রবীন্দ্র নিসর্গ-ভাবনা

জহির হাসান

চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের যুগে বসে যখন রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ-চিন্তা নিয়ে ভাবতে যাই, দেখি রবীন্দ্র-যুগের পরিবেশ ছিল আজকের তুলনায় স্বর্গ-উদ্যান বা নন্দন-কানন। ফলে পরিবেশ নিয়ে ভাবলেই মনে হয় অতীত সময়ই স্বর্গ। আমরা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত। মানে আমরা ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ করেছি। ‘প্যারাডাইজ রিগেইন’ করার আকুতি যাদের ভেতর ছিল তারা চিরকালই ভাব-কেন্দ্রিকতার প্রতি আকুল ছিল। শিল্প-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে ‘আধুনিক’ গজবীযুগের পয়দা হয়েছিল— বুদ্ধি, যুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অতি বিজয় লাভ করায়, ভাব আর বস্তুর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। ‘রোমান্টিক’ যুগকে বিতাড়িত করে স্বর্গে পাঠানো হলো, মর্তে পড়ে রইলো ক্ষমতা পূজারিরা। তাদের দৌড়-ঝাপে আজ পৃথিবী কম্পিত। পৃথিবীতে বোধ হয় ‘আধুনিক’ যুগের নিষ্পত্তি পরকাল ছাড়া সম্ভব হবে না। কারণ যে নদী মরে গেছে, যে ঘুঘু ঝরে গেছে, তাদের জিন্দা করে তাদের গান শোনা হবে কী ফের।

‘শহর’ হচ্ছে সিভিলাইজেশনের ‘দান’। আদিতম গ্রামই স্বর্গের মডেল। শহর দৈত্যের পেটের ভেতর চলে যাচ্ছে গ্রাম। বেহাত হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, মাঠ ফাঁকা জায়গা, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে পাহাড় জলাশয়। বেহাত হচ্ছে বীজ, গাছ, প্রজাতি। গ্রুপ অব কম্পানিজের কাছে জমি ভিক্ষা করতে হবে একদিন। কর্পোরেট ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো চারাদান করে বনায়ন করছে। হায়রে, কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটি! এইসব আহাজারি কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে আমাদের।

প্রয়োজনবাদী উদর ভোগ সর্বস্ববাদীরা অন্যের আকাশ চুরি করে নিজের করে ফেলে। সবকিছু অর্থে প্রকাশ সম্ভব! একচেঞ্জবাদীরা জ্ঞানচর্চার থেকে জ্ঞানীগোরে পোষে! অন্তরিন্দ্রিয় ইহাদের অহঙ্কারে ভরাট হয়ে গেছে। সমগ্রতার থেকে সংক্ষিপ্ত বিশেষেই তৃপ্ত ইহারা! চিত্তের ভাবোচ্ছ্বাস বাহুল্য মনে করে। বৈষয়িকতাই ইহাদের ইহ ও পরলোক।

অহং যেন খণ্ডাকাশ, ঘরের মধ্যেকার আকাশ, যা নিয়ে বিষয়কর্ম মামলা-মকদ্দমা এইসব। সেই আকাশের সঙ্গে যুক্ত মহাকাশ, তা নিয়ে বৈষয়িকতা নেই; সেই আকাশ অসীম, বিশ্বব্যাপী। বিশ্বব্যাপী আকাশে ও খণ্ডাকাশে যে ভেদ, অহং আর আত্মার মধ্যেও সেই ভেদ। মানবত্ব বলতে যে বিরাট পুরুষ, তিনি আমার খণ্ডাকাশের মধ্যেও আছেন। আমারই মধ্যে দুটো দিক আছে, এক আমাতেই বদ্ধ, আর-এক সর্বত্র ব্যাপ্ত। এই দুই-ই যুক্ত এবং এই উভয়কে মিলিয়েই আমার পরিপূর্ণ সত্তা। তাই বলেছি, যখন আমরা অহংকে একান্তভাবে আঁকড়ে ধরি তখন আমরা মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ি। সেই মহামানব, সেই বিরাটপুরুষ, যিনি আমার মধ্যে রয়েছেন তাঁর সঙ্গে তখন ঘটে বিচ্ছেদ।

‘বিরাট পুরুষ’ রবীন্দ্রনাথ যাকে বলছেন। সেই পুরুষে ‘অসীম’ ‘আত্মা’ ‘সর্বত্রব্যাপ্ত’, ‘মহাকাশ’ ‘পরিপূর্ণসত্তা’ ইত্যাদি গুণাদি ভাষায় প্রয়োগ করছেন। এই বিরাট পুরুষকে বিয়োগ করেই বিশ্বব্যাপী সবার চিন্তা-জগতে ‘আধুনিকতা’ নানাভাবে জারি আছে। ফলে ‘আমিত্ব’ কেন্দ্রিকতার ফল এই সব পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে। বিরাট পুরুষের থেকে নিজেকে সরিয়ে চারপাশের বিশ্বকে আমরা ‘অপর’ আকারে হাজির করি। ভাব-চর্চা, জ্ঞান-চর্চার মধ্যে এই সংকট বিকশিত হয়েছে বিনির্মাণ আকারে। বিনির্মাণ শুধুই ফর্মগত বিপর্যয় নয়, ঐ বিরাট পুরুষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আদি ধারণারাশিকে গরহাজির করা। এইভাবে সাহিত্যে কাব্যে নতুনত্ব আসে ফর্মে, তবে তাতে ‘মহাকাশ’টা বাদ পড়ে। ফলে আমাদের সাহিত্য, কাব্য ও চিত্রকলা হয়ে উঠছে সংহারমুখী; নিসর্গচ্যুত বুদ্ধি কৌশল প্রদর্শনের ক্ষেত্র। ‘অন্তরতম আনন্দময় সত্তা’ যেন মৃত্যুকে পাঠায়ে দেয় আমাদের লেখার ভেতর। তাই, আমাদের লেখা প্রকৃতিশূন্য রসহীন শুষ্ক বল্কল। তাই, আলো-ছায়া, রাত, চন্দ্রকলা, উদ্ভিদ, প্রাণী, আকাশ, ঋতুদল, জল-বৃষ্টি, মেঘ, শিশির, বাতাস, ভূমিরূপ আমাদের ভাব জগতে এসে ভাষার ভেতর অধিকার করে বসে না (দু-একজন ব্যতিক্রম লেখকের লেখা বাদে)। রবীন্দ্রনাথ জ্ঞান ও ভাববস্তুর মধ্যে ভেদ জ্ঞান করেছেন।

জ্ঞানের কথা একবার জানিলে আর জানিতে হয় না। আগুন গরম, সূর্য গোল, জল তরল, ইহা একবার জানিলেই চুকিয়া যায়; কিন্তু ভাবের কথা বারবার অনুভব করিয়া শ্রান্তিবোধ হয় না।

কিংবা ‘জ্ঞানের কথাকে প্রকাশ করিতে হয়, আর ভাবের কথাকে সঞ্চার করিয়া দিতে হয়। তাহার জন্য নানা প্রকার আভাস-ইঙ্গিত, নানা প্রকার ছলাকলার দরকার হয়। তাহাকে কেবল বুঝাইয়া বলিলেই হয় না, তাহাকে সৃষ্টি করিয়া তুলিতে হয়।’

তাহা ছাড়া যাহা জ্ঞানের জিনিস তাহা এক ভাষা হইতে আর-এক ভাষায় স্থানান্তর করা চলে। মূল রচনা হইতে উদ্ধার করিয়া অন্য রচনার মধ্যে নিবিষ্ট করিলে অনেক সময় তাহার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি হয়। তাহার বিষয়টি লইয়া নানা লোকে নানা ভাষায় নানা রকম করিয়া প্রচার করিতে পারে; এই রূপেই তাহার উদ্দেশ্য যথার্থভাবে সফল হইয়া থাকে। কিন্তু ভাবের সম্বন্ধে এ কথা খাটে না। তাহা যে মূর্তিকে আশ্রয় করে তাহা হইতে আর বিচ্ছিন্ন হইতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ জ্ঞান অপেক্ষা ভাববস্তুর প্রতি বেশি আগ্রহী। ভাববস্তুর স্বরূপকে বের করে আনার জন্য নানা উপমা দিয়েছেন। জ্ঞানের যে সাধারণী ক্ষমতা আছে, ভাববস্তুর নাই। কেননা ভাববস্তু ব্যক্তি প্রতিভা জারিত। জ্ঞানের বিশেষ আকার থাকে, ভাবের ক্ষেত্রে আভাস থাকে। সাহিত্যে নিসর্গের আনাগোনা নিয়ে আলাপ জুড়তে গেলে জ্ঞান ও ভাবের আলাপ জরুরি। কারণ সাহিত্যে ভাব রাজা, জ্ঞান প্রজা। জ্ঞান গোলাপের কাঁটা ভাব গোলাপের অবস্তুক সৌন্দর্য। সাহিত্যে জ্ঞানকে রাজা বানায়ে দিলে গোলমাল বেঁধে যাবে। আমাদের সাহিত্য কাব্য চিত্রকলায় এই গোলমাল আছে। কারণ আমাদের প্রকৃতিলোক ভাবের মাধ্যমেই সাহিত্যে কাব্যে আসে। চিন্তা/জ্ঞানের মাধ্যমে নয়। প্রকৃতি ভাবের কাছে ধরা দেয়, জ্ঞানের কাছে নয়। ফলে ভাবের জানালা যার বন্ধ প্রকৃতি তার রচনায় গরহাজির থাকা স্বাভাবিক। যেই কবি অধিকতর ভাবকেন্দ্রিক তার উপমারাশি আসে প্রকৃতির চেনা-জানা চিত্র থেকেই। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় চেনা-জানা বাংলার গাছ, লতাগুল্ম, পাখি, প্রাণী, নদী, লোকায়ত উৎসব, ঋতু যেভাবে নির্জনতা, মৃত্যু, শূন্যতা, বোধ, শোক, ধূসরতা মাখানো আমোদ এসেছে, আর কোনো কবির কবিতায় উপমায় এ-রকম পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের কবিতার প্রতিটি চরণে তার অগাধ নিসর্গপ্রেম শিল্পযুগের স্পিরিটকে এক অর্থে চ্যালেঞ্জ করে।

