সান্দ্রা বিসলি’র কবিতা

ভাবতর্জমা: মঈনুস সুলতান

[যুক্তরাষ্ট্রের কবি ও নন-ফিকশন রাইটার সান্দ্রা বিসলি’র জন্ম ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে, ১৯৮০ সালের পাঁচ মে। শিক্ষাগতভাবে তিনি আমেরিকান ইউনিভারসিটি থেকে ফাইন আর্টসে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। কয়েক বছর ‘আমেরিকান স্কলার’ নামক একটি জার্নাল সম্পাদনা করেন। তাঁর কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয় ‘দ্যা বেস্ট আমেরিকান পোয়েট্রি ২০১০’ নামক এনথোলজিতে। ‘পোয়েট্রি ডেইলি’, ‘দ্যা বিলিভার’,‘কপার নিকেল’ ও ‘ভার্স ডেইলি’ প্রভৃতির জার্নালে নিয়মিত প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট ম্যাগাজিনে’ তিনি নিয়মিত লিখেন। এছাড়া ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গদ্য রচনা।

কবি সান্দ্রা বিসলির প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে ‘কাউন্ট দ্যা ওয়েভস্ (২০১৫),’ ‘আই ওয়াজ অ্যা জুকবক্স (২০১০)’, থিয়োরীজ অব ফলিং (২০০৮)’, ‘ডোন্ট কিল দ্যা বার্থডে গার্ল: টেলস্ ফ্রম অ্যান এলারজিক লাইফ (২০১১)’ প্রভৃতি। ২০১৫ সালে পোয়েট্রি ইন্টারন্যাশনেল এর তরফ থেকে তিনি অর্জন করেন ‘কাভাফি প্রাইজ’। একই সনে ন্যাশনেল এনডাওমেন্ট ফর আর্টস থেকে তাঁকে প্রদান করা হয় ফেলোশীপ। পোয়েট্রি ফাউন্ডেশনও ‘ফ্রেন্ডস্ অব পোয়েট্রি প্রাইজ’ এর মাধ্যমে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। নিচে তাঁর পাঁচটি কবিতার ভাষান্তর উপস্থাপিত হচ্ছে। কবিতাগুলো, বায়ো-বিষয়ক তথ্য ও কবির ছবি নেয়া হয়েছে ইন্টান্যাট থেকে।]

প্রদর্শনীটি ছিলো দারুণ

বৃষ্টিস্নাত বৃহষ্পতিবারে শুরু হলো প্রদর্শনী
চেলোবাদনে মুখরিত,
ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে চিত্ররাজি
যা দেখা যেতে পারে সামনে বা পেছন থেকে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কে যেন হাসছিলো স্মীত;
লুনা মথগুলো পালের মতো তাদের বিশাল পাখা নাড়ছিলো
কী অসামান্য এ চন্দ্রাহত মথ!
শংকর মাছগুলো নাড়ছিলো তাদের বিপুল পাখনা
তারাও যেন নিয়েছে সঞ্চালনের শপথ,
আগত দর্শকদের স্পর্শ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছিলো,
ব্রেইল ও ওডিওতে পাওয়া যাচ্ছিলো ক্যাপশন
চিত্রপ্রিয় মানুষের ধ্যানে ঋদ্ধ তপোবন;
পুরো প্রদর্শনীতে ঘুরে মনে হলো
পাওয়া যাচ্ছে তাজা চেরীফলের স্বাদ,
দৃশ্যোর সাথে মননের মিটছিলো বিবাদ,
একজন সমালোচক জানতে চাচ্ছিলেন—
বিষয়টা কী আদর্শ কোন দ্রব্যের বিপ্রতীপ উপস্থাপন?
প্রদর্শনীর জননী ক্রমাগত ডাকছিলেন
কিন্তু পিতা ছিলেন নীরব;
কেউ কেউ কফিতে মেশাচ্ছিলেন স্কচ
কারো ভাবনার জীবন্ত দৃশ্যকল্পে ফুটেছিলো শব।

পুরো পরিসর এর নক্সার সময় খেয়াল রাখা উচিত ছিলো
পায়ে হাঁটা দর্শকরা কিন্তু ঘুরবে— ডানে কিংবা বামে নয়,
তারা ভাস্কর্যগুলোকে এমনভাবে স্থাপন করবে
তা যেন দৃশ্যমান হতে পারে উপর অথবা নিচ থেকে
রেখা বিভঙ্গের বর্ণচ্ছটায় যেন ভরে ওঠে তাদের সময়,
তারা দেয়ালগুলোকে বঞ্চিত করছিলো ডিমের খোসার শেডে
তবে তাতে ছিলো না কোন ক্যালসিয়াম,
টবে সাবুজিক আভা ছড়াচ্ছিলো জোড়া পাম।

