর্তেই।
তার সব তেজ ধারণের জন্য এত স্থান আর পাত্র নেই,
তার সব স্মৃতি আঁকবার জন্য অরণ্যের এত পাতা নেই,
নিঃসঙ্গ নাবিকের স্মৃতির মতন তীব্র উতরোল সমুদ্রগুঞ্জনে।

আকারে ও নিরাকারে বয়ে যাও,
শ্যামনদীকূল হতে রাধিকার চুলে
মরুবালিকার রৌদ্রভরা রূপে
দূরের আতর রেখে যাও বয়ে,
অর্থ ও নিরর্থ নিয়ে গাছের ছায়ায়,
কাঠবিড়ালির অন্ধকারে খেলা করো
বালিকা বিদ্যালয়ের পেছনে রৌদ্রগাছে,
সিল্কের শাড়িতে, গয়নার গন্ধে, নাচে।

 

সভ্যতার বিরুদ্ধে

সভ্যতার গল্পের পাতায় বাস করি, তাতে লেখা
নগরের দেয়ালের অপর পাড়ে দানবের রাজ্য।
সত্য আর নাটকের কথাসব শাস্ত্রে, মন্ত্রে লেখা।
কবে গুহাচিত্র হতে বের হয়ে এই গল্পে ঢুকে যাই।
এখানে রোববারকে সবাই রোববার বলে জানে।
গাছ শব্দে সূর্য, মেঘ, উনপঞ্চাশ বায়ুর লীলা নাই।

বালকেরাই কেবল এখান হতে বের হতে পারে।
একটা কাঠের চাকা নিয়ে মুক্তক্রীড়ায় সহজে মাতে।
এই বৃত্তযানে করে গাছের রহস্যে, দানবের রাজ্যে,
ধূলির আড়তে তারা সারা দিন খেলে। মোহযানে
করে তারা ভালুক নাচের, বাঘের রিংয়ে ঢুকে যায়,
অজস্র মেয়েবন্ধুর হাত ছুঁয়ে ঘুড়িরাজ্যে ঘুরে আসে।
বাসনার এই বৃত্তযান মার্কস, মোহাম্মদ জানে নাই।

আমরা নদীর বাঁধ খুলে দিতে চাই। ভাষার দেয়াল
পার হয়ে বস্তু আর দেহ সম্মিলিত হোক। পুনর্বার
একটা নাচের মধ্যে মানুষ বাঁচুক— যেই নাচে
রংধনুর মতন উত্তাল দেহ সর্বব্যাপ্ত হয়।
একটা ছন্দের ঘোরে সব হোক, যেই ছন্দে নদী,
গাছপালা, তারাদল চলে, ধাত্রী বায়ু বয়।

দেহের কীর্তন করি। বইখাতা ফেলে আমি বনে
চলে যাব। চিত্রিত ঘোড়ার সাথে অয়দিপাউস খেলা
করে। শব্দের বিভ্রাটে তার দিন কাটে। খড়ের গাদায়
এক কাগজের চাঁদ এসে সহিসকে দাহ করে। আমি
হরিণের সাথে লাফাতে লাফাতে যাব ভাষা হতে দূরে।

 

ভ্রমণের কথা

এসো হে শিশুরা, যারা এইমাত্র পাতাদের রাজ্য হতে,
ফুলের রঙিন পাত্র হতে বের হয়ে এলে। জানি শুধু
খেলা করবার জন্য তোমরা উঠলে ঘুম হতে আজ।
আমি লাল একটা ঘুড়ির পিছে দৌড়ে এই নৃত্যময়
দেশে এসে বোধ হয় ঠিক করলাম, আগে এলে আরো
মজা হতো— সারা দিন রংধনু তাক করে শুধু মেঘে মেঘে
তির ছুড়ে যারপরনাই মজা করা যেত। আর দেরি নয়, এসো
আমরা সকলে বানাই যান, ফুল আর নানা লতাপাতা দিয়ে।
তারপর যারা আমাদের ডাকে— ডানায় আগুন, শিংওয়ালা—
মেঘরাজ্যে, পাহাড়চূড়ায় থাকে, আঁকার কাগজে শুধু ফোটে,
চকলেট আর টফি নিয়ে যাব সকলের কাছে।

