ট্রান্সট্রোমারের কবিতা: পর্ব-৪

 

সকালবেলার পাখি

গাড়িটাকে জাগিয়ে তুললাম
যার উইন্ডশিল্ডটা ঢেকে ছিল পরাগরেণুতে।
সানগ্লাসটা চোখে দিলাম।
পাখির কূজন অন্ধকার হয়ে এল।

যখন আরেকটা লোক রেলস্টেশনে
একটা বিশাল মালগাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে একটা
খবরের কাগজ কিনছিল, যে মালগাড়িটা
মর্চে ধরে পুরোদস্তুর লাল হয়ে গিয়েছিল
আর রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ঝিকমিক করছিল।

এখানে কোথাও কোনো শূন্যস্থান নেই।

বসন্তের উষ্ণতার ভেতর একটা শীতল করিডোর,
সেখান দিয়ে কেউ একজন ছুটে আসছিল
আর বলছিল কীভাবে হেড অফিস অব্দি
তার নামে কুৎসা রটানো হয়েছে।

ল্যান্ডস্কেপের পেছনের একটা দরজা দিয়ে
সাদা-কালো ম্যাগপাইটা এল, হেলের পাখি।
আর ব্ল্যাকবার্ডটা এদিক-ওদিক ছুটোছুটি
করতে লাগল যতক্ষণ পর্যন্ত না সবকিছু
চারকোলে আঁকা একটা স্কেচ হয়ে যায়। শুধু
দড়িতে টাঙানো সাদা কাপড়গুলো বাদে:
একটা প্যালেস্ত্রিনা গায়কদল।

এখানে কোথাও কোনো শূন্যস্থান নেই।

অদ্ভুত এই অনুভূতি যে কিভাবে আমার কবিতাটা
বেড়ে উঠছে আর আমি সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছি।
সেটা বেড়ে উঠছে,
সেটা আমার জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে।
সেটা আমাকে ঠেলে পাশে সরিয়ে দিচ্ছে।
সেটা আমাকে নীড়ের বাইরে ছুঁড়ে ফ্যালে।
কবিতাটা তৈরি।

…………
হেলের পাখি: (SWE: Hels fågel); নর্স পুরাণে হেল হলো মৃত্যু ও নরকের দেবী।
ম্যাগপাই তার প্রতীক, যা মৃত্যু ও রহস্যের বার্তাবাহক।
প্যালেস্ত্রিনা গায়কদল: Palestrina choir; ইটালিয়ান কম্পোজার জিওভানি
ডি প্যালেস্ত্রিনার কম্পোজিশন।

[Robin Fulton অনূদিত Morning Birds থেকে।]

 

জুলাই, ১৯৯০

সেটা ছিল একটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
আর আমি টের পেলাম মৃত লোকটা
আমার চেয়েও ভালোভাবে
আমার চিন্তাগুলি পড়ে যাচ্ছে।

অর্গানটা চুপচাপ ছিল, পাখিরা গান গাইছিল।
বাইরে রোদ্দুরে খোড়া কবর।
আমার বন্ধুর কণ্ঠস্বরটা ছিল
সময়ের অন্যপারে।

গ্রীষ্মদিনের উজ্জ্বলতায় দৃশ্যমান,
বৃষ্টি এবং নিস্তব্ধতায় দৃশ্যমান,
চাঁদের আলোয় দৃশ্যমান আমি,
গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরি।

………….
[Robin Fulton অনূদিত From July 1990 থেকে।]

 

ভারমিয়ার

নিরাপদ কোনো জগৎ নেই… দেয়ালের ঠিক ওপাশেই শুরু হলো
হট্টগোল, শুরু হলো পানশালা, হাসাহাসি আর ঝগড়াঝাঁটি,
সারি সারি দাঁত, চোখের জল, ঘণ্টাধ্বনির গর্জন,
আর সেই উন্মাদ শ্যালক, সেই মৃত্যুদূত, যার সামনে সকলেই
কেঁপে ওঠে।

সেই একটা বিশাল বিস্ফোরণ এবং উদ্ধারের বিলম্বিত পদধ্বনি,
নদীর মোহনায় নৌকাগুলো পেখম মেলছিল, টাকাপয়সা ঢুকে যাচ্ছিল
ভুল লোকেদের পকেটে,
দাবির ওপর জমে উঠছিল দাবি।
হা-মুখের লাল লাল ফুলের বৃতিগুলো আসন্ন যুদ্ধের আভাসে ঘামছিল।

