মঈনুস সুলতানের গল্প: চিত্রকর শাহ দারা ও তাজমহলের সূচিকর্ম

কামরাটি আকার আয়তনে সুপরিসর, তবে ভোরবিহানের তুমুল আলোয়ও আধোন্ধকার হয়ে আছে। দারা জং ধরে যাওয়া ছিটকিনি টেনে জানালার একটি পাল্লা খোলার চেষ্টা করে। ক্যাচম্যাচ আওয়াজে বিরক্ত হয়ে অতঃপর সে টেনে ভারি পর্দাটি সরায়। এক রাশ আলো গলে এসে মৃদুভাবে ঝলসে দেয় ড্রেসিং টেবিলের আয়না। তাতে দুধের সরের মতো জমে আছে ময়লার ধূসর স্তর।

দারা কিছুক্ষণ ধুন ধরে তাকিয়ে থাকে। তার হাতে স্কেচখাতা ও কাঠপেন্সিল। সুদর্শন ছেলেটির মুখ থেকে লালা গড়িয়ে শার্টের বোতাম ও পকেটের কোণাকাঞ্চি ভিজিয়ে দিচ্ছে। ওদিকে খেয়াল না করে সে দিশা ধরে দেখে, আলোর লম্বালম্বি ধারায় উড়ে বেড়ানো ধুলিকণার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আকৃতি। তার চোখে পুতলি অস্থিরভাবে ঘুরতে থাকে।

ছেলেটির বয়স চৌদ্দ ছাড়িয়েছে, কিন্তু তার আচার আচরণ নাবুঝ শিশুদের মতো। কুটুমখেশ, গাঁওগেরাম — হামছায়ার গন্যমান্যরা তার সামনেই আলাপ করেন, বালকটির বোধবুদ্ধি নাকি ছয়-সাত বছরের বাচ্চার মতো। এ ধারনার সাথে তার দাদীআম্মা একমত না। তিনি এলোমেলো স্বভাবের নাতিটিকে হামেশা আগলে-উগলে রাখেন।

বার তিনেক দারাকে তিনি স্কুলেও পাঠিয়েছেন, ফায়দা কিছু হয়নি, শিক্ষক বা সতীর্থদের সঙ্গে সে মিশ খাওয়াতে পারেনি। প্রাইভেট মাস্টার রেখে বছর-কে-বছর মালামত করেছেন, কিন্তু লিখতে পড়তে বা অংক কষতে সক্ষম সে হয়নি, তবে শুনে শুনে কবিতাগুলো দারা স্মৃতিতে রীতিমতো জবানি করে রেখেছে।

সম্ভবত ছন্দের দোলখেল তার মধ্যে তৈরী করে ধ্বনির দ্যোতনা। কোন কারণ ছাড়া মাঝেমধ্যে কবিতাগুলো জোরেশোরে আওড়ানো সে পছন্দ করে। সামাজিক বৈঠকে কথাবার্তা বলার যে অলিখিত কায়দা কানুন আছে, এ সম্পর্কে দারা সচেতন নয় একেবারে। স্থান-কালও সে বিবেচনায় আনতে অক্ষম, তাই ডাইনিং টেবিলে যখন জ্যাম্পেস করে পারিবারিক খানাপিনার আয়োজন হয়, তখন দারা হয়তো দেখা গেল — ভাতের বর্তনের দিকে নজর না দিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামালের ‘সাঁজের মায়া’ কবিতাটি আবৃত্তি করছে।

পড়ালেখায় মনযোগি করার জন্য তার দাদীআম্মা দারাকে শহরে পাঠিয়ে এলোপ্যাথি চিকিৎসা করিয়েছেন, বছর-কে-বছর গিলিয়েছেন হ্যামিওপ্যাথিকের টেফরা জল, কিছুতেই কিছু না হলে, অবশেষে বাঝবন্দা লেগে রাশভারি মহিলা নাতিকে কোরানে-হাফিজ বানানোর কোশেশও করেছেন। এ আত্রাফের সবচেয়ে লেহেনদার হাফিজ বাকাউল্লাহ নূরানীর তত্ত্বাবধানে দারা মাস পাঁচেক কোরানে-পাকের তালিম নিয়েছে। জরির ফুলতোলা গোলটুপি মাথায় দিয়ে, গলায় গিলাফ প্যাচিয়ে, দুলে দুলে সে ছিপারার পর ছিপারা জবানি করেছে।

স্মৃতিতে তার কোন গলদ নেই, তবে মাঝেমধ্যে গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আনমনে তেলায়ৎ করতে করতে পবিত্র সুরার সাথে ‘তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’ বা ‘নুরু পুষি আয়শা শফি সবাই এসেছে’ জাতীয় কবিতার চরণকে গুলিয়ে ফেললে মুশকিল বাঁধে। বাকাউল্লা তার দাদীআম্মাকে হুশিয়ার করে দিয়ে জানান, এ ধরনের ‘নাদান নাখেরেস্ত’ সুলভ আচরণে শুধু ‘বদি’ অনিবার্য নয়, ‘সকত্ গোনাহ’ও অবধারিত।

হাফিজ সাহেব দারাকে তওবা করানোর কোশেশ করেন, তাতে সে সাড়া না দিলে স্পষ্টত হতাশ হন। ছেলেটিকে যে বেতিয়ে শায়েস্তা করবেন সে উপায়ও নেই, শাসনে দাদীআম্মার আপত্তি আছে। গাঁওগেরামের সবচেয়ে বেশি জমিজমার মালিকিন — বড়বিবি বলে পরিচিত এ মহিলা এক জামানার দাঁব-রওয়াব ছড়ানো এক মিরাশদারের বিধবা, তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে হাফিজ সাহেব সাহস পান না। বেচারা হয়ে দারাকে সবক দেয়ার কাজ বন্ধ করে দিয়ে নীরবে তিনি দূরে সরে যান।

হাল্কা-পাতলা স্ট্রোকের পর বড়বিবির নাতিকে লেখাপড়া শেখানোর আগ্রহে ভাটা পড়ে। কমজোরি হালতে তিনি যখন সেরেফ পালঙ্গে শুয়ে-বসে সময় কাটাতে শুরু করেন, তখন দারা স্কেচখাতায় রোগশয্যার বিস্তারিত ছবি এঁকে তাঁকে রীতিমতো তাজ্জব করে দেয়!

