সেলিম জাহান: সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে

কথোপকথনটা কখন যে এবং তারচেয়েও বড় কথা কেমন করে যে ঐ দিকে মোড় নিল, তা ঠাহরই করতে পারিনি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম মুঠোফোনে শামীমের সঙ্গে। নানান বিষয়ে কথা হচ্ছিল, করছিলাম স্মৃতিচারণও আমাদের সময়কার, মাঝে মাঝে আমাদের উচ্চকিত হাসিতে ভেঙ্গে যাচ্ছিল বাতাসের শার্সি। হঠাৎ করেই কথা গড়াল পাগল প্রসঙ্গে। তারপরই শুরু হল, ওর-আমার পাগল সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার কথা, ওর বাবার পাগল-প্রীতি আর আমার মায়ের পাগল-পৃষ্ঠপোষকতার গল্প, প্রতিভাবান ও উন্মাদের মধ্যকার সূক্ষ্ম রৈখিক পার্থক্য বিষয়ে বিতর্ক।

দু’জনারই গলা যখন তুঙ্গে, তখন হঠাৎ করে ও বলল, ‘আচ্ছা, পাগলদের জন্য তোর মায়া হয় না’? ‘মায়া’! খুব আলতো করে অস্ফুটভাবে শব্দটিকে উচ্চারণ করে আমি অনেকটা আনমনা হয়ে গেলাম। টের পেলাম, মুঠোফোনের ও প্রান্তেও এক অদ্ভুত নিস্তবদ্ধতা নেমে এল। কয়েক মুহূর্তের বিরতি—তারপরই ইথারে শোনা গেল অতি মৃদু স্বর ‘রাখি?’ ‘আচ্ছা’ নরম গলায় বলে আমি কেটে দিলাম

‘পাগলদের জন্য তোর মায়া হয় না? …’মায়া হয় না’? … ‘মায়া’— কথা ক’টি ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ আমার করোটিতে খেলা করতে লাগল। চলচ্চিত্রের ফিতের মতো বেশ কিছু মুখ, অভিব্যক্তি, কথা চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যেতে লাগলো অনেকটা নরম স্রোতের নদীর মতো। মনে পড়ল, কৈশোরে বেশ কিছু মানসিকভাবে অসুস্হ মানুষের সঙ্গে ধূসর শালিকের মতো মায়াবী একটা সম্পর্ক ছিল বটে আমার সেই বরিশালে। কেন জানি, অন্য শিশু-কিশোরদের মতো শৈশব-কৈশোরেও পাগল-ভীতি ছিল না আমার, হয়তো নিজের মধ্যেই এক ধরনের উন্মাদনা আছে বলেই।

ভারী মায়া লাগে শঙ্করমঠ বিদ্যালয়ে আমার অঙ্ক শিক্ষক অতুল বাবুর জন্য। বড় বড় গভীর চোখের নরম স্বভাবের অতুল বাবুকে আমরা সবাই ভালোবাসতাম, তিনিও খুব স্নেহ করতেন তাঁর শিক্ষার্থীদের। কোনদিন কোন ছেলেমেয়ের গায়ে হাত তোলেন নি। কিন্ত সেই অতুলবাবু একদিন বিকারগ্রস্হ হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন শতছিন্ন কাপড়, উত্তোলিত হস্ত আর সশব্দ হুঙ্কারসহ। লোকে ভয় পেয়ে তাঁকে রাস্তা ছেড়ে দেয়, দুষ্টু বালকেরা তাঁর দিকে ঢিল ছোঁড়ে, মেয়েরা ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় আতঙ্কে। ‘অতুল মাষ্টার’ থেকে তিনি হয়ে গেলেন ‘অতুল পাগলা’।

লোক-জন চেনেন না কাউকে, কিন্তু কি আশ্চর্য্য! রাস্তায় আমাকে দেখলেই আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সুতীব্র চিৎকারে ফেটে পড়েন ‘ঐ … ঐ আমার ছাত্র’ বলে। এর ব্যতয় ঘটেনি কখনো। পাগল আমাকে চেনে বলে আমার মা ভীত হন, আমার মাতামহী একটি রক্ষাকবচের ব্যবস্হা করেন, লোকে আমাকে ঠাট্টা করে ‘অতুল পাগলার ছাত্র’ বলে। বয়স কম— চোখে আমার জল নামে।