প্রকাশের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নিসর্গ-ভাবনা জীবনানন্দের থেকে আলাদা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবন-দেবতা’ বা ‘বিরাট পুরুষের’ সাথে প্রকৃতিকে মিলিয়ে দেখেছেন। ফলে প্রকৃতি অনেকটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে যেন এসেছে। ফলে জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতির যে প্রাত্যহিকের চিরকালকে পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথে প্রাত্যহিক যেন চিরকালের ভেতর হেলান দেয়। ফলে অনিত্য নিত্যের মধ্যে জায়গা করে আনন্দলোকের সন্ধান দেয়। জীবনানন্দ পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়কে কত রূপে, কত স্কেলে বাজিয়েছেন, ছবি তুলেছেন, স্পর্শে-ঘ্রাণে-স্বাদের সূক্ষ্মতর লীলায় যেন বাস্তব প্রাপ্তি ঘটায়, হোক তা নৈরাশ্য ধূসর মৃত্যু জারিত।

এখানে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, আত্মীয়তার কথা প্রতিতুলনা করলেও মূলত আলোচনা রবীন্দ্রনাথেই সীমাবদ্ধ থাকবে। রবীন্দ্র প্রকৃতি-চিন্তাকে তাত্ত্বিক আকারে ও পরে বিশেষ উদ্ধৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমের তাঁর নানা অনুভূতি ও ভাবের সঙ্গে পরিচিত হবো।

জগতের যতটা জ্ঞানের দ্বারা আমি জানিব ও হৃদয়ের দ্বারা আমি পাইব ততটা আমারই ব্যাপ্তি, আমারই বিস্তৃতি।

জ্ঞানে যেমন ক্রমে ক্রমে সমস্ত সত্যকেই আমাদের বুদ্ধিশক্তির আয়ত্তের মধ্যে আনিবার জন্য নিয়ত নিযুক্ত রহিয়াছে সৌন্দর্যবোধেও তেমনি সমস্ত সত্যকেই ক্রমে ক্রমে আমাদের আনন্দের অধিকারে আনিবে, এই তাহার একমাত্র সার্থকতা। সমস্তই সত্য, এইজন্য সমস্তই আমাদের জ্ঞানের বিষয়। এবং সমস্তই সুন্দর, এইজন্য সমস্তই আমাদের আনন্দের সামগ্রী।

গোলাপফুল আমার কাছে যে কারণে সুন্দর সমগ্র জগতের মধ্যে সেই কারণটি বড়ো করিয়া রহিয়াছে। বিশ্বের মধ্যে সেইরূপ উদার প্রাচুর্য অথচ তেমনি কঠিন সংযম; তাহার কেন্দ্রাতিগ শক্তি অপরিসীম বৈচিত্র্যে আপনাকে চতুর্দিকে সহস্রধা করিতেছে এবং তাহার কেন্দ্রানুগ শক্তি এই উদ্দাম বৈচিত্র্যের উল্লাসকে একটিমাত্র পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যের মধ্যে মিলাইয়া রাখিয়াছে।

রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের ব্রহ্মকে সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ, অসীমকে সসীমের মধ্যে, নিরাকার অরূপকে আকার রূপের আধারে দেখেছেন। তাঁর বিশ্বাসরাশির সর্বোচ্চ সীমা উপনিষদকেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথ চার অন্তরিন্দ্রিয় তথা-মন, বুদ্ধি, অহম ও চিত্তকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখেছেন। তিনি মন, চিত্ত/হৃদয়কে কেন্দ্রীয় ধরে বুদ্ধি, অহম, জ্ঞানকে পরিধির সহযোগী সত্তা হিসেবে আন্দাজ করেছেন। হৃদয়কে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়ায় সংবেদনশীল রবীন্দ্রনাথকে আমরা বুদ্ধি ও জ্ঞানবাদী রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা বড়ো করে পাই। উপর্যুক্ত ৩টি উদ্ধৃতিতে ‘জ্ঞান’ ‘হৃদয়’ ‘সত্য’ ও ‘সুন্দর’ ৪টি কেন্দ্রীয় ধারণার অন্তর্লীন সম্পর্কের লেন-দেন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তা ব্রহ্ম-চিন্তার সমান্তরাল। বুঝা যাচ্ছে কিছু রবীন্দ্রবিশ্বাস সকল সাহিত্য-কাব্য-চিত্রকলায় ঘুরে ফিরে আসে যেখানে আমরা একটা রবীন্দ্র সমন্বয় সমীকরণ আবিষ্কার করি। রবীন্দ্রনাথ অন্তর্লোকের স্থান ঠিক রেখে আর সব সম্পর্কিত উপাদান দিয়ে একটা মালা বা ঐক্যসূত্রের হদিস দেন। সত্যের উদ্বোধন হৃদয় ও জ্ঞান দিয়ে হয় (অর্থাৎ ‘সত্য’ ও ‘জ্ঞান’ একটা কিছু নিশ্চিত রয়েছে, এই স্থির বিষয়গুলোই কেন্দ্রীয় ধারণা)। জ্ঞান সত্যকে বুদ্ধির কব্জায় আনে, হৃদয় সত্যকে সোন্দর্যবোধের মাধ্যমে আনন্দের অধিকারে আনে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পকর্মে হৃদয়ের সত্যকে জ্ঞানের সত্যের থেকে বড়ো করে দেখেছেন। যার কারণে তিনি বলছেন, ‘গোলাপফুল আমার কাছে যে কারণে সুন্দর সমগ্র জগতের মধ্যে সেই কারণটি বড়ো করিয়া রহিয়াছে।’ অর্থাৎ ‘সুন্দর’ ও ‘সৌন্দর্যবোধ’ এর পেছনের কারণ। সৌন্দর্যের বিস্তৃতির কারণে তার সঙ্গে সমগ্রের যোগাযোগ ব্যাপক কারণ এর সঙ্গে আনন্দের সন্ধান লাভ ঘটে। অর্থাৎ হৃদয়ের ব্যাপকতা সংবেদনশীলতা মধ্য দিয়ে ‘বিশাল পুরুষে’ নিপতিত হয়। জ্ঞানের সঙ্গে সংবেদনশীলতার বিচ্ছেদ ঘটলে সম্পদের ব্যক্তিকরণের মধ্য দিয়ে উলম্ব চিন্তার বিকাশ ঘটে। সমান্তরাল বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে উঠতে পারে। পুঁজির স্তূপীকরণ জ্ঞানের উলম্ব-চিন্তার ফসল। সেখানে মানুষ ইদুঁরের স্বভাব অর্জনের মাধ্যমে সম্পদের স্তূপীকরণ করে আজকের পুঁজিবাদী দুনিয়ায় পণ্য আকারে নিসর্গকে দেখে থাকে।

ইহা মনে রাখিতে হইবে, মানুষ কী জানে তাহাতে নয়, কিন্তু মানুষ কিসে আনন্দ পায় তাহাকেই মানুষের পরিচয় পাওয়া যায়।
টাকার মধ্যেই যাহার আনন্দ সে টাকার ক্ষতির ভয়ে অসত্যকে অপমানকে অনায়াসে স্বীকার করে

জ্ঞান মানব মনের সচেতন অংশের একটা খোপে জমা থাকে। অবচেতন অংশে থাকে ভাব, সুন্দরের প্রতি আসক্তি, মোট কথা ঈর্ষানল যত কিছু। মানুষের পরিচয় তার অবচেতনের চেহারা দিয়ে অবচেতনের সুন্দর। অসুন্দর কাটা-ঘষা-মাজা ছাড়া প্রকাশই সত্যের সুন্দরের কাছে ধরা দেওয়া। হৃদয়ের ধর্ম সমগ্র ভাবসহ তাতেই ধরা পড়ে। সাহিত্যে অবচেতনের ডুব দেয়া ভাবরাশি হৃদয়ের অনুমতি নিয়ে যখন ভাষায় স্থান পায়, ইতোমধ্যে জ্ঞানের খোপ হয়েই তাকে ভাষায় আসতে হয়, ফলে এই স্তরে কৌশল ফর্মের নানা ফ্যাশনের ডিজাইনের পোশাক-পরিচ্ছদ তাকে পরতে হয়, ভাষার অনুশাসনে থেকে অন্যের অন্তরের বস্তু হতে হয়। উল্টা করে ঠাকুর বলেছেন, ‘বিশ্বজগৎকে ভাষা দিয়া মানুষের ভিতর দিয়া চোলাইয়া লইলে সে আমাদের অত্যন্ত কাছে আসিয়া পড়ে।’ আজকে যারা ব্যক্তিগত সুখ-শান্তির কথা ভেবে ভবিষ্যতকে জোর করে বর্তমান করে ফেলছে। ভবিষ্যতকে অগ্রিম বর্তমানে রূপান্তর ঘটাচ্ছে। একখণ্ড ফসলি জমি কিনে রাখছে ভবিষ্যতে বাড়ি বানাবে বলে। কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে বা বনভূমি/জঙ্গলের মাটির তলায় তেল-গ্যাস পাওয়া গেছে। ঐ বনভূমি উজাড় করে ফেলে তেল-গ্যাস উত্তোলন নিশ্চিত করা ভবিষ্যতকে বর্তমানে টেনে আনা। বর্তমান-ভবিষ্যতের মধ্যে যে ঐতিহাসিকতা তার অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে অবচেতনে লুকানো লোভী স্বার্থপর চেহারার দ্রুত প্রকাশ। অপেক্ষা, সাধনাকে উপড়ে ফেলে সময়কে আগিয়ে আনার প্রজেক্ট নির্বোধের মতো মেনে নিচ্ছি। কারণ আমরা নিসর্গকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বিপরীতে আনন্দ পাচ্ছি। প্রকৃতির শোধ নিয়ে ভাবছি না। মূলত আমরা হাওয়ায় বসবাস করে হাওয়ার খবর রাখি না। অনুতাপ হয় বুঝিনা এই বিচিত্র ঋতুর গর্ভে ঘূর্ণাবর্ত মাস, আলো-আঁধারের সকাল-সন্ধ্যা রাত্রির নির্জন আনাগোনা, পাখির কলকাকলি, শিশিরের গন্ধমাখা ঘাস, আধ ফোটা জ্যোৎস্না, চালতার পাতায় ঝরা শিশির, নীল কুয়াশার ক্লান্তি, সর্বোপরি আমাদের প্রয়োজনকেন্দ্রিক সংসারের গোপনে গোপনে আরেক নিষ্প্রয়োজনের সংসার নির্জনে মূক সমান্তরালে মুচকি হেসে চলে যাচ্ছে প্রতিক্ষণ। সেই সমান্তরাল জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তুচ্ছ ঘটনারাশির ইন্দ্রিয় ইতিহাস অগোচরে রয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমরা মানুষ নিজেদেরকে বুদ্ধি-শ্রেষ্ঠ প্রাণী ভেবে মহাবিশ্বের ক্ষমতাকেন্দ্র ভাবছি। মানব-কেন্দ্রিকতার কারণে পুরো নিসর্গকে ‘অপর’ জ্ঞান করছি। মানব-কেন্দ্রিকতাকে রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে সমালোচনা করেছেন।