ছেলেটির যে ছবি আঁকার ধাত আছে, সে সম্পর্কে বড়বিবি আলবৎ অবগত। বাচ্চা বয়স থেকেই সে কখনোসখনো ফকফকে সাদা চুনকাম করা দেয়ালে বা খাটপালঙ্কের শিথানে কাঠপেন্সিল দিয়ে আঁকতো ইনসানের অবিকল মুখমন্ডল, গরু-ভইশ বা কাউয়া-চিলের ছবি আঁকাও তার আয়ত্বের ভেতর ছিলো। এ নিয়ে বড়বিবি বিশেষ কিছু ভাবেননি, জানতেন তাঁর ছেলে শাহ এহতেশাম লাহোর থেকে এনে আউলাঝাউলা কিসিমের ছোট্ট পুত্রসন্তানকে উপহার দিয়েছেন — স্কেচখাতা, ক্রেয়ন ও রঙতুলি। এগুলো দিয়ে নাতি কী করছে — দুনিয়াদারীর হাজার কাজে বড়বিবি সে দিকে বিশেষ একটা নজর দেয়ার সুযোগ পাননি।

বড় আকারের বিমারের পর তিনি যখন হামেশা পালঙ্কে আধশোয়া হয়ে বসে দিন গোজরান করছিলেন, তখনা দারা হঠাৎ করে এসে তাঁর পায়ের কাছে বসে স্কেচখাতায় কী একটা আঁকিবুকি করতে শুরু করে। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সে এঁকেই যাচ্ছে..। বড়বিবি চোখের কোণ দিয়ে খেয়াল করেন, দারার মুখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে লালা, একটু আগে তিনি কড়া ডোজের দাওয়াই সেবন করেছেন, মাথা তুলে বসে — একটু এগিয়ে গিয়ে যে নাতির মুখ মুছিয়ে দেবেন, শরীরে সে তাকদ্টুকু পাচ্ছেন না, কামকাজের লোকজন, দাসী-বান্দী কাউকেও ধারে কাছে দেখছেন না, তো তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করেন, দারা ধুন ধরে বসে কী আঁকছে?

ছেলেটি প্রচুর সময় নিয়ে কেবলই এঁকে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে চোখ তুলে দেয়ালের দিকেও তাকাচ্ছে। বড়বিবি ওখানে নজর দেন। না দেয়ালের সাজসজ্জায় পরিবর্তন কিছু হয়নি। আগের মতো শিংগাল হরিণের কাঠে বাঁধানো মাথা দুটি জড়িয়ে প্রসারিত হয়ে আছে মাকড়শার জাল। তার ফাঁক দিয়ে সামান্য উপরে ঝুলছে আদ্যিকালের গ্র্যান্ডফাদার ক্লক।

বড়বিবি ভাবেন, হয়তো দারা দেয়াল-ঘড়ি কিংবা শিংগালের মাথা দুটির স্কেচ করছে। ওষুধের ঘোরে তাঁর চোখ বুজে আসছে, হঠাৎ করে মন ফিরে যায় পুরানো দিনে, ১৩২৭ বাংলার কার্তিক মাসে —দেশে যখন আলী ভাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে কেবলমাত্র খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়েছে, তখন রাজনৈতিক ডামাঢোলের ভেতর তাঁর বিবাহ হয়েছিল, গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটি পেয়েছিলেন শাদীর জেহেয হিসাবে। তিনি ভাবতে শুরু করেন, শেষ কবে রূপালি রঙের জেল্লা ছড়িয়ে প্যান্ডুলামটি দুলেছিল। সন-তারিখ স্পষ্টভাবে মনে পড়ে না, তবে যেদিন ঘড়িটি থেকে ঢং ঢং আওয়াজ বন্ধ হলো, সেদিন তিনি শুনেছিলেন, ভারতবর্ষ ভেঙ্গে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান হওয়ার সংবাদ। জানতে পেরেছিলেন, তাঁর বাপের বাড়ি করিমগঞ্জ ভাগে পড়েছে ওপারে, এখন থেকে যেতে আসতে পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে।

দারা আঁকাজোকার কাজ শেষ করে এনেছে। স্কেচখাতাটি বন্ধ করে সে পালঙ্কের রেলিংয়ে বসানো আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। একটি জিনিস বড়বিবি খেয়াল করেন, নাতির মুখ থেকে অস্থিরতার এলোমেলো ভাব মিটে গিয়ে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির মৃদু হাসি, চোখের পুতলিও স্থির হয়ে এসেছে। তিনি তাকে কাছে ডাকেন, লাজুকভাবে উঠে এসে মাথার কাছে সে দাঁড়ায়। তারপর কী ভেবে খাতাটি মেলে ধরে।

