নাহার তৃণা: অ্যানি এরনো অসাধারণ এক সাধারণ নারী যাঁর শব্দেরা ছুরির ফলার মতো ঝলসে ওঠে

ফ্রান্স এবং ফ্রান্সের বাইরে কয়েক প্রজন্ম ধরে নারীবাদের প্রতীক হিসেবে সুপরিচিত অ্যানি এরনো(Annie Ernaux) [মতান্তরে: আরনোঁ, অ্যাখনো, অ্যাহনো] সাহিত্য জগতের সাম্প্রতিকতম মুকুটটি পরেছেন নোবেল পুরস্কার জয়ের মাধ্যমে। তাঁকে এই সম্মানে ভূষিত করবার সপক্ষে সুইডিশ একাডেমির স্হায়ী সেক্রেটারি ম্যাটস মালম বলেন, “এরনো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন সাহস ও নৈর্ব্যক্তিক তীক্ষ্ণতার জন্য, যার সাহায্যে তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতি, বিচ্ছিন্নতা এবং যৌথ অবকাঠামোর শিকড় উন্মোচন করেছেন।”

লেখক মাত্রই একেক জন নিঃসঙ্গ শেরপা। তার উপর যদি তিনি নারী হয়ে জন্মান, সমাজ-সংসারের হাজারও মুখনাড়া সয়ে তার একক যাত্রাকে এগিয়ে নিতে হয়। সুদীর্ঘ এমন যাত্রার সফল গন্তব্যে সবার পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। অ্যানি থেরিস ব্ল্যাশঁ এরনো(Annie Thérèse Blanche Ernaux) সেটি পেরেছেন। পুরস্কার প্রাপ্তি মানেই সফল সেকথা হচ্ছে না, যাপিত জীবনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট নানা উত্থান-পতন পেছনে ফেলে নিরন্তর লিখে যাওয়ার যে উদাহরণ তিনি রেখেছেন সেটিকে কুর্নিশ জানাতেই বলা। সত্যি স্বীকারের চর্চায়  অ্যানি এরনো শুধুমাত্র নারীদের নন, বহু পুরুষকেও পথ দেখাবেন সন্দেহ নাই। সাহিত্যের ভুবনে  অ্যানির আপোসহীন নিরলস যাত্রা প্রসঙ্গে তাঁর ইউএস পাবলিশার্স সেভেন স্টোরিজের প্রকাশক ড্যান সিমনের ভাষ্যটি যথার্থ বলে মনে করি- “She has stood up for herself as a woman, as someone who came from the French working class, unbowed, for decade after decade”.

আত্মজৈবিক লেখায় আবেগ ঢেলে পাঠককে ভাসিয়ে নেবার মোহ থেকে কী অসম্ভব কুশলীর মতো নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন, সেটা তাঁর সৃষ্টির নৈকট্যে না গেলে বোঝা যাবে না। তাঁর সংযত, নির্মোহ প্রকাশভঙ্গি শুধুমাত্র তাঁর রচনাগুলোতেই প্রতিফলিত হয়নি; নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়েও রাশ টানতে ভোলেন না অ্যানি।

এএফপির এক সাক্ষাৎকারে নিজের পরিচয় হিসেবে সাহসী লেখনীর অধিকারী এরনোর বিনীত অথচ ঋজুকণ্ঠের উচ্চারণ—“আমি সাধারণ এক নারী, যে লেখালিখি করে, ব্যস।” কান শহরে তাঁর একটি পারিবারিক তথ্যচিত্র প্রদর্শনী চলাকালীন সময়ে এএফপি ( Agence France-Presse)এর সাংবাদিককে এরনো নিজের সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন। সেদিন কানে এরনোর পারিবারিক একটি ভিডিও তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী চলছিল, নাম “দ্য সুপার এইট ইয়ারস।” ওই দশকে তিনি ফরাসি সাহিত্যের প্রধান কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ধারণকৃত ভিডিওগুলোর মাধ্যমে তাঁর প্রাক্তন প্রয়াত স্বামী দেখাতে চেয়েছিলেন কীভাবে বিবাহিত বুর্জোয়ারা জীবনযাপন করে, কীভাবে তারা নিজেদেরকে লেখক হিসেবে জাহির করে।

সেদিনের সংক্ষিপ্ত কথোপকথনে তিনি বলেন-”ওই দশ বছর ছিল আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্ব, কারণ ওই সময়কালে আমি লেখালিখি করার জন্য নিজেকে তৈরি করতে পেরেছিলাম এবং ওই সময়েই আমি আমার স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। ওই স্বাধীনতাটুকু মুঠোতে পুরতে না পারলে আমি কিছুতেই লেখক হতে পারতাম না। যদিও আমি প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। এটা আমার জীবনের গল্প, কিন্তু এটা সেইসব হাজারো নারীদেরও গল্প যারা ওরকম স্বাধীনতার জন্য হাহাকার করে মরছে।”

