ভিতরের বাহিরগুলি: জহির হাসান 

আশির দশকের কবিদের মধ্যে যে দু-চারজন কবি কবিতার রাজপথ ছেড়ে আঁইলপথ ধরে হেঁটেছেন তার মধ্যে পুলক হাসান অন্যতম। নগরের ভিড় ঠেলে নীরব-নির্জন গহন পথের দিকে যাত্রা ছিল তার কবিতার দিশা। নীরব ও নির্জন পথের চিত্রকল্প তার কবিতায় আনাগোনা বেশি। বিপরীতে যৌথ-অবচৈতনিক সত্তার কবিতাও শক্তিশালী উপস্থিতি নজর কাড়ে। তাঁর কবিতায় এই দুই জগতের ভিতর গতায়াত চলে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষে।

অন্তর্জগতের বয়ানে আগ্রহী পুলক হাসান। অন্তর্জগতের যেমন একটা বহির্জগৎ রহে তেমনি বহির্জগতেরও একটা অন্তর্জগৎ থাকে। ভিতরের যেমন বাহির থাকে অন্যদিকে বাহিরেরও একটা ভিতর থাকে। কারণ ভিতর বা বাহির অথবা অন্তর্জগৎ কিংবা বহির্জগৎ উভয়ই একইসূত্রে গাঁথা। একের অনুপস্থিতেই অপর অর্থ উৎপাদন করতে থাকে। যেমন কবি মাহমুদ দারবিশ বলেন, নির্জনতাই কবির একমাত্র গন্তব্য নয়। চেতন ও অবচেতনের বয়ানই বাস্তবতা। কিন্তু কবিরা যখন চৈতন্যের প্রশ্রয়ে কবিতা রচেন তার ভিতর অবচেতন গরহাজির থাকে। অপরপক্ষে অবচেতনের প্রশ্রয়ে যখন কবি অনুপ্রাণিত হন তখন চৈতন্যের প্রাধান্য লোপ পায়। চিৎকারের বিপরীতে নৈঃশব্দ হাজির থাকে বলেই চিৎকার চিৎকার হয়ে উঠে। হয়ত সবসময় সবকিছু এরকম বাইনারি নয়। এর মাঝখানে আছে অনেক রংধনু। কবিতায় সৃষ্টিকে এইভাবে বাঁধ বেঁধে দেওয়া মুশকিল। কবিতা শেষ বিচারে অসম্পূর্ণ প্রজাপতিরা এটাকে সম্পূর্ণ করে দেয় যেন। তাই যেন জগৎ ও কবিতার ভিতর লেনদেন চলতেই থাকে সদা। আর সেজন্যই হয়ত যেকোনো সৃষ্টি বিষয়ে আমাদের উৎসুক্যের কমতি থাকে না— কারণ তাতে শেষ কথা থাকে না থাকে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতের উপলব্ধি, বোধ বা ইনসাইট।

কবিতার প্রকরণ নিয়ে পুলক সরলতার সাধনা করেন। সরল বাক্য, সহজ শব্দচয়ন, ধ্বনির তেমন মুর্ছনা নাই তার কবিতায়। কবিতারে ছোটখাটো ঘাসফুলের মতো নিরিবিলি একটা চেহারা দিতে পারাই যেন তার লক্ষ্য। সকল কবিতার উদাহরণ হতে পারে পুলক হাসানের কবিতা।

বাংলাদেশ ও এর ভূমির মানুষের জীবন ও আকাঙ্খা স্বপ্নই পুলকের কবিতায় বাস্তবতা তৈয়ার করে। কবিতায় নীরবতার সাধনা করা সত্ত্বেও পুলক হাসান সেই বাস্তবতাকে এড়াতে পারেন নাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তার কবিতা অনুসন্ধান করে ফেরে। স্বদেশ ও স্বজনের রক্ত মাড়ায়ে স্বপ্ন বিলাসের কবিতায় পুলক ভাসেন নাই। ফলে খুব সহজেই তার অন্তর্জগতে বহির্জগতের ব্যাপক প্রভাব মেলে তার কবিতায়। বাংলাদেশ এক দুঃখিনী বেহুলার প্রতিমায় হাজির হয় অহরহ তার কবিতায়। দুঃখিনী বেহুলার পাশে পাশে যেন কবি ভাসেন দেবতারদের স্বর্গ পর্যন্ত। বেহুলা বাংলার সমর্থন আদায় করে নেয় দেবতারদের কাছ থেকে। বাংলা পায় পরমের মর্যদা। নারীই ভূমি ও মানুষের ভূমিকায় গিয়ে দাঁড়ায়। লখিন্দর মৃত নয় এইখানে যেন সে ঘুমায়ে আছে একটু পরেই যেন জাগবে। ঘুমের ভিতরই নদীযাত্রা চলে বেহুলার মান্দাসে। বেহুলার ন্যারেটিভ একটু পাল্টায় ফেলেন পুলক তাঁর কবিতায়। বাংলা যেন এক নারী তার পুরুষের অনুসন্ধান করছেন যুগ যুগ ধরে। সে পুরুষের ঘুম ভাঙতেছে না। যেন আজকের বাংলাদেশের স্বপ্ন এর বাইরে না। অবচেতনে আজকের বাংলাদেশ যেন সেই স্বপ্ন পুরুষ হারা এক নারীর রূপক। লখিন্দর কোনো এক ঘুমন্ত জননেতারই রূপক যেন। পুলকের বেহুলা কবিতা পাঠের পর জীবনানন্দের বেহুলার কথা আমাদের মনে আসে। জীবনানন্দের বেহুলা যেখানে চিরকালীন পুলকের বেহুলা অনেক বেশি বাস্তবতা, সমকালীন ও স্বপ্নতাড়িত। বেহুলা কবিতায় এইভাবে জানান দেয় বেহুলার ন্যারেটিভ।