বড়বিবির এবার সত্যিই অবাক হওয়ার পালা। পেন্সিলে আঁকা রোগশয্যায় পড়ে থাকা মহিলার চেহারায় বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে তাঁর মুখমন্ডলের অবিকল আকৃতি। স্টেথিস্কোপ গলায় ঝুঁকে আসা গুঁফো সুরেশ ডাক্তারকেও চেনা যাচ্ছে। পালঙ্কের পাশে সাইডটেবিলে রাখা ওসুধ-বিসুদের শিশিবোতল, আধখাওয়া নাশপাতি, জলের গেলাসের ডিটেইলস্ প্রভৃতিও পরিষ্কার। বড়বিবি চেষ্টা করেন ডান হাতটি বাড়িয়ে নাতিকে স্পর্শ করতে, কিন্তু হাতটা এমন অবশ হয়ে আছে যে সহজে তুলতে পারেন না। দারা খাতা বন্ধ করে দিয়ে দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে যায় কামরা থেকে।

লাঠি ভর দিয়ে বড়বিবি উঠতে চেষ্টা করেন, কিন্তু মাথা ঘুরুন্টি দিয়ে চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। তো তিনি পালঙ্কের কিনারায় বসে খুকখুকিয়ে একটু কাশেন, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করেন — কামকাজের বেটি কোথায় চিলিমচিটি রেখেছে। কাউকে কোথাও দেখতে পান না, সামান্য বিরক্ত হন, কিন্তু আগের মতো দেহমনে দিয়াশলাই ঘঁষার মতো জ্বলে উঠে না রাগ-গ্বোসা। নির্লিপ্ত হালতে কী যেন ভাবেন, হঠাৎ করে মলপুকুরের পানাভাসা জলে পাঁকাল মাছের ঘাই এর মতো মনের নিভৃতে একটি ভাবনা খেলে যায়।

তথ্যটি বড়বিবি কোথায় পড়েছিলেন, সওগাত না বেগমে, নাকি দৈনিক আজাদে, ঠিক মনে করতে পারেন না। দারার জননী বৌবিবির মৃত্যুর পর এ বাড়িতে পত্র-পত্রিকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। তবে স্ট্রোকে কাহিল হওয়ার আগে মাঝেমধ্যে তিনি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে পুরানো সংখ্যাগুলো ঘাঁটতেন, তখন হয়তো পড়ে থাকবেন — শহর ঢাকায় আর্ট স্কুল হওয়ার সংবাদ।

হালফিল তো বর্ডার পাড়ি দিয়ে কলকাত্তায় যাওয়ার কোন কুদরত নেই। ঢাকায় ছবি আঁকা শেখার যে একটা থান হয়েছে, এ তথ্য বড়বিবিকে উদ্দীপ্ত করে। টাকা-কড়ি ধনদৌলতের কোন কমতি তাঁর নেই, ভাবেন, হয়তো দারাকে কোন দিন আর্ট স্কুলে পাঠাতে পারবেন। সাথে সাথে কচুরিপানায় দমবন্ধ হয়ে পেট উল্টিয়ে ভাসা মাছের মতো একটি দুশ্চিন্তা তাঁর করোটিতে ভাসে। আর্ট স্কুলের খরচ তিনি জোটাতে পারবেন, কিন্তু ছেলেটির বুঝবুদ্ধি তো তিফিল বাচ্চার মতো, ঢাকা শহরে দারার তত্ত্বতালাবি কে করবে?

বড়বিবির ইয়াদগারিতে এবার পুত্র এহতেশামের মুখ ভেসে ওঠে। সে নেই তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। পাঁজরে দলা পাঁকিয়ে উঠা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে তিনি কায়ক্লেশে আধশোয়া হন। একটু ঝিমানির মতো আসে। মনশ্চক্ষে যেন নিজেকে দেখতে পান, বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে আছেন তিনি, বাঁশবেতের চিক গলে চুঁইয়ে আসছে শেষ বিকালের আলো। তাঁর চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, দৈনিক আজাদের হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে তাঁর জান-প্রাণ ধড়াৎ করে ওঠে।

লাহোরের ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে থাকা প্যাসিঞ্জারবাহী রেলগাড়ির কাছে ভারতীয় জঙ্গিবিমান বোমা ফেলেছে, নিহত হয়েছে ছয় জন, আহতের সংখ্যা প্রচুর। প্রতিবেশী দুটি দেশ —পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানের মধ্যে বেঁধে গেছে লড়াই। পুত্র ক্যাপ্টেন শাহ এহতেশাম পশ্চিম পাকিস্তানে। কান্নার অজোর তোড়কে সামলাতে সামলাতে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠেন বড়বিবি।

দারা এ মুহূর্তে জানালা গলে আসা আলোয় — ঘুরুন্টি দেয়া ধূলিকণার দিকে নজর রেখে — বেশ বড়সড় নির্জন কামরাটিতে দাঁড়িয়ে হাফিজি কায়দায় উচ্চারণ করে যাচ্ছে পবিত্র কালাম। কামরাটির দেয়ালে বেশ কতগুলো পিকচার ফ্রেম এখনো ঝুলে আছে, কিন্তু এগুলোর কাঁচ সরিয়ে নেয়া হয়েছে, ভেতরে কোন ফটোগ্রাফস্ নেই।