সেই দেশে চল মন
যেখানে নদীর কিনারে পুরুষ, নারী দেখে
ভেসে-আসা সব বার্তা সুশীল, সুন্দর,
নদীস্রোত আর ইতিহাস একই ধারা।

একটা গাছের কাণ্ড বেয়ে সৌরলোকে পিঁপড়ারা যায়—
কেউ বাধা দেয় না, শিকারিরা পলাতক, খুনিরা বাদক।

বনের গভীরে এক কাঠের বাড়িতে থাকতে প্র বল ইচ্ছা হয়,
যেখানে কর্তব্য বলে কিছু নেই, পশুদের আনাগোনা দেখা ছাড়া;
আমার লেখার পাণ্ডুলিপি  জ্বেলে আগুন পোহাব শীতের সন্ধ্যায়,
সবুজ কবিতাগুলি তখন বনের অন্ধকারে জ্বলে উঠতে থাকবে,
তখন বাঘের চোখ মনে করে আমার দুঃখ সব পালাতেও পারে ।

 

শিকারিসমাজ

বনে গাছপালার ভেতর দিয়ে চলে
পাখির গানের মধ্য দিয়ে ঘুরে শেষে
কোনো এক শিকারি সমাজে পৌঁছে যাই।

জানতাম তারা সেই ভুবনের লোক
যেখানে সূর্যের সাথে পশুর ফারাক নেই,
সূর্য নেমে এসে বনে পশুর মুখোশ পরে
মানুষের সাথে খেলা করে খাদ্য হয়ে যেত।

এ-ও জানতাম মানুষ তখন শিশু ছিল।
শিশুরা তো সারাক্ষণ নাচের ঘোরেই থাকে—
নাচতে নাচতে তারা যে কখন মেঘ হয়ে যায়
আর মেঘ তো নাচের ঘোরে সর্বগামী হয়,
জানে না কখন একটা পাখায় রংধনু এঁকে দেয়,
জানে না কখন সাপের মাথার মণি ধুয়ে দেয়,
চিতার চামড়া আর হরিণের মুখশ্রী ভিজিয়ে দেয়,
ফলবান করে গাছ, জীবের আহার সংস্থান করে।

দেখলাম শিকারিসমাজে দেহ ছাড়া আর কোনো
কেন্দ্র নেই, তার ফলে বিভেদ, আড়াল নেই।
একটা গাছের দেহে মানুষ প্রত্যঙ্গ হয়ে বাঁচে—
এই দেহ পৃথিবীর, ঋতুর, পশুর, প্রাণধাত্রী বাতাসের।

***

এমন অরণ্যে ফুল কুড়ায়, যেখানে সব গাছ
কথা কয় বাতাসের সাথে আর রংধনু ফুটে ওঠে
বনের নির্জনতায় নীরবতার ভাষা হয়ে,
এমন বাদলে ভিজে যার মেঘে চরাচর ডাকে
আর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তার গাছের ছায়ায় মিশে,
পাতার কুটিরে বসে জলে দেখে হরিণের ছায়া,
নিসর্গের দেহে তারা হরিণমানুষ হয়ে বাঁচে।

 

সূর্যরথ

সূর্যে উড়ে যেতে সারা ছেলেবেলা মাঠে
কত লাল ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ে গেছি। সূর্যরথ
সব গাছপালার ভেতরে প্রত্যহ জ্বালানি রেখে যায়,
অদ্ভুত মদের গন্ধে আমার ওড়ার ইচ্ছা হয়।
ইচ্ছা হয় ফলবতী গাছের গোড়ায় বসে সূর্যমন্ত্র পড়ি।
ফুল, ফল তো উদয়, ডানা মেলা— উন্মাদনা।
পশ্চিম দেশের ফলে দেখা দেয় পুবের অপূর্ব স্বাদ।
পাখিদের গান, বৃষ্টি আর প্রতিবেশ হতে মাত্রাধিক স্নেহ পেয়ে
তবে বীজ হতে প্রাণ ডানা মেলে। রোদের উৎসবে, মোহে,
গানে আমি ডানা মেলে শুধু উড়তে চেয়েছি।

