বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২১ একটি মাইলফলক। ১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রটির জন্ম, আগামী বছর সে দেশটির সুবর্ণজয়ন্তী। বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার ভেতর দিয়ে আমরা স্বাধীনতার লাল সূর্য্যকে ছিনিয়ে এনেছিলাম—১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে। সে বিজয় শুধু একটি ভূখণ্ডের বিজয় ছিল না; ছিল না শুধু একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় ছিল একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের। তারপর পঞ্চাশ বছরের একটি দীর্ঘ পথ পরিক্রমা বাংলাদেশের— সে পরিক্রমায় অর্জন আছে, ব্যর্থতা আছে; প্রত্যাশা ছিল, হতাশাও আছে; সঠিক পথে থেকেছি, বেপথু হয়েছি। ফিরে দেখাটা আজ তাই বড় প্রয়োজন।
স্বাধীনতার একটি অন্তর্নিহিত মাত্রিকতা আছে, কিন্তু স্বাধীনতা তো কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। বিজয়েরও একটি বহির্মাত্রা আছে, কিন্তু বিজয় তো অন্তস্থিত এক বোধেরও। সুতরাং বিজয় বা স্বাধীনতা শুধু উদযাপনের নয়, চেতনারও। এবং সে চেতনা ধারণ করতে হবে বর্ষব্যাপী, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে— যারা ১৯৭১ দেখেছি তাদের এবং যারা দেখেনি তাদেরও।
আমরা যারা বিজয় দেখেছি, তাদের একটি অংশ সেই চেতনাকে ধারণ করে রাখতে পেরেছি। কিন্ত সেই সঙ্গে এটাও তো সত্য, আমরা অনেকেই সেই চেতনা বিস্মৃত হয়েছি এবং আমাদের কেউ কেউ বেপথুও তো হয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখেছেন, কিন্তু স্বীকার করেননি, তাদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয়ের চেতনাকে আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী, তাদের জন্য নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আসলে পুরো প্রেক্ষাপট অনেক বেশি তাপর্যপূর্ণ আমাদের তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যারা বিজয় দেখেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে হয়তো একটি কল্পকাহিনী, বিজয় তাদের কাছে সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আবেগী কিংবা বস্তুনিষ্ঠ যোগ সবসময় না-ও থাকতে পারে। কারণগুলো সঙ্গতই; হয়তো কেউ তাদের বিষয়টি ঠিকভাবে বলেনি কিংবা তাদের পাঠ্যক্রমে তা অনুপস্থিত থেকেছে, বা সেটা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভ্রান্তিমূলক ধারণারও জন্ম হতে পারে সহজেই।
বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, আজকের বাংলাদেশে এ অবস্থাটির কমতি নেই এবং সেটা শঙ্কাজনক। এ প্রবণতা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধারণ করবে না বিজয়ের সত্যিকারের চেতনা, জানবে না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। এ প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের দিনগুলোয় আমাদের জাতিসত্ত্বার অহঙ্কার, আমাদের ঐতিহ্যের ইতিহাস, এবং আমাদের চেতনার ভিত্তি বিলুপ্তির পথ প্রশস্ত করে দেবে।
১৯৭১ এর ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষন শেষ করেছিলেন এই বলে যে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের সংগ্রামের মূলমন্ত্রটি ঐ ডাকটির মধ্যেই নিহিত। বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ শব্দদুটোকে সুচিন্তিতভাবে আলাদা করে উচ্চারণ করেছিলেন। কারন বাঙ্গালীর সংগ্রামকে তিনি দু’টো প্রেক্ষিত থেকে দেখেছিলেন। একটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাই একটি সংগ্রামের শেষ কথা নয়, তার জনগনের সার্বিক মু্ক্তিই হচ্ছে সে সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সার্বিক মুক্তির আবশ্যিক শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এ চালচিত্রকে মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্রও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙ্গালী আত্মস্বত্ত্বা:র জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গনতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা, ও সর্বপ্রকার সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপরে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলার শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর নিকটজনকে নৃশংসভাবে হত্যার পরে রাষ্ট্রযন্ত্র এ সব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মের বেপথু করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
এ সবকিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটে ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক, যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্হান আরো সংহত হয়েছে। দুই, আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হই নি, বেপথুও তো হয়েছি। তিন, জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমদের মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে নয় বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
ফলাফল কি? প্রথমত: আমরা বিস্মৃত হয়েছি বাংলাদেশের মূলনীতিগুলো, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম। জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে ‘বাঙালি’ বনাম ‘বাংলাদেশী’ নামক একটি অকারণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে আমাদেরকে বেপথু করার চেষ্টা করা হয়েছে। গণতন্ত্রের মৌলিক মাত্রিকতাসমূহ —অংশগ্রহণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কণ্ঠস্বর— কে ভুলে গিয়ে তার পরিসীমা আমরা সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। সমাজতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ‘সামাজিক ন্যায্যতা’ ভুলে যাওয়ার কারণে সমাজে অসমতা শনৈ শনৈ বেড়ে যাচ্ছে। এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে হটিয়ে দিয়ে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে ধর্মান্ধতা।
দ্বিতীয়, মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার বিস্তারের কারণে সমাজে সংঘর্ষ ও সংহিসতা বেড়েছে। বিস্তৃত হয়েছে আমাদের অসহনশীলতা আর অসহিষ্ণুতা— অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, পরধর্মের বিরুদ্ধে, ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে। আজ সন্ত্রাস আমাদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সহিংসতা আমাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর হাত ধরেই বৃদ্ধি পেয়েছে অস্ত্রায়ণ।
আসছে বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। সন্দেহ নেই আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে— সে লড়াই বাংলাদেশের মূল চিন্তা-চেতনা ও আদর্শিক মূল্যবোধকে সংহত করার। এ লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই— এ লড়াই জিততে হবে।
সেলিম জাহান
সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.
Pingback: মহান বিজয় দিবস সংখ্যা - সাহিত্য ক্যাফে