কোনো-এক সময়ে আমরা যে শাখামৃগ ছিলাম আমাদের প্রকৃতিতে তাহার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু তাহারও অনেক আগে কোনো-এক আদি যুগে আমরা নিশ্চয়ই শাখী ছিলাম, তাহা কি ভুলিতে পারিয়াছি। সেই আদিকালের জনহীন মধ্যাহ্নে আমাদের ডালপালার মধ্যে বসন্তের বাতাস কাহাকেও কোনো খবর না দিয়া যখন হঠাৎ হু হু করিয়া আসিয়া পড়িত…

আমি তো আজ গাছপালার সঙ্গে বহু প্রাচীনকালের আত্মীয়তা স্বীকার করিব। ব্যস্ত হইয়া কাজ করিয়া বেড়ানোই যে জীবনের অদ্বিতীয় সার্থকতা, এ কথা আজ আমি কিছুতে আনিব না। আজ আমাদের সেই যুগান্তরের বড়দিদি বনলক্ষ্মীর ঘরে ভাইফোঁটার নিমন্ত্রণ। সেখানে আজ তরুলতার সঙ্গে নিতান্ত ঘরের লোকের মতো মিশিতে হইবে; আজ ছায়ায় পড়িয়া সমস্তদিন কাটিবে, মাটিকে আজ হাত ছড়াইয়া আঁকড়াইয়া ধরিতে হইবে;

মানুষ জড়ের সহিত জড়, তরুলতার সঙ্গে তরুলতা, মৃগপক্ষীর সঙ্গে মৃগপক্ষী। … পুরা মানুষ হইতে হইলে তাহাকে সবই হইতে হইবে, একথা না মনে করিয়া মানুষ মনুষ্যত্বকে বিশ্ববিদ্রোহের একটা সংকীর্ণ ধ্বজা স্বরূপ খাড়া করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছে কেন। কেন সে দম্ভ করিয়া বার বার একথা বলিতেছে ‘আমি জড় নহি, উদ্ভিদ নহি, পশু নহি, আমি মানুষ, আমি কেবল কাজ করি ও সমালোচনা করি, শাসন করি ও বিদ্রোহ করি। কেন সে একথা বলে না ‘আমি সমস্ত-ই, সকলের সঙ্গেই আমার অবারিত যোগ আছে, স্বাতন্ত্রের ধ্বজা আমার নহে।

রবীন্দ্রনাথ মানবকেন্দ্রিকতার অহমকে দুষেছেন। রূপকার্থে বলেছেন পূর্বজন্মে আমরা গাছ ছিলাম। ফলে নিজে গাছ হয়ে মনুষ্যত্বের সংকীর্ণধ্বজা কীভাবে বৃক্ষের উপর চাপাই? নিসর্গের আত্মীয়তার বন্ধন কেমনে ছিন্ন করি? রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা ‘Anthropomorphism’কে মেনে নেন নি। বরং উল্টো বলেছেন, মানুষ জড়ের সঙ্গে জড়, তরুলতার সঙ্গে তরুতলার মতো হতে বলেছেন। নিসর্গের উপর মনুষ্যত্ব না চাপিয়ে বরং মানুষ নিসর্গকে যেন অনুসরণ করে।

* * *

আমরা যাহাকে ব্যর্থ বলি, প্রকৃতির অধিকাংশই তাই। সূর্যকিরণের বেশির ভাগ শূন্যে বিকীর্ণ হয়, গাছের মুকুল অতি অল্পই ফল পর্যন্ত টিকে। কিন্তু সে যাহার ধন তিনিই বুঝিবেন। সে ব্যয় অপব্যয় কিনা, বিশ্বকর্মার খাতা না দেখিলে তাহার বিচার করিতে পারি না।

যখন দেখি, ফুল কেবলমাত্র বীজ হইয়া উঠিবার জন্যই তাড়া লাগাইতেছে না, নিজের সমস্ত প্রয়োজনকে ছাপাইয়া সুন্দর হইয়া ফুটিতেছে।

প্রয়োজনকেন্দ্রিক সবকিছুকে আমাদের সংসারের হিসাবের খাতার পাতায় ছবিতে আনি, আমরা আমাদের সংসারকে তোয়াক্কা করছি তবে আরেক প্রবহমান বিশ্বসংসারের ছবি আমাদের রেকর্ডে রাখি না। সেই অহৈতুকী নিষ্প্রয়োজন উদ্দেশ্যহীন জগতের সঙ্গে সুন্দরের যোগ আছে। অহেতুকী বিশ্বসংসারের অন্তর্নিহিত কারণের ভেদ করার চিরচেষ্টা বিজ্ঞানের অধিকারে চলে গেছে। ভাবজগতের সঙ্গে অহৈতুকী ঐ রূপ ও অধরা জগতের নানা রূপ-সংঘর্ষে বেরিয়ে আসা, ছিটকে পড়া অনুভূতি ভাষার জগতে এসে গান, কবিতা, গদ্যরূপে, চিত্রকলা রূপে পাই রবীন্দ্র রচনায়। ঋতুকে কেন্দ্র করে প্রকৃতি বিষয়ে প্রায় তিনশ’র মতো গান লিখেছেন। নিরেট অর্থে আমরা যেমন মায়ের গর্ভে একবার জন্মাই, প্রকৃতির সকল চরিত্রগুলো আমাদের ষড়ঋতুর মধ্যে যেন বারবার জন্মায়। যেন তাদের জন্মের শেষ নেই। আর ভাবুক তার ভাব রসে অহৈতুকী প্রকৃতির খেয়ালি আবেশের জগতেও বার বার নিজের পুনর্জন্মকে আবিষ্কার করেন। রোমান্টিক তকমা জুড়ে দিয়ে আমরা এই ভাবুক শ্রেণিকে তাদের লেখায় বাস্তবতার গরহাজিরার অভিযোগ তুলে আলাদা করে ফেলি। বৈষ্ণব কবিগণ কৃষ্ণরতি তথা কৃষ্ণপ্রেমে যে পঞ্চ বৈষ্ণবরসের কথা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ সেই রস যেন ‘প্রকৃতির’ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। প্রেমাষ্পদকে কাছে না পেয়ে বিরহ অপ্রাপ্তিতে যে প্রকৃতি, রবীন্দ্রনাথের গানে তা পাওয়া যায়। ঋতুর কারণে প্রকৃতির শরীরের জৈবিক ও অজৈবিক পরিবর্তনের ফলে দিন-রাত্রি-আলো-ছায়া-জোছনায় নতুন নতুন সাজে রবীন্দ্র ভাবরসে মৃত্যু, প্রেম, বিস্ময়, বাৎসল্যবোধে যে দোলা দিয়ে গেছে তার মূল ষড়যন্ত্রকারী বাংলার ষড়ঋতু। রবীন্দ্রনাথ গানের মধ্যে তাই গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তে কতনা ভাব-রসের রংধনু মাখিয়ে প্রকৃতিকে দেখেছেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি বিষয়ে যে গান তা যেন জীবনানন্দের আরেক ‘রূপসী বাংলা’। রবীন্দ্র গদ্য-রচনা সম্ভারে প্রতিটি ঋতুকে নিয়ে তিনি আলাদা করে লিখেছেন। প্রকৃতি কবির জীবনে যে কত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে তা শ্রীমতী ইন্দিরাদেবীকে লেখা পতিসর, শিলাইদহ, সাজাদপুর পর্বের চিঠিতে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যে নানাভাবে এসেছে।

রবীন্দ্রনাথ পিতার আদর্শে শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরের জমিদারি দেখাশুনা করার জন্য পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন। আর এই আসাটা ছিল পুরোটাই পানিপথে। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বোটে করে এখানে চলাফেরা করতেন। বোটের জানালা দিয়ে দূর থেকে পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষকে রবি বাবু দেখেছিলেন। প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে তাঁর মিশে যাওয়ার বাসনা আজ আমাদের কাছে উপভোগ্য ও অকিঞ্চিতকর হাস্যরসের বস্তু বটে! ‘আমি এই চৌকিটার উপরে বসে বসে ভান করছি যেন এই_সমস্ত মানুষের থেকে আমি একটা স্বতন্ত্র সৃষ্টি, আমি এদের হর্তাকর্তা বিধাতা, এর চেয়ে অদ্ভুত আর কি হতে পারে।’ এহেন জমিদারের সাব-অলটার্নের প্রতি টান চাষাভুষোদের সত্যিকারে কোনো কাজে না লাগলেও রবীন্দ্রনাথের চশমা দিয়ে দেখা পূর্ববঙ্গের জলমাটি হাওয়া নদী সব মিলিয়ে প্রকৃতির প্রতি বিস্ময়কর টান, তাঁর পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি কেন্দ্রিকতাকে আমরাও চশমা দিয়ে দেখি। কারণ তা আমাদেরকে ঠেলে কাদায় নামায় না, গ্রাম্য চাষাদের শুধুই ‘সরল হৃদয়’ (হায় রে সাদা-কালো অদ্বান্দ্বিক জাতীয় ভাবের দৃষ্টিভঙ্গি!) বলে দেখায়, ফলে তা আমাদেরকে আরও ভদ্দরলোক করে তোলে। এহেন বোধ তাঁর গ্রাম্য মানুষ ও প্রকৃতি-অনুভূতি নিয়ে আমরা মতামত দিতে পারি বটে। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘অপ্রয়োজনের’ থেকে সাহিত্য করার জায়গাটা অনেকটাই মিস করবো। মিস করবো তাঁর প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল অনুভূতির প্রকাশগুলোকে। রোমান্টিকতার মূল মেসেজটাই হারিয়ে যাবে। বাস্তববিমুখতার মধ্যে কল্পনার মূল্যবান অসারতাকে আমরা হারাবো, সেটাও খেয়ালে রাখতে হবে। কারণ আমাদের ইহা মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের প্রায় আশিভাগ পূর্ববঙ্গের গ্রামজীবন, তার প্রকৃতি, মানুষ, মানুষ-প্রকৃতি নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের অনেক গল্পই আমাদেরকে রাবীন্দ্রিকতার চমকে আটকে ফেলে কাঁদায় হাসায়। এতো অনেক বড় ব্যাপার। ‘আমার গল্পগুচ্ছের ফসল ফলেছে আমার গ্রাম-গ্রামান্তরের পথে-ফেরা এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভূমিকায়।’