হাওয়া, আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চল গানের ভেতর দিয়ে,
যেন আমি ছুঁয়ে যাই যত মদকল, ডালিমের লাল,
রৌদ্র, বীজ আর উদয়গিরির সব মন্ত্র,
একবার ছুঁয়ে যাব যত বীজতলা আর বন-মর্মতল।

 

বন

বনের গভীরে গিয়ে সেই চোরাচালানির দেখা পাই।
বনরক্ষীদের নজর এড়িয়ে সদা অর্জুনের বন হতে
সুন্দরীর বনে পোকামাকড়ের সাথে, বন্যদের সাথে
অজস্র সুড়ঙ্গ পথে বয়ে নেয় মধু, রেণু, বীজ আরো
প্রাণবাহী নানা দ্রব্য, বনের ভেতরে আরো শত দেশ
দেশান্তরে সর্বদাই চলছে পাচার গুপ্ত দ্রব্য গাছ হতে গাছে,
ডাঙা হতে জলে, উদ্ভিদ ও অনুজীবের নানা জৈবচক্রে,
প্রাণ আর অপ্রাণের যোগাযোগের অবৈধ-বৈধ পথে,
চোরাপথে, সব জ্ঞাত সীমান্ত মাড়িয়ে এলাহি বাণিজ্যে
সারাক্ষণ যে মেতেছে, সে আমার ঈশ্বর, অজ্ঞানের লীলা!

 

গাছ ১

একটা গাছের ধনাত্মক ভুবনে কী কী জিনিস আছে?
আপেলগাছের বহুদূরে গোলাকার বৃত্ত টেনে দিতে
হবে। প্রথমেই সেই বৃত্তে প্রবেশ করবে হাওয়া, তার
পাখার আগুনে লাগে গাছের ইন্ধন। কোনো নামী বীর
দেখা দিয়ে দেহে বিদ্ধ যত তির খুলে গাছে ছুড়ে
দিতে পারে, তবেই না বিষ, দাহ নিভে সমাধিতে দেহ
শান্ত হবে। চিতাবাঘ রাতে উঠে আসতে পারে গাছ বেয়ে,
উল্কাপথে আকাশে জ্বলন্ত জানোয়ারদের কাছে চলে যেতে।
একটা ভায়োলিন বা অন্য বাদ্যযন্ত্র আসবেই, কাঠের গভীরে
সুর জন্ম নেয়, অরণ্যের স্কুলে প্রথম বর্ষের ছাত্ররাও জানে।

দড়ি হাতে অমর প্রেমিক ছুটে এসে ফিরে যাবে, গাছ তাকে
প্রেমের অভয়ারণ্যের কাহিনি বলবে। ঘরহারা কেউ কেউ
আসবে, তাদের ঘর দরকার, আর কিছু উন্মাদ আসবে,
আগুন আহার করে বাঁচে, বৃক্ষ ছাড়া এত আগুন কোথায়
আছে! লাল রঙের সাথে বিবাদ মিটিয়ে হলুদ আসবে,
আগুনে আগুনে কত কথা হয়, সৌন্দর্যের শিখা জ্বলে,
সুন্দরকে তাই আসতেই হবে। আহত হাতির ছানা
এসব দেখেই সেরে উঠবে, ইগলের পাখনা বাড়বে।
জন্মদিনের রঙিন বেলুন সব এদিকেই আসবে উড়ে।
এসবের পর আমার হারানো ঘুড়িটি আসতে পারে। তার
জন্য আজো ছন্দ ভুল হয়ে যায়, রাতে ঘুম আসে না।

