ট্রান্সট্রোমারের কবিতা: পর্ব-৫ (শেষ)

২৪ ঘণ্টার পালা

কাঠপিঁপড়েটা শূন্যদৃষ্টিতে চুপচাপ পাহারা দিচ্ছিল।
আর অন্ধকার পত্রালির ফোঁটা ফোঁটা শব্দ এবং গ্রীষ্মের
গিরিখাতের গভীরের রাত্রির মর্মর ছাড়া আর কিছুই
শোনা যাচ্ছিল না।

ফারগাছটা ঘড়ির খাঁজকাটা একটা কাঁটার মতো
দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাহাড়ের ছায়ায় পিঁপড়েটা জ্বলছিল।
পাখির আর্তস্বর! এবং অবশেষে। মেঘের শকট ধীরে ধীরে
গড়াতে শুরু করে।

………….
[May Swenson অনূদিত Twenty-Four Hours থেকে।]

 

শোকগাথা

প্রথম দরজাটা খুলি।
রৌদ্রালোকিত বিশাল একটি কক্ষ।
রাস্তা দিয়ে ভারি একটা  গাড়ি চলে গেল
আর চিনামাটির তৈজসগুলো কেঁপে উঠল।

দুই নম্বর দরজাটা খুলি।
বন্ধুরা! অন্ধকার গিলে তোমরা
দৃশ্যমান হয়েছ।

তিন নম্বর দরজা। ছোট একটা হোটেল কক্ষ।
পেছনের একটা গলি দেখা যাচ্ছে।
পিচের ওপর ল্যাম্পের ঝলকানি।
অভিজ্ঞতার অপরূপ কিছু লাভা।

………..
[Robin Fulton অনূদিত Elegy থেকে।]

 

স্মৃতিরা তাকিয়ে রয় আমার দিকে

জুনের একটি সকাল, উঠে পড়ার জন্যে অনেক ভোর,
আবার ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে অনেক বেলা।

আমি অবশ্যই বাইরে বেরোব─ গাছপালাগুলো সব
স্মৃতিমেদুর হয়ে আছে, স্মৃতিরা তাদের স্থিরদৃষ্টিতে
আমাকে অনুসরণ করে।

তাদেরকে দেখা যায় না, তারা পশ্চাৎপটের সঙ্গে সম্পূর্ণ
মিশে গেছে, খাঁটি ক্যামিলিয়ন।

তারা এত কাছে যে আমি তাদের নিঃশ্বাসটাও শুনতে পাচ্ছি
যদিও শ্রবণ-বধির-করা এই পাখির কাকলি।

………….
ক্যামিলিয়ন: chameleon; পশ্চাৎপটের সঙ্গে রঙ পালটে অদৃশ্য হয় যে গিরগিটি।

[Robin Fulton অনূদিত Memories Look at Me থেকে।]

 

শীতের মাঝামাঝি

আমার জামাকাপড় থেকে
একটা নীল আভা নিঃসৃত হচ্ছিল।
শীতের মাঝামাঝি।
বরফখঞ্জনির টুংটাং।
আমি চোখ বুজি।
কোথাও একটা নিঃশব্দ পৃথিবী রয়েছে,
একটা ফাটল রয়েছে,
যেখানে মৃতেরা সীমান্ত দিয়ে
চোরাচালান হয়ে যাচ্ছে।

………….
[Robin Fulton অনূদিত Midwinter থেকে।]

 

সূর্যসহ ল্যান্ডস্কেপ

সূর্যটা বাড়িটার পেছন থেকে উঠে এসে
রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আমাদের ওপর
তার নিঃশ্বাসের লাল হলকা ফেলতে লাগল।
ইন্সব্রুক, তোমাকে আমায় ছেড়ে যেতে হবে।
কিন্তু কাল
অর্ধমৃত ধূসর বনানীর ভেতর একটা গনগনে
সূর্য থাকবে, যেখানে আমাদের কাজকম্ম
করতে হবে, বসবাস করতে হবে।

………….
ইন্সব্রুক: Innsbrück; অস্ট্রিয়ার একটি শহর।

[Robin Fulton অনূদিত Landscape with Suns থেকে।]

 

মার্চ, ৭৯

যারা কথা নিয়ে আসে তাদের সবাইকে নিয়েই আমি ক্লান্ত,
কথা, কিন্তু কোনো ভাষা নেই।
তাই আমি তুষারাবৃত দ্বীপটাতে যাত্রা করি।
বন্যদের কথা নেই কোনো।
অলিখিত পৃষ্ঠাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে!
আমি তুষারের ওপর হরিণের পথে চলে এসেছি:
ভাষা, কিন্তু কোনো কথা নেই।

………..
শব্দ: words.