তারপর বহুদিন কেটে গেছে। ততদিনে আমি যোগ দিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে বি. এম. কলেজে গেছি। হঠাৎ রাস্তায় তাঁকে দেখলাম — উন্মত্ত হুঙ্কারে চারদিক কাঁপিয়ে চলেছেন রাস্তার মাঝখান দিয়ে। আমার ওপরে চোখ পড়তেই একেবারে শান্ত হয়ে রাস্তা পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন।

দেখলাম, বুড়ো হয়ে পড়েছেন একদম। হাড় জির জিরে শরীর, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, কোটরাগত রক্তজবা চোখ। পরনে শতছিন্ন কাপড়। আমার একেবারে কাছে এসে একজন সুস্হ মানুষের মতো আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘ কেমন আছো? কি করছো আজকাল?’ উত্তর দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি শুনে তাঁর চোখে-মুখে বিরাট এক গর্বের আভা ছড়িয়ে পড়ল। আমার ভেতরে যে কি হলো জানি না, আমি নীচু হয়ে তাঁর পদধূলি নিলাম। চেয়ে দেখি স্যারের বড় বড় দু’ চোখ টল টল করছে জলে। আমার মাথায় হাত ছোঁয়ালেন। তারপরই এক বিকট হুঙ্কার দিয়ে নামলেন পথে। ততক্ষনে আমিও ঝাপসা দেখছি।

‘এটা কোন ইংরেজীই হয় নি’, বলেই পাশে পড়ে থাকা পেন্সিলটি নিয়ে খস খস করে যিনি আমার খাতায় ইংরেজী বাক্যটি শুধরে দিলেন, তাঁকে সারা বরিশালের লোক ‘কানাই পাগলা’ বলে জানে। শুনেছি, এক জমিদার বংশের সন্তান তিনি, অনর্গল নির্ভুল উচ্চারণে ইংরেজী বলেন, মাঝেমাঝেই সাজেন সম্ভ্রান্ত ইংরেজদের মতো— সুন্দর স্যুট, সাদা ধবধবে উঁচু কলারের জামার গলায় নিপাট সিল্কের স্কার্ফ, বুক পকেটে লাল রুমাল, সঙ্গে সাদা হ্যাট আর হাত বেতের ছড়ি।

কানাইদা’র জীবনের আকাঙ্খা মনে হতো মাত্র দু’টো— বি.এম. কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন মাঠে ইংরেজীতে ধারাবিবরণী দেবেন, আর শহরে বাইরে থেকে যখনই গণ্যমান্য ব্যক্তি আসবেন, তাঁদের সঙ্গে ইংরেজীতে আলাপচারিতায় মাতবেন। যেহেতু তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার অসীম, যে কোন ব্যক্তি মাত্রেই তাঁর কথায় মুগ্ধ হতেন। মনে আছে, পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মঞ্জুর কাদির বরিশালে সফরে এলে আমাদের কানাইদা’ তাঁকে এমনই তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন যে মন্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কানাইদা’ কি অক্সফোর্ডে গিয়েছেন না কেম্ব্রিজে?

কানাইদা’র ভীষণ পছন্দের ছিল আমার মায়ের হাতের রান্না। ক্ষিদে পেলেই যখন তখন চলে আসতেন আমাদের বাসায়। আমার খাটে লম্বা হয়ে হাঁক পাড়তেন, ‘মা’জী, ম্যাঁয় ভূখা হুঁ’। মা যতক্ষণ তাঁর খাবার ব্যবস্হা করতেন, কানাই দা’ পড়তেন আমাকে নিয়ে। তাঁর বকাঝকার মূল কথা হচ্ছে ইংরেজীতে আমি ‘ক অক্ষর গোমাংস’। তাঁর এই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে আমার আরো রোখ চেপে যেত। আরো বেশী করে ইংরেজী বই পড়তাম, অভিধান দেখে দেখে নতুন শব্দ শিখতাম, রেডিওতে রিজওয়ান ওয়াস্তি, জাহানারা সাইদ বা এ্যানিটা গোলাম আলীর ইংরেজী সংবাদ পাঠ শুনে শুনে সঠিক ইংরেজী উচ্চারণ আয়ত্ব করতে চেষ্টা করতাম।

