কামরুল হাসান: আরও কিছু মৃত্যু

কামরুল হাসান

যখন সে ছিল সুদূর চীনে আমরা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। এরপর ইরান তুরান পার হয়ে যখন সে হানা দিল রোম সাম্রাজ্যে, তখনো আমরা উদ্বেগহীন। ইউরোপকে পরাজিত করে সে অতলান্তিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে চলে গেল পরাক্রমশালী আমেরিকায়। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, যাক এ যাত্রা বোধকরি আমরা বেঁচে গেলাম। কিন্তু করোনা ড্রাগন যখন তার আগুনমুখ এশিয়ার দিকে ফেরাল, তখন আত্মসমর্পণ ছাড়া আমাদের গতি রইল না। তার লেজের আঘাতে বিধ্বস্ত হলো লাতিন আমেরিকা। প্রথমে তা ছিল এক…সাত… দশ। বহুদিন রইল কুড়ির নিচে। আমরা কেবল সংখ্যা দেখি, মানুষরা রইল অচেনা, অজ্ঞাত, ঐ চীনাদের মতো অচেনা, রোমানদের মতোই ভিনদেশী।

কিন্তু এখন করোনা এসে পড়েছে চেনা বৃত্তের ভেতর, পাশের দালান, আত্মীয় বাড়ি, বন্ধুর ঘরে। করোনা বহুদিন ধরেই আমাদের গৃহবন্দী করে রেখেছে, এখন যেন দরোজা ভাঙতে চাইছে। পৃথিবীর কোন কোণায় আর লুকানো যাচ্ছে না, সুতানালী সাপ হয়ে সে ঢুকে পড়ছে লৌহবাসরে। এই দৈত্যের খোলা তলোয়ারে কাটা পড়ছে প্রিয় মুখ, পরিচিত সুজন, ঘনিষ্ঠ কবি।

২৯ জুন সন্ধ্যায় ফেসবুক খুলেই বজ্রাহত। কবি তুষার গায়েনের স্ট্যাটাস ‘এই কি হ’ল সময় যাবার’। সঙ্গে দাউদ আল হাফিজের ছবি। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। এ যে বিনা মেঘে বজ্রপাত। দাউদকে চিনি তিন দশক ধরে। তার ভেতর একটা দুর্জ্ঞেয় রহস্য ছিল, যা ভেদ করা ছিল দুরূহ। কাউবয় হ্যাট পরা দাউদকে লাগতো ওয়েস্টার্ন মুভির নায়কদের মতো। সত্যি দেখার মতো ছিল তার চলাফেরা, তাকানোর ভঙ্গি। আমরা আড্ডা দিতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ক্লাবে, কবি ও অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের অতিথি হয়ে। দাউদ ছিল খোন্দকার আশরাফের সরাসরি ছাত্র ও তার ভক্ত। অনার্সে প্রথম শ্রেণি না পাওয়ায় সে এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে রাগে আর মাস্টার্স পড়েনি। নিজের ক্যারিয়ার নিজ হাতেই সে বিপর্যস্ত করল।

তার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল খোন্দকার আশরাফ সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘একবিংশ’ ঘিরে। আমরা দুজনেই একবিংশে লিখতাম, দুজনেই দুটি ভিন্ন সময়ে এর সহকারী সম্পাদক ছিলাম। কবিতার ব্যাপারে সে ছিল শুদ্ধাচারী, খুব বেশি কবিতা সে লেখেনি, কিন্তু যা লিখেছে তা মূল্যবান, কেননা নিজেকে পুনরাবৃত্তি করতে সে চায়নি। এক জীবন ধরে যা লিখেছিল তা থেকে বাছাই করে একটি কাব্য সে প্রকাশ করতে চেয়েছিল বহুদিন ধরে। সে অপেক্ষা ছিল দীর্ঘ, কেননা গাঁটের পয়সা খরচ করে সে বই প্রকাশ করতে চায়নি, সে পয়সাও তার ছিল না। যে মানুষটি ডাক্তার হয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করতে পারত, সাহিত্যকে ভালোবেসে সারাটা জীবন দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে গেল। দাউদের সাথে এই জায়গাটি আমার মিলে। আমিও তার মতো বোর্ডের মেধা তালিকায় নাম উঠিয়েছিলাম, তার মতোই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করিনি। আমি তবু দেড় বছর পড়েছিলাম, দাউদ একদিনও নয়।

জীবনটা তার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কেটেছে। এই শহরে সে বারংবার এসেছে কাজ ও আশ্রয়ের সন্ধানে, বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে শৈলকূপা, তার বাস্তুভিটায়। দিনের পর দিন ছাত্র পড়িয়ে সামান্য টাকায় কষ্টেসৃষ্টে চলেছে। শেষাবধি একটি ইংরেজি মাধ্যম কিন্ডারগার্টেন খুলেছিল। সেটাও তেমন চলেনি। ইংরেজি ভাষা ভালো জানতো বলে কিছু অর্থ, সামান্যই তা, উপার্জন করতো অনুবাদ করে। শুনেছি ‘শব্দঘর’ পত্রিকার ইংরেজি অংশটি তার অনুবাদেই বেরুত। দাউদ করোনাকালে মারা গেলেও সে কিন্তু করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেনি। জীবন যে দুঃসহ ভার ঠেলে দিয়েছিল, হৃদপিণ্ড তা বইতে পারেনি। তার মৃত্যু ঘটে হার্ট এ্যাটাকে।