সেখান থেকে দেয়াল ভেদ করে সোজা ঢুকে পড়ো এই উজ্জ্বল স্টুডিওতে,
ঢুকে পড়ো সেই ক্ষণে, যেই ক্ষণটা শতাব্দির পর শতাব্দি বেঁচে থাকবে।
ছবিগুলো নিজেদের “দি মিউজিক লেসন” বা “আ ওমেন ইন ব্লু রিডিং
আ লেটার” বলে ডাকে─সেখানে নারীটি ছিল আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা,
দুটি হৃদয় তার ভেতরে ধুকধুক করছিল।
পেছনের দেয়ালে ঝুলছিল অচেনা পৃথিবীর কুঞ্চিত একটা মানচিত্র।

শান্ত একটা শ্বাস নাও… অজানা একটা নীল বস্তু চেয়ারগুলোর সাথে
পেরেক দিয়ে আটকানো। সোনালি রিভেটগুলো প্রচণ্ড বেগে উড়ে এসে
হঠাৎ স্থির হয়ে গেল যেন তারা স্থিরতা ছাড়া আর কখনোই কিছু ছিল না।

কানে একটা গুঞ্জন, গভীরতার বা উচ্চতার।
সেটা হলো দেয়ালের ওপার থেকে আসা একটা চাপ।
যেটা সমস্ত সত্যকে ভাসিয়ে রেখে
তুলিটাকে দৃঢ় করে তুলছিল।

দেয়াল ভেদ করতে কষ্ট হয়,
সেটা তোমাকে অসুস্থ করে তোলে, কিন্তু সেটাই জরুরি।
জগৎ একটাই। কিন্তু দেয়ালগুলো…
এবং দেয়ালগুলো তোমারই একটা অংশ─
কেউ সেটা জানুক আর না-ই জানুক, সবার জন্যেই এটা এরকমই,
শুধু ছোট শিশুরা বাদে। তাদের জন্যে কোনো দেয়াল নেই।

উজ্জ্বল আকাশটা দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে।
এ যেন শূন্যের প্রতি একটি প্রার্থনা।
এবং শূন্য আমাদের দিকে তার মুখটি ফিরিয়ে
ফিসফিস করে বলে:
“আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত।”

…………….
ভারমিয়ার: Johannes Vermeer (1632–1675); বিখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পী। (ট্রান্সট্রোমার তাঁর
এই কবিতাটিকে জীবন ও শিল্পের আন্তঃসম্পর্কের একটি বিবরণী বলে উল্লেখ করেছেন।)
দি মিউজিক লেসন; আ ওমেন ইন ব্লু রিডিং আ লেটার: ভারমিয়ারের বিখ্যাত দুটি ছবি।
সোনালি রিভেট: যে পেরেক দিয়ে ছবি (পেইন্টিং বা ক্যানভাস) ফ্রেমের সঙ্গে আটকানো থাকে।

[Robin Fulton অনূদিত Vermeer থেকে।]

 

বেলা তিনটের ইজমির

প্রায় ফাঁকা রাস্তাটার ঠিক সামনেই দুটো ভিক্ষুক,
একজনের পা নেই─
অন্যজন তাকে পিঠে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

তারা দাঁড়িয়ে ছিল─যেমন কোনো জন্তু মধ্যরাত্রির
রাস্তায় গাড়ির হেডলাইটে থমকে দাঁড়ায়─
পরমুহূর্তেই আবার হাঁটতে শুরু করে।

এবং তারা স্কুলচত্বরের ছেলেদের মতো রাস্তাজুড়ে
ছোটাছুটি করছিল যখন মধ্যাহ্ন নিদাঘের অগণিত ঘড়ি
মহাশূন্যে টিকটিক করছিল।

‘নীল’ বন্দরের জলের ওপর দিয়ে ঝিকমিক করতে করতে
পিছলে যাচ্ছিল, ‘কালো’ হামা দিতে দিতে কুঁচকে যাচ্ছিল
আর পাথরের ভেতর থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
‘সাদা’ চোখের ভেতর একটা ঝড়ে ফেটে পড়ছিল।

বেলা তিনটে যখন অশ্বক্ষুরের নিচে পিষ্ট হচ্ছিল
আর আলোর দেয়ালের ভেতর চূর্ণ হচ্ছিল অন্ধকার,
শহরটা তখন সাগরদুয়ারে হামাগুড়ি দিচ্ছিল

