চাঁদ, প্রজাপতি ও জংলি ফুলের সম্প্রীতি-২

মাসুদ খান

(পূর্বপ্রকাশিত-র পর)

আফিম-খেতের হাওয়া…

একজন লোক। খুবসম্ভব কোনো ওষুধ কোম্পানির বিক্রয়-প্রতিনিধি। নতুন এসেছেন এ শহরে। হয়তো দূরের কোনো শহর থেকে। হাতে ব্যাগ। সন্ধ্যার পর শ্যামলী-তে আহার সেরে বাইরে এসে আরাম করে পান চিবাচ্ছেন। তাম্বুলরসে রঞ্জিত তার মন ও মুখ। চোখেমুখে ফুর্তি-ফুর্তি ভাব। লম্বা জাহাজের মতো এক সিনেমা হল। উত্তরা হল। লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী বালকের মতো সিনেমার বড়-বড় পোস্টার দেখছেন। দেখছেন তাকিয়ে তাকিয়ে চারদিক। হাসি-হাসি মুখ। যেন সর্ব-অঙ্গ দিয়ে বোধ করছেন পুলক ও পবিত্রতা। আমাদের শিবলী, কবি শিবলী মোকতাদির, হঠাৎ কোত্থেকে এসে জানা-নাই-শোনা-নাই আচমকা কী-কী যেন বলছে অচেনা লোকটাকে, মিটিমিটি হেসে হেসে- জানেন, জানেন, খবর শুনছেন, নানান দেশ থেকে, গাইবান্ধা সিলেট রংপুর রাজশাহি বগুড়া বাঁকুড়া ব্রেমেন বাস্তিল বীরভূম থেকে সব কবি-সাহিত্যিকরা আইসা বলা-নাই-কওয়া-নাই পথিকের বাসায় উঠতেছে। আরে পথিক মানে… চিনলেন না! ওই যে, কামরুল হুদা পথিক, গল্পকার পথিক, গল্পকার চিনলেন না? গল্প করে যে…গল্পকার…উপপদ তৎপুরুষ, আরে তৎপুরুষ বুঝলেন না? তাহার পুরুষ… তৎপুরুষ, ষষ্ঠী তৎপুরুষ… যাঃ শালার তৎপুরুষ তো দেখতেছি নিজেই এক তৎপুরুষ সমাস! আসলে কি জানেন, বাংলা এক আজব ভাষা, এক মজার ভাষা… এই ধরেন সমাস, ধরেন-ধরেন, ধরেন-না! …ধরছেন তো! ব’লে কাল্পনিক কিছু একটা লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শিবলী বলে যেতে থাকে- দুই গু-য়ের সমাহার… বলেন তো কী? আহ্ হা! পারলেন না… আবার আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বাজিয়ে গুনগুন করে গাইতে থাকে… উল্লুকেরও থাকিতে নয়ন… এটুকু গাওয়ামাত্র লোকটা ঘাবড়ে যায়, ভাবে, তাকেই বোধহয় উল্লুক বলছে… তো শিবলী গাইতে গাইতেই ইশারায় লোকটাকে আশ্বস্ত করে, বলে, “না-না আপনাকে না, এটা তো গান, এমনি-এমনিই গাই আর কি!” বলেই ফের শুরু করে দেয়- উল্লুকেরও থাকিতে নয়ন/ না দ্যাখে সে রবিরও কিরণ/ কী কবো দুঃখেরো কথা… সে-জন ভাব জানে না-হা/ সে-জন মানিক চেনে না/ যে-জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সাথে নাই লেনা-দেনা/ খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা, সে-জন সোনা চেনে না//। এতখানি গাইবার পরও তার ওপর লোকটার পুরাপুরি একিন আসে নাই দেখে শিবলী আরেকটা গান শুরু করে- তোর নামের ভরসা ক’রে তরী দিলাম ছেড়ে…/ একবার হাইল ধরিয়া বইসো গুরু ভাঙা তরীর ’পরে রে/ অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে… তো, দুই গু-য়ের সমাহার…দ্বিগু…আচ্ছা দ্যাখেন তো কী কীর্তি! দ্বিগু নিজেই দ্বিগু সমাস… হাঃ হাঃ হাঃ কী তামশা!… আবার দ্যাখেন, কর্মধারয়… ব্যাসবাক্য কী?… কর্ম যে ধারয়… কর্মধারয়… (ঠিক হইতেছে তো!)… হাহ্, কর্মধারয় নিজেই এক কর্মধারয়… আবার ধরেন বহুব্রীহি…বহুব্রীহি আছে যাহার… বহুব্রীহি নিজেই এক বহুব্রীহি সমাস…! আবার দ্যাখেন, অব্যয়-অব্যয় ভাব…অব্যয়ীভাব! আর যেন কী আছে? তৎপুরুষ। ও হো…তৎপুরুষ তো আগেই বললাম। তো দেখলেন তো, কী তামশা! সব ফকফকা! আর যেন কী! ও, দ্বন্দ্ব…দ্বন্দ্ব সমাস… এইবার দ্বন্দ্বে এসে পড়লাম তো বেশ ধন্দে। মোরে কূলে রাইখা বারেবার/ না যাইয়ো গাঙ্গেতে আর// সাথে সাথে নিয়ো তুমি নৌকাতে/ নাও বাইয়ো না মাঝি বিষম দইরাতে// কলোকলো ছলোছলো নদী করে টলোমলো/ ঢেউ ভাঙে ঝড়-তুফানে রে…/ নাও বাইয়ো না মাঝি বিষম দইরাতে//। তো যা বলতেছিলাম, সেই পথিক, গল্পকার পথিক, লিটল ম্যাগ সম্পাদক পথিক। ইদানীং খালি সায়েন্স ফিকশন ছাপাইতে চায় তার লিটল ম্যাগে…খালি বলে সাই-ফিক, সাই-ফিক… অবশ্য কবিতাও ছাপাইব…তো, তার বাসাটা তো এক্কেরে থইথই করতেছে, একদম ভর্তি দেশী-বিদেশী কবিসাহিত্যিক দিয়া! মাটির মসজিদের পাশে বাসা। জানেন, চা বানাতে বানাতে ভাবী একেবারে হিমশিম খাইতেছে। (ফের দুলে-দুলে গাইতে থাকে…) পিরিত যতন, পিরিত রতন, পিরিত গলার হার/ পিরিত কাঞ্চন পাইল যে-জন, পিরিত কাঞ্চন পাইল যে-জন, সফল জনম তারো রে/ দুনিয়া পিরিতের বাজার// শেষে শুধু গান আর গান… গানের জোয়ার… অচেনা লোকটাও গুনগুন করে তাল দিতে থাকে আস্তে আস্তে- ক্যালন মাছের ত্যালন-ত্যালন, তেইল্যা মাছের গোসা/ নতুন মাইয়ার বুড়া জামাই, নতুন মাইয়ার বুড়া জামাই/ নিত্যই করে গোস্সা গো/ দুনিয়া পিরিতের বাজার…//  (ফের…) কই মজে কইয়ের ত্যালে, মাগুর মজে ঝোলে/ রসিক মরে প্রেমের জ্বালায়, রসিক মরে প্রেমের জ্বালায়/ ফড়িং মরে ফান্দে গো// রঙ্গের নাও রঙ্গের বৈঠা…/