তাকায় যদি লখিন্দর, ভাঙবে ঘুম/পৃথিবীর, আর খুঁজে পাবে তার স্বপ্নতীর।/ সেই আশে যুগ যুগ ধরে চলেছে সে ভেসে/ বাকরুদ্ধ দ্বিধাহত দুই নয়নের জলে।/ যেন বেহুলা শুধু নয় একজন বেহুলা/ স্বপ্নপুরুষ হারানো দুঃখিনী এ বাংলা। (বেহুলা শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা ১৭)
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত-হত্যা কবির চোখ এড়ায় না। ভারত সীমান্তে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এ যাবতকালে ফেলানী হত্যা সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আপাত প্রতিবেশি বন্ধুভাবাপন্ন মনে হলেও ফেলানীর কাঁটাতারে ঝুলন্ত লাশ যে মর্মন্তুদ দৃশ্য তৈয়ার করে দুইদেশের ভিতর সম্পর্কের প্রকৃত রূপ যেন ফাঁস করে দেয়। কাঁটাতারের বেড়ায় ঝোলা কিশোরীর লাশ যেন বাংলাদেশেরই নিরীহ বিষণ্ণ পতাকা।

কাঁটাতারে ঝোলা ফেলানির লাশ জাতীয়তা, মানবতা, বন্ধুত্ব ও প্রতিবেশি এই শব্দগুলোর চিরায়ত অর্থ পাল্টে দিয়েছে। পুলক হাসানের ফেলানী নামক ছোট কবিতাটি সেই অন্তর্বাস্তবতার চিত্র আঁকছেন এইভাবে :
‘তোমার মৃত্যু/মূলত সীমান্ত চোখ রাঙানি/অতিক্রম করতে পারোনি তাই,/কাঁটাতারের বেষ্টনী/বরং পাখির মতোই নিথর দেহ/ নিয়ে ঝুলে পড়লে/ গুলিতে ঝাঁঝরা/ হয়ে/ আমরা দেখলাম প্রতিবেশির হৃদয় কতখানি শিলাময়/ স্পষ্ট হলো একজন বন্ধু ভেতরও বাস করে একজন শত্রু।/ আর মনে হলো তোমার শোকগাঁথার/ কাছে তারা কত ছোট।” (ফেলানী শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-১৯)।

কিংবা আমরা পুলকের বিবেকী রাজনৈতিক চৈতন্যের প্রকাশ দেখি ‘কাশ্মীর’ কবিতায় নিম্নরূপ: ‘মনে রেখো/ শাহিদের রক্তের চেয়ে লাল নয়/ শাসকের রক্তচক্ষু।’ (কাশ্মীর, শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-৮২)

রাজনৈতিক চৈতন্যের পাশাপাশি প্রেম তার কবিতায় একটা কেন্দ্রীয় দ্যোতনা তৈয়ার করে। এই প্রেম নারী-পুরুষের চিরায়ত টান, অধ্যাত্মিক ও সংবেদনশীল মানবিক প্রেম তার কবিতার বিষয় হয়ে ধরা দিয়েছে।

“তুমি নন্দনতত্ত্ব কাকে বলে দ্রৌপদীর মতো খুলে খুলে দেখিয়েছিলে যেন ঝাঁপি খুলে বেরুল শঙ্খিনী।” (অযথা বিতর্ক, শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা ৭৬)
“পড়েছি আগুনের প্রেমে।/ যে আগুনে পুড়েছে রুমি/ যে আগুনে পুড়ে আমিও পাচ্ছি আরাম আমের মধুযাম।” (যুগলবন্দি, পৃষ্ঠা ৮৯)
“মোমের মতো গলে পড়ে চাঁদ/নুসরাত, নুসরাত…/ কবে থামবে এই দুঃস্বপ্নের রাত?” (নুসরাতকে নিয়ে আরও কয়েক পঙ্ক্তি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা ১৫)