আর শকুনের দূরবীনচোখের ভেতর জ্বলজ্বল করছিল।

……….
ইজমির: Izmir; তুরস্কের এজিয়ান উপকূলের একটি শহর।

[Robin Fulton অনূদিত Izmir at Three O’Clock থেকে।]

 

প্রাসাদে

আমরা ভেতরে ঢুকলাম। অতিকায় একটা
হলঘর, শুনসান এবং ফাঁকা, যেখানে মেঝেটা
একটা পরিত্যক্ত স্কেটিং রিঙ্কের মতো পড়ে ছিল।
সবগুলি দরজা বন্ধ। বাতাসটা ধূসর।

দেয়ালে দেয়ালে পেইন্টিং। চোখে পড়ছিল
অন্য প্রান্তের মূকবধির একটা জগতে নিষ্প্রাণভাবে
গিজগিজ করা ইমেজগুলো: ঢাল, তুলাদণ্ড, মাছ,
যুদ্ধরত মানবমূর্তি।

শূন্যতার ভেতরে একটা ভাস্কর্য প্রদর্শিত হচ্ছিল:
হলের মধ্যিখানে একাকী দাঁড়িয়ে ছিল একটি ঘোড়া,
কিন্তু প্রথমে আমরা তাকে খেয়ালই করি নাই কারণ
তখন আমরা শূন্যতায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম।

একটা শঙ্খের ফিসফিসানির চেয়েও ক্ষীণ, শহর
থেকে আসা স্বর আর শব্দগুলো─ এই নির্জন প্রাসাদের
ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল, মৃদু গুঞ্জন তুলে কোনো শক্তি
অন্বেষণ করছিল।

আরো কিছু ছিল। আমাদের ইন্দ্রিয়ের পাঁচটি
চৌকাঠের ওপর পার-না-হয়ে-দাঁড়িয়ে-থাকা
অন্ধকার কিছু। প্রতিটি নিঃশব্দ বালুঘড়ির ভেতর
বালু খসে পড়ছিল।

এবার এগোনোর পালা। আমরা ঘোড়াটার
দিকে এগিয়ে গেলাম। সেটা ছিল বিশাল, ইস্পাতের
মতো কালো। স্বয়ং শক্তির একটা প্রতীক, যেটা
রাজন্যবর্গের বিদায়ের পরও রয়ে গেছে।

ঘোড়াটা বলছিল: ‘আমিই একমাত্র। যে শূন্যতা
আমার সওয়ার হতো আমি তাকে ছুঁড়ে ফেলে
দিয়েছি। এটাই আমার আস্তাবল। আমি ধীরে
ধীরে বেড়ে উঠছি। এবং আমি এখানকার
নৈঃশব্দ্যটা আহার করি।’

…………..
স্কেটিং রিঙ্ক: skating rink; স্কেটিং-এর জন্যে বিশেষভাবে নির্মিত বরফের পাত বা মেঝে।

[Robin Fulton অনূদিত The Palace থেকে।]

 

শীতের সূত্রাবলী


আমি আমার শয্যায় ঘুমিয়ে পড়লাম
আর জাহাজের তলির নিচে জেগে উঠলাম।

ভোর চারটায় যখন অস্তিত্বের ঘষামাজা অস্থিগুলো
পরস্পরের সঙ্গে শীতলভাবে মিশে ছিল।

আমি আবাবিল পাখিদের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম
আর ঈগলদের মধ্যে জেগে উঠলাম।


ল্যাম্পলাইটে রাস্তার বরফ
চর্বির মতো জ্বলজ্বল করছিল।

এটা আফ্রিকা নয়।
এটা ইউরোপ নয়।
এটা ‘এখানে’ ছাড়া আর কোথাও নয়।

এবং ওই ‘আমি’টা হলো
ডিসেম্বর-আঁধারের মুখের ভেতরে
শুধুই একটা শব্দ মাত্র।


অন্ধকারে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানের
প্যাভিলিয়নগুলো টিভি স্ক্রিনের
মতো জ্বলজ্বল করছিল।

বিপুল হিমের ভেতরে
লুকোনো একটা টিউনিং ফর্ক
তার সুর ছড়িয়ে যাচ্ছিল।

আমি নক্ষত্রময় আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছি
আর টের পাচ্ছি জগৎটা আমার কোটের ভেতরে
হামা দিয়ে ঢুকছে আর বেরিয়ে আসছে,
যেমনটি একটা উইঢিপিতে হয়ে থাকে।


