নাদিয়া আনজুমন এর কবিতা

কবি পরিচিতি:

আফগানিস্তানের কবি নাদিয়া আনজুমন (১৯৮০—২০০৫) এর জন্ম হিরাতে। দশম শ্রেণীর ছাত্রী নাদিয়াকে বালিকা বিদ্যালয় ত্যাগ করে পর্দার অন্তরালে যেতে হয় তালেবানী শাসন নারী-শিক্ষা সাফ হারাম ঘোষণা দিলে। অতঃপর কবি ‘সোনালি সেলাই চক্র’ বলে খ্যাত মেয়েদের কাপড় সেলাই এর ছদ্মাবরণে সংগঠিত সাহিত্য বিষয়ক আন্ডারগ্রাউন্ড স্টাডি সার্কেলের সদস্য হন । তালেবানী শাসন বিলোপের পর, হিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ছাত্রী থাকাবস্থায় প্রকাশ করেন তাঁর পয়লা কাব্যগ্রন্থ “গুল-ই-দোদি”, বা ”আন্ধার প্রসূন”। বিবাহিত হন হিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীয়ান ফরিদ আহমদ মাজিদ নেইয়া এর সাথে। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে কিছু বিষয়বস্তু নিয়ে স্বামী তীব্র আপত্তি জানান। সূত্রপাত হয় দাম্পত্য কলহের। ঈদের দিন কবি নাদিয়া কবিতার মাইফেলে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে স্বামী পর্দার অজুহাতে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। ওই দিন কলহের এক পর্যায়ে স্বামীর তীব্র প্রহারে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তিনি নিহত হন। ২০০৭ সালে তাঁর কবিতা সমগ্র প্রকাশিত হয় ইরান থেকে। উপস্থাপিত কবিতাগুলো দারী ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদে সহায়তা করেছেন কাবুল এজুকেশন ইউনিভারসিটির মোসাম্মাৎ ফিরিশতা সমন্দর।

 

আফগান দুহিতা

কীসের কবিতা?
কী আমি পাঠ করবো বলো—
ইচ্ছে হয় না মুখ খুলতে,
ঘৃণা করেছে সরবে সমাজ
সমকাল দেবে না আমাকে
মাথা তুলতে।

কীভাবে করবো আমি প্রতিবাদ?
ঠোঁটে ছোঁয়াতে চাই যে মধু
বিষ তা— মুখে লাগে বিস্বাদ।

যারা রুদ্ধ করেছে আমার বাকস্ফূর্তি
কীভাবে জানাই ধিক্কার?
বাস করছি এমন এক দুনিয়ায়
শুভার্থীও নেই কোন— তারিফ করার।

আমি কাঁদি কিংবা হাসি
যায় আসে না কারো কিছু,
যদি-বা হয় আমার মরণ,
বন্ধ করে দেয়াই সমুচিত
বিশেষ বাচনভঙ্গি
আমার কবিতা পাঠের ধরন।

বন্দী আমি আমারই অনুশোচনার
রুদ্ধ হয়েছে সম্ভাবনার সকল দুয়ার,
আমি জানি— বসন্ত, আমার আনন্দের ঋতু
হয়েছে অতিক্রান্ত
ডানা কাটা… কীইবা করতে পারি
আমি পরিশ্রান্ত।

কিন্তু যাইনি ভুলে হৃদয়ের কথা
বিন্দু বিন্দু করে আমার নিজস্ব সিন্ধুতে
জমা হচ্ছে সঙ্গীতের প্রবাল
আমার সমুদ্রতলে বেজে যাচ্ছে
গহন অতলে সুর হামেহাল।

আমারও আসবে সুদিন
ভাঙ্গবো খাঁচা— দিলখোলা এক প্রান্তরে
গাইবো আমি গান
সুর জ্বলে যায় অন্তরে।

সহিষ্ণু বৃক্ষ এক—
আমার পত্রালিতে ঝলমল করে
সূর্যের সবুজ দর্পণ,
অবরুদ্ধ হবো—
নিষ্পেষিত হবে আমার অন্তর,
তবু করবো না আমি আত্মসমর্পণ।

আফগান দুহিতা আমি
শিকড় আমার অনেক গভীরে প্রোথিত,
ক্রমাগত ক্রন্দনই আমার নসীব
কেঁদে যাবো নিয়ত।

 

এখন গভীর রাত

কিছু ধারনা উদ্ভাসিত হচ্ছে আমার কাছে
এখন গভীর রাত,
কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে শব্দের প্রপাত,
পুড়ছি আমি— অন্তরে ঝলকাচ্ছে
লোহিতে নীল হয়ে আসা অনল,
প্রজ্বলিত হচ্ছে অনিকেত অগ্নি
জানি না কীভাবে জুড়াবো— কোথায় পাবো জল?