এরনো তাঁর প্রথম উপন্যাস “ক্লিনড আউট” প্রকাশ করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। যার কাহিনি ছিল পরিবার থেকে গোপন রাখা ব্যক্তিগত গর্ভপাতের এক ভয়ানক কাহিনি।

প্রেম থেকে পরিণয়ে আবদ্ধ অসুখী জীবনের সমাপ্তি টেনে ফিলিপ এরনো(Philippe Ernaux)র সাথে ১৯৮৪ সালে অ্যানি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। এরপর একাই ছেলেদের বড় করে তোলার দায়িত্ব পালন করেন। “দ্য সুপার এইট ইয়ারস” ছিল তাঁর নিজের পরিচালনার প্রথম ছবি। তবে তাঁর উপন্যাস  নিয়ে অন্যান্য পরিচালকদের হাতে কয়েকটি দর্শকনন্দিত সিনেমা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য “দ্য আদার ওয়ান(ফরাসি নাম L’Autre) যেটি তাঁর  লা’অকুপেশন (L’Occupation) উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। প্যাট্রিক মারিও বার্নার্ড এবং পিয়েরে ত্রিভিদিক পরিচালিত ফরাসি চলচ্চিত্রটি ২০০৮ সালে ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দশর্কের প্রশংসা কুড়ায়। ২০২০ সালে অ্যানি এরনোর আত্মজৈবিক রোমান্টিক উপন্যাস “সিম্পেল প্যাশন(ফরাসি নাম Passion simple)” অবলম্বনে ড্যানিয়েল আরবিড চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সেটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের জন্য মনোনীত হয়েছিল। অ্যানি এরনোর উপন্যাস ভিত্তিক সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো “হ্যাপেনিং((ফরাসি: L’événement)। ২০২১ সালের ব্যবসাসফল-দর্শকনন্দিত ফরাসি চলচ্চিত্র, একই শিরোনামে এরনো রচিত উপন্যাস অবলম্বনে অড্রে দিওয়ান এবং মার্সিয়া রোমানোর চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে অড্রে দিওয়ান চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এটি ৭৮তম ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার জিতে নেওয়াসহ চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়ায়। হ্যাপিনিং তাঁর তারুণ্যের আরেকটি গর্ভপাতের বিষয়ভিত্তিক কাহিনি। ওই একই বছর অ্যানি এরনোকে নিয়ে আরেকটি ডকুমেন্টারি “আই হ্যাভ লাভড লিভিং হিয়ার” নির্মিত হয়। ওই তথ্যচিত্রটি ছিল লেখালিখির জন্য তিনি ফ্রান্সের অন্য যে শহরটিকে পছন্দ করেছিলেন সেই বিষয়ের উপর নির্মিত। তবে অ্যানি সবসময় জানিয়ে এসেছেন তিনি ফিল্মে কাজ করতে মোটেও আগ্রহী নন।

তাঁর ভাষায় – “আমি লিখি অন্তর্নিহিত ছবি নিয়ে, স্মৃতির মধ্যে গেঁথে থাকা ছবি নিয়ে। লেখালিখির প্রক্রিয়া এবং ক্যামেরার ভাষা, এই দুটোর মধ্যে অনেক বেশি ফারাক।”

অ্যানির উপন্যাস নির্ভর “দ্য হ্যাপেনিং” চলচ্চিত্রটি খুব সময়োপযোগী বিবেচিত হয়েছিল। ওটা এমন এক সময়ে মুক্তি পেয়েছিল যখন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের ওপর নিজের দেওয়া রুলিং বাতিল করে গর্ভপাতকে আবারো অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

এরনো তেমন আশ্চর্য হননি কোর্টের নতুন সিদ্ধান্তটি শুনে। এ বিষয়ে তাঁর ভাষ্য- “যখন নারীরা ক্ষমতাবান হতে থাকে, অথবা তাদের কণ্ঠ উঁচু হতে থাকে, তখন রক্ষণশীলতার এই জোয়ার দেখা দেয়, পুরুষেরা তখন পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে নারীদের বিষয়ে।”