পুব দিকের জানালায় ঘটনাটি ঘটার আগে
এ প্রদর্শনীকে কেউ বিবেচনা করেনি প্রদর্শনবাদী হিসাবে,
আয়োজকরা দুঃখিত হয়েছিলো ঘটনাটির প্রভাবে
অনুরোধে তারা ফিরিয়ে দেবে টিকিটের দাম
কাঁপছিলো পত্রালি সবুজ পাম,
শংকর মাছগুলো বাদামি পালের মতো পাখনা নেড়ে
ঘোষনা করছিলো সঞ্চালনের শপথ,
বিশাল সবুজ পালের মতো ডানা নাড়াছিলো লুনা মথ।
যাত্রা যতোই সংক্ষিপ্ত হোক না কেন
দোরগোড়ায় মজুত রেখেছিলো এক জোড়া জুতা,
জানবে না কেউ— কখন সে বাড়ি ফিরবে ফের
কাঁধে নিয়ে আমাজনের তোঁতা।

 

আটা হচ্ছে খামার

দু’ভাগ আটার সাথে একভাগ পানি মিশিয়ে বেক করলে
তা থামিয়ে দিতে পারে বুলেট
সুতরাং ভালো সৈনিকরা বহন করে
তাদের রুকাশুকা বিস্কিটের রেশন হৃৎপিন্ডের ওপর
বন্দুকের বাট দিয়ে বাড়ি মেরে..ভেঙ্গে-চুরে..জলে ভিজিয়ে
শুকরের চর্বিতে ভেঁজে তৈরী করা যায় নরকাগ্নি স্টু
খাওয়া যেতে পারে কাঁচা কাঁচা
আর তারিফও করা যেতে পারে সুরুয়াটির
উষ্ণ হয়ে ওঠা মাঠে আলোর প্রত্যাশায়
গম কী বেড়ে ওঠার সময় প্রস্তুত করে নেয় নিজেকে
গমের লিকলিকে চারা জানে কী
তাদের শক্তির সাথে সংখ্যার সম্পর্ক
আটার সাথে আমরা যখন মেশাই প্রতিশ্রুতি
তখন তা হয়ে ওঠে প্রয়োজনীয়
তা না হলে আটা আর ধুলোতে ফারাক সামান্যই
যদি একজন মানুষ মৃত্যুর সময় পকেটে ধরে রাখে
হার্ডট্র্যাকে পাওয়া রেশন
তুমি কী তাকে অনাহার বলবে?
তুমি কী তাকে খাদ্য বলবে
যখন আহারের নলা গেলার সময়
মানুষটিকে বিদ্ধ করে বুলেট?

 

তালিকা

আমরা তাকিয়ে থাকি তোমার চোখ দুটিতে অনুক্ষণ
বিস্মৃত হই যে— এ প্রদর্শনী হচ্ছে মূলত অন্ধ
পাখার মতো তোমার লেজের আকৃতি আদতে জোড় করা হাতের তালু
মুরগীর পাখনার প্রতিটি কম্পন-ধ্বনি জড়ো হয় তোমার শ্রবণে
তোমার পালক হচ্ছে প্রতিফলিত অনুপস্থিতির সবুজ নীল লাবণ্য
কেউ কখনো ময়ূরের নিতম্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় না
পালকের হাসিতেই নিস্পত্তি হয়
সৌন্দর্য পরিমাপের ব্যাপারটা
অথবা
কীভাবে তুমি কিছু কেড়ে খাও পিঁপড়াদের সঞ্চয় থেকে
কিংবা শোলার আধার
পনির থেকে মোরগ অব্দি
যা পুষ্পভুক— ঘুরে বেড়ায় সড়কে
যা ঝগড়া বাধায় ছাগলের সাথে
তুমি শুধু চাও পরিষ্কার করতে তোমার পালক
আমি তোমার যে জিনিসটা ভালোবাসি— তা হচ্ছে সাহসের অভাব
শুনছো পালক— সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামানো যথেষ্ট হলো আমার
শুধু পলক পড়া চোখই পরিমাপ করতে পারে আলোর গতি।

 