বছর কয়েক আগেও এগুলোতে ছিলো তার পিতা ক্যাপ্টেন শাহ এহতেশাম চৌধুরীর ছবি। একটি ছবিতে সামরিক কেতার ধড়াচূড়া পরে তিনি মিলিটারি একাডেমিতে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের হাতে ব্যাজ পরে কমিশন পাচ্ছেন। আরেকটি ফটোগ্রাফের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিলো সোয়াত ভ্যালির পাহাড়ি ঝর্ণার দৃশপট। ছবিগুলোর দিকে বার বার তাকিয়ে থাকতে দারা পছন্দ করতো। কিন্তু পিতার মৃত্যুসংবাদ শোনার পর মায়ের আকুল হয়ে দিন-কে-দিন কান্নার কারণ সে বুঝতে পারেনি। মা কেন এক পর্যায়ে খেপে গিয়ে আয়না ভেঙ্গে, ছবিগুলো ছিড়ে কুটি কুটি করে ছুড়ে ফেলেছিলেন, এ ঘটনাও তার বুঝবুদ্ধির অতীত।

এ মুহূর্তে দারা হাত বাড়িয়ে খালি ফ্রেমগুলো নাড়াচাড়া করে কী যেন খুঁজছে, তার চোখের পুতলি বেজায় অস্থির হয়ে আছে। একটি বড়সড় ফ্রেম — যাতে বাঁধানো তাজমহলের ছবিটি এখনো অবিকৃত আছে, সে তা খুলে এনে টেবিলের উপর রেখে গাঢ় নজরে তাকায়। তখনই ছেলেটির স্মৃতিতে ফিরে আসে এই ছবি সংক্রান্ত কিছু ঘটনা, তাজমহল কী, ইতিহাসখ্যাত এ সৌধটি কী কারণে তৈরী হয়েছিল, দারা ঠিক বুঝতে পারে না, তবে বাবা যে তার আম্মাকে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যাবেন, এ অঙ্গিকারের তথ্যটি তার মনে আঁটায় আটকে পড়া মক্ষিকার মতো ফরফর করে। আরেকটি বিষয়, আম্মা যখন রোগে অবসন্ন, ঠিক মতো হাঁটাচলাও করতে পারছেন না, তখন এ ছবিটির দিকে তাকিয়ে সফেদ কাপড়ে এম্ব্রয়ডারি করার জন্য রঙপেন্সিলে দিনের পর দিন নক্সা এঁকেছিলেন।

দারা এবার বুকশেল্ফের বইপত্র তোলপাড় করে খুঁজছে। বাদশাহ শাহজাহানের ছবি আঁকা একটি বই খুলে ভেতরে তাজমহলের রঙিন ছবির দিকে সে তাকিয়ে থাকে। এ বইটি থেকে বাবা বারবার আম্মাকে পড়ে শোনাতেন। বলতেন, খুব শান শওকতের সম্রাট ছিলেন তিনি, তামাম হিন্দুস্থান জুড়ে তাঁর দাঁব রোয়াবের কোন অন্ত ছিলো না। একজন শাহজাদার নামও নাকি ছিলো দারা, এ সব কথা সে শুনেছে একাধিকবার, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারেনি শাহজাহানের সাথে তার সম্পর্ক কী, কিংবা আম্মা কেন বেকরার হয়ে তাজমহল দেখতে চেয়েছিলেন?

বইটি রেখে এবার ডাঁই করে রাখা স্পোর্টসটাইম পত্রিকাগুলো সে খুলিবিলি করে খুঁজে, ধবধবে সাদা পোষাক পরা ব্যাট হাতে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের ছবির দিকে মনযোগ দিয়ে তাকায়, কিন্তু যা খুঁজছে তা পায় না, এবং কী খুঁজছে ঠিকঠাক মতো মনে করতেও তার সমস্যা হয়। হঠাৎ করে চোখে পড়ে টেবিলের তলায় পড়ে থাকা ক্রিকেটের খেলনা-মতো ব্যাট, বল, স্ট্যাম্প প্রভৃতির দিকে। বাবা শিয়ালকোট শহর থেকে এসব তার জন্য নিয়ে এসেছিলেন।

দারার চোখ এবার দেয়ালের উপরের দিকে ঝুলানো একটি পোস্টারে পড়ে। ব্যাট হাতে ক্রিকেটার হানিফ মোহাম্মদের ছবিটি বাবা ভালোবাসতেন, বলতেন,‘শাহ দারা, একদিন তুমিও তাঁর মতো ব্যাটে বল হাকড়িয়ে পর পর এক নাগাড়ে তিন সেঞ্চুরি তুলবে।’ দারা ছবিটি ছুঁতে যায়, কিন্তু বেশ উঁচুতে পোষ্টারটি, তখনই মনে পড়ে, একবার স্কেচখাতায় ক্রিকেটারের দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে বাবার ছবি সে এঁকেছিল। তা দাদীআম্মার চোখে পড়লে তিনি এমন বেকরার হয়ে কাঁদছিলেন যে, দারা ভড়কে গিয়ে চিত্রিত পৃষ্টাটি ছিড়ে এ কামরার কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল, এবং এ মুহূর্তে সে ওই ছবিটি খুঁজছে।

এ কামরায় এক জামানায় বাবা যে আম্মার সাথে বাস করতেন, অত কিছু দারা ঠিক বুঝতে পারে না, তবে হাছুমিছু যে সব স্মৃতি মাঝেমধ্যে তার করোটিতে গরম দুধের মতো বলকে উঠে, তা থেকে সে নিশ্চিত যে, পালঙ্কের পাশে খেলনা ঝুলানো দোলনাটি ছিলো তার নিজস্ব। সে তুলতুলে কম্বলটি সারিয়ে খানিক খুলিবিলি করে, তখনই পিতার মৃত্যুর স্মৃতি ফিরে আসে তার মনে।

