শিবলী সাদিক
নিসর্গ সিরিজ ১ ।। নিসর্গ সিরিজ ২
গাছকে লেখা চিঠি
আজো গাছ সম্বন্ধে তেমন করে কিছু বলা হয় নি, এমন কি জগদীশ বিজ্ঞানী গোপন করেছেন সেই সব কথা যা খুবই ব্যক্তিগত গোপনীয়, ঘুমপ্রবণ আয়নার সামনে বলে যায় সকলেই নিজস্ব ভাষায়। ব্যতিক্রম ইতিহাসে, ভূ-ভারতে শুধু একজন।
বহুদিন আগে এক রহস্যময় অশ্বচালক আত্মহত্যার গোলাপি নোট রেখে যায়, তাতে তার চিঠিপত্র– তালপাতায়, বিবর্ণ পশুচর্মে লেখা ( আজো ঝর্নায় অনুচ্চ তার মনোলগ শোনা যায় ) বিভিন্ন ভূগোলে, ধূসর সময়ে ছড়ানো-ছিটানো, তামাটে, পীতাভ, রক্তবর্ণ, দুর্লভ মণির মত স্বেদযুক্ত, সেইসব চিঠি যা সময়াভাবে গাছের নিকটে হয় নি মেইল করা, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কী ছিল সেসব পত্রে, তার জোর অনুসন্ধান এখনো চলছে গোপনীয়তার সাথে। গুজবটুকুই আমাদের একমাত্র আশা আর জ্ঞান। এটুকু নিশ্চিত জানা গেছে ভাষাবিজ্ঞানীদের এই পূর্বপুরম্নষ কখনো কথা বলতেন না, যা বলার মতো, তা গাছকে লিখে জানাতেন। ইতিহাসে এ ব্যাপারে অনেক প্রমাণ আছে, তবে এ বিষয়ে অন্যত্র সচিত্র আলোচনা করা দরকার।
তার জন্ম নিয়ে কিছু কিংবদন্তীর প্রচলন আছে। পাহাড়ে অনেক উন্মাদনিবাসে নিশুতি রাতে গোল হয়ে যারা গল্প করে, আর যারা মরম্নপ্রবণ অঞ্চলে উটের গলায় ছুরি বসিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করতে করতে আড্ডা মারে, তাদের প্রত্যেকে নিজস্ব জলবায়ু দ্বারা, আত্মহত্যার ঝোঁক, অনিদ্রারোগ ও রাহুকেতু দ্বারা প্রভাবিত। তাদের কথায় তথ্যের চেয়ে, নিরাসক্ত ভক্তির চাইতে, দীর্ঘনিশ্বাসের গোপন ছাপ আছে। তবু বলা যায় তিনি নক্ষত্রের নিচে জন্মেছিলেন, শৈশবে মথের নির্বাক প্রজাপতি হয়ে-ওঠা দেখে সৌন্দর্য ও ভাষার দুরতিক্রম্য নিরবতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তার নেশা আর পেশা হয়ে ওঠে নিরবতার রহস্যময় অনুসন্ধানে বিভিন্ন দেশে ঘোরা। দুর্গম অঞ্চলে যত পায়ের ছাপ পাওয়া যায়, বাইসনের অস্থির পাশে, গুহাচিত্রে, উল্কাদের অবশেষের পাশেই তার পদচিহ্ন বিজ্ঞানীদের আজ আর বিষ্মিত ও হতভম্ব করে না। তার পায়ের ছাপ থেকেই নৃতত্ত্বের সকল তর্কের শুরু।
তার যাত্রা ছিল মৌসুমী বায়ুর সমান্তরালে, অচেনা যাযাবর পাখিদের পিছে। এই জ্ঞান তার হয়েছিল যে, অনেক গ্রহ নক্ষত্র মানুষ কোনো দিন জানবে না, তবু তার নির্দেশে গহীন অরণ্যে পথ চলা যায়, না হলে দেশ-কালের ধারণা অমূলক। তাই তিনি অরণ্যচারী ছিলেন কি না সন্দেহ থেকেই যায়। যদিও গাছপালার ভাষা তিনি প্রায় আয়ত্ত করেছিলেন, তবু লোকালয় থেকে খুব বেশী দিন দূরে থাকতে পারতেন না, এইভাবে তিনি ইতিহাসের, লোকসমাজে অন্তর্গত হয়ে রইলেন। কাঠের জীবন্ত মূর্তি, যা ইনুইটদের সংস্কৃতির বাণিজ্য হিসেবে মিউজিয়ামে দেখা যায়, তার মধ্যে অন্তর্গত হয়ে রইলেন । তবু তার চিঠিগুলিই উলেস্নখ্য। যা উদ্ধারে আরো সতর্কতা দরকার। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আমাজনে, গাছদের কাছে চিঠি লেখা যেতে পারে। শোনা যায়, প্রতি বসনত্দেই তার কথাগুলো কোনো গোপন অরণ্যে ব্যক্ত হয়, হয়ে থাকে, স্বয়ং উৎপলকুমার বসু বনে এরকম সেলাই মেশিন দেখে প্রায়শঃ কবিতা লিখতেন।
তবু তো জানা দরকার নিশুতি রাতের বনে চাঁদ দেখে অভিভূত হয়ে কোন দ্রাঘিমারেখা ধরে তিনি হাঁটতেন, আর তার চারপাশে কোনো লোকালয় ছিল কি না, এশিয়া মাইনরে, আজটেকে সদ্য-আবিষ্কৃত হরফের সাথে, গিলগিমেশের সাথে তার দেখা হয়েছিল কি না। আহা, সেইসব বন এখন কি আর আছে! স্টক মার্কেটে আমাজনের শেয়ার বিক্রি হয়, শুধু কাঠ, কোটি ঘনফুট কাঠ আমাদের দরকার। তার চিঠিগুলি তবে কি আগামী দিনের জন্য জমা রইলো, যখন সবুজ ভাষায় নিরবতার চর্চা হবে ফের?
পদ্ম
(পুনর্লিখিত)
বিলের কাজল জলে ফুটে আছে সত্যপদ্ম–
চৌষট্টি পাপড়ি তার, কামে-রূপে থরথর কাঁপে,
মাটি থেকে ছেনে তুলে যত রূপ-তাপ-মোহ-মদ্য,
স্তরে স্তরে, শিলাস্তরে যত শৈলী, পাপড়িতে মাপে।
ভ্রমর দূরত্বে থেকে দেখে নেয় জলগর্ভ ধরে
কত কত রংধনু। তার কিছু রং পদ্মে ফোটে,
আর বাকি রং সব নীরবে অতলে যায় ঝরে।
রত্নলোভী মধুকর নগদের লোভে তবু ছোটে।
ফুলে শেষে যেই বসে, সৌন্দর্যের তাপে জ্বলে যায়।
রূপ ও তস্কর পরে পরস্পর গড়ে তোলে দ্বীপ
সেই দ্বীপে ছোটে আজ কবিতা আমার হায়,
তাপদগ্ধ, হাহাকার, পাখনায় মরণপ্রদীপ।
২
ও ভ্রমর, উড়িস না তুই আর পড়ন্ত বেলায়।
অল্প কিছু আগে আজ বিকেল সবটা আলো নিয়ে
পদ্মের শোভায় মরে গেছে,
সেই আলো গুল্মলতা, শ্যাওলায় জমে-থাকা
সব সস্তব্ধতার রং ধীরে ধীরে মেলে দিচ্ছে,
যেখানে আকাশ চুপচাপ, মজ্জমান, ধ্যানমগ্ন;
ডানা থেকে নিভিয়ে ফেলছে সকল বিস্ময়,
পাখি আর পতঙ্গের ক্ষোভ, বৃষ্টি আর কোলাহল।
বিশ্বের আগুন রঙে শমিত, নিভেছে মুখরতা,
নম্র জলজের রূপে সব বাক্য চুপচাপ_
জন্ম-মৃত্যু স্তব্ধ আজ।
ও ভ্রমর, উড়িস না তুই অবেলায়।
৩
সংকেতই মুখ্য বলে মানি, কেননা ভ্রমর তাই,
জলের সংকেত নিয়ে শূন্যতায় উড়ে যায়।
ফলে গাঢ় জল, বিলের ক্যানভাসে পদ্মের শোভা,
আসন্ন সন্ধ্যার ডানা_ সব বার্তাময়, রঙের সংকেত
অতল কুহক থেকে, যাদুর চেরাগ থেকে উঠে আসে।
ক্যানভাস জুড়ে বস্তু বর্ণলিপি ফর্মের কোলাজ সংগীতময়তা
ভ্রমরের মগ্ন গান; স্বরলিপি মৃণালশিকড়ে তবু গুহ্য থেকে যায়।
৫
সূর্য ডুবে গিয়ে জাগে দৃশ্য-অদৃশ্যের বোধ।
এখন জলের তলে সূর্য জ্বলে, অতল পুড়ছে।
অতটা আগুন ছাড়া রং জ্বালাতে কে পারে!