 

গাছ ২

গাছকে আমার দেখা হয় নাই, তার তলে গিয়ে
কত পাতা আর ফল কুড়িয়ে, পাখির গান শোনে
সময় কাটছে, তার উদ্যানেই পথিক আতিথ্যে আছি।
তার অন্তর্গত সুর আর রূপ নাকি মহাজাগতিক, হায়
কত প্রাণী হেঁটে যায় গাছতলা দিয়ে আর লোভ নিয়ে
দেখে গাছে ঝুলে-থাকা সূর্যফল, আর আমিও তো এই
রূপ দেখে যাই দিন-রাত, কিন্তু বীজ আমাকে বলে না
জাগতিক রহস্যেরা কীভাবে পাতায়, ফুলে বারবার উঁকি
দেয় আর সব জীব আহার্যের টানে এসে কিছুটা রঙিন
হয়ে ফিরে যায় পাতাদের আলো দেখে, রঙের প্রপাত
ঝরা দেখে, কিছু গান নিয়ে সকলেই ফিরে। আয়ু দিয়ে,
বায়ু দিয়ে গাছ সবাইকে সবল রাখছে, এবার বসন্তে একা
আমি ছাপাখানা চাইছি, আমার লেখা কে ছাপছে আর?

প্রবাহের টানে পদ্ম খুলে কোনো দিন নানা সূত্র ভেসে
যেতে দেখি। আমি তো অঙ্ক জানি না, বীজগণিতের
জ্ঞান কম, তবু বুঝি কমপক্ষে কয়েক পাতার বেশি কিছু
প্রাণসূত্র নিয়ে জলে তরঙ্গ উঠেছে। হয়তো এসব একদিন
কেউ পাঠ করে নেবে, পাতার অক্ষর কেউ পড়ে নেবে।
নিরক্ষর হয়ে আমি পদ্মনালে করে কিছু সুধা টেনে নিই—
জল— প্রাণ-অপ্রাণের এই মহাপাত্র হতে, আর কিছু নয়।

 

পাতা

আত্মগোপনের জন্য পাতার ভুবনে যাই,
আবিষ্কার করি কত জটিলতা সেখানেও—
খাদ্যকণা নিয়ে কালো পিঁপড়ারা খুব ব্যস্ত,
মাকড়সা বুনছে জাল ঘন করে,
আটকালে বের হয়ে আসা যে হবে না,
ছোট পোকা সাবধান করে দেয়। কারো
ফুরসত কোনো নাই— পাতাদের কারখানা
সারাক্ষণ ব্যস্ত—কত রঙিন পদার্থ গাছ দাবি করে,
নানা ফুল, ফল দ্রুত বানাবার জন্য, আর এসব যে
পোকামাকড়, পাখির লালা আর রসনাকে
লক্ষ্য রেখে যাতে ছুটে আসে মৌমাছি, ভোমরা,
তার পিছে দোয়েল, কোয়েল, পিছে বড় জানোয়ার,
তির হাতে গুহাবাসী লোক। তার ফলে পাতাদের
দেশে উৎসব, হল্লা, নানা খেলাধুলা দেখে ভুলে যাই
কবে এলাম এখানে আর বেরোবই বা কী করে!

সব কথাই লিখিত ছিল, সত্য, মিথ্যা, সব অনুমান,
গাছের পাতায় ভিড় করেছিল সুদূর বর্ষার সব গান।
তারও আগে পৃথিবীতে ধোঁয়া আর আগুন সর্বত্র ছিল,
জীবে ও অজীবে রাগ ও বিরাগে কত সেতু বেঁধেছিল।
জলের নিচের মাছ, তারাদের নানা সংবাদসহ আমপাতা
সকাল থেকেই কাঁপছিল, পদ্মপাতা হারানো গানের খাতা,
নাড়া দিই গাছে, নড়ে সব মাছ, গূঢ় সম্পর্কের সব দিক—
কিছু প্রকাশিত, ঝরে পড়ে, মেঘে মেঘ রটে তারও অধিক।