অনেক বছর পরে দিল্লীতে গেছি জাকির হুসেন স্মৃতি বিতর্ক করতে। সংকোচের সঙ্গে বলি, বিজয়ী হয়েছিলাম সেখানে। তুমুল করতালির মধ্যে যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসছি, তখন দেখি, সাহেব মতোন সুবেশ এক প্রৌঢ় আমার দিকে এগিয়ে আসছেন বিমুগ্ধ হাসি আর প্রসারিত হস্তদ্বয় নিয়ে। কে আবার—আমার কানাইদা’। বুকে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। তারপর ইংরেজীতে হড়বড় করে কত কি যে বললেন – ভারত-চীন সম্পর্ক নিয়ে, প্যালেস্টাইন নিয়ে, কাওয়াবাতা বিষয়ে। সবই অসংলগ্ন কথা-বার্তা। বুঝলাম, তাঁর অপ্রকৃতিস্হতা সারেনি। তবে একটি কথা আমার কানে আটকালো— এখন ভারী সুন্দর ইংরেজী বলিস তুই। সে কথায় কেন জানি চোখ আমার সজল হয়ে এলো।

বরিশালের সব পাড়ার বালককুলের সঙ্গে আছিয়া পাগলীর ছিল অহি-নকুল সম্পর্ক। ছেলেরা ওঁর পেছনে লাগত, ক্ষ্যাপাত, টিটকারি দিত, আছিয়াবু’র (মা আমাদের বলেই দিয়েছিলেন ঐ নামেই তাঁকে সম্বোধন করতে) পেছন ফিরে ঢিল কুড়িয়ে ছেলেদের দিকে ছুঁড়ে মারতেন। ছেলেরাও কম যেত না। ইটের টুকরো কুড়িয়ে আছিয়াবু’র দিকে তাক করে ছুঁড়ত। অনেক সময়ে রাস্তায় ঐ ইষ্টকবর্ষনে দিশেহারা হয়ে আছিয়াবু’ আমাদের বাডীর মধ্যে ঢুকে দৌঁড়ে মা’র রান্না ঘরে চলে যেতেন। মা’কে জড়িয়ে ধরে থর থর করে কাঁপতেন ভয়ে আর আতঙ্কে।

পাগলকে লোকে ভয় পায়। কিন্ত পাগলেরও যে কি পরিমাণ ভয় তথাকথিত সুস্হ মানুষগুলোকে, তা আছিয়াবু’কে দেখেই বুঝতে পেরেছি। একবার বালকদের ছুঁড়ে মারা ঢিলে আছিয়াবু’র কপাল ফেটে গিয়েছিল। দরদর করে রক্ত পড়ছিল। তার মধ্যেই চিনে চিনে আমার মা’য়ের কাছে চলে এসেছিলেন তিনি। মা নিজহাতে তাঁর মাথায় পট্টি বেঁধে দিয়েছিলেন। অষুধও খাইয়েছিলেন মনে পড়ে।

প্রায়শই দেখতাম, ছোট বাচ্চা দেখলেই আছিয়াবু’ কোলে তুলে নিতে চাইতেন। লোকে ধর ধর মার মার করে উঠত। তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠত, কুঁকড়ে যেতেন তিনি, ভয় পেয়ে সরে যেতেন। কিন্তু বুঝতাম, একটি মাতৃহৃদয়ের বুভুক্ষা তাঁর মধ্যে কাজ করত। লেকমুখে শুনেছি, একসময়ে একটি ফুটফুটে বাচ্চা ছিল তাঁর। তার মৃত্যুর পরেই বিকারগ্রস্হ হয়ে পড়েন তিনি। লক্ষ্মীট্যারা আছিয়াবু’কে পরে আর কখনো দেখিনি।

অতুল স্যার, কানাইদা’ কিংবা আছিয়াবু’র জন্যে এতো বছর পরেও একটি মায়ার জায়গা রয়ে গেছে আমার হৃদয়ে। হাওয়া যেমন ঘাসের ডগায় দোলা দিয়ে যায়, আমার সেই প্রিয় মানুষটির উচ্চারিত ‘মায়া’ শব্দটি হৃদয়ের সেই তন্ত্রীতেই টঙ্কার দিয়ে গেল। খুলে গেল স্মৃতির কপাট।সেই কপাটের ফোকর দিয়ে যেন নিভন্ত মোমের মতো গলে গলে পড়ল সেই মোক্ষম কথা ক’টি—

‘একমুখ দাড়িগোঁফ,
অনেক কালের কালো ছোপ ছোপ,
জটপড়া চুলে তার উকুনের পরিপাটি সংসার
বিছুটি চোখের কোনে দৃষ্টি বিস্মরণে মগ্ন,
বাবু হয়ে ফুটপাতে একা একা দিনরাত রঙ্গে
পাগল! পাগল, সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে’।

 

সেলিম জাহান

ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top