এখানে দেখবো রবীন্দ্র ভাবনায় ষড়ঋতু— গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের বিচিত্ররূপ, প্রকৃতির মধ্যে শূন্যতা, আকাশ, ঋতুর স্বরূপ প্রকাশে নানা উপমা, ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব, আলো-ছায়ার ছবি, পাহাড়ে গমনের অনুভূতি, দিন-রাত্রি, মৃত্যুর প্রাকৃতিতে প্রকাশ, প্রকৃতির সঙ্গে-আত্মীয়তার, প্রেমের, বিরহ-বেদনামাখা চিত্র সরাসরি একাধিক উদ্ধৃতির মধ্যে নানা রং রূপে হাজির হয়েছে। ঋতুর চাকায় জিম্মি প্রকৃতির চিত্র ঋতু অনুক্রমে সংক্ষেপে এখানে আলোচিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঋতুতে ঋতুতে যে ভেদ তা সনাতন হিন্দু ধর্মের চার বর্ণের মধ্যে ফেলে এর স্বরূপকে তুলনা করেছেন। তিনি গ্রীষ্মকে বলেছেন ব্রাহ্মণ। বর্ষাকে ক্ষত্রিয়। শীতকে বৈশ্য। হেমন্ত, শরৎ ও বসন্তকে তুলনা করেছেন শুদ্রের সঙ্গে।
গ্রীষ্ম
চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে

বকুল ফুলে ফুলে কখন যে ভ্রমর আসে, বাতাসে সে কানাকানি। আকাশে কী গোপন বাণী এসে আছড়ে পড়ে বিরহ সাগরের কূলে। দাহনবেলায় ক্লান্ত কপোত তাপিত প্রাণে তৃষ্ণার জল খোঁজে। খালবিল নদী নালাও তৃষ্ণার্ত। প্রকৃতির ভেতর রস ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ফলে গিয়ে স্থিত হয়। বৈশাখী ঝড়ের বাতাসে থাকে ঠাণ্ডা ঝড়ো বৃষ্টির আগমনী বার্তা। প্রকৃতি বলে, ‘এসো শ্যামল সুন্দর আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।’ রবীন্দ্রনাথ গ্রীষ্মের বৈরাগ্য, বিতৃষ্ণা, অসহিষ্ণুতা, অনাসক্তি, অনাগ্রহ অগ্নি-স্বাদে তুলে ধরেছেন ।

গ্রীষ্মকে ব্রাহ্মণ বলা যাইতে পারে। সমস্ত রসবাহুল্য দমন করিয়া, জঞ্জাল মারিয়া, তপস্যার আগুন জ্বালিয়ে সে নিবৃত্তিমার্গের মন্ত্র সাধন করে। সাবিত্রী-মন্ত্র জপ করিতে করিতে কখনো বা সে নিশ্বাস ধারণ করিয়া রাখে, তখন গুমটে গাছের পাতা নড়ে না; আবার যখন সে রুদ্ধ নিশ্বাস ছাড়িয়া দেয় তখন পৃথিবী কাঁপিয়া উঠে। ইহার আহারের আয়োজনটা প্রধানত ফলাহার।

শরৎ-হেমন্ত-শীতে মানুষের ফসলের ভাণ্ডার, সেইজন্য সেখানে তাহার তিন মহল; ঐখানে তাহার গৃহলক্ষ্মী। আর যেখানে আছেন বনলক্ষ্মী সেখানে দুই মহল বসন্ত ও গ্রীষ্ম। ঐখানে তাহার ফলের ভাণ্ডার, বনভোজনের ব্যবস্থা; ফাল্গুনে বোল ধরিল, জ্যৈষ্ঠে তাহা পাকিয়া উঠিল। বসন্তে ঘ্রাণগ্রহণ আর গ্রীষ্মে স্বাদগ্রহণ।

বর্ষা

নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।

বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।

বর্ষাকে তাঁর অঙ্গে অঙ্গে চেনা যায়। প্রকৃতি বর্ষা আছর করলে তার কতরূপ তা বাঙালি মাত্রই জানে। বর্ষা তারে না পারি এড়াতে। বর্ষা কারও কারও কাছে জলে কাদায় মাখা তাই ভালো লাগে না। গৃহবন্দি থাকতে হয়। আকাশের মেঘের কৃপায় সবার চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হয়। আজকের আবহাওয়া-জলবায়ুর বিবর্তনের কারণে সেই রবীন্দ্রবর্ষার চিত্র আর বাংলায় নাই। তবু একদিন একটানা বৃষ্টি হলেই রবীন্দ্র বর্ষার আষাঢ়-শ্রাবণের নস্টালজিক চিত্র যেন আমাদের মানসপটে আজও ভাসে। মনে হয় ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে।’ কিংবা ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো/দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।’ বিরহিণী চেয়ে আছে আকাশে। নব যৌবনা বর্ষা পাঠায়ে দিয়েছে আমাদের কাছে তমালের সজল ছায়া, কেকাধ্বনি, অকারণে উড়ে যাওয়া আকাশের দিকে বলাকার শ্রেণী, বাঁশীতে রাধানাম, রিমঝিম বর্ষণের মধ্যে কেতকী করবী কামিনী যূথিকার গন্ধবাণী, জলেভরা আকুলিত ধানের ক্ষেত, দিক হারানো পরান, অলক্ষ্যে ছুটে যাওয়া বাদল হাওয়া, কদম্বরেণু ছিটানো বিছানা, ভূর্জপাতায় রচিত নবগীত, তড়িতচকিত জনপদবধূ, গীতময় তরুলতিকা, শশীতারাহীন আকাশ, আষাঢ়ের পূর্ণিমা, ভয়ঙ্করী বন্যা, বৃষ্টিমুখর তালের পাতা, জটামেঘের নৃত্য, ঘোর রজনী, বিদ্যুৎ চমক, শ্রাবণ মেঘের খেয়াতরী … ইত্যাদি।

রবীন্দ্র মানসে মহাকবি কালিদাসের গভীর প্রভাব। কবি যখন বলেন, ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে।’ তখন আষাঢ়ের ঐতিহাসিকতার কথা বলেন। কালিদাসের বর্ষা, রবীন্দ্র বর্ষার ঐতিহ্য। মেঘদূত কতটা নস্টালজিক করেছে তা আমরা বুঝি তাঁর ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধ থেকে।

রামগিরি হইতে হিমালয় পর্যন্ত প্রাচীন ভারতবর্ষের যে দীর্ঘ এক খন্ডের মধ্য দিয়া মেঘদূতের মন্দাক্রান্তা ছন্দে জীবনস্রোত প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে, সেখান হইতে কেবল বর্ষাকাল নহে, চিরকালের মতো আমরা নির্বাসিত হইয়াছি। সেই যেখানকার উপবনে কেতকীর বেড়া ছিল, এবং বর্ষার প্রাক্কালে গ্রামচৈত্যে গৃহবলিভুক্ পাখিরা নীড় আরম্ভ করিতে মহাব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল এবং গ্রামের প্রান্তে জম্বুবনে ফল পাকিয়া মেঘের মতো কালো হইয়াছিল, সেই দশার্ণ কোথায় গেল! আর, সেই-যে অবন্তীতে গ্রামবৃদ্ধেরা উদয়ন এবং বাসবদত্তার গল্প বলিত, তাহারাই বা কোথায়! আর, সেই সিপ্রাতটবর্তিনী উজ্জয়িনী! অবশ্য তাহার বিপুল শ্রী, বহুল ঐশ্বর্য ছিল, কিন্তু তাহার বিস্তারিত বিবরণে আমাদের স্মৃতি ভারাক্রান্ত নহে আমরা কেবল সেই যে হর্ম্যবাতায়ন হইতে পুরবধূদিগের বেশ সংস্কার থূপ উড়িয়া আসিতেছিল তাহারই একটু গন্ধ পাইতেছি এবং অন্ধকার রাত্রে যখন ভবনশিখরের উপর পারাবতগুলি ঘুমাইয়া থাকিত তখন বিশাল জনপূর্ণ নগরীর পরিত্যক্ত পথ এবং প্রকান্ড সুষুপ্তি মনের মধ্যে অনুভব করিতেছি, এবং সেই রুদ্ধদ্বার সুপ্তসৌধ রাজধানীর নির্জন পথের অন্ধকার দিয়া কম্পিতহৃদয়ে ব্যাকুলচরণক্ষেপে যে অভিসারিণী চলিয়াছে তাহারই একটুখানি ছায়ার মতো দেখিতেছি, এবং ইচ্ছা করিতেছে তাহার পায়ের কাছে নিকষে কনকরেখার মতো যদি অমনি একটুখানি আলো করিতে পারা যায়।

কালিদাসের মেঘদূতের দুটি অংশ পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ। পূর্বমেঘ যক্ষের বিরহপর্ব ও প্রকৃতির নানা বর্ণনা। যাকে ঠাকুর বলেন, অজ্ঞাত নিখিলের সহিত নবীন পরিচয়, এই হইল পূর্বমেঘ। মনে করাইয়া দেয়, অপরূপ সৌন্দর্যলোকের মধ্যে কোন্-একটি চিরজ্ঞাত চিরপ্রিয়ের জন্য মনকে উতলা করিয়া তোলে। অপরপক্ষে, যাত্রার অবসানে চিরমিলনের জন্য আশ্বাস দেয়, তাই উত্তরমেঘের সংবাদ।

সকল কবির কাব্যেরই গূঢ় অভ্যন্তরে এই পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ আছে। সকল বড়ো কাব্যেই আমাদিগকে বৃহতের মধ্যে আহ্বান করিয়া আনে ও নিভৃত দিকে নির্দেশ করে। প্রথমে বন্ধন ছেদন করিয়া বাহির করে, পরে একটি ভূমার সহিত বাঁধিয়া দেয়। প্রভাতে পথে লইয়া আসে, সন্ধ্যায় ঘরে লইয়া যায়। একবার তানের মধ্যে আকাশ-পাতাল ঘুরাইয়া, সমের মধ্যে পূর্ণ আনন্দে দাঁড় করাইয়া দেয়।

এই হলো রবীন্দ্রনাথের কালিদাস প্রীতির গভীর কারণ। কালিদাসের প্রকৃতি চেতনা রবীন্দ্রনাথ অধিকার করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বর্ষা ঋতুকে সবচেয়ে বড় করে দেখেছেন। বর্ষাকে সকল ঋতুর রানি বানিয়েছেন। বর্ষার প্রকৃতির প্রেমে পড়ে রবীন্দ্রনাথ কত না তত্ত্ববুদ্বুদ জন্ম দিয়েছেন। শূন্যতা, মৃত্যু, অহৈতুকী প্রেম তাঁকে আচ্ছন্ন করেছে।
বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বলিলে দোষ হয় না। তাহার নকিব আগে আগে গুরুগরু শব্দে দামামা বাজাইতে বাজাইতে আসে, মেঘের পাগড়ি পরিয়া পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয়। অল্পে তাহার সন্তোষ নাই। দিগ্বিজয় করাই তাহার কাজ। লড়াই করিয়া সমস্ত আকাশটা দখল করিয়া সে দিক্চক্রবর্তী হইয়া বসে। তমালতালী-বনরাজির নীলতল প্রান্ত হইতে তাহার রথের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, তাহার বাঁকা তলোয়ার খানা ক্ষণে ক্ষণে কোষ হইতে বাহির হইয়া দিগ্বক্ষ বিদীর্ণ করিতে থাকে, আর তাহার তৃণ হইতে বরুণবাণ আর নি:শেষ হইতে চায় না।