আমার শরীর ছাপিয়ে উঠে আসছে আত্মার সৌরভ
ঠিক জানি না কোথায় এ শব্দরাজির উৎসমূল,
আমাতে প্রগাঢ় হচ্ছে অনুভব।
উপে যাচ্ছে নিঃসঙ্গতা- বইছে সুবাতাস
মেঘমালায় ঝলসাচ্ছে বিজরি,
দূরাগত হচ্ছে আমার হৃদয়ের ক্রন্দন
মিইয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস।

ঝলমল করছে নক্ষত্র
নীহারিকা ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে ধূমকেতু,
ডানা মেলছে আমার নিজস্ব পাখি
স্পর্শ করছে আকাশ,
তৈরি হচ্ছে ছায়াপথে আলোকের সেতু।

তাঁর পবিত্র রোজনামচায় বিধৃত হচ্ছে
আমার উন্মাদনা,
তোমাকে কী না বলতে পারি—
কী চাও তুমি— হে আমার প্রভু,
তোমার জন্যই তো হয়েছি দিওয়ানা।

তাকাও একবার আমার দিকে
আজ ই-তো সমাপ্তি
মনে হয় আমার রোজ কেয়ামত,
বাঙময় হয়ে উঠছে অনেক দিনের নীরবতা
দেখাও আমাকে জ্যোতির্ময় পথ।

আমি তৃপ্ত, পড়ছে মনে সব কথা
আমাকে তো দিয়েছো রেশম
গোলাপের স্নিগ্ধ সুবাস,
ছড়িয়ে পাপড়ি সারারাত এম্রোডারি করি
কবিতার পুষ্পিত ফরাশ।

 

লুকিয়ে থাকে যে

লুকিয়ে থাকে যে— অচেনা পাহাড় পর্বতের অন্তরালে
সুপ্তিতে নিমগ্ন হয়—ঝিনুকের নীরবতার ভেতরে মুক্তো,
সমুদ্রের শুভ্র ফেনা প্রচ্ছন্ন থাকে প্রবালে।

বসবাস করে যে— কেবলমাত্র স্মৃতিময়তায়
আমার ভেতর বয়ে যায়
বিস্মৃতির নদী,
জমছে মনে ধূসর ধুলো নিরবধি।

অপরিচিত বনানী— গুহা কন্দরের আবডাল থেকে
ভেসে আসে যে মন্দ্র স্বর,
স্মরণ করিয়ে দেয় আমাকে
কোথায় আমার মূল ঠিকানা— নিজস্ব ঘর।

বিনাশ প্রয়াসী যিনি—কখনো ডেকে আনেন ধ্বংস
সৃষ্টির বিপরীতে উজাড় করেন ঝাড় ও বংশ,
কীভাবে তোমাকে দেন তিনি
মেঘের মেদুর সূত্র— বিজরির সোনালি তসবির,
তাঁর নির্দয়তার তুফানে ছড়ায় দিগন্তে ঝড়ো সমীর;
ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার বিশ্বাসের কিশতি
সমুদ্রের ঊর্মিমহলে টালমাটাল,
কীভাবে একটি রূপালি পত্র দিতে পারে তোমাকে
চন্দ্রের শুশ্রূষা
দেখাতে পারে আকাশের সুরতহাল?

কোন কিছুই তো হারায় না এ দুনিয়ায়
তাবৎ বস্তুনিচয় অবিনশ্বর,
যদি ভাটা পড়ে নদীর প্রবাহে
মেঘদলে ভেসে যায় বৃষ্টির নৌবহর;
আর চাঁদের দুহিতা যদি শুভাশিস জানায়
স্মিত হাস্যে
পাহাড়ে জন্মায় ফলদ বৃক্ষ,
ছড়ায় সবুজ পত্রালি শ্যামলিম লাস্যে;
আর নির্দয়তার ছদ্মবেশ ছেড়ে যদি
বেরিয়ে আসো— তুমি অনুকম্পাশীল,
সুরুজ কী উঠবে আবার-বইবে সুখস্মৃতিময় সুবাতাস
গোলাপ প্রসূনে সুরভিত হবে আমার নিখিল।

যে স্মৃতি লুকিয়ে আছে আমার চোখে
যখন সত্তা ছিলো বিপদগ্রস্থ,
ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা-মারী ও মড়কে হয়েছি ভীত সন্ত্রস্ত;
তবে কী প্রত্যাশার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে
দিগন্ত আবার
দিদারে তাঁর বিধৃত হবে মহিমা অপার?

 

মঈনুস সুলতান

জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট করেন। বছর পাঁচেক কাজ করেন লাওসে-একটি উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে।

খণ্ড-কালীন অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস এবং স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস এর। কনসালটেন্ট হিসাবে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, মেসিডোনিয়া ও কিরগিজস্তান প্রভৃতি দেশে কাজ করেন অনেক বছর।

ইবোলা সংকটের সময় লেখক ডেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস নামে একটি ফান্ডিং কর্মসূচির সমন্বয়কারী হিসাবে সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা শহরে বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচীন মুদ্রা, সূচিশিল্প, পাণ্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।

Facebook Comments

One comment

  1. Nargis Pervin

    কবি নাদিয়া আনজুমন এর জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করে মর্মাহত হলাম! আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এভাবেও একজন কবিকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়! পাশাপাশি অনুভব করি ও শ্রদ্ধা জানায় কবি আনজুমনের সেই যোদ্ধা সত্তাকে। আসলেই তাই কবিতার জন্য, সৃজনের জন্য চাই একটা খোলা আকাশ। কবি আনজুমনের কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতেও দেখি সেই আবেদন। তাই কখনো নিষ্ফল আক্রোশে নিজেকে ডানাকাটা বললেও হৃদয়ের ডাক ভুলতে পারেননি কোনদিনই! তাই হয়তো কবির নিজস্ব পাখি স্পর্শ করেছে সেই মুক্ত আকাশ, ছায়াপথে গড়ে দিয়েছে আলোকের সেতু! আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা তাঁকে হারিয়েছি!

    কবি আনজুমনের কবিতা অনুবাদ করে তাঁকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য, আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি কবি-লেখক তথা অনুবাদক মঈনুস সুলতানকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top