বেন ওকরি’র গল্প জীবিত জনের প্রার্থনা

ভাষান্তর: নাহার তৃণা

[বেন ওকরি(জন্ম ১৫মার্চ ১৯৫৯) নাইজেরিয়ান কবি, ছোটগল্পকার এবং ঔপন্যাসিক উত্তর আধুনিক এবং উত্তর ঔপনিবেশিক ঐহিত্যের ক্ষেত্রে বেন ওকরিকে একজন অন্যতম বলিষ্ঠ লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয় লেখনশৈলীর জনপ্রিয়তার কারণে প্রায়শ তাঁকে  সালমান রুশদি এবং  গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতো লেখকদের সাথে তাঁর তুলনা করা হয়ে থাকে উরহোবো(Urhobo) গোত্রের বেন ওকরি পশ্চিমমধ্য নাইজেরিয়ার মিনা প্রদেশে ১৯৫৯ সালে জন্ম গ্রহন করেন ওকরি বয়স যখন প্রায় দুবছর তখন তাঁর বাবা সিলভার সপরিবারে নাইজেরিয়া ত্যাগ করে লণ্ডন পাড়ি জমান লণ্ডনের যাওয়ার পেছনে বেনের বাবার যে স্বপ্নটি ছিল সেটি হলো আইন বিষয়ে অধ্যায় করা লণ্ডনে বেন তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব শুরু করেন প্যাকহ্যাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাত ধরে ১৯৬৮ সালে বেনরা আবার সপরিবারে নাইজেরিয়া ফিরে আসেন তাঁর বাবা লাগোসে আইন ব্যবসা শুরু করেন বেন নাইজেরিয়ায় উরহোবো কলেজে ভর্তি হন পরে আরো পড়াশোনার জন্য লণ্ডন যান এবং কোলচেস্টারের এ্যাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করেন বেন ওকরি সবচেকম বয়সী লেখক হিসেবে ১৯৯১ সালে বুকার পুরস্কার লাভ করেন তাঁর বহুল চর্চিত এবং প্রশংসিত দুটি বই হলো দ্য ফ্যামিসড রোড(The Famished Road(1980), দ্য ল্যাণ্ডস্কেপস উইদইন (The Landscapes Within (1981),  দ্য ফ্যামিসড রোড তাঁর প্রথম উপন্যাস এবং এই বইটির জন্যেই তিনি বুকার পেয়েছিলেন আরো অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে কমনওয়েথ পুরস্কারের সম্মানও বেনের ঝুলিতে রয়েছে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ, যুদ্ধে বিপর্যস্ত মানবিকতা, জাদুবাস্তবতা বেনের লেখায় বিশেষ স্হান অধিকার করে থাকে।]

 

সূর্যের শরীর থেকে সারাদিনের তেজটুকু মুছে গিয়ে যখন সেটা ডুবতে বসেছে, তখনই আমরা শহরে প্রবেশ করলাম। প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করলাম কেউ বেঁচে আছে কিনা। অধিকাংশ বাড়ির অবস্হা শোচনীয়, ছাদ ভেঙে পড়েছে, দেয়ালগুলো উবে গেছে। চারপাশের সব ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপের চেহারা নিয়েছে। মৃত্যুর করাল গ্রাসে গোটা শহরটা বুঝি নিথর। গোটা শহরই বন্দুকধারীদের দখলে। বিশৃঙ্খলতার ষোলকলায় বুঝি পরিপূর্ণ পৃথিবীর এই চরাচর। শহরটা দাঙ্গাবাজ যেসব ছোটখাট পাণ্ডাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো তারা আমাদের জন্য আসা খাদ্যবস্তু নিজেদের কব্জায় নিয়েছিল। এখানকার আকাশসীমায় কোনো বিমান প্রবেশে বাধা দেয়ার সাথে সাথে আমাদের জন্য আগত ত্রাণের খাদ্যসামগ্রী সব তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। আমাদের দিকে নজর দেয়ার কোনো বালাই ছিলো না তাদের। আমরা খেলাম কী খেলাম না, সেটাও গ্রাহ্যের মধ্যে ছিল না। আমি গত তিন সপ্তাহ ধরে না খেয়ে আছি। বাতাস খেয়ে এখন পেট ভরাচ্ছি এবং অবিরাম খুঁজে যাচ্ছি। না খেয়ে থাকায় প্রতিদিনই আমি একটু একটু করে যত শুকিয়ে যাচ্ছি, ততই যেন আমার চারপাশে নানান কিছু দেখতে পাচ্ছি। আমি মৃতদের দেখি, যারা অনাহারে ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছিল, আমি তাদের দেখতে পাই।