 

নাবিক ও চাঁদ

চাঁদ আর নাবিকের যোগাযোগ নিয়ে কোনো
‘বাণিজ্য-বাসনা’ নামের পুস্তকে কিছু লেখা আছে,
কেউ লিখে গেছে সৈকতে বালিতে, হয়তো বাতিক
ছিল তার, মাঝরাতে ঘুম হতে উঠে সমুদ্রগর্জনে তার
দূর দেশে বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে গান মনে পড়ে যেত,
কোনো দেশে তার বাড়ি ছিল কেউ জানে না, অনেক আগে
এসব প্রায়ই হত, যখন ঢেউয়ে ভেসে আসত মুক্তার নানা গল্প,
কুমারীরা ঘুমের আগেই কত দেশে চাঁদ হয়ে জলে ভেসে যেত,
নাবিক হারাত পথ, জলকুমারীর গানে সারা রাত সমুদ্রে ঘুরত।

চাঁদ দেখলেই রাতে বাণিজ্যের কথা অনেক লিখতে ইচ্ছা হয়,
কিন্তু জলে হতে উঠে আসা বুদ্বুদ, রুপালি মাদকতা গ্রাস করে,
বালিতে সৈকতে ইতস্তত পড়ে থাকা কিছু নুড়ি কুড়িয়েই ভাবি
চাঁদের সকল কথা, ঢেউ সত্য, অন্য সব শুধু ক্ষয় আর ক্ষতি।

নাবিক এখনো আসে, আমরা বিস্ময়ে বলি, তুমি বুড়ো হও নাই,
হাঙর, ঢেউয়ের লবণ তোমাকে করেনি ক্ষয়, ঠিকঠাক আছ।
হেসে বলে, আমি যদি বুড়ো হই কে তোমাদের এনে দেবে
দূর দেশ হতে ফল, সমুদ্রঘোটক, আয়না জাদুর, যার এক দিক
দিয়ে ঢুকে চলে যাবে অন্য দেশে, অন্য অনেক রাজার ঘরে।
হাড়ের পতাকা নিয়ে আজো ঘুরি দূর সব দেশে যেখানে প্রবাল,
মুক্তা আছে, কিনে আনি চাঁদ, উপকূলে ঘরে ঘরে বালকের দল
আজো জামার ভেতরে নেমে কত ঝিনুক কুড়ায়, আমি আনি সব।

 

দুজন

আলপথে আমরা দুজনে ওত পেতে বসে আছি।
আমাদের মিল কম, তবু মাঝে মাঝে দেখা হয়,
ফলের নৌকায়, ঘাসফুলে, দাবাগ্নির পাশে, কোনো
জন্মদিনে আমরা দুজনে লাল বেলুনের জন্য হাত পাতি।

দেখা হলে কিছু বার্তা বিনিময়, কুশল জিজ্ঞাসা হয়—
একজন বলি দুজন—  বাজপাখি ছাড়া আর কাউকেই দেখছি না,
অন্যজন এসব সংকেত ঠিক বুঝে নেয়, তার কাছে নানা
খাতা আছে, তাতে পিঁপড়াদের ভাষা, নানা ধুলাবাক্য লেখা।
কখনো নদীর দুই পাড় হতে দুজনের কথা চালাচালি হয়।

আজ রৌদ্রলিপি নিয়ে দুজন প্রান্তরে বসে কথা বলি,
যে ভাবে কাকতাড়ুয়া শস্যের সহিত কথা বলে থাকে।
কথা শেষে একজন ঘরে ফিরে আসি আর অন্যজন
নেমে যায় শস্যের আড়ালে, খনিজেরা ডাকে,
নানা ভাষা শিখে নিতে ধুলাবালিদের স্কুলে যায়।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top