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, শিবলী অনর্গল বলে যাচ্ছে আর তুড়ি বাজাতে বাজাতে গুনগুন করে গাইছে, আর আগন্তুক লোকটা শিশুর বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে সব শুনছেন। কোনো অপ্রস্তুত ভাব নাই। বরং খুব খুশি-খুশি লাগছে তাকে।

লোকটার কাছে সবকিছু অপূর্ব-অপূর্ব লাগছে। ওই জাহাজের মতো লম্বা সিনেমা হল- তার সাতরঙা পোস্টার, সাতরঙা হোর্ডিং, অচেনা এক শিবলীর কাছ থেকে আচমকা অপ্রত্যাশিত সব তথ্যপ্রাপ্তি, স-ব, সবকিছু… দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, শুনছেন, আর মিটিমিটি হাসছেন।

আকবরিয়া মার্কেট। পড়ুয়া। বইয়ের দোকান। কবি শোয়েব শাহরিয়ারের। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তখন। শহরের নানান জায়গা থেকে তরুণ কবিরা, ছোট কাগজের সম্পাদকেরা, কবিযশোপ্রার্থীরা ধীরে ধীরে এসে জড়ো হচ্ছে পড়ুয়া-র সামনে। আড্ডা হচ্ছে তুমুল, কখনো পড়ুয়া-র সামনে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই, কখনো শ্যামলী-তে, কখনো আকবরিয়া-য়, কখনো এশিয়া-য়, মিষ্টির দোকানে, মিষ্টি খুব পছন্দ কবিদের, কখনোবা তৃষা-য়। আকবরিয়া এলাকাটা যেন শহরের হৃৎপিণ্ড, এই ছোট্ট স্বপ্নসম্ভব শহরের! আ স্মল বিউটিফুল হার্ট দ্যাট অলওয়েজ থ্রব্ স্!

আজ বৃহস্পতিবার। ওই যে এক দীর্ঘকায় ছিপছিপে তরুণ। মাহমুদ হোসেন পিন্টু। কী এক অচেনা নেশায়, অজানা আকর্ষণে তিব্বতি ছোরার মতো দুধারে বাতাস কেটে কেটে হনহন করে হেঁটে আসছে পড়ুয়া-র সান্ধ্য আড্ডার দিকে। যেন একরকম ছুটেই আসছে! কাঠের আসবাবের দোকান তাদের। বনানী ফার্নিসার্স। এখন সন্ধ্যা বৃহস্পতিবারের। কাল বন্ধ। কাল ছুটি। পড়ুয়া-র বাঁশির সুর কানে এসে বাজছে, মন একেবারে উন্মন হয়ে আছে। প্রাণ পিপাসিত হয়ে আছে ওই সান্ধ্য আড্ডার জন্য। তরল্লা বাঁশেরও বাঁশি ছিদ্র গোটা ছয়/ বাঁশি কতই কথা কয়/ আমার নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি রহনো না যায়/ প্রাণসখীরে, ওই শোন কদম্বতলায় বংশী বাজায় কে// সন্ধ্যা হয়ে আসছে আর তার সেই কাঠের ছোট্ট অরণ্যে, বিচিত্র সাইজ-করা সব কাষ্ঠখণ্ডে, বার্নিশবিহীন অসমাপ্ত আসবাবের কাঠামোতে গজিয়ে উঠছে ঝলমলে পাতা ও পল্লব। প্রাণ পাগল হয়ে যায়। সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি শ্রমিকদের সপ্তাহের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে, হিসাবনিকাশ সেরেই দে ছুট…

আরো একজন। বিপরীত দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন পড়ুয়া-র দিকে। সরকার আশরাফ। কথাকার। ‘নিসর্গ’-র সম্পাদক। চেহারাটা বেশ রাফ অ্যান্ড টাফ। প্রেস থেকে এলেন। পায়ে ধুলা, চুলেও ধুলা উড়ছে। লিটল ম্যাগাজিন তার ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা…।

(চলবে…)

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top