দেখি, তারা আগের চেয়ে এখন বেশ আনন্দে আছে। আমাদের তুলনায় অনেক সুখে আছে। সবখানেই তাদের দেখতে পাই। তারা হাসি আনন্দে প্রাণবন্ত জীবন কাটাচ্ছে, দেখে মনেই হয়না কোথাও কিচ্ছু ঘটেছে, যেন তারা আমাদের চেয়েও বেশী সজীব। ক্ষিদের যন্ত্রণাটা যতবেশি আমাকে কাবু করছে ততবেশি তারা চারপাশে জড়ো হচ্ছে। আমার যেসব পুরোনো বন্ধু আমার আগে মারা গেছে- তাদের শরীর এখন মাছি বাহিনীর দখলে। তারা উন্মুক্ত আলো হাওয়ার উ্পর আছে এখন।  আমরা যারা জীবিত আছি – তাদের দিকে তাকিয়ে আছে অতিশয় করুণা আর সহানুভূতির দৃষ্টিতে।

আমার মনে হয় মৃতদের বেঁচে থাকার এই বিষয়টা আমাদের শ্বেতাঙ্গ যেসব ভাইয়েরা টিভি ক্যামেরাসহ সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে আসে তারা ঠিক ঠাওর করতে পারে না। তারা আশা করে আমাদেরকে হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখবে। কিন্তু সে পথে না হেঁটে, তাদের সামনে ভিক্ষের হাত না পেতে সপাটে শান্তচোখে তাদের দিকে চেয়ে থাকি।  হয়ত তারা খুব সন্তর্পণে এমনটা ভাবে যে এভাবে মরতে আমাদের বিন্দুমাত্র ভয় না পাওয়ার পেছনে হেতুটা কী! কিন্তু তিন সপ্তাহ অনাহারের থাকার পর মন যখন তার পর্যবেক্ষণ শক্তি খুইয়ে ফেলে; তুমি তখন জীবিতের চেয়ে অধিকমাত্রায় মৃত। আত্মা তখন এসব ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণের জন্য পালিয়ে বাঁচতে চায় কিন্তু শরীরের সাথে আত্মার নিবিড় সম্পৃক্ততার কারণে ভুগতেই হয়।

আমাদের আসলে ভোরের দিকে শহরে ঢোকা উচিত ছিল। মৃত এই নগরে কেউ বেঁচে নেই। এমনকি ঘোড়া, গরু আর ছাগলগুলোও মরতে বসেছে। বাতাসে মৃত্যুর উৎকট গন্ধ, কিন্তু এটাই শতভাগ সত্যি নয়। বিষাক্ত তাপে পচে যাওয়া চর্বি আর কাঁচা নর্দমার দুর্গন্ধ তার সাথে সঙ্গ দিয়ে ভারি করে তুলেছে শহরের বাতাস তা ঠিক, কিন্তু তার সাথে ফুলেল সুবাস যুক্ত হয়ে একটা তামাশারও সৃষ্টি করেছে।

এখানে শুধু মৃতরাই বেঁচে থাকতে পারে। তারা সবখানেই তুমুলভাবে বেঁচে আছে। তারা সম্মিলিত সুরে গলা মিলিয়ে সোনায় মোড়া দিনের গান গেয়ে, উচ্ছ্বসিতভাবে পরিচিত জীবনের আনন্দ জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে।

আর যারা বেঁচে থাকতে পারছে তারা হলো সৈন্যদল। যারা জীবনভর নিজেদের মধ্যেই নিরন্তর যুদ্ধ করে গেছে। তাতে কতজন মারা গেছে সেটা কোন গুরুতর ব্যাপার নয়। তাদের কাছে আসল ব্যাপার হলো কীভাবে তারা নিদারুণ যুদ্ধকৌশল দিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে এই সুন্দর শ্মশানভূমির দখল নিতে পারবে যা একদা সুসভ্য মানব বসতি ছিল।

আমি আমার পরিবার-পরিজন এবং প্রেমিকাকে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছিলাম। আমার জানা দরকার তারা আদৌ বেঁচে আছে কি নেই। যদি সেটা জানতে না পারি তাহলে অর্থহীন এক অপেক্ষার সুতোয় ঝুলে থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবো বাকী জীবন। তাদের কেউ বেঁচে নেই এবং আমাকে তাদের প্রয়োজন নেই জানতে পারলে আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারতাম। তাদের সম্পর্কে যেসব তথ্য পেয়েছি সেটাই আমাকে এই শহরে নিয়ে এসেছে। আমার প্রেমিকা, ভাই, পরিবার পরিজন যদি কোথাও থেকে থাকে তবে সেটা এই শহর।