কথা বলে পিয়ানো

ঘন্টা খানেক হলো বিস্মৃত হয়েছি আমি
আমার স্থূলকায় অবয়ব সম্পর্কে
আমার দগ্ধ-স্নায়ুতে পীড়িত অন্তর্গত ভুবন
বিচ্ছিন্ন থাকার প্রতি আমার নেশাগ্রস্থ আকর্ষণ
ঘন্টা খানেক হলো ভুলেছি আমি বৃষ্টিপাতের বিভিষিকা
বিবর্তিত হয়েছিলাম আমি ঘন্টা খানেকের মতো
সালেমেন্ডার প্রজাতির গিরগিটিতে
হেঁটেছি গুটি গুটি পায়ে তটরেখার তালাশে
তার আংগুল থেকে খসে পড়ে বার্তা
আর আমার তলপেট থেকে বিযুক্ত হয়ে
অজস্র ডিম্বাণু শিকড় ছড়ায় কর্দমে
কে তাতে তা দেবে আমি ঠিক জানি না
আমার ভেতরে খেলা করে একটি মিথ্যাচার
ওয়ালজ নৃত্য ও কাঁচের দেবদূত
দাঁড়িয়ে দুপায়ে ঘন্টাখানেক হলো কেবলই দৌড়াচ্ছি
হাঁপাচ্ছি আর লাফ দিয়ে অতিক্রম করছি প্রতিবন্ধক

ঘন্টা খানেকের মতো রূপান্তরিত হয়েছিলাম আমি
ম্যাপোল বৃক্ষে
আংগুলে ধারণ করে আছে সে গ্রীষ্ম
বার্তা অংকুর হয়
উড়ে যায় ডানা মেলে
এক ঝাঁক ছোট্ট সুদর্শন হেলিকপ্টারের জানালায় ঝুলতে ঝুলতে

 

যথাযথ পেশা

পুরো ছয় মাস আমি ক্যাসিনোতে তদারকি করি তাসের জুয়োখেলা
আরো মাস ছয়েক আমি একটি শপিং মলে বাজিয়েছি ব্রাহামস্ এর ধ্রপদী বাদন
জাদুঘরেও কর্মরত ছিলাম ছয় মাস, ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যগুলো গুছিয়ে প্রদর্শন করার দ্বায়িত্ব ছিলো আমার।
আমার হাত আকারে ছোট বলে প্রস্তর যুগের হাতিয়ার নির্মাণের কাজ থেকে সরিয়ে শ্যাওলা উৎপাদন করতে বলা হয়, তখন আমি ইস্তেফা দেই চাকুরি থেকে।

আমি মিনিটে একানব্বইটি শব্দ টাইপ করতে পারি— যা ছিলো আমার ক্যারিয়ারের জন্য সহায়ক। লাইব্রেরীতে পুস্তক বিন্যাসের ডিউয়ি ডেসিমেল পদ্ধতিটা আমার জানা আছে। এছাড়া আমি কথা বলতে পারি র্যাশান ভাষায়, ল্যাটিন ভাষায়ও আমার দক্ষতা আছে বিঘত। এমন কী আলাস্কার টিনিংগিট আদিবাসীদের ভাষাও জানি বেশ খানিকটা।

এক সাথে খাবারের সাতটি ভিন্ন ভিন্ন ডিশ আমি দুহাতের তালুতে ধরে চলাফেরা করতে পারি, ভারসাম্যে কোন খামতি হয় না। এ মুহূর্তে আমার একমাত্র বাসনা হচ্ছে— বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকতে, আর আমার চারদিকে ঝরে পড়বে জুম বৃষ্টি। কোন অসুবিধা নেই, আমি তোমার জরুরি নথিপত্র গুছিয়ে রাখবো। তোমার পছন্দ মতো কোন আগন্তুকের সঙ্গে শরীরী ভালোবাসায় লিপ্ত হতেও আপত্তি নেই। তুমি যা চাইবে আমি তা করতে রাজি আছি— যদি বারান্দায় স্রেফ বসে থাকার সুযোগ দেয়া হয়। এ বিষয়গুলো যদি তোমাকে আকর্ষণ করে থাকে তীব্রভাবে, তাহলে এসবেই তোমার মেতে থাকা উচিত, তাই না? আমি একবার এক দালালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— তোমার পেশার কোন ব্যাপারটি তুমি ভালোবাসো, সে জবাব দিয়েছিলো- সফলভাবে রাতারাতি মুনাফা আর্জন। যে কোন কারণ ছাড়া খুন করে বেড়ায়—আরেকবার আমি সেরকম এক ঘাতককে জিজ্ঞেস করেছিলাম- কোন জিনিসটি তোমাকে উদ্বুদ্ধ করে, সে জবাব দিয়েছিলো- মানুষ।

 

মঈনুস সুলতান

জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট করেন। বছর পাঁচেক কাজ করেন লাওসে-একটি উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে। খণ্ড-কালীন অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস এবং স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস এর। কনসালটেন্ট হিসাবে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, মেসিডোনিয়া ও কিরগিজস্তান প্রভৃতি দেশে কাজ করেন অনেক বছর।

ইবোলা সংকটের সময় লেখক ডেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস নামে একটি ফান্ডিং কর্মসূচির সমন্বয়কারী হিসাবে সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা শহরে বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচীন মুদ্রা, সূচিশিল্প, পাণ্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top