আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষনটি ছিল সর্ব অর্থেই ঐতিহাসিক। একটি জাতির শঙ্কিত ও অনিশ্চিত ক্রান্তিকালে তার নেতা জাতিকে পথনির্দেশ দিচ্ছেন—বড় গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কঠিন সে কাজটি। বঙ্গবন্ধু কিন্তু অনায়াসেই এ কাজটি করেছেন অবিশ্বাস্য দক্ষতার দ্বারা। পৃথিবীর সর্বকালের একটি শ্রেষ্ঠ ভাষন এটি— বিষয়বস্তুর দিক থেকে, উপস্হাপনার দিক থেকে, উজ্জীবনের দিক থেকে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাকে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ভাষনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সব মাত্রিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পাঁচটি দিক আমাকে সদা মুগ্ধ করে।
প্রথমত: একটি জাতির জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চিত মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যখন তার ভবিষ্যত পথযাত্রা নির্দেশ করছিলেন, তখন তিনি বলছিলেন তাঁর মন থেকে— আবেগ ও বিবেক মিশিয়ে। আবেগ ও বাস্তবতার এক অদ্ভূত সংমিশ্রন ছিল তাঁর সে বক্তব্য। আবেগে উজ্জীবিত করছিলেন তিনি বাঙ্গালী জাতিকে, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি জাতিকে সম্ভাব্য আঘাত সম্পর্কে। জনতার সঙ্গে সততার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। বক্তৃতার সারাটি সময়ে তিনি কোন কাগজের দিকে তাকান নি, কোন লিখিত বর্ণনার আশ্রয় নেন নি, তাঁর ভাষণ ছিল স্বত:স্ফূর্ত ও হৃদয়-নি:সৃত। একটি জাতির ক্রান্তিকালে তাদের পথনির্দেশ দেয়ার কালে এমনটি ভাবা যায় না।
দ্বিতীয়ত: সম্পূর্ণ স্বত:স্ফূর্ত ভাষন হলেও তার বক্তব্য ও যুক্তির কাঠামো ছিলো বিস্ময়কর। তাঁর ভাষনের গঠন ও চলমানতা ছিল একটি সঙ্গীতের মতো— কোথাও তাল কাটে নি, কোথাও সঙ্গতি নষ্ট হয় নি, কোথাও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় নি। একের পর এক বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়েছ একটি স্বাভাবিক গ্রণ্হিবদ্ধ জলধারার মতো। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়া হয়েছে একটি যৌক্তিক অনুপান ধরে। পুরো জাতিকে তিনি যেন একটি সুগ্রণ্হিত সিম্ফনীর মতো।সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বক্তব্যের একটি দৃঢ়তা ও উপস্হাপনের এক অনন্য ঋজুতা।
তৃতীয়ত: বঙ্গবন্ধুর ভাষনের মূল লক্ষ্য ছিলো দু’টো গোষ্ঠী – বাংলাদেশের জনগণ ও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। বাংলাদেশের জনগণকে তিনি পথনির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের উজ্জীবিত করছেন, তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন। তাঁর সেই ডাক জনগনকে যূথবদ্ধ করেছে, তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে এবং তাঁদেকে সাহসী করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন পাকিস্তানী শাসককূলের বিরুদ্ধে, সাবধান করে দিয়েছেন তাদের অপপ্রয়াসের ফলাফল সম্পর্কে, উন্মোচন করে দিয়েছেন তাদের আসল রূপ। শাসককুলের রক্তচক্ষুকে তিনি ভয় পান নি, তাদের ষড়যন্ত্র তিনি বুঝতে পরেছিলেন এবং তাদের মোকাবেলার কথাও তিনি বলেছিলেন।।পুরো বক্তৃতায় এক অভাবনীয় ভারসাম্য রক্ষা করেছেন তিনি—তাঁর ভাষণ ছিল সংযত, কিন্তু সংহত।
চতুর্থত: তাঁর শব্দচয়ন, ভাষা এবং বাক্যগঠন ছিল হৃদয়গ্রাহী। তিনি শক্ত কঠিন কথার আশ্রয় নেন নি, পান্ডিত্যও দেখাতে যান নি। কঠিন বিষয়কেও তিনি সহজ করে বলেছেন।বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্য উপস্হাপন করেছেন সাধারন মানুষের বোধগম্য ভাষায়—সহজ কথা সহজেই বলেছিলন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি সোজাসুজি বলেছেন শাসককুলের অপপ্রয়াসের কথা, সামনের সঙ্কটসমূহের কথা, তিনি জনগনকে মিথ্যে আশ্বাস দেন নি, তাঁদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন নি। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য নানান বিষয়ের মতো কথার মাধ্যমেও জনগনের সঙ্গে একটি আত্মিক সম্পর্ক স্হাপিত হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর। তাই তিনি বাঙ্গালী জাতির মনকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে।
পঞ্চমত: বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করেছিলেন আমাদের সংগ্রামকে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ও ‘মুক্তির সংগ্রাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। আমার মনে হয় অত্যন্ত সচেতনভাবে বঙ্গবন্ধু শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন তাদের অন্তর্নিহিত অর্থ মনে রেখে। ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন। স্বাধীনতা এলেই মুক্তি আসেনা। স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই কেবল মুক্তি সম্ভব। সুতরাং বাঙ্গালী জাতির সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে শেষ হবে না, তাকে মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে, কারন স্বাধীনতা মুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
আজ পঞ্চাশ বছর পরেও বঙ্গবন্ধুর মার্চের ভাষনের চিন্তা-চেতনা বাঙ্গালী জাতির ভবিষ্যত পথযাত্রার জন্যে তাৎপর্য্যপূর্ণ। আগামী দিনগুলোতে এ ভাষণ হবে আমাদের প্রেরণার উৎস। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের জন্যেও এ ঐতিহাসিক ভাষণ থাকবে একটি পাথেয় হয়ে সর্বকালে, সর্বযুগে।
সেলিম জাহান
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.