পৃথিবীর শেষতম শহর এটি। শহরের মরচে ধরা ফটক পেরিয়ে আছে বিস্তৃত মরুভূমি। সেই মরুভূমি বিস্তৃত হয়ে আছে সমস্ত অতীত জুড়ে, ইতিহাস জুড়ে, পাশ্চাত্য জগতের দিকে, ক্ষুধা আর দারিদ্রের উৎসের দিকে, যেদিকে আছে প্রাণহীন নিষ্ঠুর এক পর্বতমালা।

রাতের বেলা পাহাড়ের শীর্ষদেশ থেকে অতৃপ্ত আত্মাদের হৃদয় বিদারক সঙ্গীতধ্বনি ভেসে আসে। সেই করুণ বিষাদের সুর আমাদের সকল আশাভরসা চুরি করে নেয়, আমাদের বাধ্য করে সচিৎকারে বাতাসের কাছে নিজেদের তেজটুকু বিলিয়ে দিতে। তাদের শীতল সঙ্গীতে আমরা পুরোপুরি বাধ্য হই মৃত্যুর কাছে নিজেদের সমর্পণে।

এইসব যুদ্ধ বিবাদ লাগার আগে, আমাদের ফেলে আসা অতীতে,  পৃথিবীর সকল সুন্দর সম্ভাবনা জেগে ছিল। সেখানে একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আর সুন্দর ভবিষ্যত তৈরি করার সমস্ত সম্ভাবনাই ছিল, কেবল যদি আমরা সেগুলো খুঁজে নিতে সক্ষম হতাম। কিন্তু এখন আমাদের সামনে রয়েছে কেবলি মৃত্যু পাহাড়ের সুকরুণ সুর।

আমি অনেকটা যন্ত্রের মতো এবং কান্নাহীন শুকনো চোখে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম আমার প্রিয় স্বজনদের। আমার ক্ষুধা যন্ত্রণার আর কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। প্রিয়জনদের খুঁজে বেড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না আসলে। পরিচিত মুখ দেখতে পাওয়ার আশায় আমি স্তূপকৃত মৃতদেহগুলো উলটে-পালটে দেখতে থাকি। সব মৃতমুখই পরিচিত মনে হয়। মৃত্যু যেন তাদের সবাইকে আমার আত্মীয় করে তুলেছে।

আমি খুঁজতেই থাকি। একটা অপরিচিত মুখের কাছাকাছি হই, এটা আমার ভাই! অদৃশ্য কারো উদ্দেশ্যে যেন জানিয়ে দেই কিংবা নিজেকেই বোঝাই, ভাইয়ের দেখা পেয়েছি। মুঠোভর্তি মাটি ছড়িয়ে দেই মৃত ভাইয়ের উপর। ঘন্টা খানেক পর, শুকিয়ে যাওয়া একটা কুয়োর কাছাকাছি পরিবারের আরো কয়েকজনের দেখা পাই। আমার মা একটা শুকনো হাড়কে এমন শক্ত করে ধরে আছে যেটাকে একটা মাছিও পুছবে না। অসহায়ভাবে মাথাটা নেড়ে মৃতদেহগুলোর উপর মাটি ছড়িয়ে দেই। তারপর আবার খুঁজতে শুরু থাকি।

আরো একজনকে খুঁজে পাওয়া বাকি আছে আমার, যার অনিন্দ্যসুন্দর অথচ অপরিচিত মৃতমুখটা আমাকে সান্ত্বনা দেবে। যখন আমি সে মুখটা খুঁজে পাবো, পাহাড়ি সে মৃত্যুশীতল গানের  কাছে তখন নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করবো।

সূর্যটা যখন ডুবে যাওয়ার তোড়জোড় করছে, এমন সময় অর্ধনির্মিত একটা স্কুলঘর থেকে একটা গানের সুর ভেসে আসতে শুনলাম। এমন জাদুকরী শ্রুতিমধুর সুর আমি দ্বিতীয়টি শুনিনি; আমার মনে হলো জীবন যাদের কাছে মধুর কেবল তারাই এমন করে গাইতে পারে, এমনভাবে গাইছে যেন তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসেই প্রার্থনা ঝরে পড়ছে।