এর পরেই ভেসে আসে সন্দেশ প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী লুৎফর রহমানের মৃত্যুর খবর। দুটোই অপ্রত্যাশিত, দুটিই বেদনার। শাহবাগ সংলগ্ন আজিজ মার্কেট যে ক্রমান্বয়ে একটি বইবাজারে পরিণত হলো, তার পেছনে যে কতিপয় প্রকাশকের নীরব অবদান রয়েছে, লুৎফর রহমান তাদের একজন। প্রথম বইয়ের দোকানটি খুলেছিল পাঠক সমাবেশের বিজু। দ্বিতীয় দোকানটি (সন্দেশ) খুলেছিলেন লুৎফর রহমান। একটা সময় ছিল আমি প্রায়শই আজিজে যেতাম, বিজু ও লুৎফর ভাইয়ের সাথে দেখা হতোই, কেননা তাদের দোকান দুটিই সমুখে। শুরু থেকেই তিনি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আমার সাথে দেখা হলে বলতেন, ‘কামরুল ভাই, একটা বই অনুবাদ করে দিন, আমি ছাপবো।’ অনুবাদ সময়ব্যাপ্ত ও শ্রমসাধ্য কাজ বলে আমি সেই উন্মুক্ত আহবান এড়িয়ে যেতাম। অতি সম্প্রতি আমি আমেরিকার বেস্টসেলার ঔপন্যাসিক মিচ আলবমের একটি উপন্যাস অনুবাদ শুরু করলে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন মুূদ্রণের। আমিও তাই চাইছিলাম, তাতে বহুকাল ধরে আমার কাছে তিনি যা প্রত্যাশা করছিলেন, তা পূর্ণ হতো। হায়, করোনা তাকে বাঁচতে দিল না।

প্রকাশক হিসেবে তিনি যেমন সৃজনশীল ছিলেন, তেমনি যুক্ত ছিলেন সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাথে। গতবছর আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সমিতি আয়োজিত একটি কর্মশালায় অতিথি বক্তা হয়ে বই প্রকাশে লেখকের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে। তখন জানতে পারি প্রকাশকদের দল বেঁধে বিভিন্ন বুক ফেয়ারে অংশগ্রহণের কথা। তিনি ছিলেন দলনেতা। সে সময়ে তারা পরিকল্পনা করছিলেন, ত্রিপুরা, আসাম, কলকাতা ও দিল্লী বুক ফেয়ারে পরপর যোগ দেবার, তার ভাষায় একইসঙ্গে ‘রথ দেখা ও কলা বেঁচা।’ বই ভালোবাসতেন, আর ভালোবাসতেন ভ্রমণ।

কাল সন্ধ্যায় এলো আরেকটি মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ। যে মানুষটি আড্ডাকে মাতিয়ে রাখতেন গল্পে আর কৌতুকে, যার ঠোঁট লাল হয়ে থাকতো পানের রসে, যিনি কথায় কথায় ছড়া কাটতে পারতেন, সেই প্রবল জনপ্রিয় ছড়াকার আলম তালুকদার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত, কারণ তিনি লকডাউন জীবনে ফেসবুকের অনলাইন সাহিত্য সভাগুলেতে সক্রিয় ছিলেন। বস্তুত মানুষ ঝরে পড়ছে হেমন্তের পাতার মতো। গত বছর আমরা কজন কবি তাঁরই গাড়িতে চড়ে টাঙ্গাইলে একটি সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। সারাপথ তিনি ভরে তুলেছিলেন।গল্পে আর কৌতুকে। দেশের বিশিষ্ট ছড়াকার হয়েও বাংলা একাডেমি পুরস্কার না পাওয়ায় একটা খেদ ছিল মনে। এখন তো তিনি সকল পুরস্কারের ঊর্ধ্বে।

আলম তালুকদার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্পেশাল বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে তিনি সরকারের প্রশাসনে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গিয়েছিলেন। তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল জাতীয় গ্রন্থাগার, তিনি ছিলেন এর প্রধান গ্রন্থগারিক, অনেকটা বোর্হেসের মতো। ছড়ার পাশাপাশি তিনি অনেক মজার, দমফাটানো হাসির গল্প লিখতেন। তার জীবন ছিল কৌতুকপ্রধান, হাস্যমুখর ও প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ। ফেসবুকে তার সাথে মাঝেমাঝেই আমার ছড়ার, ঠিক লড়াই নয়, ছড়ায় ছড়ায় ভাব বিনিময় হতো। অমন প্রাণপূর্ণ মানুষের বলা নেই, কওয়া নেই, চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। কষ্ট পাচ্ছি।

লেখাটি শেষ করবো কবিবন্ধু দাউদ আল হাফিজের কাব্য ‘আনাবাস কিংবা দ্বিধার গন্ধম’ থেকে দুলাইনের একটি কবিতা দিয়ে, যাতে বোঝা যায় তাঁর শক্তির ছটা।

“রবীন্দ্রনাথহীন আমাদের সমস্ত জীবন
বাইশে শ্রাবণ, বাইশে শ্রাবণ!’

 

কামরুল হাসান

 

 

 

 

 

 

 

কামরুল হাসান এর জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১, শরীয়তপুরে। তিনি মূলত কবি। অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ গদ্যকার হিসেবেও খ্যাত। আছে নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

ভারতের বিশ্বখ্যাত খড়গপুর আইআইটি থেকে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সমাপ্ত করেন। এছাড়াও স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যের ব্রাডফোর্ড ও এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কামরুল হাসান শিক্ষকতা করছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ।

কাম রুল হাসান দ”হাতে লেখেন। এ প র্যন্ত ১৪ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি ছোটগল্প, ১টি প্রবন্ধ, ৪ ভ্রমণ গ্রন্থ, ২ টি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া স মী র রা ইয় চৌ ধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে পোস্ট ম র্ডাণ বাংলা পোয়ে ট্রি ২০০৩ সম্পাদনা করেছেন।

[email protected]

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top