মানুষের মৃত্যুর সাথে চির বিচ্ছেদের বিষয়টি দারা ঠিক বুঝতে পারে না, তবে ঘটনাটি পরষ্পরের সাথে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকা কয়েকটি দৃশকল্পে যেন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তার পরিষ্কারভাবে মনে পড়ে, বাড়িতে চাহরম উপলক্ষ্যে প্রচুর কুটুমখেশ গাঁওগেরামের জানাশোনা মানুষদের জড়ো হওয়ার কথা, মিলাদ শরীফের পর গরিবগোর্বাদের ভেতর হরেক রকমের ফলপাঁকুড়, খইমুড়ি ও সানকিতে করে ক্ষীর ইত্যাদি বিলিয়ে দেয়ার দৃশ্য।

কিন্তু মৃত্যুর ঘটনায় বাবার যে আর বাড়ি ফিরে না আসার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়েছে, তা ঠিক ধরতে পারে না। মৃত্যুসংক্রান্ত বিষাদের তেমন কোন অনুভূতিও তার নেই, কিন্তু মাসের পর মাস যে বাবা ফিরে আসছেন না, এ ব্যাপারে সচেতন হলেই তার করোটিতে যেন দূরের কোন ছতিমগাছের ডালে বসে একটি কুচকুচে কালো কাউয়া ডেকে ওঠে।

ভারত পাকিস্তানের সতেরো দিনের যুদ্ধে তার বাবা যে খেমকারান সেক্টরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে লড়েছিলেন, তারপর একাধিক স্যুটকেস বোঝাই মালমাত্তা নিয়ে করাচী থেকে চিটাগাং এর দিকে জাহাজে রওয়ানা হয়েছিলেন, এ সব কথাবার্তা দারা শুনেছে। কলম্ব বন্দরে জাহাজ ভিড়লে বাবা নাকি আরো কিছু সদাইপাতি করতে যান, তখন অ্যাক্সিডেন্ট হয়, তাঁর লাশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি, তবে জাহাজ কোম্পানিতে খোঁজখবর করে শুধু স্যুটকেসগুলো বাড়িতে আনা হয়।

তাতে চমৎকার নক্সা করা দুখানা কার্পেট ছিলো, আর ছিলো দারার জন্য ছবি আঁকার বই, কালার বক্স; আখরোট, খোবানি ও মনাক্কার কয়েকটি প্যাকেটও ছিলো। এ সব দারা চোখে দেখেছে, চেহলামের সময় গরু-সিন্নির কথা তার মনে পড়ে। তারপরও হানিফ মোহাম্মদের পোস্টারটির দিকে তাকিয়ে, মুখ থেকে লালা ঝরিয়ে সে ভাবে, কবে ফের বাবা বাড়ি ফিরবেন, এবং এবার তার জন্য কী নিয়ে আসবেন।

স্মৃতির টুকরা টাকরা ডিটেলস্ ও সে সম্পর্কীত অভিঘাত তাকে তব্দিলের মতো করে দিলে, সে অবসন্ন হয়ে বসে পড়ে রকিংচেয়ারে। তার মন কোন কিছুই বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না, মানকচুর পাতা থেকে গাড়িয়ে পড়া শিশিরের মতো দ্রুত স্মৃতিদগ্ধ তাবৎ ইমেজরাজি উপে যায়। ব্যাথা-বেদনার অনুভূতি বোধ করি এ মুহূর্তে তার মধ্যে প্রবল নয়, কাউয়ার ডাকটিও মৃদু হতে হতে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সে যেন মুগ্ধ হয়ে ডেসিং টেবিলের আয়নায় দেখতে থাকে, রকিংচেয়ারসুদ্ধ একটি বালকের ক্রমাগত দুলে যাওয়া। বেজায় দোদুল্যমান রেখাচিত্রের দিকে তাকিয়ে থেকে তার মধ্যে ফিরে আসে ছন্দের দোলখেল। সে মশগুল হয়ে আবৃত্তি কয়ে যায়,‘ ছিপখান তিন-দাঁড়/ তিনজন মাল্লা/ চৌপর দিন-ভোর/ দ্যায় দূর-পাল্লা..।’

হঠৎ করে, যেন কিছু একটা মনে পড়েছে, এ রকমভাবে রকিংচেয়ার থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দারা বেরিয়ে আসে বারান্দায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকটা সময় সে চৌদেয়ারের উপর দিয়ে দেখে, কাছারি ঘরের চাল আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার রূপবাহার। লোহিতের তুমুল বর্ণঢ্যতা তাকে একটু যেন আনমনা করে দেয়। কেন সে আধোন্ধকার কামরাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে, তা পুরোপুরি ভুলে গিয়ে, খুশবাস হালতে সে খানিকটা ডাব্লিউ শেইপের পুরো দালান ঘেরা বারান্দা ধরে হাঁটে।

দারা কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে অতঃপর উঠে আসে দক্ষিণ দিকের খোলামেলা ঝুলবারান্দায় ছত্রিতলে। ছোট্ট পরিসরের বেলকনি মতো এ বারান্দাটি মল-পুকুরের জল থেকে উঠে আসা দুটি খুঁটির উপর দাঁড় করানো। কচুরিপানার বেগুনি ফুলে ফুলে সামাচ্ছন্ন জল ছুঁয়ে ভেসে আসছে আলোবোলা হাওয়া। সে নিরিখ করে ঝুলবারান্দার প্রতিটি ডিটেলসের যেন মাপঝোক নিতে থাকে।