তুষারের মধ্যে থেকে তিনটি
কালো ওক গাছ বেরিয়ে আছে।
রুক্ষ, কিন্তু খুবই তৎপরহস্ত।
তাদের বিশাল বোতলগুলি থেকে
বসন্তে শ্যামলিমা ফেনিল হয়ে উঠবে।


শীতের সন্ধ্যার ভেতর বাসটি হামাগুড়ি দিচ্ছিল।
শালবনের ভেতরে সেটা একটা জাহাজের মতো জ্বলছিল
যেখানে রাস্তাটা ছিলো সরু, গভীর, মৃত একটা খাল।

অল্প কিছু যাত্রী: কিছু বৃদ্ধ আর কিছু কিশোর।
যদি এটা থেমে যায় আর বাতিগুলি নিভিয়ে দেয়,
জগৎটা মুছে যাবে।

…………….
জাহাজের তলি: keel.
টিউনিং ফর্ক: tuning-fork; সুরশলাকা।

[Robin Fulton অনূদিত Winter’s Formulae থেকে।]

 

জুলাইয়ের অবকাশ

উঁচু উঁচু গাছগুলোর নিচে চিৎ হয়ে শুয়ে-থাকা লোকটা
গাছগুলোর উপরেও ছিল। স্লো মোশনে উৎক্ষিপ্ত হতে-থাকা একটা
ক্যাটাপুল্ট চেয়ারে শুয়ে শুয়ে সামনে পেছনে দুলতে দুলতে সে
খুব ধীরে ধীরে হাজার হাজার শাখা-প্রশাখার ভেতর ছড়িয়ে যাচ্ছিল।

জেটির ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা চোখ কুচকে জলের দিকে
তাকিয়ে ছিল।
জেটিগুলো মানুষের চেয়েও দ্রুত বুড়ো হচ্ছিল।
তাদের কড়িকাঠগুলো ছিল রূপালি-ধূসর আর তাদের উদরে পাথর।
চোখ-ধাঁধানো আলো এসে তাদের গভীরে আঘাত করছিল।

সারাদিন একটা খোলা নৌকায় ঝলমলে খাঁড়ির ওপর ঘুরে
বেড়িয়েছে যে লোকটা শেষমেশ সে একটা নীল লণ্ঠনের ভেতর
ঘুমিয়ে পড়বে, যখন দ্বীপগুলো কাচের ওপর বিশাল
মথের মতো হামাগুড়ি দেবে।

…………..
ক্যাটাপুল্ট চেয়ার: catapult chair; জরুরি মুক্তির ধাক্কায় ছুড়ে দেওয়া আসন (যুদ্ধবিমানে ব্যবহৃত)।
জেটি: jetty; জাহাজঘাটা।

[Robin Fulton অনূদিত Breathing Space July থেকে।]

 

ছাদের উপরকার গান শুনে জেগে-ওঠা লোকটা

ভোর, মে মাসের বৃষ্টি। শহরটা এখনও একটা পাহাড়ি
গ্রীষ্মকুঞ্জের মতো শুনসান হয়ে আছে। রাস্তাগুলোও সব শুনসান।
আর আকাশে একটা বিমানইঞ্জিনের নীলচে-সবুজ গর্জন─
জানালাটা খোলা।

ঘুমন্ত লোকটা যে স্বপ্নটির ভেতর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে ছিল
সেই স্বপ্নটা স্বচ্ছ হয়ে গেল। সে নড়েচড়ে উঠে তার
মনোযোগের সরঞ্জাম হাতড়াতে শুরু করল─
মহাশূন্যের ভেতরেই প্রায়।

………….
[Robin Fulton অনূদিত The Man Who Awoke with Singing over the Roofs Morning থেকে।]

 