তবে তিনি হ্যাপেনিং সিনেমার প্রতিক্রিয়া দেখে খুব খুশি। কারণ ২০০০ সালে বইটি প্রকাশ হওয়ার সময় তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। নারীবাদ তখন এতটা উচ্চকিত ছিল না।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নোবেল জয়ের জন্য অ্যানি এরনোকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর কণ্ঠস্বরকে এই বলে অভিহিত করেন- “that of the freedom of women and of the forgotten”. ম্যাক্রোঁ’র মতো অনেকেই তাঁকে তেমনটা ভাবলেও অ্যানি নিজেকে নারীবাদের প্রতীক হিসেবে দেখতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে তাঁর সপাট মন্তব্য- “আমি সাধারণ এক নারী, যে শুধু লেখালিখি করে, ব্যস এটুকুই।”

এটা স্পষ্ট যে ফরাসি সাহিত্য জগতের একজন গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী লেখক অ্যানি এরনো নিজেকে এর প্রতীক হিসেবে নয় বরং একজন সমর্থক ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অ্যানি এরনো ‘মি-টু’ এবং অন্যন্য সাম্প্রতিক আন্দোলনের মধ্যে নারীবাদের জাগরণকে দেখতে পেয়ে আনন্দিত। নারী জাগরণের ইতিবাচক দিকটি নিয়ে তিনি আশাবাদী। একই সাথে মি-টু আন্দোলনের  বিপক্ষে বিষদগারে অগ্রণী ভূমিকা রাখা অভিনেত্রী ক্যাথরিন দ্যনোউভ(Catherine Deneuve) এর আচরণে তিনি যে যথেষ্ট লজ্জাবোধে আক্রান্ত, সেকথাও সপাটে গার্ডিয়ানের এক সাক্ষাৎকারে জানাতে দ্বিধা করেননি। সেই সাক্ষাৎকারে অ্যানি বলেন- “নারীদের সেই আন্দোলন নিয়ে ক্যাথরিনের বক্তব্য তার জন্য ছিল ভয়ানক লজ্জার। আদতে ক্যাথরিনের সেই বক্তব্য সমাজের বিশেষ সুবিধাভোগী একশ্রেণির নারীদের মনোজগতেরই প্রতিফলন। সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, তার বক্তব্যকে এককথায়  আমি  ন্যাক্কারজনক হিসেবে অভিহিত করবো। মি-টু আন্দোলনের সাথে আমি সম্পূর্ণভাবে সহমত পোষণ করি। নিশ্চিতভাবেই তাতে কিছু বাড়াবাড়ি ছিল, কিন্তু যে জরুরি বিষয়টা এতে সামনে এলো সেটি স্পষ্ট– নারীরা আগের মতো নিজেদের উপর ধেয়ে আসা নির্যাতন চুপচাপ মেনে নেবার বিপক্ষে। কোনো রকমের হুমকি বা প্রলোভনের কাছে তারা ঝুঁকতে রাজী নয়। ফরাসি সমাজে নারীকে প্রলোভনে চুপ করিয়ে রাখার যে সংস্কৃতির কথা আমরা শুনে থাকি সেটি কেবলমাত্র পুরুষতান্ত্রিক হেজিমনির বিষয় আর কিছু নয়। ক্ষমতার এমন অপব্যবহার শুধুমাত্র যৌনক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, তার থাবা সর্বত্র- সাহিত্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেটি স্পষ্ট।”

আজকের আত্মসচেতন নারীদের উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তব্য: “নারীরা আর তাদের সাথে যা খুশি ঘটতে দেবে না।”

তিনি নতুন প্রজন্মের নারীবাদীদের তার সত্যিকারের আনন্দের বহিঃ প্রকাশ দেখাতে চান।

এরনো বলেন- “যখন রাজনৈতিক দৃশ্যাবলী খুব সুখকর থাকে না, তখন যে জিনিসটা জীবনে আনন্দ দিতে পারে, বাধা সরিয়ে এগিয়ে নিতে পারে সেটা হলো নারীবাদ।”

নিজের লেখালিখি নিয়ে অ্যানি এরনোর সোজাসাপ্টা মতামত- লেখালিখি একটি রাজনৈতিক কাজ, যা সামাজিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে আমাদের চোখ খুলে দেয়। সে উদ্দেশ্যে তিনি “ছুরি” হিসাবে ভাষা ব্যবহার করেন, একই ভাবে কল্পনার আবরণ ছিঁড়ে ফেলতে তিনি সেই ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকেন।

সাহসী, অকপট একজন শব্দকারিগর অ্যানি এরনোকে ২০২২-এ সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তিতে  প্রাণঢালা অভিনন্দন ভালোবাসা।

 

ঋণ স্বীকার:

1.www.nobelprize.org

2. Annie Ernaux: ‘I’m just a woman who writes’ by Alexandra DEL PERAL,October 6, 2022

3.The Guardian: Books Interview- Autobiography and memoir by Kim Willsher, 6 Apr, 2019.

 

নাহার তৃণা

জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top