মৃত্যুবোধ পুলকের কবিতায় আসছে ক্ষণবাদীদের দৃষ্টিতে। যেইখানে জীব ও জড়ের পার্থক্যের নাম জীবন। জড়ের নিয়তি ধারণই জীবনের মৃত্যু। ক্ষণবাদে মৃত্যু অপসৃয়মাণ কিছু নয়। এক লহমাই মহাকাল যেইখানে। ফলে একটি মৃত্যুই মহাকাল। এইখানে চৈতন্যর অবসানই মৃত্যু নয়। মৃত্যু যে দেখে তারই মৃত্যু হয় মূলত। যে মৃত্যুকে বরণ করে সে জীবনকে বিনিময় করে। পুলকের কবিতায় ক্ষণবাদী মৃত্যুবোধ এইভাবে উদৃযাপন করে :“ঝরে যাবার জন্যই ফোটে পুষ্পকলি/ মৃত্যু তাই জীবনের অঞ্জলি” (জন্মমৃত্যু শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা-৩৪)

“কিন্তু আলোর পরশ পেয়েই উধাও/যেন জানিয়ে দিয়ে গেল/জীবন এক পলকের দৃষ্টি সরাও।” (কুয়াশা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃষ্ঠা ৩৬)
’ইচ্ছে করে বলি আমার কবিতা/ তোমারই মনের রাফখাতা। কিন্তু কাকে বলি করো পাঠ/ শূন্যতা ভরাট’ (নির্বাচিত ১৫০ কবিতা, সম্পর্ক, পৃষ্ঠা-২৬)
মর্ম ছুয়ে নামে ঢেউ/দেখি না কেউ।/দেখি না তার ভেতর উপুড়/হাওয়ায় নূপুর বহে কি না। ( নির্বাচিত ১৫০ কবিতা, ঘুঘু, পৃষ্ঠা-৫৬)
চেতনার রং মাখঝা দিন/ আমরা কিন্তু এখন ভীষণ বন্ধুহীন।/বন্ধুর ছদ্মবেশে প্রতিদিন মৃত্যু এসে। ( নির্বাচিত ১৫০ কবিতা, ও বন্ধু, পৃষ্ঠা-৭৮)
রুবাইয়া এই ভরদুপুওে তোমাকে চাওয়া/যেন মাঝখানে থেহমে যাওয়া/গানে ফের সুর ধরা।( নির্বাচিত ১৫০ কবিতা, জ¦র, পৃষ্ঠা-৮০)
একদিন হাঁটতে হাঁটতেই আমরা দেখে ফেলি/দুজনের ম্লান ছায়া/ একদিন হাঁটতে হাঁটতে আমরা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম একটি বাঁশি।(নির্বাচিত ১৫০ কবিতা, তোমার মনে নেই, পৃষ্ঠা-৮৬)

পুলক সবসময় এক রকম কবিতা লিখেন নাই। নিজের একটা কণ্ঠস্বর দরকার এই তাড়নার বশবর্তী হয়ে বার বার আধার ও আধেয়ের কুহকের ভিতর তার পজিশন শিফট্ করেছেন। বারবারই কবিতার মিনিমাল জায়গাটাই তার মূল ভূমি হিসেবে রয়ে গেছে। পুলক হাসান কবিতায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী নন। তিনি প্রচারবিমুখ, কবিতা লেখাকে একটা জার্নি হিসাবে নিয়েছেন সহজ সরল বাক্যের ভিতর গুজে দেন কবিতার বীজ। কবিতা তাই ছোট আকারে হাজির হয়।

রাজনীতি, প্রেম ও মৃত্যুচেতনার বাইরে তাঁর কবিতায় আধুনিক মানুষের দ্বন্দ্ব, দ্বিধা, স্মৃতি-সত্তা, উদ্বাস্তু, অস্তি-চিন্তা, অসুয়া সময়, অবচেতন সত্তার উন্মোচন নানা চিত্রকল্পে ধরা পড়েছে। পুলক হাসানের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশ করেছে আলোঘর প্রকাশনা এবং নির্বাচিত ১৫০ কবিতা প্রকাশ করেছে খেয়া প্রকাশনী।

 

জহির হাসান

জহির হাসান। জন্ম ২১ নভেম্বর ১৯৬৯, যশোর জেলার পাইকদিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে। শৈশব ও কৈশোর কাটছে যশোর ও ঝিনাইদহের গ্রামে। লেখালেখির শুরু ৭ম শ্রেণি।  প্রথম কবিতা প্রকাশ ১৯৮৪ সালে যশোর থাকি প্রকাশিত  দৈনিক স্ফ’লিঙ্গ পত্রিকায়। আগ্রহ ধর্ম, ভাষা, দর্শন ও চিত্রকলায়।  পড়াশোনা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে।       
প্রকাশিত কবিতার বই: পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩), গোস্তের দোকানে (২০০৭), ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০), পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১২), খড়কুটো পাশে (২০১৪), আয়না বিষয়ে মুখবন্ধ(২০১৬),  আম্মার হাঁসগুলি(২০১৭),  বউ কয় দেখি দেখি (২০১৮),  বকুলগাছের নিচে তুমি হাসছিলা(২০১৯), আম্মার আরও হাঁস(২০২০) ও  আমি ও জহির(২০২১)
অনুবাদ : এমে সেজেরের সাক্ষাৎকার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রচনাসংগ্রহ (২০১১) ।
সাক্ষাৎকার পুস্তিকা (কবি উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার) : কথাবার্তা (সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬)
Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top