গোধূলিবেলায় তাই পৃথিবী সমগ্রতার থেকে জলে
মেলে দেয় একে একে রং-ময়ূরের ডানাগুলো,
যা দিগন্ত পার হয়ে অপার জলের দিকে ভাসে।
তাই এই বিল, যাতে আকাশের ক্যানভাস জ্বলে,
রঙের ময়ূর জ্বলে, আর জলতরঙ্গের ‘পরে
দেশ-কাল ডুবে ভাসে, তার রক্তে যদি আজ
ডুবে মরি, আমার মরণ তুমি পদ্মের ওপরে দিয়ো জ্বেলে।
৬
পদ্মের নিকটে পেঁৗছা জীবনে সম্ভব নয়,
সৌন্দর্যের কাছে শুধু মৃত্যুর পরেই পেঁৗছা যায়,
যেমন মৃত্যুর পরে রাজহাঁসের সৌন্দর্য বুঝা যায়_
জ্যোছনা রাতের জলে দেখা যায় সব হাঁস।
যত দিন বেঁচে আছি তত দিন শুধু হা-হুতাশ,
তত দিন অপেৰার পালা, কবে রাত হবে।
জগতের সব পদ্ম তখন লুকাবে কোথায়,
তখন তো আর কোনো ফাঁক নেই, ফাঁকি নেই
যত পদ্ম বিলে, জলে, ছায়াপথে ফোটে,
তার কাছে ঘর করে আমরা থাকব,
সৌন্দর্যের কাছে বসে দেখতে থাকব
জগৎ উন্মাদ হয়ে আকারে ইঙ্গিতে যত কথা বলে
তাই পদ্ম হয়ে বিলে, জলে, ছায়াপথে ফোটে,
আমরা পদ্মের ঘরে বসে জলে সব দেখে যাব।
নদী-৩
নদী দিয়ে কী বয়ে যায়, এই কথা কারে বলা যায়, কিভাবে সম্ভব বলা। সকাল বেলার নদী মাছের আঁশটে গন্ধ থেকে, তারাদের বাসি স্বপ্ন থেকে উঠে আসে। তাই অসম্ভব ঘোলা, সারা রাত মাছের সঙ্গম আর রম্য পদ্ম কথা বলে সব জল ঘোলা করে রাখে। রোদ যত ওঠে, তত দেখা যায় সেই সব স্বপ্ন ঢেউ তোলে কোথা ধায়। দুপুরে মাছরাঙার স্বপ্ন, হিজলের ডানা জলে ভাসে, কত কত জানালার আভা ঝিক ঝিক করে। এই স্বপ্নে কেউ নামে না_ দুগ্ধবতী সাদা মেঘ, দৰ জলদাস, সব সোনা, মণি-রত্ন নিমেষেই ভস্ম করে দিবে।
বিকেলের নদী ময়াল সাপের মত। চুপচাপ পড়ে থাকে। কোনো অনামা গ্রামের কাছে, ঝোঁপ-ঝাড়ের ফাঁকে। তার মনে বিষ। অথচ বাইরে শান্ত জল। এই জলে মাছ নেই, এক বিধবার বাড়ি যাবে। জগতের তাবৎ বিষ অহিংস হয়ে জলে খুবই বিষন্ন হয়ে থাকে।
সন্ধ্যায় চোরেরা ফিরে আসে। সারা রাত মাছ চুরি করে। যত মাছ ধরে, তত ছুটে যায়। চোরদের নৈশস্বপ্ন থেকে নদী বয়ে যায়। সারা রাত।