[Robin Robertson অনূদিত From March 1979 থেকে।]

 

মন্তব্যসহ একটি পোট্রেট

এটা হলো আমার চেনাজানা একটা লোকের পোট্রেট।
তিনি তাঁর খবরের কাগজটা খুলে টেবিলে বসে ছিলেন।
চশমার পেছনে তাঁর চোখদুটি থির হয়ে আছে।
তাঁর স্যুট পাইনবনের ঝিকিমিকি দিয়ে ধোয়া।

ম্লান, অর্ধসমাপ্ত একটা মুখ।─
যদিও তিনি সর্বদাই বিশ্বাসের প্রেরণা জুগিয়ে এসেছেন।
সেইজন্যেই লোকজন তাঁর কাছাকাছি আসতে চাইত না,
পাছে কোনও দুর্ভাগ্যের শিকার হতে হয়!

তাঁর বাবা শিশিরের মতো টাকা কামিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই বাড়িতে কেউই পুরোপুরি নিরাপদবোধ করতো না─
তাদের সবসময়ই মনে হতো যেন বহিরাগত চিন্তারা
রাতে ঘর ভেঙে ঢুকে পড়বে।

খবরের কাগজ─সেই বিশাল নোংরা প্রজাপতিটা,
চেয়ার, টেবিল, এবং ওই মুখাবয়বটা, স্থির হয়ে আছে।
জীবন বিশাল বিশাল সব স্ফটিকের ভেতরে থেমে গেছে।
তাহলে এটা আপাতত এরকমই থাকুক!

*
তাঁর ভেতরে যে আমিটা রয়েছে সেটা স্থির হয়ে আছে।
কিন্তু আছে। তিনি টের পাচ্ছেন না বলে সেটা বেঁচে
আছে, অস্তিমান আছে।

আমিটা কী? বহুকাল আগে মাঝে মাঝে আমি কয়েক মুহূর্তের
জন্যে আমার, আমার, আমার খুব কাছে চলে আসতাম।

কিন্তু ‘আমি’র দেখা পেতে না পেতেই আমি আমাকে হারিয়ে ফেলতাম─
সেখানে শুধুই একটা গহ্বর, যার ভেতরে আমি
অ্যালিসের মতো পড়ে গেছি!

………….
অ্যালিস: Alice in Wonderland-এর অ্যালিস, খরগোসের গর্তে পড়ে গিয়ে যার যাত্রা শুরু হয়।

[Robin Fulton অনূদিত Portrait With Commentary থেকে।]

 

অক্টোবরের স্কেচ

টাগবোটটা মর্চে ধরে তামাটে হয়ে গেছে। সমুদ্র থেকে
এত দূরে, এটা এখানে করছেটা কী?

এটা হলো ঠাণ্ডায় নিভে যাওয়া খুব ভারি একটা লণ্ঠন।
কিন্তু গাছগুলির রঙ খুব বুনো: তারা অন্যপারে সংকেত পাঠাচ্ছে!
যেন কেউ উদ্ধার পেতে চাইছে।

বাড়ি ফেরার পথে দেখি ঘাসের লন ফুঁড়ে বেরুচ্ছে হর্সটেল মাশরুম।
সেগুলো কোনো সাহায্যপ্রার্থীর আঙুল, যে কিনা ওই ভূতলের
অন্ধকারে বহুকাল ধরে একা একা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আমরা পৃথিবীর।

……………
টাগবোট: tugboat; যে জাহাজের সাহায্যে অন্য ভারি জাহাজকে ঘাটে ভেড়ানো হয়। হর্সটেল মাশরুম: horsetail mushrooms; একধরনের মাশরুম। এটি ছয় ইঞ্চি লম্বা হয়।

[Robert Bly অনূদিত Sketch in October থেকে।]

 

রোমান খিলান

বিশাল রোমান চার্চের ভেতরকার আধো-অন্ধকারে
ট্যুরিস্টের গাদাগাদি।
খিলানের পর খিলানের হাঁ-মুখ এবং সম্পূর্ণ কোনো দৃশ্য নেই ।
কয়েকটি মোমশিখা দপদপ করছিল।
অবয়বহীন এক দেবদূত আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার
সারা শরীরের ভেতর দিয়ে ফিসফিস করে বলে:
“মানুষ হয়েছ বলে লজ্জিত হয়ো না, গর্বিত হও!
তোমার ভেতরে অন্তহীন খিলানের পর খিলান খুলে যায়।
তুমি কখনই সম্পূর্ণ হবে না এবং সেরকমটাই হবার কথা।”
অশ্রুরুদ্ধ আমি
মিস্টার অ্যান্ড মিসেস জোনস, হার তানাকা আর
সিনোরা সাবাতিনির সঙ্গে রৌদ্রপ্লাবিত চত্বরটাতে
প্রবল ঠেলাঠেলির ভেতর দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলাম,
এবং তাদের সবার ভেতরেই অন্তহীন খিলানের পর খিলান
খুলে যাচ্ছিল।

………….
খিলান: arch, vault.

