সেলিম জাহানের মুক্তগদ্য: হারিয়ে গেছি আমি

‘আপনি নাকি হারিয়ে গিয়েছিলেন?’ প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক। আমি কিছু বলার আগেই নিক্ষিপ্ত হল তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘মানে, রাস্তা হারিয়েছিলেন?’ বুঝলুম, কারো কাছে শুনেছেন ভাসা ভাসা, শৈশবে আমার হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। ‘না, রাস্তা হারাই নি’, আশ্বস্ত করি তাঁকে, ‘বরং রাস্তাই হারিয়ে ফেলেছিল আমাকে’। কিন্তু আমার কথায় আশ্বস্ত হওয়ার বদলে বিভ্রান্তই হন ভদ্রলোক। ‘সে আবার কি ধরণের হারিয়ে যাওয়া’?, বিড় বিড় করেন তিনি।

আসলে কত রকমের হারিয়ে যাওয়া যে আছে জীবনে। রাস্তা হারাই— যাব রেবতী মোহন লেনে, গিয়ে উপস্হিত হই সিদ্দিক বাজারে। কতকিছু যে হারাই—চাবি থেকে চশমা, কলম থেকে বইপত্র, চিঠি থেকে মুঠোফোন। হারাবার বস্তুর কমতি নেই জীবনে। জিনিস হারাই পথে-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে, বাড়ীতে- দপ্তরে। ঠিকানা হারাই—বন্ধু বলে গেছেন বাড়ীর নম্বর, হারিয়ে ফেলেছি। বলেছেন আমন্ত্রন শুক্রবারে, হারিয়ে ফেলেছি ফোন নম্বর। কেমন করে জানা যাবে ক’টায় যেতে হবে?

আজকের পৃথিবীতে শিশুরা তাদের শৈশব হারায়, কিশোররা হারায় তাদের কৈশোর। যে হাতে বই ধরার কথা, সে হাত যখন হাতুড়ি ধরে, তখন তারা তাদের শৈশব হারায়। তেমনিভাবে যে কিশোর পড়ার ভারে নুয়ে পড়ে, পরিবারের চাপের কাছে সময় হারায়, তারাও তো তাদের কৈশোর হারায়।

স্মৃতিও তো হারাই আমরা। ভুলে যাই প্রিয়জনের নাম। ছেলেবেলার বন্ধুরা যখন পড়ন্ত বেলায় সামনে এসে দাঁড়ায়, হাতড়ে বেড়াই কি যে ছিল নাম টা— এটা কি বেলাল, না কি রমেন, জোসেফ ও তো হতে পারে। ভুলে যাই দিনক্ষন— জন্মদিন ভুলি, বার্ষিকী বিস্মৃত হই।, কত ঘটনার স্মৃতি হারিয়ে যায়।

বিশ্বাস হারাই মানুষের ওপরে। কখনো হয়তো কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে— অর্থের ব্যাপারে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে, প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে। আর বিশ্বাস ফিরে আসে না— হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো। আস্হা হারাই প্রতিষ্ঠানের ওপর, নিয়মের ব্যাপারে, মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। আস্হা হারাই রাষ্ট্রের ওপরে, নেতৃত্বের ওপরে। ভাবি রাষ্ট্রে সমতার প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে, ন্যায় লঙ্ঘিত হবে না, মানবিকতা রক্ষিত হবে। যখন এর কিছুই হয় না, আমাদের আস্হাটির জায়গাটি থাকে কোথায়?

নিজেকে তো হারিয়ে ফেলি নানান সময়ে— চিন্তায় ডুবে যাই পারিপার্শ্বিকতাকে ভুলে গিয়ে। হারিয়ে ফেলি সত্যিকারের আমিকে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই আমিটি কে। আমার নিজের মাঝে শত শত আমিকে দেখি— মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, “আমার মাঝের সত্যিকার আমি কি উঠে দাঁড়াবেন”? নিজেকে খুঁজে বেড়াই নিজের মাঝে— আপনাকে জানা আমার ফুরোয় না।

অন্যের মাঝেও তো হারায় মানুষ— প্রেমে, মায়ায়, মমতায়। এ হারানোর সুখ আর আনন্দের কি তুলনা চলে? এ হারানো মানুষকে রিক্ত করে না, সিক্ত করে, পূর্ণ করে। এ হারানো মানুষ অনেক সময়ে টের পায় না—হঠাৎই তা হয়ে যায়, অনেকটা সেই ‘হারিয়ে ফেলেছি মন, জানি না কোথায়, কখন’ এর মতন। ভালবাসায় কি নিজেকে হারিয়ে ফেলে নি ‘নেতাই কবিয়াল’ ‘ঠাকুরঝির’ মাঝে? কিংবা ‘বিজয়া’ কি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে নি যে ‘নরেন’ এর প্রতি প্রেমে সে হারিয়ে গেছে?

আবার অন্যদিকে মানুষ অন্যভাবেও তো হারায়। বহু মানুষকে যে ভাবে দেখেছি, পরে তাঁরা সেখান থেকে হারিয়ে গেছে। বহু প্রণম্য মানুষের পদস্খলন দেখেছি— তাঁরা আমাদের শ্রদ্ধা হারিয়েছেন। বহু বান্ধব তাঁদের মত ও পথ বদলেছেন, নানান মোহের কাছে পরাজিত হয়েছেন। যা তাঁরা হতে পারতেন, তা তাঁরা হন নি, যা তাঁরা করতে পারতেন। তা তাঁরা করেন নি। সুতরাং তাঁদেরও তো আমরা হারিয়েছি— সর্ব অর্থেই। জাতি পথ হারায়, দেশ লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে।

অনেক সময়ে হারিয়ে ফেলি ইতিহাস, ঐতিহ্য আর মূল্যবোধ। পরিবর্তনের নাম করে বদলে ফেলি সনাতন মূল্যবোধ। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে অস্বীকার করি ঐতিহ্য। নানান স্বার্থ প্রণোদিত হয়ে বদলে ফেলতে চাই ইতিহাস। আমাদের দেশের সংস্কৃতি, স্বকীয়তা আর মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এ হারানো বড় প্রকট। আমরা বিস্মৃত হই যে এগুলো হারালে আমাদের আর কিছুই থাকে না।

যখন প্রিয়জনেরা এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তখন আমরা বলি, ‘আমরা বন্ধু হারিয়েছি, স্বজনেরা চলে গেছে, অথবা প্রিয়জনেরা আর ফিরবে না।’ এ হারানো আর ফিরে আসে না। মাঝে মাঝে তখন মনে হয়—’লুকিয়ে আছ, আঁধার রাতে, তুমি আমারও বন্ধু হে’।

তবে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রবি ঠাকুরের বামির তুলনা নেই। ‘হারিয়ে যাওয়া’ কবিতায় মাঝের ক’ লাইনে এক অদ্ভুত হারানোর কথা আছে:

‘সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে
প্রদীপটা তার নিভে গেছে বাতাসেতে,
শুধাই তারে, ‘কি হয়েছে বামি?’
সে কেঁদে কয় নীচে থেকে, ‘হারিয়ে গেছি আমি’।

 

সেলিম জাহান

ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top