এইজন্য বর্ষা ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু। কেননা কবি গীতার উপদেশকে ছাড়াইয়া গেছে। তাহার কর্মেও অধিকার নাই, ফলেও অধিকার নাই, তাহার কেবলমাত্র অধিকার ছুটিতে কর্ম হইতে ছুটি, ফল হইতে ছুটি।

বর্ষা ঋতুটাতে ফলের চেষ্টা অল্প এবং বর্ষার সমস্ত ব্যবস্থা কর্মের প্রতিকূল। এইজন্য বর্ষায় হৃদয়টা ছাড়া পায়। ব্যাকরণে হৃদয় সে লিঙ্গই হউক, আমাদের প্রকৃতির মধ্যে সে যে স্ত্রীজাতীয় তাহাতে সন্দেহ নাই। এইজন্য কাজ-কর্মের আপিসে বা লোভ-লোকসানের বাজারে সে আপনার পাল্কির বাহির হইতে পারে না। সেখানে সে পর্দানশিন।

বিদ্যাপতি লিখিয়াছেন- মত্ত দাদুরী, ডাকে ডাহুকী, ফাটি পাওত ছাতিয়া। এই ব্যাঙের ডাক নববর্ষার মও ভাবের সঙ্গে নহে, ঘনবর্ষার নিবিড় ভাবের সঙ্গে বড়ো চমৎকার খাপ খায়।
আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় পঙ্কিল পথে লোক বাহির হয় নাই। মাঠে বহুদিন পূর্বে খেতের কাজ সমস্ত শেষ হইয়া গেছে। পুকুরে পাড়ির সমান জল। এইরূপ জ্যোতিহীন, গতিহীন, কর্মহীন, বৈচিত্র্যহীন, কালিমালিপ্ত একাকারের দিনে ব্যাঙের ডাক ঠিক সুরটি লাগাইয়া থাকে। তাহার সুর ঐ বর্ণহীন মেঘের মতো, এই দীপ্তিদৃশ্য আলোকের মতো, নিস্তব্ধ নিবিড় বর্ষাকে ব্যাপ্ত করিয়া দিতেছে; বর্ষার গম্ভীকে আবেগ ঘন করিয়া চারিদিকে টানিয়া দিতেছে।

শরৎ

আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা।

আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা
নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।।

রবীন্দ্রনাথ শরৎকে বলেছেন প্রাণধর্ম সম্পন্ন। বর্ষাকে বলেছেন হৃদয় ধর্মের অধিকারী। শরতের মধ্যে শিশুর ভাব। তার হাসি-কান্নার মতো এই শরৎ। ঐ হাসি-কান্নার কার্যকারণের গভীর কোনো কারণ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ছেলেদের হাসিকান্না প্রাণের জিনিস, হৃদয়ের জিনিস নহে। প্রাণ জিনিসটা ছিপের নৌকার মতো ছুটিয়া চলে, তাতে মাল বোঝাই নাই; সেই ছুটিয়া-চলা প্রাণের হাসিকান্নার ভার কম। হৃদয় জিনিসটা বোঝাই নৌকা; ধরিয়া রাখে, ভরিয়া রাখে, তার হাসিকান্না, চলিতে চলিতে ঝরাইয়া ফেলিবার মতো নয়।’
প্রকৃতিতে শরৎ এসেছে বুঝি কীভাবে? বর্ষার কানায় কানায় ভরা পাত্র থেকে যেন অনেকখানি জল কোথায় উধাও হয়ে গেছে। প্রকৃতি অতিরস থেকে গরম হয়ে ওঠে। গৃহবন্দি দশার অবসান হয়ে বাদলের শেষে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ আসে, শারদশশী মেঘের আড়ালে লুকায়। ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরির খেলা, কে যেন বিনা কারণে দূরে বাঁশি বাজায় ফলে কাশের গুচ্ছ মাথা নাড়ে, দোলে কারা যেন শেফালিমালা পরে শুভ্র মেঘের রথে চড়ে, শিশিরভেজা ঘাসে শিউলিফুলের গোলাপী রং যেন ভাতশালিকের পায়ের মতো, মেঠো ফুল মালতির বনে উঁকি দেয় মেঠো চাঁদ… ইত্যাদি।

শিলাইদহ থেকে ইন্দিরাদেবীকে লেখা এক চিঠিতে ১৮আগস্ট ১৮৯২) রবীন্দ্রনাথ জানান তাঁর শরতের অনুভূতি:
এমন সুন্দর শরতের সকাল বেলা! চোখের উপরে যে কী সুধা বর্ষণ করছে সে আর কী বলব। তেমনি সুন্দর বাতাস দিচ্ছে এবং পাখি ডাকছে। এই ভরা নদীর ধারে, বর্ষার জলে প্রফুল্ল নবীন পৃথিবীর উপর শরতের সোনালি আলো দেখে মনে হয় যেন আমাদের এই নবযৌবনা ধরণী সুন্দরীর সঙ্গে কোন-এক জ্যোতির্ময় দেবতার ভালোবাসা-বাসি চলছে তাই এই আলো এবং এই বাতাস, এই অর্ধ-উদাস অর্ধ-সুখের ভাব, গাছের পাতা এবং ধানের ক্ষেতের মধ্যে এই অবিশ্রাম স্পন্দন জলের মধ্যে এমন অগাধ পরিপূর্ণতা, স্থলের মধ্যে এমন শ্যামশ্রী, আকাশে এমন নির্মল নীলিমা।

শরৎকালের এই আকাশ, এই পৃথিবী, সকাল বেলাকার এই ঝিরঝিরে বাতাস এবং গাছপালা তৃণগুল্ম নদীর তরঙ্গ সকলের ভিতরকার একটি অবিশ্রাম সঘন কম্পন; সমস্ত মিশিয়ে বাতায়নবর্তী এই একক যুবকটিকে সুখে দুঃখে এক রকম অভিভূত করে ফেলছিল। পৃথিবীতে জানালার ধারে একলা বসে চোখে মেলে দেখলেই মনে নতুন নতুন সাধ জন্মায়-নতুন সাধ ঠিক নয়-পুরনো সাধ নানা নতুন মূর্তি ধারণ করতে আরম্ভ করে।

রবীন্দ্রনাথ শরৎ-কে স্বল্পায়ু বলেছেন। শরৎ-কে চেনা যায় প্রকৃতির মধ্যে তার স্বল্প আয়োজনের জন্য। ছোট ছোট ফসলের জন্যই পৃথিবীতে বার বার ঘুরে ঘুরে আসা। শরতের সম্ভার ঐ শিশিরাশ্রু শেফালিকা, কাশ-মেঘ, আর আগমনী উৎসবের তার সমাপ্তি।
শরৎ বড়ো গাছের ঋতু নয়, শরৎ ফসলখেতের ঋতু। এই ফসলের খেত একেবারে মাটির কোলের জিনিস। আজ মাটির যত আদর সেইখানেই হিল্লোলিত, বনসম্পত্তি-দাদারা এক ধারে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া তাই দেখিতেছে। এই ধান, এই ইক্ষু, এরা যে ছোটো, এরা সে অল্পকালের জন্য আসে, ইহাদের যত শোভা যত আনন্দ সেই দুদিনের মধ্যে ঘনাইয়া তুলিতে হয়।’ কিংবা আমাদের শরতে আগমনটাই ধুয়া। সেই ধুয়াতেই বিজয়ের গানের মধ্যেও উৎসবের তাল লাগিল। আমাদের শরতের বিচ্ছেদবেদনার ভিতরেও একটা কথা লাগিয়া আছে যে, বারে বারে নূতন করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে বলিয়াই চলিয়া যায়, তাই ধরার আঙিনায় আগমনী-গানের আর অন্ত পাই। যে লইয়া যায় সেই আবার ফিরাইয়া আনে। তাই সকল উৎসবের মধ্যে বড়ো উৎসব এই হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়ার উৎসব।

হেমন্ত

হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা—
হিমের ধন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা।

বৈশ্যবৃত্তির অন্তর্ভূক্ত রবীন্দ্র তিন ঋতু— শরৎ-হেমন্ত-শীত। তাঁর মতে, সমাজের নিচের বড়ো ভিত্তি ঐ বৈশ্য। বর্ষা, শরৎ যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে আলোড়িত করেছে, মনে হয় হেমন্ত তেমনটা পারে নাই। প্রকৃতি পর্বে মাত্র ৪/৫টি গান আছে হেমন্তকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বর্ষার কবি, নজরুল বসন্ত, আর জীবনানন্দ দাশ হেমন্ত ঋতুর কবি।

শরৎ ও শীতের মাঝখানে পড়ে একটা সংকর চরিত্র হেমন্ত ঋতুর। সে পুরা শরৎ না পুরা শীত। প্রকৃতিতে এর নিশ্চয় গভীরতর কারণ আছে। রবীন্দ্রভাবনায়-

এই অংশেই বাল্য যৌবন বার্ধক্যের তিন মূর্তিতে বৎসরের সফলতা মানুষের কাছে প্রত্যক্ষ হয়। শরতে তাহা চোখ জুড়াইয়া নবীন বেশে দেখা দেয়, হেমন্তে তাহা মাঠ ভরিয়া প্রবীণ শোভায় পাকে, আর শীতে তাহা ঘর ভরিয়া পরিণতি রূপে সঞ্চিত হয়।

ফলে হেমন্ত শরৎ-শীতের মধ্যে চিরকাল বাহকের ভূমিকা পালন করে। শরতের থেকে প্রাপ্তি পৌছে দেয় শীতের কাছে। শরতের মিহি শিশিরকে শীতে বড় আকার দিয়ে আমাদের চোখে পষ্ট ধরায়ে দেয়। শরতের মেঘকে শোষণ করে আকাশকে নীল করে তোলে যেন চন্দ্র তার ষোলকলায় নাচতে পারে। মাঠ সোনালি ধানে যেন পোয়াতি হয়ে ওঠে। নিভৃত, নির্জনতার ক্লান্ত নীরবতা নিজ ডানার তলায় নিয়ে কিছুকাল ঝিম মেরে বসে। হেমন্ত কার্তিকের অপরাহ্ন বেলায় হিজল পাতা ঝরায়, সবচেয়ে নিরব সন্ধ্যা এসে শালিকদের নিয়ে যায় ঘরে, তখন নাকে এসে লাগে শিশিরের মৃদু ঘ্রাণ।

শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে।
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়।

প্রকৃতির মধ্যে গ্রীষ্ম থেকে হেমন্ত পর্যন্ত যত ময়লা, ক্লান্তি, জরা জমে তা শীতের শরীরে স্তূপ হতে থাকে। শীত ঐ পুঞ্জীভূত জরা নিজ কাঁধে নিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়ে থাকে। জরা ধারণ করে শীত কিন্তু সে জরাক্রান্ত নয়। ভেতরে ভেতরে চলে নানা ভোগের আয়োজন। শরৎ ও হেমন্ত যতটা ত্যাগের শীত ততটাই ভোগের এবং কর্মময় ঋতু। শীতকে শূদ্র বর্ণের মধ্যে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ। শীতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
শরতে তাহা চোখ জুড়াইয়া নবীন বেশে দেখা দেয়, হেমন্ত তাহা মাঠ ভরিয়া প্রবীণ শোভায় পাকে, আর শীতে তাহা ঘর ভরিয়া পরিণতি রূপে সঞ্চিত।

শীত শেষ হওয়ার আগেই আমলকী পাতা ঝরে, শিউলিঝরা শেষ, তারাময় রাত, দুর্বা ঘাসে ঘাসে শিশির-তাতে সূর্যালোক লেগে চোখ ধাঁধানো সুন্দর মুক্তার পরে দূর্বা নুয়ে থাকে, কুয়াশায় ঢেকে রাখে দূরে গ্রাম-জীবনবৃক্ষ-সারি, মাঠে বেরুলে পা ভিজে যায়, লম্বা শীত রাত শেষ হওয়ার আগেই ক্ষুধায় গরুগুলো ডাকতে থাকে, উঠোনভর্তি ধান, মাঠভর্তি শাকসব্জির আবাদ, শর্ষে ফুলের হলুদে মৌমাছি গান গায়, ফসল-কাটার পর কোথাও শূন্য মাঠ, বাতাসে কৃষাণির ধান উড়ানোর দৃশ্য, শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লেপমুড়ি দিয়ে পড়ে থাকে প্রকৃতি কখন যে সূর্য উঠবে এই অপেক্ষায়। আজকের দিনে শীতের চেহারা গ্রাম বাংলায় এরকম নয়। বিদ্যুতায়ন ও স্যালো- মেশিন আসার পর শীতের চেহারা বদলে গেছে। শীতের সৌন্দর্য ও মোহটা এখনও মানুষের মনে আছে। সেই ছোটবেলাকার শীতটা কোথায় দূরে লেপমুড়ি দিয়ে আছে। আমাদের সাথে সেই শীতের কী আর কোনোদিন দেখা হবে না— একদিন একথা বলার জন্য কাউকে খুঁজতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অল্প কথায় শীতকে ধরেছেন:

আর শীতটা বৈশ্য। তাহার পাকাধান কাটাই-মাড়াইয়ের আয়োজনে চারটি প্রহরব্যস্ত, কলাই যব ছোলার প্রচুর আশ্বাসে ধরণীর ডালা পরিপূর্ণ। প্রাঙ্গনে গোলা ভরিয়া উঠিয়াছে, গোষ্ঠে গোরুর পাল রোমস্থ করিতেছে, ঘাটে ঘাটে নৌকা বোঝাই হইল, পথে পথে ভারে-মন্থর হইয়া গাড়ি চলিয়াছে; আর ঘরে ঘরে নবান্ন এবং পিঠাপার্বণের উদ্যোগে ঢেঁকিশালা মুখরিত।

বসন্ত

কে রঙ লাগানো বনে বনে।
ঢেউ জাগালে সমীরণে।।

 

এই মৌমাছিদের ঘর ছাড়া কে করেছে রে
তোরা আমায় বলে দে ভাই, বলে দেরে।।

বসন্ত যৌবনের ঋতু। ছয় ঋতুর মধ্যে মধ্যে বর্ষা, শীত ও বসন্তকে তাদের প্রাবল্যের তীক্ষ্ণতা ও বিশেষ বিশিষ্টতার জন্য একদম আলাদা করে চেনা যায়। প্রকৃতি নিজেই হাজির হয় নিজ বেশভূষা পরিবর্তন করে। অন্তরে-বাহিরে প্রকৃতির হিন্দোলের খেলা। একটু ধৈর্য নিয়ে বাহিরে তাকালে বসন্ত নিজেকে দেখায়। শীতের জীর্ণবাস ফেলে নতুন সাজে সজ্জিত। মনে হয় দেখি পরতে পরতে। ঐ যে আমের মঞ্জরি, দখিন বাতাস কোথা যায়, ঝুমকো লতার চিকন পাতা কাঁপছে কেন, পলাশ কানন ধৈর্য হারা কিশলয়, রঙের ঝড়ে কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে গায়, রোমান্টিক বনছায়ায় ফাগুনের চাঁদের আলো, অরণ্যের হৃদয় হিন্দোলে গুঞ্জন কল্লোলে মাতোয়ারা কে, অসীম আকাশে অশোক রেণু উড়ে উড়ে কী দেখছে, জলে স্থলে বনতলে কীসের দোল, শুকনো পাতা কেন ওড়ে, রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে কী বলতে চায়, দক্ষিণ দুয়ার খোলা কেন, মুকুলে ছেয়ে গেছে কেন বকুল বন, পুলকিত কেন আম্রবীথি বেণুবনের বাতাস মৌমাছিদের কিছু কী বলছে, মাধবী-বিতানে গন্ধ আহা আজ নবনব পল্লবরাজি কোথাও যেতে চাহে নাকি, শিরীষ হিন্দোলে কে যেন ঘর ছাড়া করছে মধুমঞ্জরীর রঙ ক্ষণে ক্ষণে যেন উঠানামা করছে, সবার মনে কিসের রাগ-রাগিনী, কেউ কী মিলন পিয়াসী তাই এত কানাকানি করছে, কালবৈশাখী নাচন কেন, নীল আকাশে সোনার আলোয় কবি পাতার নূপুর বাজছে কেন, প্রকৃতি উড়িবার যেন চায়, নিশীথে কে বাজায় বাঁশি দক্ষিণ বায়ু উদাসী বলে, পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে নবীন প্রাণের পত্র আসে; আর কে যেন কাঁদো-কাঁদো গাইছে—
ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে
অনেক হাসি অনেক অশ্রু জলে।
এই হলো বসন্তে প্রকৃতির নানা অস্থির চিত্ত চিত্র।

রবীন্দ্রনাথ বসন্তের উপলব্ধি লিখছেন এই ভাবে:
এই তো অল্প দিন হইল, আমাদের আমলকী মউল ও শালের ডাল হইতে খস্ খস্ করিয়া কেবলই পাতা খসিয়া পড়িতেছিল — ফাল্গুন দূরাগত পথিকের মতো যেমনি দ্বারের কাছে আসিয়া একটা হাঁফ ছাড়িয়া বসিয়াছে মাত্র অমনি আমাদের বনশ্রেণী পাতা খসানোর কাজ বন্ধ করিয়া দিয়া একেবারে রাতারাতিই কিশলয় গজাইতে শুরু করিয়া দিয়াছে।

প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের মনের সম্পর্ক আমরা এমনি করিয়াই ছেদন করিয়াছি। বসন্তে সমস্ত বনে উপবনে ফুল ফুটিবার সময় উপস্থিত হয়; তখন তাহাদের প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব। তখন আত্মদানের উচ্ছ্বাসে তরুলতা পাগল হইয়া উঠে; তখন তাহাদের হিসাবের বোধমাত্র থাকে না; যেখানে দুটো ফল ধরিবে সেখানে পঁচিশটা মুকুল ধরাইয়া বসে।

আমরা কি এতই একান্ত মানুষ। আমরা কি বসন্তের নিগূঢ় রস সম্ভার বিকশিত তরুলতা পুষ্প পল্লবের, কেহই নই। তাহারা যে আমাদের ঘরের আঙিনাকে ছায়ায় ঢাকিয়া, গন্ধে ভরিয়া, বাহু দিয়া ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া আছে, তাহারা কি আমাদের এতই পর যে, তাহারা যখন ফুলে ফুটিয়া উঠিবে আমরা তখন চাপকান পরিয়া আপিসে কোনো অনির্বচনীয় বেদনায় আমাদের হৃৎপিন্ড তরুপল্লবের মতো কাঁপিয়া উঠিবে না?
ছেলে বেলায় বসন্তের জ্যোৎস্নারাত্রে যখন ছাদে পড়ে থাকতুম তখন জ্যোৎস্না যেন মদের শুভ্র ফেনার মতো একেবারে উপচে পড়ে নেশায় আমাকে ডুবিয়ে দিত।

* * *

আমাদের এই শরীর পঞ্চভূতের ফাউন্ডেশন। পঞ্চভূতকে আশ্রয় করে আছে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়। আর আছে বিমূর্ত চার অন্তরিন্দ্রিয়। মূর্ত ও বিমূর্তের অবস্থিতির আধার এই শরীর। শরীরকে আশ্রয় করে আছে অন্তরিন্দ্রিয়, তাই সে যেন একই সাথে মূর্ত ও বিমূর্ত। আমার শরীর বাদে সবই বহির্জগৎ। তরঙ্গহীন শান্ত পুকুরে ঢিল ছুড়লে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তাই ভাব। ভাবকে তত্ত্ব নামে ডাকা হয়। যাতে কোনো বিকার ঘটে না, তাই তত্ত্ব।