ভেসে আসা সঙ্গীতটি যেন সৃষ্টিজগতের সূচনার আনন্দ ধ্বনির মতো বেজে যাচ্ছিল। এ যেন যেই পবিত্র নির্দেশ যার মাধ্যমে সকল প্রাণীর মধ্যে জীবনের সঞ্চার ঘটেছিল, উদ্ভিদের মাঝে অঙ্কুরোদগম ঘটিয়েছিল, বনের পশুপাখিরা আনন্দের সাথে নেচে বেড়াতে শুরু করেছিল, মানুষের পরিচয় ঘটেছিল রঙিন পৃথিবীর সাথে, যারা প্রথমবারের মতো দু’চোখ ভরে দেখতে শুরু করেছিল বৃক্ষের সবুজ, সমুদ্রের নীল, বাতাসের সোনালী আভা আর নক্ষত্রের রূপোলী আলো।

আমার অনুসন্ধানের সত্যিকারের পরিসমাপ্তি ঘটলো এখানে। এই সঙ্গীত যেন আমার এই দু্‌র্বিসহ জীবনের পুরস্কার, যদিও এই পরিণতি আমি আশা করিনি। মনে হচ্ছিল স্কুল ঘরটিতে পৌঁছাতে অনন্ত সময় লেগে যাবে। শরীরে কোনো শক্তি আর অবশিষ্ট ছিলো না, তা সত্ত্বেও এতটা পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছি শুধুমাত্র আমার ক্ষুধার্ত পেটের বিশাল জায়গা জুড়ে গানের সুরটি অনুরণন তুলে যাচ্ছিল, যা আমাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছে।

মনে হয় এক শতাব্দী পরে, যখন ইতিহাস নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল আর ঠিক একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, কেননা আমাদের মধ্যে কেউই বিগত জীবন থেকে পাঠ নেবার শিক্ষা নেয়নি, বা আমাদের যন্ত্রণাসমূহ থেকে শেখাটাকে খুব একটা পছন্দের বলে ভাবেনি।

শেষ পর্যন্ত আমি স্কুলঘরের দরজায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হলাম।

কিন্তু এই বিধ্বস্ত শহরের বেঁচে যাওয়া একমাত্র প্রাণী একটি গরু আমার পৌঁছে যাওয়ার আগেভাগে স্কুলঘরের দরজায় পৌঁছে যায়। খুব সম্ভবত, গরুটিও ভেসে আসা ওই সুর দ্বারা তাড়িত হয়েই এসেছে। গরুটি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো, এবং আমিও তাকে অনুসরণ করলাম।

গোটা ঘরের সবটুকু জায়গা আগেই মৃতদের দখলে চলে গেছে। কিন্তু ঘরের বাতাসে মোটেও দমবন্ধ ভাব ছিলো না, সজীবতায় ভরপুর ছিলো সে বাতাস। বাতাস জুড়ে একটি স্তবধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছিল। যা কিনা মৃত্যুর চেয়েও দুর্গন্ধময়। কিন্তু এই ঘরের মৃতরা বাইরের স্তূপকৃত মৃতদের চেয়ে একেবারেই আলাদা।

স্কুলঘরের লাশগুলোকে, ধৃষ্টতা ক্ষমা করা হোক( -ঈশ্বর করুণা করুক-) মনে হচ্ছে জীবিত। কারণ তাদের প্রশান্তিময় উপস্হিতির বর্ণনায় এরচে’ উপযুক্ত শব্দ আমার জানা নেই। আমি অনুভব করেছি যে তারা নিজেরাই কক্ষটিকে প্রশান্তময় করে তুলেছিল কারণ তারা তাদের শেষ মুহুর্তগুলিতে কেবল নিজেদের কথা ভাবেনি, ভেবেছে সবার কথা, যারা একই পরিণতি ভোগ করছে।

ব্যাপারটা এ জন্যই হয়ত আমি বুঝতে সক্ষম হয়েছি, কারণ আমি নিজেও একটা পর্যায়ে ওই একই কাজ করতে শুরু করি। হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের এক কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসবার পর অনুভব করলাম যে আমিও গোটা মানব জাতির জন্য প্রার্থনা করতে শুরু করেছি। আমি প্রার্থনা করেছি— যদিও খুব ভালোভাবেই জানা ছিলো প্রার্থনার এই বিষয়টা হয়ত সময় নষ্ট বৈ আর কিছু নয়— তবুও আমার মন সমস্ত জীবিতদের জন্য প্রার্থনায় নত হতে চাইলো, এই প্রার্থনা পর্বত এবং গাছেদের জন্য, জীবজন্তু এবং নদনদীর জন্য, আমার এই প্রার্থনা যে যেখানে আছে সে সমস্ত মানুষের জন্য।