[Robin Fulton অনূদিত Romanesque Arches থেকে।]

 

ফানশাল

সৈকতের খুব সাধারণ একটি মাছের রেস্তোরাঁ, জাহাজডুবির পর বেঁচে যাওয়া লোকেদের
দাঁড় করানো একটি ছাউনি। অনেকেই দরজার দিকে ফিরে তাকালো, তবে সমুদ্রের দমকা
হাওয়ার দিকে নয়। একটা ছায়া তার ধোঁয়াটে কুঠরির ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আটলান্টিসের
পুরোনো রেসিপিতে একসঙ্গে দুটো মাছ ফ্রাই করছিল, রসুনের মৃদু মৃদু বিস্ফোরণ, টমেটো
স্লাইসের ওপর ভাসমান তেল। আহারের প্রতিটি গ্রাস বলছিল সমুদ্র আমাদের মঙ্গলই চায়,
সমুদ্রের গহন থেকে উঠে আসা একটা গুঞ্জন।

সে এবং আমি পরস্পরের দিকে তাকাই। কোনোরকম ক্লান্তির অনুভূতি ছাড়াই বনফুলে
ছাওয়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে ওঠার মতো। আমরা প্রাণীপক্ষে, আমরা স্বাগত, আমাদের
বয়স হচ্ছে না। কিন্তু যৌথভাবে আমাদের বহু অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার মধ্যে সেইসব মুহূর্ত-
গুলোও রয়েছে যেখানে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ নই (যেমন, যখন আমরা জাঁকালো দানবটাকে
রক্ত যোগান দেবার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়েছি─ যিনি আমাদেরকে রক্ত-সঞ্চালনের নির্দেশ
দিয়েছেন), আর সেই সমস্ত ঘটনা যেগুলো আমাদেরকে আলাদা করে দিতে পারত যদি না
তারা আমাদেরকে আবার একত্র করে দিত, এবং সেই সমস্ত ঘটনা যা আমরা দুজনেই ভুলে
গেছি─ কিন্তু সেগুলো আমাদেরকে ভোলে নাই! সেগুলো পাথর হয়ে গেছে, উজ্জ্বল এবং
অনুজ্জ্বল সব পাথর। বিক্ষিপ্ত একটা মোজাইকের ভেতরকার সব পাথর। এবং এখন সেটা
ঘটছে: টুকরোগুলো উড়ছে একসাথে, মোজাইকটা দৃশ্যমান হচ্ছে। সেটা আমাদের জন্যে
অপেক্ষা করছে। আমাদের হোটেলরুমের দেয়াল থেকে সেটা ভাস্বর হয়ে উঠছে, একইসঙ্গে
হিংস্র এবং কোমল একটা ডিজাইন, হয়তো একটা মুখাবয়ব, আমাদের অবশ্য এইসমস্ত
খেয়াল করার মতো সময় নেই যখন আমরা আমাদের কাপড়চোপড় ছাড়ছি…

গোধূলির সময় আমরা বাইরে বেরোই। অন্তরীপের অতিকায় গাঢ় নীল থাবা সমুদ্রের মধ্যে
এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা মানুষের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে চলে যাই। নম্রভাবে
ঠেলাঠেলি করি, মৃদুভাবে নিয়ন্ত্রণ করি, প্রত্যেকেই উদগ্রীবভাবে বিদেশী ভাষায় বকবক
করতে থাকে। “কোনো মানুষই একটা দ্বীপ নয়।” আমরা তাদের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে
উঠি, নিজেদের মাধ্যমেও। নিজেদের ভেতরকার সেই জিনিসটার মাধ্যমে, যেটা অন্যেরা
দেখতে পায় না। যেটা শুধু নিজের দেখাই পেতে পারে, অন্তরতম একটা স্ববিরোধ, গ্যারেজের
ফুল, মাঙ্গলিক অন্ধকারের দিকে একটা বাতায়ন। খালি গেলাসে বুদবুদ-করা একটা পানীয়।
নৈঃশব্দ্য সম্প্রচার করা একটা লাউডস্পিকার। প্রত্যেকটি পদক্ষেপের পেছনে পুনরায় বেড়ে
ওঠা একটা রাস্তা। একটা গ্রন্থ যা শুধু অন্ধকারেই পড়া যায়।

……………..
ফানশাল: Funchal; পর্তুগালের ম্যাডেরা দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী। আটলান্টিক সমুদ্রের সীমান্তবর্তী বৃহত্তম শহর।
অন্তরীপ: cape; যে ভূখণ্ড ক্রমশ সরু হতে হতে সাগরে এসে মিশেছে।

[Patty Crane অনূদিত Funchal থেকে।]

 

নান্নু মাহবুব

জন্ম: ১১ জুন, ১৯৬৪, যশোর। লেখালেখির শুরু ৮০’র দশকে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ: রাত্রিকালীন ডাকঘর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫)
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ: পুনরুত্থিত শহর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫)
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ: আজ কী ফুল ফুটিয়েছো, অরণ্য? (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)

প্রতিভাস, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির
সাক্ষাৎকারভিত্তিক ৪টি অনূদিত গ্রন্থ:মাইন্ড ইজ আ মিথ, নো ওয়ে আউট, থট ইজ
ইয়োর এনিমি, ও মিস্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট।16:25:26
Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top