ভাবের অভাব ঘটে কখনো। তখন সৃষ্টি আসে না। তখন লিখতে পারি না আমরা। যদি লিখি তা হবে অভাবজনিত লেখা। সেই লেখা ননসেন্স। ভাব অসীম, অসংখ্য হতে পারে। বৈষ্ণবগণ ব্যভিচারী ভাবকে তেত্রিশ প্রকারে ফেলেছেন। তার প্রথম ১০টি ভাবের নাম: নির্বেদ (বিয়োগ ও ঈর্ষা হেতু যে আত্মধিক্কার জন্মে), বিষাদ (কামনার ব্যর্থতা), দৈন্য (ভয় দু:খ ও অপরাধ জন্য দীনতা), গ্লানি (মনঃপীড়া, রাতজনিত ক্লান্ত), শ্রম (রাতশ্রম, নৃত্যশ্রম), মদ (মধুপানজনিত মত্ততা), গর্ব (রূপ, গুণ সৌভাগ্য প্রাপ্তি হেতু), শঙ্কা (অপরাধ, পরের ক্র্থরতা জনিত) ত্রাস (মেঘের শব্দ শ্রবণ, ভয়ানক কিছু দেখা জনিত), আবেগ (প্রিয় দর্শন, অপ্রিয়-দর্শন জনিত) ইত্যাদি। বর্হিজগৎ ও অন্তরিন্দ্রিয়-এর অভিঘাতে সৃষ্টভাব পঞ্চইন্দ্রিয়ের অধিকারে আসে রস হয়ে- তা কর্মেন্দ্রিয় মারফৎ ভাষায় আকার পায়।

ভাব থেকে রস, রস থেকে রূপে আকার লাভ করে। রস থেকে রূপে যেতে আরও অনেক কিছু যুক্ত হয় ধ্বনি মাধুর্য অলঙ্কার রীতি ছন্দ। বলা হয়ে থাকে তাই সাহিত্য রস যাহার আত্মা, ভাব যাহার শক্তি, শব্দ ও অর্থ-যাহার অবয়ব, ধ্বনি যাহার প্রাণ, মাধুর্যাদি যাহার গুণ, উপমাদি অলঙ্কার যাহার ভূষণ, রীতি যাহার অঙ্গ-সৌষ্ঠব, ছন্দ যাহার গতি। লেখক মাত্রই ভাবুক ও রসিক হতে হয়।

প্রকৃতি আমাদের শরীরের বাহিরে থেকে সারাক্ষণ আমাদের শরীরের ভেতরে উঁকি দেয়। যে ভাব বুঝে বা যার ভাবে তা ধরা পড়ে প্রকৃতি তাকে অধিকার করে। প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথকে ভাব-রসে অধিকার করেছিল তাঁর শৈশবেই। প্রকৃতি কতটা অধীর অস্থির করে ফেলেছিল তা বুঝা যায় তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে কিছু স্মৃতি-ছবি থেকে।

জল পড়ে পাতা নড়ে

যখন প্রয়োজন চুকিয়াছে, যখন পথিক তাহা পার হইয়া আসিয়াছে, তখনই তাহা ছবি হইয়া দেখা দেয়। জীবনের প্রভাতে সকল শহর এবং মাঠ, নদী এবং পাহাড়ের ভিতর দিয়া চলিতে হইয়াছে, অপরাহ্নে বিশ্রামশালায় প্রবেশের পূর্বে যখন তাহার দিকে ফিরিয়া তাকানো যায়, তখন আসন্ন দিবাবসানের আলোকে সমস্তটা ছবি হইয়া চোখে পড়ে।
শৈশব ছবি

সেই বারান্দায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশ হইতে অপরাহ্নের ম্লান আলো আসিয়া পড়িয়াছে। রামায়ণের কোনো-একটা করুণ বর্ণনার আমার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে দেখিয়া, দিদিমা জোর করিয়া আমার হাত হইতে বইটা কাড়িয়া লইয়া গেলেন।

অন্ধকার, নির্জনতা

পুষ্করিণী নির্জন হইয়া গেলে সেই বটগাছের তলটা আমার সমস্ত মনকে অধিকার করিয়া লইত। তাহার গুঁড়ির চারিধারে অনেকগুলো ঝুরি নামিয়া একটা অন্ধকারময় জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছিল। সেই কুহকের মধ্যে, বিশ্বের সেই একটা অস্পষ্ট কোনো যেন ভ্রমক্রমে বিশ্বের নিয়ম ঠেকিয়া গেছে।

ঘর ও বাহির

বাড়ির বাহিরে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল, এমন-কি, বাড়ির ভিতরেও আমরা সর্বত্র যেমন-খুশি যাওয়া-আসা করিতে পারিতাম না। সেইজন্য বিশ্ব-প্রকৃতিকে আড়াল-আবডাল হইতে দেখিতাম। বাহির বলিয়া একটি অনন্ত-প্রসারিত পদার্থ ছিল যাহা আমার অতীত, অথচ যাহার রূপ শব্দ গন্ধ দ্বার-জানালার নানা ফাঁক-ফুকর দিয়া এদিক-ওদিক হইতে আমাকে চকিতে ছুঁইয়া যাইত। সে যেন গরাদের ব্যবধান দিয়া নানা ইশারায় আমার সঙ্গে খেলা করিবার নানা চেষ্টা করিত। সে ছিল মুক্ত, আমি ছিলাম বদ্ধ— মিলনের উপায় ছিল না, সেইজন্য প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল।

স্মৃতি

তখনকার দিনে এই পৃথিবী বস্তুটার রস কী নিবিড় ছিল, সেই কথাই মনে পড়ে। কী মাটি, কী জল, কী গাছপালা, কী আকাশ, সমস্তই তখন কথা কহিত-মনকে কোনোমতেই উদাসীন থাকিতে দেয় নাই।

সন্ধ্যা

যখন সন্ধ্যা হইয়া আসিত পিতা বাগানের সম্মুখে বারান্দায় আসিয়া বসিতেন। তখন তাঁহাকে ব্রহ্মসংগীত শোনাইবার জন্য আমার ডাক পড়িত। চাঁদ উঠিয়াছে, গাছের ছায়ার ভিতর দিয়া জ্যোৎস্নার আলো বারান্দার উপর আসিয়া পড়িয়াছে, আমি বেহাগে গান গাহিতেছি—
তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে
কে সহায় ভব-অন্ধকারে।

পাহাড়

যেখানে পাহাড়ের কোনো কোণে, পথের কোনো বাঁকে, পল্লবভাবাচ্ছন্ন বনস্পতির দল নিবিড় ছায়া রচনা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং ধ্যানরত বৃদ্ধ তপস্বীদের কোলের কাছে লীলাময়ী মুনিকন্যাদের মতো দুই-একটি ঝরনার ধারা সেই ছায়াতল দিয়া শৈবালাচ্ছন্ন কালো পাথরগুলার গা বাহিয়া ঘনশীতল অন্ধকারের নিভৃত নেপথ্য হইতে কুলকুল করিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে, সেখানে, ঝাঁপানিয়া ঝাঁপান নামাইয়া বিশ্রাম করিত। আমি লুব্ধভাবে মনে করিতাম, এ-সমস্ত জায়গা আমাদিগকে ছাড়িয়া যাইতে হইতেছে কেন। এইখানে থাকিলেই তো হয়।

শূন্য


আমি জানি ছন্দের যে অংশটাকে যতি বলে অর্থাৎ যেটা ফাঁকা, অর্থাৎ ছন্দের বস্ত-অংশ যেখানে নেই, সেইখানেই ছন্দের প্রাণ-পৃথিবীর প্রাণটা যেমন মাটিতে নহে, তাহার বাতাসেই ।

যাহারা বস্তুর কারবার করিয়া থাকে তাহারা সেটাকে অবস্তু ও শূন্য বলিয়া মনে করে সেটা কম জিনিস নয়। লোকালয়ের হাটে ভূমি বিক্রি হয়, আকাশ বিক্রি হয় না। কিন্তু পৃথিবীর বস্তুপিণ্ডকে ঘেরিয়া সে বায়ুমণ্ডল আছে, জ্যোতির্লোক হইতে আলোকের দূত সেই পথ দিয়াই আনাগোনা করে। পৃথিবীর সমস্ত লাবণ্য ঐ বায়ুমণ্ডলে। ঐখানেই তাহার জীবন। ভূমি ধ্রুব, তাহা ভারী, তাহার একটা হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে সে কত পাগলামি তাহা বিজ্ঞলোকের অগোচর নাই। তাহার মেজাজ কে বোঝে। পৃথিবীর সমস্ত প্রয়োজন ধুলির উপরে; কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত সংগীত ঐ শূন্যে, যেখানে তাহার অপরিচ্ছিন্ন অবকাশ। রবীন্দ্রনাথ ঋতুকে জড়িয়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়েছেন। নির্জনতা, মৃত্যু, আলো-ছায়া, স্মৃতি, ছবি, দৃশ্য রচনা, সন্ধ্যার নীরবতা, শূন্য ও শূন্যতা, মৃত্যু, সম্পর্ক এইসব নানাবিধ বিষয়কে ছুঁয়ে প্রকৃতি ছবি তুলেছেন তাঁর ছিন্ন পত্রাবলীর পত্রে। আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে দার্জিলিং, শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর, কটকে, কলকাতায় অবস্থান কালে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাদেবীকে ১৮৮৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৯৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কিছু চিঠি লেখেন। তবে শিলাইদহ ও সাজাদপুর পর্বে লিখিত পত্রগুলোতে কবির প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সংবেদনশীল অনুভূতি পাওয়া যায়। এখানে নমুনা আকারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছি।
বিষাদ

আমি বসে বসে ভাবছিলুম, আমাদের দেশের মাঠঘাট আকাশ রোদ্দুরের মধ্যে এমন একটা সুগভীর বিষাদের ভাব কেন লেগে আছে? তার কারণ এই মনে হল, আমাদের দেশে প্রকৃতিটা সব চেয়ে বেশি চোখে পড়ে— আকাশ মেঘমুক্ত, মাঠের সীমা নেই, রৌদ্র ঝাঁ ঝা করছে, এর মধ্যে মানুষকে অতি সামান্য মনে হয়— মানুষ আসছে এবং যাচ্ছে, এই খেয়া নৌকোর মতো পারাপার হচ্ছে, তাদের অল্প অল্প কলরব শোনা যাচ্ছে, এই সংসারের হাটে ছোটোখাটো সুখ-দুঃখের চেষ্টায় একটুখানি আনাগোনা দেখা যায়— কিন্তু এই অনন্ত প্রসারিত প্রকাণ্ড উদাসীন প্রকৃতির মধ্যে সেই মৃদুগুঞ্জন, সেই একটু-আধটু গীতধ্বনি, সেই নিশিদিন কাজকর্ম কী সামান্য, কী ক্ষণস্থায়ী, কী নিষ্ফল কাতরতা-পূর্ণ মনে হয়। (সাজাদপুর, ২৩ জুন ১৮৯১)

মৌনতা

এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে সেই আমার একটি মানসিক ঘরকন্নার সম্পর্ক, সেই একটি অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা আছে— যা ঠিক আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। সেটা যে কতখানি সত্য তা বললেও কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। জীবনের সে গভীরতম অংশ সর্বদা মৌন এবং সর্বদা গোপন-সেই অংশটি আস্তে আস্তে বের হয়ে এসে এখানকার অনাবৃত সন্ধ্যা এবং অনাবৃত মধ্যাহ্নের মধ্যে নীরবে এবং নির্ভয়ে সঞ্চরণ করে বেড়িয়েছে। এখানকার দিনগুলি তার সেই অনেক কালের পদচিহ্ন-দ্বারা যেন অঙ্কিত।