শরৎরাত্রির উপন্যাসের সূচনা

ফেরি-নৌকাটা থেকে তেল-তেল একটা গন্ধ আসছিল আর ঘোরের মতো কিছু একটা
সারাক্ষণ ঝনঝন শব্দ করে যাচ্ছিল। সার্চলাইটটা জ্বলে উঠল। আমরা ঘাটের দিকে
এগুচ্ছিলাম। শুধু আমাকেই এখানে নামতে হবে। “তোমার কি সাঁকো লাগবে?” না।
দীর্ঘ টলোমলো একটা পা ফেলে আমি সোজা রাত্রির ভেতর ঢুকে পড়ি, আর ঘাটের
ওপরে, দ্বীপটার ওপরে গিয়ে দাঁড়াই। দুইহাতে দুটো বিকৃত ডানার মতো ঝুলন্ত
প্লাস্টিকব্যাগ নিয়ে, এইমাত্র পিউপার খোলস থেকে হামা দিয়ে বেরিয়ে আসা একটা
প্রজাপতির মতো আমার নিজেকে ভিজে ভিজে আর উদ্ভট লাগছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি
নৌকাটা তার উজ্জ্বল জানালাগুলি নিয়ে দূরে ভেসে যাচ্ছে, আর তারপর আমি হাতড়ে
হাতড়ে সেই বাড়িটাতে এসে পৌঁছাই যেটা দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে। আশপাশের
সব বাড়িগুলিও জনমানবহীন…। এখানে ভালো ঘুমোনো যেতে পারে। আমি চিৎ হয়ে
শুয়ে থাকি এবং আমি জানি না আমি ঘুমোচ্ছি না জেগে আছি। আমার পড়া কিছু বই
নিশ্চিহ্ন হয়ে অদৃশ্য হবার জন্যে পুরোনো পালতোলা জাহাজের মতো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের
দিকে ভেসে যাচ্ছে… একটা ফাঁপা শব্দ শোনা যাচ্ছে, উদাসীন একটা ঢাকের শব্দ। একটা
জিনিস যেটাকে বাতাস বারবার এমন কিছুর ওপর আছড়ে দিচ্ছে, যেটাকে পৃথিবী স্থির
করে ধরে রেখেছে। রাত্রি যদি শুধুই আলোর অনুপস্থিতি না হয়ে থাকে, রাত্রি যদি সত্যিই
কিছু একটা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা হলো এই শব্দ। মন্থর একটা হৃৎপিণ্ড থেকে আসা
স্টেথিস্কোপের শব্দ, সেটা ধুকপুক করছে, নিস্পন্দ হয়ে যাচ্ছে, আবার ধুকপুক করছে।
প্রাণীটা যেন আঁকাবাঁকা একটা পথে সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছে। বা কেউ একটা দেয়ালে ধাক্কা
দিচ্ছে, যে কিনা অন্য জগতের লোক কিন্তু এখানেই রয়ে গেছে, ধাক্কা দিচ্ছে, ফিরে আসতে
চাইছে। কিন্তু বহু দেরি হয়ে গেছে! সে সেখানে নামতে পারে নাই, সে সেখানে উঠতে পারে
নাই, সে জাহাজটাতে উঠতে পারে নাই…। অন্য জগতটাও আসলে এই জগতটাই। পরদিন
সকালে দেখি হিসহিস করা সোনালি-বাদামি পাতার একটা ঝাড়। উন্মূল বৃক্ষের হামাগুড়ি।
মুখওয়ালা সব পাথর। অরণ্যটা পিছে ফেলে আসা সব দানবে পরিপূর্ণ যা আমি ভালবাসি।

……………

পিউপা: pupae; মূককীট; প্রজাপতি হবার পূর্ববর্তী দশা।
উন্মূূল জট: (SWE: rotvälta); rotvälta বলতে বোঝায় উপড়ে পড়া
গাছের শিকড় ও মাটির জটলা।
বিস্মৃত: (SWE: akterseglade); মূলত নৌচলাচলের পরিভাষা;
এর অর্থ হলো পিছনে পড়ে যাওয়া বা নৌকা থেকে বাদ পড়া। এখানে রূপকভাবে
ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ যারা পেছনে পড়ে গেছে বা বিস্মৃত।

[Robin Fulton অনূদিত How the Late Autumn Night Novel Begin থেকে।]

 

নান্নু মাহবুব

জন্ম: ১১ জুন, ১৯৬৪, যশোর। লেখালেখির শুরু ৮০’র দশকে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ: রাত্রিকালীন ডাকঘর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫)
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ: পুনরুত্থিত শহর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫)
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ: আজ কী ফুল ফুটিয়েছো, অরণ্য? (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)

প্রতিভাস, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির
সাক্ষাৎকারভিত্তিক ৪টি অনূদিত গ্রন্থ:মাইন্ড ইজ আ মিথ, নো ওয়ে আউট, থট ইজ
ইয়োর এনিমি, ও মিস্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট।
Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top