ক্যানসারে কাহিল হতে হতে এক পর্যায়ে তার আম্মা আর হাঁটাচলা করতে পারতেন না। তবে তাঁর সই সুফিয়াখালা আসলে তাঁর কাঁধে ভর দিয়ে, কামকাজের ঝি-বেটিদের সহায়তায়, কষ্টেসৃষ্টে ঝুলবারান্দায় উঠে এসে আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়ে বসতেন। মাঝেমধ্যে তাঁর শরীর-গতর থেকে থেকে কেঁপে উঠলে, সুফিয়াখালা কম্বল মুড়িয়ে দিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতেন।

তবে কোন কোন দিন যাদুবলে যেন আম্মার শরীর ভালো হয়ে ওঠতো। খুশমেজাজে দারাকে পড়ে শোনাতেন দু-চারটি কবিতা। সুফিয়াখালার কাঁধে ভর দিয়ে গিয়ে বসতেন গোল টেবিলে। তাজমহলের ছবিটি দেয়াল থেকে নামিয়ে এনে তাঁর চোখের সামনে রাখা হতো। ওই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, তিনি বেশ বড়সড় একটি সফেদ কাপড়ে পেন্সিলে অনেক সময় নিয়ে নক্সাাটি তুলেন। তারপর নানা রঙের রেশম দিয়ে সামান্য একটু এম্ব্রয়ডারিও শুরু করেছিলেন, কিন্তু আগাতে পারলেন না, মুখ দিয়ে রক্ত উঠলো, রেডিয়েশন থেরাপি দিতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো ঢাকা শহরে।

পুরো এক মাস পর আম্মা বাড়ি ফিরে আসেন। চিকিৎসায় একটু ভালোও হয়েছেন, তবে চোখমুখ ক্যামন যেন বিবর্ণ ময়লা হয়ে উঠেছে, পাঁজাকোলা করে এনে আরাম কেদারায় বসানো যেত, কিন্তু হাতে সুইসুতো নেয়ার তাকদ ছিলো না।

সুফিয়াখালা প্রায় সারাদিনই এ বাড়িতে পড়ে থেকে সই এর দেখভাল করছেন। এ সময় তাজমহলের নক্সাটি এম্ব্রয়ডারিতে ফুটে উঠতে শুরু করে। আম্মা রেশম ইত্যাদি ঠিক করে দিতেন, তাঁর নির্দেশনা মতো আরাম কেদারার সামনে — যেখানে মেঝেতে মোজাইকের রঙচটা পদ্মটি আছে, ঠিক ওখানে শীতলপাটি বিছিয়ে সুফিয়াখালা এম্ব্রয়ডারি করতে শুরু করেন।

মসজিদের মতো সৌধটির আকৃতি একটু ফুটে উঠতেই আম্মা তাকে রূপালি রেশমে কীভাবে প্রতিফলন পুকুর ও সড়কের দু’পাশে সবুজ চুমকিতে ঝাউ গাছ প্রভৃতি ফুটাতে হবে — তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝিয়ে দেন। কথা বলতে বলতে তাঁর মুখে ফের রক্ত উঠে, এবং তিনি বাদ মাগরেব ইন্তেকাল করেন।

দারা এ মুহূর্তে মোজাইকের রঙচটা পদ্মটির উপর দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওখানে ঝুলছে চিমনি ভাঙ্গা একটি হ্যাজাক বাতি, তাতে এক জোড়া চড়ূই বাসা বেঁধেছে। পাখি দুটি ফুরুত ফুরুত করে আসা যাওয়া করছে, ঠোঁটে করে নিয়ে আসছে খড়কুটা। বারান্দার কোন ডিটেলের তেমন পরিবর্তন হয়নি, শুধু তাঁর আম্মাই এ পরিসরে গয়েরাজির। ছেলেটির কান্না পায় না, নতুন কোন কবিতা যে সে শুনতে পাচ্ছে না, এ নিয়েও তার কোন আক্ষেপ নেই, তবে এখানে দাঁড়িয়ে সে যেন ফের ছাতিম গাছের ডালে বসা কাউয়াটির কা কা শুনতে পায়।

কুচকুচে কালো পাখিটির কর্কশ ধ্বনি ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে দারার করোটি থেকে, আর সাথে সাথে এম্ব্রয়ডারিতে তাজমহলের পূর্ণাঙ্গ দৃশ্যপট ভেসে উঠছে তার মনসচক্ষে। আম্মার মৃত্যু পর সুফিয়াখালা অসম্পূর্ণ সূচিকর্মটি তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। অতঃপর তাঁর স্বামী — দারার খালু কঠিন অসুখে পড়লেন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য শহরে নিয়ে যাওয়া হলো,খানিকটা ভালো হয়ে বাড়িও ফিরে আসলেন, ফের ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার কবিরাজ দেখানো হলো, ফিরে আসলেন প্রায় চলৎশক্তিহীন হয়ে। কিছুদিন ঘরবৈঠকী হালতে বিছানায় পড়ে থাকলেন।

ওই সময় সুফিয়াখালা তাদের খানা কামরার টেবিলে অসম্পূর্ণ সূচিকর্মটি নিয়ে আবার বসেন। দিন-কে-দিন তিনি সুই-সুতা-রেশম ও চুমকি দিয়ে অনেক মেহনতে তাজমহলের তসবিরটি পূর্ণাঙ্গ করে তুলেন। খালার পরিবার যে রোগব্যাধিজনিত সংকটে বিপন্ন হয়ে উঠেছে, তিনি যে আগের মতো তার দিকে মনযোগ দিতে পারছেন না, অত শত কী দারা বুঝতে পারে?