আমাদের দুটো জীবন আছে- একটা মনুষ্যলোকে, আর একটা ভাবলোকে। সেই ভাবলোকের জীবনবৃত্তান্তের অনেকগুলি পৃষ্ঠা আমি এই পদ্মার উপরকার আকাশে লিখে গেছি। (শিলাইদহ, ৮ আগষ্ট ১৮৯৪)।

দুপুর ও নিস্তব্ধতা

দুপুরবেলাটিও খুব নিস্তব্ধ এবং গরম এবং শান্ত এবং স্থির হয়ে আছে- খুব ছেলেবেলায় ইস্কুলে একটার সময় ছুটি হলে নির্জন ক্লাসে জানালার কাছে বসে, কলকাতার বাড়িগুলোর শূন্য নিস্তব্ধ ছাদ-শ্রেণীর দিকে চেয়ে এবং বহুদূর আকাশের চিলের তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুনে যে রকম মন-কেমন করতে থাকত, আজও ঠিক সেই রকম ভাবটা মনে উদয় হয়েছে। (শিলাইদহ ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫)

মৃত্যু

আমার সঙ্গে এই বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পরমাণুর বাস্তবিক কোনো জাতিভেদ নেই, সেই জন্যেই এই জগতে আমরা একত্রে স্থান পেয়েছি-নইলে আমাদের উভয়ের জন্যে দুই ভিন্ন জগৎ সৃজিত হয়ে উঠত। আমি যখন মাটির সঙ্গে মাটি হয়ে যাব, তখনও আমার অনন্ত প্রাণময় বিশ্বাত্মীয়ের সঙ্গে বন্ধন বিচ্ছিন্ন হবে না— আমি আমার নিজের ভিতরকার সহজ আনন্দ থেকে এইটে অনুভব করি। (শিলাইদহ, ২৩ আগষ্ট ১৮৯৫)
আকাশ ও আলো

যেন প্রকৃতি কুতুহলী পাড়াগেঁয়ে মেয়ের মতো সর্বদাই আমার জানালা-দরজার কাছে উঁকি মারছে। আমার ঘরের এবং মনের আমার কাজের এবং অবসরের_ চারিদিকে প্রসন্ন, প্রফুল্ল, সরস এবং সজীব, নবীন এবং সুন্দর হয়ে আছে। এই বর্ষণমুক্ত আকাশের আলোকে এই গ্রাম এবং জলের রেখা, এপার এবং ওপার, খোলা মাঠ এবং ভাঙ্গা রাস্তা,

আমি আকাশ এবং আলো এত অন্তরের সঙ্গে ভালোবাসি! আকাশ আমার সাকী, নীল স্ফটিকের স্বচ্ছ পেয়ালা উপুড় করে ধরেছে, সোনার আলো মদের মতো আমার রঙের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমাকে দেবতাদের সমান করে দিচ্ছে।

এই আকাশের মধ্যে আমি একটি সুগভীর নিস্তব্ধ অন্তরঙ্গ ভালোবাসা এবং অনন্ত শান্তির সম্পূর্ণ সান্ত্বনা অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে সর্বাঙ্গে এবং সর্বমনে অনুভব করি। এই আকাশের ভাণ্ডার, এই আলোক, এই শান্তি কখনো ফুরোবে না— আমার সঙ্গে বরাবর যদি ঐ সুনীল নির্মল জ্যোতির্ময় অসীমতার এই রকম অব্যবহিত প্রত্যক্ষ যোগ থাকে তাহলে আমার জীবন কখনোই সম্পূর্ণ নীরস হবে না। (সাজাদপুর, ২ জুলাই ১৮৯৫)

শূন্যতা

কিন্তু ভূমির শূন্যতাকে সবচেয়ে বেশি শূন্য বলে মনে হয়— কোথাও গতি নেই, জীবন নেই, বর্ণের বৈচিত্র্য নেই, কোমলতার আভাসটুকু মাত্র নেই— যেখানে শস্যে তৃণে তরুলতায় পশুপক্ষীতে ভরে যেতে পারত সেখানে একটি কুশের অঙ্কুর পর্যন্ত নেই-কেবল একটা উদাস কঠিন অসীম বৈধব্যেও বন্ধ্যাদশা— পাশ দিয়ে পদ্মা নদী চলে যাচ্ছে, ওপারে ঘাট, বাঁধা নৌকো, স্নানরত লোকজন, নারকেল এবং আমের বাগান— সন্ধ্যাবেলায় নদীর ধারের হাট থেকে কলধ্বনি শোনা যায়, বহুদুরে পাবনার পারের তরুশ্রেণী ঘননীল রেখার মতো দেখা যায়— কোথাও গাঢ়নীল, কোথাও পাণ্ডুনীল, কোথাও সবুজ, আর মাঝখানে এই রক্তহীন মৃত্যুর মতো ফ্যাকাশে শাদা-নিস্তব্ধ নিশ্চেষ্ট জনহীন। (শিলাইদহ, ২৮ নভেম্বর, ৮৯৪)।

দুপুর

এখানে যেমন আমার মনে লেখবার ভাব এবং লেখবার ইচ্ছা আসে এমন আর কোথাও না। বাইরের জগতের একটা জীবন্ত প্রভাব আমার সমস্ত মুক্ত দ্বার দিয়ে অবাধে প্রবেশ করতে থাকে-আলোতে আকাশে বাতাসে শব্দে গন্ধে সবুজহিল্লোলে এবং আমার মনের নেশায় মিশিয়ে অনেক রকম গল্প তৈরি হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষত এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে বড়ো একটি নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের বিশেষত কাকের ডাক এবং সুদীর্ঘ সুন্দর অবসর সব-শুদ্ধ জড়িয়ে আমাকে ভারী উদাস এবং আকুল করে। (সাজাদপুর ৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪)

মহাকাশ

মনে আছে যখন শিলাইদহে কাছারি করে সন্ধেবেলায় নৌকা করে নদী পার হতুম এবং রোজ আকাশে সন্ধ্যাতারা দেখতে পেতুম, আমার ভারী একটা সান্ত্বনা বোধ হত— ঠিক মনে হত আমার নদীটি যেন আমার ঘর সংসার এবং আমার সন্ধ্যাতারাটি আমার এই ঘরের গৃহলক্ষ্মী, আমি কখন কাছারি থেকে ফিরে আসব এই জন্যে সে উজ্জ্বল হয়ে সেজে বসে আছে।

আজ তাই বাতি নিবিয়ে দিয়ে বাইরে কেদারা নিয়ে অন্ধকারে বসেছিলুম— আকাশের সমস্ত জ্যোতির্জগৎ, সমস্ত লোকলোকান্তর, অনন্ত রহস্যের অন্তঃপুরবাসিনী মেয়ের দলের মতো উপরের তলার খড়খড়ি থেকে আমাকে দেখছিল— আমি তাদের কিছুই জানি নে এবং কোনোকালেই জানতে পাব কিনা তাও জানি নে— অথচ ঐ জ্যোতির্মণ্ডলীর মধ্যে বিচিত্র জীবনের অনন্ত ইতিহাস প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। (পতিসর, ২৪মার্চ, ১৮৯৪)

মেঘ

ইতিমধ্যে দেখছি খুব ফুলো ফুলো বড়ো বড়ো কতকগুলো মেঘ চতুর্দিক থেকে জমে এসেছে— আমার এই চারিদিকের দৃশ্যপট থেকে কাঁচা সোনালি রোদ্দুরটুকু যেন মোটা মোটা ব্লটিং প্যাড দিয়ে একেবারে চুপসে তুলে নিয়েছে। (শিলাইদহ, ১০ মে ১৮৯৩)

রাত্রি

কিন্তু আমার এই নিস্তব্ধ রাত্রি ছাড়া আর কিছুই নেই। একলা বসে বসে আমি যে এর ভিতরে কী অনন্ত শান্তি এবং সৌন্দর্য দেখতে পাই সে আর ব্যক্ত করতে পারি নে। একদল আছে তারা ছট্ফট্ করে ‘জগতের সকল কথা জানতে পারছি  নে কেন’, আর একদল ছট্ফটিয়ে মরে ‘মনের সকল ভাব প্রকাশ করতে পারছি নে কেন’- মাঝের থেকে জগতের কথা জগতেই থেকে যায় এবং অন্তরের কথা অন্তরেই থাকে। (সাজাদপুর; ২২ জুন ১৮৯১)

সন্ধ্যা

দুপুর বেলা খুব এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তারপরে বিকেলে পদ্মার ধারে আমাদের নারকোল-বনের মধ্যে সূর্যাস্ত হল। আমি নদীর ধারে উঠে আস্তে আস্তে বেড়াচ্ছিলুম। আমার সামনের দিকে দূরে আমবাগানে সন্ধের ছায়া পড়ে আসছে এবং আমার ফেরবার মুখে নারকোল গাছগুলির পিছনে আকাশ সোনায় সোনালি হয়ে উঠেছে। পৃথিবী যে কী আশ্চর্য সুন্দরী এবং কী প্রশস্ত প্রাণ এবং গভীরভাবে পরিপূর্ণ তা এইখানে না এলে মনে পড়ে না। যখন সন্ধেবেলা বোটের উপর চুপ করে বসে থাকি, জল স্তব্ধ থাকে, তীর আবছায়া হয়ে আসে, এবং আকাশের প্রান্তে সূর্যাস্তের দীপ্তি ক্রমেক্রমে ম্লান হয়ে যায়, তখন আমার সর্বাঙ্গে এবং সমস্ত মনের উপর নিস্তব্ধ নতনেত্র প্রকৃতির কী-একটা বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ অনুভব করি! কী শান্তি, কী স্নেহ, কী মহত্ত্ব কী অসীম করুণাপূর্ণ বিষাদ! এই লোকনিলয় শস্যক্ষেত্র থেকে ঐ নির্জন নক্ষত্রলোক পর্যন্ত একটা স্তম্ভিত হৃদয়রাশিতে আকাশ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, আমি তার মধ্যে অবগাহন করে অসীম মানসলোকে একলা বসে থাকি— কেবল মৌলবীটা পাশে দাঁড়িয়ে অবিশ্রাম বক্ বক্ করে আমাকে ব্যথিত করে তোলে। (শিলাইদহ, ১ অক্টোবর ১৮৯১)

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top