যন্ত্রণায় কাতর সমস্ত মানবজাতির কাতরতা আমার কানে ভেসে আসে; যে সুরটা একই সঙ্গে ছিলো তীব্র এবং সম্মোহনীয়। আমারও তখন ঠোঁট নড়াবার শক্তিটুকু আর অবশিষ্ট নেই, তবুও মনে মনেই কখন জানিনা আমিও সেই সুরটা গুনগুনাতে শুরু করেছি। সমস্ত সন্ধ্যাটাই আমি সেই সুরে মগ্ন ছিলাম। তারপর এক সময় যখন মুখ ফিরিয়ে পাশের স্নিগ্ধোজ্জ্বল অপরিচিত মুখটার দিকে তাকালাম, দেখি সে আমারই প্রেমিকা! খুঁজে পাওয়ার আনন্দ ঝরে পড়লো আমার প্রার্থনা সঙ্গীতে।

টিভি ক্যামেরাসহ একজন সহৃদয় শ্বেতাঙ্গ যখন স্কুলঘরের ভেতর এলেন, তখনও আমি নিঃশব্দেই গেয়ে চলেছি। আমার দু’চোখ জলে আচ্ছন্ন, আমি কাঁদছি; বাইরের পৃথিবীর মানুষদের জানান দিতে ঘরভর্তি মৃতদের ভিডিও ধারণ করা হচ্ছিল,  তখন আমি আশা করছিলাম আমার গানটিও রেকর্ড করা হয়েছে। আমার চারপাশের মৃতদেহগুলোর মুখ জুড়ে শান্তসমাহিত হাসি লেপ্টে আছে। তারা কেউ আমাকে কোনো আকুতি জানায়নি, শান্ত, নিঃশব্দ মুখগুলো ভেসে যাচ্ছিলো এক অপার্থিব আনন্দের ঝলকানিতে। কেউ আমাকে কোনো রকম তাড়া দিচ্ছিল না তাদের সঙ্গী হবার জন্য। আমার ইচ্ছের উপর ছেড়ে দিয়েছিল ব্যাপারটা।

কোনটা বেছে নেবো আমি? মানব জীবন — যা সীমাহীন লোভ লালসা আর তিক্ততায় পরিপূর্ণ, যে জীবনে কখনো নিষ্ঠুর হতে হয় কখনোবা দয়ালু, কখনো বেঁচে থাকার জন্য চরম ভণ্ডামিও করে যেতে হয়। সেই জীবন— যা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে গেছে নিরন্তর। তাছাড়া এখন আর আমার বেঁচে থাকার জন্য কিস্যু অবশিষ্ট নেই। প্রবল ক্ষুধার যাতনায় আমার আত্মার মৃত্যু ঘটেছে।

শেষবারের মতো আমি চোখ খুললাম। দেখতে পেলাম আমাদের উপর উন্মুখ ক্যামেরা তাক করা। আমরা এখন খবর সংগ্রহকদের কাছে মৃত ছাড়া কিস্যু নই। কিন্তু আমি যখন তীব্র এক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে অচেনা এক আলোর পথে ভাসতে ভাসতে পাড়ি জমাচ্ছি অন্যলোকে, তখন যেন আমিও ওদের দেখতে পাচ্ছি মায়ামমতাশূন্য ভালোবাসাহীন এক বিরান পৃথিবীতে মৃতপ্রায় পড়ে আছে ওরাও। দৃশ্যত নির্জন ঘরে গরুটা হেঁটে বেড়াচ্ছে আপন খেয়ালে, সমস্ত মৃতদের মধ্যে আমার স্বস্তিময় ভঙ্গিতে পড়ে থাকার দৃশ্যটা বুঝি ক্যামেরা হাতের লোকগুলোর চোখে বেশ দৃষ্টিকটু ঠেকলো। তাদের চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে আমিও হাতপা খানিকটা নেড়ে আড়ষ্ঠতা ভেঙে পাশে থাকা প্রেমিকার হাতটা ধরলাম। অব্যক্ত যন্ত্রণায় শ্বাস নিয়ে, খাবি খেতে খেতেও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললাম, তারপর পুরোপুরি নিজেকে ছেড়ে দিলাম। সন্দেহ নেই, আমার হাসিটি উপস্হিত সাংবাদিকদের হতবাক করেছে, কিন্তু ওরা যদি আমার মনের কথাটা জানতো, তাহলে বুঝতে পারতো আমি এভাবেই বিদায় বলি, এভাবেই বিদায় নিচ্ছি।

মূলগল্প: A prayer from the living by Ben Okri

 

নাহার তৃণা

জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top