এ ব্যাপারে নির্দ্দিষ্ট করে কিছু বলা মুশকিল। তবে খালাদের খানা কামরার দেয়ালে আম্মার নক্সা করা তাজমহলের খুটিনাটিতে বিস্তারিত ছবি যে ঝুলছে — এ ব্যাপারে দারা ষোল আনা সচেতন। চিত্রটির কথা মনে পড়লেই, সামান্য একটু হেঁটে খালার বাড়িতে গিয়ে সূচিকর্মটির সামনে খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকা তার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তো অভ্যাসের টানে দারা এক সময় হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছন দিকের ঝোপঝাড়ে পূর্ণ জংলা মতো পরিসর অতিক্রম করে এসে পৌঁছে খালার বাড়ির আঙিনায়।

উঠানে বান্দরের লাঠি গাছটির তলায় দাঁড়িয়ে আছে একটি ট্রাক। তাতে তাঁর খালাতো ভাই এর সাথে মিলে-ঝুলে কামকাজের লোকজন তুলছে — ছ্যালার টাটে আয়না প্যাচানো একটি ড্রেসিং টেবিল, বেতের সোফা ও মোড়াগুলো আগেই তোলা হয়েছে। বৃক্ষটিতে ঝেপে এসেছে হলুদ ফুল। ঝলমলে পাপড়ি ছড়িয়ে একটি গুচ্ছ কেন জানি ঝরে পড়ে ট্রাকের বনেটে। বাক্সে করে আনা হয় চীনামাটির বাসনকোসন, সুফিয়াখালা ছন্নের মতো ছুটে এসে জিনিসগুলো কম্বল দিয়ে প্যাচিয়ে ট্রাকে তুলতে বলেন।

না, খালা দারার সঙ্গে কোন কথাবার্তা না বলে ক্যামোন যেন বিভ্রান্তের মতো ফিরে যান ঘরে। ছায়া দেয়া পুষ্পিত তরুটির দারুণ রকমের হলুদ বর্ণ দারাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। সে বান্দরের লাঠি গাছটির দিকে তব্দিলের মতো তাকিয়ে থাকে। গেল মাস সাতেকে দারার খালুর স্বাস্থ্যসংকট আরো ঘনিভূত হয়েছে, তাঁর মস্তিষ্কে ব্রেন টিউমারজনিত বিষ-বেদনা তীব্র হয়ে উঠলে — খালা সোনার জেওরপত্র বিক্রি করে তাঁকে করাচী নিয়ে গিয়েছিলেন, ওখানে প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসক ডাক্তার জুম্মা সয়ং অপারেশন করেছিলেন, কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাময় ঘটেনি।

বর্তমানে তার খালু ঢাকা শহরের এক আত্মীয়ের বাসায় শয্যাশায়ী আছেন, তিনি আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না, সেবা দেয়ার জন্য তাঁকে হামেশা একটি হাসপাতালের নিকটবর্তী কোন জায়গায় রাখতে হবে, তাই খালা পারিবারিক বসতবাড়িটি বিক্রি করে আজ একেবারে ঢাকা শহরে চলে যাচ্ছেন। বাড়ি বিক্রির টাকাতে বাসা কেনার পরিকল্পনা চলছে, এ সব তথ্য দারার কানে এসেছে, কিন্তু আদতে এ পরিবারে কী ঘটতে যাচ্ছে, দারা বোধ করি তা পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেনি।

কামকাজের লোকজন ধরাধরি করে বিরাট একটি আলমারি নিয়ে ট্রাকের দিকে আসছে। দারার খালাত ভাই তিন ব্যান্ডের ফিলিপস্ রেডিওটি বয়ে এনে, তার পাশে দাঁড়িয়ে উদবিগ্ন স্বরে বলেন,‘এই — দাঁড়িয়ে আছো কেন, জিনিসপত্রের সাথে ধাক্কাধুক্কা লেগে যাবে তো, যাও, ঘরে গিয়ে বস।’

দারা উঠান পেরিয়ে উঠে আসে বারান্দায়, না, বসার জন্য বেতের চেয়ার বা মোড়া ইত্যাদি বোধ করি — সব অলরেডি ট্রাকে তোলা হয়ে গেছে। বসে জিরানোর আগ্রহও দারার নেই।

সে ঘরে ঢুকে প্রায় আসবাবপত্রহীন হয়ে আসা কামরায়গুলোতে ঘুরপাক করে। একটি সিংগার মেশিন বয়ে নিয়ে তার খালা পাশ দিয়ে হেঁটে যান। এ বাড়িতে আসলে আগে যে রকম তাকে বসিয়ে তিনি সুজির হালওয়া করে দিতেন, কখনো লেবুর শরবতের সঙ্গে হাতে তুলে দিতেন দুখানা নানখাতাই বিস্কুট, আজ কিন্তু এসব কিছুই ঘটে না, মনে হয়, দারার দিকে নজর দেয়ার ফুরসত খালা পাচ্ছেন না।

দারা এবার এসে দাঁড়ায় খানা কামরায়। মধ্যিখানের বড়সড় টেবিলটি সরানোর ফলে বেজায় খালি খালি লাগে। কামরার এক কোণে একটির উপর আরেকটি তুলে তিনটি চেয়ার রাখা হয়েছে। সে দু’পা এগিয়ে গিয়ে দেয়াল স্পর্শ করে, ঠিক এই জায়গায় দু-এক দিন আগেও ঝুলতো তাজমহলের সূচিকর্মটি। ফিরে আসেন তার খালা, একটু দাঁড়ান, কিছু না বলে তিনি আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেন দারার মুখ। রান্নাঘর থেকে খালাত বোন ডেকে উঠলে, তিনি হন্তদন্ত হয়ে দারাকে ছেড়ে ছুটে যান ওই দিকে।

না, চিত্রটি আর ঝুলছে না। তবে আয়না বাঁধানো ভারি ফ্রেম সরিয়ে ফেলার দাগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেয়ালে। দারা হাত বাড়িয়ে আংগুল দিয়ে তা স্পর্শ করে, তারপর নীরবে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। উঠানে ট্রাকটির পিটে চেপে তার খালাত ভাই কামকাজের লোকজনদের সাথে মিলেঝুলে আসবাবপত্র ও বাকসো-পোটরা গোছানোর চেষ্টা করছেন। ওই দিকে নজর না দিয়ে দারা দ্রুত হেঁটে ফিরে আসে নিজ বাড়িতে।

সিঁড়ি ধরে বারান্দায় উঠতে উঠতে সে অনুভব করে, কুচকুচে কালো কাউয়াটি তার পাঁজরের ভেতর পাখা ঝাপটাচ্ছে। কোন দিকে না তাকিয়ে — দুয়ার খুলে সে ঢুকে পড়ে আধোন্ধকার কামরায়। তারপর রকিংচেয়ারে বসে বেজায় জোরে দুলতে দুলতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও বুঝতে পারে না।

ঝি-বেটির হাঁকডাকে অতঃপর দারা জেগে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। উঠানে দাঁড়িয়ে আছে সেভেন-সিটার জাতীয় একটি গাড়ি। তার ছাদে কয়েকটি ট্রাংক ও স্যুটকেস দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। ঝি হাত ধরে তাকে নিয়ে আসে দাদীআম্মার কামরায়। ওখানে সুফিয়াখালার পুরো পরিবারকে দেখতে পেয়ে সে অবাক হয় না তেমন। খালাত বোন তার ঘাড়ে হাত রেখে তাকে ঘুরিয়ে দেয়।

দেয়ালে হরিণের জোড়া শিংগের তলায় ঝুলছে তার আম্মার নক্সা করা তাজমহলের সূচিকর্মটি। খালাত ভাই নাড়াচাড়া করে এক দিকে কাত হয়ে যাওয়া ফ্রেমটি ঠিক করে দিচ্ছেন। জানালা গলে বিকালের আলো এসে সারি দিয়ে সাজানো ঝাউবীথিকার চুমকিগুলোকে ঝলমলিয়ে দিচ্ছে। দারা যেন সম্মোহিত হয়ে ওই দিকে তাকিয়ে থাকে। সুফিয়াখালা এসে উল্টাপাল্টা করে পরা তার শার্টের বোতাম ঠিক করে দেন। অতঃপর তিনি উঠে ড্রেসিং টেবিল থেকে একটি চিরুনি তুলে নিয়ে তার চুলও আচড়িয়ে দেন।

দাদীআম্মার কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে — সুফিয়াখালা বাস্তুভিটা বিক্রি করে গ্রাম ছাড়ার অজুহাত হিসাবে তাঁর স্বামীর শরীর খারাপের প্রসঙ্গ তুলেন। ডাক্তার জুম্মা তাঁর রোগগ্রস্থ হালতে বছর কয়েক বেঁচে থাকার সম্ভাবনার ব্যাপারে আশাবাদী, তবে সপ্তাহে অন্তত দু-বার করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। এছাড়া হঠাৎ করে অবস্থার অবনতি হলে যাতে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা যায় — এ ব্যাপার মাথায় রেখে পরিবারটি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি কেনার মতো একটি বাসাও পাওয়া গেছে।

খালা দাদীআম্মার পা ছুঁয়ে সালাম করে বেশ জোর দিয়ে বলেন, ঢাকায় সংসারের সব কিছু সুশার হলে উঠলে তিনি ছেলেকে দিয়ে আর্ট স্কুলে খোঁজ নেয়াবেন। হয়তো কোন একদিন দারা তাঁর বাসায় থেকে ওখানে ছবি আঁকা শিখতে পারবে।

কেমন যেন ঘোরের ভেতর সমস্ত কিছু ঘটে যায়। খালা পরিবারের সকলকে নিয়ে সেভেন-সিটারে চেপে বসেন। বার কয়েক হ্যান্ডোল মারার পর গাড়িটি স্টার্ট নেয়। চাকার দাগ থেকে জেগে উঠা ধুলাবালি উপেক্ষা করে — দারা চলমান গাড়িটির পেছন পেছন হেঁটে যায় বাড়ির বাইরে। সড়কে — খানিক দূরে — গাড়িটি বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে গেলেও সে দাঁড়িয়ে থাকে আরো কিছুক্ষণ। আর তার করোটিতে ফের ধ্বনিত হতে থাকে, ছাতিম গাছের ডালে বসে থাকা কালো পাখিটির আর্তস্বর।

 

মঈনুস সুলতান

জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট করেন। বছর পাঁচেক কাজ করেন লাওসে-একটি উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে।

খণ্ড-কালীন অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস এবং স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস এর। কনসালটেন্ট হিসাবে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, মেসিডোনিয়া ও কিরগিজস্তান প্রভৃতি দেশে কাজ করেন অনেক বছর।

ইবোলা সংকটের সময় লেখক ডেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস নামে একটি ফান্ডিং কর্মসূচির সমন্বয়কারী হিসাবে সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা শহরে বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচীন মুদ্রা, সূচিশিল্প, পাণ্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top